প্রেমের তাজমহল_২ পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
4

#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২৫
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

গোধূলি বিকেল মানেই এক অপরূপ শান্তির মুহূর্ত। দিনের আলো আর রাতের আঁধারের মাঝখানে এক মায়াবী সময়। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। তার রঙ ধীরে ধীরে সোনালি থেকে কমলা হয়ে লালচে আভায় মিশে যাচ্ছে আকাশে। দক্ষিণা বাতাস বইছে। আনায়া ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আর দুদিন বাদেই ও এই বাড়ির মেহমান হয়ে যাবে। চেন বাড়ি কেমন পর হবে যাবে। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আনায়া। পাশের মাঠে বাচ্চা ছেলেগুলো খেলা করছে। ওদের মাঝে উচ্ছাসই আলাদা। আনায়ার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। কতো শত স্মৃতি জুড়ে আছে। আনায়ার হটাৎ চোখ পড়লো পাশের ছাদে। ছাদটা ফাঁকা পড়ে আছে। এমনি সময় ও আর অর্ষা মিলে কতই না খুনসুটি, দুষ্টামি, মারামারি করছে। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে দুজনের। আনায়ার খেয়াল হলো সেদিনের পর অর্ষা আর ওদের বাড়িতে আসেনি। এমনি সময় তো দিনে পাঁচবার ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে চলে আসে। এই দুদিনে এলো না যে? মেয়েটা অসুস্থ হলো না তো! অর্ষা টানা এভাবে আনায়াদের বাড়ি না এসে থাকে না। আবিরকে দেখার জন্য বাহানায় দিনে কয়েক বার আনায়াদের বাড়িতে ঘুর ঘুর করবে। আনায়া কাল একবার ভেবেছিলো অর্ষাদের বাড়িতে যাবে। কিন্তু শপিংয়ে যাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলো এখনই যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ওড়না সুন্দর করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দিলো অর্ষাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

অর্ষাদের ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে অর্ষার আম্মু। আনায়া তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি অর্ষা কোথায়? দুদিন ধরে দেখছি না যে ওকে”

“আর বলিস না মেয়ে আমার জ্বর বাধিয়ে ম*রা ম*রা অবস্থা। অবচেতন হয়ে ওয়াশরুমে পড়ে ছিলো। আমি ওকে ওর রুমে ডাকতে যেয়ে দেখি ঝর্ণা ছাড়া অর্ষা ফ্লোরে লুটিয়ে আছে। তারপর তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার ডাকলাম। ডাক্তার বলল অতিরিক্ত ভিজার কারণে এমন হয়েছে”

আনায়া হন্ত দন্ত হয়ে সুধালো,
“এখন কেমন আছে? জ্বর কমেছে?”

“এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো”

“আমি যাই অর্ষার সাথে দেখা করে আসি”

আনায়া দৌড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। ভাবনায় এলো ও কেমন বান্ধবী যে ওর বান্ধবীর এমন অবস্থা আর ও কিছু জানেই না! বন্ধু হিসেবে নিজেকে ব্যার্থ মনে হচ্ছে। ওর আরো আগে অর্ষার খবর নেওয়া দরকার ছিলো। অর্ষার রুমের দরজা খোলাই ছিলো। আনায়া ভিতরে প্রবেশ করলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রুমের কথাও অর্ষা নেই। ওয়াশরুমে উঁকি দিলো সেখানেও অর্ষা নেই। এই অসুস্থ শরীরে মেয়েটা গেল কোথায়? আনায়া এগিয়ে গেল ব্যালকনিতে। ব্যালকনিতে রাখা কাউচে অর্ষা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে একটা ফটো ফ্রেম। আনায়া এগিয়ে গেল অর্ষার দিকে। নিঃশব্দে পাশে বসলো। ডাকলো না
মেয়েটা এমনি অসুস্থ এখন ঘুম ভাঙ্গানো ঠিক হবে না! দুই দিনে মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে। মুখে আগের সেই লাবণ্যতা নেই। ফেকাশে ভাব। আনায়া হাত ছোঁয়ালো অর্ষার কপালে। মুহূর্তেই শিউরে উঠলো। জ্বরে মেয়েটার গাঁ পুরে যাচ্ছে। আনায়ার খারাপ লাগলো। অনুসূচনা হচ্ছে। আগ্রহ জাগলো ফটো ফ্রেমটা দেখার। আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে আস্তে আস্তে ফটো ফ্রেম অর্ষার হাত থেকে সরাতে চাইলো। অর্ষা শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। ওর আঁকড়ে ধরার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে মূল্যবান কিছু। আনায়ার বেগ পেতে হলো। অবশেষে অর্ষার কাছ থেকে ফটো ফ্রেম নিতে সফল হলো। ফ্রেমের দিকে নজর গেলে আনায়ার সেখানেই চোখ আটকে গেল। এটা তো আবির আর অর্ষার ছবি দিয়ে বাঁধানো ফটো ফ্রেম।

