#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____২১
নিশাতের হৃদপিণ্ড শ্যাম পুরুষের আদলখানি দেখে বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে উঠল। শরীরটা যেন অসাড়তা লাভ করল নিমিষেই। সুতির সাদা ওড়নাটা চাদরের ন্যায় জড়িয়ে আছে ওর রোগা দেহে। ভ্রু যুগল পার করে ওড়নাটা আঁখিপল্লব প্রায় ছুঁই ছুঁই। তবুও চিরচেনা সেই সৌম্য আর মনোহর চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বেগ পোহাতে হলো না ওর। তার মনে হলো প্রহর এক মাসে অত্যধিক সৌষ্ঠবপূর্ণ হয়েছে। যত বাড়ে দূরত্ব, নয়নাযুগলের পিয়াসা ততই প্রহরকে চক্ষু আয়নায় নতুন করে আবিষ্কার করে যেন। লম্বা সময় ধরে খাবার, ঘুমের অনিয়মে,অযত্নে, অবহেলায় মলিনতা ধারণ করা চেহারায় নির্মল,স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে। দুই দিকে প্রসারিত হয় পাতলা অধরোষ্ঠ। কতটা অনাবিল শান্তি বইছে বক্ষস্থলে ও প্রকাশ করতে পারবে না। কেবল বলতে পারবে তার স্বস্তির এক অংশের মালিক তার প্রহর ভাই। কতকাল শাসন করে না প্রহর, মা*রে না! এই ৩০টা দিন সে নিজের ছোট্টবেলার বুঝ হওয়ার বয়স থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত প্রহরের সকল মা*র,শা-সনগুলোর একেকটা মূহুর্ত স্মরণ করেছে। তার মধ্যে একটা মিষ্টি, মধুর স্মৃতি ওর হৃদয় অত্যধিক নাড়া দেয়।
প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে নতুন নতুন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পর একদিন ফুপুর বাড়ি যায় নিশাত শিমুলের কথায়। বাড়িতে তখন প্রত্যয় এবং প্রহর দুই ভাই উপস্থিত ছিল। উজ্জ্বল সাহেব সেদিন বড় বড় আঁখ এনেছিলেন বাজার থেকে। আঁখ কার কতটা প্রিয় নিশাত জানে না তবে তার এতটাই প্রিয় যে তেঁতুল দেখলে জিভে যেমন পানি চলে আসে? ঠিক তেমনটাই আঁখ চক্ষে পড়লে অবস্থা হয় ওর। আলতা ভাইঝির পছন্দের ব্যাপারে খুব অবগত। প্রত্যয় ছোট ছোট সাইজে আঁখগুলো কেটে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। তার থেকেই আলতা একটা ধরিয়ে দেয় নিশাতের হাতে। বলে,” সবার আগে আমার নিশু টেস্ট করবে আঁখটা মিষ্টি নাকি পানসে। ” ফুপির আদরে আহ্লাদী হয়ে নিশাত কামড় বসায় আঁখে অসতর্কভাবে। তাৎক্ষণিক চিৎকার করে ওঠে,হাত থেকে আঁখের স্থান হয় মেঝেতে। প্রহর রুমে ছিল। চিৎকারে ছুটে আসে বাকি সবার মতোন সেও। নিশাত এর দাঁত ভেঙে মাড়ি থেকে রক্তিম তরল রক্ত ঝরছে। এমতাবস্থায় শিমুল হেসে দিল,সাথে প্রত্যয়ও। আলতা চোখ রাঙালেন দু’টোকে। কড়া সুর তুললেন, ” ফা–জিল দু’টো। আমার মেয়েটার দাঁত ভেঙে গেছে আর তোরা হাসছিস? ” মায়ের কঠিন স্বরে ভাই-বোনের হাসি নিভে যায়। দৃষ্টি কাতর হয়। প্রহর ত্রস্ত পায়ে উদভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে এসে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” ব্যথা করছে তিলবতী? ”
নিশাত চোখে অস্পষ্ট দেখতে শুরু করল। কথা বলা কষ্ট সাধ্য হয়ে দাঁড়াল তার। মিচমিচে কালো মণিজোড়া হতে বড় বড় দু ফোটা জল উপচে গ্রীবাদেশে পৌঁছাল। প্রহরের ছাই রঙা টি শার্টের অল্পটুকু অংশ টেনে ধরে বলল,
” র,,,ক্ত! র,,ক্ত দেখে ভয় লাগছে ভাইয়া। ”
প্রহর কারো পরোয়া না করে তক্ষুনি নিশাতের শরীর টা টেনে মুখটা নিজের শক্ত বুকে গুঁজল। অভয় দিল সে কোমল মিশ্রিত শীতল কণ্ঠে, ” রক্ত দেখা যাচ্ছে আর? দেখছিস তুই? ”
বুকে ঠোঁট গোঁজ করে রাখা বারো বছর বয়সী নিশাত সেই সময়টায় স্রেফ তুমুল নীরবতা পালন করল। ওই ফাঁকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ছুটে এলেন আলতা। প্রহর মায়ের হাতে বক্স দেখে অত্যন্ত আদুরে শব্দ সাজায়। বলে,
” তুই মাথাটা তুলে চোখ বন্ধ রাখবি,ওকে তিলবতী? দু চোখ বন্ধ করে আমার হাতে হাতটা রাখবি শক্ত করে, দেখবি রক্ত নেই, ভয়ও লাগছে না তোর। মানবি তো আমার কথা?”
