#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৩৯
শীত শীত ভাবটা স্মরণিকা নিবাসের ইট-পাথর,আনাচে-কানাচে,ফুলে ফুলে মিশে গিয়ে বসে রইল চুপটি করে। নীরবে, নির্বিঘ্নে, এলোমেলো হয়ে শীত স্নিগ্ধ হাওয়ার সাথে মিলেঝুলে দোলা খেয়ে চলেছে হুটহাট মানবদেহে। ওলের সোয়েটারটা গায়ে জড়িয়ে শিমুল তারস্বরে পড়ছিল। আকস্মিক গলাটা আঁটকে গেল তার। কেমন মন খারাপের বাতাস শিহরণ জাগিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেল নিমিষেই। শিহরণ জাগাল সর্বাঙ্গে। বইটা ঠেলে চেয়ার ছাড়ে শিমুল। পড়ার মনটা হারিয়ে গিয়েছে। মনের অস্থিরতায় কি পড়া মগজে ঢুকে? ধুপধাপ, অগোছালো পদলি ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সকালেই সৌরভ ভাইয়ের সাথে একদফা কথা সেড়ে ফেলেছে মুঠোফোনে। তবুও মনটা এত এত আনচানের খেলায় ডুবেছে কেন? ক’দিন বাদেই পরীক্ষা। অপ্রকাশিত প্রেমিক পুরুষ আদেশ করেছেন ভালো রেজাল্ট করতে হবে। কি সুন্দর করে কথা বলেন এখন সৌরভ ভাই! একটুও বকেন না শিমুলকে। বরং আদুরে গলায় বলেন,
” তুই এক ফালি চাঁদের মতোই মায়াময় শিমুল, বরফের মতোই শক্ত মনের। অল্প প্রেম উত্তাপে গলে যাস তুই। যে কথার সৌন্দর্যের জাদুতে টানে, ধৈর্য্য ধরে পাথর মতোন কঠিন মনে প্রেম জাগায়, অনুরাগের প্রদীপ নিয়ে ভরসার আলো ছড়িয়ে বেড়ায়, বিশ্বাসের ঝুলি নিয়ে মজবুত সম্পর্কের নিমন্ত্রণ বিলি করে, তাকে চোখ বন্ধ করে হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী বানানো যায়। একদমই তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। ”
ব্যস, শিমুল বুঝে যায় তখন সৌরভের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দের মর্ম। ভালোবাসায় না কি মানুষ বোকা হয়ে যায়? জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায়? কই! ওর পেল না তো। উল্টো ছোট বয়সে বুঝ বেড়েছে। শুধুই ভালোবাসা বুঝার বুঝ। সৌরভ ভাই যদি এক জনমেও ” ভালোবাসি,ভালোবাসি” না বলে, তবুও সে এই মধুর শব্দটা শোনা ব্যতীতই অনায়সে তার নিঃশ্বাসে,নিঃশ্বাসে মিশে থাকবে আকণ্ঠ। কেননা সেই কথাগুলোই ভালোবাসা হয়ে প্রবেশ করে শিমুলের রঙিন প্রেম মহলে।
হুট করে তার চোখের সূক্ষ্ম নজর গিয়ে পড়ে বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে রাস্তায়। পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল ছোট মামা ওদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে ঘনঘন ইতস্ততভাব ফোটে ওঠছে। জড়তাটা পুরো চেহারা দখল করে রেখেছে, পায়ে বোধহয় শিকল হয়ে পেঁচিয়ে আছে। ছোট মামা একবার আগাচ্ছে, আরেকবার ভীষণ মলিনভাব প্রকাশ করে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সুন্দর ভূমিতে আসার পর কোনোদিন তার কোনো মামাকে বাড়ির সামনে দেখেনি শিমুল। রবিন মামাকে দেখে বেশ চমকালো। ঘোরতর কোনো ব্যাপার না হলে তার অহংকারী, গাম্ভীর্যে ভরপুর মামাদের পায়ের ধূলি কখনোই স্মরণিকা নিবাসের মাটি ছুঁবে না৷ দৌড়ে মায়ের রুমের দরজায় দাঁড়াল সে। তপ্ত শ্বাসে,হাঁপানো স্বরে খবর দিল ছোট মামার আগমনের।
আলতার মনে হলো সে সদ্য আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল। বিস্ময়ে নড়চড় ভোলে বসেছে। স্তব্ধ ভঙ্গিমায় মেয়ের দিকে চেয়ে মুহূর্তেই ছুটে গেল গেইটের দিক। বলা যায় না যদি রবিন চলে যায়! পায়ের গতি বাড়িয়ে এসে ছোট ভাইয়ের সমুখে দাঁড়ালো। রবিন চমকে গেলেও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বড় বোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” প্রহর কোথায় আলতাবু? ওর খোঁজে এসেছি আমি। ”
আলতা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। চেষ্টা করলেন অশ্রুকণা চেপে রাখার। পারলেন না। মাঝে মাঝে রাস্তায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রবিনের সঙ্গে দেখা হলেও,কথা হলেও, ভাই এই বাড়ির চৌকাঠে আসে না বহু কাল,বছর। নিরু মা–রা যাবার পর তার লা–শটাও অন্তিম বার চোখের দেখা দেখতে আসে নি। রবিনের প্রতি কোনো ঘৃণা, কষ্ট কিছুই নেই আলতার। সে সম্পর্ক ভাঙতে নয়,গড়তে পছন্দ করে। অহংকার, হিংসার ধারেকাছে ভিড়েন না তিনি। ভাইয়ের হাতটা খপ করে ধরে বললেন,
” ভিতরে আয়। প্রহর ঢাকা গিয়েছে। ”
” কখন গিয়েছে? কখন ফিরবে? ”
রবিনের গলাটা অত্যধিক ভয়মিশ্রিত। আঁতকে ওঠেছে সে। আলতা ও শিমুল উভয়ে ঘাবড়ে গেল। শিমুল এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
” কী হয়েছে মামা? ভাইয়ার সাথে কথা আছে? চলে আসবে সন্ধ্যার আগে। ”
” ও আসতে আসতে যে সব শেষ হয়ে যাবে রে। ”
আলতা ভাইয়ের বিমর্ষ কণ্ঠ শুনে আবারও কোনো অঘটনের অগ্রিম বার্তা অনুভব করলেন৷ ভাইকে টেনে নিয়ে আসলেন বাড়ির ভেতর। ব্যকুলভাবে বললেন,
” কী শেষ হয়ে যাবে? কী হয়েছে? ”
” নিশুর বিয়ে আজ বুবু। ”
আলতার সমস্ত শরীর ঝক্কি দিয়ে উঠল। শিমুল ব্যস্ত পায়ে মোবাইল আনতে গেল। ভাইকে ফোন করতে হবে,বিয়ে আঁটকাতে হবে।
” নিশুর বিয়ে মানে?”
” বড় ভাই সব জেনে গেছেন প্রহর নিশুর বিষয়ে। পাত্রপক্ষ এসে গেছে। এখনই বিয়ে। সবটার আয়োজন আমাদের লুকিয়ে করেছেন। যতক্ষণে আমরা টের পেলাম পাত্রপক্ষ হাজির, কাজীও চলে আসছে। প্রহর ছাড়া কেউ আটকাতে পারবে না বুবু। বিয়ে হয়ে গেলে কী হবে?”
” আমি যাব। বড় ভাইকে থামাব। আমার ছেলের রঙিন জীবন সাদা-কালো হয়ে যাবে,মা হয়ে আমি কেমনে সহ্য করব? তাকে ছাড়া বাঁচবে না আমার ছেলেটা। ”
শিমুল ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ কান্নায় ভেজা ওর। চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে অবিরাম। ধরা গলায় বলল,
” ভাইয়া কল ধরছে না আম্মু। প্রত্যয় ভাইয়াও ধরছে না। ভাইয়া তো কখনো এমন করে না। এখন কী হবে? বড় মামা কখনোই আমাদের কথায় বিয়ে থামাবে না। ”
গন্ডগোলের খবর পেয়ে প্রহর ছুটে যাওয়ার আগে আলতার দুহাত আঁজলায় নিয়ে বলেছিল, ” নেতা হিসেবে আমার দলের লোকগুলোকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব মা। রেডি থেকো, এসেই নিশুকে বউ বানাতে যাব। ”
মা**রামারি, দ্বন্দ্ব এসব ভয় পান উনি। কিন্তু ছেলে দুটোই ছোট থেকেই বাবা ও জেঠার মতোই রাজনীতিবিদ হতে চায়। আর যাই হোক মানুষের ইচ্ছের ওপর লাগাম টানা খুবই অপছন্দ করেন তিনি। ইচ্ছেদের ওড়তে দিতে হয় প্রজাপতিদের মতোই। সেটা ভেবে প্রহর ও প্রত্যয় দুই ছেলেকে বাঁধা দেন নি। ভালো করেই জানেন, প্রহর সঠিক, ন্যায়ের জন্যই লড়াই করবে। কিন্তু ছেলেদের প্রাণ নিয়ে শঙ্কায় থাকেন প্রচন্ড। যেদিন থেকে প্রহরের নেতা হবার কথা চলল আলতা ঘুমাতে পারেন না। অজানা চিন্তা এসে বলে দেয় পথটা ভয়ংকর। আজও প্রহর বেরিয়ে যাওয়ার সময়টায় প্রবলভাবে ঝড় উঠেছিল অন্তরআত্মায়। সেই ঝড় বুঝি ছুঁয়ে দিল নিশাতকে। শিমুলকে বললেন ঊষাকে কল দিয়ে প্রহর, প্রত্যয়ের খোঁজ নিতে।
ঊষা কল্পনা করে নি এমন এক অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। শিমুলের কান্না জর্জরিত, অস্পষ্ট কথাগুলো তাকে আহত করেছে খুব। সে শত শত বার চেষ্টা করল প্রত্যয় ও প্রহরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার। তাকে বাড়িতে রেখেই ঝামেলার খবর পেয়ে ছুটে যায় প্রত্যয়। ঊষার হাত পা জমে বরফে পরিণত হবার উপক্রম। মাথাটা যন্ত্রণায় ভো ভো করছে। সূচালো একটা কিছু বুক চিরে দিয়ে লুকিয়ে পড়ল কোথাও। না আর বসে থাকতে পারবে না সে। দুটো ভালোবাসার মানুষ আলাদা হয়ে যাবে, কষ্ট নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে, এমনটা হতে দিবে না ও। রিস্ক নিয়েই হাজির হলো ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারল প্রত্যয় হসপিটালে গিয়েছে। কু ডাক ছড়িয়ে পড়ে অন্তঃপুরে তৎক্ষণাত৷ তারপর গন্তব্য হয় হসপিটাল। গিয়ে এমন সময়ে একটা দুঃখের সংবাদ শুনতে হবে ভাবে নি ঊষা। তার ভিতরটা ভেঙে চুড়ে গুড়িয়ে গেল। যেই মানুষটা রক্তা–ক্ত হয়ে হসপিটালের বেডে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে, তাকে কেমন করে তার প্রিয়তমার বিয়োগের খবর পৌঁছাবে ও?