আনায়ার সেদিনের ঘটনা মনে পড়লো,
আনায়া অর্ষা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। অর্ষা সেবার জন্মদিনে আনায়ার কাছে আবিরের সাথে একটা ছবি তোলার আবদার করেছিল। আনায়া অর্ষার জন্মদিনে অনেক গুলো গিফট দিয়েছিলো তাতে তার হবে না। ওর আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেতেই হবে। অর্ষা কখনো এভাবেই কোনো কিছু নিয়ে আবদার করেনি। তাই আনায়া রাজি হয়ে গেছে। সাধারণত আবির তেমন মেয়েদের সাথে মিশে না। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা তো বহুদূর। আনায়া অর্ষার আবদার রাখতে রাজি হয়েছিলো। যেভাবেই হোক ও অর্ষার আবদার রাখবেই। অর্ষার জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই আনায়ার জন্মদিন। সেদিন আনায়া আবিরের কাছে আবদার করেছিল ও আবির আর অর্ষা একটা ছবি তুলবে। আবির রাজি হয়েছিলো। আবির আনায়াকে মাঝে দাঁড়াতে বললে আনায়া বলল,
“তুমি মাঝে দাড়াও। আমি আর অর্ষা দুপাশে দাঁড়াচ্ছি”

আনায়ার কথা মতো আবির কথা বাড়ায় নি। অর্ষাও ওর ছোটো বোনের মতোই। ছবি তুলবে এমন সময় আনায়া সরে গিয়েছিল। আবির আর অর্ষার ছবি উঠেছিলো। ছবিটা তে অর্ষা আবিরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর আবির ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। ছবি পেয়ে অর্ষার সেকি আনন্দ। ওর আনন্দের যেন শেষ নেই। বেস্ট ফ্রেন্ড এর খুশিতে আনায়াও সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলো।

সেই ঘটনা মনে করে আনায়া হেসে ফেলল। মেয়েটা কতই না ভালোবাসে ওর ভাইকে। এমন ভাবে এক তরফা কজন ভালোবাসতে পারে? আনায়া অর্ষাকে দেখে বার বার অবাক হয়। আনায়া আলতো হাতে অর্ষা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। ধীরে ধীরে অর্ষার গাঁয়ের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। আনায়া উঠে গিয়ে জলপট্টি দেওয়ার জন্য বাটিতে করে পানি আর রুমাল নিয়ে এলো।

মাথায় ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ অনুভব করে অর্ষা চোখ মেলে তাকাতে চেষ্টা করলো। ক্লান্তি, অসুস্থতা মিলে পেরে উঠছে না। শরীরের সকল শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। তাও টেনে টুনে চোখ খুলল। পাশে আনায়াকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কখন এলি?”

“খানিক ক্ষণ আগে”

“ডাকিস নি কেন?”

“ঘুমাচ্ছিলি তাই”

“ডাকলেই পারতিস”

“মন সায় দিচ্ছিলো না”

কথার পৃষ্ঠে অর্ষা কোনো জবাব দিলো না। আনায়া হুট্ করে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সরি দোস্ত। তুই এতোটা অসুস্থ আর আমি তোর খবর নিতেই পারিনি। মাফ করে দে আমায়”

অর্ষা মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“আরে বোকা এভাবে বলছিস কেন? আমি তো জানি তুই ব্যাস্ত ছিলিস বলেই আসতে পারিস নি। মায়ের কাছ থেকে শুনলাম কাল শপিংয়ে গিয়েছিলি”

শপিংয়ের কথা শুনে আনায়ার মুখ লাজে রাঙা হয়ে উঠলো। অর্ণবের কর্মকাণ্ড গুলো মনে পড়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“হ্যাঁ”

“সব কেনা শেষ?”

“হ্যাঁ। আর শোন তোকে আমার বিয়ে তে পড়ার জন্য কিছু কিনতে হবে না। তোর সব কেনা হয়ে গেছে। আমি দিয়ে যাবো নি”

“কে কিনে দিলো?”

“কে আবার আপনার জিজু”

অর্ষা দুস্টুমি করে বলল,
“আমার জিজু তোর কি হয়?”

আনায়ার লজ্জা পেল। এই বজ্জাত মেয়ে ইচ্ছে করে ওকে লজ্জা দিচ্ছে। অসুস্থ শরীরেও ওকে লজ্জা দিতে ছাড়ছে না।
“জানি না”

“আমার জিজু তোর হাব্বি হয়, হাব্বি”

আনায়া কিছু বলল না। হটাৎ মাথায় প্রশ্ন আসতেই দুম করে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“সত্যি করে বল তো তোর জ্বর এলো কি করে? তুই ঝর্ণার নিচে পড়ে ছিলিস কিভাবে? সত্যি কথা বলবি কিন্তু”

