#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৩৪
ঊষার লাজুক নজর ঝুঁকে স্থির হলো নিজের হাতের করপুটে। নিটোল ওষ্ঠাধর কম্পিত হতে গিয়েও থমকালো। হলো নিস্তব্ধ। কী জবাব দিবে ও! মিছামিছি উত্তরবিহীন তার কাছে কোনো সদুত্তর সাজানো নেই। থাকলেও সেই উত্তরে মিশে আছে ভয়াবহ প্রলয়। প্রহর নির্মল,শ্বেত পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে হৃষ্টপুষ্ট কনুই পর্যন্ত গুছিয়ে রাখল। তপ্ত দুপুরে ধোঁয়া উঠা কফির মগে তীক্ষ্ণ নজর নিবিষ্ট রেখে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে,
‘ তুই সত্য লুকাতে চোখ নিচু করে ফেললি। কিন্তু তোর এই নত মাথা আমাকে সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিল। এই অপূর্ণ, অপ্রকাশিত ভালোবাসা থেকে পালাতেই এত জলদি বিয়ে করে নিচ্ছিস?’
ঊষা অধোবদনে ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘ পালাতে হলে কবেই এ বাড়ি ছেড়ে দিতাম ভাইয়া। পালিয়ে যাচ্ছি না । শুধু মনে হলো জীবনটা গুছানো প্রয়োজন। ‘
প্রহর বক্র চাউনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই কি আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিস? ‘
তড়াক করে সোজা হয়ে বসে ঊষা। ব্যগ্র হয়ে বলল,
‘ না ভাইয়া। লজ্জা পাচ্ছি না। তুমি আমার মনের কথা ধরে ফেলেছ এটাই আমার জন্য অনেক। বাবা ছাড়া কেউ জানত না। নিজের মধ্যে কথাটা কয়েক বছর ধরে লুকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে ম**রে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল। এই যে তোমার কাছে এখন মন খুলে বলতে পারছি কত ভালো লাগছে জানো? ‘
‘ যাকে এত ভালোবাসলি,বাসিস তাকে কখনো জানাবি না?’
প্রহরের সোজাসাপটা প্রশ্নসূচক বাক্য শুনে ঊষার অন্তঃপুর অশান্ত হয়ে উঠে। চিত্তে শুরু হয় শঙ্কার তোলপাড়। ভীষণ আকম্পন কণ্ঠস্বর,
‘ না ভাইয়া। আমি প্রত্যয় ভাইয়াকে কখনো বুঝতে দিতে চাই না আমি তাকে পছন্দ করি৷ নয়ত আমি ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতে পারব না। সবসময় মনে হবে ভাইয়া তো আমাকে ভালোবাসে নি,তাহলে আমি কেন ভালোবাসা প্রকাশ করে আমাদের সম্পর্কের রূপ বদলে দিয়েছি? আজ যেমন করে সহজে ভাইয়ার সাথে মিশতে পারি,এটা জানার পর আর স্বাচ্ছন্দ্যে মিশতে পারব না। এমনকি ভাইয়াও আমার সাথে দূরত্ব বজায় রাখবে,কথা বলবে না আগের মতো। তোমার কাছে একটা অনুরোধ ভাইয়া এটা কাউকে বলো না। দূরে চলে গেলেও আমি আগের মতোই তোমাদের আদরের জায়গায় থাকতে চাই। প্রত্যয় ভাইয়ার ভোরের পাখি ডাক থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। প্লিজ ভাইয়া। ‘
সিগারেটের ছোঁয়ায় ঈষৎ পোড়া ঠোঁটে স্মিত হাসি সমেত প্রহর উঠে দাঁড়ায়। ঊষাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ আমি অনেক আগেই প্রত্যয়ের জন্য তোর ভালোবাসা বুঝিয়ে গিয়েছি। শুধু সামনে কি হবে সেটার অপেক্ষায় ছিলাম। প্রত্যয় মৃন্ময়ীকে না চাইলে আমি ধরে বেঁধে ওকে তোর বানিয়ে দিতাম। দেখ,আমি তোর কাজকর্মে বুঝে গেলাম তুই ওকে ভালোবাসিস কিন্তু গর্দভটা বুঝল না। একদম নিশুর মতো গাধা। চোখের সামনে ভালোবাসা, কানার মতো না দেখে চলে যাচ্ছে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আদৌ গাধাটা মৃন্ময়ী নামের মেয়েটাকে ভালোবাসে কি-না! ওর তো আবার মেয়েদের সাথে টাইমপাসের খারাপ স্বভাব আছে। ‘
ঊষা দাঁড়িয়ে বলল,
‘ সত্যিই বাসে ভাইয়া। নয়ত এত মাস কি পেছন পেছন ঘুরত?’
