#প্রেমাঙ্গন
লেখিকা:#শ্যামলী_রহমান
অন্তিম পর্ব
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কেটে যাচ্ছে জীবনযাত্রা। শরত,হেমন্ত, শীত পেরিয়ে আগমন ঘটেছে বসন্তের।বাতাসে বইছে বসন্তের হাওয়া। চারদিকে ফুলের গন্ধে ম ম করছে।শিমুল পলাশের রঙে রাঙিয়েছে প্রেমময় হৃদয়।কৃষ্ণচূড়ার দেখা মিলেছে সবেই।ফাগুনের আগুন লেগে আগমন হয়েছে বসন্তের। ফুল যেমন রঙিন করেছে শহর,গাছের পাতার পতন ঘটিয়ে,দিয়েছে তাকে দহন।
এমনই একদিনে শহর ঘুরতে বেরিয়ে দুজন, সুজন।সাথে রয়েছে তাদের সঙ্গীনি।
আরশিয়া আর রিহান এসেছিলো উদ্যানে। সময়টা বিকেল হওয়াতে মানুষের আনাগোনা একটু বেশিই।
শহরের এই আনাগোনা ভালো আজ যেন ভালো লাগলো না। আরশিয়া কে নিয়ে সে কোনো নির্জন প্রহরে যেতে চায়।তাই তো চট করে উঠে পড়লো। আরশিয়া উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করে বসলো,“কই যাও?
“চল হারিয়ে যাই কোনো নির্জন প্রহরে,
যেখানে থাকবে তুমি আমি আর আমাদের সুপ্ত অনুভূতি।
আরশিয়া হাত বাড়ালো।রিহানের হাতে হাত রেখে উঠে পড়লো। কোলাহল ফেলে দুজনে চললো দূর অজানায়।
প্রায় ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর দুজনে পৌঁছালো এক নির্জন গ্রামে। নির্জন কারণ এখানে মানুষের বসবাস থাকলেও শহরের কোলাহল নেই,গাড়ির হর্ন নেই, নেই বিষাক্ত বায়ু।আরশিয়া নেমেই দাঁড়ালো গ্রামের কোল ঘেঁষে নদীর কূলে।দু হাত মেলে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে শুদ্ধ বাতাস।খোলা চুল উড়ছে,শীতল বাতাসে মন ও দুলছে,হদয়ে লাগছে শীতল হাওয়া। উষ্ণতা দিতে কেউ একজন জড়িয়ে নিলো মেলে ধরা সেই দুহাত। আরশিয়া চোখ খুললো। একবার এই শুদ্ধ বাতাসের মতো নিজস্ব শুদ্ধ পুরুষের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মুক্তঝরা সে হাসি দেখে মুগ্ধ হলো প্রমিক হৃদয়।
অর্থি পার্কে হাঁটছে আর তার পিছু দৌঁড়াচ্ছে রনিত।মূলত আজ তাদের মধ্যে ঝগড়স হয়েছে। গত দুদিন ধরে অর্থি রাগ করে কথা বলেনি।আজ ওর মা’কে বলে ঘরতে এনেছে রাগ ভাঙাবে বলে।কিন্তু হিতে বিপরীত হলো।অর্থির রাগ ভাঙার বদলে আরো রেগে গেঋে।কারণ একটাই রনিত আসার সময় একটা মেয়ের সাথে ধ্বাক্কা খেয়েছে,তা দেখে অর্থি রেগে আছে। রনিত কতক্ষণ ধরে বুঝাচ্ছে কিন্তু সে শুনছে না।শেষে রনিত থেমে গেলো।হাঁপিয়ে পড়েছে সে। পার্কের বেঞ্চে বসে জিরিয়ে নিলো।পানির বোতল হতে পানি খাচ্ছিলো।
“ ভাইয়া পার্কের এই লোকেশনটা কোথায় বলতে পারেন?”
অপরিচিত মেয়ে কন্ঠ শুনে রনিত তাকালো।একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের স্কিন তার দিকে করে আছে। রনিত দেখার জন্য মেয়েটার দিকে একটু হেলে গেলো। ছবিটার দেখার পর সামনে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। আঙ্গুল বরাবর সে তাকিয়ে দেখে অর্থি অগ্নিশর্মা চোখে তাকিয়ে আছে। রনিত টপ করে হাত নামিয়ে নিলো।মেয়েটি ধন্যবাদ জানালো পরিবর্তে সে হাসলো।এই হাসিও যেন তার কাল হলো।মেয়েটি চলে যেতেই অর্থি রেগেমেগে সামনে আসলো,বলল,
“শেষ হয়েছে?
