প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-১৭+১৮

0
400

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১৭

রাতে বড়রা সবাই ড্রইং রুমে একসাথে বসে আছে। স্পোর্টস চ্যানেলে খেলা দেখছেন ইলিয়াস মাহমুদ এবং ইউসুফ মাহমুদ। এখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজতে চললো। কিছুক্ষণ আগেই সবাই একসাথে রাতের খাবার খেয়েছে৷ আজ দুপুর থেকে আবহাওয়া ভালো না। মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে ঝোড়ো বাতাস বইছে। যেকোনো মুহুর্তে লোডশেডিং হতে পারে। পরিবেশটা ঠান্ডা ঠান্ডা। কাজিনমহলের সবাই ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে। রুবি আর তার স্বামী রবিন পাশাপাশি বসে আছে। শুভ, সাইফ, হেনা, হাসনা আর শিরিন একসাথে গোল হয়ে বসেছে। তন্দ্রা আর স্বাক্ষর একে অপরের হাত ধরে বসে আছে। চুপচাপ বসে থাকতে খুবই বোরিং ফিল করছে শিরিন।

–সবাই এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন? এভাবে বসে থাকতে খুব বোর ফিল হচ্ছে।
–মনের কথাটা বলে দিলি শিরিন।

হেনার কথায় কোনো উত্তর দেয় না সে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

–তোমরা বসো আমি আসছি।

কথাটা বলেই ছাদ থেকে চলে যায়। সবাই ছাদের দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পর শিরিন আবারও ফিরে আসে। তার হাতে একটা ছোট টেবিল আর কাঁচের বোতল। টেবিলটা সবার মাঝখানে রাখে আর উপরে কাঁচের বোতলটা।

–চলো ট্রুথ ডেয়ার খেলি সবাই৷
–আমি এইসব খেলতে পারবো না।

মোবাইল নিয়ে ক্যারম খেলতে শুরু করে স্বাক্ষর। সে বাদে বাকি সবাই রাজি হয়ে যায়৷ সে এখানে বসে আছে এটাই অনেক। শিরিন অনুরোধের স্বরে বলে…

–প্লিজ ভাইয়া। তুমি তো এইসব খেলা থেকে দূরেই থাকো। আজ না-হয় আমাদের সাথে একদিন খেললে।
–রাজি হয়ে যাও না। সবাই চাইছে, তুমিও আর না করো না৷
–ঠিকাছে।

তন্দ্রাও চাইছে সে ট্রুথ ডেয়ার খেলুক তাই সেও রাজি হয়ে যায়। শিরিন টেবিলের উপর রাখা বোতলটা প্রথম ঘুরায়। বোতলের মুখটা গিয়ে পড়ে হেনার দিকে। হাসনা তাকে জিজ্ঞেস করে।

–ট্রুথ নিবি নাকি ডেয়ার।
–ডেয়ার।
–তাহলে কিউট শালিক পাখির ডেয়ারটা আমিই দিব। খেলা শেষে আমাদের সবার জন্য কফি বানাবে তুমি। এটাই তোমার ডেয়ার।
–এটা কি হলো দুলাভাই। আপনি এতো সহজ ডেয়ার কেন দিলে হেনাকে?
–হাসনা তুই চুপ থাক তো। এখন দেখি পরবর্তী ট্রুথ বা ডেয়ার কে নিবে।

এবার হেনা বোতল ঘুরায়৷ কয়েকবার ঘুরার পর বোতলের মুখটা সাইফের দিকে। সাইফ আগেই বলেছে সে ট্রুথ নেবে। হেনা এবার তার ভাইকে প্রশ্ন করে…

–শেফালীকে প্রপোজ করার কাহিনিটা আমাদের বল এখন।
–এই তুই কি আমার নিজের বোন?
–ভাই চুপচাপ বলে দে।
–সেদিন আমি আর শেফালী বাঁশ ঝাড়ের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার হাতে গোলাপ ফুল ছিল৷ প্রপোজ করবো এমন সময় কোত্থেকে আব্বা এসে আমার পেছনে দাঁড়ায়। আব্বাকে দেখে তো শেফালী ভয়ে দৌঁড়ে পালায়। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আব্বা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবেন। কোথায় পালাবো বুঝতে পারছিলাম না! দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে গোবরের উপর পড়ে গিয়েছিলাম। টানা তিনদিন শরীর থেকে গন্ধ যায়নি।

