#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___১৫
প্রহর হালকা ভেজা তোয়ালেটা আনল বাথরুম থেকে। নিশাত তখনও বিছানায় শুইয়ে আছে। এতটা সময় প্রহরের অর্ধ উদোম দেহটা ছিল তার ওপর। দেহ দু’টোর দুরত্ব ছিল, ছুঁয়ে দেয় নি তবুও বিনা স্পর্শে সমগ্র দেহ শিউরে উঠছিল বার বার। ভয়ে এখনো হৃৎপিণ্ডের লাব ডাব, লাব ডাব শব্দ ক্রমাগত বাড়ছে। উঠতে পর্যন্ত পারছে না। চিকন শরীরটা ভয়ের ঠ্যালায় কমজোর হয়ে পড়েছে। প্রহর নিঃশব্দে ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে একত্রে করে নিল। কব্জিতে ক্ষীণ ব্যথা অনুভূত হলো ওর। তবুও চুপসে রইল সে। তোয়ালে দিয়ে হাত বাঁধতে দেখে কণ্ঠস্বর কাঁপল,
‘ কি করছেন?’
‘ চুপ। ‘
সশব্দে ধমকে উঠে প্রহর। কণ্ঠে ক্রোধ, ঝাঁঝ। নিশাতের অন্তঃপুরের অবস্থা শোচনীয়। চোখ থেকে ফটাফট অশ্রু গড়াতে লাগল। কাজল লেপ্টে গেল। মাথার ক্রাউন সরে গিয়ে চুল এলোমেলো। প্রহর হাত বেঁধে টেনে উঠে বসাল ওকে। বলল,
‘ তোর জন্যই আমার মেজাজের গতিবিধির পরিবর্তন হয়। তোর জন্যই মুড নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তোর জন্যই তিন বছর আগে বার্থডে সেলিব্রেট করা বন্ধ করেছি। এখন তুই এসেছিস ঊষার কথায় সেজেগুজে আমাকে উইশ করতে? জুতা মে””রে গরু দান? একদম কাঁদবি না। ‘
দশম শ্রেণী পড়ুয়া গ্রামে বড় হওয়া নিশাতের আজও তেমন বুঝ হয় নি। তবে এটা অনুধাবন করল প্রহর ভাই একটুও বদলায় নি,আগের মতোই নি””ষ্ঠুর ওর সাথে। কান্না বন্ধ করতে গিয়ে আরো বাড়ল। আওয়াজবিহীন, নিঃশব্দে গাল ভিজিয়ে গলা বেয়ে বুকে এসে ঠেকছে অশ্রুবিন্দু। প্রহর ফের চাপা গর্জন করে,
‘ কাঁদলে শা””স্তি দ্বিগুণ হয়ে যাবে নিশু। চুপ,চুপ। আমি খারাপ জানিস না? তোকে সহ্য করতে পারি না আমি। তোদের বাড়িতে গেলে মামু অপমান করে। তোর মুখ দেখলে মামুর মুখ মনে হয়,তাই তোকে অসহ্য লাগে। আবার তিন ফুটের শরীরে একটা ডাবল সাইজের গাউন পড়েছিস। বি*শ্রী লাগছে দেখতে। ‘
নিশাত নাক টানছে। পা*গল লাগছে তার প্রহরকে। এত সুন্দর করে সেজেগুজে এসে উইশ করার পর কেউ এমন ব্যবহার করতে পারে! থাকবে না ও এখানে। অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নুইয়ে রেখে কম্পনরত গলায় বলে,
‘ আম,,আমি চলে যাব। ‘
‘ যা। ‘
নিরলস,স্থির কণ্ঠস্বর। মস্তিষ্কে আগুন জ্বলছে প্রহরের। সাহস কি করে হলো এই মেয়ের এত সেজেগুজে আসার! নিশাত বাঁধা হাত নিয়ে ভারী গাউনে ধীরস্থির পায়ে হাঁটছে। ফিরে একবার প্রহরের দিকে তাকায়। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসছে। অল্পতেই বড্ড আ ঘাত পেয়েছে ওর অপরিপক্ক মনটা। জ্ঞান, বুঝ ধ্যানও তো পুরোপুরি হয় নি ওর। সবে যখন হওয়া শুরু তখন থেকেই প্রহরের দ্বারা রীতিমতো অত্যা-চারিত হয়ে আসছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দেহটা টেনে সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজায় এসে থমকে দাঁড়ায়। আরেকটু হেঁটে গেইট অব্দি আসে। দারোয়ান ওকে দেখে গেইট লাগিয়ে দেয় সাথে সাথে। বিনয়ী আচরণ করেন। বলেন,
‘ আপনি যেতে পারবেন না। ‘
ছোট ছোট আকৃতির চোখ দু’টো লাল নিশাতের। কিশোরী মন জেদ দেখিয়ে বলে,
‘ আমি চলে যাব। গেইট খুলে দিন। ‘
‘ আপনাকে যেতে দিতে নিষেধ। ‘
‘ কে মানা করেছে? ‘
‘ আমি। ‘
পেছন থেকে চেনা স্বর শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছাতেই তড়াক করে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে প্রহর। খালি শরীরেই চলে এসেছে। নির্লজ্জ লোক। সামনের দিকে পা বাড়াতেই প্রহর ওকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করল। নির্বাক,স্তব্ধ সে। নড়ল না। যা মর্জি হয় করুক, কথা বলবে না ও। রুমে এনে ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে উঠল,