বাবার পাশে গিয়ে বসল ঊষা। মোশতাক সাহেব ভাবনার জগতে নিমজ্জিত। প্রত্যয়কে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল ও। চক্ষে বিঁধল, রোমশ হাতে সফেদ ব্যান্ডেজ গৌরবে লেপ্টে আছে। বুকটা হাহাকার করে উঠল নিমেষেই, কষ্ট চোখে বেয়ে ঝরল অশ্রু রূপে, নৈঃশব্দ জড়ো হলো কণ্ঠনালিতে। প্রত্যয় ওর কাছে এসে হালকা ধমকে প্রশ্ন করল,
” তুই এখানে এসেছিস কেন? এত রিস্ক কেন নিলি? বাহিরে সাংবাদিক আছে না? তোকে দেখেছে? ”
” আছে। ভাইয়ার আপডেট জানার অপেক্ষা করছেন সবাই। চারদিকে অনেক নিউজ ছড়িয়ে পড়েছে। আমায় কেউ দেখতে পায় নি। বাবার সেক্রেটারি নিয়ে এসেছে। ”
” তবুও তোর আসা উচিত হয় নি ঊষা। ইলেকশনের এই কয়েকটাদিন সবাইকে খুব সামলে থাকতে হবে। ”
গুরুতর পরিস্থিতিতে নিশাতের বিয়ের কথাটা কীভাবে বলবে ঠাহর করতে পারছে না ঊষা। কিন্তু বলতে হবেই। প্রথমে জেনে নিল,
” প্রহর ভাইয়ার কী অবস্থা এখন?”
প্রত্যয়ের নাসারন্ধ্র গলিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস উন্মুক্ত হলো। নিষ্প্রভ, পানসে মুখে প্রতুত্তর করে,
” জ্ঞান ফিরেছে। মাথায় আ–ঘাত পেয়েছে আর হাতে। মাথার আ–ঘাতের পরিমাণ একটু বেশি হওয়ায় ডাক্তার বলেছেন দুই দিন হসপিটালে থাকতে হবে। ”
” এসব কী করে হলো?”
” ভাইয়াকে আম্মু, আমি,বড় আব্বু সবাই নিষেধ করেছিলাম ঝামেলা এমনিতেই মিটে যাবে, তার যাওয়ার দরকার নেই। অপোজিট পার্টিকে লেলিয়ে দিয়েছে কেউ। হুট করেই নির্বাচনের পূর্বের অনুষ্ঠিত সম্মেলনে হাম–লা,তারপর এমন অবস্থা। পেছন থেকে ভাইয়ার মাথায় আ–ঘাত করেছে কেউ, সুযোগে ভাইয়াকে মে**রে ফেলতে চেয়েছিল। ”
ঊষা খুঁত খুঁত করছে। বাবার সামনে নিশাতের কথাটা বলবে কি-না? আর প্রহর ভাইয়ের শরীরের অবস্থা খারাপ। এমতাবস্থায় এসব বলা কি ঠিক হবে? কী করবে,কীভাবে বলবে, এ নিয়ে প্রচন্ড দ্বিধায় পড়ে গেল সে। সংশয়, হতাশা,
মনের উচাটন সবই বিশদভাবে ঊষার চোখে ফোটে ওঠছে। মানুষের চোখ না-কি কথা বলে? এই মুহূর্তে ওর চোখও কিছু বলতে চাইছে তা প্রত্যয়ের বুঝতে বেগ পেতে হয় নি। আলতো করে হাতটা চেপে ধরে বলল,
” একটু আমার সাথে আয়। ”
ও প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও প্রত্যয়ের হাঁটার তালে তালে পা ফেলল। আভিজাত্যপূর্ণ হসপিটালটায় মানুষের আনাগোনা খুবই ক্ষীণ। নির্জন করিডোরে প্রত্যয়ের চোখের সামনে এসে দাঁড়াল।
” তুই কি কিছু বলবি? কেমন যেন মুখ কালো করে আছিস। কিছু হয়েছে ঊষা?”
ঊষা দেরি না করে ভিজে আসা কণ্ঠে বলে উঠল,
” ভাইয়ার কাছে নিয়ে চলো। নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়াকে জানাতে হবে। ”
প্রত্যয় বজ্রাহত দৃষ্টিতে চেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল,
” বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে? কখন?”
” আজই,এ মুহূর্তে। শিমুল ফোন করে জানিয়েছে। নিশাতের বাবা কাউকে আভাস পেতে দেয় নি। হুট করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ”
প্রত্যয় আর বিলম্ব করল না। কারো দিকে না তাকিয়ে কেবিনে আসল সরাসরি প্রহরের কাছে। প্রহর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে৷ ওকে দেখেই নরম, দুর্বলভাবে বলল,
” ডাক্তারকে বল রিলিজ দিতে আমাকে সন্ধ্যার আগে। গ্রামে যাব। সাথে তোরাও যাবি। নিশুকে কথা দিয়ে রেখেছি আমি। নিশু আমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করে থাকবে। ”
প্রত্যয় জানে নিশাতের বিয়ে হয়ে গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে তার ভাই। মুখ নুইয়ে জানালো,
” নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ভাই। মা গিয়েছে আটকাতে। কিন্তু বড় মামা মা’কে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কি-না সন্দেহ আছে। ”
প্রহর তীক্ষ্ণ চক্ষে তাকাল। গর্জে উঠলো সে,
” বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে? কার সাথে? ”
বলতে বলতে বেড ছেড়ে নেমে এলো সে। কপালের শিরা উপশিরা টান টান হয়ে গেল৷ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল রগে রগে। খালি পায়েই দরজার দিকে এগোতে এগোতে আদেশ করল,
” গ্রামে ফোন দিয়ে মেম্বারকে ওদের বাড়িতে পাঠা, আমাদের লোক পাঠা। আমি দেখব আমার নিশুকে কে কেঁড়ে নেয় আমার থেকে। ”
মোশতাক সাহেব কেবিনের সামনেই ছিল। প্রহর ঠিকভাবে হাঁটতেও পারছে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন,
” কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” দেশের জন্য সবসময় ভেবেছি, কখনোই রাজনীতিতে নিজের কর্তব্যের হেলাফেলা করি নি আমি। আজ আমার ভালো থাকা হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কীভাবে স্থির থাকতে পারি? গ্রামে যাচ্ছি আমি। ”
প্রত্যয়ও ভাইয়ের সাথে সাথে বেরিয়ে গেল। ঊষা বেরোতে নিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বাবাকে একবার বলে গেল,
” তুমি বাড়িতে চলে যেয়ো বাবা। তোমার শরীর ভালো না। গ্রামে যাচ্ছি আমরা। জলদি ফিরে আসব। নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ”
মোশতাক সাহেব মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন নিষ্পলক। ক্রোধের অনলে জ্বলছেন তিনি। সর্বদা চেয়েছেন প্রহর যেন নিশাত থেকে দূরে থাকেন। বোনের মৃ–ত্যুর তীব্রদাহনে এখনও পুড়ছেন দিন-রাত। উজ্জ্বল সাহেব যতই ভুলে যাক, মজুমদার বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে ক্ষমা করে দিক। তিনি সবটাই মনে যত্ন করে পুষে রেখেছেন, যা একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে পুরো মজুমদার বাড়িকে।
প্রহর গাড়িতে ওঠেই প্রত্যয় থেকে মোবাইল নিয়ে নিশাতকে কল দিতে শুরু করল। কল রিসিভ হচ্ছে না। মানসপটে কালো মেঘ এসে জড়ো হলো, মেজাজটা লাগামছাড়া হয়ে গেল বড্ড। ইচ্ছে করছে নিশাতের গলা টি**পে ধরতে। সে কাউকে কবুল বলবে আর প্রহর ধৈর্য্য ধরে শান্ত হয়ে বসে থাকবে? কবুল বলার আগেই গলা টি**পে ধরে রেখে বলবে, “নে এবার কবুল বল।” ঊষাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল সন্দিগ্ধ কণ্ঠে,
” নিশু ওর বাপের ভয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে? ”
ঊষা তাড়াহুড়ো করে জবাব দিল,
” না ভাইয়া। নিশু রাজি হয় নি। জোর করেই দিচ্ছে তাকে। ”
প্রহরের রাগ কিছুটা দমল। নিশাতের ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ নেই তার। ভালোবাসা সে চোখের ভাষায় বুঝে নিতে পারে। নিশাতের চোখে ভালোবাসা আগে দেখতে পাইনি বলেই তো সে নিজেকে এতগুলো বছর দমিয়ে রেখেছিল। কেননা ভালোবাসা জোর করে হাসিলের জন্য নয়,বরং ভালোবাসাকে কোমলভাবে হৃদয়ের গোপনে আগলে রাখতে হয়। তার ভয়টা ছিল বাবার জন্য তার ভালোবাসা অস্বীকার করে বেঁকে না বসে নিশাত৷ ছোট বয়সের,ভীতু মেয়েগুলো পদক্ষেপ নিতে ভীষণ ভয় পায়। প্রহর গলা উঁচিয়ে বলে,
” শিমুলকে কল দিয়ে বল মা যেন ওই বাড়ির চৌকাঠে না যায়। আমি চাই না, মা কোনো ধরনের অপমানের কবলে পড়ুক। বিয়ে কীভাবে আঁটকাতে হবে আমি জানি। প্রহরের নিশুকে প্রহরের কাছেই সঁপে দিতে হবে মামুজানের। ”
প্রহর এবার সোজা কল দিল রফিক আজমের মোবাইলে। তিনি সমীরণকে বার বার আশ্বস্ত করছেন নিশাত একটু সুস্থ হলেই বিয়েটা হবে। বিয়ে হতে বেশি সময় লাগবে না। ৫ মিনিটের ব্যাপার। মেয়েটা একটু জ্ঞানে আসুক। সমীরণ দাঁতে দাঁত পিষে হজম করছে কথাগুলো। এত সহজে সে হাল ছেড়ে দেবে না। আগে ছিল প্রহরকে শেষ করার মনোবাসনা, এখন যোগ হয়েছে নিশাতকে প্রতিক্ষণে অল্প অল্প করে কষ্ট দেবার আকাঙ্ক্ষা। এই টুকুন বয়সের একটা মেয়ের কত বড় দুঃসাধ্য হলো ওর মুখে থুথু মা**রার। এমনকি ওর বুকে খামচি দিয়েও দূরে সরিয়ে দিয়েছে ওকে। হুম**কি দিয়েছে, ওর হাত কে–টে ফেলবে।
কাবিননামা বাড়িয়ে দিলে সাইন করবে না বলে কাঁদতে থাকে নিশাত। জোর করেও কেউ করাতে পারছিল না৷ এক সময় কাঁপতে কাঁপতে চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়ে। পাড়ার ডাক্তার ডাকিয়ে এনেছে রফিক আজম। ডাক্তার চেইক করে জানালেন হুঁশে আসতে সময় লাগবে খানিকটা। আজ যা-ই হয়ে যাক না কেন এই বিয়ে তিনি দিয়ে ছাড়বেন। ফোনের শব্দে অচেনা নাম্বার দেখে একবার ধরবেন না ভাবলেন। তারপর আবার রিসিভ করলেন,
” হ্যালো…..”