সাইফের কথা শুনে সবার হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবার উপক্রম। শুভ তার পিঠে চাপড় মে’রে বলে…

–তোর প্রপোজ করার কাহিনি শুনে আমার শখ মিটে গেছে ভাই।

একে একে রবিন, রুবি, হাসনা, শিরিন আর তন্দ্রার ট্রুথ নেওয়া শেষ। ওরা ডেয়ার নিয়ে ফেঁসে যেতে চায় না তাই ট্রুথই নিয়েছে। এবার স্বাক্ষরের টার্ন আসে। সেও ট্রুথ নেয়। রুবি এবার স্বাক্ষরকে প্রশ্ন করে৷

–তোমার কাছে ভালোবাসার মানে কি ভাইয়া?

অন্ধকারেই স্বাক্ষর চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নেয়। তন্দ্রা তার মুখের দিকেই তাকিয়ে। টেবিলের পাশে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছে। সেই আলোতেই স্বাক্ষরের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাতের উপরে একটা চুমু দিয়ে, হাতটা ধরে থাকে। সবাই অধীর আগ্রহে স্বাক্ষরের মুখ পানে চেয়ে আছে।

–ভালোবাসার মানে হচ্ছে, একে অপরের সম্মান করা, মূল্যায়ন করা, যেকোনো পরিস্থিতিতে পাশে থাকা, তার সকল ছোটখাটো সকল বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা। রাগ অভিমান যাই-ই হয়ে যাক না কেন, কেউ কাউকে ছেড়ে না যাওয়া। আমার কাছে ভালোবাসার প্রাপ্তি হচ্ছে আমার তন্দ্রাবতী।

স্বাক্ষরের কথায় সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। এতে করে তার কিছুটা অস্বস্তি এবং লজ্জা লাগে। তবে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে হাসি রেখে মাথা চুলকায়৷ তন্দ্রা বুঝতে পারে স্বাক্ষর লজ্জা পাচ্ছে তাই সে এবার বলে…

–নেক্সট নেক্সট।
–লাস্ট টার্ন হচ্ছে ভাইয়ের। এবার ভাই, আমি আর বোতল ঘুরাবো না। তুই বল কি নিবি।

শিরিনের কথায় কিছুটা ভাব দেখিয়ে শুভ বলল…

–ডেয়ার।

শুভর ডেয়ার নেওয়ার কথাটা শুনে হেনার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। তাড়াহুড়ো করে সবাইকে বলে…

–এই বজ্জাতের ডেয়ারটা আমি নিজে দিব। অনেক জ্বালিয়েছিস তুই। আজ আমার পালা। তোর ডেয়ার হলো, আজ তুই শাড়ি পড়ে মেয়েদের মতোই সাজবি।
–একদম ঠিক। আমরা কোথাও সেজে গেলে বলতো, এই এসেছে পেত্নীর দল৷ আজ তোকে আমরা পেত্নী সাজাবো।
–আমার লাভ লস নাই। আমার পুরা লাইফ’টাই লস।

শুভর কথায় সবাই একত্রে হেসে দেয়। ফেসবুকে মিমিস শেয়ার করতে করতে ছেলেটা দিনকে দিনকে উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে।

রাতটুকু ওদের এভাবেই আড্ডা দিতে দিতেই কে’টে যায়। শেষ প্রহরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই তন্দ্রা নিজেকে স্বাক্ষরের বক্ষস্থলে পায়। কাল রাতে ছাদেই সে স্বাক্ষরের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছিল। স্বাক্ষর যখন তাকে কোলে করে আনতে যাবে তখন তার ঘুম কিছুটা হালকা হয়ে যায়। যার দরূন সে পায়ে হেঁটেই স্বাক্ষরের সাথে ঘরে আসে। এভাবেই একটা রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি হওয়ার আগেই ভ্যানিস। এখন ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বাজে। আটটার দিকে শুভরা চলে যাবে। তন্দ্রা উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পায়, রান্নাঘরে সাহেরা মাহমুদ এবং তাহেরা মাহমুদ রান্না করছেন। তন্দ্রা গিয়ে উনাদের কাজে সাহায্য করতে থাকে। নাস্তা বানানো হয়ে এলে সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রা ঘরে পাঠিয়ে দেন স্বাক্ষরকে ডেকে তোলার জন্য। বাকিরা সবাই উঠে গিয়েছে। সে ঘরে এসে দেখে, তার ডাক দেওয়ার আগেই স্বাক্ষরে উঠে গিয়েছে৷ সেই সুযোগে তন্দ্রা বিছানাটা গুছিয়ে নেয়। স্বাক্ষর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে।

