প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-১৪+১৫

0
416

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১৪

বিছানায় কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে স্বাক্ষর। বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। রাতের সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। স্বাক্ষর বিছানায় শুয়েই এপাশ ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না। বউয়ের সাথে সাথে ঘুমও আজ পালিয়েছে। কই বিয়ে করেছে বউ নিয়ে থাকবে বলে। তা না করে দুজনে আলাদা আলাদা ঘরে অবস্থান করছে। ইলিয়াস মাহমুদ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এই শুক্রবার ওদের রিসেপশন আয়োজন করা হবে। তার আগে দুজনকে আলাদাই থাকতে হবে। হাতে মাত্র একদিন। গ্রামে মিজান তালুকদারকে জানানো হয়েছে রাতেই। অসুস্থতার জন্য লম্বা জার্নি করতে পারেন না তিনি। উনার বড় ছেলে আর মেঝো ছেলে কাজের সুত্রে বাইরে গেছেন। খালি বাড়ি আর অসুস্থ মিজান তালুকদারকে একা ফেলে, ছেলের বউরা আসতে পারবেন না। উনার ছোট ছেলে যাবেন আর নাতি নাতনিদের পাঠাবেন বলে দিয়েছেন। স্বাক্ষর তার কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে বলতে থাকে….

–বুঝলি টুনটুনি, না জানিয়ে বিয়ে করার শাস্তি দিচ্ছে আব্বু আমাকে। বিয়ে করেছি বউ নিয়ে থাকার জন্য কিন্তু এখন দেখছি আরও একটা দিন আর দুটো রাত অপেক্ষা করতে হবে। তবে চিন্তা করিস না, তারপর থেকে তোকে আর আমার প্রয়োজন হবে না। আমি আবার দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারি না। কোলবালিশ আমার চাই না। আমার বউ-ই লাগবে।

তুলিকে জড়িয়ে ধরে তন্দ্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ড্রিম লাইটের আলো আর বাইরের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় পুরো ঘরে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে৷ বিছানার কোণায় তন্দ্রার লম্বা বেনী ঝুলে আছে। বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা দুবার বেজে ওঠে কে’টে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। এমনিতেই তন্দ্রা এ ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমায় না। ড্রিম লাইটের আলোতে তন্দ্রার মুখশ্রী স্পষ্ট দেখতে পায় স্বাক্ষর। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় প্রেয়সীর কাছে। এতোক্ষণ তার অভাবই ফিল করছিল সে। ডান হাত দিয়ে তন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কারো স্পর্শে গভীর ঘুমটা যেন আগের থেকে বেশ অনেকটা হাল্কা হয়ে এসেছে৷ তন্দ্রা চোখ মেলে তাকিয়ে আবছা আলোয় কারো অবয়ব দেখতে পায়। প্রথমে কিছুটা ভয় পায় আর অবয়বের কাছ থেকে দূরে সড়ে আসে। তন্দ্রাকে এমন সড়ে যেতে দেখে স্বাক্ষর আস্তে করে বলে….

–আরে বউ আমি। ভয় পেও না।
–তুমি এতো রাতে এখানে কেন?
–বউ ছাড়া ঘুম আসছিল না। তাইতো ভাবলাম একটু তুমি বিলাস করে আসি।
–সকালে তুমি বিলাস করো, এখন আমার ঘুম আসছে। ঘুমাবো আমি।
–তুমি ঘুমাও। আমি না-হয় তোমায় দেখতে দেখতে সারা রাত পাড় করে দিব।
–কি অবলীলায় না, কথাটা বলে দিলে। কেউ যদি এভাবে আমাদেরকে দেখে ফেলে, কি ভাববে ভেবে দেখেছো?
–ভাববে আমি আমার বউকে ছাড়া থাকতে পারিনি, তাই তার ঘরে অব্দি চলে এসেছি। ব্যাপারটা কিউট না?