” বিয়ে হয়ে গেছে? বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন?”
কণ্ঠ চিনতে ভুল করেননি তিনি। মৃদু ভরকালেন। গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
” তাতে তোমার কী?”
প্রহর ভ্রুঁ কুঁচকালো। রাগত্ব স্বরে বলল,
” আমার কী মানে! আপনি আমার প্রেমিকাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন, আবার প্রশ্ন করছেন আমার কী?”
” তোমার সাহস কি করে হলো আমার মেয়ে নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ কথা বলার? বেয়া–দব। ”
” জানেনই তো আমি বেয়া–দব। তাই এমন সাহস করতে আমার কষ্ট হয় না। সুন্দর করে বলছি, পাত্র যেখান থেকে ধরে এনেছেন সেখানে পাঠিয়ে দিন। ”
” তোমার কথায় পাঠাতে হবে? তুমি আমার বোকা মেয়েটাকে এভাবে ফাঁসাচ্ছো কেন? ”
প্রহরের চিবুকের উপরে ওষ্ঠাধর কোণে কালচে দাগ হয়ে আছে। স্মিত হাসিতে ঝলমল করতে লাগল সেটা। ঊষা ভাইয়ের মুখের কথা শুনতে পেল।
” ভালো কথা বললেন। ফাঁসিয়েছি তো। আপনার মেয়ে আমার ভালোবাসায় ফেঁসেছে মামুজান। যে একবার ভালোবাসার জালে আটকা পড়ে, তার আর মুক্তি মিলে না। আমিও তো সেই জ্বালে আটক। ”
” শুনো,ভালোই ভালোই আমার মেয়েকে ছাড়ো। তোমার মতো বেয়াদব চরিত্রের ছেলের কাছে আমি কখনো মেয়ে বিয়ে দেবো না। পুরো জাতই ত্যাড়া,অভদ্র। ”
প্রহরের মাথা রাগে দপদপ করতে লাগল। বি**শ্রী শব্দ বেরিয়ে আসতে হুটোপুটি করছে। ঘাড় দু’দিকে নেড়ে নিজেকে থামালো,শান্ত করল সে। বলল,
” আমার বুকের ভেতর যে ভালোবাসার বন্যা বয়ে চলেছে তাতে আমি কখনো বাঁধ দিতে পারি নি। প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে থাকা ভালোবাসা নামক আসক্তি ছেড়ে দিয়ে আমি হতে পারি নি কভু নিরাসক্ত। যদি আপনি সেই আসক্তি দূর করতে পারেন, তবে আমি স্বেচ্ছায় আমার প্রাণভোমরাকে ছেড়ে দিয়ে আপনাকে জিতিয়ে দেবো। আমার প্রিয়তমার মায়াবী চেহারার দিকে ফিরেও তাকাবো না একবার। ”
রফিক আজম থমকে গেলেন। প্রবল নিস্তব্ধতা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে আরম্ভ করল। বুঝলেন,এই ছেলে নিশাতের পিছু ছাড়বে না। একটু হুঁশ আসলেই কোনোরকমে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে হবে। ফোন কাটতে নিলে আরও শুনলেন,
” ঝামেলা করবেন না। আমিও ঝামেলায় যেতে চাই না। আপনি মেয়ের বাবা। তাই সবিনয়ে বলছি,আমি নিশুকে ভালোবাসি। আমার হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন নিশু,নিশু,নিশু উচ্চারণ করে। আমি কী করব? ওকে ছাড়া কীভাবে থাকব? কোথায় যাব? নিজেকে কীভাবে বাঁচাবো? আপনি ওকে আমায় দিয়ে দিন প্লিজ। ”
উনি চট করে কলটা কেটে দিলেন। এত এত ভালোবাসার কথা কোনোদিনও উনাকে হারাতে পারবেন না।
____________________
নিশাতের চেতনা ফিরতেই ফের বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া হলো তাকে। এবার রফিক আজম নিজেই কাবিননামা নিয়ে রুমে আসল। চাপা স্বরে বললেন,
” সাইন করো, তারপর ধর্মীয় মতে বিয়ে হবে।”
নিশাত ছলছল চোখে তাকিয়ে পাষন্ড মনের লোকটার কাছে কাতর স্বরে আকুতিমিনতি করল,
” এখানে সাইন করলে আমি ম**রে যাব আব্বা। আমাকে মে**রে মাটিতে পুঁতে ফেলেন,তবুও সাইন করতে বলবেন না।”
হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি,
” আড়াই ঘন্টা ধরে নাটক করে যাচ্ছেন আপনি। সাইন করতেই হবে আপনার। ”
জোর করে নিশাতের হাতে কলম ধরিয়ে দিলেন তিনি। পিংকির মা পাশ থেকে মিনমিন করে বললেন,
” বড় ভাই, বিয়েটা না করতে চাইলে থাকুক। জোর করে বিয়ের মতো বন্ধনে বাইন্ধা দিয়েন না। আল্লাহ নারাজ হইব।”
রফিক আজম রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলেন পিংকির মায়ের দিকে। পিংকির বাবাও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ভাইয়ের দৃষ্টি দেখে দমে গেলেন। তিনি আবারও গম্ভীর স্বরে বললেন,
” সাইন করেন আম্মা। আপনি আমাকে কঠোর হইতে বাধ্য করলেন। বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানের কখনোই সুখ হয় না। আশা করি আমার এত বছরের কষ্টের দাম দিবেন আপনি। ”
নিশাত অসহায় চোখে আব্বার দিকে তাকাল। গলা কাঁপছে তার। আর পারছে না লড়াই করতে। বুকটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। কখন আসবে প্রহর ভাই? তার ছোট প্রানটা যে আর পারছে না। বাবা-মার সাথে কেইবা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে? কলমটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে নিল হাতটা। মনে মনে ভেঙে পড়ল ভীষণ। বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন প্রহর ভাই। আপনার তিলবতী খুব ভালোবাসে আপনাকে। ” আব্বার দিকে তাকিয়ে জেদি গলায় বলে উঠল,
” এই সাইন আমাকে আর প্রহর ভাইকে মে**রে ফেলবে আব্বা। আপনি দায়ী থাকবেন আমাদের মৃ**ত্যুর। আমার কাছ থেকে আপনি ক্ষমা পেয়ে গেলেও, প্রহর ভাইয়ের কষ্টের জন্য আপনাকে কোনোদিন ফুপি, শিমুল, কেউ ক্ষমা করবে না। ”
সাইন করতে নিয়ে হাতটা কাঁপতে লাগল নিশাতের। রোকেয়া মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন,
” সাইন করতে হবে না তোর। আমরা দুজনে চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। ”
রবিন এসে কলমটা নিয়ে বলল,
” উঠে আয়। নিচে বিয়ে হবে তোর,প্রহর এসেছে। ”
সমীরণ স্তব্ধ, নির্বাক প্রহরকে দেখে। তার মা প্রহর কেন এখানে এসেছে জিজ্ঞেস করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। প্রহর সমীরণের সামনের সোফায় বসে ঠান্ডা মাথায় এক বাক্যে উত্তর দেয়,
” মামুর বাড়িতে মামুর মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি আন্টি। ”
তনুজার বাবা-মা হকচকালেন। স্পষ্ট স্বরে চেঁচালেন,
” মানে?”
প্রহর আগের মতোই বলল,” বিয়ে করতে এসেছি। ”
প্রত্যয় আর ঊষাকে রেখে উপরে গেল সে। সমীরণ উঠতে নিলে প্রত্যয় বাঁধা দেয়,
” বোস এখানে,বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাস। ”
প্রহর সাথে কাজী নিয়ে এসেছে। নিশাত কারো তোয়াক্কা না করে ডেকে উঠল,” প্রহর ভাই!”
প্রহর চোখ বুঁজে ফেলল। বিড়বিড় করল নিজ মনে, ” নিশু রে,দেখ আমার কলিজা কাঁপছে, তুই কেন এত সুন্দর করে সাজলি?”
শ্যামবরণ, ধারালো চেহারায় ছোপ ছোপ কালো দাগ,মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। নিশাতের বুক ভেসে যাচ্ছে কান্নায়। প্রহরের সাথে আনা কাজী কাবিননামা বের করে নিশাতের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। প্রহর নির্ভয় হয়ে বলল,
” তোর এটাই সাইন করতে আপত্তি নেই তো মেহরিন মজুমদার নিশাত?”
নিশাত আব্বার দিকে এক পল চাইল। রক্তাভ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। প্রহর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে,
” তুই সাইন কর। বাড়ির সবাই আমাকে জামাই হিসেবে চায়,মামুজানও চাইবেন। ”
রফিক আজম দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
” আমি তোমাকে পুলিশে দেবো। ”
প্রহর তার মামুজানের দিকে গাঢ় চোখে চেয়ে বলল,
” পুলিশ বাড়ির বাহিরে আছে। সাথে নিয়ে এসেছি। নিশুকে বিয়ে করে চলে যাব জে**লে। ”
রফিক আজমের মুখে থমথমে ভাব।
” তুমি মজা করছো আমার সাথে!”