অর্ষার সেদিনের কথা মনে করতে বসলো,
কান্না করতে করতে অর্ষার অবস্থা নাজেহাল। নিজেকে কোনো ভাবেই সামলাতে পারছে না। এই অবস্থায় নিচে যাওয়া ঠিক হবে না। কারো সামনে পড়ে গেলে নিজেকে সামলাতে পারবে না। তাই সেই রাতেই আনায়াদের ছাদ থেকে ওদের ছাদের চলে এসেছিলো। অর্ষার আম্মু কখনোই ছাদের দরজায় লাগায় না। তিনি ভালো করেই জানে অর্ষা রাত বিরেতে ছাদে ওঠে। সেদিনও ছাদের দরজা খোলাই ছিলো। অর্ষা সোজা নিজের রুমে চলে আসে। দরজা আটকে দরজা ঘেঁষে বসে পড়ে। তাও ওর কান্না থামার নাম নেই। বুক চিরে কান্না আসছে। চোখের সামনে আবির আর অহনার সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। অর্ষার ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে উন্মাদ উন্মাদ লাগছিলো। অবশেষে টিকতে না পেরে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে পড়লো। ঝর্ণার পানির সাথে সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে অর্ষার চোখের পানি। ভিজতে ভিজতে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। অর্ষার সেদিকে খেয়াল নেই। অসার হয়ে আসছিলো দেহ। শরীরে শক্তি পাচ্ছিলো না। কখন যে জ্ঞান হারিয়েছে নিজেও জানে না। জ্ঞান ফিরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করেছিল। হাতে ক্যানোলা লাগানো। পাশে বসে ওর আম্মু কান্না করছিলো।

কথা গুলো ভাবতে ভাবতে অর্ষার ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের কোণে পানি এসে জমতে শুরু করলো। আনায়াকে এসব জানতে দেওয়া যাবে না। ও আবিরকে ভুল বুঝবে। ওর কষ্টে মেয়েটাও কষ্ট পাবে। সামনে ওর বিয়ে এসব জানলে ওর মন আরো খারাপ হবে। অর্ষা তো জানে আনায়া ওকে কতটা ভালোবাসে। যবে থেকে আনায়া জানতে পেরেছে অর্ষা আবিরকে ভালোবাসে তবে থেকে ওকে সাপোর্ট করে এসেছে। অর্ষা চায় না ওর এই সময় মন খারাপ হোক। তাই মুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“আরে তেমন কিছুই না। গরম লাগছিলো তাই ঝর্ণা ছেড়ে ভিজছিলাম। চোখে কখন ঘুম এসে পড়েছে নিজেও জানি না”

“তোর কি আমাকে বাচ্চা মনে হয়?”

“একদম না, অর্ণব সিকদারের বউ মনে হয়”

আনায়া ফের লজ্জা পেল। অ*সভ্য লোকটা সামনে থাকলে তো লজ্জা দেয় এখন তার নামেও আনায়ার লজ্জা লাগছে। কি অবাক কাণ্ড! আনায়া অর্ষার কান আলতো করে মুচড়ে ধরে বলল,
“দাঁড়া আমার বিয়েটা হয়ে গেলে আব্বুকে বলে শীঘ্রই তোর আর ভাইয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। বেশি পেকে গেছিস তুই”

অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,
“সেটা এই জন্মে সম্ভব না”

#চলবে?

#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২৬
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। আজ বাদে কাল খান বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে। আনায়াদের বাড়ি সজানো হচ্ছে। লাল, নীল, হলুদ রঙ বেরঙের আলোয় সেজে উঠেছে পুরো এলাকা। বিজনেস ম্যান আশরাফ সাহেবের একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা এলাকা না সাজালে হয়! আশরাফ সাহেব মেয়ের বিয়েতে বিন্দু মাত্র ত্রুটি রাখেননি। দুহাত ভরে খরচা করছেন। তার আদরের একমাত্র কন্যার বিয়ে বলে কথা। আনায়াদের বাড়িতে বসেছে আত্মীয়দের মেলা। আনায়ার খালা, মামা, কাজিন সবাই এসেছে। পুরো বাড়ি আত্মীয় স্বজনে গিজ গিজ করছে। বড়রা আলাদা জায়গায় ছোটরা আলাদা জায়গায় যার যার মতো গল্প, হাসি মজা করছে। আনায়া ওর রুমে বসে সাজছে। ওকে সাজতে সাহায্য করছে ওর মামাতো বোন প্রিয়া। মেয়েটা সাজ গোজে পটু। ওকে দেখে মনে হবে কোনো প্রফেশনাল মেকাপ আর্টিস্ট। একটু পড়েই হলুদের প্রোগ্রাম। রাতে মেহেদীর প্রোগ্রাম করা হবে।তাড়াতাড়ি করে বিয়ের তারিখ দেওয়ায় আলাদা আলাদা প্রোগাম করার সময় নেই। একই দিনে হলুদ মেহেদী পড়ানো হবে। আনায়াকে হলুদের সমারোহে সাজানো হচ্ছে। তাজা ফুলের তৈরি সকল গহনা। হাতে ,গলায়, কানে সব তাজা ফুলের গহনা। সব নীলিমা আনায়ার জন্য অর্ডার দিয়ে এনেছে। ওর একমাত্র ননদীনির বিয়ে বলে কথা। আনায়ার শরীর থেকে তাজা ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। মন মাতানো সুবাস যাকে বলে। আনায়ার সাজা শেষ হলে ওকে স্টেজে নিয়ে বসানো হলো। আনায়ার পাশে বসে আছে মিহি আর অর্ষা। নীলিমা কাজে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। অর্ষা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। তাও অর্ষা আসতে চাইছিলো না। আনায়া ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে এসেছে। অর্ষার এই হাসি আনন্দ সব কেমন বিষাদ বিষাদ লাগছে তাও মুখে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। নাহয় আনায়ার মন খারাপ হবে। ও চায় না এই মুহূর্তে আনায়ার আরো বেশি মন খারাপ হোক। খানিকক্ষণ বাদে আনায়াদের বাড়িতে অর্ণবদের বাড়ি থেকে কিছু মানুষ এলো। বিয়ের কিছু সামগ্রী নিয়ে। যেগুলো বাকি রয়ে গিয়েছিল। তাঁদের সাথে এসেছে অহনাও। অহনা দৌড়ে আনায়ার কাছে চলে এলো। উচ্চাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ভাবি তোমাকে মা-শা-আল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে। ভাইয়া দেখলে তো চোখই ফেরাতে পারবে না। ছোটো খাটো হার্ট অ্যাটাক করে বসবে। তবে বেচারার কপাল খারাপ। সো স্যাড! সমস্যা নেই আমি ছবি তুলে নিয়ে যাবো। ভাইয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে জ্বালাবো”

