প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
929

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____২৩

সৌরভ হতবিহ্বল। থতমত খেল সে। তড়িঘড়ি করে সরিয়ে আনল হাত দুটো। নিগূঢ় অন্ধকার বিরাজমান পুরো অংশ জুড়ে। বাহির হতে ঘরে ঢুকতেই মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় তার অক্ষিপটে একটি অবয়ব ধরা পড়ে। চো*র নাকি! এমনতর ভাবনা মনের ঘরে জড়ো করে অন্ধকারে অগ্রসর হয় অবয়বের দিক। তার মতে,দরজা খোলা ছিল রাত বিরাতে চো**রের হানা স্বাভাবিক। ফলপ্রসূ হাতেনাতে ধরবে বলে পেছন হতে পেঁচিয়ে নিজের বক্ষে বন্দী করল দেহটা। এখন সে স্বয়ং ব্যাপক নিস্তব্ধ। পেশিবহুল হাত দুইটা কাঁপছে। কাকে স্পর্শ করল! ছেলেদের দেহ হয় শক্ত, চামড়ায় চাপ দিলে এতটা কোমল লাগে না,ড্যাবে যায় না। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিল সে অবস্থায়।

শিমুল কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির,অটল ও। নেত্রদ্বয় জলে সিক্ত। আড়ষ্ট ভয়ে,অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায়। হিতাহিত জ্ঞান ফিরতেই উদভ্রান্তের ন্যায় পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ জ্বালাল সৌরভ। আচমকা এই মুখটা এত গভীর রাত্রিরে চোখে ভাসবে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করে নি ও। বিস্ফোরিত তার নয়নজোড়া। শিমুল সেই চাহনিতে ভয়ার্ত,ছলছল আঁখি যুগল নিবদ্ধ করল। কর্ণে ঝংকার তুলে প্রবেশ করল চাপা ধমকের প্রশ্ন,

” তুই এখানে কী করছিস? ”

শিমুল বিমূঢ়, বাকহারা। ভ-য়ের তাড়নায় ওর আত্মায় পানি নেই, প্রচন্ড শুষ্ক অবস্থা। পুরোনো প্রবাদে আছে,❝ চো**রের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। ❞ স্বভাবে চো**র না হলেও অন্যের গৃহে লুকিয়ে চুরিয়ে এসে এই মুহূর্তে নিজেকে চো**র সাব্যস্ত করতে বিবেকে বাঁধছে না ওর। সৌরভ চোখ কুঁচকে তাকাল। ক্ষীণ জ্যোতিতে সমুখের মেয়ের মুখশ্রীতে অপ্রতিভ ভাব বিশদ। কণ্ঠটাও বেশ অপ্রকৃতস্থ,

” আম,,আমি,,,”
বলতে গিয়ে থমকে গেল গলাটা। সৌরভ ওর এক হাত টেনে মুষ্টিমেয় করে নিয়েছে। তৎপরে বলল,

” এখানে না,আমার সাথে চল। ”

বুকে ধুপধাপ বাজ পড়া পরিস্থিতি,তা সত্ত্বেও শিমুলের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একরাশ লজ্জা। সাদা বর্ণের বদনে দুম করে লাল রঙ মিশে গেল বিনা দ্বিধায় যেন। প্রেমিক পুরুষ আজ প্রথমবার ইচ্ছেতে ছুঁয়েছে ওর অঙ্গ। এটা নিঃসন্দেহে ওর জন্য শান্তি,লজ্জা, এক আকাশসম তৃপ্ততা। যেই সৌরভের সামনে দাঁড়িয়ে দু চারটে শব্দ বলতেও ওর দূরত্ব বজায় রাখতে হয়,সেখানে সেই ব্যক্তির নিজ থেকে স্পর্শ ওর জন্য না চাইতেও অপ্রত্যাশিত এক বিশাল পাওয়া।

সৌরভ রবিন কাকার লাইব্রেরি ঘরে উঁকি দিল। বুঝতে প্রয়াস চালালো কেউ আছে কিনা! মিনিট দুয়েক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঠাহর করতে পারল কারো অস্তিত্বের উপস্থিতি নেই। করপুটে আঁটকে রাখা হাতের মালিককে নিয়ে চট করে ওই ঘরে ঢুকে পড়ল। দরজা হালকা করে ভেজিয়ে দিল। একটা চেয়ারে শিমুলকে বসিয়ে, চেয়ারের দু হাতলের ওপর হাত রাখল। ঝুঁকল ঈষৎ। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,

” কার সাথে এসেছিস?”

শিমুল নত মাথায় বসে আছে। পা গুলো নড়ছে ওর, যা সৌরভের চক্ষু এড়িয়ে গেল না। ধরা পড়ল তার সবটুকু হাল। ঠোঁটের কম্পন,ঘন ঘন ঢোক গিলা,বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়া কিছুই বাদ পড়ছে না সৌরভের সরু চোখের চাউনি হতে। আমতা আমতা করল,

” এক,একা এসেছি। ”

সৌরভের চোখে ধপ করে আগুন জ্বলল যেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” ইয়ার্কি মা**রছিস আমার সাথে? এতরাতে একা এসেছিস তুই?”

মস্তিষ্ক ফাঁকা, বুদ্ধির ঘাটতি সেখানে। কী বললে যুতসই এবং সৌরভের বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে, ভেবে ভেবে কূলকিনারা, পথঘাট কিছুই মিলছে না শিমুলের। বয়সটা তো এখনো অপরিণত,অপরিপক্ক। এরকম দশা মেয়েটা আর কোনোদিন মোকাবিলা করে নি। বড়ো ভাইয়ার কথা বললে সৌরভ নিশ্চিত লঙ্কা কান্ড বাঁধাবে, আবার না বলেও উপায় নেই। অঢেল কান্নার দাপটে শরীরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। সৌরভ তবুও নির্বিকার। ভাব এমন- উত্তর না পাওয়া অব্দি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও শিমুল নামের পুচকে মেয়ের রেহাই নেই। শেষমেশ মাথায় অবিন্যস্ত, অকস্মাৎ যা সৃষ্ট হলো তা-ই ব্যক্ত করে মেয়েটা,

” ভাইয়ার সাথে এসেছি। ”
সৌরভের মুখাবয়ব আরও কঠিন হলো। কণ্ঠে তেজ এঁটে বলল,
” কোন ভাই?”
” প্রহর ভাই। ”
” তোর ভাই কোথায়?”– সন্দিহান দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন করে সৌরভ।
” ভাইয়া মোড়ে। আমাকে মামী নিয়ে এসেছে ভিতরে, নিশুকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই। আমাকে ওর রুমে দিয়ে মামী কী কাজে যে বের হয়,পানির পিপাসা লাগলে আমি পানি খেতে নিচে আসি। ”

শিমুলের তোতলানো, কম্পিত কণ্ঠ সৌরভের সংশয় দমাতে পারল না। দায়সারাভাবে বলল,

” তুই নিশুর রুমে যা,আমি তোর ভাইয়ের সুদর্শন চেহারা দর্শন করে আসি। ”

শিমুলের চোখ বড় বড় আকৃতি ধারণ করে তৎক্ষনাৎ। প্রহর তো নিশাতের রুমে। কী করবে এখন! করুণ শোনাল ওর গলা,