রোকেয়া মেয়ের কানে ফিসফিস করলেন,
” এবার তো পালিয়ে যাওয়া লাগবে না তোর। প্রহর হীরের টুকরো। তোর বাবা একদিন ঠিকি মানবে। সবার সামনেই তোকে বিয়ে করতে বীরের মতো আসল ছেলেটা। এমন বীরকে না মেনে যাবে কই?”
নিশাত গুটি গুটি হাতে নিজের নামটা লিখে দিল ভিতরের ধুকপুকানি সমেত। আইনত হয়ে গেল সে তার প্রহর ভাইয়ের বউ। যা হবে হোক, প্রহর ভাই ঠিক সামলে নেবে। পৃথিবীতে সে বোধহয় প্রথম বউ, যার বিয়ে হয়েছে তর্কাতর্কির মাঝে। কাজী সহাস্যে বললেন কবুল বলতে।
নিশাত মায়ের দিকে একবার তাকালো, আব্বাকে কয়েক সেকেন্ড দেখল,প্রহর ভাইয়ের চোখের মাদকে আসক্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কবুল,কবুল,কবুল। ”
#চলবে,,,!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪০
প্রহরের মুখ থেকে কবুল শব্দটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র নিশাতের অন্তরে ঢংঢং করে ডঙ্কা বাজল। চো**রা নজরে একবার দেখে নিল হৃদয় কাঁপানো মুখখানা। পরক্ষণেই আব্বার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকাল ও। অচিরেই মুখে ছেয়ে গেল ছাই রং। বাবার রক্তিম চাহনি তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় বিঁধল নরম মাংসপিণ্ডে। তেজের হল্কার কবলে নিশাত ভয়ার্ত, দুশ্চিন্তায় মগ্ন দৃষ্টিযুগল রাখল বিছানার সবুজের বুকে সাদা সাদা ফুল আঁকা চাদরে। আব্বার গম্ভীর কণ্ঠ শ্রবণপথ এড়ালো না। তিনি প্রহরকে লক্ষ্য করে বললেন,
” নিচে আসো। সেখানেই কথা বলব। ”
প্রহর নির্ভেজাল কণ্ঠে প্রতুত্তর করে,” জি। ”
নিশাত,রোকেয়া, রবিন চমকে গেল। এত শীতল,স্বাভাবিক কথা! প্রহরকে দেখলে যার চেহারায় অষ্ট প্রহর ক্রোধ,দাম্ভিকতা লেগে থাকে, সে কিনা অস্বাভাবিকভাবে বিয়ে হয়ে যাবার পরও এত শান্তভাবে কথা বলছে! ব্যাপারটা মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না রোকেয়ার। স্বামীকে বেরিয়ে যেতে দেখেই প্রহরের কাছে এগিয়ে এসে ভীতসন্ত্রস্ত, অসহায় মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর মামা আবার কিছু করবে না তো?”
” রিলেক্স মামী। কিছুই হবে না। আপনার মেয়ের জামাই খালি হাতে যুদ্ধের ময়দানে পা রাখে নি। অদৃশ্য অ**স্ত্র সমেতই এত দূর এসেছি। ”
প্রহরের কথার পৃষ্ঠে অল্প করে হাসলেন রোকেয়া। সবল চেহারার, তুখোড় বুদ্ধিপূর্ণ এই ছেলেটাকে অতিশয় ভালো লাগে উনার। মেয়ের জামাই বলে নয়। ছোট থেকেই প্রহরকে একটু বেশিই পছন্দ করেন। নিশাতকে যখন পদে পদে শাসন করত তখন মনে হতো চঞ্চল মেয়েটার জন্য এই রাগী, এলোমেলো স্বভাবের ছেলেটাই পারফেক্ট। কিন্তু মাঝে মাঝে বেঁকে যেতেন দুই বাড়ির পরিস্থিতি বিবেচনা করে। নিজের অতীব পরিচিত,চেনাজানা একটা সুপাত্রে মেয়ে দিলে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। আর প্রহর তো ব্যকুল হয়ে ভালোবাসে নিশাতকে। তাই আজ থেকে রোকেয়া মেয়ের জন্য চিন্তা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বস্তির শীতল বাতাসে মনের রাজ্য আনন্দে মেতে উঠল।
” আমিও নিচে যাই। বিয়ে হইল, একটু মিষ্টিমুখ হইব না? তুই নিশুরে নিয়ে আয়। ”
রোকেয়া চলে গেলে,রবিনও পিছু পিছু ছুটতে লাগলেন। প্রহর জোরেশোরে ডাকল,
” মামা!”
রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র মুখে। প্রহরের সুপুষ্ট দেহটা এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মামাকে। কৃতজ্ঞতার গলায় বলল,
” ধন্যবাদ মামা। আপনি সঠিক সময়ে মা’কে না জানালে আমি নিশুকে হারিয়ে পাগ–ল হয়ে যেতাম। ভীষণ ভালোবাসি আপনার ভাইঝিকে। ”
তার পিঠে হাত চাপড়ে রবিন ন্যাতানো গলায় কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠে,
” তোমার ফুপিকে হারানোর কষ্ট এখনো আমার হৃদয়ভূমি রক্তা**ক্ত করে। শান্তির ঘুম, ঘুমাই না অনেক বছর। প্রতিটা রাত নিজের মৃ**ত্যু কামনা করি। এ পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য আর আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। একজন আমার সব মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছে। তারপর পৃথিবীর কোনো কিছুই আর আমাকে কাছে টেনে ভালো থাকার মন্ত্র শিখাতে পারে নি। তোমরা সুখী হও। বিরহ সবার জন্য না। বিরহ সরিয়ে ভালোবাসার সফলতাই হোক তোমাদের উদ্দেশ্য। তাকে আমি পাব না, তাই বিবর্ণ আমার ধরণী। তুমি তোমার হৃদয়াক্ষীকে পেয়েছ, আজ থেকে রঙিন তুমি ও তোমার জীবন। ”
সবাই চলে গেলে প্রহর নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে আস্তে করে বলল,
” নিচে নেমে আয় নিশু। ওভাবে নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেয়ে বসে আছিস কেন?
অস্বস্তি দানা বেঁধে আছে নিশাতের মনে,শরীরে। প্রহর ভাইয়ের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই ঝপাং করে লাফিয়ে বিছানা ছাড়ল। বোকা বনে গেল। সে কি নতুন বউ না! সদ্যই বিয়ে হলো তার। অথচ তাকে বলা হচ্ছে সে কেন নতুন বউয়ের মতো বসে আছে? ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তৈরি হলো হুট করে। প্রহর ভাই কেন এত রহস্যময় কথা বলছে? অবশ্যই নব বধূ সে, প্রহর ভাইয়ের বউ। শাড়িটা ঠিক করে লম্বা ঘোমটা টানল। চুড়ির রিমঝিম শব্দ দ্রুত গতিতে বদ্ধ কক্ষের নির্জনতায় চমৎকার মুহূর্ত সৃষ্ট করল। প্রহর নাক মুখ কুঁচকে ফেলে।
” চুড়িও পড়েছিস ওই সমীরণের জন্য? ওর জন্য যা যা পড়েছিস সব এক্ষুনি খুলবি,খোল। ”
নিশাতের চোয়াল ঝুলে গেল, ” হ্যাঁ? ”
প্রহর তড়িৎ বেগে কাছে এসে দাঁড়াল। নিশাত ওষ্ঠদ্বয় ফাঁক করে কিছু বলতে যাবে, প্রহর ওর ঠোঁটে তর্জনী চেপে বলে উঠল,” চুপ!”
রক্ত জমে নিশাতের শুভ্র মুখশ্রী ডালিমের ন্যায় লাল হয়ে গেল। বুক ভারী হয়ে উঠল নিঃশ্বাসে। শ্বাসরুদ্ধভাবে ঠোঁট নাড়াতে চাইলে আরও চাপ অনুভব করল নিটোল ওষ্ঠাধরে।
প্রহর বা হাতটা টেনে নিয়ে রুষ্টভাবে চুড়িগুলো খুলে ফেলে দিল বিছানায়। সমীরণের জন্য সেজেছে নিশাত এটা সে মানতে পারবে না। সুন্দর, মনোহারিণী কেবল তারই জন্য নিজেকে সাজাবে। আজ পূর্ণ অধিকার নিয়ে বলল,
” পানসে মুখে বিয়েটা হলো নিশু,তোর কি একটুও খারাপ লাগছে না?”
নিশাত কসরৎ করে চোখ তুলে চাইল। হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন করল,
” পানসে মুখে! আপনার মুখ পানসে লাগছে? আর আপনার মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কীভাবে ব্যথা পেলেন? ”
কাঁপা কাঁপা হাতে ঠোঁটের পাশের ক্ষত স্থানে হাত ছোঁয়াল নিশাত। কোমল হাতের স্পর্শে প্রহরের চোখ বুঁজে এলো। গাঢ় কণ্ঠস্বর,
” তুই আবার আপনি বলছিস? তুই কি আপনি,তুমিতে আটকে গেছিস নিশু? আপনি,তুমিই সম্বোধন করবি আমাকে? আচ্ছা, মেনে নিলাম। আমার তিলবতীর জন্য সাতখু***ন মাফ। ”
কপালের কাছে সফেদ ব্যান্ডেজের ওপর রক্ত জমেছে গোল হয়ে। নিশাত সেখানেও ছুঁয়ে দিল। বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল ও,
” কীভাবে ব্যথা পেলেন আপনি কিন্তু বলেন নি। ”
প্রহর চট করে হাতটা নামিয়ে আঁকড়ে ধরে চোখ রাঙাল। ফিসফিস করে একটুখানি রাগত্ব স্বরে বলল,
” কাঁদছিস কেন? হু? কেউ শুনলে কি বলবে? একটু আগে বিয়ে করেই আমি তোকে কাঁদাচ্ছি এটা মোটেও ভালো চোখে দেখবে না কেউ। তোর বুদ্ধি, জ্ঞান কম। তুই হলি গাধী আর মাথামোটা। কেঁদেকেটে তোর বুদ্ধিমান জামাইয়ের বদনাম করিস না। ”
নিশাত সরব করে চোখ নামিয়ে নিল। এই লোক যে তাকে ব্যথা পাওয়ার কারণ বলবে না এতে একফোঁটাও সন্দেহ নেই।
প্রহর নিশাতের নখ হতে শুরু করে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বলল পুনরায়,
” আমি কিন্তু বলেছি আমার মুখ পানসে হয়ে আছে। ”
নিশাত মিইয়ে গলায় জবাব দিল,” নিচে চলেন। আমি আম্মুকে ঝাল করে কিছু রান্না করে দিতে বলব। ”
” আমি ঝাল খাব না। মিষ্টি খাব,বিয়ের মিষ্টি। ”
নিস্তরঙ্গ, দ্বিধাহীন, শক্ত কণ্ঠ শুনে নিশাতের শরীরের রক্ত ছলকে উঠল। নেত্রযুগলের সম্মুখে নেশাক্ত, অন্যরকম দুষ্ট চাহনি দেখে বিস্ময়ে গুটিয়ে নিতে চাইল নিজেকে৷
” আম্মু বলে গেল নিচে গিয়ে মিষ্টিমুখ করে নিতে। ”
প্রহর হতাশামিশ্রিত শ্বাস ছাড়ল। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিলন ঘটিয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
” একটুও বড় হবি না? আরেকটু বড় কেন হলি না তুই? প্রেম বুঝিস, মন বুঝিস, কী চাইছি সেটা বুঝতে পারছিস না?”
নিশাত অবাক হলো। হকচকালো সে,
” কী চাইছেন?”
প্রহর তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে মাদকময় কণ্ঠে আবদার করল,
” আমি সুপুরুষ নিশু। জোরাজোরির বিপক্ষে। সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। একটা দীর্ঘ স্পর্শ চাই আমার ঠোঁট দু’টোতে। মিষ্টি ছোঁয়া পেলে আমি আর তোর সাথে করল্লার মতো তেঁতো কথা বলব না। এটা তোর জামাইয়ের প্রমিস। ”
নিশাত চট করে ঠোঁটগুলো উল্টে মুখের ভেতর নিয়ে নিল। শিরা উপশিরায় রক্তচ্ছাস। একদিনে দুবার চুমু! সকালের চুমুতে জ্বরে অবস্থা কাহিল,এখন আবার! শরীরের উত্তাপে চোখও জ্বলছে। প্রহর মাদক হেসে ললাটে উষ্ণ ছোঁয়া মাখল। বলল,
” তুই এখন আমার। তোর যখন মন হবে মিষ্টি মুখ করব। তার আগে আমি কিন্তু একটা মিষ্টিও খাব না নিশু। তোর শরীর গরম। আর কোমরে আচরের দাগ কেন?”
নিশাতের গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। কলিজা কেঁপে উঠল। বক্ষস্থলে অস্থির ভাব এসে জড়ো হলো। প্রহর ভাইকে কীভাবে বলবে সমীরণের রুক্ষ আচরণের ফলপ্রসূ এই হাল? অধোমুখী হয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলে প্রহর ঝাপটে ধরল। রাগান্বিত কণ্ঠে প্রশ্নাত্মক বাক্য ছুড়ে দিল ঝটপট,
” তোর আচরণ অন্য কিছু বলছে। খুলে বল আমায়। ”
নিশাত নিভন্ত স্বরে, ভয়ে ভয়ে জানালো,
” সমীরণ,,,উনি বাজেভাবে স্পর্শ করেছে। ”
” কীভাবে স্পর্শ করেছে?”
নিশাত এবার ফুপিয়ে উঠল। তার কিশোরী মন অপবিত্র ছোঁয়ায় মুষড়ে পড়েছে। পৃথিবীর সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য,শান্তির স্থানে মাথা রেখে বলল,
” বাজে,,,বাজেভাবে। ”
নিশাতকে বুক থেকে সরিয়ে আদেশ করল প্রহর,
” শাড়িটা পাল্টিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। ”
রোষের তোড়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। অ্যাডামস অ্যাপল ক্রমাগত উঠানামা করছে। নিশাতের মন কু ডাকল। হতচকিত হয়ে উচ্চারণ করল,
” প্রহর ভাই! ”
দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে প্রহর ততক্ষণে। নিচে এসে সোজা প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে বলে,
” বন্দুকটা দে। ”
সমীরণসহ সকলে চমকে উঠল। ভয়ের একটা সূক্ষ্ম রেখার দেখা মিলল সবার মাঝে। প্রত্যয় আপত্তিকর গলায় না করল। দেবে না সে। রেগেমেগে বহ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠল প্রহর।
” ওটা আমার লাইসেন্স করা। তুই দিতে বাধ্য। ”
ঊষা তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করে,” কী হয়েছে ভাইয়া?”
সবাইকে উপেক্ষা করে প্রহর প্রত্যয়ের কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে সমীরণের বাহুতে তাক করল। নিশাত উপর থেকে এসব দেখে কুঁকড়ে গেল ভয়ে। এত নির্দয়, পাষাণ কেন তার প্রহর ভাই! কাউকে এত সহজে আ**ঘাত করা যায়!
সমীরণ চোখ নাচালো। ভয়কে লুকিয়ে রেখেছে সে। প্রহরের সামনে কোনোভাবেই হারবে না। প্রহর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,” শিয়াল হয়ে সিংহ সাজার ব্যর্থ চেষ্টা। ”
রফিক আজম গর্জে উঠলেন। বললেন,” তুমি আবার বেয়াদবি শুরু করেছ! ছাড়ো ওকে। ”
প্রহর না শোনার ভান করে ট্রিগার চেপে বলল,
” আমার ছোট ছোট স্বার্থে আঘাত লাগলে আমি হিংস্র হয়ে যাই। আর সে তো আমার তিলবতী ছিল। ”
চলবে।
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪১
কনকনে, হাড়কাঁপানো অগভীর এক রজনীতে তনুজা ফোন করল প্রহরকে। স্পষ্টভাষী মানুষ সে। সুতরাং কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
” নেতাসাহেব, মন ভালো আছে নিশ্চয়ই? আমাদের বাড়ির ভাঙচুরের তীব্র শব্দ এসে জানিয়ে গেল আপনি বিয়ে করেছেন। অভিনন্দন আপনাকে। ”
প্রহর দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেট চেপে বারান্দায় বসে ছিল। দাঁড়িয়ে শীতলতাকে খান খান করে দিয়ে প্রশ্ন করল,
” আপনার ভাইয়ার হাত ঠিক আছে? ”
” ঠিক রেখেছেন আপনি? হাতে ব্যান্ডেজ দেখলাম। ভালো হাতে বাবার হা–রাম উপায়ে উপার্জিত অর্থে কেনা অনেক কিছুই ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। আপনাকে খু**ন করবে এমন হুমকিও দিচ্ছে থেকে থেকে। আপনাকে সাবধান করব না। বরং বলব সুযোগ পেলে সমীরণকে ছাড়বেন না। ”
প্রহর সিগারেটটা বারান্দার মেঝেতেই ফেলে দিল। উচ্ছিষ্টাংশটুকু পা দিয়ে পিষে বলল,
” আপনার রক্তের ভাই সে। মায়াদয়াহীন কেন আপনি? শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে আড়ালে থেকে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। ”
তনুজার প্রলম্বিত নিঃশ্বাসের শব্দে কান আরও খাড়া হয়ে গেল প্রহরের। সে কিছু বলতে নিলে তনুজা থামিয়ে দিয়ে বিজ্ঞ গলায় বলল,
” কারণ ব্যতীত আমি কারো সাথে অন্যায় করি না প্রহর সাহেব। যেই আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না,সেই আমি অন্যের সাথে অবিচার করব? আমার ক্ষুদ্র জীবনে সীমাহীন আফসোস কেন আমি নিকৃ**ষ্ট মানুষের ভীড়ে জন্ম নিলাম। ”
” আপনি আজও বলেন নি কেন আপনি আপনার ভাইয়ের গোপন শ—ত্রু। ”
” আমি তার শ–ত্রু না, বোনই। ভাইয়ার ও আমার মাঝে পার্থক্য হলো একজন অন্যায় করতে ভালোবাসে,আরেকজন সেই ভালোবাসাকেই ঘৃ***ণা করি। আমি বহুদিন থেকে,বছর ধরে ভাইয়ার একজন শ**ত্রুর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ঠিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর একদিন জানলাম আপনার ক্ষতি করতে চায় সমীরণ ভাইয়া। এবং আপনি তার ভয়ে দমিয়ে যাওয়া লোক না। আপনি তো রাজনৈতিক জগতে সিংহের মতোন পদক্ষেপ ফেলে রাজত্ব করা ব্যক্তি। এটা নিয়েই ভাইয়ার প্রবল ঈর্ষা। সকল ক্ষমতা আপনার দখলে চলে যাবে, সবাই আপনাকেই মান্য করে, আপনি এমপি হয়ে যাবেন খুব সহজেই সততা, কর্ম দিয়ে, মন জয় করে। এসব বেশ ভালো জানত। তাই আপনাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বদা তক্কে তক্কে থাকে। এ জরাজীর্ণ পৃথিবীতে ক্ষমতার লোভে তো মানুষ হিং***স্র হয়ে যায়। ভাইয়াও পূর্ব থেকেই হিং–স্র। বার কয়েক আপনার ওপর হামলার বিষয়টা কোনো এক মাধ্যমে আমি জানলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আপনার মাধ্যমেই ভাইয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমি এই মর্ত্যলোকের সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি বানিয়ে ছাড়ব। আমি চাই সে বুঝুক ভালো থাকা কেউ কেঁড়ে নিলে প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মর**তে কেমন অনুভব হয়। সেজন্যই আমেরিকা বসেই আপনার সাথে যোগাযোগ করলাম। বাবা মায়ের বড় আদরের আমি, তাঁরা আমার প্রতি ভীষণ দুর্বল। সেটাই আমি কাজে লাগালাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল ভাইয়াকে নির্বাচনেই দাঁড়াতে দেবো না। এটাই হবে তাকে নিঃস্ব করার প্রথম ধাপ। আমেরিকা বসে বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করি যদি আপনার সাথে বিয়ে না-হয় তবে আমি কোনোদিনও বাংলাদেশে পা রাখব না। বাবা রাজি হলেন। বললেন, ভাইয়া না দাঁড়ালেও আপনাকে অন্যভাবে হারাবে। নিজেদের মধ্যেই অন্য কাউকে খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করবেন। করলেনও তা। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আমার মামাতো ভাই হয় সেটা অজানা নয় আপনার। ”
