প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-২৯

0
848

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____২৯

আলতা আঁচলে মুখে চেপে কেঁদে চলেছেন অবিরত,অরব। একনাগাড়ে টপাটপ ঝরছে নোনতা জল। প্রহরের চোখে মুখে এতসময় যাবত বিচরণ করা বিরক্তিভাব উবে গিয়ে, তেজ নিভল কিছুটা। চাহনিতে ঠাঁই পেল হতাশা। কাতর গলায় বলল,

‘ তুমি কি এই মরণকান্না থামাবে মা?’
ফুলেফেঁপে উঠলেন আলতা। কণ্ঠে আকাশসম তেজ,
‘ কেন থামব? আরো কর রাজনীতি। তোরা কেউই আমার কথার দাম দিস না। কী দরকার ছিল বাপের কথায় লাফিয়ে লাফিয়ে দুই ভাই এসব অপ–কর্মে জড়ানোর? ‘
‘ লিসেন মা। এটা মোটেও খারাপ পেশা না। বরং ভীষণ হেল্পফুল। হাতে ক্ষমতা থাকলে অনেক কিছু করা যায়। সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়াটা হয়ে যায় সহজ। এই পথে হাঁটলে এমন একটু আধটু চোট পেতেই হবে। তাই বলে কি ম**রে গিয়েছি? বেঁচে আছি। তোমার সামনেই জলজ্যান্ত বসে আছি। সামান্য ক্ষততে দুর্বল হই না আমি। ‘
পায়ের ব্যান্ডেজটায় বিবশ চোখে তাকালেন আলতা। হাতের দগদগে ক্ষত ঢাকতে আগেরটা খুলে মুড়িয়ে দিতে লাগলেন নতুন ব্যান্ডেজ। গলাটা প্রচন্ড আহত। যেন পাহাড় ন্যায় বিশাল কষ্ট আছে জমে গ্রীবাদেশে।
‘ সেদিন আব্বার বাড়িতে নিশাতকে দেখতে গিয়ে পা কেটে আসলি। আজ ওকে নিয়ে গেলি পাশের গ্রামের দাওয়াতে। গিয়েই হলি হাম**লার শিকার। এ যাবত কয়বার মর**ণদশা হয়েছে তোর খেয়াল আছে? কী দরকার অনিশ্চিত, যন্ত্র*ণার জীবন নিয়ে থাকার?’
আলতা থামতে গিয়ে, নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে বিচলিত হলেন। মনে পড়ার ভঙ্গিতে তাকালেন।
‘ আর নিশু? ও কেমন আছে? আমার মেয়ে ব্যথা পেয়েছে?’
‘ তোমার মেয়ে ব্যথা পাবে আমি থাকতে? তোমার ছেলের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার ভাইঝি সুরক্ষিত। ‘
‘ ঘরে বউ রেখে ওর সুরক্ষা করবি?’

আলতার কণ্ঠে অভিযোগ স্পষ্টত। প্রহর মায়ের মুখ অবয়বে চেয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হাসল মৃদু। বলল,
‘ আপনার অভিমানী স্বরটা বেশ সুন্দর ডাক্তার ম্যাম। উজ্জ্বল সাহেব নিশ্চয়ই এই কণ্ঠ শুনেই ইম্প্রেস হয়েছিল। ‘
ছেলের বাহুতে কিল বসাতে গিয়ে থমকে গেলেন আলতা। ইশ! কতকাল পর ছেলেটা অমন করে কথা বলছে! প্রহরের আগের মতো কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ব্যাপক হারে আনন্দ, খুশি,সুখ,শান্তি সব! সব জড়ো হয়। সুখের আবেশে ভারী হয়ে ওঠে বুক। ব্যান্ডেজ সেরে করুন সুরে বললেন,
‘ তুই কিন্তু এখনও বলিস নি পা টা কীভাবে কা–টলি?’