‘ তুই যেতে পারবি না। আমার মন ঠিক হয়েছে, শা-স্তি দেবো না তোকে। আমি যেহেতু এনেছি, রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতে হবে৷ রাজনীতিবিদের কর্মই জনগণের সেবা করা। সেই হিসেবে তুইও সেবার অন্তর্ভুক্ত। ‘
নিশাত নিশ্চুপ থাকবে বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। চোখ ফুলে গিয়েছে তার। প্রহর বেড সাইডের টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে ওর কাছে আসল। চিবুকে আঙ্গুল চেপে ধরে ফ্যাকাসে মুখশ্রীটা তুলে ধরে নিজের দিকে। দুই জোড়া চোখের মিলন ক্রিয়া ঘটতে ঘটতে অসমাপ্ত থেকে যায়। শানিত চাহনিতে চোখ রাখতে পারে না নিশাত। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হয়ে আসে তৎক্ষনাৎ। শ্যাম পুরুষের রোষপূর্ণ চাহনি ওর নরম হৃদয়স্থে গভীর দাগ কাটে। প্রহর টিস্যু দিয়ে গালের কালি মুছে দিয়ে বলে,
‘ তুই সাধারণ থাকলে আমার খারাপ লাগে,অসাধারণ হলে আরো বেশি খারাপ লাগে। সবদিক থেকে তুই আমার খারাপ করিস,তাই আমি তোকে বাঁচাতেই তোর সাথে খারাপ করতে হয়। ‘
নিশাত এরকম রহস্যজনক কথার মানে ধরতে পারে না। নিরবতা ভঙ্গ করে তীব্র অভিমান, ব্যথা নিয়ে দৈবাৎ বলে উঠে,
‘ আমি পিংকির কাছে যাব। ‘
প্রহর তোয়াক্কা করল না। উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘ খালি হাতে উইশ করতে চলে এলি,কেক কই?’
‘ ঊষা আপুর কাছে। ‘
বালিশের পাশ হতে মোবাইলটা নিয়ে প্রত্যয়কে কল লাগাল প্রহর। রিসিভ হতেই হ্যালো বলাতে সময় নষ্ট করল না। বরং এক বাক্যে আদেশ করল,
‘ কেক টা নিয়ে আমার রুমে আয়। ‘
ঊষা ছাঁদের উপর থেকে নিশাতের কান্নামুখ,ভাইয়ের কান্ড দেখেছে। প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে। ওর পেছন পেছন আসে আরুশি, তুবা,নাহিদ সকলে। দরজার সম্মুখে ভিড় জমায় সবকটা। ওই তো অপরা-ধীর ন্যায় বিছানায় বসা নিশাতকে দেখা যাচ্ছে। ঊষার মনে বিষন্নতাদের প্রবেশ হয়। সে ভেবেছিল নিশাতের প্রতি ভাইয়ের দুর্বলতা আছে,নিশাতকে মানবে কিন্তু হলো তার ব্যতিক্রম। মেয়েটার কি হাল করেছে! মায়া হয়। প্রহর গায়ে টি শার্ট জড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকায়। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,
‘ কেকটা রেখে যা প্রত্যয়। ‘
কেকটা রেখে প্রত্যয় করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নিশাতের দিকে। অনুমতি চায়,’ নিশুকে নিয়ে যাই ভাই?’
জবাব আসে,’ ও এখানেই থাকবে,তোরা যা। ‘
নিমিষে নিশাতের ঠান্ডা কণ্ঠ শুনে প্রত্যয়,’ আমাকে নিয়ে যাও ভাইয়া। ‘
‘ তুই এখন এই রুম থেকে বের হলে সুস্থভাবে গ্রামে ফিরতে পারবি না৷ তুই যা প্রত্যয়। ‘– শান্ত গলায় থ্রে/টমূলক বাক্য।
প্রত্যয় বেরিয়ে এসে ঊষার ওপর চিৎকারের মেলা জুড়ে দিল। রেগেমেগে আগুন সে, ‘ তোকে কতবার বলেছি এটা কোনো মজা না। তিন বছর আগে কোনো মজার ঘটনা ঘটে নি ঊষা। ভাইকে নিজের চরিত্রে দাগ বহন করতে হয়েছে। চরিত্রে দাগ লাগলে কেমন লাগে সেটা যার সাথে ঘটে সেই বুঝে। নিশুকে পাঠিয়ে ভুল করেছিস। আমি তোকে নিষেধ করেছিলাম। ‘
ঊষা সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ভুলটা ওরই। ভাবে নি প্রহরের জন্মদিনের প্রতি অগাধ জেদের জন্য নিশাত জড়িত। সেই মেয়েটাও তো জানে না।
.
.