প্রহরের মোবাইল বাজছে। কলটা তার সেক্রেটারির। দুই রাত পার হলেই গ্রামের চেয়ারম্যান ইলেকশনের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হবে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এবার উজ্জ্বল সাহেবের বিপরীতে যে ব্যক্তি সর্বদা লড়াই করেন সে ইলেকশনের পদপার্থী হবে না। এবার নতুন কেউ উজ্জ্বল সাহেবের বিপরীতে লড়বেন। মানুষটা কে জানার জন্যই লোক লাগিয়েছে সে। হয়ত জেনে গেছে! দুজনের কথার মধ্যে তৃতীয় কারো অস্তিত্ব, দখলদারি অপছন্দ তার। কলটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল৷ মুখোভঙ্গি শক্ত হলো কিছুটা। নিরলস কণ্ঠে বলল,
‘ তোকে একটা কথা বলি ঊষা। এটা হয়ত তুই খারাপ দিকে নিবি,নয়ত সঠিকটা উপলব্ধি করে ভালোভেবে মনে জায়গা দিবি। আমাদের ছেলেদের জেদটা বেশি। জেদে আশেপাশের মানুষকে পরোয়া করি না। যেটা চাই,মানে চাই-ই। পছন্দ হওয়া কোনো কিছু যদি আমাদের বিপরীতে থাকে এক প্রকার আক্রোশ জমা হয় মনে। তখন উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় হাসিল। যেকোনো উপায়ে হাসিল করতেই হবে৷ প্রত্যয়কে আমি ছোট থেকেই চিনি। ওর জেদের পাল্লা আমার থেকেও ভারী। সেটা তুইও জানিস। যেটাকে ও ভালোবাসা বলে দাবি করছে,যেটা ছাড়া বাঁচবে না বলছে হতে পারে সেটা তার জেদেরই অংশ। কারণ মৃন্ময়ী মেয়েটার কাছে পদে পদে প্রত্যাখ্যান পেয়েছে সে। তুই যে আজ শাড়ি পড়েছিস ওর কথায় রাইট? গতরাতে রুমে যাওয়ার সময় প্রত্যয়ের লাস্ট কথাটা আমার কানে এসেছে। বিয়ের কথাটা শুনেই মনমরা হয়ে থাকছে। আবার বড় আব্বুর সাথে এক চোট বেয়া**দবিও সেরে ফেলেছে। তার একটাই কথা এখন তোকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। কেন দেওয়া যাবে না? তোকে ছাড়া ওর অভ্যাসগুলো শেষ হয়ে যাবে বলে? না, ব্যাপারটা অন্যকিছু। উত্তরটা আমি জানাব না তোকে। জানাবে সময়। আর তুই যদি কষ্টে বিয়েতে রাজি না হয়ে স্বেচ্ছায় মন থেকে হয়ে থাকিস, তাহলে বলব পিছু হটিস না। ভালো কিছু অপেক্ষা করছে তোর জন্য। শাড়িতে তোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। একটা সেলফি তুলবি ভাইয়ার সাথে? ‘
ঊষা মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। মলিন মধ্যাহ্নে মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দী হলো ভাই-বোনের দারুণ এক মুহূর্ত। পরক্ষণেই দ্বিধান্বিত মন নিয়ে কফির মগ হাতে তুলে নেয় ঊষা। নিগূঢ় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল মন মস্তিষ্ক। প্রহর ভাইয়া কি মৃন্ময়ীকে প্রত্যয়ের জেদ বলল! এটা কীভাবে সম্ভব! নিঃসন্দেহে অসম্ভব এটা। মৃন্ময়ীর জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া, রাত-বিরেতে ছুটে যাওয়া, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো,বেহায়া হয়ে উঠা এত! এতকিছু কেবলই জেদ! প্রহর ভাইয়া ভুল করেও অযৌক্তিক কথা বলে না। তাহলে এসব? কোথাও প্রশ্ন একটা থেকে যায়। ঊষা নিজেকে বুঝালো প্রত্যয়ের ওর প্রতি ভালোবাসা স্বাভাবিক, বোন ভেবে বাসতেই পারে। বোনের জন্য অস্থির হওয়াটাও নরমাল। সে মৃন্ময়ীকেই ভালোবাসে। মেয়েদের সাথে টাইমপাস আর ভালোবাসা এক নয়। ফোনআলাপে সময় নিয়ে কথা বলা,আর পিছু পিছু পাগ**লের মতো ছুটে যাওয়ায় ঢের তফাত।
কফি নিয়ে রুমে ঢুকল ও। প্রত্যয় বিছানায় নেই। উঁকি দিয়ে দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল ঊষা। তারস্বরে ডাকল,
‘ কফি নিয়ে যাও ভাইয়া। ‘
বারান্দা থেকে রাগান্বিত স্বর এলো তীব্র গতিতে,
‘ সকালে আসিস নি কেন?’
‘ বুয়াকে পাঠিয়েছিলাম। দরজা ভেতর থেকে আঁটকে ঘুমাচ্ছিলে,তাই আর ডাকি নি। তাছাড়া আমার একটা ক্লাস ছিল, মেডিক্যালে যেতে হয়েছে। সামনে পরীক্ষা।প্রয়োজনীয় ক্লাসগুলো কীভাবে মিস করি বলো?’
‘ বেরিয়ে যা রুম থেকে। ‘
ক্রোধমিশ্রিত, দৃঢ় কণ্ঠ। ঊষার ভেতরটা কম্পিত হলো। জখম হলো রুঢ় স্বরে। ফিরে চলে যেতে নিলে ঝড়ের বেগে এসে ওর হাতটা চেপে ধরল প্রত্যয়। হিসহিসিয়ে বলে উঠল,
‘ বিয়েতে হ্যাঁ বলার সময় মনে ছিল না সামনে পরীক্ষা? আমাকে সকালে ডেকে দেওয়ার সময় তোর মনে হলো সামনে পরীক্ষা? জামাইয়ের মুখ না দেখেই আমাকে অবহেলা? আমাকে এখন অপছন্দ তোর?’
অকস্মাৎ হেঁচকা টানে ঊষা শুরুতে চমকালেও প্রত্যয়ের
কথাগুলো শুনে শীতল হয়ে গেল। কণ্ঠে খানিকটা উত্তাপ,
‘ এগুলো কেমন অস***ভ্যতামি ভাইয়া? হতেই পারে আমার হবু হাসবেন্ড এর চেহারা আমার পছন্দ। এতে তোমার অবহেলা কোথায় হলো? তুমি কি চাও বিয়ে না বসে এই বাড়িতে তোমাদের সামনে থেকে থেকে বুড়ী হই? আমার ভবিষ্যৎ নেই? সংসারের স্বপ্ন নেই? যেখানে আমি বলছি বিয়ে করেও পড়াশোনা চালাতে পারব, তাতে তোমার কী সমস্যা? ‘
প্রত্যয় ঝটকা মে**রে হাতটা ছেড়ে দিল। কৌতুক মিশেল হাসিতে বলে উঠল,
‘ ঠিকি তো আমার কি সমস্যা! ‘
বলেই হাত দিয়ে টেবিল থেকে কফিভর্তি মগটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। সিরামিকের চিত্রিত মগটার টুকরো টুকরো অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল মেঝেময়। ঊষার অক্ষিকোটরে ভয় জমা হলো। প্রত্যয়ের দিক তাকালো ভীতু দৃষ্টে। তোয়াক্কা করল না প্রত্যয়। বরং বলল,
‘ আমি জীবনে অনেক দোষ করে ফেলেছি। এলোমেলো করে ফেলেছি নিজেকে। চল এখন নিজ হাতে তোর বিয়ের আয়োজন করে পুণ্যের কাজ করি। ‘
ঊষা নিস্পন্দ, নীরব। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে প্রত্যয়ের কথা,ভাবভঙ্গি। গতকাল থেকে হঠাৎ কি এমন হলো যে সেকেন্ডই প্রত্যয় এমন অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে!