” সৌরভ ভাইয়া!”
” বল। “— ভরাট কণ্ঠের অনুমতি।
শিমুল লজ্জা শরমের মাথা খেলো নিমেষে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে বলে,” আমার না হি,,হি পেয়েছে? ”
কালো ঘন ভুরু যুগল কুঞ্চিত হলো সৌরভের। ভাঁজ পড়ল ললাটের মধ্যস্থানে। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি। প্রবল আক্রোশ ভরা কণ্ঠ,
” হি হি কী? আবার ইয়ার্কি করছিস!”
” হি হি মানে ওই যে? বুঝো না?”– তখনও মাথা, চোখের দৃষ্টি অবনত। অথচ গলায় যেন লজ্জাদের মিলনমেলার আয়োজন চলছে।
সৌরভ বুঝবার চেষ্টা করল। বুঝল বোধহয় খানিক। অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে সে। দ্বিধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোর কি হিসু পেয়েছে? ”
” হু। এক নাম্বার টা-ই পেয়েছে। ”
দাঁতে দাঁত লেগে এলো তার। হিসহিসিয়ে উঠল, মৃদু চেঁচাল,
” তো নিশাতের রুমে ওয়াশরুম আছে,সেখানে যা। ”
” না,না। আমার একা বাথরুমে যাইতে ডর লাগে। তুমি চলো,বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবা। ”
চ*ড় মেরে শিমুলের টসটসে, ফুলোফুলো মুখটাকে আরও দ্বিগুণ লাল করে দিতে স্পৃহা জাগছে তার। আস্ত ডিঙি মেয়ে, তার নাকি বাথরুম ভীতি! নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে বসে আছে। নিজেকে সামলালো সে। এত প্যাঁচাল করে লাভ নেই, বাথরুমে আর কতক্ষণ লাগবে! মিনিট পাঁচেকের কাজ। ধৈর্য্যের পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে বলে,

” আচ্ছা চল। নিশুর রুমে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকব,তুই তোর কাজ করিস। ”

মেয়েরা সর্বদা চেষ্টায় নিমগ্ন থাকে তার প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্যে লজ্জাবতী,নতমুখী নারী হয়ে থাকতে। অথচ শিমুল ভাইয়ের জন্য নিজের সেই গুণগুলো বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। লাজহীন কণ্ঠে নিঃশ্বাস ক্ষণিকের জন্য আঁটকে বলল,

” বেগ বেশি,সিঁড়ি বইতে গেলে যদি পরে যায়? আপনাদের নিচের ঘরে বাথরুম নাই?”তৎপরে সে দাঁড়িয়ে ছোটাছুটি আরম্ভ করল। বিচক্ষণ সৌরভের মন ডাইভার্ট করতে তাড়া দিতে লাগল,” জলদি নিয়ে যান না। ”

সৌরভের হাসি চেপে রাখতে অত্যধিক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।
পরিহাস করল,” এখনও যার হিসু নিয়ে বিরাট কান্ড ঘটে,যার বাথরুমে ভূ–তের ভয় সে কিনা আমাকে প্রেম প্রস্তাব দেয়? আগে ভালো করে বড় হ বাবুনি। আয় বাবুনি নিয়ে যাই তোকে বাথরুমে। ”

বাবুনি! তীক্ষ্ণভাবে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল শিমুলের কানে। ছি! ছি! আর কী কী সহ্য করতে হবে ওর! কোথায় চেয়েছিল হবে প্রেমিকা,হয়ে গেল বাবুনি। তার সৌরভ ভাইয়ার বাবুনি।
মিথ্যা অজুহাত সাজালেও ফেঁসে গেল সে। এবার সত্যি সত্যিই এক নাম্বার পেয়ে বসল। বিপত্তি বাঁধল তাড়াহুড়ায় পায়জামার ফিতা খুলতে গিয়ে উল্টো প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলল,একেবারে জটিল প্যাঁচ যাকে বলে। বি-শ্রী,কটু বিষয়টা না ঘটলে ও এই গিট্টু নিয়েই অনায়সে ভাইকে বাঁচাতে এক ঘন্টা বাথরুমে বসে থাকত। কিন্তু মিথ্যে যে ওকে এমন মা-র দেবে কে জানত! ভিতর থেকে ভেজা বিড়ালের ন্যায় শুধালো,

” সৌরভ ভাইয়া?”
ভারিক্কি কণ্ঠ শোনা গেল মুহূর্তে,
” দশ মিনিট হয়েছে, নাটক না করে বের হ। ”
শিমুল মিনমিন করে তক্ষুনি,
” আমার পায়জামার ফিতে গিট্টু লেগে গেছে,এখন কী হবে?”
” আর কী হবে? বসে থাক। আমি গেলাম। তোর মতো আজাইরা না আমি। ”
” প্লিজ যেয়ো না। ”
” তো কী করব?”
” জানিনা,কিছু একটা করো। নয়ত,নয়ত,”
” বুঝেছি, তুই বেরিয়ে আয়। ”
দরজাটা খুলে শিমুল উঁকি দিল ভিতর হতেই। জানতে চাইল,
” কী করবে?”
” তোর মাথা,মুন্ডু চিবিয়ে খাব।”
বিড়বিড় করে অজস্র গা-লিগা-লাজ করতে থাকল সৌরভ। শিমুলের অক্ষিকোল ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। সৌরভ বাথরুমের ভেতর ঢুকে আদেশ করল,

” জামা তোল। ”
শিমুল চমকালো। বিস্ময়ে জড়ীভূত মুখশ্রী। ক্রু*দ্ধ, রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সৌরভ,” এমন ভাব করছিস যেন তোর সর্ব**নাশ করতে আসছি আমি? অবশ্য ফিতে খুলে না দিলে তোর সর্ব**নাশ হতে দেরি নাই। তাই সাহায্য করে দিই মানবতার খাতিরে। এটা বলব না বিয়ে করলে তোর সমান মেয়ে থাকত। কিন্তু বিয়েটা করলে আজ ঠিক একটা বাচ্চার বাপ থাকতাম। ”

শিমুলের কান ঝাঁঝিয়ে উঠে। নেত্রযুগল নিমীলিত হয়ে আসে। ফর্সা মুখটা সিক্ত রক্তিম আভায়। নড়বড়ে হাতে জামাটা কোমর অব্দি তুলে ধরল। সৌরভ শুধু এক পল চেয়ে পায়জামার ফিতেটায় হাত রাখল। পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করল শিমুলের লালচে রঙে ছেয়ে থাকা মুখ পানে। সহসা ঘোর লেগে এলো তার। কি কোমল মুখখানি! নিশুতির গহনে তার ভেতরের সত্তা টালমাটাল রূপ ধারণ করছে। ভদ্রতার মুখোশ উন্মুক্ত করে অভদ্র, বেহায়া,নির্লজ্জ হতে চাইছে একটুখানি। নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা হাট বসিয়েছে মনে,মস্তিষ্কে। অসংযত চাওয়া থামাতে সে তার চিত্তের সাথে কুরুক্ষেত্র চালাল। চোখ বুঁজে ফেলল। তাৎক্ষণিক টনক নড়ল তার। চোখের পাতায় হাজির হলো পিংকির হাসোজ্জল চেহারাটা। আরো একদফা! আরও একবার তার বুকের কোথাও ভাঙ্গনের সূচনা ঘটল। ফিতের প্যাঁচ শিথিল হয়ে আসলে শিমুলের হাতে ধরিয়ে বেরিয়ে আসল দ্রুত পায়ে। ধরে আসা নরম গলায় ভরসা দিল,