স্বাক্ষরের যেন এ ব্যাপারে কোনো ভাবান্তর নেই। সে এখনো তন্দ্রার মুখ পানে তাকিয়ে আছে। তন্দ্রা একটু নড়েচড়ে বসে বলল…

–কিউট না ছাঁই। সবাই নির্লজ্জ বলবে। তোমাকে তো বলবে বলবেই আমাকেও বলবে।
–বউ হাইপার হইও না। একটু পরেই আমি চলে যাচ্ছি। সবাই তো বাগান বিলাস, জোছনা বিলাস, বৃষ্টি বিলাস করে। আমি একটু তুমি বিলাস করতে এসেছি৷ অশান্ত মনটাকে তো একটু প্রশান্তি দেওয়া দরকার। তাই-না?

তন্দ্রা প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না। তুলি এখনো আরাম করে ঘুমোচ্ছে৷ স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে নিয়ে যায় বেলকনির কাছে। দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বেলকনিতে আবছা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলো প্রবেশ করছে। দুজন কপোত-কপোতীর অবয়ব একটু আধটু বুঝা যাচ্ছেও বটে। স্বাক্ষর তন্দ্রার মাথাটা নিজের কাধে রাখে। তন্দ্রার চুলের থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। তন্দ্রার কোমল বাম হাত খানা নিজের পুরুষালি হাতের মাঝে নিয়ে নেয়। স্বাক্ষরের হৃদস্পন্দন তন্দ্রা নিশ্চুপ থেকে শুনতে পারছে।

–বউ তোমার জন্য দুটো উপহার আছে।

তন্দ্রার দৃষ্টিতে প্রশ্নবাচক চাহুনি। সে স্বাক্ষরের কাধ থেকে সন্তপর্ণে নিজের মাথা সড়িয়ে নেয়। আগ্রহী দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। স্বাক্ষর তার প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট দুটো বক্স বের করে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে তন্দ্রার ডান হাতে ধরিয়ে দেয়। প্রথম বক্সটা খুলে সে। সাদা স্টোনের একটা সোনার আংটি। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটে জ্বলজ্বল করে উঠছে। আংটিটা তন্দার অনামিকায় পড়িয়ে দেয়। একদম ফিট হয়ে বসেছে আঙ্গুলে। দ্বিতীয় বক্সটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দেয় সে।

–এটা পরে কোনো সময় পড়ে নিও।

তন্দ্রা বক্সটা খুলে সেখানে একটা নোসপিন দেখতে পায়। কিন্তু তার তো নাক ফোটা নেই। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নেয়। স্বাক্ষর ঘোর জড়ানো কন্ঠে তন্দ্রাকে বলে…

–তোমাকে কি জড়িয়ে ধরতে পারি বউ?

আজ তন্দ্রার সারা সময় নীরব থাকতেই ইচ্ছে করছে। স্বাক্ষরের ঘোর জড়ানো কন্ঠ তার মনে যেন অন্যরকম অনুভূতি জাগাচ্ছে।

–তোমার নীরবতাকে কি আমি বরাবরের মতোই সম্মতি মনে করে নিব?

আজ দ্বিতীয় বারের মতো তন্দ্রা আবারও স্বাক্ষরকে নিজে থেকে আলিঙ্গন করে। স্বাক্ষর তন্দ্রার চুলে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়ায়। গভীর আলিঙ্গনে দুজন কপোত-কপোতী একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকে। আর সাক্ষী হয়ে থাকে কিছু সুন্দর প্রহর। বেশ কিছু সময় পর স্বাক্ষর তন্দ্রার কাছ থেকে সরে আসে। তন্দ্রা তার দিকে একবার তাকায়। হুট করে স্বাক্ষর তন্দ্রার ললাটে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ডুবিয়ে দেয়। আবেশে তন্দ্রা তার নেত্রযুগল বন্ধ করে নেয়। কানের কাছে গরম নিশ্বাস অনুভব করে তন্দ্রা। ঘোর জড়ানো কন্ঠে স্বাক্ষর আবারও বলে…