‘ তোর বিয়ের লেহেঙ্গা কী রঙের?’
অতিশয় অবাকতা গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয় ঊষাকে। বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে জবাব দিল,
‘ মেরুন। ‘
‘ সুন্দর কালার। নিচে যা এখন। আমার রুমে আর আসিস না। নয়ত তোর জন্য খারাপ হয়ে যাবে। ‘
‘ কী হবে? ‘
‘ অনেককিছু। তুই বুঝবি না। তাড়াতাড়ি বের হ আমার রুম থেকে। আমি তোকে মে”””রেও ফেলতে পারি। ‘
‘কি!’– ঊষা হতবাক।
প্রত্যয় দরজা দিকে পা বাড়িয়ে সাফ সাফ বলে উঠে,
‘ তুই তো দূর হবি না,আমিই দূর হই। ‘
ঊষার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলছে অভ্যন্তরে। দরজার দিক তাকিয়ে দেখে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে ওর দিকে নিষ্পলক, নির্নিমেষ। চোখে চোখ আঁটকাতেই কেঁপে উঠল গলা।
‘ তোর হবু হাসবেন্ড এর এড্রেস আর নাম্বারটা দে। ‘
‘কেন?’
‘ স্পেশাল মিট করব। এত আয়োজন করে তুলে দিব,আগে একবার বরকে দেখব না? তোকে আদিমযুগের মেয়ে লাগছে যার কি-না বিয়ের আগে বর দেখতে নিষেধ। ‘
ঊষা দ্রুত বলল,
‘ ছেলে রাজি ছিল। আমি ইচ্ছে করেই মিট করি নি।’
‘ আমি করব,নাম্বার দে। ‘
সমুখের পুরুষের ভাবগতি যথেষ্ট সন্দেহজনক। অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে নাম্বারটা দিল ঊষা। ওর ও তো আজ বিশেষ একজনের সঙ্গে মিট করার কথা। বিয়ের আগে সব সমাধান করে দিয়ে যেতে চায় ও। বাবাকে বলেছে বিয়ের পরও দু’টো বছর এখানে থাকবে। কিন্তু সত্যি এটাই চলে যাবে সে এখান থেকে। অন্যের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে প্রত্যয়কে চোখের সামনে অপলক দেখে দেখে সবকিছু বিগড়ে দিতে চায় না। বাড়াতে চায় না চাপা যন্ত্রণা। যেই নতুন মানুষটার সাথে ওর জীবন জড়াতে যাচ্ছে, তাকে ও বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না। সংসারটা প্রকৃতির ধরাবাঁধা নিয়মেই করবে। ততদিনে যদি ভালোবাসা জন্মায়!
নিশাতকে ঠেলেঠুলে রেডি করিয়ে ওর ছোট ফুপুর সাথে বাসস্ট্যান্ডে পাঠিয়ে দিল রোকেয়া। মা কেন এমনটা করল নিশাতের মনে প্রশ্ন জেগে আছে। বার কয়েক ছোট ফুপুকে জিজ্ঞেস করেও কারণ জানা গেল না। কয়েক মিনিটের মাথায় শিমুল এবং আলতাকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে হতবাক হয়ে গেল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ছোট ফুপুর ওপর। তিনি আলতো হেসে বললেন
‘ তোর বাবাকে বলে এসেছি তোকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যিটা হলো ঢাকা যাচ্ছি আমরা প্রহরের কাকাতো বোনের বিয়েতে। সকাল থেকেই অনেক বার কল দিয়েছে মেয়েটা। বলল যেকোনো ভাবে তোকে নিয়ে যেন বিয়েতে উপস্থিত হই। প্রহরও বলল তার ঘুমন্তপরীটাকে যেন নিয়ে যাই৷ ‘
নিশাতের কপোলদ্বয় লালের আস্তরণে ছেয়ে গেল। লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল ও। মা এবং ছোট ফুপু ওকে এভাবে সাপোর্ট দিবে কল্পনাও করে নি সে। প্রহর ভাই মানুষটার মন জয় করার নিখুঁত গুণ আছে বলে মনে করে ও। যেই মা ওকে প্রহর ভাইকে ভালোবাসার অপ**রাধে মারল, মোবাইলে কথা বলার পর আদরে ভরিয়ে তুলল ওকে। কি জানি কোন ধরনের ম্যাজিক করল প্রহর ভাই!