প্রহর চোখ বুঁজে ফেলল। ঘন ঘন পাপড়িগুলো ছুঁলো চোখের নিম্ন ত্বক। পুরো কক্ষে তপ্ত নিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি। কণ্ঠে উপহাস,
‘ আর কীভাবে কাটব? সব তোমার বাপের বাড়ির কূটনীতির ফলাফল। তোমার ভাইঝিকে আনতে পারছি না তোমার ভাইয়ের জন্য। আর ওকে দেখতে গিয়ে আমার এমন দশা। গেলাম চো–রের মতো। মামী দৌড়ে এসে বলল প্রহর সৌরভ আছে সামনের দরজায়। তুই বারান্দা দিয়ে নাম বাবা। আমি কি কোনো মুভির নায়ক? বললেই বারান্দা দিয়ে নামতে পারব? কিন্তু তোমার ভাবী আমাকে নামিয়েই ছাড়ল। নামতে গিয়েই কাঁচে পা ধেবে এ হাল। আজ যদি প্রেমটেম করে অমন আ**ঘাত পেতাম তাহলে মেনে নিতাম মাথা নত করে,এক রত্তিও আফসোস হত না এত এত অপ–মানের, দুঃখের,লুকিয়ে চুরিয়ে যাবার৷ এই সবকিছুর উশুল আমি তোমার ভাইঝিকে দিয়ে তুলব মনে রেখো। ‘

আলতা আলতো হাসলেন। প্রচন্ড মুগ্ধময় হাসি। প্রহরের কণ্ঠ ভার হয়। বলে,
‘ তোমার এই হাসিটা ওই মেয়ে কেমন করে পেল বলো তো? একেবারে বুক ফালা ফালা করা হাসি হাসে। দেখলেই ইচ্ছে করে মুখ চেপে ধরে বলি একদম হাসবি না কারো সামনে। ‘
প্রহর মায়ের অধর জুড়ে এবার রহস্যময় হাসির খেলা দেখল। শুনল কৌতুকের স্বর,
‘ তোর কিন্তু কাল এনগেজমেন্ট। বাহিরে তোর হবু মিসেস দুশ্চিন্তায় পায়চারি করছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে। ‘
প্রহর বিষন্ন দৃষ্টি ছুঁড়ে মারল মায়ের দু চক্ষে। কথায় অভিমান,উত্তাপ,
‘ ওকে পাঠাবে না। যাকে পাঠানোর প্রয়োজন তাকে পাঠাচ্ছ না তুমি মা। ‘
‘ তোর ক্ষণস্থায়ী জীবনে ওকে দীর্ঘস্থায়ী করার কথা আমি আগে কল্পনা করলেও এখন আর করি না। মোলায়েম ও। দুমড়ে মুচড়ে যাবে। পারবে না সইতে। তাছাড়া এতগুলো বছর একই কারণে তুইও দূরে ছিলি। ‘
চট করে উঠে দাঁড়াল প্রহর। উদোম, সুঠাম দেহে টি শার্ট জড়াতে জড়াতে প্রতুত্তর করে স্বাভাবিক, শীতল গলায়,
‘ ওর সইয়ে যাওয়ার বয়স হচ্ছে মা। বড় হতে হতে ঠিক বুঝে যাবে সব। ‘
‘ তনুজাকে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছিস?’
‘ ভালো হবে তাই।’

‘ নিশুর সাথে অমন করছিস কেন? এনি হাউ তিন বছর আগে তোর জন্মদিনে হওয়া ব্যাপারটা নিয়ে এমন ব্যবহার করছিস ওর সাথে? ‘
‘ আমি ওর সাথে স্বাভাবিক ছিলামই কবে?’– নির্ভীক, নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর প্রহরের।
‘ তিন বছর আগে বড় ভাইয়া যা করেছে আমি মানি সেটা সম্পূর্ণ ভুল। ‘
প্রহর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তাচ্ছিল্যের, মজা পেয়েছে শুনে এমনতর হাসি। পরক্ষণেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