দাঁতের অসহ্য রকম ব্যথায় মুখে কিছু বলতে পারল না নিশাত। মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বুঝাল। প্রহর বুক থেকে ওকে সরিয়ে কোমরে হাত রেখে টেনে থরথর করে কাঁপতে থাকা দেহটা আগলে রাখল বাহু বন্ধনে। আলতা তুলা বের করে রক্ত মুছে দিয়ে, একটা ব্যথা দূর করার ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন। ভেঙে আসা দাঁতটা তুলে ফেলতে নিলে প্রহর বাঁধা দিয়ে বলে,
” তুমি নিশুকে সামলাও আম্মু। এটা আমি ফেলে দেবো। ”
ছেলের কাছ থেকে নিশুকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেন আলতা। শিমুলের প্রথমে দাঁত ভাঙার কান্ডটা অবলোকন করে হাসি পেলেও পরে বোধ আসে তার মাঝে। নিশাতের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয়। অপরদিকে আলতা দেখলেন প্রহর সব আঁখ নিয়ে বাহিরে ফেলে দিচ্ছেন। তিনি প্রচন্ড বিস্ময়ে আবিষ্ট হলেন। অবাকতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করেন,
” এগুলো ফেলছিস কেন?”
” কারো এসব বা**লের ছাইপাঁশ খেতে হবে না,যা কিনা ক্ষ-তির কারণ হয়। তোমার ভাইঝিকে বলে দিও ওকে আর এসব খেতে দেখলে বাকি দাঁতগুলো আমি ভেঙে ফেলব। ”
আঁখ যে শুধু নিশাতের পছন্দসই তা না,প্রহরেরও অত্যধিক প্রিয় ছিল। সেই প্রিয় খাদ্যকে অপ্রিয় ঘোষণা করে সে সেদিন,সাথে তার দেওয়া থ্রে****টে ভয়কাতুরে নিশাত কখনো আর আঁখ খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে নি মনোমধ্যে ভুলক্রমেও।
সতেরো বছরের দোরগোড়ায় এসে নিশাতের ভাবাবেগ হলো সেদিনকার শা**সন,কথাগুলো ছিল আদুরে শা*সন। না জানি বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে আর কি কি স্মৃতির মর্মার্থ বিশ্লেষণ করতে পারবে! তবে তার এটুকু জীবনের সামান্য পরিমাণ বুঝ থেকে সে উপলব্ধি করেছে এক মারা—ত্মক ব্যধি বাসা বেঁধেছে তার অন্তস্থলে। যাকে এড়িয়ে চলত শাসন, শা*স্তি, মা*রের শঙ্কায়, আজ তার জন্য প্রকান্ড অনুভূতি অনুভব করে। গুটি কয়েকদিনের অন্তর্দেশের যেই ব্যাকুলতাকে আখ্যায়িত করেছে ভালোবাসা নামে,ও জানে না সত্যিই তা কিনা। হৃদয়কুহরে অবিশ্রান্ত জড়ো হওয়া অনুভূতিরা খালি জানে প্রহর থাকলে এ জীবনটা একটু আদুরে শাসনীয় হবে,অল্পখানি কঠোর হবে তবুও! তবুও ওর প্রহর ভাই শুধু ওরই নামে লিখিত থাকবে।
প্রহর বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে, সম্মুখে বড়,মেজো,ছোট মামা ও সৌরভ। রোকেয়া, পিংকির মা,ছোট ফুপি,পিংকি সামান্য দূরে উপস্থিত। নিশাত সদর দরজার কাছটার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহরের তীর্যক চাউনি ওর দিকে খেয়াল করতেই দুর্বল দেহটা হেলে যায় প্রাচীরে। এই নজরজোড়া কেউ দেখেনি,শা-নিত দৃষ্টি দেখেছে কেবল ও। রফিক আজম খ্যাঁক করে উঠলেন,
” কী জন্য আসছ? তাড়াতাড়ি বইলা চলে যাও। ”
প্রহর সহাস্যে পাল্টা প্রশ্ন নিক্ষেপ করল বড় মামার দিক,
” আপনারা বাড়িতে আসা মেহমানকে বসতে দেন না? নাকি বাড়িতে চেয়ার,সোফা নেই?”
রফিক চমকালেন। ভারী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
” বেয়া*দবির সীমা লঙ্ঘন করছো তুমি ছেলে। ”
প্রহর মৃদু হাসে। শ্লেষাত্মক হাসি। বলে,
” ভাগ্নের নাম জানেন না নিশ্চয়ই। এ কারণেই ছেলে সম্বোধন করলেন। প্রহর এজায আমার নাম। ”
প্রহর মন্দ বলে নি। স্মরণিকা নিবাসের প্রতিটা মানুষের প্রতি অদম্য ঘৃ*ণায় কখনো তাদের নিয়ে ঘাটেই নি রফিক। ভাগ্নে, ভাগ্নীর নামগুলো পর্যন্ত ভালো করে জানেন না। উনার ঘৃ*ণার তেজ কমার বদলে বাড়ছেই ক্রমশ। গম্ভীর মুখোভঙ্গি এঁটে বললেন,
” যা বলার বলে যাও। এত প্যাঁচাল করার জন্য তোমার মতোন আজাইরা সময় লইয়া বইসা থাকি না। ”
প্রহর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল খোলা অম্বরের নিচে দাঁড়িয়ে। নিঃশ্বাসটা মিশে গেল প্রকৃতিতে। সকাল সকাল একটা মিটিং শেষ করে ঢাকা থেকে গ্রামে ছুটে এসেছে। গত একটামাস অনেক ব্যস্ততা গ্রাস করে নিয়েছিল তাকে।
রোকেয়া হাতে একটা বেতের মোড়া নিয়ে হাজির হলেন। ভাগিনার জন্য ব্যাপক মায়া তাঁর মনে। স্বামীর জন্য প্রকাশ করতেই পারে না,তবে আড়ালে সুযোগ পেলে হাতছাড়া করেন না। প্রহর মামীর হাত থেকে মোড়াটা নিয়ে বড় মামার সামনে রাখল। নম্র কণ্ঠে বলল,
” বসুন। ”
ক্রু**দ্ধ নজর নিক্ষেপ করল সৌরভ। নিশাত কুঁকড়ে আছে। মস্তিষ্ক ছিদ্র করে ফেলছে প্রহরের উপস্থিতি। অজানা আশঙ্কায় ভীত ও। তড়তড় করে মনে পড়ে গেল শিমুলের বলা বাক্যটা। বক্ষস্পন্দন থমকে গেল প্রায় অবিলম্বে। সেকেন্ড বাবদ ছুটতে আরম্ভ করল প্রবল বেগে। নিজের জামা খামচে ধরল নিজেকে মিছে আশ্বাস দিতে। মেকি বিশ্বাস ধারণ করে চিত্ত মাঝে, ‘ ভাইয়া দাওয়াত দিতে আসেন নি। অন্য কোনো কারণে এসেছে হয়ত। ‘ সমস্ত বিশ্বাস, ভরসা,আশা,আবেগ ধূলিসাৎ হলো ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে পুরুষালি মোটা স্বর ভেসে আসতেই,