” আমি লড়তে ভয় পাই না। আপনাকে বিয়ে করার ব্যাপারটা পুরোই আমাদের দু’জনের সাজানো একটা ঘটনা। আমি সৎ হলে, জনগণ আমাকে ভালোবাসলে আমি হারব না, সেটা নিশ্চিত। আমি যদি না-ও জিতি,তাতেও আমাকে কষ্টের ছিটেফোঁটা স্পর্শ করতে পারবে না। ক্ষমতা নামে হয়, আসল জোর মনেই থাকে। আমি নেতা হওয়া ছাড়াও চাইলে প্রতিটা মানুষের উন্নতি করে যেতে পারব। আমার উদ্দেশ্য ক্ষমতা নই, আমার লক্ষ্য প্রতিটা মানুষের উন্নতির তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। চাইলে আপনি নিজ স্থান থেকেও কারো ভালো থাকার কারণ হতে পারেন। মানুষের ভালো করতে গিয়ে প্রিয়জনকে হারিয়ে আমি নিজে ম—রে যাব তা হবে না। নিজেকে সবথেকে বেশি আনসেফ মনে করি সমীরণের কাছেই। সে নীরবে,নিভৃতে আমার আপনজনকে আঘাত করতে পারে। সেকারণেই আপনার উদ্দেশ্যে সায় জানিয়েছি। এনগেজমেন্টের দিন শর্তনামার কাগজে সমীরণ এবং আপনার বাবার সাইন নিয়েছি। আমার একটাই শর্ত ছিল যদি কখনো আমার আপনজনের কিছু হয় তাহলে সরাসরি দোষী হবে সমীরণ ও আপনার বাবা। এনগেজমেন্টের দিন আমি আপনাকে রিং পড়াব না, আমার মা পড়াবে সেটাও পূর্ব নির্ধারিত ছিল। ”
” হ্যাঁ। কারণ আপনি একজন ভাগ্যবতীকে ভালোবাসেন। সেই লাকি মেয়েটা যে আপনার কাজিন নিশাত,আমি একটুও টের পেলাম না। মেয়েটা খুব ছোট। যখন জানলাম নিজের থেকে ১১ বছরের ছোট একটা মেয়েকে ভাইয়া বিয়ে করতে যাচ্ছে আমি জোর গলায় জানিয়ে দিলাম কখনোই মানব না আমি। সেজন্যই বাবা-মার সাথে মেয়ের বাড়িতে যাই নি,পাত্রীটা কে সেটাও জানতে পারি নি। বাড়িতে ফিরে সমীরণ ভাইয়ার হট্টগোলে জানলাম। ”
প্রহর নিশ্চুপ। কথার আওয়াজ না শুনতে পেয়ে তনুজা চমৎকার মধুময় স্বরে অনুরোধ করে,
” আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি হবু নেতাসাহেব? ”
” আপনি এই মুহূর্তে ব্যক্তিগত, পাবলিকগত সকল প্রশ্নই নির্বিঘ্নে করতে পারেন তনুজা। ”
তনুজা বিগলিত হাসল। ভেতরটা কেমন করে উঠল তার। বিরহিণী মনটা চিৎকার করে বলছে অপরের ক্ষতি করতে এসে,অসহায় বানাতে এসে, তুই নিজেই প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়ে নিজেরই ক্ষতি করলি তনুজা। ফিরিস এখন ভীনদেশে নিজের ভাঙাচোরা, খন্ড খন্ড মনটাকে কুড়িয়ে। সে অনুভূতিতে ধমকে, শাসিয়ে, বুকের অভ্যন্তরে ঘুম পাড়িয়ে বলল,
” নিশাত আপনারও অনেক ছোট। দশ,এগারো বছরের ছোট হবেই। এত পিচ্চি একটা মেয়েকে আপনি কবে থেকে ভালোবাসেন?
” সেটা জানিনা৷ তবে হৃদয় চুরি করেছে আঁখ খেয়ে দাঁত ভেঙে। ”
তনুজা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। থমকালো। দাঁত ভাঙলে ভালোবাসা হয়ে যায়? অদ্ভুত!
” একটু বুঝিয়ে বলবেন?”
” নিশাত জন্ম নেওয়ার পর থেকেই ওকে আমার কেন যেন ভালো লাগত না। মামার প্রতি ক্ষোভ জমে আছে আমাদের। নিশাতের মধ্যে আমি মামুজানের ছায়া দেখতাম। পুরো শরীর রাগে রি রি করে উঠত ওকে দেখলেই। ইচ্ছে করত ওর বাবা যেমন আমাদের নানার বাড়ির আদর যত্ন, সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে, তেমনভাবেই ওর থেকে সব ছিনিয়ে নিতে। জেদ থেকেই আমি ওর ওপর খুব অত্যা**চার করে বেড়াতাম। কারণে অকারণে শাসন করতাম, মা–রতাম, অপমান করতাম। আমার রক্তে মিশে গিয়েছে ওকে শাসন করার,ধমকানোর, সহজভাবে কথা না বলার অভ্যাসটুকু। নিশুকে এত এত শাসন করতাম যে সে ভয়ে আমার সামনে আসত না। আমাদের বাড়িতে আসলেও মার পেছন পেছন লুকিয়ে থাকত। আমি সামনে দাঁড়ালে মায়ের পেছন থেকে অল্প করে মাথা বের করে ভয়ার্ত চোখে দুটো মেলে দেখত আমাকে। ভীষণ মায়া হতো, তবুও আমি ইচ্ছেমতো ভয় দেখিয়ে যেতাম। অশান্তিতে রাখতাম। একদিন আঁখ খেতে দিয়ে মুখ থেকে রক্ত ঝরে। রক্ত দেখে কাঁপতে কাঁপতে ঢলে পড়ে আমার বুকে। সেদিনই মারাত্মক সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। তুলতুলে হাতের স্পর্শে ভিতরে ধপ করে প্রেমপ্রদীপ জ্বলে ওঠে, মায়া জোরালো হয়। আগুনের বহ্নিশিখায় জ্বলতে জ্বলতে ওই মুহূর্তে অনুভব করি যাকে আমি ভয় দেখিয়ে নেতিয়ে রাখি সে সবথেকে ভরসাযোগ্য আমাকেই মরে করে। এক মুহূর্তে ভালোবাসা হয় নি, তবে নিজের শাসন, কথার ধাতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি। এগুলোর সাথে নতুন করে যা যুক্ত হলো তা হলো, তাকে প্রাণ দিয়েও আগলে রাখব আমি। প্রাণেশ্বরী বানিয়ে দূর থেকে চোখের তারায় রাখতে রাখতে বছর বাদে মায়া ধীরে ধীরে রূপ নিল ভালোবাসায়। ”
” এক পলকে ভালোবাসেন নি?”
” এক পলকে ভালোবাসা হয় না, বড়জোর আকর্ষণ হয়। সেই আকর্ষণে মানুষটাকে দেখার আগ্রহ বাড়ে। দেখতে দেখতে মায়া বসে যায়। যেই মায়ার সমাপ্তি নেই, মৃ**ত্যু পর্যন্ত মনের ঘরে বসবাস করে,সেই মায়ার নাম হলো ভালোবাসা।”
” আপনি এত সুন্দর করে কেন কথা বলেন নেতাসাহেব? জানেন, আপনার কথার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। নিশাতও নিশ্চয়ই কথার জালেই ফেঁসে ম–রেছে। ”
প্রহর বেকায়দায় হেসে বলল,
” নিশু ওর জীবনের সতেরো বছরের হিসেব নিকাশ করলে দেখবে তার প্রহর ভাই তাকে জীবনেও মিষ্টি করে কথা বলে নি। ”
” এত ভালোবাসেন অথচ প্রকাশ কেন করেন না?”
” সবটুকু ভালোবাসা একসাথে প্রকাশ করতে হয় না। ভালোবাসা একটু একটু করে দিতে হয়, যেন অল্পটুুকু ভালোবাসা নিয়ে আমরা দীর্ঘতম সুখের মুহূর্ত কাটাতে পারি। একসাথে দিয়ে দিলে, ভালোবাসা পাবার জন্য কেউ তৃষ্ণার্ত হয় না। ”
তনুজার চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে অশ্রু শব্দকে আটকাচ্ছে ও। সে চায় না প্রহর জানুক,বুঝুক ওর অনুভূতি। পিপাসা পেলে পানির কদর যেমন বেড়ে যায়,সে-ও একবিন্দু ভালোবাসা পাবার আশায় তৃষ্ণার্ত,ব্যকুল। একটুখানি ভালোবাসা পেলেই সে মৃ–ত্যু অব্দি ভালো থাকতে পারবে। কিন্তু যার ভালোবাসা চায় তার ভালোবাসা যে সে এই জীবনে পাবে না। একতরফা অনুভূতি নিয়ে অসুখে নিঃশেষ হতে হবে আমৃত্যু। তার তৃষ্ণা মিটবে না,কেউ মেটাতে পারবে না। খুশির জোয়ারে ভেসে যেতে পারবে না কখনো,কোনোদিন। ওপাশ থেকে প্রহর একটু গাঢ় স্বরে বলল,
” আপনার এবং আমার কাজ এখানেই সমাপ্ত, মিস তনুজা। এখন আপনাকে শুধু আমার বিয়ে হওয়াতে কষ্ট পেয়েছেন এমন অভিনয় করতে হবে। নয়ত,,,
” নয়তো যদি কেউ ঘুণাক্ষরে টের পায় আমি বিখ্যাত মডেল,রাজনীতিবিদ সমীরণের লুকায়িত শ**ত্রু,তাহলে সেই জা—নোয়ার রক্তের সম্পর্ক ভোলে যাবে। আমাকে ধ্বংস করতে হয়তো বাবা-মার দিক চেয়ে এক সেকেন্ড ভাববে, কিন্তু আমার মৃতযই থাকবে তার একমাত্র অভিসন্ধি। ”
” হ্যাঁ। আপনি ফিরে যাচ্ছেন কবে?”
” শীঘ্রই। তবে আমি আপনার ঘাড়ে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই প্রহর সাহেব। ”
প্রহর বিচলিত হলো না। কোনো ভাবাবেগ হলো না তার মাঝে। শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন সাজালো,
” কেমন দায়িত্ব? ”
তনুজা বুক ফুলিয়ে গরম গরম নিঃশ্বাস প্রকৃতির মাঝে মিশিয়ে দিল। শীতকে চরম উপেক্ষা উপহার দিয়ে গায়ের চাদরটা ছাদের দোলনায় ফেলে রাখল এলোমেলো করে। নিজেকে প্রস্তুত করতে মগ্ন ও। কথাগুলো বলার সময়টায় একদম কাঁদা যাবে না। দুর্বল চিত্তের মেয়ে নই সে।
” সমীরণ ভাইয়া একা নয়, তার একজন যমজ ভাই ছিল সেটা জানেন?”