‘ ওটা কোনো ভুল ছিল না। তিনি অতীতের রা-গ ধরে রেখে শুধু সুযোগ লুটে নিয়েছেন। সেদিন আমি জাস্ট নিশুকে সামনে রেখে জন্মদিনটা উদযাপন করতে চেয়েছিলাম। মামীর থেকে অনুমতি নিয়েই এনেছিলাম ওকে। হয়ত মামী ভয়ের দাপটে পারেন নি সত্যিটা বলতে,মুখ খুলতে। তোমার ভাই কী করল? মামলা ঠুঁকে দিলেন আমার নামে। উনার ভাষ্যমতে, তাঁর কচি মেয়েকে আমি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছি জোর করে। আমার গায়ে তকমা লাগালেন,দূষিত তকমা। এসব নিশু করে নি। ওর প্রতি আমার কোনো আক্ষেপ, জেদ নেই। মাঝে মাঝে মেজাজের অদলবদল হয়,রাগটা ওর ওপর গিয়ে পড়ে এটুকুই। তাছাড়া আমি আগে থেকেই ওর সাথে কঠিন মা। তুমি এসব চিন্তা করে প্রেশার হাই করো না। বিশ্বাস রাখো,তোমার ভাইঝি কখনো আমার দ্বারা কষ্ট পাবে না। ‘

মোশতাক সাহেব ছুটে এলেন। পেছন পেছন উজ্জ্বল, তনুজার বাবা। বাবাকে দেখে সাহস বাড়ল তনুজার। সবার সাথে ঘরে ঢুকল ঝট করে। আলতা কিছু বলতে গিয়েও নিরব হয়ে গেলেন। কক্ষ ছাড়লেন। মোশতাক সাহেব উদ্বিগ্ন, প্রবল উত্তেজিত,

‘ আজ আবার হা**মলা! ঠিক আছো তুমি? ‘
‘ আপনি চিন্তা করবেন না। এসব কিচ্ছু না। এর থেকেও গুরুতর হাম–লা সহ্য করে ফেলেছি। এ আর নতুন কি! ‘

কাঠ কাঠ উত্তর। মোশতাক সাহেব আশ্বস্ত হলেন কিছুটা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে উজ্জ্বল পিঠ চাপড়ালেন।
‘ নিজের খেয়াল রেখে এ পথে চলতে হবে। ‘
‘ পথটা রিস্কি। এটাই এখন রক্তে মিশে গিয়েছে বাবা। ‘
উত্তর শুনে প্রসন্ন অনুভব করলেন মোশতাক সাহেব। মনে মনে বললেন,’ এই হলো রাজনীতির রাজ্যে রাজার কথার সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য। ‘

সবার চেহারায় অল্প খুশির ছটা লেগে থাকলেও তনুজার কাজলে আঁকা আঁখি দুইয়ে ধরা পড়ে বাবার থমথমে আদল। বাবাকে কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ আপসেট মনে হচ্ছে। কিন্তু কারণটা কী! ওর বুকের ভেতরটা যেন কেউ কুচিকুচি করে ফেলেছে। যেই মুহূর্তে প্রহরের রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজে মোড়ানো বাহু নজর কাড়ল চোখের,তক্ষুনি সূত্রপাত হয়েছে বক্ষস্থলে ভাঙনের, গতির পরিবর্তন করেছে হৃদস্পন্দন। মোহ ছাপিয়ে মায়াতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল নিমিষেই ও। সে শুনেছে ভালোবাসার চেয়ে মায়া মারা**ত্মক ক্ষতিকর বিষয়, কিন্তু অত্যন্ত আদুরে শব্দ। ওকে ক্ষেতের মাঝ হতে প্রহরই নিয়ে আসে। বাড়িতে এসেই রুমে গিয়ে ধড়াম করে লাগিয়ে দেয় রুমের দরজা। ভয়ার্ত হয়ে তনুজা ছুটে যায় আলতার নিকট। মা ছাড়া রুমে আর তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এলাউ করে নি সে। দুর্ভাবনা, আকুলতা মনে বহন করে মুখিয়ে রয়েছে তনুজা এক দু বাক্য প্রহরের সঙ্গে বিনিময় করার আশায়।