প্রহর ড্রয়ার থেকে বড়সড় একটা ছু রি বের করে। নিশাতের গলা শুকিয়ে এলো সেই দৃশ্য চক্ষু আয়নায় আঁটকাতেই। প্রহর ভাইয়ের ওপর তার আর কোনো বিশ্বাস অবশিষ্ট নেই। এই মেঘ,এই বৃষ্টি টাইপ অবস্থা লোকটার। উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ আমি যাব না প্রহর ভাই। এখানেই থাকব,সারারাত থাকব।’
প্রহর চেয়ার টেনে কেকটা হাতে নিয়ে ওর মুখোমুখি বসল। ছু রি দিয়ে কেকটা কেটে এক পিস নিশাতের লাল ওষ্ঠযুগলের সন্নিকটে ধরে প্রশ্ন করে,
‘ সারারাত থেকে কি করবি? তুই সারারাত থাকলে আমি চরিত্রহীন হয়ে যাব। থাকতে পারবি না তুই। কেক খা। ‘
নিশাত বিস্ময়াবিষ্ট। প্রহর ভাইয়ের ওপর নয়,নিজের ওপর। প্রহর ভাই সর্বদা উল্টাপাল্টা বলেন কিন্তু ওর কেন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে? প্রহর ভাই চোখ রাঙালেও তার কান্না চলে আসে,একটু নরম হয়ে কথা বললে শান্তি লাগে। এই মানুষ টা সবসময় তার সাথে নরম ব্যবহার করলে এত ভয় পেতে হত না ওর। কিন্তু ওকে কাঁদাতে, মা*রতে,বকতে,অপমা*ন করতেই ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। এটাই কঠিন, নির্ম””ম সত্য।
‘ খাব না। ‘
‘ কেন খাবি না? ‘
নিশাত খানিকক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,
‘ যার জন্মদিন সে আগে খায়। ‘
‘ আমার মতো বুড়োলোকের আবার কিসের জন্মদিন? ‘
নিশাত হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনি বুড়ো?’
‘ তোর কি আমাকে জোয়ান লাগছে?’
‘ বুড়ো হলেন কীভাবে?’
‘ মহানন্দ গ্রামের রফিক আজম নামের এক বুড়ো আমাকে বলেছে তার মেয়ের তুলনায় আমি বুড়োলোক। তাই ভাবছি তোর জন্য কচি দেখে একটা ছেলে দেখব। ফুপাতো ভাই হয়ে মামাতো বোনের বিয়ের দায়িত্ব না নিলে জীবন বৃথা। ‘
নিশাত কিছু বলতে নিবে প্রহর ওর মুখে কেক ঢুকিয়ে দিল৷ শুধু এটুকু না৷ একের পর এক কেকের পিস খাওয়াতে শুরু করে। মেয়েটা ঢোক গিলে বলে,
‘ প্রহর ভাই, আর খাব না। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ‘
‘ তুই খাবি। আমি কেক খাই না। টাকা দিয়ে কিনে এনে নষ্ট করার কোনো মানে হয়? আমি তোর জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসব৷ ‘
‘ পেট ব্যথা করছে। ‘
‘ ওষুধ কিনে দেবো। ‘
‘ আর খেলে বমি চলে আসবে। ‘
‘ বমি হলে হবে। ‘
নিশাত উপায়ন্তর না পেয়ে বাঁচার জন্য ভ”য়ংকর এক ঘটনা ঘটালো। মুখ গুঁজে দিল প্রহরের বুকে। কেক টা পড়ে গেল মেঝেতে। খাবে না আর সে। বুকে মুখ গুঁজে রাখলে কীভাবে খাওয়াবে প্রহর ভাই? অধর জোড়া লুকিয়ে রাখল অতি সন্তর্পণে বুকে। প্রহরের ভারী কণ্ঠ শোনা যায় তক্ষুনি,
‘ যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছিস তুই নিশু। ‘
যুদ্ধ লাগলে লাগুক,মুখ আর তুলবে না ও। প্রহরের বদ কান্ড থেকে রক্ষা পেতে এছাড়া আর রাস্তা খোলা দেখতে পায় নি সে। চারদিকে কেবল ছিল অন্ধকার।
————————–
খাবার টেবিলে মোশতাক সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নিশাতের৷ ফর্মালিটি ব্যতীত বাড়তি কোনো কথা বের হলো না উনার মুখ থেকে। এতে আহত অনুভব করে ও। তার আসাটা বোধহয় উনার পছন্দ হয় নি। আবার হতে পারে উনি অল্পভাষী। মন্ত্রী মানুষ, গম্ভীর গম্ভীর ব্যাপার টা জায়েজ। রাতে আর কি হয়েছিল তার মনে নেই। সকালে নিজেকে নিজের রুমেই পায়। শিথানের পাশে বসা ঊষার দেখা মিলে ঘুমে ভরপুর চোখ দু’টো মেলে ধরতেই। বার কতক অপরা-ধীর ন্যায় ক্ষমা চেয়েছে ঊষা। তার বেশ লজ্জা লাগছিল ঊষার এভাবে ক্ষমা চাওয়ায়।