আনায়া হাসলো অহনার বাচ্চামোতে। মেয়েটা আসলেই কিউটের ডিব্বা। অহনা বক বক করেই চলেছে। আনায়া বসে বসে ওর কথা শুনছে আর হাসছে। অহনা বড্ড চঞ্চল আর হাস্যজ্জল স্বভাবের মেয়ে। এক নিমিষেই কারো মন জয় করতে সক্ষম। আনায়ার কিছুটা ভালো লাগলো। অর্ণবদের বাড়িতে ওর সাথে আড্ডা দেওয়ার মতো একজন মানুষ তো পেল। অহনা কথা বলতে বলতে হুট্ করে ভিডিও কল লাগালো অর্ণব কে। ফোন রিসিভ হলে অপর পক্ষ কে কিছু বলতে না দিয়ে অহনা বলা শুরু করলো,
“ভাইয়া দেখ ভাবিকে কতো সুন্দর লাগছে। পুরো পুতুল পুতুল লাগছে”

অর্ণব কাজ করছিলো। বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার দরুন দায়িত্ব সব ওর ঘাড়েই। ওদের বাড়িও সাজানো হচ্ছে। অর্ণব সেগুলোই পর্যবেক্ষণ করছিলো। কাজের মাঝে ফোন আসায় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এসেছিলো। কিন্তু ফোন রিসিভ করার পর বিরক্তির বদলে চোখে মুখে মুগ্ধতা বিরাজ করছে। অর্ণব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হলুদ রঙের সাথে তাজা ফুলে আবৃত তার মায়াবতীর পানে। মেয়েটা এমনিই ওর রাতের ঘুম হারাম করে। আজ নিঃঘাত অর্ণব রাতে ঘুমাতে পারবে না। পাশ থেকে অহনা বলল,
“ইসস আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই আমি ভাবিকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম। সুন্দরী ভাবি আমার”

অর্ণবের ধ্যান ভাঙলো। কতো বড় সাহস! ওর সামনে ওর বিয়ে করা বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। ভাবা যায় ! অর্ণব ফুসে উঠে বলল,
“পে*ত্নী তুই তোর বদ নজর সরা আমার বউয়ের ওপর থেকে। আমার বউয়ের যদি কিছু হয়েছে শা*কচু*ন্নি তোর খবর আছে”

“নিজের যখন একটু আগে আমার ভাবির দিকে বেলাজের মতো তাকিয়ে ছিলে সেই বেলায়? আমার তাকানোতে ভাবির কিছুই হবে না, তোমার তাকানোতে নজর লাগবে”

অহনা পাশে বসা মিহিকে বলল,
“এই মিহি কাজল নিয়ে এসো তো”

মিহি বুঝতে না পেরে বলল,
“কেন?”

“কেন আবার ভাবিকে কালো টিপ দিয়ে দিবো যেন কারো নজর না লাগে”

অর্ণব বলল,
“বাহ্ কি সুন্দর কথা! আমার বউ আর আমি তাকালেই দোষ”

অহনা বলল,
“হ্যাঁ, তুমি তাকাবে না”

দুই ভাই-বোন ঝগড়া করছে। আনায়া বসে বসে এদের ঝগড়া শুনছে। এইযে কথার মাঝে অর্ণব ‘আমার বউ, আমার বউ’ বলছে আনায়ার মনে শীতলতা বয়ে যাচ্ছে। অর্ণব আর আনায়া যখন ঝগড়া করে তখন অন্য এক অর্ণব কে দেখা যায়। একদম বাচ্চাদের মতো পায়ে পা দিয়ে দুজন ঝগড়া করে। তখন অর্ণবকে দেখে কেউ বলবে না এই ছেলেটা সংসদে বসে বড় বড় নেতাদের মাঝে ভাষণ দেয়। ওদের ঝগড়া দেখতে দেখতে আনায়ার ওর আর আবিরের দুস্টুমিষ্টি খুনসুটির ঘটনা গুলো মনে পড়ে গেল। আবির আর ও তো এমনই ভাবে মারামারি করে। আবার আনায়ার কিছু হলে আবিরই বেশি ডেসপারেট হয়। দুজনের যেমন সাপে নেওলে সম্পর্ক তেমনি একে অপরকে ভালোবাসে। কালকের পর থেকে আনায়া আবিরের সাথে দুস্টুমিষ্টি খুনসুটি গুলো মিস করবে। ভাবতেই আনায়ার চোখের কোণে পানি চলে এলো। অর্ণব ঝগড়ার মাঝে খেয়াল করলো তার মায়াবতীর চোখে পানি। হন্তদন্ত হয়ে সুধালো,
“মায়াবতী তোমার কি হয়েছে? এই আনায়া করছো কেন? আমায় বলো কি হয়েছে? এই অহনার বাচ্চা তুই পাশে থাকতে আমার বউ কান্না করছে কেন? ওর কান্না থামা”