হালকা হালকা গন্ধবহ বইছে আঁধারিয়া প্রকৃতি জুড়ে। টলছে গাছের পাতা। ঈষৎ ঈষৎ ঠান্ডায় জুবুথুবু অবস্থা। শীতের আগমনী বার্তা বহিছে প্রকৃতির আনাচে-কানাচেতে। ঊষা চপল পায়ে ছাদে এলো। সন্ধ্যার কমলাটে সূচনালগ্নে ছাঁদে ছিল ও। তখনই ছাঁদে পাতানো বেতের মোড়ার ওপর আনমনে, ভুলোমনে ফেলে যায় মোবাইলটা। যেহেতু এ বাড়ির সদস্য ব্যতীত কেউই তেমন একটা ছাঁদে আসে না তাই হারানোর চান্স ছিল শূণ্যের কোঠায়। পড়ার ফাঁকে অকস্মাৎ মনের দরজায় মোবাইলের খেয়াল উপস্থিত হওয়া মাত্র বইটই খোলা রেখে তড়িৎ গতিতে,অস্থিরচিত্তে এলো ছাদে। এসেই বড়সড় শক খেল ও। চমকালো অতীব। নিবিড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে চলে আসতে নিলে সমুখের পথ হলো অবরুদ্ধ। সমীরণ গাঢ় গলায় বলে,
‘ দাঁড়াও। ‘
চওড়া,বলিষ্ঠ দেহী সমীরণের সম্মুখে ও চুনোপুঁটি ব্যতীত কিছুই নয়। এছাড়া পরিবেশ ঘন অমানিশায় ডুবে। সামনের ব্যক্তিটা কতটা চরিত্রহীন, দৃষ্টি কতটা কামুকতা মিশ্রিত তা হারে হারে জানে সে। নিস্তেজ কণ্ঠে উত্তাপ এনে গলা উঁচিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্নাত্মক বাক্য নিক্ষেপ করল,
‘ কেন? কী জন্য? আপনি সবসময় পথ আগলে কেন দাঁড়িয়ে পড়েন?’
‘ কথা আছে। ‘
নিরুত্তাপ সমীরণ। অভিব্যক্তি উদাসীন। ঊষার মায়াময় চেহারার হাল পাল্টে গেল। ছোট ছোট চোখ, ওষ্ঠযুগল কুচঁকে ফেলল। বিকৃত আকৃতিতে পরিণত হয় মুখ। বি**শ্রী গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি পেঁচিয়ে যাওয়ার উপক্রম তার। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছুটছে ক্রোধ। সেই ক্রোধানলে দগ্ধ হয়ে মুখ খুলল,
‘ আপনি আমাদের বাড়িতে এসে ম**দ খেয়েছেন? আপনার এরকম অভদ্রতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। ‘
সমীরণ প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করল। অধর কোলে রসাত্মক মিশেল হাসি। ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,
‘ কেন তোমার ওই দু ভাই খায় না? আমি খেলে দোষ? ধুর শা**লা। ‘
‘ মুখ সামলান। বেয়াদব লোক। আমার দু ভাই কখনোই বাড়িতে বসে এসব করে না। আপনার মতো চরিত্র**হীনও না তারা। ভদ্রতার বালাই আপনার মধ্যে না থাকলেও তাঁদের মধ্যে আছে। ‘
সমীরণ মাথা দোলাল। আনন্দিত গলায় তার অকপটে স্বীকারোক্তি,
‘ আমি অভদ্রই। তোমার কাছে চূড়ান্ত অভদ্র হতে চাইছি। সুযোগটুকু দাও হবু ডাক্তার সাহেবা। ‘
বলেই সে অনুমতিবিহীন টেনে ধরল ঊষার বা হাত। তুমুল বেগে ঊষার শরীর অবশ হয়ে গেল। জমে গেল,নির্ভীক, নির্জীব হয়ে পড়ল সে। সমীরণ সুপুষ্ট হাতে কাছে টানে ওর স্থির শরীরখানা। বিড়বিড় করে,
‘ আমার হয়ে যাও। যেদিন প্রথম তোমাকে মন্ত্রীর মেয়ের বিয়েতে দেখেছিলাম তখন থেকেই তুমি আমার চাওয়া। প্রয়োজন হলে তোমাকে পেতে আমি সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবো। তার আগেই স্বেচ্ছায় নিজেকে সঁপে দাও আমাকে। ‘