কিছুক্ষণ আগেই ওরা সবাই বেরিয়ে পড়েছে। তন্দ্রার একটু আধটু মন খারাপ হয় ওদের চলে যাওয়ায়। তুলি আজ স্কুলে যাবে৷ তন্দ্রারও ইচ্ছে করছে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার। তন্দ্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব করছিল তখনই তুলি আসে তার ঘরে৷ তুলির হাতে হেয়ার ব্যান্ড। তন্দ্রা ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি নিয়ে বিছানায় বসে তুলিকে বলে…

–আয় আমার কাছে৷ আমি চুল বেধে দিচ্ছি।

তুলি গিয়ে তন্দ্রার সামনে বসে। তন্দ্রা তুলির চুলে দুটো ঝুটি বেধে দেয়৷ কপালের সামনে আসা ছোট কা’টা চুল গুলোকে ক্লিপ দিয়ে আটকে দেয়।

–তুই ড্রইং রুমে গিয়ে বোস। আমি আসছি।
–হুম।

তুলি যেতেই তন্দ্রা ড্রেসিং টেবিলের উপর চিরুনিটা রেখে দেয়। পাশেই তার ব্যাগটা রাখা। মোবাইলটা ব্যাগের ভেতরে রেখে, হিজাব ঠিকঠাক পড়া হয়েছে কি-না একবার দেখে নেয়। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সকালে তন্দ্রা জানিয়েছিল, আজ সে ভার্সিটি যাবে তাই স্বাক্ষর ড্রইং রুমে বসে তারই জন্য অপেক্ষা করছে। পাশে তুলি বসে বসে গেমস খেলছে স্বাক্ষরের ফোন দিয়ে। তন্দ্রা ড্রইং রুমের কাছে আসতেই তুলি ফোনটা দিয়ে দেয় স্বাক্ষরকে। এরপর তিনজন একসাথে বেরিয়ে পড়ে। স্বাক্ষর প্রথমে তুলিকে তার স্কুলের সামনে পৌঁছে দেয়। এরপর এক হাতে তন্দ্রার হাতটা ধরে আর অন্য হাতে ড্রাইভিং এ মন দেয়৷ কিছুক্ষণের মাঝেই সে তন্দ্রার ভার্সিটির সামনে চলে আসে। স্বাক্ষর তন্দ্রা কপালে একটা উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। তার এমন কাজে মুচকি হাসে তন্দ্রা৷

–দুপুরের খাবারটুকু সময়মতো খেয়ে নিও।
–হুম! আসছি। সাবধানে যেও।

তন্দ্রা ভার্সিটির ভেতরে চলে গেলে স্বাক্ষর গাড়ি নিয়ে হসপিটালে চলে যায়। আজ ইলোরা একাই এসেছে৷ মুহিতের নাকি জ্বর এসেছে তাই সে আজ আসেনি। পরপর তিনটা ক্লাস করে ওরা দুজন ভার্সিটি থেকে চলে আসে। একবার মুহিতকে দেখে আসা উচিত। দুজনে কিছু ফল কিনে নেয় সাথে করে৷ এরপর রিকশা করে মুহিতের বাড়ির সামনে আসে৷ বেশ অনেকটা সময় মুহিতদের বাসায় থেকে তন্দ্রা আর ইলোরা যে যার বাড়িতে চলে যায়। তন্দ্রা বাসায় আসার পর, ফ্রেশ হয়ে অল্প কিছু খেয়ে নেয়। এরপর ঘরে আসতেই ফোন চেক করলে, দেখতে পায় স্বাক্ষর তাকে তিনটে কল করেছে। তন্দ্রা স্বাক্ষরের ফোনে কল করে। স্বাক্ষর কল রিসিভ করে না; কে’টে দিয়ে সে নিজেই কল ব্যাক করে।

রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণই ভালো লাগে তন্দ্রার। আগে প্রায়শই এভাবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতো সে। রাতের আকাশটা তার বড্ড ভালো লাগে। তার উপর বৃষ্টি অথবা জোছনা হলে তো কথাই নেই। তন্দ্রা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্বাক্ষরের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। আজ রাতের আকাশটা বেশ মেঘলা। ঝড়ো বাতাস বইছে বাইরে৷ তন্দ্রা দু’হাত মেলে বাতাসটাকে অনুভব করতে থাকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে একটু আধটু। বাতাসের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কণা তন্দ্রার শরীরে এসে লাগছে। তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়৷ স্বাক্ষরের কথা ভাবতে থাকে৷

–এ যেন বৃষ্টির রুমঝুম কলতান নয়, তোমারই আগমনের সুর।

চলবে?…….