–আওয়ার ফার্স্ট নাইট।

স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা কিছুটা লজ্জা পায়। সে স্বাক্ষরের দিকে তাকায় না। ওই চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। বুকের ভেতর যেন দ্রিমদ্রিম করে ঢোল বাজাচ্ছে। দু’জনে বেলকনি ছেড়ে ঘরে চলে আসে।

–আসছি বউ।

কথাটা বলেই স্বাক্ষর ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তন্দ্রা তার যাওয়ার পানে বেশ অনেক সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বিছানায় তুলির পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে খুব দেরিতে ঘুম ভাঙে তন্দ্রার। আড়মোড়া ভেঙে কালো রঙা দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকালে সাড়ে দশটার বেশি বাজতে চললো। তুলি অনেক আগেই উঠে পড়েছে। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে এসে দেখে তুলি টিভি দেখছে। স্কুল থেকে তিনদিনের ছুটি নেওয়া হয়েছে। স্বাক্ষর বাদে সবাই এখানে উপস্থিত। হয়তো হসপিটালে গিয়েছে। দুপুরে সবাই মিলে শপিং এ যাবেন। তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের কেনাকাটা করার জন্য। এই বিষয়েই উনারা আলোচনা করছেন। তন্দ্রা ডাইনিং টেবিলে তার জন্য রাখা নাস্তাটুকু খেয়ে নেয়। এতোক্ষণে বেশ ক্ষিধেই পেয়েছিল তার। কোনো মতে খাবার টুকু খেয়ে ঘরে চলে আসে। চার্জে লাগানো ফোনটা হাতে নেয়। ইলোরার নাম্বারে কল করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলে। এরপর নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। ইলোরার আসলেই বেরিয়ে যাবে। সবটা স্বাক্ষরকে না জানিয়েই করতে চাইছে সে।

দুপুরে তন্দ্রাকে নিয়ে সবাই শপিং মলে এসেছে। সবাই বলতে সাহেরা মাহমুদ এবং তাহেরা মাহমুদ আর ইলোরাও আছে সাথে। তন্দ্রাকে মাস্ক পড়ে থাকতে দেখে তাহেরা মাহমুদ কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেন….

–এই গরমে মাস্ক লাগিয়েছিস কেন?
–সকালে ঠান্ডা পানি খেয়ে সর্দি লেগে গেছে মা৷ বারবার হাঁচি আসছে।
–তোদের বারবার বারণ করি ঠান্ডা পানি না খেতে তারপরও আমার কথা শুনিস না। লাগিয়ে ফেললি তো গরম ঠান্ডা। আজ বাসায় চল, তোকে আমি ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবো।

তাহেরা মাহমুদ এর কথা ইলোরা মিটিমিটি হাসছে। তন্দ্রা তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। সাহেরা মাহমুদ বলেন…

–আহা তাহু। রাগ করছিস কেন? ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। চল ভেতরে যাই।

ভেতরে যাওয়ার আগেই সেখানে স্বাক্ষর চলে আসে। একবার সবার দিকে তাকিয়ে থেকে তন্দ্রার দিকে তাকায়। তন্দ্রাকে মাস্ক পড়তে দেখে তার কপাল কিছুটা কুচকে আসে।

–তন্দ্রাবতী মাস্ক পড়ে আছো কেন?

স্বাক্ষরের কথার প্রত্যুত্তরে তাহেরা মাহমুদ বলেন….