“ভাবি, ও ভাবি। তুমি কান্না করছো কেন? ভাইয়ার আজাইরা বক বক শুনে কান্না করছো? থাক কান্না করো না। আমি ভাইয়ার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিবো ও আর বকবক করবে না”

“শা*কচু*ন্নি তুই আমার বদনাম করা বাদ দিয়ে ওর কান্না থামা আগে”

“এই তুমি চুপ করবে ভাইয়া?”

আনায়ার কান্না সেখানেই থেমে গেছে। দুই ভাই বোনের ঝগড়া দেখে। আনায়া চোখের পানি মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আর বলো না চোখে হুট্ করে কি যেন পড়লো। তাই চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিলো”

“তাই বলো। আমি আরো ভাবলাম..”

“তোকে এতো বেশি ভাবতে কে বলেছে?”

“তুমি চুপ থাকো তো”

আনায়া মাঝ থেকে বলে উঠলো,
“তোমরা দুজনই চুপ করো। তোমাদের দুই ভাই বোনের ঝগড়া শুনে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেল”

অহনা দাঁত কেলিয়ে বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি কান ঝালপাল হলে হবে বলো? এরপর তো আমাদের সব ঝগড়া তোমার সামনেই হবে। আর তুমি আমাদের ঝগড়া মিটমাট করবে”

“আমি বাপু পারবো না”

“সে দেখা যাবে”

আনায়ার অপর পাশে বসা অর্ষা তাকিয়ে আছে হাস্যজ্জল অহনার দিকে। অহনাকে দেখে ওর জেলাস ফিল করার কথা, হিংসে হওয়ার কথা কিন্তু ওর কোনোটাই হচ্ছে না। আসলেই মেয়েটা অনেক সুন্দর নাহলে তার আবির ভাই এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে! যেমন তার দুধে আলতা গাঁয়ের বরণ তেমন সুন্দর হাসি। যেকোনো পুরুষ এক নিমিষেই ঘায়েল হতে বাধ্য ওর সৌন্দর্যে। অর্ষা বিড়বিড় করে বলল, ❝পরের জন্ম বললে কিছু থাকলে সে জন্মে আমি অহনা হয়ে জন্ম নিতে চাই। আমার না হওয়া আবির ভাইকে আমার করে পেতে চাই❞

অহনাকে দেখে অর্ষার বড্ড আফসোস হচ্ছে। কি হতো ও আবির ভাইকে পেয়ে গেলে? কারো কি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত? মনের এক কোণ থেকে উত্তর ভেসে এলো,
❝এক জীবনে সব কিছু পেতে নেই। ভাগ্যে যে থাকবে সে এমনিই আসবে, আর যে থাকবে না তুমি তাকে পেয়েও হারাবে❞

অর্ষা মনকে সুধালো,
❝ভাগ্যে যে থাকবে সে তো আসবেই, কিন্তু মনে যে থাকবে তার কি হবে?❞

অপর পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। অপর পক্ষ নীরব। অর্ষা হাসলো। বিষাদে মাখা সেই হাসি। ও তো বোঝে কিন্তু ওর অবুঝ মন যে বোঝে না যে আবির ভাই তার হবে না। সে অন্য এক নারীর হবে। অর্ষার বুক চিরে দীর্ঘশাস বেরিয়ে এলো।

নীলিমা, মিহি, প্রিয়া, অর্ষা সবাই মিলে আনায়াকে হলুদ মাখিয়ে ভুত বানিয়ে ফেলেছে। আনায়ার অবস্থা দেখে চার জনই দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আনায়ার মেজাজ খারাপ হলো। ওকে হলুদ মাখিয়ে ভুত বানানো তাই না! আনায়া হলুদের বাটি থেকে এক খাবলা হলুদ নিয়ে মিহির পুরো মুখে মাখিয়ে দিলো। মিহির অবস্থা দেখে বাকিরা হাসছে। আনায়া এই হাসির সুযোগ নিয়ে নীলিমা আর প্রিয়ার মুখেও হলুদ মাখিয়ে দিলো। অর্ষা বাকি রয়ে গেছে। অর্ষাকে লাগাতে নিলে ও ছুটে পালালো। আনায়াও ছুটলো ওর পিছনে। পুরো বাগান জুড়ে ওরা ছুটো ছুটি করেছে। বাগানে ওরা পাঁচ জন ছাড়া কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। অর্ষা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক পর্যায়ে সামনে থেকে আসা কারো সাথে ধাক্কা খেল। আনায়া ওখানেই থেমে গেল। অর্ষা দ্রুত নিজেকে সামলে ওপরে তাকালো। ওর সামনে আবির দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের কানে ফোন। ফোনে কথা বলছিলো হয়তো। অর্ষা সেকেন্ড দুই আবিরের দিকে তাকালো। সেদিনের পর এই প্রথম আবিরের সামনাসামনি পড়লো। মানুষটা কে দেখে বুকের মাঝে হু হু করে উঠলো। মানুষটা তো আর ওর না তাই তাকিয়ে থেকে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? অর্ষা মাথা নিচু করে বলল,
“দুঃখিত আবির ভাই। আমি খেয়াল করিনি”

আবির গম্ভীর মুখে বলল,
“ঠিক আছে। এরপর থেকে খেয়াল রেখো”

অর্ষা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সরে গেল। আবিরও কথা বলতে বলতে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। অর্ষা সোজা নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। আনায়া কিছুই বুঝলো না। শুধু তাকিয়ে রইল দুজনের যাওয়ার দিকে।

#চলবে?