“কি শেষ হবে?”
“মেয়েদের সাথে কথা বলাবলি?
“কি আশ্চর্য কথা তো আমি বলিনি,তিনি লোকেশন জানতে চাইলো তাই….
রনিত কে পুরো কথা বলতে না দিয়ে অর্থি আবার গটগটিয়ে ছুটলো।
রনিত হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিলো, বলল,
“বিবাহ না করিতেই জীবনখানা করিতেছে তেজপাতা,এখন আমারো পুরো বিয়ে না করেই বলতে ইচ্ছে করছে বিয়ে করা মানেই জ্যান্ত মানুষ মরা।
না জানি কয়দিন পর বিয়ে করলে কি অবস্থা হয়।এখন তো আধ পাগল তখন না হয় পুরো পাগল হবো।
অর্থি কিছুদূর গিয়ে থেমে গেলো। পিছনে তাকিয়ে বলল,“ বসে আছেন কেন?আসুন।
রনিত উঠলো, নিরস কন্ঠে বলল,“কেন তোমার পিছনে দৌঁড়াতে?”
অর্থি হাসলো,হাসি চেপে রাগের ভান করে বলল,
“শুধু এখন নয়,সারাজীবন আমার পিছনে দৌঁড়াবেন,সঠিক সময় এলে পাশে এসে হাতে হাত রেখে হাঁটবেন।
বলেই অর্থি ঘুরলো। রনিত হেসে উঠলো।মুহূর্তে দৌঁড়ে গিয়ে অর্থির পাশাপাশি হলো।
কিছুটা ঝুঁকে বলল, হাফিয়ে যাওয়া অভিনয় মাত্র,তোমায় ভালোবাসতে যেমন হাঁফিয়ে যাবো না,তেমনই পাশাপাশি কিংবা পিছনে ঘুরতেও বিরক্তবোধ করবো না।
অর্থি এবার রাগের খোলস ছাড়লো।হেসে পায়ে পা মিলিয়ে দুজনে হেঁটে চললো।
গ্রামটি হলো রাজশাহী শহর হতে অনেকটা দূরে। সেখানে নেই কারেন্ট, নেই আধুনিকতার ছোঁয়া। নদীর কূলে বসতী গড়েছে কিছু মানুষ। নদী পেরিয়ে যেতে হয় সে গ্রামে। তারাও এসেছে উপভোগ করেছে সে অনুভূতি। হঠাৎ ছুটে আসলো কিছু ছোট বাচ্চা। আরশিয়া তাদের নিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। রিহান দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে, বাচ্চাদের সাথে আরশিয়াও খিলখিলিয়ে হাসছে।সেই হাসিতে মুগ্ধ হচ্ছে সে।
খেলা শেষে পুরো গ্রাম ঘুরলো তারা। সূর্য ডুববে এখনই।পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিহান আরশিয়া কে তাড়া দিলো,“চলো সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটু পর এখানে অঁধারে ছেয়ে যাবে। আরশিয়া নদীর পাড় হতে ছুটে আসলো,বলল,“ইসস যদি এখানে থাকতে পারতাম। তবে কত….
“নির্জন নিশিথে তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম,গ্রামের খোলা পরিবেশে,মাতাল করা হওয়ায় ছুটে যেতাম।
আরশিয়া কে বলতে না দিয়ে রিহান বললো। আরশিয়া চুপ করে শুনলো। নৌকায় উঠতে গিয়ে আরশিয়া পড়ে যেতে নিলে রিহান ধরে ফেললো,বলল, “এখন আমার এই গোধূলি বেলায়,নৌকার কোনায় বসে গাইতে ইচ্ছে করছে।
‘আজ এই পথ যদি না শেষ হয় তবে,কেমন হতো তুমি বলোতো?
আরশিয়া ঠিক করে বসলো,বলল,“নদীপথ শেষ না হলে থাকতে না খেয়ে..