প্লেটে দেওয়া দু’টো রুটি থেকে একটু একটু ছিঁড়ে নিয়ে মুখে তুলছে,সাথে কিচ্ছু নেই। খাবারে বেশ অনীহা কাজ করছে,মনের হাল ভালো না মেয়েটার। থেকে থেকে প্রহরের বক্ষে ঠোঁট গুঁজে দেওয়াটা মনে পড়ছে শুধু।
মোশতাক সাহেব প্রত্যয়ের সাথে মিটিং নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ প্রহর উঠেছে? ‘
প্রত্যয় নম্র স্বরে প্রতুত্তর করল,
‘ভাই ঘুমাচ্ছে। ‘
‘ ওকে একটু ডেকে দিলে ভালো হতো। রাতে কথা বলতে পারি নি,আর্জেন্ট কথা আছে। ‘
‘ আচ্ছা আমি যাচ্ছি। ‘
‘ নাস্তা শেষ করে যাও। ‘
ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে হাজির হয় প্রহর। টেবিলের উপর থেকে আপেল নিয়ে একটা কামড় বসাল। মোশতাক সাহেব পেপারে চোখ বুলিয়ে একটা পেইজে এসে থামলেন। চিহ্নিত করে একটা অংশ দেখিয়ে বললেন,
‘ এই মেয়ে তোমার রাজনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। শ–ত্রুপক্ষের মেয়ে বলে কথা। তাছাড়া প্রস্তাব টা তোমার প্রতিপক্ষ নিজেই রেখেছেন। দিস ইজ অ্যা গোল্ডেন অপরচুনিটি ফর আস। ‘
প্রত্যয় কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটে,
‘ একটা মেয়েকে টার্গেট না করলে হয় না?’
‘ মেয়েকে টার্গেট করা হলো কোথায়? সে আমার বউ হতে যাচ্ছে। ‘— সোজা কথা প্রহরের।
মোশতাক সাহেব বললেন,’ দেখা করতে যাচ্ছ তাহলে?’
প্রহর চেয়ারে বসে ঊষাকে এক কাপ কফি দিতে বলল। নিশাতের প্লেট থেকে একটা রুটি নিয়ে নিল নিজের প্লেটে। নিশাত হতভম্ব। সামনে দশ থেকে বারোটা রুটি রাখা অথচ ওর থেকেই নিতে হলো! প্রহর ডালভাজি নিতে নিতে বলল,
‘ যাব,বিকালে। নিশুকে নিয়ে যাব সাথে। ‘
‘ ও কেন যাবে?’
মোশতাক সাহেব অবাক হলেন। নিশাতকে প্রহরের রাজনীতির পথের কাটা মনে হয় তাঁর। তিনি চান প্রহর বড় হোক,রাজনীতিতে রাজত্ব করুক। প্রহর মুখের খাবার টা গিলে তেজহীন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মোশতাক সাহেবের দিকে। বলে,
‘ ফুপাতো ভাইয়ের হবু বউ দেখতে। ‘
নিশাত এক দুঃসাহস করে বসল। গলা উচাঁলো একটুখানি,
‘ আমি যাব না৷ ‘
সহসা কথার পৃষ্ঠে শুনতে হলো,
‘ তুই বউ না দেখতে গেলে আমি বিয়ে করব না। আমার বিয়ে না করার দায় মাথায় নিতে হবে তোর। ‘
নিশাতের চিল্লিয়ে বলতে মনস্পৃহা জাগে,’ আপনি বিয়ে না করলে আমার কী প্রহর ভাই? আপনি বিয়ে করলেই বা কী? আমার কেন মন খারাপ লাগছে?’
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____১৬
‘ কিরে তুই নাকি চাচ্চুর বাসায়?’
শিমুলের হন্তদন্ত,ব্যগ্র গলা শুনে ঘাবড়ে গেল নিশাত। কল দিয়ে হ্যালো না,সোজাসাপ্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মা র ল মেয়েটা। কথা বলার ইচ্ছে নেই ওর শিমুলের সঙ্গে। সে কেন কোনোদিনও বলে নি প্রহর ভাইয়ের পছন্দের মানুষ, প্রেমিকা আছে? প্রিয় বান্ধবীর প্রতি ভারী অভিমান জড়ো হয়েছে মনে। নরম গলায় বলে,
‘ হু। ‘
অপর পাশ থেকে শিমুলের দ্বিগুণ তেজী কণ্ঠ,
‘ তুই ভাইয়ার সাথে চাচ্চুর বাসায় গেলি, অথচ আমাকে বললি না। অনেক পর হয়ে গেছিস তুই নিশু। ঊষা আপুর সাথে কথা না হলে কখনো জানতেই পারতাম না আমি। আদৌ তুই বলতি কিনা সন্দেহ আছে। ‘
‘ তুইও তো আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিস কথা। বলিস নি প্রহর ভাইয়ের পছন্দের মানুষ আছে। ‘
ওইপাশে বোধহয় বজ্রপাত পড়েছে এবং তা ঠিক শিমুলের ওপর। নিশাতের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
‘ কি তুই জেনে গিয়েছিস?’