#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

আকাশে থালার ন্যায় পরিপূর্ণ চন্দ্র। পূর্ণিমার আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে রয়েছে। পুরো এলাকা লাল, নীল, হলুদ রঙের আলোয় ঝলমল করছে। আনায়াদের বাড়ি শোরগোলে পরিপূর্ণ। আনায়ার কক্ষ পুরো আঁধারে ছেয়ে আছে। ব্যালকনির দরজা খোলা থাকায় আলো প্রবেশ করছে রুমে। একটু আগেই মেহেদী পড়া শেষ করে রুমে এসেছে আনায়া। ক্লান্ত শরীর, উদাস মন। শরীর ঝিমিয়ে আসতে চাইছে। এতো এতো আনন্দের মাঝেও কোথাও একটা চাপা কষ্ট রয়েই যাচ্ছে। আনায়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মেয়েদের জীবন তো এটাই। যেই বাড়িতে তারা জন্মের পর আদর, যত্ন, ভালোবাসায় হেসে খেলে বড় হয়েছে সেই বাড়িই একদিন তাঁদের ছেড়ে যেতে হয়। তিন অক্ষরের একটা শব্দ ব্যাস! বদলে যায় মেয়েদের জীবন, তাদের পরিচয়, তাঁদের বাসস্থান। একটা মানুষের সাথে সারাজীবন থাকার জন্য, তার সাথে রঙিন স্বপ্ন বোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে যেতে হয়। আনায়ার গলায় কান্নারা গলা পাকিয়ে আছে। খানিক বাদে বাদে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আনায়া অনেক কষ্টে এতক্ষন সবার সামনে নিজেকে সামলে রেখেছে। কিন্তু রুমে এসে শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। আনায়া খানিক সময় নিলো। নিজেকে হালকা করা প্রয়োজন। কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেছে। কান্না থামিয়ে কাপড় নিয়ে ছুটলো ওয়াশরুমে। ড্রেস চেঞ্জ করা দরকার। ড্রেস চেঞ্জ করে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন অনেকটা হালকা লাগছে। আয়নার সামনে যেয়ে বসলো। চুল গুলো জট বেঁধে আছে। ধীরে ধীরে জট ছাড়ানো শেষ করলো। এমন সময় ব্যালকনিতে ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। নিস্তব্ধ রজনীতে এমন বিকট শব্দে আনায়া খানিকটা ভড়কে গেল। ভীতু পায়ে এগিয়ে গেল ব্যালকনিতে। উঁকি দিয়ে দেখলো মানব ছায়া। ওর ব্যালকনিতে এই রাতের বেলা মানুষ আসবে কোথা থেকে? আনায়া কাঁপা কাঁপা স্বরে সুধালো,
“কে? কে ওখানে?”

ছায়া মানব হুট্ করে পিছনে ফিরে আনায়ার হাত ধরে টান দিলো। আনায়া ছিটকে যেয়ে সামনের মানুষটার বুকে পড়লো। ফট করে চোখ তুলে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে। আনায়ার চোখ সেখানেই আটকে গেল। কালো টিশার্ট, কালো জিন্স পরিহিত এমপি সাহেবের সুদর্শন মুখশ্রী। অপর দিকে অর্ণব আটকে গেছে মায়াবতীর ঝিল সম আঁখিতে। মায়াবতীর সর্বনাশা আঁখিদয়। কোনো এক ক্লান্ত বিকেলে এই চোখের মায়ায়ই তো পড়েছিল। বছরের পর বছর কেটেছে ওর মায়াবতীর মায়ার ঘোর কাটেনি। আনায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আপনি?”

“আমি ছাড়া অন্য কারো সাধ্যি আছে এতো রাতে আমার বউয়ের রুমে ঢোকার?”

“হুট্ করে এই সময়?”

“মায়াবতীকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো”

আনায়া অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“তাই বলে এতো রাতে?”

“প্রেমিক পুরুষদের কাছে রাত দিন মেটার করে না। মেটার করে প্রেয়সীকে দেখার আকুলতা”

“কালকে থেকে তো সব সময় চোখের সামনেই পাবেন”

“কালকের পরের টা পরে দেখা যাবে। এখন চুপ করে আমায় দেখার সুযোগ দেও তো”

আনায়া আর কোনো কথা বলল না। বলবে না কথা বজ্জাত লোকটার সাথে। ওকেই দেখবে আর ও কথা বললেই দোষ। হুহ! অর্ণব আচমকা প্রশ্ন করে বসলো,
“কান্না করছো?”

আনায়া হতচকিয়ে গেল। অর্ণব বুঝলো কিভাবে?
“কই না তো?”