” সামনের সপ্তাহের শনিবারে আমার এনগেজমেন্ট। আপনাদের সবার দাওয়াত রইল। আশা করি আপনারা আসবেন। আপনাদের মতো আমরা আত্মীয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করে উৎসব পালন করতে পারি না। আমি মানি আমার নানার বাড়ি আছে, তিনজন মামা আছেন। লোকসমাজে সেটা আমি গর্ব করে বলি। আমার বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষগুলো উপস্থিত থাকবে না সেটা খারাপ দেখায়। অনুষ্ঠান স্মরণিকা নিবাসেই হবে। অনুরোধ রইল- আসবেন। ”
প্রহর অনুরোধ করবার পাত্র নয়। সৌরভের সন্দেহ জাগল। ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে কিছু বলতে চাইলে রফিক বাধ সাধেন। রাশভারি গলায় বলেন,
” এবার তুমি যেতে পারো। ”
প্রহর চাপা ক্লেশে জবাব দেয়,” যাব। ” তারপর রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,” এক গ্লাস পানি হবে মামী?”
রোকেয়ার চোখের পাতা ভার হলো। ছেলেটাকে কখনো আপ্যায়ন করতে পারেন না এ বাড়ির বাঁধানো নিয়মের জন্য। দেয়ালে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকা নিশাতকে জোরে হাঁক ছাড়লেন,
” নিশু পানি নিয়ে আয় তোর ভাইয়ার জন্যে। ”
মায়ের ডাকে কোনো প্রকার হেলদোল হলো না নিশাতের। তার মনের অলিন্দে তীব্রদাহ চলছে। পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে ও,নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কানজোড়া,চোখ দু’টো বিশ্বাস করতে চাইছে না প্রহরের মুখের কথা। অথচ কান ও চোখের বিবাদ যে ঘুচে গিয়েছে খানিক্ষণ পূর্বে।
রোকেয়া ডাকলেন আবারও,
” নিশু,,এই নিশু!”
ধরফড়িয়ে ওঠে ওর সমস্ত কায়া। দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। রোকেয়া ঠাওর করতে পারলেন না হঠাৎ করে মেয়ের হয়েছে টা কী! নিজে পানি এনে দিলেন প্রহরকে। প্রহর পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বক্র চাউনি ফেলল দু তলায়। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বেতের মোড়ার ওপর গ্লাসটা রেখে নিরাসক্ত গলায় বলল,
” যাই মামী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমরা থাকবে অনুষ্ঠানে। ”
বেড়িয়ে যেতেই সৌরভ ভীষণ রা–গমিশ্রিত কণ্ঠে পরপর বলতে থাকল,
” পানি আনিয়ে আবার না খেয়ে চলে গেল। কে বলে দাওয়াত দিতে আসতে? যেখানে সেখানে নিজেদের পাওয়ার খাটাবে। ”
আনোয়ার পাশ থেকে বড় ভাইয়ের লক্ষ্যে প্রশ্ন তৈরি করে,” আপনি ভিতরে আইতে দিলেন ক্যান ভাইজান? ”
” তাদের পাওয়ার আমাদের থেকে বেশি এখন। গ্রামের লোক তাদের মান্য কইরা চলে। ঢুকতে না দিলে ঠিকি ওইখানে দাঁড়াইয়া তামাশা করত। এটা কি ভালা দেখাইত? এই কথা এখানেই থেমে যাক। ”
বরাবরই সবসময়কার ন্যায় নিশ্চুপ চরিত্র পালন করছে রবিন। সে দো**ষী,পাপি**ষ্ঠ,অন্যায়—কারী। তার জন্যই দুই পরিবারে বিচ্ছেদ। এ বাড়িতে তাঁর ঠাঁই মিলছে তা-ই বা কম কী! সুতরাং তাঁর জন্য নীরবতাই আপাতত জীবনের সবথেকে বড় ভূমিকা।
_________________________________
প্রহরের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে ঊষা,প্রত্যয় ক্ষণিক সময় আগেই গ্রামের বাড়িতে হাজির হয়েছে। মোশতাক সাহেব এসেই ভাইয়ের সাথে গ্রামের আগত নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। তনুজার পরিবারের সাথে এখনও উজ্জ্বল সাহেব ও আলতার পরিচয় হয় নি। প্রহর এবং প্রত্যয়ের জীবনে লেখাপড়া হতে রাজনীতিতে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেওয়া সবটার অবদান মোশতাক সাহেবের। তাই বড় ভাইয়ের মুখের ওপর কখনও কিছু নিয়ে দ্বিরুক্তি করেন নি উজ্জ্বল সাহেব। ভাই যদি বলেছেন উত্তরে যাবি,তাহলে তিনি সেদিকেই যাবেন। এতটাই ভাই ভক্ত মানুষটা। প্রহরের জন্য পছন্দ করা মেয়েকে এক ঝলক না দেখেই বড় ভাইকে বলেছেন,” নিঃসন্দেহে আপনি আমার দুই ছেলের ক্ষেত্রে বেস্ট ডিসিশন নিবেন। ” আলতা কিঞ্চিৎ দ্বিমত পোষণ করলেও স্বামীর ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে দমে যেতে হলো। তাছাড়া প্রহরের মনেও সংশয় নেই, তনুজাকেই বিয়ে করবে সে। উল্টো আলতা ভাবত নিশাতের দিকে ঝুঁকে আছে ছেলের মন৷ ভুলভাবনা ছিল তাঁর। ভাবনাটা তাঁর একান্ত ছিল না,উজ্জ্বল সাহেবেরও ছিল। সব চিন্তা নিষ্ফল প্রমাণ করে প্রহর এবং তার সিদ্ধান্ত। চায়ের ট্রে নিয়ে লনের দিকটায় আসতেই দেখলেন গটগট পায়ে প্রহর হেঁটে আসছে। উজ্জ্বল ডাকলেন তাকে,” কোথায় গিয়েছিলে?”