‘ হ্যাঁ। আজ প্রহর ভাই আমাকে ওনার হবু বউ মানে পছন্দের মানুষকে দেখাতে নিয়ে যাবেন। আমি গিয়ে কী করব বল? যাব না আমি। ‘
‘ ভাইয়ার বউকে তুই আগে আগে দেখে ফেলবি এটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। ‘
‘ কেন তোরা দেখিস নি?’
‘ দেখেছি হাজার বার ভাইয়ার চোখে তার জন্য পেয়ার। ‘
শিমুলের গানের সুর শ্রবণ হওয়া মাত্র নিশাতের মনের ঘরের চাল ফুটো হয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে থাকে, বিরতিহীন। সকালে নাস্তার টেবিলে প্রহরের বিয়ের কথা শুনে অজানা মন খারাপেরা প্রবল আস্থা নিয়ে বসত গড়েছে দীর্ঘদিন থাকার। নিভে যাওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ তোর ভাবী কেমন?’
তৎক্ষনাৎ শিমুলের গর্বিত কন্ঠস্বর শ্রবণপথে এলো,
‘ প্রহর ভাই যদি হয় ডায়মন্ড? সে হলো প্লাটিনাম। এজন্যই ভাইয়া হয়তো তাকে এত চায়। জাস্ট মুখে বলে না। ‘
নিশাতের বিষন্ন স্বর,’ ওহ। ‘
‘ হু। এবার বল কেমন বোধ করছিস ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে? ‘
নিশাত ঠাশ করে ফোন রেখে দিল। নতুবা মুখ খুলে বেরিয়ে আসত, ‘ খুব জঘন্য, খুবই জঘন্য অনুভব করছি আমি। ‘
প্রহর ভাইয়ের প্রেমিকা,বউ থাকা নিঃসন্দেহে ওর জন্য খুশির সংবাদ। তবে এত কেন খারাপ লাগছে? বক্ষস্থল চিরে সূক্ষ্ম একটা ব্যথার সৃষ্ট হয়েছে। সবাই জানে উনার প্রেমিকা আছে তাহলে সে কেন জানে নি? খোঁজ খবর রাখে নি বলে? ও মনকে বুঝ দিল ছোটবেলা থেকে অপ”মান,মা-ইর দিয়ে আসছে তাই একটু আধটু বিষন্নতার ছোঁয়া হাজির হয়েছে মন দুয়ারে। বউ পেলে ওর প্রতি কি আর আগ্রহ থাকবে প্রহর ভাইয়ের? তখন স্বাধীন জীবন৷ উৎফুল্ল মনে উনার বউ দেখতে যাবে ও। অগ্রিম একটা নাচও শিখে ফেলবে। খুব ভালো নাচ পারে নিশাত। দরকার পড়লে সৌরভ ভাইয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঢাকা থেকে শপিং করবে বিয়ে খাওয়ার জন্য। তারপর সে স্বাধীন, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুলে সবাইকে ট্রিটও দিবে। বিয়ের দিনটাকে ” নিশুর স্বাধীনতা দিবস” বলে ঘোষিত করবে। সব প্ল্যান ঠিকঠাক, একদম ঝাকানাকা। এখন শুধু বাস্তবায়নের পালা।
নিশাতের এত এত প্ল্যানে বিঘ্ন ঘটে মিনিট খানেক বাদেই। বুকের বা পাশে অবস্থিত হৃৎপিন্ড তার মালিকের সাথেই শুরু করল তীব্র বেই-মানি। যেদিকে তাকায় নিশাতের মনে হচ্ছে সেদিকে এক বোতল বি-ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। এক্ষুণি তেড়েফুঁড়ে এসে বলবে, ‘নে বি-ষ খেয়ে ম*রে যা। তোর হাবভাব ভালো না। যদি আমার বিয়েতে বাঁধা হোস? তার আগেই বল বিদায় দুনিয়া। ‘
সইতে না পেরে কিশোরী মনের উতালপাতাল ঢেউ নিয়ে ও গিয়ে উপস্থিত হলো ঊষার রুমের সামনে। ঊষা সবে মেডিকেল থেকে ফিরেছে। একটা জরুরি ক্লাস ছিল। ফলস্বরূপ নিশাতকে বাড়িতে রেখে যেতে হয়েছিল এক ঘন্টার নিমিত্তে। এপ্রোন টা খুলে বিছানার উপর রাখতে নিয়ে দরজার সম্মুখে নজরে পড়ে নিশাতের বিরস, মলিন চেহারায়। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড হলুদ পাখি?’
‘ আমি পিংকির কাছে যাব আপু। আমাকে পিংকির শ্বশুর বাড়ি দিয়ে আসো। ‘
দুর্বল কণ্ঠস্বর শুনে ঊষা থমকালো। অন্যের কষ্ট বুঝতে মোটেও সমস্যা হয় না তার। এগিয়ে এসে বলল,
‘ যাবে তো সন্ধ্যায়। ভাইয়া সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে যাবে। দিন টা থাকো। ‘
অভ্যন্তরীণ হাস ফাঁস দেখানোর উপায় নেই নিশাতের। জেদ ধরল,
‘ আমি এখনই চলে যাব। ‘
‘ কেউ কিছু বলেছে?’