” আমি বাহিরে আছি,তুই আয়। ”

শিমুল সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। সৌরভের নিকটে আসা ওর দেহের প্রতিটি লোমকূপে শিহরণ বইয়ে দিয়েছে। মাদল বাজছে এখনও। ধীরে ধীরে ডান হাত চেপে ধরল বুকে। আহ! এবার শান্তি। অসম্ভব ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা এ স্থানে সৌরভ আরো বেশি বেশি ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে। এমন করে যত্ন করলে,পরোয়া করলে সারাজীবনই নাটকীয়বাজ হবে এই শিমুলরাণী। উঁহু! সৌরভ ভাইয়ের বাবুনি৷ লাজে শীগ্রই দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকল ও।
——————————————-

নিশাত অনুরোধ করে আবারও। কাতর, দুর্বল স্বর,

” নিয়ে যান না আমাকে। ”
প্রহর ঠোঁট বাকিয়ে অল্প হাসে। বলে,
” কীভাবে নিয়ে যাব তোকে?”
” আপনার বুকে পকেট নেই? ”
প্রহর পরনের টি শার্টটার দিকে তাকাল। সহজাত হাসি হেসে সদ্ভাব সঠিক রেখে জবাবে জানায়,
” নেই। ”
জ্বরের উত্তাপে,উষ্ণতায়, জ্ঞানশূণ্য নিশাত। কল্পনায় মত্ত হয়ে রা-গ,জেদের,কষ্টের বহিঃপ্রকাশ করে বসে,
” কেন নেই? সবকিছুর সমাধান আছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার সমাধান নাই কেন? অস**ভ্য লোক আপনি। ”

প্রহরের কান খাড়া হয়ে গেল। চক্ষে বিস্ময়। বিছানায় পড়ে থাকা নিশাতকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” আমি অস**ভ্য লোক?”
নিশাত দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
” হ্যাঁ। ”
প্রহর এবার চওড়া হাসল। পরক্ষণেই দুর্বোধ্য হাসিতে পরিণত হলো হাসিটা। ফিচেল স্বরে বলল,
” কথাটা শিকেয়তোলা রইল মেরি সুইটহার্ট। মামুজানের বাড়িতে বসে কথা দিচ্ছি তিলবতী, তোকে অস**ভ্যতার শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ক্ষান্ত হব আমি। তখন তুই থাকবি একদম সজ্ঞানে। চিন্তা করবি কোথায় কোথায় মুখ লুকাবি। ”

হুট করে দরজা খুলে ভেতরে আসল কেউ। প্রহর মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে পুরে উঠে দাঁড়াল। পেছনে উপস্থিত শিমুলের চেহারায় লেপ্টে আছে শঙ্কা। কিছু বলতে যাবে তার আগেই উদ্বেল কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____২৪

হুট করে এনগেজমেন্ট এর দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার সুবাদে ঊষার পড়াশোনা লাটে ওঠার অভিপ্রায়। ব্যাপারটা এমন না যে দু-তিনদিনে কি আর পড়ার ক্ষতি হবে। কিন্তু পড়ার মাঝে নিজেকে সর্বদা ডুবিয়ে রাখা মেয়েটার কাছে কেবল একটা দিন পড়াতে ফাঁকি দিলেই কেমন রিক্ততা ঘিরে ধরে বুক পাঁজরে। মনের ঘরে উঁকি মারে অবহেলিত, বিস্বাদ প্রণয়। ওর হৃদয় হতে যেই প্রেমের উদগত হয়েছে সেটার কোনো রং নেই, তৃপ্ততা নেই, শুধুমাত্র অসম্পূর্ণ বিষাদ রয়েছে। অবাধ্য মনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পড়ার মাঝে নিবেশিত করা ছাড়া তার কাছে কোনো উপায়ন্তর রাখে নি নিয়তি। প্রত্যয়কে পাওয়া ওর জন্য মুশকিল কোনো চ্যাপ্টার না,বরঞ্চ ভালোবাসা পাওয়া দুর্বোধ্য। নিঃশক্তি দেহটা টেনে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। তাৎক্ষণিক ভোঁতা যন্ত্রণা সৃষ্ট হলো মস্তিষ্কে,নেত্রযুগলে জ্বলন। তোয়াক্কা করল না ও। ঘুমের বিঘ্ন ঘটলেই এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। বহুকাল পর জায়গা বদলেছে ঘুমানোর। ফলস্বরূপ তন্দ্রা কাছে ভিড়তে নারাজ ছিল। এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে ঘুমের দয়া হলো তার ওপর। এলো রজনীর শেষভাগে। এখন নিজেকে নির্জীব থেকে সজীব করে তোলার একটাই মেডিসিন যাকে বলে ‘চা। ‘ ঊষার প্রতিটা সকাল-দিনান্তের ভালো সঙ্গী।

কোঁকড়ানো কেশগুচ্ছ হাত খোঁপা করতে করতে সর্বপ্রথম বেলকনিতে আসল ঊষা। চক্ষু মুদে নাসারন্ধ্র পথে বুক ফুলিয়ে ভেতরে টেনে নিল শান্তির এক প্রশ্বাস। হেমন্তের রাজ্য শাসনামলে স্মরণিকা নিবাসের ফুটন্ত গন্ধরাজ, কামিনীর মাতাল ঘ্রাণ ধাক্কা খেল নাকে মুহূর্তেই। মোটা ঠোঁটজোড়া অমোঘ প্রশান্তিতে প্রশস্ত হয়ে গেল ঊষার। ধীরে গতিতে চোখ দুটি মেলে তাকাল সুদূরে। এ বাড়ির বারান্দাগুলো অসম্ভব সুন্দর। চারপাশ উন্মুক্ত। আলতো আলতো কুয়াশারা প্রকৃতিকে আড়াল করতে ব্যস্ত। কিন্তু হায়! এ যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সবে শীতের নিমন্ত্রণ নিয়ে প্রকৃতিতে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসেছে, স্থায়িত্ব পেতে এখনও অনেক অপেক্ষার প্রহর পার করতে হবে। কখনো কখনো ঊষার মন বলে প্রকৃতি এক প্রহেলিকা। উগ্র,শান্ত,রহস্য সব বৈশিষ্ট্য বহন করে। অকস্মাৎ নজরে আসল বাড়ির বাগানের মধ্যের দোলনাটার দিক। এটা নিয়ে ওর একটা সুন্দর স্মৃতি আছে,বলতে গেলে বড্ড ভালোবাসাময় স্মৃতিটুকু।