–আর বলিস না বাবা। ঠান্ডা পানি খেয়ে সর্দি লাগিয়ে ফেলেছে সে।
–ঔষধ খেয়েছ?
–হুম।

স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে শপিং মলের ভেতরে ঢুকে। সবাই একসাথে পছন্দ করে তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের রিসেপশনের জন্য ম্যাচিং করে যাবতীয় যা যা লাগে সবই কেনাকাটা করে। অনেক গুলো দোকান ঘুরে তন্দ্রার ল্যাভেন্ডার কালার লেহেঙ্গা পছন্দ হয়েছে। তার পছন্দ অনুযায়ী লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে স্বাক্ষরের পাঞ্জাবি কেনা হয়েছে। আরও কিছু কেনাকাটা করে ওরা বাসায় ফিরেছে। ওরা বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। ওরা বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই তন্দ্রার নানু বাড়ির সবাই চলে আসে। সবাইকে দেখে তন্দ্রা বেশ খুশিই হয়। বিশেষ করে রুবি আর তার হাসব্যান্ডকে দেখে খুশি হয়েছে। রাতে ছোট্ট করে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয় তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের। হেনা সুন্দর করে তন্দ্রার দু’হাত ভরে মেহেন্দি পড়িয়ে দেয়। দু’হাতের মাঝে ছোট্ট করে স্বাক্ষরের নামও লিখে দেয়। শপিং মল থেকে আসার পর একবারের জন্যও স্বাক্ষর তন্দ্রার দেখা পায় না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। আজ স্বাক্ষরের সাথে তার ছোট মামা শুয়েছে। স্বাক্ষরকে এভাবে ছটফট করতে দেখে তার ছোট মামা বলেন…..

–ভাগ্নে একটা রাত তো সবুর করো।
–হুহ! তোমার জন্য আমি একটা কম মামী পেয়েছি। তিন তিনটে মামীর প্রয়োজন ছিল। তাহলেই না জামাই আদর জমতো।
–সে রাজি থাকলে এতোদিনে বিয়েটা হয়েই যেতো ভাগ্নে।
–তুমি আমার মামা কম বন্ধু বেশি। শুধু বলেই দেখো। তুলে এনে বিয়ে করিয়ে দেবো।
–এসব কথা পরেও হবে৷ এখন ঘুমাও। অনেক রাত হচ্ছে।

চলবে?…….

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১৫

সকাল হতে না হতেই বাড়িতে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ফ্যামিলিগত ভাবেই স্বাক্ষর তন্দ্রার রিসেপশন আয়োজন করা হচ্ছে৷ ইলিয়াস মাহমুদ আর ইউসুফ মাহমুদ এর অফিস থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ ইনভাইট করার হয়েছে। প্রতিবেশিদেরও আসতে বলা হয়েছে। ইলোরার বাবা মা আর ছোট ভাই এসেছে। মুহিতের পরিবার থেকেও তার বাবা মা এসেছেন। মুহিত তার বাবা মায়ের একটা মাত্রই ছেলে। স্বাক্ষরের বেস্টফ্রেন্ড আকাশও এসেছে। রিসেপশনটা বাড়িতেই করা হবে। দুপুরের দিকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে। স্বাক্ষর আজ বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে। স্বাক্ষর বেশ কয়েকবার তন্দ্রার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু কাজিনমহলের কেউই তন্দ্রার সাথে তার দেখা করতে দিতে চাইছে না। তাদের একটাই কথা, তন্দ্রাকে সাজানোর পর দেখতে পারবে। এদিকে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে দেখার জন্য মনে মনে বেশ ছটফট করছে।

তন্দ্রার লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে আনা ল্যাভেন্ডার কালার পাঞ্জাবি পড়েছে স্বাক্ষর। জুম্মার নামাজের সময় হয়ে এসেছে। বাড়ির সব পুরুষরা মসজিদে চলে গিয়েছে নামাজ আদায় করার জন্য। মেহমানদের আপ্যায়নের সব কাজ প্রায় হয়ে এসেছে। ঘন্টা খানেক পর সবাই আসতে শুরু করেছে। পার্লার এর একটা মেয়ে এসেছে তন্দ্রাকে সাজানোর জন্য। ফর্সা গায়ে ল্যাভেন্ডার কালার লেহেঙ্গাটা দারুণ মানিয়েছে তন্দ্রাকে। হাল্কা পার্টি সাজ। লম্বা চুলগুলো কার্লি করা। মাথায় স্টোনের ক্রাউন আর হাল্কা কিছু অর্নামেন্টস। তন্দ্রাকে সাজানো শেষ হলেই পার্লার এর মেয়েটা চলে যায়। তন্দ্রার ঘরে এখন শুধু ইলোরা, হেনা, হাসনা আর শিরিন আছে। তন্দ্রাকে যখন সাজাচ্ছিল সেই সুযোগে ওরাও তৈরি হয়ে নিয়েছে। ইলোরা এসে তন্দ্রার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলে…