প্রহর সারল্য কণ্ঠে উত্তর দিল,” তোমার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলাম। ”
উজ্জ্বল উজবুকের মতো তাকালেন ছেলের দিক। উনারই শ্বশুর বাড়ি? এই ছেলের কি মামার বাড়ি লাগে না? আলতা ট্রে টা টেবিলে রেখে প্রহরের দিকে দ্রুত পায়ে আগালেন। নিম্ন আওয়াজে জিজ্ঞেস করলেন,
” শুধু শুধু কেন গেলি? আসবেন না উনারা কেউ। ”
” শিমুল কোথায়?”
” কেন?”
” নিশাতকে আনার ব্যবস্থা করো। ”
ছেলের লালচে চোখ, কঠোরতায় আবদ্ধ মন পড়তে চেষ্টা করলেন আলতা। যা অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার। একটু ত্যাড়া–মো করে বললেন,
” ওকে এনে কী করব?”
প্রহর সরু নেত্রে চেয়ে বলল,
” ছোটবেলা থেকে ও বলত ❝প্রহর ভাইয়ার বউ দেখব,বউ দেখব,সুন্দর বউ। ❞ তোমার মনে নেই? তাই ও আমার বিয়ের সকল অনুষ্ঠানে থাকবে। কীভাবে আনবে আমি জানিনা। কিন্তু ওকে চাই। ”
#চলবে~
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____২২
মানুষের মন পরিবর্তনশীল। ক্ষণে ক্ষণে বদল হয় মনের রূপ। এককালে যেই জিনিসটা তিক্ত মনে হয়,সময়ের স্রোতে সেই জিনিসটাই আকর্ষণীয় লাগে,তীব্রভাবে গেঁথে যায় হৃদয়স্থে। অবজ্ঞা, অনাদরে ফেলে রাখা জিনিসটা একটা সময় হয়ে যায় অতিশয় প্রয়োজন। অত্যধিক তেঁতো লাগলেও কালের পরিক্রমায় অমৃত মনে হয়। মানসিক,শারিরীক সুস্থতা নির্ভর হয়ে পড়ে সেই দুর্লভ বস্তুখানির ওপর। প্রহর নামক ব্যক্তিটাও সদ্য এক প্রেমের অতলস্পর্শে ডুবন্ত নারীর জীবনে ঠিক এমন। কিছু কাল পূর্বেও সে এই কিশোরীর অবুঝ চিত্তে তিত স্বাদ মিশ্রিত এক বদ পুরুষ হিসেবে শোভাময় থাকলেও, এইক্ষণে ক্ষুদ্র প্রাণের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে রাখার মূলমন্ত্র সে। কিন্তু হায়! কিশোরীর যে মাটি হতে ওই রূপালি চাঁদে স্পর্শ করার সাধ্য নেই।
পড়ার টেবিলে দুই হাত রেখে তার মধ্যে মুখটা গুঁজে রাখল নিশাত। চলছে দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ। রুমটা কিয়ৎ পরিমাণ তমসায় আবদ্ধ। উন্মুক্ত জানালার সরু অংশ হয়ে এক ঝাঁক মশাদের আগমন সাঁঝনামা সেই কক্ষটায়। এক দু’টো মশা নির্বিঘ্নে মেয়েটার ঘাড়ে বসে রক্ত চুষছে উৎফুল্লভাবে। এতে তার কোনো হেলদোল নেই। নিস্তব্ধ,নির্বাক নিশাত। অভ্যন্তরে যে বিষ-ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে,শিরায়,ধমনীতে তার কাছে দৈহিক অংশে মৃদু ব্যথা নগন্য।
নিশাতের অক্ষিকোল খানিক সময় পর পর জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে,গাল ভিজে যাচ্ছে। নরম মাংসপিণ্ডের বুকে তীর রূপে অবিরত গাঁথছে প্রহরের সুমধুর, আড়ষ্টহীন কণ্ঠের একেকটা বাক্য। অসহনীয় যন্ত্র”””ণায় ছটফট করছে অন্দরমহলে বদ্ধ প্রাণপাখিটা। এইটুকুন বয়সে কীভাবে ও এত ভারী কষ্ট, ক্লেশের ভার বহন করবে! রুমের দিকে ধেয়ে আসা পায়ের আওয়াজে সে নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলল। নিঃসাড় দেহ নিয়ে ধাতস্থ হতে পারল না। টেবিলে ওভাবেই পড়ে রইল। কর্ণপাতায় হালকা হালকা আসল মায়ের ঝাঁঝের স্বর,
” রুমটাকে তুই কী বানিয়ে রাখছস নিশু? মাগরিবের আজান পড়ছে,আঁধার নামছে তুই দেখস না? ঘরে বাতি নাই,জানালা খোলা তোর আব্বা দেখলে রে*গে যাইব। সাঁঝ হইলে যে বাড়ির সকল জানালা লাগিয়ে দিতে হয় ভুলে গেছস?”