” জানি। আপনার সেই ভাই ড্রা—গস নিতেন। অতিরিক্ত মাদকা**সক্ত হয়ে মা**রা গিয়েছিলেন। ”
” ভুল জানেন। ভাইয়া নিজের মৃ**ত্যু ডেকে আনবে এমন বোকা সে ছিল না। ”
তনুজার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কড়া ঠান্ডার মধ্যেও দরদর করে ঘামছে। প্রহর আঁচ পেয়ে সন্দিহান মুখে বলল,
” আপনি ঠিক আছেন?”
” অন্তিম ভাইয়া ভীষণ অগোছালো ধাঁচের ছেলে ছিল। তাই বলে খারাপ, উচ্ছৃঙ্খল ছিল এমন নয় কিন্তু। ভাইয়া ট্রাভেলিং এর ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। কিশোরগঞ্জ বেড়াতে যায় বছর পাঁচেক আগে। সেখানে সদ্য কলেজে উঠা এক বাড়ন্ত কিশোরীকে দেখে মনপ্রাণ সব আটকে যায়। জায়গা দিয়ে বসে হৃদয়ের কদম্বকাননে। আমাকে ছবি পাঠায়। চাপা নাক, বড় বড় চোখ, ধারালো চেহারার সাধারণ মেয়েটা আমারও মনে গেঁথে যায়। আমি দুষ্টমি করে বলি ভাইয়া বিয়ে করে নিয়ে আয়। তার তিনদিন বাদে শুনতে পাই ভাইয়া সত্যিই সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছে। বাবা-মাকে খবর পাঠায় সে বউ নিয়ে আসতে চায়। বাবা বেঁকে বসলে মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হলো বিয়েটা মানতে। মেয়ের পরিবারের সাথে কথা পাকাপাকি হলো কয়েক মাস পর ঘটা করে উঠিয়ে আনবে মেয়েকে। ভাইয়াকে নিয়ে ফিরলেন বাবা সবকিছু পাকাপোক্ত করে। এখানে এসে বাবা জানালেন সামনের এমপি ইলেকশনে অন্তিম ভাইয়া লড়বে। সমীরণ ভাইয়া কোনো প্রকার অনুভূতি প্রকাশ করল না এতে। বাবার মুখের ওপর কথা তার কোনো সন্তানই বলত না। এরই মধ্যে আমার আমেরিকায় পড়তে যাবার সকল কাজ কমপ্লিট। ভিসা হয়ে গেল,টিকিট কেটে ফেললাম তাড়াহুড়ো করে। কারণ একটা সেমিস্টার মিস মানেই ক্যারিয়ার গড়ার পথে পিছিয়ে যাওয়া। ইচ্ছে ছিল যাবার আগে ভাবীর সাথে একটাবার দেখা করে যাব,তবে ভাগ্যেই ছিল না। সেখানে যাবার চার মাসের মাথায় এক ভোরে মা আমাকে ফোন করে প্রচন্ড কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। আমি কারণ জানতে চাইলে বলে অন্তিম ভাইয়ার অবস্থা দুর্বিষহ। সারাক্ষণ ড্রাগ–স নেয়, অন্ধকার রুমে পড়ে থাকে। কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। ড্রাগ–স না নিতে পারলে পাগল হয়ে যায়। আমার ভিতর কেঁপে ওঠে তখন। একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হুট করে এতটা আসক্ত কেমন করে হলো! আমি ভাবীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইলাম। কিন্তু হলো না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ যেন হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। ওদিকে আমি বাংলাদেশে ব্যাক করার যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার শত শত প্রয়াসের মাঝেই হুট করে একটা ইমেইল এলো। ওপেন করতেই দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। অন্তিম ভাইয়া লিখেছিল, ‘ জানিস তনু, আমার দেহে ডা**গ্রস প্রবেশ করছিল অথচ আমি বুঝতেই পারি নি। কোনো অনুভূতিই হয় নি আমার। যতদিনে অনুভূতি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছিল ততদিনে আমি সম্পূর্ণভাবে আসক্ত। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে ড্রাগ–স নিতে না পারলে। কাউকে সহ্য হয় না। সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার কি জানিস? আমি আমার স্ত্রীকে সহ্য করতে পারি না। বিষাক্ত, অসহ্য লাগে সবাইকে। আমার মন মস্তিষ্ক আমি কাবু করতে পারছি না। আমাকে বাঁচাবি তনু? না-কি তুই সমীরণের পথেই হাঁটবি? সে ভাই রূপে দ্রোহী তনু। আমার এই অবস্থার জন্য সে দায়ী। যেই ক্ষমতা রক্তের,আত্মার সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় সেই ক্ষমতাকে আমি ঘৃ–ণা করি। ‘
” ড্রা–গস কীভাবে দিতেন? আপনি সম্পূর্ণ বিষয়টা জানতেন? আর আপনার ভাবী কোথায়?”
” আমি ঠিক সাতদিন পর আপনার সাথে মিট করতে চাই। কিছু কথা সামনাসামনি বলে যেতে চাই। আপনার সময় হবে?”
” হবে। ”
এটা উচ্চারণ করেই প্রহর ফোনটা নামিয়ে রাখল। শিরা উপশিরা টনটন করছে তার। ভুল করে ফেলেছে। অনেক বড় ভুল। মামুজানের কথার সম্মান রাখতে গিয়ে শুধু হাতটা না ভেঙে বুক বরাবর গু**লি করে একটা দেশদ্রোহী, বেইমান, প্রাণ নাশকারীকে উচ্ছেদ করার দরকার ছিল।
আলতার সাথে কথা সেড়ে রুমে আসে ঊষা৷ পেছন পেছন প্রত্যয়ও ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি আটকে দেয়। ঊষা চুল হাত খোঁপা করতে করতে নির্দ্বিধায় বলে,
” বেরিয়ে যাও ভাইয়া। তোমার ঘরে যাও। ”
কথাটা বলেই রুমে না থেকে বারান্দায় চলে গেল ঊষা। আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রত্যয় নিরবে, নিশ্চুপে পাশে এসে নৈঃশব্দ্যের সমাপ্তি টেনে দিল।
” তুই আমার সাথে এমন করছিস কেন? তোর সাথে দুটো কথা বলতে এসেছি, গিলতে আসি নি তোকে। ”
” কি বলবে বলো। ”
” আকাশের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার দিকে তাকা। ”
” তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। ”
ঊষার গুমোট কণ্ঠ শুনে প্রত্যয়ের মেজাজ তুঙ্গে উঠল। বাহু ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে ঊষাকে টেনে আনল সে। হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
” কি সমস্যা তোর? দেখ,ঊষা জোরজবরদস্তিতে আমি নেই। আমার মনে হয়েছে তোকে বিয়ে করাটা দরকার, করেছি। বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন, আমার ভালো থাকার জন্যও তোকে ভীষণ প্রয়োজন। হ্যাঁ, আমি আবেগবশীভূত হয়ে ভুল করেছি। ভালোবাসার পথে না হেঁটে ভুল পথের পথিক হয়েছি। কিন্তু এখন তো সঠিক রাস্তায় এসেছি। ”
রাগে গা পিত্তি জ্বলে ওঠে ঊষার। লোহার মতো কঠিন মুখ করে বলে,
” মৃন্ময়ীকে ছোঁয়া, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো, দিন-রাত পাগলের মতো তার জন্য হন্য হয়ে ছুটে যাওয়া সব মিথ্যা হয়ে যাবে? ”
প্রত্যয় ঊষার মাথায় হাত রেখে অন্যদিকে মুখ করে বলে,
” তোর অজানা নয় বাড়ন্ত বয়স থেকেই মেয়েদের সাথে প্রেমালাপ জমানো আমার চরিত্রে মিশে গিয়েছিল। ভার্সিটিতে মৃন্ময়ীকে দেখেই পছন্দ হয়। তার সাথে কথা বলতে গেলেই প্রথমদিনেই আমাকে রাজনীবিদরা চরি***ত্রহীন এসব বলে অপমান করে। তখন মোহ থেকে আমার মনে জেদ ধরে একেই আমি দুর্বল করে সারাজীবন অসহায় বানিয়ে নিজের কাছে রাখব। কিন্তু কে জানত আমি নিজেই তোর ভালোবাসার কাছে অসহায় হয়ে যাব! ছোট থেকেই তোকে আমার ভালো লাগত, মজার ছলে বলতাম তুই আমার বউ। কিন্তু এই ভালো লাগা নিয়ে গভীরভাবে ভাবি নি কখনো। শুধু মনে হতো তুই কাছে থাকলেই শান্তি, সুখে থাকি। তোকে হারানোর কথা কল্পনা করতেই আমার শরীর শিউরে ওঠে। তোর বিয়ের কথা যেদিন কানে এলো সেদিন থেকেই আমি উদ্ভট অনুভূতি টের পাই। আগের আমিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে অনুভূতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে শুরু করল। যে হারিয়ে গেলে নিজের শ্বাসকে নিজের মনে হয় না, সুখশান্তি অনিষ্ট হয়ে যায়, মৃ***ত্যুকেই আপন মনে হয়, যার উপস্থিতে মনে হয় চারপাশে খুশির বাতাস বইছে সে-ই তো ভালোবাসার মানুষ। তুই আমার সেই মানুষ ঊষা, তুই আমার হৃদয়ের একচ্ছত্র অধিষ্ঠাত্রী। বহু মেয়েকে পছন্দ করেছি,বহুজন ভালো লাগা হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস কর কেউ ভালোবাসা হয় নি। ভালোবাসা বুঝতে আমার বিলম্ব হয়েছে, কিন্তু আমাদের ভালোবাসাকে আমি হেরে যেতে দিই নি। সবাই ভালো হয় না, আমি বোধহয় বাজে ছেলে। কিন্তু এই বাজে ছেলে তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে, আজীবন ভালোবাসবে। ”
ঊষা ডান হাতটা প্রত্যয়ের হৃদয়স্থ বরাবর রেখে ধাক্কা দিয়ে বলিষ্ঠ শরীরটা সরিয়ে দিল নিজের থেকে। প্রত্যয় পিছিয়ে গেল দুই,তিন পা। বাকরুদ্ধ,হতভম্ব চক্ষুদ্বয় ঊষার অস্পষ্ট রক্তাভ চেহারায় নিবদ্ধ করল। কাঁদছে ও। বৃহৎ অশ্রু কণার শ্রাবণধারা কপোল বেয়ে নামছে বাঁধাহীন।
” কেন বাজে হলে তুমি? কেন জড়ালে মৃন্ময়ীকে নিজের পছন্দে? চরিত্র***হীন তুমি। তোমার ভালোবাসা আমি গ্রহণ করব না। ক্ষমা করব না কোনোদিন তোমাকে। কাকি-কাকা, বাবার পায়ে ধরে, আমার বিয়ের বরযাত্রী ফিরিয়ে দিয়ে নাটকীয় বিয়েতে কেন টেনে নিল আমাকে? তোমাকে সেই ছোট থেকে একতরফা ভালোবেসে যাওয়াই কি আমার জীবনের অভিশাপ ভাইয়া? ২৬ টা বছর লেগে গেল তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করতে? অথচ আমি যে বছর বছর ধরে নিজেকে হারিয়েছি প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়ায়? আমি তোমাতেই আসক্ত ছিলাম, তুমি আমাতে বিভোর হতে বড্ড সময় নষ্ট করে ফেললে ভাইয়া। ”
প্রত্যয় হাত বাড়িয়ে ছুঁতে এলে ঊষা দৌড়ে গিয়ে বারান্দার দরজা আটকে দিল। ঠেস দিয়ে বসে পড়ল দরজায়। জামা খামচে ধরে বুকফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়ল। কেন চাওয়া অনুযায়ী কিছু হয় না? প্রত্যাশিত জিনিসটা পেতে এত এত বেগ পোহাতে হয় কেন? প্রত্যয়কে সে সবসময় ভালো রূপে চেয়ে এসেছে, মেয়েদের সাথের সব ধরনের ফ্লার্ট চোখ বুঝে,কষ্ট চেপে মেনে নিয়েছে। কিন্তু মৃন্ময়ী নামে ভালো মেয়েটা কেন এটার অংশীদার হলো?