‘ না আপু। বাবা জেনে গেলে সমস্যা, চলে যাওয়া ভালো।
‘ পিংকির হাসবেন্ড সামলাচ্ছে পিংকিকে। ও তোমার খোঁজ করে নি। কথা হয়েছে প্রত্যয় ভাইয়ার তার সাথে। তাছাড়া প্রহর ভাই থাকতে কীসের টেনশন? ‘
‘ ইনিই সবথেকে বড় টেনশন। ‘– নিশাত গোপনে, মনে মনেই বাক্যটা আওড়ালো। হালকা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় নড়ল ক্ষীণ,
‘ আমাকে প্লিজ দিয়ে আসো আপু। ‘
ঊষা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা কেঁদে দিবে এমন মুখোভঙ্গি। কোমল হৃদয়ের প্রাণ। সকালে প্রহরের কথাগুলো শুনেছে ও। কিন্তু তার জানামতে নিশাতের মনে প্রহরের জন্য কোনো ফিলিং নেই। এতদিন ভেবেছিল প্রহর ভাইয়ের দুর্বলতা আছে নিশাতের প্রতি কিন্তু ভাবনার ফলাফল শূণ্য, ভুল। যদি থাকত তবে কি এক বাক্যে বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হত! রাজনীতিবিদের তকমা গায়ে মেখে অত্যন্ত কঠোর হয়ে গিয়েছে মানুষটা। কণ্ঠে আহ্লাদ ঢেলে বলল,
‘ নিয়ে যাব তোমাকে পিংকির কাছে। যাও তৈরি হয়ে নাও। ‘
ঊষা নিশাতকে নামিয়ে দিয়ে গেল। পিংকির বাড়ির লোকেশন ও জানত না। প্রত্যয়কে ফোন দিয়ে জেনে নেয়। প্রত্যয় অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরও সে বলে নি কেন এড্রেস প্রয়োজন। শুধু বলেছে লাগবে মানে লাগবেই। মৃন্ময়ীর জন্য অপেক্ষায় ছিল বলে আর এত ঘাটতে যায় নি সে ব্যাপারটা৷ ফেরার পথে ঊষার নজরে পড়ে বিলবোর্ডে টানানো সমীরণের গম্ভীরভাব মিশ্রিত মুখশ্রী খানা। কালো পাঞ্জাবি পরিধান করে এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে চেয়ে আছে নিষ্পলক হাসোজ্জল এক রমণীর পানে। সেই রমণীও নামকরা মডেল দিবা৷ সমীরণ নামের গম্ভীরমুখো লোকটার দু’টো রূপ আছে। ভদ্র সমাজের সামনে এক,মেয়ে মানুষের সমুখে অন্যরূপ। শ্বেত পাথরের ব্রেসলেট পড়া হাতের দিকে তাকাল ঊষা। হাসি পেল ঘটনাটা মনে আসতেই। এই হাত দিয়েই সমীরণের গালে সপাটে এক চ*ড় বসিয়েছিল সে মাস তিনেক পূর্বে। মুখোশধারী এই পুরুষ রাজনীতিতে আবার প্রহর, প্রত্যয়ের বিরাট বড়ো শ ত্রু। একে অপরকে খু**ন করতেও হাত-পা কিছু কাঁপবে না।
———————————
নিশাতের ভেতরকার উচাটন কমার বদলে বেড়ে গেল। এখানে এসে হাল হলো নাজেহাল। অবস্থা পুরোই বেগতিক। বার কতক চিন্তায় লিপ্ত হয়েছে প্রহর ভাই কি গিয়েছে দেখা করতে? এত এত চিন্তার কারণ নেই ওর নিকট। অথচ প্রহরের সান্নিধ্যে অন্য নারী ভাবলেই সমস্ত দেহ কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। আসার পর গিয়েছিল পিংকির সাথে দেখা করতে। দেখেই পিংকি লোক দেখাতে ঝাপটে ধরল। অতঃপর কানের কাছে মুখ নিয়ে তির্যক বাক্য ছুঁড়ে দেয়,
‘ তুই আমার শ্বশুর বাড়ি এসেই ঘুমানো শুরু করলি? তুই নাকি আসার পরই এখন পর্যন্ত নাক টেনে ঘুমিয়েছিস, কারিম বলল। ‘
নিশাত মুহূর্তেই হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কারিম কে?’