নিশাত নিশ্চুপ। উত্তর দিল না। চোখ বুঁজে স্রেফ শুনতে থাকল। রোকেয়া চওড়া মেজাজে গজগজ করতে করতে জানালা লাগালেন। নিশাতের হাবভাব সুবিধাজনক ঠেকছে না উনার নিকট। প্রহরকে পানি দিতে বললে সেই যে মুখ ফিরিয়ে ঘরকুনো হলো বের হবার নামদাম নেই। অকস্মাৎ মেয়েটার কী হলো বুঝতে অসফল তিনি। আবার এখন চুপ করে আছে বেয়া*দবের মতোন। মা যে কিছু বলছে তোয়াক্কা পর্যন্ত করছে না। আলো জ্বালিয়ে কষিয়ে কয়েক চ**ড় দিবে ভাবলেন। দীর্ঘদিন কোথাও বাস করলে অভ্যস্ত হয়ে যায় মানুষ কোথায় কী রাখতে হয় তাতে৷ ঘনঘটা অন্ধকারেও হাতড়ে লাইটের সুইচ খুঁজে নিলেন রোকেয়া। টিমটিমে সাদা দীপ্ততায় সৌন্দর্য ফিরে পেল পুরো রুমটা। উল্টো ঘুরে টেবিলের দিক নজর যেতেই হকচকিয়ে গেলেন উনি। ধ্বক করে উঠল বুক। তড়িৎ গতিতে টেবিলের দিক ছুটে আসলেন। মেয়ের বিধস্ত হাল পরখ করতেই শরীরে থরথর কম্পন আরম্ভ হলো। শশব্যস্ত হলেন তক্ষুনি,
” নিশু! এই নিশু? কী হয়েছে তোর? এভাবে বসে আছিস কেন?”
কোনো রাখঢাক নেই। রোকেয়ার চিন্তার মাত্রা বাড়ল। গায়ে হাত দিতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তীব্র উষ্ণতা সইতে না পেরে হাত সরিয়ে আনলেন বিদ্যুৎ গতিতে। নিশাতের কোমল কায়া নেতিয়ে পড়েছে উত্তাপে। জ্বরের তাপে জ্ঞান হারিয়ে অনুভূতিশূণ্য। সৌরভ মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল। বোনের ঘর থেকে মায়ের ডাক শুনে বিনা বিলম্বে উপস্থিত হলো সে। সাথে বাড়ির বাদ বাকি সকল সদস্য। রোকেয়া ওদের দেখে কান্নারত কণ্ঠে বললেন,
” জ্বরে হুঁশ হারাইছে,ওরে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দে বাপ। ডাক্তার আন। ”
সৌরভ তড়িঘড়ি করে বিছানায় এনে শোয়াল নিশাতকে। জ্বর চেইক করে তারও বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। বাজারে এ সময় ডাক্তার পাওয়া যাবে। কয়েকবার কল করেও না পেয়ে খালি পায়েই ছুটল সে বাজারের দিক। রোকেয়া ও ছোট ফুপি বালতিতে পানি এনে মাথায় ঢালতে লাগল,সাথে জলপট্টি। পিংকি ওর মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে অনুমতি চাইল,
” তোমারে একটা কথা বলি আম্মা? ”
নিশাতের চাচী তীক্ষ্ণ নজরে তাকালেন মেয়ের দিক। বিরক্তভরা কণ্ঠে সায় জানালেন। তখনই পিংকি সন্দেহ মিশিয়ে নিম্নস্বরেই বলল,
” আম্মা! ওরে আমি বেড়াইতে আসার পর থেকে দেখলাম কেমন মনমরা,কথা কম কয়। তারপর আজ প্রহর ভাই আসার পর দেখলাম খুশিতে মুখ ঢাইকা নিচে হাজির। উনি চলে যাবার পর আবার এখন বিছানায় পড়ছে। ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?”
পিংকির মায়ের টনক নড়ে ওঠে। তিনি খেয়াল করেছেন শুরুতে ঠিকঠাক থাকলেও প্রহর যখনই বিয়ের কথা বলল নিশাত ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না,অদ্ভুত আচরণ করছিল। বিষয়টা সাধারণ ভেবে তিনি মাথায় না ধারণ করলেও পিংকির কথায় ভুলের ছিটেফোঁটা নেই। সত্যি বলেছে সে,পুরোটা ব্যাপারই কেমন ঘোলাটে এবং সংশয়মিশ্রিত। এখন ঝামে**লাটা মিটে যাক! মুখ্যম সুযোগ মিললে রোকেয়ার সাথে কথা ভাগ করবেন তিনি।
সৌরভের ফোন বেজে চলেছে একাধারে। থামবার জো নেই। ওইপাশের ব্যক্তির অবস্থা বোধহয় বেতাল নয়ত এত কল কেন করবে! নাম্বারটা সেভ নেই,একেবারে নতুন ও অপরিচিত। তবুও বুঝল সে কে হতে পারে,কার অবস্থা উত্তেজিত হয় সে ফোন না ধরলে। গম্ভীর গলায় বলল,
” কী সমস্যা তোর? পা*গলের মতো এত রাতে কল দিচ্ছিস কেন? ”
ওপাশ থেকে হতভম্ব স্বর এলো,” তুমি কীভাবে জানলে আমি?”