–একদম পরীর মতো লাগছে রে তোকে। নোসপিনটা দারুণ মানিয়েছে৷
–ভাইয়া তো কাল রাত থেকে তোর সাথে দেখার করার জন্য ছটফট করছে।

শিরিনের কথায় তন্দ্রা লজ্জা পায়। আজ তার বেশ লজ্জা লজ্জা ফিলিংস হচ্ছে। তাকে আরও লজ্জা দেওয়ার জন্য হাসনা বলে…

–কি দিয়ে জাদু করলি রে ভাইকে?
–তোর নাক ফুটো করার বিষয়টা ভাইয়া বাদে বাড়ির সবাই জানে। তার কাছ থেকে লুকোচুরি কেন? আড়ালে তো ঠিকই তাকে দেখছিস।

হেনা প্রশ্নটা করেই ভ্রু কুচকালো। ইলোরা তার দিকে তাকিয়ে বলল…

–আরে বুঝো না, ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিবে সারপ্রাইজ।
–বেশি বেশি বলছিস তোরা। এমন কিছুই না।
–এমনটাই৷ নয়তো কেন বললি স্বাক্ষর ভাইয়া যেন বউ সাজের আগে তোকে না দেখে? শপিং এ মাস্ক পড়ে গিয়েছিলি কেন?
–হয়েছে বোন মাফ কর।

তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার ঘরে আসেন ডাকার জন্য। মেয়েকে একপলক তাকিয়ে দেখে নেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিলেন তিনি। আল্লাহর হয়তো এটাই ইচ্ছে ছিল। ধীর পায়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসেন তাহেরা মাহমুদ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন…

–মাশাআল্লাহ৷

তন্দ্রা হাসি মুখে তার মা’কে দেখতে থাকে। তাহেরা মাহমুদ ওদের সকলকে তাড়া দিয়ে বলেন…

–হলো তোদের? তন্দ্রাকে নিয়ে ড্রইং রুমে আয়।

তাহেরা মাহমুদ এর কথা শিরিন মনে মনে কিছু একটা ভাবে। হেনাকে ইশারায় কিছু একটা বোঝায়।

–ফুপি তুমি যাও আমরা তন্দ্রাকে নিয়ে আসছি।

তাহেরা মাহমুদ হেসে চলে যেতে নিলে হেনা উনাকে আটকায়।

–ফুপি যাওয়ার সময় শুভ, সাইফ আর মুহিতকে পাঠিয়ে দিও৷
–আচ্ছা।

তাহেরা মাহমুদ যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর ওরা তিনজন তন্দ্রার ঘরে আসে। এরপর সবাই একসাথে ঘর থেকে বের হয়। শুভ, সাইফ আর মুহিত সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের জন্য তন্দ্রাকে দেখাই যাচ্ছে না। মেহমানরা সবাই তন্দ্রাকে দেখার জন্য ড্রইং রুমেই অপেক্ষা করছে। স্বাক্ষর তো অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে৷ বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আসে। হচ্ছে টা কি! কাল রাত থেকে সে তন্দ্রার দেখা পাচ্ছে না। আর এই ছেলে মেয়ে গুলো তো হাড়বজ্জাত। কতবার চেষ্টা করলো তন্দ্রাকে একটিবার দেখার। বারবারই তার চেষ্টা বিফলে। স্বাক্ষরের বিরক্তি মাখা মুখটা দেখে এখানে উপস্থিত মিটিমিটি হাসছে। তার কাছে এসে তন্দ্রার সামনে থেকে ওরা সবগুলো সড়ে দাঁড়ায়। তন্দ্রাকে দেখা মাত্রই স্বাক্ষর এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গিয়েছে সে। আজ তন্দ্রাকে তার কল্পনার তন্দ্রাবতীর মতোই লাগছে। এতোদিন যেমনটা সে কল্পনা করে এসেছে। স্বাক্ষর খেয়াল করে তন্দ্রা নাক ফুটো করিয়েছে এবং তার দেওয়া নোসপিনটাই সে পড়ে আছে। দেখতে খুব মায়াবী লাগছে। লাইটের আলোতে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলজ্বল করে উঠছে।

