প্রেমের ধাঁরায় পর্ব-২৯

0
256

#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ২৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ধৃতি ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসে৷ বাইরে এসেই সে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“একটি মেয়ের জীবনে কিছু সিদ্ধান্ত খুব ভেবেচিন্তে নিতে হয়। বিয়েও ঠিক সেই রকমই একটা সিদ্ধান্ত। আমি তাড়াহুড়ো করে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আগে আমাকে আমার জীবনটা গুছিয়ে নিতে হবে৷ এ কয়েক মাস যাবত যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমি গেছি সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। আর সে জন্যই আমি অনুরোধ জানিয়ে বলছি,আমাকে এখন এই বিষয় নিয়ে যেন আর কোন রকম কোন জোরাজুরি করা না হয়। আশা করি, আমার এই কথাটা আপনারা রাখবেন।”

আলমগীর পাটোয়ারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“তোমার সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই ধৃতি৷ তুমি নিজের জীবনের ব্যাপারে যা ভেবেছ তাতে ভুল নেই। তবে আমার পরামর্শ যত দ্রুত নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়ে জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করতে পারবে তোমার জন্য ততোটাই ভালো।”

আকাশও বলে,
“তোমার জীবন গুছিয়ে দিতে পাশে থাকতে পারি তো? একজন বন্ধু হিসেবে?”

ধৃতি মৃদু হাসে। আকাশ বুঝতে পারে ধৃতির ইশারা ইতিবাচক। সে মনে মনে বলে,
“এক সময় তোমার সাথে প্রেমের ধাঁরায় ভেসে যাব, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে তার আগে আমাদের সুন্দর একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। একে অপরকে আরো বেশি চিনতে হবে, জানতে হবে। এই সময়টাই আমি চাই।”

এদিকে আরশাদ উদ্বিগ্নতার সাথে ধৃতিকে জিজ্ঞেস করে,
“আমার প্রতি তোমার কি মনোভাব ধৃতি? এই বিষয়টা দয়া করে পরিস্কার করো।”

ধৃতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“এই ব্যাপারটা আমি আরো অনেক আগে ক্লিয়ার করেছি আরশাদ সাহেব। আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ নেই। আপনি আমার অনেক উপকারও করেছেন, আমার কঠিন সময়ে আমাকে সাহায্য করেছিলেন সেসব ঋণ হয়তো আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। তবে কি জানেন, যখন প্রসঙ্গ একজন জীবনসঙ্গীর তখন জীবনে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর বেশি প্রয়োজন। আপনি মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো, তবে আপনার মধ্যে কিছু খারাপ গুণও আছে যা আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে আমার পক্ষে কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মানছি,পৃথিবীর কোন মানুষই পারফেক্ট নয়, সবারই কোন না কোন দোষ ত্রুটি রয়েছে এমনকি আমি নিজেও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নই৷ তবে প্রত্যেকের নিজের জীবনসঙ্গীর থেকে কিছু চাওয়ার থাকে। আমারও তেমন কিছু চাওয়া আছে। আমি বেশি কিছু কিন্তু চাই না শুধু এমন একজনকে চাই, যিনি আমাকে পর্যাপ্ত সম্মান দেবেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখবেন। আর বিশ্বাস এমন একটা জিনিস, যা হারালে কখনো আর ফেরত আসে না। আপনার উপর আমি অনেক বেশি বিশ্বাস করেছিলাম আরশাদ সাহেব। যখন আপনি আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমি সত্যি তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। আপনার সাথে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ কিন্তু বিয়ের মঞ্চে…আমি জানি যা ঘটেছে তাতে করে আপনাকেও সম্পূর্ণ দোষ দেয়া যায় না। আপনার মা আপনার থেকে সত্য লুকিয়ে ঠিক করে নি। কিন্তু সেই মুহুর্তে আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস, আশা, আকাঙ্খা সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এখন আমি আর তা চাইলেও ফেরত আনতে পারব না। এত তিক্ত স্মৃতি নিয়ে আপনার সাথে নতুন করে আমি একটা সম্পর্ক শুরু করতে পারব না। তাই আমি আজ একটা ব্যাপার আপনাকে পরিস্কার করে বলে দিতে চাই। আর সেটা হলো আমার পক্ষে আপনাকে নিয়ে ভাবা আর কখনোই সম্ভব না। আমাকে ক্ষমা করবেন কিন্তু..এটাই আমার সিদ্ধান্ত।”

আরশাদের মনোবল একদম ভেঙে যায়। এতদিন তার মনে যেটুকু আশার সঞ্চার ঘটেছিল তা যেন মুহুর্তের মধ্যে ধসে পড়ে। আরশাদ ব্যথিত স্বরে বলে,
“আর একটা সুযোগও কি আমি পাবো না ধৃতি?”