_______________________________
হুট করে ঊষার বিয়ের কথা কর্ণপাত হতেই যারপরনাই অবাক হয় আলতা, শিমুল,নিশাত সকলেই। ওদের পৌঁছাতে প্রায় সাঝের লগ্ন পেরিয়ে ধরণীতলে নেমে এসেছে আঁধার। টিমটিমে রঙিন আলোতে চমৎকার দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। ঊষার সাথে দেখা হয় নি। এসেই শুনল সে নাকি কি এক কাজে বেরিয়েছে, কাউকেই বলে যায় নি। প্রত্যয়কে দেখল ব্যস্ত হাতে ডেকোরেশনের লোকের সাথে কাজ করতে। নিশাতকে দেখতে পেয়ে শুধু এতটুকু বলল,’ জার্নি করে এসেছিস,রেস্ট নে। ‘ কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সাক্ষাৎ একবারও পেল না ও। এই বাড়ির প্রতিটি আনাচে-কানাচে চোখ বুলিয়ে অবাধ্য মনকে বুঝাতে শেষমেশ থামল প্রহরের রুম হতে কিঞ্চিৎ দূরত্বে। আরেকটু যেতে নিয়েও থেমে গেল পা দু’টো। বুকটা প্রচন্ড ঢিপঢিপ করছে। যাবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে উল্টো ঘুরতেই শব্দ হলো দরজা খোলবার। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার আগেই শোনা গেল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেগতিক করে তোলা স্বর,
‘ মামুজান আমার বাপের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চেয়ারম্যান এর ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে। মাথাটা খুব গরম। দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয় নিশু, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আছে তোর সাথে। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩৫ ( অর্ধাংশ)
এক গ্লাস নয় বরং এক জগ পানি নিয়ে নিশাত হাজির হলো তার ঘন ঘন রূপ পাল্টানো প্রহর ভাইয়ের দোরগোড়ায়। দরজা বন্ধ। খানিক সময় আগেই না কঠিন মুখে পানি চেয়ে কড়া নির্দেশ করল! অথচ এখন দরজা লাগানো ভিতর থেকে। গিরগিটি না-কি প্রহর ভাই? এই ভালো,এই খারাপ। এই বুঝি শরতের আকাশে উড়ন্ত শুভ্র সুখে আাচ্ছাদিত মেঘ,আবার বুঝি কৃষ্ণাভ মেঘের দেশের পি**শাচ রাজা। মানুষ চেনা,বুঝা ভয়ং–কর দুরূহ।
নিশাতের অন্তরের গহীনে ঢিমঢিম,ঝমঝম করে ঢাকঢোল বাজছে। চিন্তা হচ্ছে আব্বা কি সত্যিই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে? ওর ক্ষুদ্র বয়স থেকে জানা তথ্য মোতাবেক রাজনীতি বিশেষ একটা পছন্দ করেন না আব্বা। তাহলে এটা কি করে সম্ভব? না জানি কেমনতরো কথা শোনাতে আলাপ আলোচনার কথা বলে ডাকিয়েছে প্রহর ভাই? চিকন হাত দিয়ে কাঠের দরজার ওপর কয়েকটা টোকা দেয় নিশাত। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। গমগমে একটা আওয়াজ আসে, ” আয়। ”
চোখের পলক ঝুঁকিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ভিতরে আসে সে। চোখের কোণা দিয়ে দরজার দিকে তাকায়। খেয়াল করল দরজা লাগিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে গরম মেজাজের মানুষটা। চাহনি মেলে রেখেছে ওর পানে নিষ্পলক, স্থির। দ্রুত গতিতে নজর সরিয়ে জগটা বেড সাইডের টেবিলের ওপর রাখল। মাথা নত করেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিল। এই মাথা এখন তোলা যাবে না। মাথা তোলা মানেই, হাতছানি দিয়ে বিপদ**কে আলিঙ্গন করবার নিমন্ত্রণ জানানো। অমোঘ সত্য কথা হলো, ওর অমন ছোট বুকে অত বড় বি**পদ আঁটবে না। সুতরাং আলিঙ্গন করার বিষয়খানা নিতান্তই তুচ্ছ, একেবারেই বাতিল। গোপনে,নিঃশব্দে প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিয়ে ওই যে বুকের কোথাও ঘাপটি মেরে বসে অবিরত লাব ডাব শব্দ করে চলেছে? সেই নিরীহ অঙ্গকে বাহবা দিল। ছোট কলিজা বড় করল। অতঃপর ঢিমে ঢিমে তালে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। নিশাত যেদিন থেকে জানল প্রহর ভাই তাকে চায় সেদিন থেকে ভিতরে ময়ূর নাচে পেখম মেলে,প্রেম প্রেম পায় ভীষণ, আর কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সাহসও উঁকিঝুকি দেয় তার মনমাঝারে।
প্রহর দরজায় হেলান দিয়ে, সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,
” কোথায় যাচ্ছিস? আর মাথা নুইয়ে রেখেছিস কেন? আজ কি তোর বিয়ে? শরম লাগছে? ”
চারটা প্রশ্ন! ক্রমাগত প্রশ্নের তোপে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশাত।মাথা নাড়াল বা দিকে একবার,ডানদিকে একবার। শুনল
অসহিষ্ণু গলা,
” মাথা নেড়ে কোনটার উত্তর দিলি? মুখে কথা বলতে পারিস না?”
মৃদু ধ*মকে অল্প মনোক্ষুণ্ণ হলো নিশাতের। গত দুয়েক দিন ধরে বেশ আহ্লাদী হয়ে উঠেছে সে। প্রহরের তেজের হল্কায় আ**হত হতে নারাজ সে ভীষণ। ভালোবাসলে কি আঘা*ত করা যায়? এমন করে রসকষহীন গলায় কথা বলে কেউ? সে তো শুনেছে ভালোবাসলে প্রেমিকরা কাব্যিক কাব্যিক কথা শোনায়। ওদের ক্লাসের শেফালি নামের মেয়েটা যে প্রেম করে তার প্রেমিক কত মোহনীয় চিঠি লিখে,ছন্দ লিখে,গান শোনায়,প্রেম প্রেম মিষ্টি কথা বলে। ক্লাস এইট থেকে প্রেম করে শেফালি ওদেরই ক্লাসের এক ছেলের সাথে। একদিন তাকে আর শিমুলকে ভাঁজ করা একটা কাগজ দেখাল। লাজুক গলায় বলে, ” এইডা আমার প্রেমিক দিছে। দেখ, কি ছন্দ লেখছে আমার লাইগ্যা। ” শিমুল কাগজটা ছুঁ মে**রে নিয়ে জোরে জোরে ছন্দটা পড়েছিল,❝ তুমি ফুল আমি পাখি। চলো দু’জন মিলে হাঁটি। জান..বলো না একবার ভালোবাসি। ❞
সম্মুখে জলজ্যান্ত উপস্থিত শ্যামবর্ণের পুরুষটা নিশাতকে অমন মধুমাখা বাক্য কেন শোনায় না? কথা বলবে না ও। এই লোক সর্বদা ওকে অপ***মান করার সুযোগ হারিকেন দিয়ে খুঁজে বেড়ায়। একবার তো বলল থাপ্প**ড়েই নাকি ভালোবাসা! থা**প্পড় মে**রে গাল ব্য–থা করে দেওয়া ভালোবাসা নাকি গালে চুমু দিলে ভালোবাসা? এসব কবে বুঝবে এই কাঠখোট্টা লোকটা? কবে দিবে চুমুটুমু?
” কী ভাবছিস তুই?”