‘ আর কে? তোর দুলাভাই, আমার জামাই। আর ঘুমাইস না বইন। মান সম্মান থাকবে না। ‘
নিশাতও ফিসফিস করে বলে,
‘ তোর মান সম্মানের পরোয়া করে কে? আমি মান সম্মানের ফালুদা,বিরিয়ানি বানাইতে আসছি জানোস না? নইলে তোর জন্য কি মহাব্বত লইয়া ঘুরে বেড়াই যে টানে টানে তোর লগে আসমু? আর একটা কথা বললে এক টুকরাও সম্মান অবশিষ্ট থাকবে না। ‘
পিংকি ভয়ে চুপসে গেল। এমন হাবভাব যেন পৃথিবীতে ওর চেয়ে লাজুক বধূ হতে পারবে না কেউ। দুই অধর আর আলগা হলো না। পিংকির ভয়া-র্ত চেহারা দেখে ক্ষণিকের প্রশান্তি পায় নিশাত। তবে কেবলই অল্পসময়ের জন্য। এ বাড়িতে পিংকির দাদী,নানী,চাচী শ্বাশুড়ি সব আছেন৷ কাল বৌভাতের অনুষ্ঠান বলে বাহিরে প্যান্ডেলের কাজ চলছে। আসার পর একবারও মাহিশার দেখা মিলে নি। অপরিচিতদের মাঝে পরিচিত একটা মুখ দেখলেও স্বস্তি পাওয়া যায়।
.
.
অন্তরিক্ষে ঈষৎ র-ক্ত বর্ণের ছোঁয়া। লজ্জায় গুমোট ভাব ধরেছে গোধূলি প্রহর। রক্তাভ আকাশের বুক চিরে উড়তে লাগল সবুজ বর্ণ ধারণকারী কিছু পাখি। হতে পারে কয়েকটা টিয়া ফিরছে নীড়ে। নিশাত অভিভূত, বিস্মিত। শহুরে পরিবেশে টিয়া! ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে আরেকটু ভালো করে চাইতেই একটা আশ্চর্যতম কান্ড দেখে। টিয়াগুলো নিচ থেকে উড়ে আসছে। নিচে তাকাল ও তড়িঘড়ি করে। একটা ছেলে খাঁচা থেকে একে একে টিয়াপাখি ছাড়ছে। ব্যাপার টা ওকে ভাবালো। মানুষ পাখি ধরে খাঁচায় ঢোকায় আর ছেলেটা ছেড়ে দিচ্ছে! এখানে এসে পিংকির ঘরে এবার দেখেছিল ছেলেটাকে। সম্পর্কে পিংকির মামাতো দেবর হয়ত। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসল ঘটনাটা কাছ থেকে দেখার জন্য। বাচ্চাকাচ্চার দল একত্রে বেশ উৎসুক হয়ে যোগ দিয়েছে এ ঘটনায়৷ ওকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিংকির বোন ইলমি এসে বলল,
‘ আপা,এতক্ষণ কই ছিলি? দেখ,কী সুন্দর পাখিগুলো ছাইড়া দিতাছে। ‘
নিশাত নিচু গলায় প্রশ্ন করল ছেলেটাকে ইশারায় দেখিয়ে,
‘ উনি কে?’
‘ কারিম ভাইয়ের মামাতো ভাই। এনার নামটা অনেক কঠিন আপা। আমি বলতে পারি না। ‘
‘ কী এমন কঠিন নাম যে তুই উচ্চারণ করতে পারিস না?’
‘ তুই গিয়ে ওনার কাছ থেকে জেনে নে। ‘
‘ না,আমি যাব না। ‘
‘ কিন্তু উনি আমারে কইলেন তোরে ডেকে নিয়ে যাইতে।’
হকচকালো নিশাত। কণ্ঠে অবিশ্বাস, বিস্ময়ের সমাহার,
‘ আমাকে?’
‘ হ,আপা। ‘
‘ কেন?’
‘ আমি জানিনা। ‘
ওদের কথার মাঝে ছেলেটা নিজ থেকেই এগিয়ে আসল। পাখির খাঁচায় এখনও এক জোড়া পাখি আছে। বিহ্বল দৃষ্টিতে পাখি দু’টোর দিকে এক পলক চাইল নিশাত৷ প্রশ্ন জাগে,” এ দু’টো কেন ছাড়ে নি?” জবাবটা বাস্তবেই পেল। ছেলেটা ওর দিকে পাখি দু’টো বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘ তোমার জন্য এই এক জোড়া থেকে গেল।’
সরাসরি ” তুমি” সম্বোধনে নিশাত ভড়কে গেল। স্মিত লজ্জাও হলো বটে। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে ইতস্তত অনুভব করে ও। উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলে ছেলেটার রাশভারী গলায় থমকে যায় পা দুটো।
‘ তুমি বলে ডেকেছি কারণ আমার অনেক ছোট তুমি নিশাত। আমি অচেনা হোক বা চেনা ছোটদেরও আপনি করে বলব এত ফর্মালিটি পালন করতে পারি না। একদিন যেহেতু তুমি তে যেতেই হবে আপনি বলে শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট করার মানে হয়? আমি আরাধ্য। পেশায় ডাক্তার আর ছোটোখাটো একটা পাখি হাউজের মালিক। তোমার শুধু নামটা জানি। পিংকি ভাবীর কাজিন সেটা জানি। আর কিছুই জানিনা। পরিচিত হতে চাই। ‘
‘ দু’টো পা,দু’টো হাত,একটা মাথা,আটাশ টা দাঁত আর একটা জলজ্যান্ত নিশাত। আর কি পরিচয় লাগবে পাখিওয়ালা ভাই?’