” যেভাবেই জানি,তাতে তোর কী? কেন ফোন দিয়েছিস?”- ধম**কালো সৌরভ।
শিমুল হাল ছাড়ল না। ফের জিজ্ঞেস করল,” কীভাবে জেনেছ?”
” বললাম তো তোর এসব জানতে হবে না। ”
” জানতে হবে। বলো প্লিজ সৌরভ ভাইয়া। ”
ক্রোধে সৌরভের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” আমাকে তুই বাদে এত কল দিয়ে আর কে জ্বালাতন করবে?”
সোজাসাপ্টা অপ**মান। কিন্তু বুঝেও না বুঝার ভান করল শিমুল। মাখল না গায়ে। কিছু পেতে হলে যেমন কিছু হারাতে নয়, তেমনি ও সৌরভ ভাইয়াকে পেতে অনেক ধৈর্য্য ধরতে রাজি। সৌরভের আকস্মিক একটা বিষয় খেয়ালে চলে আসল। রসকষহীন,কাঠখোট্টা হয়েই প্রশ্ন করল,
” তুই আমায় কী বলে ডাকলি?”
” সৌরভ ভাইয়া। ”
” না,এটা না। তুই আমাকে তুমি করে কেন বলছিস?”
শিমুল তখন লজ্জা পেয়ে উত্তর দেয়,
” একদিন আপনি থেকে তুমিতে যেতেই হইব,তাই আগে থেকেই প্র্যাকটিস করতেছি। ”
সৌরভের ভেতরে দাউদাউ করে আ-গুন জ্বলে উঠল। কপালে ভাঁজ পড়ল গুটি কয়েক। ঝাঁঝালো, বুক কাঁপানো গলায় দৃঢ়ভাবে শা-সাল,
” ঠাটিয়ে একটা মা*রব, তোর আক্কেল জ্ঞান সব হবে। দুই ফুটের একটা মেয়ে। এখনও তোর দাঁত সব পড়েছে? চাপার দাঁতগুলো উঠছে? নিজেই একটা বাচ্চা আবার তুমিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফোন রাখ। ”
কাতর, আকুলতা শোনা গেল শিমুলের,
” কল রেখো না ভাইয়া দয়া করে। ”
সৌরভ অগ্রাহ্য করতে পারল না চিকন, মুগ্ধ কণ্ঠস্বর। রুক্ষতা বজায় রেখে বলল,
” কী বলবি?”
” নিশাত কোথায়? কখন থেকে কল করছি ওর খবর নেই। ওকে একটু ডেকে দাও না। ”
এ যাত্রায় একটুখানি নিভল সৌরভ। নিষ্প্রভ, ক্লান্ত স্বর,
” ওর শরীরের অবস্থা সন্ধ্যা থেকে খারাপ। স্যালাইন চলছে। আর এখন ঘুমে। ”
শিমুল আঁতকে উঠল। ব্যাথা-তুর কণ্ঠ তার,
” কী হয়েছে নিশুর?”
” জ্বরে দুর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। হুঁশ ফিরলেও শরীরের হাল ভালো না। ডাক্তার এসে দেখে গিয়ে,,”
কথাখানি শেষ করতে পারল না সে। কল কেটে গেল টুপ করে। মনে মনে গা** লি দিতে গিয়েও থেমে গেল। নাদান এই মেয়ের জন্য গা**লি খরচ করা বোকামি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। ভাবল,একবার নিশাতকে দেখে আসা দরকার। রোকেয়া মেয়ের শিয়রদেশে বসে ছিলেন। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে উনার। সৌরভের চোখে বিঁধতেই বলে,
” ও কি খেয়েছে মা? আর না খেলে তুমি গিয়ে খেয়ে নাও,এখন আমি বসি। তুমি খেয়ে আসলে চলে যাব। ”
রোকেয়া বিছানা ছাড়লেন। কিছু মনে পড়া গলায় বললেন,
” তোর আব্বার খাবার দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। মেয়েরে দেখে মন খারাপ করে রুমে যে গেল আর তো ডাকল না আমারে। আমি বরং গিয়ে দেখি। ”
” আচ্ছা যাও। “– কথার মাঝে সৌরভের মোবাইলটা বেজে উঠল পুনশ্চঃ। চেয়ে দেখল শিমুল হোয়াটসঅ্যাপে অডিও কলও না সরাসরি ভিডিও কল দিয়ে বসে আছে। মায়ের সামনে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল তার মধ্যে। রোকেয়া এক পলক নিশাতের মলিন,নিস্তেজ মুখখানা দেখে বেরিয়ে গেলেন। কলটা কেটে গিয়ে মেসেজ টোন বাজল। তাতে লেখা-‘ প্লিজ কলটা ধরো ভাইয়া। ‘
হুলুস্থুল কান্ড বাঁধাতে মেয়েটা পারদর্শী। সুতরাং রিস্ক নেওয়া আর বিপ**দ ডাকা সমান। এবং তা ভেবে ও কলটা ধরতে বাধ্য হলো। ধরা মাত্র শিমুল হড়বড়িয়ে বলে,
” ব্যাক ক্যামেরা দাও,নিশুকে দেখাও। জলদি দেখাও। ”
সৌরভ চাপা ধমকে উঠল,
” আস্তে মাইয়া! ইয়ারফোন আনি নি আমি,লোকে শুনবে।
ব্যাক ক্যামেরা ধরতেই শিমুলের অন্তরআত্মা কাঁপল। চোখের আরশিতে ভাসছে র*ক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখটা। গলা ধরে আসল ওর,” তুমি অন্যদিকে তাকাও ভাইয়া। আমি তোমার জন্য ভালো করে নিশুকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি এক কাজ করো, ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে নিশুকে দেখাও। ”
বেজায় বিরক্ততে দাঁত কিড়মিড় করছে সৌরভ। অন্যত্র মুখ ফিরিয়ে ক্যামেরা ধরে রাখল নিশাতের মুখ বরাবর। শিমুল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে ভাইয়ের রুমে ঢুকল। প্রহর তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। সাউন্ড মিউট করে শিমুল ডাকল তাকে,” ভাইয়া!”