” দরজা খোল ভোরের পাখি। ”
” আমাদের জীবনে আর কখনো ভোর আসবে না ভাইয়া। তোমার ভোরের পাখির প্রাণে তুমি ছু–রি বসিয়ে দিয়েছ। ”
” আমি ভুল করেছি,সামনে বসিয়ে শাস্তি দে। আর দূরে ঠেলে দিস না। আমার এত কষ্ট ভালো লাগছে না। দয়া করে আমার কথা শোন। আমি তোকে ভালোবাসি বউ। ”
ঊষা অধরে হাত চেপে রোদনের আওয়াজ আটকানোর প্রাণপণ প্রয়াসে ডুবল। তারই ভালোবাসার মানুষটা কেন এত নিকৃষ্ট হলো? কেন? ভাগ্য এমন কেন তার? ভাগ্যকে আজ খুব দোষারোপ করতে ইচ্ছে করছে। পরিস্থিতিকে মন চাইছে বলতে আমার জীবনের সময়গুলো সুন্দর হলেই পারত। প্রেমের প্রতি ঘৃ**ণা ধরে গেল। এই প্রেমই সব কষ্টের কারণ। না সে প্রত্যয়ের প্রেমে পড়ত, আর না এমন যন্ত্রণা পেতে হতো এখন। বিড়বিড় করল চাপা ক্লে*শে, ঘৃ***ণায়,দুঃখে,
” কেন এলে প্রেম
কেন এলে আমার দোরগোড়ায়?
কেড়ে নিলে তুমি সর্বস্ব।
বলো তো প্রেম
কেন মানুষ গুমরে ম**রে,হারায় তোমার উষ্ণ ধোঁয়ায়? ”
__________________________
ঝং ধরা নিঝুম মর্ত্যধামে রাত্তিরের গভীরে শীতের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। মজুমদার বাড়ির সর্বত্র নিরবতার বিস্তার। দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্তির শেষে নিশাতের প্রিয় সঙ্গী ঘুম ফিরে এসেছে। আরামসে ঘুমের রাজ্যের ঘুমপরী হয়ে তন্দ্রাবিলাসে ব্যস্ত ও। ফোনের বিচ্ছিরি শব্দে দু একবার নড়েচড়ে ফের নিদ্রার দিকে ধাবিত হতে লাগল। বারংবার ঘুমের ব্যাঘাত করা মোবাইলটাকে আছাড় মা**রতে গিয়ে দেখে প্রহর কল করেছে। প্রহর ভাই! এত রাতে! ক’টা বাজে? রাত দেড়টা। কল রিসিভ করে হ্যালো বলার কষ্টটুকু করতে হলো না। আকাশে অকস্মাৎ চমকানো বজ্রপাতের ন্যায় বিদ্যুৎবেগে কথাগুলো ভেসে এলো শ্রবণ দুয়ারে,
” তোর বাপ শর্ত দিয়েছে তুই কলেজের গন্ডি না পার হওয়া পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে বউ সেজে যেতে পারবি না। আমি কি অবুঝ? ফিডার খাই? এত সহজে উনি বিয়ে মেনে নেবার লোক? আমাকে অশান্তিতে রাখার জন্যই মামুজানের অমন বন্দোবস্ত। রাগে তখন বেরিয়ে গেছি বলে যে শর্ত হজম করে নিয়েছি এমন না৷ ঠান্ডা গলায় উনি শর্ত দেবেন, আমি মেনে নেবো? দরজা খোল,এখুনি এসে দরজা খুলবি তুই। ”
হতচকিত কণ্ঠস্বর নিশাতের,” এখন?”
” এক্ষুনি। জলদি আসবি। তোদের বাড়িতে জামাই আপ্যায়ন হচ্ছে মশা দিয়ে। খুব তাড়াতাড়িই সব রক্ত শুষে নিয়ে তোর জামাইকে মা***রার কর্মযজ্ঞ চলছে। ”
নিশাত ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সিঁড়িতে আসতেই স্তব্ধ হয়ে পড়ল। ছোট ফুপি মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছে। ওকে দেখেই ভ্রুঁ কুঁচকে সবিস্ময়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
” তুই এত রাতে? কোথায় যাচ্ছিস?”
ফুপি সজাগ মানে দরজার কপাট মেললেই বুঝে যাবে। কথা লুকানোও বৃথা। আমতা আমতা করলে তিনি মৃদু হেসে বললেন,
” প্রহর এসেছে? ”
নিশাত লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। এত রাতে উনি এসেছেন ফুপি কী ভাববেন? ইশ!
” দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দরজা মেলে ঘরে নিয়ে যা। বিয়ে হবার পর কথাই হলো না তোদের। তার মধ্যে বড় ভাইয়া শর্তের দেয়াল তোলে দিলেন। বিয়ে করেও শান্তি নেই ছেলেটার। ”
মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট ফুপি চলে গেলেন। নিশাত জড়োসড়োভাবে এসে দরজা মেলে দিল। হুট করে ধেয়ে আসা তুফানের মতোই নিশাতকে আলুথালু করে দিয়ে টুপ করে প্রহর ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। টেনে সোজা রুমে নিয়ে আসল। এখানেও দরজা আটকে দিল। নিশাত ভূতগ্রস্থ হয়ে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। চক্ষুদ্বয় ঘুমের আবেশে সেকেন্ড সেকেন্ড মুদে আসতে চাইছে। প্রহর ভাইকে দাপুটে ভঙ্গিমায় এক পা এক পা করে কাছে আসতে দেখে ছিটকে দূরে সরে গেল সে।
প্রহরের মনমেজাজ খুব বেশিই উত্তপ্ত। রোষের তোড়ে উচ্চারণ করল,
” নকড়া করবি না। দাঁড়া ওখানে। ”
নিশাত স্থির রইল। চোরা নজরে প্রহরকে দেখতে লাগল। কালো টিশার্ট, জিন্স পরনে। জ্যাকেট খুলে বিছানায় রেখেছে ইতোমধ্যে। ওর আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল তালাবদ্ধ করে অন্য হাতটা নিয়ে হৃদযন্ত্রের ওপর রাখল। পুরন্ত ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,
” বিয়ের প্রথম রাত আজ। উপহার না-কি দিতে হয়? এই হৃদয়টাই তোকে উপহার দিলাম। এটা তোর। আমার হৃদয় ভূমিতে তোরই আধিপত্য রবে চিরকাল। ”
নিশাতের চাহনি প্রহরের বুকের বা পাশে অটল। ভালোবাসা এমনও হয়! একটা মানুষ তার মন,হৃদয় অন্যের তরে সঁপে দিচ্ছে নিশ্চিন্তে। অথচ ভালোবাসায় যে বেদনা আছে? নিশাত যদি কখনো অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলে?
প্রহর বুকের মধ্যিখানে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। ঘাড়ে সিক্ত ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। এক লহমায় প্রহরের পিঠ খামচে ধরল নিশাত। তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে দেহে, রক্তে প্রবল উচ্ছ্বাস। প্রহর গলার কাছ থেকে মুখ তুলে ওর কপালে, গালে,নাকে অজস্র চুমু খেল। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে অনুভূতি দমিয়ে রাখা কঠিন। মন যাকে চায় তার প্রতি শারীরিক চাওয়ার অনুভূতি জন্মাবে না তা হাস্যকর। তবে সবকিছুরই একটা সময় আছে। মন দিয়ে পাওয়া নিশাতকে চাইলেই শারীরিকভাবে পেয়ে যেতে পারে কিন্তু এমনটা সে করবে না। আজ নয়, দৈহিক মিলন লগ্নটা আরো আরো অপেক্ষার প্রহর কাটিয়েই নাহয় আসুক। তবুও সুন্দর সময়ে আসুক। বুকের ভেতরের সামাল সামাল রবকে সম্মতি জানিয়ে অল্প করে হেসে বলল,
” কাল চলে যাব। ইলেকশনের ভেজালে ব্যস্ত থাকব। মন দিয়ে পড়িস। তোর মর্জি হলে আমাদের না হওয়া মিষ্টিমুখটা এখন হতে পারে। ”
নিশাত খিঁচে রইল। সে নিজ থেকে পারবে না। প্রহর ওর কম্পনরত ওষ্ঠযুগলের কাছাকাছি ঠোঁট এনে কেমন নেশা ধরানো গলায় অনুমতি চাইল,
” আপনি কি মিষ্টিমুখ করতে সায় দিচ্ছেন মিসেস মেহরিন মজুমদার নিশাত?”
নিশাত মন কেমন করা অনুভূতি নিয়ে চোখ বুঁজে ফেলে। এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না সে কভু।
#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)