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-১৮

সকালে তন্দ্রার আগে স্বাক্ষরের ঘুম ভেঙে যায়৷ তন্দ্রা তাকে কোলবালিশের মতো করে জড়িয়ে ধরেছে। বুকে সাথে আষ্টেপৃষ্টে আছে। স্বাক্ষর এভাবেই তন্দ্রার চুলে মাঝে নিজের হাত ডুবিয়ে দেয়। কপালের ছোট কা’টা চুলগুলো খুব বিরক্ত করছে তন্দ্রাকে। বার বার চোখমুখ কুচকে আসছে। স্বাক্ষর সন্তপর্ণে চুল গুলো কপালের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর উঠে ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকে৷ এরই মাঝে তন্দ্রার ঘুমও কিছুটা হালকা হয়ে আসে। চোখ মেলে স্বাক্ষরকে বিছানায় পায় না সে। আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে, স্বাক্ষর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। তন্দ্রা ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে স্বাক্ষরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তন্দ্রার এমন কাজে স্বাক্ষর মুচকি হাসে।

–আজ এতো প্রেম কেন?
–কে বলল এটা প্রেম?
–তাহলে কি?
–এটা হচ্ছে বৈবাহিক আলিঙ্গন।
–তাই নাকি?
–হুম তাই।

তন্দ্রা স্বাক্ষরের কাছে গিয়ে তাকে সামনে থেকে গাঢ় আলিঙ্গন করে। স্বাক্ষর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে তার প্রেয়সীর দিকে। তন্দ্রা শব্দ করে স্বাক্ষরের গালে একটা চুমু খায়; এরপর ওয়াশরুমে চলে যায়। স্বাক্ষর আলমারি থেকে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বের করে ব্যাগের ভেতর রাখে। ফোন আর ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে তন্দ্রাকে ডাক দেয় স্বাক্ষর।

–তন্দ্রাবতী হলো তোমার?
–এই তো আসছি।

তন্দ্রা ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছে; ভার্সিটি যাবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে আজ। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে পা পিছলে পড়ে যায় সে৷ স্বাক্ষর গিয়ে তুলে দাঁড় করায় তাকে৷

–কোথাও লেগেছে?
–পায়ের গোড়ালিতে আর হাতে।
–হাঁটার সময় চোখ কোথায় থাকে?

স্বাক্ষরের কন্ঠে গম্ভীরতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেও হাসছিলো আর এখনই আবার তার সাথে রেগে আছে। এতে অবশ্য তারই দোষ।

–ঐ চোখ তো শুধু তোমারেই দেখিবার চায় গো।
–স্টুপিড। মা’রবো এক চড়। প্রেমের ভুত নেমে যাবে৷

স্বাক্ষর ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তন্দ্রাও রেডি হয়ে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে। ডাইনিং টেবিলের স্বাক্ষর নাস্তা খাচ্ছে। তন্দ্রাকে দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। সেও কোনো কথা বলে না, টেবিলে বসে নিজের মতো খেতে থাকে।

স্বাক্ষর আজ বাইক নিয়ে বের হয়েছে। তন্দ্রা বাইকের সামনে আসতেই, কোনো কথা ছাড়াই সে তার দিকে হেলমেট এগিয়ে দেয়। তন্দ্রাও চুপ করে বাইকে উঠে বসে। তারও স্বাক্ষরের প্রতি অভিমান জমেছে। একটু পড়েই তো গিয়েছে; তার জন্য এভাবে বকতে হবে! ভার্সিটির সামনে এসে তন্দ্রা বাইক থেকে নামে।

–টিফিনটা সময় মতো খেয়ে নিও৷

তন্দ্রা স্বাক্ষরের কথার কোনো উত্তর দেয় না। দ্রুত গতিতে পা ফেলে গেইট অতিক্রম করে ভার্সিটির ভিতরে চলে যায়। তার যাওয়ার পানে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে স্বাক্ষর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক নিয়ে চলে যায়। এদিকে স্বাক্ষরের সাথে কথা বলতে না পারায় তন্দ্রার মনটা খুব আনচান করতে থাকে। কোনো ক্লাসই মন দিয়ে করতে পারে না। ক্যান্টিনে বসে কোনো রকমে, বাড়ি থেকে আনা খাবারটুকু খেয়ে নেয়।

ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার পর….