সারা শরীরে ঘেন্না ধরে গেল ঊষার। বুকের অভ্যন্তরে জোরেশোরেই পড়ছে ধ্বক ধ্বক চাবুকের আ-ঘাত। কঠিন স্বরে বলল,
‘ আমি আপনার বিজ্ঞাপনের শরীর প্রদর্শন করা মেয়ে নই যে আপনি বলবেন আর নিজের অমূল্য সম্পদ আপনার মতো নির্লজ্জ, দুশ্চ**রিত্রকে দিয়ে আমি ভিখিরি হয়ে যাব। ‘

সমীরণের রক্তিম চোখের দৃষ্টি অসম্ভব লাল হয়ে উঠেছে। হাতে অত্যধিক চাপ প্রয়োগ করে ঊষাকে ব্যথা দিতে উদ্যত হলো সে। তড়তড়িয়ে অশ্রুকণারা এসে ভীড় জমালো চক্ষুগহ্বরে। রোদনভরা চাহনি ঊষার। বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠে সমীরণ,
‘ সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আমি আঙ্গুল বাঁকা করতে জানি। তোর,,,,
কথা শেষ করবার আগেই মাটিতে ছিটকে পড়ল সে। চৈতন্য ফিরে পাওয়ার পূর্বেই হাতের পৃষ্ঠে ধারালো জুতার ক্রমাগত চাপ। ব্যথায় স্থির হয়ে আসতে আরম্ভ করে হাতটা। শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে যন্ত্রণা। তবুও দমল না সে,

‘ কী ভাই? এখানে এখনই আসতে হলো?’
‘ তুই ঊষাকে ছুঁয়েছিস কোন সাহসে হারা–মির বা***চ্চা? কেন ছুঁইলি তুই ওরে? ‘
অসংবরণ ক্রোধে ফেটে পড়েছে প্রত্যয়। দরদর করে ঘামছে সে। চোয়াল কঠিন হয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি যেন ভস্ম করে দিতে প্রস্তুত সমীকরণকে। অথচ সমীরণ নিরলস,
‘ তাতে তোর কী? কষ্ট লাগছে? ক’টা রাখবি। তুই কি ঘরে একটা,বাহিরে একটা রাখিস? আরে ভাই আমার মৃন্ময়ীর দরকার নেই। ওটা নিয়ে শান্তিতে থাক না। এখন আমার আর ঊষার মাঝে আসছিস কেন? তোরও কি আমার মতো চরিত্রে দোষ আছে ব্রো?’

ঊষার অন্তরআত্মা ছ্যাঁত করে উঠল। বড়সড় বিপদের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছে ও। প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল,
‘ ভাইয়া চলো প্লিজ। এই লোক এমনই। কাল বড় ভাইয়ার এনগেজমেন্ট। ঝামেলা করো না। নিচে চলো। ও ইচ্ছে করে তোমাকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করছে। ‘
প্রত্যয় পা সরিয়ে এনে জ্বলন্ত চক্ষে চেয়ে বলল,
‘ কলিজায় হাত দিয়েছিস। ‘
পকেট থেকে রুমাল বের করে সমীরণের সম্মুখেই ঊষার হাতটা মুছে দিয়ে আঙ্গুলের ফাঁকে আঙুল বদ্ধ করল সে। ঊষার কষ্ট, ঘেন্না,আপত্তিকর স্পর্শ সবকিছু ধুয়েমুছে গেল আকস্মিক। মোহাবিষ্ট হলো ও। রোমকুপে রোমকুপে শিহরণের আন্দোলন। এই ছোঁয়া,এই আঙুলে আঙুলের বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়াটা যদি অন্যরকম হতো!
____________________________________