স্বাক্ষর আর তন্দ্রাকে এক সাথে বসানো হয়। মেহমানরা সবাই বেশ প্রশংসা করে ওদের দুজনকে একসাথে দেখে। দুজনকে নাকি পাশাপাশি খুব সুন্দর মানিয়েছে। মেহমানদের খেতে দেওয়া হয়েছে। এদিকে শুভ, শিরিন, হেনা, হাসনা, সাইফ, মুহিত, ইলোরা একত্রে মিলে স্বাক্ষর তন্দ্রার সাথে গ্রুপ সেল্ফি তুলছে। এখন গোধুলি বিকেল। মেহমানরা সবাই এতোক্ষণে চলে গেছে। মুহিত আর ইলোরার বাড়ির সবাইও চলে গিয়েছেন। ছাদে তন্দ্রার লাগানো কাঠগোলাপ গাছটায় আজ অনেক ফুল ফুটেছে। একসাথে এতোগুলা ফুল দেখে তন্দ্রা ভীষণ খুশি হয়ে যায়। শুভ তার ক্যামেরা দিয়ে স্বাক্ষর আর তন্দ্রাকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তোলে।

ইলোরা আর মুহিত আজ রাতে তন্দ্রাদের বাড়িতে থেকে গেছে। দুপুর থেকে পড়ে থাকা ল্যাভেন্ডার কালার পাঞ্জাবিটা অনেক আগেই চেঞ্জ করে ফেলেছে স্বাক্ষর। বিকেলে ছবি তোলা শেষ হবার পরপরই তন্দ্রা তার ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এতো সময় লেহেঙ্গা পড়ে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ফ্রেশ হয়ে লাল রঙের লং জামা পড়ে নেয়। গলায় চিকন চেইন আর দু’হাতে দুটো চিকন চুড়ি পড়ে আছে। নোসপিন পড়ার পর থেকে তন্দ্রাকে দেখতে বউ বউ লাগছে৷ একটু পর সে নিজেকে আয়নায় দেখছে। আনমনেই লজ্জা পাচ্ছে। স্বাক্ষরের ঘরটা ছোট্ট ছোট্ট ক্যান্ডেল লাইট দিয়ে সাজিয়েছে আকাশ, শুভ, সাইফ আর মুহিত মিলে। ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানোর কথাটা স্বাক্ষরই আকাশকে বলেছিল। বেস্টফ্রেন্ডকে যা বলা যায় তা তো ছোটদের বলতে পারবে না। আকাশ পরে বাকিদের জানিয়ে দেয় ক্যান্ডেল দিয়ে সাজাতে।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তন্দ্রাকে স্বাক্ষরের ঘরে নিয়ে আসা হয়। তন্দ্রাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে ওরা সবাই ঘরে বাইরে চলে যায়। এসি চলার মাঝেও তন্দ্রার হাত একটু আধটু ঘামছে। নাকের ডগায়ও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ভেতরে ভেতরে খুবই নার্ভাস হচ্ছে সে। ঘরে বাইরে ইলোরা, হেনা, হাসনা আর শিরিন দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। দশ হাজার টাকা না দিলে আজ স্বাক্ষরকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দেবে না তারা। স্বাক্ষরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ, শুভ, সাইফ আর মুহিত। স্বাক্ষর কোনো রকমে ওদের পাওনা টাকা দিয়ে দেয়। আর ওরাও টাকা পেয়ে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়।