“তোমার চোখে তাকিয়ে কাটিয়ে দিবো সকাল সন্ধ্যা রাত্রে।”
সময়টুকু যেন থেমে রইলো।সন্ধ্যায় নদীর মৃদু ঢেউ, মৃদু হাওয়া যেমন সাক্ষি রইলো কিছু মুহূর্তের।
শহর জুড়ে বৃষ্টি নামলো।রাতের আকাশে তারারা মুখ লুকালো। কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি আসলো। বৃষ্টি দেখে কেউ ছুটলো বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে,কেউবা ছুটলো বৃষ্টিতে ভিঁজতে। মিহির নীলার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছে।
“বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার ঠান্ডা লাগবে চলো।
নীলা শুনলো না হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে দৌঁড়ে গেলো।বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলো। মিহির না পেরে গেইট খুলে বাহির হলো।একটু পর এসে নীলাকে টেনে নিয়ে বাহির হলো।নীলা বলে যাচ্ছে,“ কোথাই নিয়ে যাচ্ছেন?”
মিহির নীলাকে নিয়ে রিকশার সামনে দাঁড়ালো। উঠতে বলে সে উঠে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। নীলা হাত ধরে উঠলো।মিহির সে হাতে নীলার নেতিয়ে পড়া শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে বলল,“মনে আছে সে দিনের কথা?বলেছিলাম আমাদের ও এমন সময় আসবে।রাতের শহরের বৃষ্টিতে তুমি আমি ভিঁজবো।হাত মেলে তোমায় আগলে রাখবো।
নীলা চমৎকার হেসে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো।মিহিরে দৃষ্টি উপেক্ষা করে রিকশার হুডি তুলে দিলো।মেলে ধরলো দুহাত।যেন বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে চায় তারই মন ও প্রাণ। রিকশা চলতে থাকলো,বৃষ্টির রেশ যেন আরো বাড়লো,ভিজিয়ে জুবুথুবু হয়ে গেলো দুজনেই। তার পর থামলো না রিকশার গতি কিংবা তাদের প্রতিশ্রুতি।
সকাল হতে আরশিয়া বার বার হাঁচি দিচ্ছে। এই এখন কথা বলতে বলতেও হাঁচি ফেলছে।
“দেখছো ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলেছো।কালকে কোথা থেকে ভিজে এসেছো বলোতো?
সায়মা মির্জার কথায় আরশিয়া উত্তর দিতে গেলো,“আম্মা কালকে আসার সময় হু..
হাঁচচছো।
কথার মধ্যে আবারো হাঁচি। আরশিয়া বিরক্ত হলো।
সায়মা মির্জা বললেন,“হয়েছে বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না।
যাও গিয়ে গরম পানি বসিয়ে দিয়েছি ভাপ নেও। আরশিয়া টিস্যু ফেলে রান্না ঘরে পা বাড়ালো। হুট করে কিছু পড়ার শব্দে সায়মা মির্জা ছুটে আসলেন। মেঝেতে আরশিয়া পড়ে আছে। কিছুটা ভয় পেয়ে সবাই কে ডাকলো। মায়ের কন্ঠ শুনে রিহান দৌঁড়ে নামলো। তারেক মির্জা বা কেউ নেই বাসায় আছে শুধু সায়মা আর রিহান। সেও একটু পর বেরিয়ে যেত কিন্তু জ্বর এসেছে বিধায় আছে।
রিহান রান্না ঘরে এসে দেখে আরশিয়ার মাথা তার মায়ের কোলে এবং তার চোখ বন্ধ। “অজ্ঞান হয়ে গেছে পানি নিয়ে আয়।”
রিহান তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসলো।চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। রিহান তার গাল নাড়িয়ে ডাকছে,“এই আরশিয়া?আরশিয়া?
আরশিয়া চোখ খুললো। রিহানের দিকে তাকালো।রিহান ওর হাত ধরে আছে চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ। আরশিয়া উঠতে গিয়ে হুট করে গড়গড় করে বমি করে দিলো।বামপাশে রিহান থাকার কারণে পুরো শার্ট,প্যান্ট বমিতে ভরে গেলো। আরশিয়া উঠে বেসিনে গেলো। রিহান গিয়ে ওকে ধরলো যেন পড়ে না যায়।আরশিয়া বমি করে যাচ্ছে, সায়মা তার কানের তালু দিয়ে চেপে ধরে আছে।
একটু পর আরশিয়ার বমি থামলো। চোখ বন্ধ করলো সে। ওকে ধরে সোফায় বসালো।
রিহান চিন্তিত কন্ঠে বলল,“কি হয়েছে বলোতো?তোমার অসুস্থ লাগছে আগে বলবে না?