গতরাত হতে নিশাতের পেটে খাবার পড়ে নি। রোকেয়া বলে কইয়েও মেয়েকে খাওয়াতে পারছেন না। মেয়ের মনের হালচাল নিয়ে এবার আর তাঁর বুঝবার কিচ্ছুই বাকি নেই। রান্না করতে গিয়ে চিন্তায় সব কেমন থেমেথেমে থাকছে। কিশোরী বয়সের এহেন হাল নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। আজ উনারও খুব করে নিরুর চেহারাটা ভেসে উঠছে। ওই এক মুখ,ওই এক মানুষের রেখে যাওয়া বি**ভৎস কান্ড ভয়ের দানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে গেছে সবার মনে। রোকেয়ার আত্মা কেঁপে উঠল। নিশাতও যদি এমন করে? প্রেমের ভূত মাথায় চাপিয়ে মর**ণঘাটে যাওয়ার মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত যদি নিয়ে নেয়? না,না। মেয়েকে চোখে চোখে রাখবেন উনি অন্যঘরে না দেওয়া অব্দি।

কাঁথা মুড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে নিশাত। ঘুম কাতুরে মেয়েটার গত রাত থেকে এক ফোঁটাও ঘুমোয় নি। চোখের নিচে কালো আবিরের মাখামাখি এক রাত্তিরেই। ঘুম,নাওয়া,খাওয়া সব ভুলে তার মাথায় স্রেফ উঁকি দিচ্ছে প্রহরের এনগেজমেন্ট এর বিষয়টা। সারাদিন,সারাবেলা ফুরিয়ে এলো কেঁদে কেঁদে। গুমরে কাঁদছে ভিতর। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে কত্তগুলো কল দিয়েছে শিমুলকে। রিসিভ হয় নি। আচ্ছা ও কি একটাবার যাবে ওই বাড়ি! কিন্তু বাড়িতে কী বলে যাবে! বাবা,সৌরভ ভাই,কাকা সবাই-ই এসময় বাড়িতে রয়েছে।

ঘড়িট কাটা টিকটিক করে সাতের ঘরে পৌঁছালো। সুখের বিনষ্ট করে এগিয়ে চলছে দুর্দম্যে সময়। নিশাতের ফোনেও তখন জোরেজোরে বেজে চলেছে রিংটোন। দু-তিন বার বেজে থামল। নিচের ঘরে বসা ছিল নিশাত। ফোনের আওয়াজ শুনে ছুটে এলো দমটুকু হাতে নিয়ে। হাপুস নয়নে চাইল স্ক্রিনে। আশ্চর্য হলো,অবিশ্বাস্য ঠেকল। পুনরায় বাঁজতেই তুলে ধরল কর্ণধারে। দৃঢ়, সাবলীল স্বর,

‘ কাল সকালে বাস স্ট্যান্ডে আসবি,সাথে সেদিন যেই বক্সটা দিয়েছিলাম সেটা নিয়ে আসবি। আর ঘরে লাল ওড়না আছে?’

নিশাত স্তব্ধ। ওপাশের মানুষটার মেজাজ তিরিক্ষি। দলা পাকানো কান্নার বল সমেত বেরিয়ে এলো, ‘ হু। ‘

অপর পাশের মানুষটা ঠিক ঠিক শুনল কান্নারত কণ্ঠ। বেশ ভালো করেই শুনল। ঝাঁঝের সহিত আদেশ করল,

‘ লাল ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে আসবি। খবরদার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোমটা দিবি না,নিজেকে দেখবি না। তোকে দেখব আমি। ‘

তর সইল না নিশাতের। ব্যকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে বসে,

‘ আপনার আংটি পড়ানো অনুষ্ঠান শেষ? ‘

‘ শেষ। ‘

সহজ সরল, কিশোরী হৃদয়ে জলোচ্ছ্বাস তোলবার উত্তর।

#চলবে,,,