সবে মাত্র তন্দ্রা গোসল করে ভেজা জামা কাপড় গুলো বেলকনিতে মেলে দিয়ে এসেছে। আননোন নাম্বার থেকে অনবরত কল আসছেই। বিরক্ত হয়ে ভাবছে কলটা ধরবে কি ধরবে না। বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে তার বাবার ঘরে যায়। আজ ইউসুফ মাহমুদ অফিসে যাননি। মেয়েকে দেখে তিনি এক গাল হেসে দেন। এরই মাঝে আবারও কল আসে। তন্দ্রা তার বাবার দিকে তাকায়।

–কি হয়েছে মা?
–আব্বু! আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে।
–কই দাও তো দেখি।

তন্দ্রা ইউসুফ মাহমুদ এর কাছে নিজের ফোনটা দিয়ে দেয়৷ মেয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরেন। উনি কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে গানের সূর ভেসে আসছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আসে ইউসুফ মাহমুদ এর। গলার স্বর গম্ভীর করে তিনি বলেন….

–লজ্জা করে না এভাবে একটা বিবাহিত মেয়েকে ফোন করে বিরক্ত করতে। এই শিক্ষা পেয়েছো ছেলে! ব’খা’টে।

ফোনের ওপাশ থেকে স্বাক্ষর হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এসেছিল বউয়ের রাগ ভাঙাতে। এখন দেখছে শ্বশুর মশাই তাকে ব’খা’টে বলে সম্মোধন করছেন। হসপিটালে বসে থেকে পেটে হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসলো৷ কোনো কিছুতেই যেন তার হাসি থামছে না। না জানি রাতে সামনা সামনি দেখা হলে কি করবে। শ্বশুরকে দেখে হাসি আটকে রাখতে পারবে তো! তার বউও হয়েছে এক ব’ল’দ। ওহ স্যরি ব’ল’দিরানী। আননোন নাম্বার হয়েছে দেখেই কি বাবার কাছে ফোন ধরিয়ে দিতে হবে।

রাতে স্বাক্ষর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরে৷ দুপুরে ঠিক ভাবে খাওয়া হয়নি। খুব ক্ষিধেও পেয়েছে তার৷ ঘরের ভেতর এসে দেখে তন্দ্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেনী করছে৷ মুহূর্তেই তার দুপুরের কথা মনে পড়ে যায়। গম্ভীরমুখে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে৷ এদিকে তন্দ্রা তার সাথে কথা বলবে না বলে পণ করেছে। সারাদিনে নিজ থেকে একটাবার কলও করেনি সে স্বাক্ষরকে। দ্রুত বেনী করা শেষ করে সে৷ স্বাক্ষর শার্টটা খুলে বিছানার উপর রেখে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তন্দ্রা তার নীরবতা দেখে মনে মনে ভাবল….

–তার আবার কি হলো? রাগ তো দেখানো উচিত আমার। আর সে কি-না মুখটাকে গম্ভীর করে রেখেছে।

কিছুক্ষণ পর স্বাক্ষর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ক্লান্তি ভাবটা অনেকটাই কমে গেছে৷ ঘরের এসি আগে থেকেই অন করে রাখা৷ হাল্কা মাথা ব্যথা করছে তাই সে টাওয়ালটা একটা চেয়ারের উপর রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ রেখে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে বলে…

–মাথাটা একটু টিপে দিবে তন্দ্রাবতী?

স্বাক্ষরের এমন আদুরে আবদার না রেখে কি কোনো উপায় আছে? তন্দ্রা তার মাথার কাছে গিয়ে বসে। স্বাক্ষর একবার তাকিয়ে, তন্দ্রার কোমড় জড়িয়ে শুয়ে থাকে। তন্দ্রা আলতো হাতে স্বাক্ষরের মাথার চুলগুলো আস্তে আস্তে টেনে দেয়৷ স্বাক্ষর এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। একটু ভালো লাগছে এখন।

–তুমি খাবে না?
–হুম।
–উঠো তাহলে।
–তার আগে আমাকে এটা বলো, দুপুরে যখন আমি কল দিয়েছিলাম তখন তুমি ফোনটা ছোট আব্বুর কাছে দিয়েছিলে কেন?
–কই দুপুরে তো তুমি কল দাওনি।

স্বাক্ষর মুখ তুলে তাকায় একবার। এরপর উঠে তন্দ্রার ফোনে সেই আননোন নাম্বারটা দেখায়।

–এটা তোমার নাম্বার?
–হ্যাঁ।
–আমি তো ভাবছিলাম কে না কে?