সন্দিগ্ধ কণ্ঠস্বর। নিশাত হতচকিত হয়ে পড়ল। পরক্ষণেই মিনমিন করে প্রতুত্তর বলল,
” কিছু না। ”
” যাহ গ্লাসে পানি ঢাল। এক জগ কেন আনলি? তোর কি মনে হয় আমার ভিতর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে? ”
নিশাত আবারও মাথা নাড়ালো। এ যাত্রায় চরম ক্ষেপে গেল প্রহর৷ খপ করে নরম চিবুকটা ধরে ফেলল। উপরে তুলে আদেশ করে,
” আমার দিকে তাকা। ”
নিশাতের লম্বা পাপড়িগুলো অবাধে ছুঁয়ে আছে ত্বক। অভ্যন্তরে জেগেছে আড়ষ্টভাব। চোখ না-কি কথা বলে? তাকালে যদি প্রহর ভাই ওর চোখের কথা জেনে নেয় তবে কী হবে? আলগা করবে না সে পল্লবজোড়া। কারণ চুমুর মতো মার**ণাস্ত্র সহ্য করার শক্তি এখনও হয় নি তার কোমল দেহে। মিইয়ে গিয়ে আমতা আমতা করল ও,
” নিচে…মেহমান আছে। আমাকে ছোট ফুফু ডেকেছিল আসার সময়। আমি যাই। ”
” দরজা খুলতে পারলে যা। ”
প্রহরের নিরলস,ভারিক্কি গলা শুনে ভারী অবাক হলো ও। চিন্তায় মগ্ন হলো মন মস্তিষ্ক। সটান দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরুষ। মুখচ্ছবি বড্ড অস্বাভাবিক। কালো কুচকুচে মণিজোড়ার চাহনি তুখোড়। নিশাত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
” তুমি সরো ভাইয়া। ”
নিশাতকে চমকে দিয়ে প্রহর অতীব শান্ত, কোমল,ঠান্ডা গলায় বলল,
” সরে যাব সুইটহার্ট। তোকে রুমে বন্দী রাখার পারমিট নেই আমার কাছে। আগে কিছু কথা বলে নিই? মনোযোগ দিয়ে শোন। ভুল করেও দরজা খোলার চেষ্টা করবি না। তোকে মা*রব না,ধ*মকও দিব না। ”
প্রহর দরজার কাছ থেকে সরে আসল। হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,
” পরশু দিন তোদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব যাবে। মামুজান,তোর ভাই এক পায়ে খাড়া হয়ে না করবে এটা শিউর। কিন্তু তোর মুখ থেকে যেন কোনো ❝ না❞ না আসে। যদি বাপের ভয়েও না করিস আমি তোকে শেষ করে দিব। এতকাল,বছর অপেক্ষা করেছি তোর মনে আমার জন্য ভালোবাসার। কারণ আমি জানতাম তুই রাজি না থাকলে তোকে আমার বানানো সম্ভব না৷ তাই সারা দুনিয়া উল্টে গেলেও তোর মুখ থেকে বের হতে হবে মজুমদার বাড়ির সবার সামনে তুই আমাকে চাস। ঠিক আছে? ”
নিশাতের শরীরের রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। আব্বার সামনে,সৌরভ ভাইয়ের সামনে ভালোবাসার কথা বলতে হবে ওকে? বুক কাঁপছে তার। প্রহর পানির গ্লাস হাত থেকে নামিয়ে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসিস তো? নাকি অল্প বয়সের আবেগে পা***গল বানিয়ে ছেড়ে দিবি আমাকে? এমনটা করিস না তিলবতী। পা*গল হতে রাজি আছি কিন্তু তোকে ছাড়তে না। ”
#চলবে,,!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব _____৩৫( বাকি অংশ)
নিশাত নিচে নামতেই ঊষার কাজিন তুবা ছুটে আসল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল,
” হেই কেমন আছো? আমি তুবা,ঊষা আপির খালাতো বোন। প্রহর ভাইয়ার জন্মদিনে এসেছিলাম। তবে তোমার সাথে কথা হয় নি। ”
হালকা গোলাপি অধরদ্বয় দু দিকে ছড়িয়ে আলতো হাসে নিশাত। তুবার ঝলমলে চেহারায় পূর্ণ দৃষ্টি মেলে শুধায়,
” আমি নিশাত। প্রহর ভাইয়ার মামাতো বোন। ”
তুবা হাসি হাসি মুখ করে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করল,
” আই নো। ঊষা আপি বলেছে প্রহর ভাইয়ার বিশেষ একজন তুমি। ”
কথাটা শোনা মাত্রই তুবার দিকে বিস্ফোরিত নেত্রে চাইল নিশাত। হতবাক,নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
” বিশেষ? ”
” হুম। কিন্তু দেখো না,ঊষা আপি মনে হয় বুঝতে ভুল করেছে। আমি ভেবেছি প্রহর ভাইয়ার পছন্দের মানুষ বুঝি তুমিই। আজ এসে শুনলাম উনার নাকি এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে, বিয়ে ঠিক। পাত্রীকেও দেখলাম। রাজনীতিবিদ এবং ড্যাশিং মডেল সমীরণ আরবিন এর বোন। এই নিশাত জানো? সমীরণ আমার ক্রাশ। তার ব্যাপারে পুরো গবেষণা করা শেষ আমার। তার বোন তনুজাকেও আমি চিনি। প্রহর ভাইয়ার হবু বউ জানার পর আমি অবাক। বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি ভীষণ এক্সাইটেড। তনুজা ভাবী বলেছেন একটু পর উনার ভাই আসবেন এখানে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে। অনেক অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল সমীরণকে খুব কাছ থেকে এক পলক দেখার। ”
সমুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে তুবা। মেয়েটা নিঃশ্বাস ফেলতেও কপটতা করছে। কথাগুলো বলতে পারলেই তার ভেতরটা হালকা হবে যেন। সেদিকে মনোযোগের ছিটেফোঁটাও নেই নিশাতের। তার শ্রবণগ্রন্থি আপাতত তালাবদ্ধ। মন সেই কোন ক্ষণেই থমকে গিয়েছে তনুজার আসার সংবাদ শুনে। বক্ষস্থলে ঈর্ষাদের সমাবেশ বসেছে। প্রহর ভাই বলেছে ওকে চায়,ওকে ভালোবাসে তাহলে তনুজা কেন এখনো আসে এখানে? কী চায় প্রহর ভাই? একদিকে বলছে মজুমদার বাড়িতে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাবে,অন্যদিকে অন্য এক রূপবতী নারীকে আংটি পড়িয়ে বউ হিসেবে গ্রহণ করবে বলে আশা দিয়ে রেখেছে।
নিশাতের কোমল মনে বিভিন্ন চিন্তা, কথার মেলা বসেছে। প্রহর ভাই কেন এসব করছে,আসলে উনি কী চায় কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না ওর। তুবাকে কাটিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পানসে গলায় বলল সে,
” এখন যাই। শিমুলের কাছে যাব। ”
” ওহ! শিমুল ড্রইং রুমেই বসে আছে তনুজা ভাবী, আরুশি আপু,নাহিদ ভাইয়ার সাথে। সেখানেই চলো। আমরা মেয়েরা সবাই একই রঙের শাড়ি পড়ব মেহেদী অনুষ্ঠান আর হলুদের জন্য। তনুজা ভাবী কালার,জুয়েলারি সিলেক্ট করে অর্ডার দিয়েছে। উনার পরিচিত শপ,পাঠিয়ে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এত মিশুক উনি! ”
তনুজা,তনুজা! নামটা কাটার ন্যায় বিঁধছে নিশাতের নরম মাংসপিণ্ডে। শরীর গরম হয়ে উঠেছে। কিড়মিড় করছে দাঁতগুলো। এরকম ঈর্ষণীয় প্রভাব কখনোই পড়ে নি ওর ওপর। কান্না, হাসি,হিংসা সবকিছুর জন্য প্রহর ভাই দায়ী। তনুজার মুখোমুখি হলেই অন্তঃপুরে দ্বিগুণ নয়,তিনগুণ তেজে চলে উঠবে হিংসার বহ্নিশিখা। নিস্পৃহ কণ্ঠে তুবাকে বলতে চাইল,
” আমি যাব না,তুমি যাও। ”
এর পূর্বেই তুবা টেনে তাকে নিয়ে আসল জমজমাট আড্ডার স্থানে। সকলের কেন্দ্রবিন্দু তনুজা। সবার মাঝে বসে আছে সে। বেশবাস অত্যন্ত আকর্ষণীয়, নজরকাঁড়া। প্রথম চাওয়াতেই যেন চোখ ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কালো,নীলের রংয়ের ঝলমলে কেশগুচ্ছ পনিটেল স্টাইলে বাঁধা। পড়নে জিন্স,শ্বেত রঙের রাউন্ড শর্ট টপস। টপসটা সৌডুল কোমর পেরিয়ে হাঁটু অব্দি নেমে এসেছে। গলায় নীল স্কার্ফ প্যাঁচানো। নিশাত একটাবার, অনিচ্ছায় নিজের দিক হতাশ দৃষ্টি ফেলল। পরনে তার সাদামাটা একটা গোলাপি থ্রি পিস। তার কিশোরী মনে উদ্বেল তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। সে কোন অংশে কম? চাইলেই তনুজার মতোন ড্রেস পড়তে পারে। ওর পরিবার রাজনীতি করে না,ভাই মডেল না। কিন্তু আর্থিক দিক থেকে অনেকাংশে কম নয়,যথেষ্ট স্বচ্ছল। অভ্যন্তরের অদ্ভুত জ্বলুনি কমাতে স্বয়ং নিজেকেই হাজার-হাজার,শত-শত বুঝ দিল ও।
” হেই স্লোগানিস্ট! ডিয়ার নিশাত তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে এসে বসো। ”
উচ্ছ্বসিত, মধুর একটা কণ্ঠস্বর নিশাতের কর্ণকুহরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে গেল অনায়াসে। মিষ্টি স্বরের মালিক ফিরিয়ে আনল ওর চেতনা। আকৃষ্ট করল আরো বেশি করে নিজের পানে। তাকাল ও। আরুশি, শিমুল,নাহিদ সব তাকিয়ে দেখছে তাকে। তুবা পুনরায় ওর হাতটা ধরে আসরে প্রবেশ করল। বলল,
” আরুশি আপু তোমার আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমার আপন রক্তের বোন। ”
আরুশি ধমকে উঠল,
” কী বলছিস এসব? এইভাবে পরিচয় দেয়? এ কারণেই এখনও আম্মুর ঝাঁটার বারি খাস। ”
চারিধারে খিলখিল হাসির আওয়াজে তুবা চিৎকার করে উঠল,” আপু!”
আরুশি ওষ্ঠাধর চেপে হাসি থামানোর প্রয়াসে লেগে পড়ল। নাহিদের কথা বলার আগেই নাহিদ কণ্ঠে একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে জানায়,
” আমি নাহিদ। আরুশির তিন বছর সিনিয়র। ঊষার মামাতো ভাই। ”
” নিশাত আমার পাশে বসো। ”
তনুজার সুমধুর গলাটা আবারও নিশাতকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য করে। বড্ড মায়া মিশিয়ে কাছে বসার আহবান জানাল। নাকচ করতে অসফল হলো নিশাত। বসল পাশে। নতুবা উপায় ছিল না। না বলে অন্যত্র বসা অবশ্যই যুৎসই হতো না। সবাই ওকে বেয়া**দব ভেবে বসে থাকত নিশ্চিত। তনুজার অপর পাশে বসা শিমুলকে পরিপূর্ণভাবে অবজ্ঞার সমুদ্রের লহমায় ছেড়ে দিল ও। তরঙ্গ ওকে ভাসিয়ে ভীনদেশে নিয়ে যাক,অতল গহ্বরে ডুবিয়ে নিঃশেষ করে ফেলুক,নিরুদ্দেশ করুক তাতে এক ফোঁটাও ভ্রুক্ষেপ করার সময়,স্পৃহা কোনোটাই নেই নিশাতের। কেমন বান্ধবী যে ওর হবু সতীনের পাশে বসে হা হা করে হাসে? শিমুলটা যেদিন প্রেম করবে ঠিক ঠিক ওর জন্যও একটা সতীন হাজির করবে নিশাত।
পাঞ্জাবি পাল্টাতে গিয়ে প্রহরের চোখ আঁটকালো বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা শপিং ব্যাগটার ওপর। কথার তালে এটা দেওয়ার বিষয়খানা মাথায়ই ছিল না তার। প্রচুর চাপে কেটেছে আজকের দিনটা। তার অপজিট আসনে যেহেতু সমীরণ লড়বে মন্ত্রী হবার স্বপ্নটা অতীব সহজে পূরণ হবে না। একটার পর একটা চাল চেলে যাচ্ছে সমীরণ। আজ মন্ত্রীসভার একটা মিটিংয়ে সমীরণ সবার সম্মুখে বলে বসেছে যার ছোট ভাই রাত বিরেতে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে সে নেতা হবার যোগ্যতা কীভাবে রাখে? সাথে একটা ছবিও দেখায় সে। ছবিটাতে স্পষ্টত প্রত্যয় মৃন্ময়ীর হাত ধরে টানছে। দেখেই যে কেউ বুঝবে এতে মেয়েটার বিন্দুমাত্র সম্মতি নেই। ঘটনাস্থলে মৃন্ময়ীকে প্রত্যয়ের প্রেমিকা বলে ধামাচাপা দিয়েছে প্রহর। কিন্তু সমীরণ উঠেপড়ে লেগেছে তাকে সরাতে। সমীরণকে দমানোর নিমিত্তে খেলার গুটিটা তার ধরে রাখতেই হবে।
শপিং ব্যাগটা নিয়ে নিচে আসল প্রহর। তাকে দেখেই নিশাতের মনোক্ষুণ্ণ হলো। তখন প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে আর থামে নি সে। সোজা চলে এসেছে। তাকে কিছু বলার থাকলে প্রহর ভাই তৎক্ষনাৎ আঁটকাত। নিশ্চয়ই তনুজার জন্যই আসা। বক্ষস্থলে জ্বলন সৃষ্ট হলো। উন্মুখ চেয়ে থাকল নিশাত সামনের দিকে। তনুজা লাফিয়ে উঠার কার্যের ইতি টেনেছে দ্রুতগতিতে। পায়ে পায়ে চলে গিয়েছে প্রহরের সামনে। নির্ভেজাল মনে রসিয়ে রসিয়ে বলছে,
” নেতাসাহেব! এখন আসার সময় হলো আপনার? কখন এসেছি জানেন? আধাঘন্টা হবে। ”
প্রহরের হাতের শপিং ব্যাগে চোখজোড়া নিবদ্ধ করে প্রশ্ন করল পুনশ্চঃ,
” এটাতে কী?”
তনুজার চটাংচটাং কথার ধাঁচে ভালোই বুঝা যাচ্ছে প্রহরের সাথে বেশ স্বচ্ছন্দ ভাব তার৷ অল্পস্বল্প রাগে নিশাতের অক্ষিপটে লালের আস্তরণ জমতে লাগল। কান্নার ডেলা উঠে এসেছে কণ্ঠনালি পর্যন্ত। টন টন করছে সমগ্র দেহ।
প্রহর চাইল না ওর দিকে। তনুজার চোহারায় চক্ষুদ্বয় স্থির রেখেই তারস্বরে হাঁক ছাড়ল,
” নিশু এদিকে আয়। ”
বিলম্ব বিহীন নিশাত রুষ্ট মুখে এগিয়ে আসল। প্রহর এইবার নজর ওর দিকে রেখে শান্ত গলায় বলল,
” আজ এটা পড়িস।”
তনুজা ফোঁড়ন কাটল,
” কী এতে?”
” শাড়ি। ”
” কিন্তু আমরা তো শাড়ি অর্ডার দিয়ে ফেলেছি নেতা সাহেব। চলে আসবে এক্ষুণি। ”
প্রহর ঘন ঘন কুচকে কালো ভ্রুঁ জোড়া অল্প উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক বাক্য ছুঁড়ে মা*রল,
” কোন রঙের?”
বিচলিত হলো না তনুজা। বরং শ্যামবর্ণ আদলে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে জবাব দিল,
” সবুজ। ”
” নিশুকে সবুজ পড়লে শেওড়া গাছের পে**ত্নী মনে হয়। আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন। ওর জন্য হলুদই ভালো। আপনারা বরং সবুজ পড়ুন। আপনাকে সুন্দর মানাবে। ”
নিশাতের কর্ণদ্বয় ঝা ঝা করে উঠল। শপিং ব্যাগটা জোরে টান দিয়ে নিয়ে নিল প্রহরের হাত থেকে। নিচে ছোট ফুপির রুমের দিকে যেতে যেতে মুখে অনুচ্চারিত শব্দটা মনে মনে তিনবার উচ্চারণ করল প্রহরের উদ্দেশ্যে,
” চরি***ত্রহীন,চরি**ত্রহীন,চরি**ত্রহীন। ”
____________________________________
ঊষা সবুজ জামদানী পরেছে। মাথায়, কানে,হাতে রজনীগন্ধাও গোলাপের অর্নামেন্টস। ফুলের সুভাস বারংবার ওর হৃদয় নিংড়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। মন্থর গতিতে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে এলো সে। প্রত্যয় ডাক পাঠিয়েছে। যেতেই ক্লান্ত প্রত্যয় ওর হাত ধরতে চাইল। সাবধান করল সে,
” ভাইয়া! হাতে মেহেদী দেওয়া। ”
প্রত্যয় সরু চোখে তাকাল। নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে,
” আচ্ছা আমার সাথে আয়। ”
” তোমাকে ক্লান্ত লাগছে। মেহেদী দেওয়ার ওখানে দেখি নি তোমাকে। এখানে কেন ডেকেছ?”
” তোকে একটা জিনিস দেখাব। ”
” কী?”
প্রত্যয় ধীর পায়ে ঊষার পশ্চাতে এসে দাঁড়াল। ওর আঁখিদুটিতে হাতের দেয়াল তুলে দিয়ে লহু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” তুই কী দৃষ্টি ছাড়া আমি যেই পথে তোকে নিয়ে হাঁটব, সেই পথে হাঁটতে রাজি?”