আকাশের ঝলমলে তারাদের রাজ্যে প্রহরের নির্নিমেষ চাহনি। শিমুলের ডাকে সিগা””রেট টা বারান্দার প্রশস্ত রেলিংয়ের ওপর চেপে ধরল,হারিয়ে গেল তেজ। ফেলে দিল সিগা””রেটটা। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই মুহূর্তের মধ্যেই জমে গেল সে। দৃষ্টি স্থির,অনিমেষ। ঠোঁট জোড়া নড়ল বুঝি। শিমুল কল কেটে দিল।
” ওর খুব জ্বর ভাইয়া৷ এ কারণেই তোমার ফোন তুলছিল না অথচ তুমি রে–গেমেগে আগুন। ”
বিস্ময়ে নিবিষ্ট কণ্ঠ কানে আসল,” কার জ্বর? ”
প্রত্যয় ও ঊষা একসাথে রুমে এসেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে শিমুল প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে জানায়,” নিশাতের।”
ঊষার ভেতরটা ছ্যাঁত করলে উঠল। নিদারুণ কষ্টমিশ্রিত গলায় বলে,” বেশি?”
” খুব বেশি আপু। ”
প্রহর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,” এসব ঢং ওই চু**রনির। আমার এনগেজমেন্টে আসবে না বলে তালবাহানা। ওই বাড়ি গিয়ে জ্বরের ভূ’ত নামাব আমি। শিমুল যা গাড়ির চাবি নিয়ে আয়। ”
প্রত্যয় দ্বিধান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করল ভাইয়ের চেহারায়। বুঝল প্রহর। সোজাসাপ্টা বলল,
” কিছু বলবি?”
” প্রশ্নটা ব্যক্তিগত ভাই।”
প্রহর একটু ভাবল। অনুমতি দিল প্রত্যয়কে-” জিজ্ঞেস কর।”
বয়সের খুব বেশি ব্যবধান না হলেও বড় ভাইকে ভ-য় পায় প্রত্যয়,যেটা কখনো প্রকাশ করে না কিন্তু পায়। সংকোচ নিয়ে প্রশ্নসূচক বাক্য সাজালো উত্তরের আশায়,
” তুমি সত্যিই তনুজাকে বিয়ে করবে?”
প্রহরের কাটকাট কথা,” বিয়ে আবার মিথ্যা হয় নাকি রে?”
” না।”
সামান্য সহজ হলো সে। অভাবনীয় একটা প্রশ্ন করে,
” নিশাতের প্রতি তোমার কোনো অনুভূতি নেই? ”
প্রহর মোবাইল চাপতে চাপতে নিরলসভাবে বলল,
” অবশ্যই আছে। ও আমার মামাতো বোন। বোনের জন্য অনুভূতি থাকবে না? তোরও আছে। ”
” তুমি ওকে শুধুই মামাতো বোন ভাবো?”– সাহস করে ঊষা প্রশ্নটা করেই ফেলল।
প্রহর দৃষ্টি গরম করে বলল, ” তোদের ঘাড়ে ক’টা মাথা হয়েছে? আমাকে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছিস কেন? ”
” অদ্ভুত ভাবনার সৃষ্টি তুমি করলে। তাই আমরা ভাবতাম,! ”
প্রত্যয় প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রহর হাতের মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে মারে সহসা। লাগামহীন কণ্ঠে বলল,
” নিশুকে কী আমি কোলে করে ঘুরে বেড়িয়েছি? চুম্মা দিয়েছি? আর দুটো কাজিনের মতো শাসন করেছি,মে**রেছি বলে তোরা এসব ভাববি? বের হ দু’টো আমার ঘর থেকে। নয়ত আমার মুখ আরও খারাপ হবে বলে দিলাম। ”
ঊষা দ্রুত চলে এলো। প্রহর এমনিতে রা-গ প্রকাশ করে না কিন্তু রা-গ ভিতরে পুষে মাঝে মাঝে সীমাহীন বলে ফেলে।
____________________________
শিমুলকে নিয়ে মজুমদার বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়াল প্রহর। বড় মামীকে কল দিল বার কয়েক। রোকেয়া নিশাতের সঙ্গে ছিল। বাড়ির মূল ফটক পার করে আসলেন পা টিপে টিপে,চুপিসারে। রোকেয়া ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
” তোরা এখানে?”
প্রহর স্মিত হেসে বলল,
” নিশুর নাকি শরীর খারাপ? শুনেই শিমুলটা কাঁদছিল অনেক। বার বার বলছিল ওকে একটু দেখব ভাইয়া। দিনের বেলায় আমরা আসলে ভেজাল, সে কারণে রাতেই নিয়ে আসলাম। ”
শিমুল হতবুদ্ধি হয়ে ভাইয়ের দিক তাকাল। প্রহর ওকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে ভঙ্গি করে,” কাঁদিস না। মামী নিয়ে যাবে নিশুর কাছে। ”
রোকেয়া স্বামীর কারণে ভীত হলেও শিমুলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন।
” সবার ঘুমের ঠিক থাকলেও তোদের রবিন মামা রাত জাগা নিশাচর। ও যদি দেখে ফেলে?”