স্বাক্ষর তার কপাল চাপড়ে বলে…

–আর ওমনি ধেইধেই করে ছোট আব্বুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলে। আর আমার ভোলাভালা শ্বশুর আমাকে ব’খা’টে বলে সম্মোধন করলেন। গান গাওয়ার মুডটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আনরোমান্টিক বউ একটা।

স্বাক্ষরকে আফসোস করতে দেখে তন্দ্রার তো হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম। মানে হচ্ছে তার বাবা যাকে ব’খাটে বলে শাসিয়েছে সে আর কেউ না, তারই গুনধর “গম্ভীর মহারাজ” নিজেই। হাসি যেন পেট ফে’টে বের হতে চাইছে।

–এখন উঠো। সবাই হয়তো আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে।
–যাচ্ছি।

ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসেছেন৷ স্বাক্ষর, তুলি আর ইলিয়াস মাহমুদ পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে। উনাদের মুখ বরাবর তন্দ্রা আর ইউসুফ মাহমুদ বসেছেন। তন্দ্রা চুপচাপ তার বাবার পাশে বসে থেকে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইউসুফ মাহমুদকে দেখে স্বাক্ষর কিছুতেই দুপুরের কথাটা মন থেকে মুছতে চাইছে না। হাড় ফে’টে যেন হাসি বের হয়ে আসতে চাইছে। তন্দ্রারও ঠিক একই অবস্থা৷ স্বাক্ষরের হাসি আটকাতে গিয়ে বারবার কাশি উঠে যাচ্ছে। খাওয়া ছেড়ে সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে হাসতে হাসতে তন্দ্রা বেচারির অবস্থা খারাপ৷ তাহেরা মাহমুদ কপট রাগ দেখিয়ে বলেন….

–ছেলেটা কাশি উঠেছে। কই পানি দিবি তা না, গাধার মতো হাসছিস।

মায়ের চোখ রাঙানো দেখে তন্দ্রা চুপ হয়ে যায়। তবুও যেন তার হাসি থামছে না। মুখ টিপে হাসছে অনবরত। স্বাক্ষর পানি খেতে খেতে তন্দ্রার দিকে তাকায়। ইশারায় যেন বুঝিয়ে দেয় “একবার ভাগে পাই”। তন্দ্রা হাসা বন্ধ করে, কোনো রকমে রাতের খাবারটুকু খাওয়া শেষ করে। স্বাক্ষরের আগে সে খাওয়া শেষ করে ঘরে আসে। তাড়াতাড়ি করে ঘরের লাইট অফ করে কম্বলের নিচে ঘাপটি মে’রে শুয়ে থাকে। এমন একটা ভাব করে যেন, বুঝাচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। স্বাক্ষর ঘরে এসে দেখে ঘরের লাইট অফ; তন্দ্রা বিছানায় শুয়ে পড়েছে আগেই। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় কিছুটা বুঝা যাচ্ছে। সে দরজা আটকে বিছানায় আসে। এক টানে কম্বল সরিয়ে দেয়। তন্দ্রার এতে কোনো হেলদোল নেই। এই মুহুর্তে স্বাক্ষরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, সে যে জেগে আছে। তন্দ্রার অনেকটা কাছে এগিয়ে গিয়ে স্বাক্ষর, তার গলায় একটা লাভ বাইট দেয়।

–রাক্ষস আমাকে খেয়ে ফেললো গো।
–খুব তো হাসা হচ্ছিল আমার উপর। এটাই তোমার শাস্তি। এখন সারারাত আমার পা টিপে দিবে।
–পারবো না।
–স্বামীর আদেশ অমান্য করবে?
–হুহ।

তন্দ্রা মুখ ভেংচি কে’টে স্বাক্ষরের পা টিপে দিতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিজের কাছে টেনে নেয়৷ কপালে উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে, গাঢ় আলিঙ্গনে লেপ্টে থাকে দুজনে।

চলবে?…….