ঊষার দ্বিধাহীন কণ্ঠ,
” রাজি। ”
” তাহলে চল। ”
আস্তে আস্তে পা ফেলে কয়েক কদম হাঁটল ঊষা। তার সঙ্গে হাঁটল তার পরাণ জুড়ে বসবাসরত মানুষটা। আহা! এভাবেই যদি প্রত্যয়ের বাহুতে বন্দিনী হয়ে,ভালোবাসায় বন্দিনী হয়ে পাড়ি দিতে পারত ও বহু বহু দূর! কিন্তু তা যে অসম্ভব! মৃন্ময়ীয় সাথে কথা হয়েছে ওর। প্রত্যয়কে আর কাঁদতে দিবে না ও। এই একটা দিনের জন্য,মৃন্ময়ীর সাথে সাক্ষাতের জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে ঊষা।
” ভাইয়া চোখ মেলব?”
” হ্যাঁ। ”
ঊষার চোখের আয়নায় প্রদর্শিত হলো একটা দোলনা। দোলনাটার দুইপাশ সবুজ লতাপাতা ও ফুল দিয়ে সাজানো। ঠিক যেমন রাজকুমারীদের হয়। বিস্ময় লুকাতে অপারগ হয়ে আশ্চর্য নেত্রে তাকাল প্রত্যয়ের মুখে। বিনিময়ে প্রত্যয় বেকায়দায় হাসল। তারিয়ে তারিয়ে বলে উঠল,
” এভাবে কি দেখছিস? আয় দোলনায় বসবি। ”
অবাকতার ঘোরে নিমজ্জিত ঊষা। প্রত্যয়ের সাথে আরও দুই পা বাড়িয়ে দোলনায় বসল। প্রত্যয় দাঁড়াল পেছনে। ঊষা ঘাড় বাঁকিয়ে আচ্ছন্নভাবে প্রশ্ন করল,
-“এই দোলনাটা তুমি বানিয়েছ ভাইয়া?”
-” তোর জন্য। তোর মনে আছে স্মরণিকা নিবাসের দোলনাটার কথা? চড়ার জন্য সারাক্ষণ পা*গল হয়ে থাকতি। কিন্তু আমি দিতাম না। ”
-” হ্যাঁ। ছোট থেকেই ত্যাড়া মানুষ তুমি। ”
প্রত্যয় বাঁকা হেসে বলল,
-” ইচ্ছে করেই দিতাম না। তোর রাগী মুখটা দেখতে অসম্ভব ভালো লাগত।
বলেই ফের হাসল প্রত্যয়। পরক্ষণেই ডাকল গাঢ়,নরম স্বরে,
-” ঊষা!”
ঊষার বুকে ঘাপটি মে*রে থাকা উত্তেজনা তরতর করে বেড়ে গেল। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল,
-” বলো ভাইয়া। ”
-” তোর মনে আছে একদিন দোলনায় বসে তোকে একটা কথা বলেছিলাম আমি? ”
-” কোন কথাটা?”
-” বর আর বউয়ের ছবি এঁকেছিলাম আমি। মনে পড়েছে? ”
পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে উঠল ঊষার। মনে পড়ে গেল সেদিন প্রত্যয়ের বলা কথাটা-“ তোর জামাইয়ের নাম প্রত্যয় এহসান। ” নিষ্প্রভ কণ্ঠে আস্তে করে প্রতুত্তর করল,
-” আছে। ”
-” তোর কি মনে পড়ে আমি বলেছিলাম, সেই বউটা তুই,পাশের বরটা আমি। ”
-” দুষ্টমির ছলে বলেছিলে তুমি। ”
-” দুষ্টমি মনে হয়েছে তোর?”
-” হ্যাঁ। নয়ত মৃন্ময়ী নামের মেয়েটা কি তোমার নিশিরাতের কষ্টের কারণ হত?”
প্রত্যয় একটুও থমকালো না,হোঁচট খেল না। কায়দা করে এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দিল,
” কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না৷ তুই চোখে যা দেখেছিস তা মেকি হতে পারে। আড়ালে সত্যটা হতে পারে অন্যকিছু। বিয়েটা তুই করিস না। ”
ঊষা পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন করব না?”
পেছন হতে সামনে এসে দাঁড়াল প্রত্যয়। হাঁটুগেড়ে বসে দুটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অশ্রুসজল চক্ষু মেলে ধরল। নিভন্ত তার কণ্ঠস্বর,
” তুই কিছু বুঝতে পারছিস না ভোরের পাখি?”
” বুঝতে পারছি। তোমার মনে আমার জন্য মায়া জেগেছে। আমি চলে যাব ভেবে শূন্যতার ভয় হচ্ছে। চিন্তা করো না ভাইয়া,খুব জলদিই তোমার খুশি তোমাকে ধরা দিবে। ”
প্রত্যয় নিস্তেজ, অশ্রুসিক্ত বাক্য আওড়ায়,
” এটাই বুঝেছিস তুই? ”
” হুম।”
” বিয়েটা করিস না প্লিজ। ”
ঊষার অত্যন্ত স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। প্রত্যয়কে অনুরোধ করতে মন চাইছে,” একটা বার কি ভালোবাসি বলবে ভাইয়া? ”
মুখে বলল,” তোমার কী সমস্যা ভাইয়া?”
প্রত্যয় মাদক হেসে জবাবে বলল,” কারণ আমি চাই তুই সারাজীবন আমার ভোরের পাখি হয়ে থাক। তুই অন্য কারো ঘুম ভাঙানো পাখি হবি এটা আমি সহ্য করতে পারব না। ”
ঊষা ভয়ার্ত মুখে প্রশ্ন করল দৈবক্রমে,
” তুমি না মৃন্ময়ীকে ভালোবাসো ভাইয়া? মাথা ঠিক আছে তোমার? কীসব বলছো? এসবের মানে কী?”
” ছোট থেকেই তুই আমার ভালো লাগা ছিলি ঊষা। তোকেই চেয়েছি আমি,তোকেই চাই। আমার তোকেই লাগবে। ”
#চলবে,,!