আরশিয়া দম ফেলে উত্তর দিলো,“হুট করে শরীর খারাপ লাগতেছিলো সকাল থেকে বেশি। তেমন পাত্তা দেইনি।
সায়মা মির্জা কিছু একটা ভেবে রিহান কে বলল,“ডাক্টারের কাছ থেকে চেক-আপ করে নিয়ে আয়। কি হয়েছে জানা যাবে।
আরশিয়া শাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো।কিছু একটা ভাবলো,সেও হিসাব মিলালো।হয়তো কিছুটা বুঝতে পারলো।শাশুড়ির সন্দেহ ভুল নাকি সঠিক তা জানতে সেও চায় বিধায় রাজি হলো।
বিকেল হতেই আরশিয়া কে নিয়ে নীলার চেম্বারে গেলো।
আরশিয়া কে দেখে নীলা আনন্দিত হলো। তার জন্যই তো জীবনে মিহির কে পেলো।তার পূর্ণতায় আরশিয়ার অবদান অনেকটা।
হেসে রিহান আর আরশিয়া কে বলল,“আরেহ তোমরা?বসো,বসো।
দুজনে বসে পড়লো। রিহান প্রথম জানতে চাইলো,“মিহির ভাই কোথাই?”
“ও তো নেই। একটু আগেই কিছু জুরুরি কাজে বেরিয়ে গেলো।আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। কেন?তোমাদের কি তার সাথে কোনো দরকার?”
রিহান মাথা নাড়ালো, বলল,“না। আমাদের তোমার সাথে দরকার।
নীলা জানতে চাইলে তাকে সব খুলে বলে।
নীলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।রিহান কে বেরিয়ে যেতে বলে আরশিয়া কে কিছু জিজ্ঞেস করলো।কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়েও সিউর হওয়ার জন্য চেক করলো। মুহূর্তে তার মুখে হাসি এলো।হাসতে হাসতে রিহান ডাকলো।রিহান যেন অপেক্ষায় ছিলো, সে ছুটে আসল,জানতে চাইলো,“কি হয়েছে?”
আরশিয়া নীলার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,কি উত্তর দিবে তা জানার আগ্রহে দুজনে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে। নীলা অপেক্ষা শেষ করে দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার এন্ড মিসেস মির্জা আপনারা বাবা-মা হতে চলেছেন।
রিহান স্তব্ধ হলো,কথা বলতে ভুলে গেলো।সে কি ভুল শুনছে এই দ্বিধায় ও পড়লো।
আরশিয়া কিছুটা অবাক আবার স্বাভাবিক ও। শাশুড়ির সন্দেহ এবং তার ভাবনা মিলে গেলো।
রিহান আনন্দে বাক হারা হয়ে গেলো।ধীর পায়ে আরশিয়া কাছে আসলো। হুট করে জড়িয়ে ধরলো আরশিয়ার বাহু। হাতটা জড়িয়ে রাখলো পেটে।তারা ভুলে গেলো নীলার উপস্থিতি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,“ আমাদের দ্বিতীয় পূর্নতা এখানে।প্রথম পূর্ণতা পেয়ে যতটা আজ তার চেয়ে অধিক খুশি আমি।
তোমাকে শতকোটি ধন্যবাদ এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। এখন শুধু সুস্থ হয়ে তার পৃথিবীতে আসার অপেক্ষা।
নীলা ততক্ষণে একটু সময়ের জন্য বেরিয়ে গেলো। আরশিয়া রিহানের হাতটা উঁচু করে হাতের পিঠে গাঢ় চুমো খেলো। চোখে চোখ রেখে বলল,“ আমি এবং আমাদের পূর্ণতা নিয়ে নতুন করে সাঁজাবো আমাদের সংসার। সে সংসারে খুব শিগগিরই আগমন হবে একটু দুষ্টু রাজকন্যা কিংবা রাজকুমারে।
আমাদের একান্ত রাজ্যে সুখ উল্লাসে কাটাবো বাকি জীবন।”
_____সমাপ্ত_____