অর্ণব হাসলো। মেয়েটা ওর কাছ থেকে লুকাতে চাইছে কিন্তু সে কি জানে সে গোটা মানুষটা অর্ণব শিকদারের নখদর্পনে? উহু জানে না!
“আমার থেকে লুকানো এতো সহজ না মায়াবতী! এখন বলো কান্না কেন করছো?”

আনায়া মৃদু স্বরে বলল,
“কালকের পর থেকে তো আমি আর আমার পরিবারে সাথে থাকতে পারবো না। যখন খুশি তাঁদের ছুতে পারবো না। প্রতিদিন আম্মুর বকা শোনা হবে না, আব্বুর আদর মাখা ডাক, বড় ভাইয়ার ভালোবাসা, ছোটো ভাইয়ার সাথে খুনসুটি কোনোটাই হবে না। সেগুলো ভেবেই আরকি..”

অর্ণব আনায়ার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল কণ্ঠে বলল,
“ধুর বোকা মেয়ে! তোমার যখন ইচ্ছে হবে তুমি আমায় বলবে আমি তোমাকে দিয়ে যাবো। যখন ওদের মিস করবে তখন টুপ্ করে তুমি আর আমি চলে আসবো ওদের জ্বালাতে। কেমন হবে বলো?”

আনায়ার মন কিছুটা হালকা হলো। জীবন সঙ্গী বুঝদার হলে জীবন সুন্দর। আনায়া মুখ তুলে অর্ণবের দিকে সন্দীহান চোখে তাকিয়ে সুধালো,
“সত্যি করে বলুন তো হুট্ করে টপকানোর কারণ কি? কোন মতলবে এসেছেন শুনি!”

অর্ণব দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আনায়ার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
“গুড এই না হলে এমপি অর্ণব সিকদারের বউ?”

আনায়া চোখ ছোটো ছোটো করে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করলো। প্যাকেটের ভিতর হলুদ। অর্ণব এক হাতে হলুদ মাখিয়ে নিয়ে বলল,
“সবাই আমার বউকে হলুদ লাগিয়েছে। আর আমার বউকে আমি হলুদ লাগাবো না সেটা কখনো হয়? উহু, কখনোই না। তাই চলে এসেছি”

অর্ণব আলতো হাতে আনায়ার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আনায়া তাকিয়ে পা*গল লোকের পা*গলামো দেখছে। এই রাতের বেলা উনি এসেছে হলুদ লাগতে ভাবা যায়?
“আমায় লাগবে না?”

আনায়া অবুঝের মতো ঠোঁট উল্টে বলল,
“আমার কাছে তো হলুদ নেই”

“কে বলল নেই? এই যে..!”

কথাটা বলে অর্ণব আনায়ার গালের সাথে নিজের গাল ঘষে দিলো। অর্ণবের গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আনায়ার গালে বিধলে আনায়া শিউরে উঠলো। খামচে ধরলো অর্ণবের বুকের কাছটার টিশার্ট। অর্ণব গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“লেগেছে? বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

আনায়া মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালো। অর্ণব আনায়ার কাণ্ডে মুচকি হাসলো। লাজুক বউ তার। অর্ণব আনায়ার হাত দু হাত মেলে ধরলো। মেহেদীর ডিজাইনের মাঝে নিজের নাম খুঁজছে। অবশেষে পেয়েও গেল। হাতের তালুতে পেচিয়ে ডিজাইন করে অর্ণবের নাম লেখা।
“মেহেদীর কোণ নিয়ে এসো”

“কেন?”

“কাজ আছে যাও”

আনায়া রুম থেকে মেহেদী নিয়ে অর্ণবের হাতে দিলো। অর্ণব কিছুক্ষণ মেহেদীর কোণ নেড়ে চেড়ে দেখলো। অতঃপর এক কোণে ছোটো করে নিজের নাম লিখে দিলো। আনায়া বলল,
“আপনার নাম বড় করে লেখা আছে তো?”

“দেখেছি। কিন্ত আমি চাই তোমার সব কিছুতে আমার ছোঁয়া, আমার অস্তিত্ব থাক”

আনায়া মনে মনে বলল,
❝যার অস্তিত্ব জুড়ে আপনি সেখানে আলাদা করে অস্তিতের প্রয়োজন নেই❞

আনায়া মাথা নিচু করে রেখেছে। লজ্জায় গাল লাল হয়ে আছে মেয়েটার। অর্ণব থুতনিতে হাত রেখে আনায়ার মুখটা ওপরে তুললো। ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো আনায়ার ললাটে। আরো কিছুক্ষন সময় তাকিয়ে রইলো। আনায়া মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি বাসায় যাবেন না?”

“যেতে ইচ্ছে করছে না। রেখে দিবে?”