তন্দ্রা বিছানায় বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। আজ আকাশটা চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ। চাঁদের আলো জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতরেও আসছে। তার উপর পুরো ঘর জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট ক্যান্ডেল লাইট জ্বালিয়ে রাখা। ক্যান্ডেলের টিপটিপ লাল আভায় পুরো ঘরটায় যেন অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজ করছে। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ ঘরের দরজা আটকানোর শব্দ হয়। তন্দ্রা সেইদিকে তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর দাঁড়িয়ে। ধীর পায়ে সে তন্দ্রার দিকেই এগিয়ে আসছে। তন্দ্রা কিছুটা নড়েচড়ে বসে। একঝাঁক নার্ভাসনেস তার ঘিরে ধরেছে। স্বাক্ষর বিছানার পাশের টেবিলে একটা খাম রাখে।

–আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমার গলা কাঁপছে কেন তন্দ্রাবতী? তুমি কি ভয় পাচ্ছো আমাকে?
–ভয় না একটু নার্ভাস।
–চলো বেলকনিতে গিয়ে বসি।
–হুম।

তন্দ্রা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। স্বাক্ষর কাছে এসে তন্দ্রার কোমল হাতটা ধরে। দু’জনে বেলকনিতে এসে দোলনাটায় বসে। মৃদু বাতাসে বেলকনিতে লাগানো কাঠগোলাপ আর বেলী গাছটার থেকে ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। দোলনাটা হাল্কা দোল খাচ্ছে৷ তন্দ্রার বেশ ভালোই লাগছে এখানে বসে থাকতে। স্বাক্ষর তন্দ্রার মাথার উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নেয়। খোপা করে রাখা চুলগুলো আলগোছে খুলে দেয়। শ্যাম্পু করা চুল থেকে মিষ্টি সুবাস পাচ্ছে স্বাক্ষর৷ এক ঘোর লাগানো অনুভূতি। তন্দ্রাকে কাছে টেনে নিয়ে তার চুলে মুখ ডুবায়। কিছুক্ষণ পর মুখ সরিয়ে তন্দ্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে৷ কাধে থুতনি রেখে কোমড় জড়িয়ে রেখে স্বাক্ষর। চারিপাশটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। তন্দ্রা একদম চুপ করে আছে। তার সর্বাঙ্গ মৃদু কাঁপছে। তন্দ্রা একটু সরে আসতে নিলে স্বাক্ষর আবারও তাকে আঁকড়ে ধরে।

–দূরে যেতে চাইলে খুব বেশি কাছে টেনে নিব তন্দ্রাবতী। তুমি সহ্য করতে পারবে তো?

তন্দ্রা যেন মুহুর্তেই বাকহারা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে তার কোনো কথাই বের হচ্ছে না। স্বাক্ষরের হাতটা সরিয়ে ঘরে চলে আসে। স্বাক্ষরের দিকে তাকাতে তার খুব লজ্জা লাগছে। এতোক্ষণ তার ভেতর শুধু নার্ভাসনেস কাজ করছিল, এখন তো লজ্জা নামক বস্তুটা তাকে কাবু করতে যাচ্ছে। স্বাক্ষর তার পেছন পেছন ঘরে আসে। তন্দ্রাকে লজ্জা পেতে দেখে সে আবারও জিজ্ঞেস করে…

–আমার উত্তর কিন্তু আমি এখনো পাইনি তন্দ্রাবতী।
–আমি জানি না।
–কিন্তু আমি তো অনেক কিছুই জানি।

তন্দ্রার খুব কাছে এগিয়ে যায় স্বাক্ষর। দুজন দুজনের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পারছে। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে অনুভব করতে পারছে খুব করে। তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে নেয়। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে আরও কাছে টেনে নেয়। তন্দ্রার ওষ্ঠদ্বয়ে উষ্ণ স্পর্শ ছুঁয়ে দেয়। সময়ের সাথে সাথে স্পর্শ গুলো গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। বেশ অনেকটা সময় দুটো ওষ্ঠদ্বয় এর গভীর আলিঙ্গন ঘটে।

চলবে?…….