“সম্ভব নয়।”

আরশাদ আর কথা বাড়ায় না। ধৃতির দৃঢ অবস্থান তাকে বুঝিয়ে দেয় এখন সে যাই বলুক না কেন ধৃতি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না। ধৃতির জীবনে তার আর কোন যায়গা হবে না। এসব ভেবেই আরশাদ বলে ওঠে,
“তুমি যদি আমাকে সত্যিই আর সুযোগ দিতে না চাও তাহলে…আমিও তোমায় জোর করবো না। আমি চাই, তোমাকে..তোমাকে খুশি দেখতে। সেই খুশিতে যদি আমার অংশীদারিত্ব নাও থাকে তবুও আমি চাই তোমাকে সর্বোচ্চ খুশি দেখতে। সেই খুশিটা অন্য কারো সাথে হলেও..”

বলেই আরশাদ তাকায় আকাশের দিকে। ধৃতি বলে ওঠে,
“আপনাকে ধন্যবাদ আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর জন্য।”

আরশাদ গম্ভীর স্বরে পিছন ফিরে তাকায়। এখানে সবার সামনে নিজের চোখের জল ফেলতে চায় না সে। তাই ধীরে পায়ে আরশাদ বেরিয়ে এলো ধৃতির বাইরে থেকে৷ বাইরে বেরিয়ে এসে অঝোর ধারায় চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগল। জীবনে এই প্রথম ভালোবাসার কষ্টটা অনুভব করল আরশাদ। ছোটবেলায় পড়া দেবদাসের গল্পটার কথা মনে পড়ছে আরশাদের। তাই সে নিজেকে দেবদাসের সাথে তুলনা করছিল। তুলনা করে দেখছিল, তার জীবনও দেবদাসের মতোই হয়ে গেছে। তবে সে ঘুরে দাঁড়াবে৷ একটা মেয়ের জন্য কষ্টে ডুবে থাকবে না। প্রয়োজনে বিজনেসের কাজে আরো ডুবে যাবে। যাতে করে এই ক্ষতটা ভুলে উঠতে পারে। এই চিন্তা থেকেই সে নিজের কোম্পানির ম্যানেজারকে ফোন করে বলে,
“গত কয়েক দিনের যে ফাইল গুলো জমে আছে সেগুলো আমার ডেস্কে সাজিয়ে রাখুন৷ আমি শীঘ্রই অফিসে ফিরে সেগুলো দেখছি।”

বলেই ফোন রেখে দিয়ে সে বলে,
“এই শহরের বেস্ট বিজনেসম্যান আমি। এত সহজে আমার ভেঙে পড়লে চলবে না।”

বলেই আরশাদ সামনের দিকে পা বাড়ায়।

★★★
সময় এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে। এভাবেই দেখতে দেখতে ৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ৩ মাসে ধৃতি নিজের জীবন অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। নিজের পড়াশোনায় আবারো শুরু করেছে। যাতে করে জীবনে আবারো এগিয়ে যেতে পারে। ধৃতি এবং আকাশ এখন অনেক ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেছে।

ধৃতি ও আকাশ একসাথে হেটে বেড়াচ্ছে ভার্সিটির অঙ্গনে। ধৃতি আকাশকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার নতুন কেসের ব্যাপারে কি হলো?”

“কেসটা তো সমাধানের পথে এগিয়ে গেছে। আমিই জিতব ইনশাআল্লাহ। জীবনে কোন কেসই আমি হারিনি।”

ধৃতি মৃদু হেসে বলে,
“ভীষণ ট্যালেন্ডেড আপনি।”

“তো আপনি নিজের জীবনের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলেন ধৃতি?”

ধৃতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি চাই কোন সমাজসেবা মূলক সংগঠনে যুক্ত হতে। অসহায় মেয়েদের পাশে দাড়াতে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়ে আছে যারা প্রতিনিয়ত অত্যাচার এবং নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে কিন্তু প্রতিবাদ করতে ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে যে সমাজ কি বলবে, কি প্রভাব পড়বে। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চাই। এইসব মেয়েদের সহায় উঠতে চাই। ব্যস, এটুকুই।”

“অনেক সুন্দর ভাবনা। এই যাত্রায় আমাকে আপনার পাশে নেবেন তো?”

ধৃতি হেসে বলে,
“আপনি থাকতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”

“আমি সবসময় আপনার পাশে থাকতে চাই ধৃতি।”

আবেগঘন কন্ঠে বলে ওঠে আকাশ৷

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