নিরু শাড়িটা মাত্র পরে সাড়ল। এর মধ্যে ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকল ঊষা। সরল দৃষ্টিতে তাকাল ফুপির সৌন্দর্যের দিক। খাড়া নাক,চোখের ঘন পাপড়ি,লম্বা কোঁকড়া চুল,পাতলা দু অধর, একেবারে ফিটফিটে ফর্সা নিরুর দিক নারী-পুরুষ যে কেউ একটা পলক তাকাতে বাধ্য হয়। শাড়িতে তাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় লাগে। সদ্য অল্প স্বল্প বুঝে উঠা ঊষাও তার ফুপির সৌন্দর্যের মায়ায় বিমোহিত। নিরু কাচের দু মুঠো চুড়ি পরে বিছানায় বসল। মায়াময় কণ্ঠে জানতে চাইল,

” কী দরকার আমার আম্মাটার? অমন দৌড়ে এলেন কেন আম্মা? ”

ঊষা দ্রুত পায়ে ফুপির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রশংসা করল,
” তুমি সুন্দর ফুপি। ”

” কতবার বলবেন আম্মা? আপনি কি জানেন? আপনি আমার থেকেও বেশি সুন্দর। ”

ঊষা লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। চিবুক গিয়ে স্পর্শ করল গলার নিকটস্থে। আবদার করল সংকোচ নিয়ে,

” তোমার মতো করে আমার চুলগুলো বেঁধে দাও না ফুপি। ”

নিরু হতাশ নয়নে ওর চুল দেখল। ঘাড় ছুঁয়েছে সবে। এটুকুন চুল দিয়ে দুই বিনুনি তো হবে না। সে কিছু একটা ভেবে একটা বক্স থেকে দু’টো শুভ্র ফিতা নিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,

” আমার মতোই কেন বানতে হবে? ”

বাচ্চা কণ্ঠটা অকপটে উত্তর দেয়,

” প্রত্যয় ভাইয়া বলেছে তোমার চুল বাঁধা নাকি ভাইয়ার খুব পছন্দ। তোমার মতো বাঁধলে আমাকেও পছন্দ করবে ভাইয়া। ”

নিরু চুলগুলো নিয়ে দু দিকে দুটি ঝুটি বেঁধে দিল। ক্ষীণ হাসি ঠোঁটের কোল জুড়ে। নির্নিমেষ চাহনি নিবদ্ধ ঊষার মুখখানায়।

” তোমার প্রত্যয় ভাইয়া তোমাকে অপছন্দ করে?”
ঊষা বামে,ডানে মাথা নাড়াল সরব করে। বুঝালো করে না। নিরু ওর চিবুকে নরম হাতটা রেখে বলে,

” আমরা সবাই তোমারে অনেক ভালোবাসি আম্মা। আমাদের ঘরের একটা মাত্র প্রদীপ তুমি। প্রদীপের অনেক কদর করতে হয়। কারণ অন্ধকার কেউই ভালা পায় না। ”

ফুপির কথার অর্থ ঠিকঠাক না বুঝলেও ঊষার ভিতর আনন্দে টগবগ করতে লাগল। বাগানে দোলনা বেঁধেছে বাড়ির এক কাজের লোক। গতকাল ঊষা দোলনা চড়ার জন্য কেঁদেকেটে হুলুস্থুল কান্ড ঘটিয়েছিল। এমনকি রাতে ঘুমের মাঝেও দোলনার জন্য কেঁদে কেঁদে উঠছিল মেয়েটা। ফলপ্রসূ সকাল সকাল মোশতাক সাহেব একমাত্র মেয়ের কান্না আর সইতে না পেরে শহর থেকে দোলনা আনালেন। ফুপির ঘর থেকে বেরিয়ে টালমাটাল পদলি ফেলে বাহিরে আসতেই দেখে চওড়া,দীর্ঘ দোলনার একপাশ প্রত্যয়ের দখলে। হাতে খাতা নিয়ে ড্রইং করতে নিমজ্জিত সে।

” ভাইয়া কী করছো?”
চিকন সুরে উচ্চারিত ধ্বনির বদলে কোনো উত্তর এলো না। অগত্যা ঊষা পুনর্বার জিজ্ঞেস করল। তবুও এক দশা। তাই প্রত্যয়ের গেঞ্জি ধরে টান মারল ও। নিমেষে গর্জে ওঠে প্রত্যয়,

” বিরক্ত করছিস কেন?”
” কী আঁকছ তুমি?”
দোলনার একপাশের খালি জায়গা টায় বসে উঁকি দিল খাতায়। তৎক্ষনাৎ মুখ হা করে চমকানোর ভঙ্গিতে বলে উঠল,
” এগুলো তো জামাই, বউ ভাইয়া। তুমি জামাই বউ কেন এঁকেছ? ছি! পঁচা কাজ করেছ তুমি। ”

ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল প্রত্যয়। ঊষা তার ছোট ছোট হাতগুলো মুখে দিয়ে রেখেছে, ভাব এমন যেন লজ্জায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যয় খাতাতে তার আঁকা অপরিপক্ক ছবির লাল বউটা দেখিয়ে বলে,

” এটা তুই। আর পাশেরটা তোর জামাই। ”
” আমার জামাই? “– অবাক চোখে চেয়ে অনতিবিলম্বে প্রশ্নটা ছুঁড়ে মা-রল ঊষা।
সে তাল মিলিয়ে বলল,” হু। ”
” আমার জামাইয়ের নাম কী ভাইয়া?”
” কী নাম, জানিস না?”
ঊষা ভাবুকতার ভঙ্গিমা ধরে বলে,” না। ”
” প্রত্যয় এহসান তোর জামাইর নাম। ”
” কী বলো? তুমি আমার জামাই? ”
” হ্যাঁ। পুতুল পুতুল খেলতে গেলে তুই যে সবার কাছে বলিস ভাইয়া আমার জামাই,তাহলে এখন আমি তোর জামাই না কেন? তুই সবসময় আমাকে জামাই বলবি ঠিক আছে,পুষি?”

ঊষা ফ্যাসাদে পড়ে গেল। সে খেলায় অন্য কাউকে জামাই বানাতে লজ্জা পায়। সবাই মিছে মিছে জামাই বানায়। কার টা বেশি সুন্দর এ নিয়ে ঝগড়া করে। সবাই জানে ওর প্রত্যয় ভাই বেশি সুন্দর, তাই তো তাকে জামাই বানায় ও। কিন্তু মা বলেছে এসব পঁচা খেলা যেন আর না খেলে,ওড়না দিয়ে শাড়িও যেন না পরে। প্রত্যয় শুনলে ব-কবে ওকে। বকল না!উল্টো ওকে বলছে জামাই বলতে সারাজীবন। ভাইয়া ক্ষেপে যায় নি তো! ভয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,” আচ্ছা। ”