প্রহর আশ্বাস দিল,” দেখবে না মামী। তুমি টেনশন নিও না।”
” ঠিক আছে আয়। ”
প্রহর, শিমুল রোকেয়ার পেছন পেছন এলো। আসার সময় প্রহরের বুদ্ধিতে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নেয় শিমুল। ওদের নিশাতের ঘরে ঢুকিয়ে রোকেয়া গেলেন সৌরভের ঘরের সম্মুখে পাহারাদার হতে। আর কেউ না জাগলেও,সৌরভের জেগে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
শিমুল দৌড়ে এগিয়ে গেল নিশাতের কাছে। হাতটা ছুঁয়ে দেখল ওর। আলতো করে ডাকল,” নিশু!”
তপ্ত গলায় থামালো ওকে প্রহর,” ওকে ডাকছিস কেন? যা মামীকে গিয়ে বল পানি দিতে। চো*রের মতো এসে গলা শুকিয়ে গেছে। ”
এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল শিমুল রুমে। কোথাও পানি নেই। ভীতু হয়ে ভাইকে বলে,
” আমি মামীকে কোথায় পাব?”
” করিডোরেই থাকবে হয়ত। না পেলে চলে আসিস। ”
” আচ্ছা। ”
প্রহর পিছু ডেকে সতর্ক করে,” শোন,সাবধানে যাস। ”
শিমুল যাওয়ার সময় নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে গেল। প্রহর লম্বা একটা শ্বাস টেনে নেয় নাসারন্ধ্র মাধ্যমে। নিশাতের পাশে বসে তিরস্কারের সুর তুলল,
” বল*দ! গবেট কোথাকার। জ্বর বাঁধিয়ে ফেললি? আমার বিয়ের কথা শুনেই তোর জ্বর হতে হলো? ইচ্ছে করছে মে*রে ফেলি তোকে। ”
তন্দ্রাভাবে খুব বেশি আচ্ছন্ন ছিল না নিশাত। শুধুমাত্র তাপে আঁখিজোড়া জ্বলছিল। খুলে রাখা দায় হয়ে পড়ছিল। স্যালাইনটা এখনও চলছে। ঝাপসা ঝাপসা নেত্রে দেখল হৃদয়স্থলে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা মুখটা। স্বপ্নে ভাসতে থাকল সে। ঘোর লাগানো কণ্ঠস্বরে অভিমান, যাতনা প্রকাশ করে বসল,
” আপনি! আপনি বিয়ে কেন করছেন? ”
প্রহর ভড়কালো এহেন প্রশ্নে। পরক্ষণেই বুঝল জ্বরের ঘোরে তার তিলবতী। দুর্বোধ্য হাসি দখল করল তার দুই ঠোঁট। মুখটা অতি সান্নিধ্যে নিল নিশাতের মুখের। তখনও নিশাতের চক্ষু পল্লব আপন যুদ্ধে নেমেছে ভালো করে মেলবার। দেখল,প্রহরের ওষ্ঠদ্বয় নড়ছে। শ্রবণ হলো,
” আমি বিয়ে করলে তোর কী?”
সময় ব্যয় করল না ও,” আপনি বিয়ে করলে আমাকে মা**রবে কে?”
প্রহর মজা পেল এমন করে দুষ্ট কণ্ঠে বলে,” তুই আমার মা*ইর পছন্দ করিস? আদর পছন্দ করিস না? ”
নিশাতের সম্মতিদান,” করি। আমার ভালো লাগে । ”
আজ হয়ত অনেক সুন্দর আর মজার রাত। প্রহর হাসি চেপে নিজ মনে আওড়ালো,” সব ফেলে তোর এসব ভাল্লাগে? সাধে কি তোকে গাধী বলি? ”
শিমুলটা গেল কোথায়? উঠে দাঁড়ায় সে। কিন্তু আর নড়তে পারে না। নিশাত হাত টেনে ধরে,” প্রহর ভাই! ”
উপেক্ষা করতে পারল না সৌষ্ঠবদেহী পুরুষটা ওর কণ্ঠ। বসল পাশে। কঠিন স্বর ” বল। ”
” আমাকে নিয়ে যান না। আপনার বুকে করে নিয়ে যান। “– অচেতন হালে নিঃসংকোচ আবেদন ওর।
প্রহর ঢোক গিলে। তর্জনী দিয়ে নিশাতের গলার ঘামবিন্দু স্পর্শ করে। মোহময় স্বর ধ্বনি,
” বুকে করে কীভাবে নেবো তোকে? কোলে করে নেওয়াটাই মুশকিল করে দিল পরিস্থিতি। আমার বুকে ঠাঁই পেলে কি তোর শান্তি? ”
” হ্যাঁ, খুব। ”
শিমুল এ বাড়ির কিছুই চিনে না। ঘন ঘন আসা যাওয়া থাকলে চিনত। কিন্তু ভাগ্যের নি–র্মম পরিহাসে নানার বাড়িতে আসতে হয় লুকিয়ে, গোপনে গোপনে। মিনিট খানেক মামীকে খুঁজে না পেয়ে অন্ধকারে নিজেই নিচে নেমে আসল। তখনই ওর নরম উদরে হাতের চাপ পড়ল,ঠোঁটগুলোও চেপে ধরল কেউ অন্য হাতে। বক্ষস্পন্দনের উঠানামা তড়তড় করে বৃদ্ধি পেল তার, যুক্ত হলো ফুসফুসের বেগতিক ক্রিয়া।
#চলবে~