নিশাতের বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দের শুরু মুহূর্তেই। আরাধ্য ভুরু কুঁচকে পশ্চাতে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রহরকে দেখে ঢিমেতালে বলে উঠল,
‘ ভাই!’
‘ পাখি নিয়ে সাইডে দাঁড়া। তোর সাথে পরে কথা হবে। নিশু আয়। ‘
স্নিগ্ধ পরিবেশ। তবুও ঘামে ভিজে উঠেছে প্রহরের সফেদ পাঞ্জাবি। মুখাবয়বে ক্লান্তির মেলা।
নিশাত নিশ্চুপ। অন্তস্থলে ভ-য় হানা দিয়েছে। প্রহরের এমন পরিবেশে এত শান্ত ব্যবহার সুবিধার ঠেকছে না। হবু বউয়ের সাথে দেখা করে এসেছে কি! কোথায় যেতে বলছে? নড়চড় না দেখে চোখ রাঙাল প্রহর। ভয়ে দ্রুত পায়ে পেছন পেছন আসল। গাড়ির সামনে দাঁড়ানো একটা ছেলে গাড়ির দরজা মেলে দেয়। প্রহর গাড়িতে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ গাড়িতে উঠে বস। ‘
নিশাত মাথা নত করে ফেলল। যাবে না সে। এই গাড়ির ভেতর যাওয়া মানে ঘূর্ণিঝড়। প্রহর ভাই ছাড়বে না ওকে। না বলে,হবু বউ না দেখে জেদ করে এসেছে বলে নিশ্চয়ই মা*রার জন্য নিয়ে যাচ্ছে । ভীত সন্ত্রস্ত স্বর তার,
‘ আমি যাব না। ‘
‘ তুই যাবি, তোর ঘাড় যাবে। আমার হবু বউ দুই ঘন্টা ধরে রেস্টুরেন্টে ওয়েট করছে। তুই চলে এলি এখানে পাখির মালিকের সাথে ভাব জমাতে? একটু ছাড় দিলেই তুই পাখি হয়ে যাস নিশু। বেশি উড়লে আমি কিন্তু স্পেশাল খাঁচা বানিয়ে বন্দিনী বানিয়ে রাখব তোকে। ‘
ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল নিশাত। যাবে না ও। এখান থেকে একবার গ্রামে যেতে পারলে আর জীবনেও প্রহর ভাইয়ের মুখোমুখি হবে না। ভূ-মন্ডলের সবাই ওর কাছে বিশ্বাসের যোগ্য, স্রেফ প্রহর নামক ব্যক্তি ছাড়া। এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যাবে তাহলেই রক্ষা তার হাত থেকে। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে প্রায়, কোমরে শক্ত দুটো পেশিবহুল হাতের চাপ অনুভব করল। পেটেও চাপ পড়ল। ব্যথায় মুখ রক্তশূণ্য,ফ্যাকাসে হলো নিমেষে।
প্রহর কোমর ধরে শূণ্যে তুলে গাড়িতে এনে জাপটে ধরে রাখল। নিশাতের দম বন্ধ হয়ে আসছে। হৃদয়স্থে সেতার বাজছে। এলোমেলো লাগছে খুব। ঘর্মাক্ত,শক্ত বুকে বাঁধা সে কঠিনভাবে। কান্নামিশ্রিত গলায় বলে ওঠে,
‘ আপনি এমন করছেন কেন প্রহর ভাই? ‘
প্রহর আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল। রুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,
‘ তোর জন্য।’
‘ আমি কি করেছি? ‘
‘ দো*ষ করেছিস?’
‘ কি দো-ষ?’
‘ বড় হচ্ছিস না। ‘
নিশাতের কণ্ঠ হতে বেরিয়ে আসল অবাকতা মেশানো প্রশ্ন,
‘ আর কত বড় হতে হবে?’
প্রহরের নির্লিপ্ত জবাব,
‘ যতটা বড় হলে তুই অনুভূতি বুঝতে পারবি, আর তোকে অত্যা–চারের পরিমাণ বাড়ানো যাবে ততটা। ‘
‘ আমার কোমর ব্যথা করছে।
‘ আমি ছুঁলেই তোর কোমর,পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়? কথা বললে একটু পর গলা, ঠোঁট ব্যথা শুরু হবে সুইটহার্ট। ‘
দৃঢ়,কাঠ কাঠ কণ্ঠ। ” সুইটহার্ট! ” নিদারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতির সম্মুখীন হলো নিশাত নিমিষেই। তর সইল না আর ছাড়া পাবার। স্বরনালীতে শক্তির বড্ড অভাব। মিহি কণ্ঠে বলতে চাইল,
‘ প্রহর ভাই, আমি পালানোর চেষ্টা করব না। ছেড়ে দিন প্লিজ। ‘
প্রহরের একই গলা শোনা গেল ফের,
‘ তোকে ছাড়ার হলে কবেই রেহাই পেয়ে যেতি সুইটহার্ট। ‘
#চলবে,,!