সেই কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া ঊষা হতে সময়ের সাথে সাথে দৃঢ় আশা নিয়ে আজ মেডিক্যাল পড়ুয়া ঊষা হলো সে। বদলে গেল প্রত্যয়ের কথা,পরিবর্তন হলো পরিস্থিতি, চাওয়া,আকাঙ্ক্ষা, মানুষ, মুখ। অথচ গ্রাম ছেড়ে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে,দূরত্ব মানিয়ে নিয়েও বুকে বউ হবার ইচ্ছেটা ধারণ করে রেখেছিল। স্বপ্ন, আশা এসবের দুঃসাহস সে করেনি,তাকে দিয়ে করানো হয়েছিল সেই অবুঝ বয়সে। তাহলে আশা দেওয়া মানুষটার মনের হাল কেন পরিবর্তনের খাতায় নাম লিখাল? নিরু ফুপির কথাও খুব মনে পড়ছে ওর। গ্রামের সবাই বলে সে তার নিরু ফুপির ন্যায় কোঁকড়া চুল পেয়েছে। অক্ষি কাচে ভাসছে বারংবার তার চলে যাওয়ার মুহূর্তটুকু। কি বি**ভৎস ছিল সেই সময়খানি! শেষবেলা ফুপির চেহারাটা দেখে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে ও। ভয়ের চোটে রক্ত হিম হয়ে এসেছিল। দিন কতক আওড়াল , ” ফুপির মুখ থেকে ফেনা বের হয়,ফেনা বের হয়। ” ফুপি কেন চলে গেল,কী হয়েছিল ও জানেনা। মস্তিষ্ক স্রেফ জানান দেয়- ফুপি বুকে অসম য**ন্ত্রণা নিয়ে বিদায় দিয়েছে সবাইকে।

নিশাতের জ্বরের মাত্রা কমে এসেছে দুদিন হলো। আপাতত চনমনে ভাবে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে শিমুলের জন্য রাস্তায় দাঁড়াল। আজ আর ওই বাড়ির মুখী হবে না। শিমুল কাজের লোককে দিয়ে খবর পাঠাল সে যাবে না স্কুলে। ভিতরে ভিতরে ঢের অভিমান হলো নিশাতের। ও জ্বরে বিছানায় পড়েছিল এই মেয়ে খবর নেয় নি একটাবার। প্রহর ভাইকে ও পছন্দ করে জানা সত্ত্বেও দিব্যি মজা করছে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে। ওকে এখন চিনছেই না। হাপুস নয়নে হাঁটতে লাগল স্কুলের উদ্দেশ্যে। আগামীকাল প্রহরের এনগেজমেন্ট। ও যদি পারত তনুজাকে কে-টে মরিচ লাগিয়ে দিতে। কিন্তু প্রহর এতে ওকে আস্ত রাখবে না। কী করলে ও ওর প্রহর ভাইকে পাবে? ভালোবাসা প্রকাশ করার মতোন প্রকান্ড ভয়া**বহ কাজটা তো ওর দ্বারা অসম্ভব। রিজেক্ট শব্দটা সে মানতে পারবে না। বলেই বা কী হবে! প্রহর ওকে ভালোবাসলে তনুজাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হত না।
পেছনে গাড়ির হর্ণের তীব্র আওয়াজে বুকটা ধ্বক করে উঠল। লাফিয়ে সরে গেল নিমিষেই। হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির তাল বেড়ে গেল। পশ্চাতে চাইতেই একটা হাত ইশারায় ডাকল কাছে। যাবে কি যাবে না ভাবনায় পড়ল মন। দ্বিধাবোধ নিয়ে অগ্রসর হতেই একটা লোক মুখ বাড়িয়ে মধুর গলায় জিজ্ঞেস করল,

” স্মরণিকা নিবাসটা এদিকে পুচকি?”

নিশাত হতবাক। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল অল্প সময়ের জন্য। বিস্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করল। কবি কবি ভাব নিয়ে থাকা ছেলেটা প্রশ্ন করল ফের,

” হেই সুন্দরী পুচকি, প্লিজ আন্সার মি।”

আরও একদফা থতমত খেল সে এহেন কথায়। তর্জনী তুলে সে ইশারা করল স্মরণিকা নিবাসে পৌঁছাবার রাস্তা বরাবর। ছেলেটা গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে থমকে গেল। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

” তোমার গায়ের রং টা খুব নজরে লেগে গেল সুন্দরী পুচকি। এতে আমার দো–ষ নেই, দো**ষ আমার চোখের। তবে প্রথম দফায় মন কাছে টানার ক্ষমতা রাখো তুমি। থ্যাংকস দেবো না,কারণ বার বার দেখা হবে এখন থেকে আমাদের।”

এমন অদ্ভুত, অস***ভ্য ইঙ্গিতে কথা বলবার মানুষ নিশাত প্রথমবার দেখে নি। ওর জীবনে আরো একটা অ**সভ্য লোক,ঘাড়ত্যাড়া লোক দেখেছে। ভিন্ন কিছু হলো পরিচিত,অপরিচিত শব্দগুলো। ওর জীবনের অস–ভ্য লোকটা ওর পরিচিত এবং বক্ষস্পন্দনে আধিপত্য বিস্তার করা লোক। আর বর্তমানের লোকটা অত্যধিক অপরিচিত। তার ক্ষুদ্র হৃদয়ের স্পন্দন তড়তড় করে বাড়িয়ে গেল বাজে বাজে কথা বলে।

তনুজাদের বাড়ির সবাই হাজির শিমুলদের বাড়িতে। আলতা,কাজের লোক সবাই কাজে ব্যস্ত। ঊষা চাচির হাতে হাতে কাজ করে দিতে লাগলে আলতা অনুরোধ করলেন,

” মা,দারোয়ানকে চায়ের পাতা আনতে বলেছিলাম। আনল কি-না দেখবি একটু?”

” যাচ্ছি কাকিমা। ”

বাহিরে এসেই মুখোমুখি হলো বিরক্তিকর একটা মানুষের। যাকে দেখলে তার সমস্ত অঙ্গে অঙ্গে অজস্র বোলতার হুল ফোঁটানোর যন্ত্র–ণা আরম্ভ হয়। চোখের গহ্বর হতে আগুনের হলকা বের হয় যেন। সমীরণ ওর মুখে জোরে একটা তপ্ততা মিশ্রিত ফুঁ দিল। ঠোঁটের কার্নিশে মৃদু হাসি ঝুলানো তার।চাউনি অটল। কথা বলল সে,

” আমার শুরুর অধ্যায়ের সমাপ্তি কি তুমি? যেখানে সেখানে কেন তোমাকেই দেখতে পাই? এটা কি বিশেষ কিছুর সাইন?”

ঊষার নেত্রদ্বয় দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠল। কণ্ঠে নির্ভয় ভাব,

” আমার হাতের থা**প্পড় কি আপনার এত প্রিয়? নারী লোভী লোক একটা!”

সমীরণ বেহায়া ভাব ধারণ করল। হাসল,স্মিতহাসি। চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে নিপুণভাবে ঊষার চোখের গভীরত্ব মাপতে চাইল সে। অপার ব্যর্থতা নিয়ে বলল,

” “শুনো ললনা, মনটা আমার খুঁজে পাচ্ছি না
হারিয়ে ফেলেছি তোমার ওই কৃষ্ণ চোখের মোহনায়
তুমি আমার হও,আমি আর দ্বিমুখী হব না। ”

“এক মন কতবার হারায়?”

” লক্ষ লক্ষ বার হারায়,হারাবে। থামবে না হারানো,চলতে থাকবে সন্ধান। তবে! যেদিন মিলবে পারমানেন্ট বাসস্থান, ভালোবাসব আমৃত্যু, হব আমি বিষা-ক্ত প্রেমিকের লিডার। ”

ঊষা পারছে না এই লোককে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। তনুজার ভাই বলে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে ও। বিড়বিড় করল,

” আপনার ভাগ্য ভালো সমীরণ দ্যা নারীলোভী, আমি পায়ে জুতো পরে বের হই নি। ”
________________________________

প্রহরের পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে এসেই তনুজা ছটফট করতে লাগল। আলতার পিছু পিছু ঘুরছে প্রহরের কী কী লাগবে, না লাগবে জানতে। বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে আলতা মুখ খুললেন,

” শক্তপোক্ত, ত্যাড়া মানুষটা পায়ে কেমনে ব্যথা পেল সেটা জেনে আসো আগে। ”

#চলবে,,,

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____২৫

তনুজা শাড়ির আঁচলটা একটু উপরে উঠিয়ে ঘরণী ভাব ধারণ করল। হালকা নীল চুলের গোছা হাত খোঁপা করার বৃথা চেষ্টা চালাল ও। পারল না,অদক্ষ সে এসবে। শাড়িটাও মায়ের থেকে পরে এসেছে। শাড়িতে অনভ্যস্ত হওয়ার দরুন সিঁড়ির ধাপ বইতে বেগ পোহাতে হচ্ছে প্রচুর। শুনেছে প্রহরের শাড়ি অত্যন্ত পছন্দ, তাই তার ওয়েস্টার্ন বেশভূষা ছেড়ে শাড়ি পরিধানের রুটিন চালু। আলতার কাছ থেকে প্রহরের রুম কোনদিকে জেনে নেয়। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়ল অবিশ্রান্ত, হাঁপানো কণ্ঠে,

” প্রহর সাহেব! এসেই শুনলাম আপনার নাকি পায়ে ব্যথা! কীভাবে ব্যথা পেলেন?”

প্রহরের নজর মোবাইলের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। সটান হয়ে শুয়ে আছে সে। পায়ে ব্যান্ডেজ। সাদা ব্যান্ডেজের ওপর বৃত্ত আকারে লালচে রক্ত। ব্যান্ডেজটা দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য্য ধরে রাখছে সে মায়ের মায়াভরা অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে বাধ্য হয়ে। নতুবা এরকম কা**টাছেঁড়া তার জন্য সাধারণ ব্যাপার। রাজনীতিতে ঢোকার পদক্ষেপেই সে একটা ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিল। টানা দশটা দিন পড়েছিল হসপিটালে গু–লিবিদ্ধ হয়ে। অতঃপর বড়ো,ছোট আ””ঘাত সইয়ে যাওয়া শিখে গিয়েছে, তিনটে স্টিচ লেগেছে এমনতর ক্ষত তুচ্ছ মাত্র।

” ঢুকার অনুমতি কি পাব না? “— মিহি কণ্ঠের উৎসুক প্রশ্ন।

প্রহর মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চাইল দরজার সমুখে অবস্থিত তনুজাকে। চাহনি দীর্ঘায়িত হলো না, এক পল ছিল বোধহয়। ভারী গলায় আসার অনুমতি দেয়,” আসুন। ”

তনুজা বিদ্যুৎ গতিতে ঘরে ঢুকল। দ্রুত বেগে প্রশ্ন করল আবার,

” বললেন না তো,ব্যথা কীভাবে পেলেন?”

প্রহর মোবাইলটা শিয়রে রাখে, বালিশের পাশে। তনুজার চেহারায় অস্থিরতার ছাপ পরিস্ফুটিত। বুকের অভ্যন্তর ভাগের উত্তেজনা চোখে,ওষ্ঠাধরে,মুখচ্ছবিতে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ক্রমশ। চোখের সূক্ষ্মতায় সবটা পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁটের কোণ বাঁকাল সে এবং তা সম্পূর্ণ তনুজার দৃষ্টি লুকিয়ে, অগোচরে। বিদ্রুপের স্বরে বলে,

” আপনার কি কষ্ট হচ্ছে? ”

তনুজা থমকালো। বুকে তীব্র তোলপাড় অনুভব করল। চকিতে তাকাল প্রহরের মুখের দিক। অচিরেই চক্ষুগহ্বরে আঁটকালো প্রশ্নাত্মক চাহনি। কুচকুচে কালো মণির ওই গহনে মন হারিয়ে বসল পর পর। নড়ল মেরুন রঙে রঙিন হওয়া দু অধর,

” কষ্ট হওয়ার ব্যাপারটা কি মন্দ? আমার সকল কষ্ট আপনাকে ঘিরেই হবে,কারণ আপনিই আমার ভবিতব্য। ”

ক্রমে ক্রমে জিতার পাল্লা ভারী হচ্ছে প্রহরের। মাথার পেছনে হাত গলিয়ে বলল,

” শক্ত বাংলা শব্দ শিখে ফেলেছেন আপনি বিদেশীনি। একটা সিক্রেট বলি আপনাকে? এটা একটা ইশারা বলতে পারেন আপনার জন্য। অথবা সতর্কবাণী। ”

অদ্ভুত কথার ধাঁচে তনুজার অক্ষি যুগল ছোট ছোট আকৃতিতে পরিণত হলো নিমিষেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নেত্রপাত করল। কণ্ঠে প্রবল আগ্রহ,

” বলুন। ”

প্রহর উঠে বসল। বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দূষিত করে ফেলে রুমের পরিবেশ। বলে,

” নরম জাতের মেয়েগুলো প্রচন্ড বোকা হয়। সেই বোকাসোকা, গুটিশুটি মেরে থাকা, ভয়ে হাঁটু কাঁপা মেয়েকে আমার ভীষণ মনে ধরে। এমন একটা মেয়েকে আমি এতটা চাই,যতটা চাইলে সে আমার বুকের বাম দিকের নরম মাংসপিণ্ড খুবলে খুবলে রক্তা**ক্ত করলেও আমার মূক হয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ”

তনুজা নিরব, স্তম্ভিত। ভাবনার দেশে পাড়ি জমাল। প্রহরের চরিত্র সম্পর্কে যতদূর জেনেছে শ্যামবর্ণ এই সৌষ্ঠবদেহী পুরুষের জীবনে কোনো নারীর ছোঁয়া নেই। তবে কি ওকে কোমল হতে বলছে? ওর ম্যাচিউর,সরাসরি কথা ব্যক্ত করার দিকটা কি প্রহরের মনের বিরোধী? উদ্যোগী হয়ে জানতে চাইল,

” আপনি কি আমাকে নরম স্বভাবের হতে বলছেন?”

উক্ত প্রশ্নের জবাবে বাক্য ব্যয় করল না প্রহর। আহত পা টা মেঝেতে স্পর্শ করে নির্বিকারচিত্তে বলল,

” আপনাকে শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তনুজা। ”

তনুজার গোলগাল গড়নের মুখশ্রীখানি অরুণ রঙে ছেয়ে গেল অবিলম্বে। গোলাপি পাতলা ঠোঁটে জায়গা পেল লজ্জালু হাসি। কেবলই এক বাক্য তবুও অতিরিক্ত ভারী ঠেকল ওর নিকট। নুইয়ে গেল মস্তক। পরক্ষণেই প্রহরের ঝাঁঝমিশ্রিত গলায় হকচকালো ও,ভাবতে বাধ্য হলো অত্যধিক।

” আপনি বুঝদার হতে পারেন,কিন্তু আপনার মাথার এক অংশ ফাঁকা। “– এহেন একটা কথা কেন বলল প্রহর? ঠাওর করা অত্যন্ত মুশকিল হয়ে পড়ছে। প্রহরকে বুঝা আর কোনো কঠিন ধাঁধা সলভ করা যেন প্রায়ই এক। সমীরণ কি তবে ঠিক বলেছে! কিছু জিজ্ঞেস করবে তার পূর্বেই হাতে শার্ট নিয়ে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল প্রহর। তনুজা বিস্মিত নেত্রে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পথে।

টি শার্টের ওপর শার্ট জড়িয়ে একেক করে সবকটা বোতাম মুক্ত করে রাখল প্রহর। শার্টের হাতা নিপুণ হাতে ভাঁজ করে কনুইয়ের একটুখানি কাছে এনে থামল। ঘাড় দুই দিকে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কাত করে পুরোদমে ফিটফাট হয়ে গেল, মাথায় যে স্থানের প্রতিচ্ছবি অংকন করেছে,সেখানে যাওয়ার নিমিত্তে। পথিমধ্যে মোশতাকের ডাক শ্রবণন্দ্রিয় হতেই এগিয়ে গেল ড্রইংরুমের আড্ডাস্থানে। পরিচিত তিনটি চেহারার দেখা পেল। তনুজার বাবা,মা ও চিরশ–ত্রুর স্থানে খাসভাবে বসানো সমীরণের। মোশতাক সাহেব তাকে দেখে মুখে শুকনো হাসি কায়েম রেখে বলে উঠলেন,

” কোথায় ছিলে? তোমার শ্বশুর,শ্বাশুড়ি এসেই তোমার খোঁজ করছেন। ”

” ঘুমিয়ে ছিলাম। “- নম্র কণ্ঠে প্রতুত্তর করে প্রহর। মোশতাক সাহেবের মন জুড়িয়ে গেল। প্রত্যয় মাঝে মাঝে উনার এক কাঠি উপরে থাকলেও প্রহর যেন তাঁরই শিষ্য। তার স্বভাব সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত তিনি। বেপরোয়া স্বভাবের ছেলেটা উনাকে মান্য করে, এতে খুব খুশি খুঁজে পান তিনি। একটা ছেলের ইচ্ছে ছিল উনার। ঊষাকে নিয়ে উনি সন্তুষ্ট নন,তেমনটা না৷ মেয়ে উনার জন্য গর্ব। তবুও প্রহরকে পেয়ে একটা ছেলে পেয়েছে যেন। তনুজার বাবা স্মিত হেসে বললেন,

” বসো বাবা। আমরা তোমার আর তনুজার এনগেজমেন্ট নিয়েই কথা বলছিলাম। ”

প্রহর চারদিকে দৃষ্টি মেলে বসল ঠিক ঠিক সমীরণের পাশে। মৃদু চাপা স্বরে বলল,

” তোর বাপ আমাকে দুই দুবার মা-রতে চেয়ে এখন মুখে মধুর বুলি আওড়াচ্ছে। তোরা কি গিরগিটির বংশধর? ”

সঙ্গে সঙ্গে সমীরণের সমগ্র আদলে ক্রোধেরা হানা দিল। সংবরণ করতে চাইল সে নিজেকে। চোয়াল শক্ত রেখে বলল,

” মুখ সামলে কথা বল। ”

” কত সামলাব বল। তোর বোন আমাকে পুরোই বেসামাল করে দিয়েছে। এখন তুই সামলাতে বললে হবে? তোর বোনটা অনেক কাজের। বোনের মতো মানুষ হো। ”

সমীরণের মুখোভঙ্গি আরো কঠিন হতে কঠিন হয়ে আসল। মোশতাক সাহেব ওদের দিকে তৃপ্ততার চাহনি নিক্ষেপ করলেন।

” তোমাদের দুজনকে একসাথে বসে থাকতে দেখে ভালো লাগছে। ”

” স্বাভাবিক। বন্ধুদের পাশাপাশি ভালো মানায়। ”

মনে মনে ঘোর বিরোধিতা করল কেউ প্রহরের উচ্চারিত বাক্যের। ভার্সিটির প্রতিটা দেয়াল,মাঠ,ঘাট সবকিছু স্বাক্ষী দুজনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, মা-রপিটের। উঠে দাঁড়াল প্রহর।

” আমার এখন যেতে হবে। আপনারা থাকুন। ”

মোশতাক সাহেব আনন্দপূর্ণ মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছো?”
প্রহরের নির্বিঘ্নে,ভাবলেশহীন বাক্য, ” মন যেদিকে চায়। সঠিক বলতে পারছি না। ”

মোশতাক সাহেব কিছু একটা আন্দাজ করলেন। হুঁশিয়ার করলেন ইশারায়, ” লক্ষ্য মনে রেখো। ”

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে এক পলক মোশতাক সাহেবের দিকে। তৎপরে সমীরণ ও তার বাবা-মাকে দেখে নিল। কণ্ঠে তাচ্ছিল্যভাব, ” আমি আমার নির্ধারণ করা লক্ষ্য ভুলি না,আমার চাওয়াও ভুলি না। ”

ছুটির ঘন্টা বাজতেই তাড়াহুড়ো করে সব ছেলেমেয়ে বের হতে উদ্বুদ্ধ হয়। নিশাত বেঞ্চে বসে একে একে সবার বেরিয়ে যাওয়া অবলোকন করছে। ওর পাশে বসা সাথী তাড়া দিতে লাগল,

” নিশু উঠ,উঠ। সবাই চলে যাইতাছে। তুই কী ঘুমিয়ে পড়ছিস?”

ব্যাগের উপর থেকে ঝটপট মাথা তুলে বসল নিশাত। চোখ দু’টো অসম্ভব রক্তিম। নিঃশ্বাসও মুক্ত হচ্ছে নিঃশব্দে। ঠোঁটযুগলের চামড়া শুকিয়ে টান টান ভাব। এই বুঝি ফেটে রক্ত ঝরবে, লালের আবীরে ছেয়ে যাবে অধরোষ্ঠ। সাথীর দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠ,

” তুই কি অসুস্থ? বাড়ি যাইবি না?”
নিশাতের মিহি স্বর ভাসল সমগ্র কক্ষে,” যাব। তুই যা,আমি বের হব একটু পর। ”
” শিমুল আসে নি বইলা তোর মন খারাপ? ”
নিশাত জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক অধরজোড়া সিক্ত করে জবাব দেয়,” জানিনা। ”
” আমি বুঝছি। ও এহন আইব না। তোর ফুপাতো ভাইয়ের না আংটি বদলের অনুষ্ঠান কাল?”

নিশাত মাথা নাড়িয়ে বলল,” হু। ”

প্রহরের এনগেজমেন্ট শনিবারে হবার কথা পাকাপোক্ত হয়। শনিবার আসতে এখনও মাঝে একদিন। খুব কি দেরি? না,দেরি নয়। তবে এনগেজমেন্টের পাকা দিন পরিবর্তন করে আগামীকাল শুক্রবারের সময় ধার্য করা হলো। নতুন করে পুনর্বার দাওয়াত পাঠায় মজুমদার বাড়িতে। দ্বিতীয় বার দাওয়াত দিতে আর প্রহর আসে নি,এসেছে চেয়ারম্যান অর্থ্যাৎ উজ্জ্বলের বিশস্ত এক লোক। তনুজাকে ভালোবেসে ওকে ভুলে বসেছে প্রহর নামক জ-ঘন্য লোকটা। ভুলে বসেছে শাসন,মার””ধর করা। কেউ যে শাসন,মা”রধর এতটা বি”শ্রীভাবে মিস করতে পারে সেটা প্রেমে না পড়লে কখনোই উপলব্ধি করত না নিশাত। প্রহর যদি ডেকে বলে,’ গাধী কাছে আয় তোকে মা””রি। ‘ তাহলে নিঃসংকোচে এগিয়ে যাবে ও। গাল পেতে দিয়ে বলবে,’ ইচ্ছেমতোন থাপ্প–ড় দিন। ছোট আমি,কষ্টের ওজন সইতে পারছি না প্রহর ভাই। ‘

মিনিট বিশ পর, সবার শেষে নিঃশক্তি দেহটা টেনে স্কুলের গেইট পেরিয়ে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল বিরতিহীন। উদ্দেশ্য টমটম খোঁজা। এ শরীর নিয়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। স্কুল ছুটির সময়ে টমটমের মেলা বসে,গিজগিজপূর্ণ অবস্থা থাকে। অথচ এখন দুস্তিথি পড়েছে।

টমটম না পেয়ে সমুখে পা ফেলতেই আত্মা ধুম করে লাফিয়ে উঠল নিশাতের। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। কপাল হতে কানের পাশ দিয়ে এক ফোঁটা ঘাম বিন্দু বেয়ে গেল। তিরতির করে কম্পনরত আঁখিপল্লব মেলে সম্মুখে নিক্ষেপ করল ভীতু চাহনি। পানি চিকচিক করছে চক্ষুকোলে,বক্ষস্থলের ধড়ফড়ের আওয়াজ শ্রবণগ্রন্থিতে প্রবেশ করছে অবলীলায় তড়তড়িয়ে। আচমকা একটা বাইক এসে শরীরের খুব সন্নিকটে ব্রেক কষায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। দৃষ্টি চমৎকৃত। মাথায় হেলমেট পরে একজন সুঠাম পুরুষ বাইকে বসে আছে। গা টা ছমছম করে উঠল বিপদ বুঝতে পেরে। বাম পা পিছিয়ে নিতেই শীতল স্বর এলো কর্ণকুহরে,

” আমার পেছনে বস। ”

কণ্ঠটা ওর অতিশয় চেনা। কতশত,সহস্র, লক্ষ্য বার শ্রবণপথে এসেছে এ সুর। বহু বার লহরীর সূচনাপাত ঘটিয়েছে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে। নিশাত নিস্পন্দ হয়ে চেয়ে রইল অপলক,বেহিসাব। ঝাঁঝমিশ্রিত গলা শুনতেই নড়েচড়ে উঠল।

” তোকে কি কোলে করে বসাতে হবে?”

অল্পক্ষণ সময় নিয়ে আমতা আমতা করল,

” আপনি এখানে কী করছেন?”

” তোদের স্কুলের মেয়েগুলো হেব্বি কিউট দেখতে। আমি এতদিনে বিয়ে করলে আমার মেয়েও সিক্স নয়ত সেভেনে পড়ত, না রে? বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে দেখে বাচ্চার বাপ না হওয়ার আফসোস করতে চলে এলাম এখানে। আর প্রশ্ন করবি?”

শেষের কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল প্রহর। নিশাত অপ্রতিভ হলো, সিরিয়াস মোমেন্টে হাসবার মতোন দুঃসাহসিক কান্ডখানা করতে যাচ্ছিল আবার। কোনোমতে ঠোঁটে ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে আটকাল অভদ্র হাসিটুকু। মন্দ বলে নি প্রহর। বিয়ে করলে ঠিকি তার একটা বাবু থাকত,সে হতো বাবুর বাপ। কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগ খুলে সুবোধ বালিকার ন্যায় বাইকে উঠতে যাবে টেনে ব্যাগটা নিয়ে নিল প্রহর। বলল

” তোর ব্যাগটা এত ভার কেন? কি ভরেছিস এতে? লিলিপুট হয়ে এত বড় ব্যাগ নিয়ে হাঁটিস। ”

নিশাত উঠে বসে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। প্রহরের কাঁধ স্পর্শ করবে কি-না ভাবতে লাগল। নিস্পৃহ কণ্ঠে উত্তরে বলল,

” আজ গাইডসহ এনেছিলাম। তাই ওজন বেশি। ”

” আচ্ছা। ধরে বস আমাকে। ”

ও বোকার ন্যায় প্রশ্ন করে বসল,” কোথায় ধরব?”

প্রহর ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল ওকে। অত্যন্ত মনোযোগের সহিত চাইল। ইতস্তত অনুভূতিতে হকচকিয়ে গেল নিশাত। হেলমেটে ঢাকা মুখ,দৃষ্টি সে পরখ করতে পারল না। তবে নিশ্চিত সেই চোখ দু’টির নজর গভীর, অনিমেষ।

” আগে আমার সাথে বাইকে উঠলে কোথায় ধরতি? কাঁধ, ঘাড়, পেট সব আপাতত তোর সম্পত্তি। যেভাবে পারিস মালিকানা খাটা। ”

মনের আনচান, বেতাল অনুভূতি সমেত প্রহরের পেট জড়িয়ে ধরল ও। চাওয়ার বৃদ্ধি হলো। স্পৃহা জাগছে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে দিতে। প্রহর বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,

” তোর লিপস্টিকের ঘ্রাণটা সুন্দর। সেদিন রাতে কি এটাই ছিল ঠোঁটে? ”

নিশাতের শীর্ণ কায়ায় তরঙ্গ খেলে গেল। হড়বড়িয়ে প্রশ্ন করল তখনি,

” কোন রাতে?”

প্রহর দৃষ্টি সামনে নিবিষ্ট রাখে। নির্লিপ্ত সে,

” জ্বরের ঘোরে আমাকে চুমু খেয়েছিলি যে রাতে। ”

নিশাতের মাথা ঘুরছে। এটা কী শুনল সে! নিজ কানকে বিশ্বাস করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। উত্তেজনা ভীড় জমালো কণ্ঠে,

” আমি চুমু খেয়েছি?”

প্রহর ক্ষিপ্রতায় বলল,
” তাহলে কে খেয়েছে? রফিক আজম বলে আমি চরি**ত্রহীন। আর আমার মোবাইলে থাকা ছবি বলে চরিত্র**হীনের বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট চরিত্র লুন্ঠনের চেষ্টা চালিয়েছে তাঁর সুন্দরী কন্যা মেহরিন মজুমদার নিশাত। ”

নিশাতের মুখ হা হয়ে গেল,” ছবি?”

” বহুদিন পর সুযোগ পেয়েছি মামুজানের পেটে ডায়রিয়া,আমাশয়ের উৎপত্তি ঘটানোর। হাতছাড়া করি কীভাবে? ”

#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)