আনায়া চুপ রইলো। অর্ণব ফের বলল,
❝তোমার মনের এক কোণে সযত্নে রেখে দেবে আমায় মায়াবতী? বিশ্বাস করো তোমায় একটুও জ্বালাবো না। চুপ করে এক কোণে ঘাপটি মেরে থাকবো। রাখবে আমায়?❞

আনায়া একটু সময় নিয়ে ভাবলো। অর্ণবরের খানিকটা কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
❝রেখে দিলাম, থেকে যান❞

❝রয়ে যাবো আমৃত্যু কাল❞

দুজনের মাঝে নীরবতা। চোখে চোখে কথা বিনিময় হচ্ছে দুজনের। অর্ণব ঝুঁকে এলো আনায়ার দিকে। ফিসফিস করে বলল,
“এখন যাচ্ছি তবে কালকের জন্য তৈরি থেকে। অর্ণব সিকদারের ধর্য্য কিন্তু বড্ড কম”

আনায়া লাজুক হাসলো। লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলল। অর্ণব উচ্চ শব্দে হেসে দিলো। অতঃপর প্রস্তান করলো সেখান থেকে।
——-

আনায়া উদাস মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছে না। আচমকা দরজায় টোকা পড়লো। আনায়া ভাবলো এত রাতে কে এলো? দরজা খুলে দেখলো সামনে আবির দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি? এতো রাতে? কোনো দরকার ভাইয়া?”

“ঘুরতে যাবি?”

“এই রাতের বেলায়?”

“হ্যাঁ। আগে যেমন তুই আমি রাতে ঘুরতে যেতাম তেমন। চল যাই”

“চলো”

আবির হাত বাড়িয়ে দিলো। আনায়া আবিরের হাতে হাত রাখলো। সেই ছোটো বেলার অনুভূতি। দুই ভাই বোন হাতে হাত রেখে চলল ঘুরতে। রাতের নিস্তব্ধ শহর। পুরো এলাকা ঝলমল করছে। আনায়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে। আবির তাকিয়ে আছে ওর আদরের ছোটো বোনটার দিকে। দেখতে দেখতে বোনটা যে কখন বড় হয়ে গেল আবির যেন খেয়ালই করেনি। কাল ও মনে হয়েছে ওর বাচ্চা বোনটা। আজ বাদে কাল যার বিয়ে। আবির মৃদু কণ্ঠে সুধালো,
“এতো তাড়াতাড়ি বড় কেন হলি বনু? ছোটো থেকে গেলে তো আরো ভালো হতো। আরো কটা দিন খুনসুটিতে কাটিয়ে দিতাম। আলতো করে আগলে রাখতাম বুকের মাঝে। কেন এতো তাড়াতাড়ি বড় হলি?”

আনায়া আবিরের কথা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললে?”

আবির খেয়াল করে দেখলো আনায়ার মুখ ভার হয়ে আছে। তাই ওকে রাগাতে বলল,
“বললাম তোর বিয়েটা হয়ে গেলে তোর রুম তো ফাঁকা হয়ে যাবে। তোর রুম কে আমি আমার স্টাডি রুম বানাবো। ভালো হবে না বল?”

“তোমার সাহস তো কম না?”

“ফাইনালি আমাদের বাড়িটা পে*ত্নী মুক্ত হবে। আমার তো এখনই আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে”

“নাচতে থাকো। কোন গানে নাচবে? রোমান্টিক নাকি আইটেম সংয়ে?”

“যেটা তুই বলিস”

“দাড়াও চালাচ্ছি তোমার গান”

আনায়া রাস্তার পাশ থেকে ইটের টুকরা তুলে নিয়ে তাড়া করলো আবিরকে। আবির ইচ্ছে করেই আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছে। আনায়া আবিরের ছুই ছুই দূরত্বে। আবির ওকে ভেঙিয়ে বলল,
“পারে না, পারে না”

“একবার তোমায় হাতের কাছে পাই তারপর দেখাচ্ছি মজা। দাড়াও”

দুজন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেকটা দূর চলে এসেছে। আবির হাপিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়লো। আনায়াও ধপ করে ওর পাশে বসে পড়লো। হাতে থাকা ইটের টুকরো ফেলে দিলো। আবির হাপানো কণ্ঠে বলল,
“আর দৌঁড়াতে পারবো না। হাপিয়ে গেছি”

“আমিও”

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। আনায়ারা আবিরের কাঁধে মাথা দিয়ে হেলান দিলো। মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমায় অনেক মিস করবো ভাইয়া”

কথাটা বলতে বলতে ঝর ঝর করে কেঁদে দিলো আনায়া। আবির বোনের গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। গালে হাত রেখে বলল,
“কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে! তুই কি ভেবেছিস এতো সহজে তোকে জ্বালানো ছেড়ে দিবো? উহু, আমি দুদিন পর পর তোর শশুর বাড়ি চলে যাবো তোকে জ্বালাতে। নো টেনশন”

আনায়া ফিক করে হেসে দিলো। হেসে দিয়ে বলল,
“তুমি আর শুধরালে না”

আবির উঠে দাঁড়ালো। আনায়ার হাত টেনে ওকে দাঁড় করলো।
“চল বাড়ি যাই। অনেক রাত হয়েছে”

দুই ভাই বোন হাতে হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। পৃথিবীতে সবচেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক বুঝি ভাই বোনের। এই তাড়াতাড়ি মারামারি করবে, আবার এই মুহূর্তের ব্যাবধানে সব ভুলে গিয়ে একে অপরের দুঃখে সঙ্গী হবে। নীরব রাত্রি সাক্ষী হয়ে রইলো দুই ভাই-বোনের খুনসুটিময় মুহূর্তের।

#চলবে?

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ)