#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ২৬✨হানিমুন স্পেশাল✨
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আমান ও ছোয়া দুজনেই শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কাল সকালে তাদের থাইল্যান্ড যাওয়ার কথা। ছোয়া অনেক বেশি উত্তেজিত থাকলেও সেটা প্রকাশ করছে না। তবে আমানের যেন কোন আগ্রহই নেই থাইল্যান্ডে যাওয়া নিয়ে। যদি ছোয়ার সাথে তার সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক থাকত তাহলে হয়তো পরিস্থিতিটা ভিন্ন হতো! আমান অনেক বেশি খুশি থাকত থাইল্যান্ডে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যকার এই দূরত্ব যেন আমানের মনে বসন্ত আসার পথ মলিন করে দিয়েছে। বিভিন্ন ভাবনার মাঝেই ছোয়া অর্ধেক রাত পার করে দিল। মাঝরাতের দিকে আমান খেয়াল করে ছোয়া এখনো জেগে আছে। আমান ছোয়াকে প্রশ্ন করেই ফেলে,
‘তুই এত রাত জেগে আছিস কেন বল তো?’
ছোয়া হাই তুলতে তুলতে উত্তর দেয়,
‘ঘুম আসছে, কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না। এই প্রথম বিদেশে যাচ্ছি, তাই আরকি একটু,,’
আমান ছোট করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ওহ বুঝলাম। ঠিক আছে তোর যদি খুব বেশি চিন্তা হয় তাহলে যাওয়ার দরকার নেই।’
ছোয়ার মুখটা পানসে হয়ে উঠল। তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বলল,
‘না, আমি যাবো। আমার কি যাওয়ার ইচ্ছা নেই নাকি?’
আমান রাগী গলায় বলে,
‘তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। কালকে সকালের ফ্লাইটের কিন্তু আমাদের যেতে হবে মনে রাখিস।’
ছোয়া এবার নিজের দুচোখের পাতা বন্ধ করে নিল। আজ সকালেই ইউটিউবে থাইল্যান্ডের একটা ভিডিও দেখেছে। সেই অনুযায়ী থাইল্যান্ডের একটা কল্পিত দৃশ্য ভেসে উঠল তার মনের মধ্যে। ছোয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে মনে মনে বলল,
‘আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। উফ, কখন যে সকাল হবে আর আমি থাইল্যান্ডে যাবো। এই রাত যেন শেষই হচ্ছে না।’
৫১.
ভোরের আলো ইতিমধ্যে মেঘ ভেদ করে ফুটে উঠেছে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দে মুখরিত প্রকৃতি। ছোয়া যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠেই ফজরের সালাত আদায় করে নিয়েছে। অতঃপর মন দিয়েছে থাইল্যান্ডের ভাবনায়।
সকাল হতেই আমান তাড়া দিলো। ফ্লাইটের টাইম নাকি হয়ে এসেছে। ছোয়া বেশ হালকা কাপড়ই নিয়েছে। কারণ থাইল্যান্ডে এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। আর গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ অনেকটাই বেশি সেখানে।
ছোয়া একটি লাল রঙের শাড়ি সাথে হিজাব পড়ে নিয়েছে। এই সাজেই নাকি সে থাইল্যান্ডে যাবে। আমানের সামনে এসে উপস্থিত হতেই আমান ভ্রু কুচকে বলল,
‘তুই কি এভাবেই যাবি?’
‘হুম, কেন কো অসুবিধা আছে?’
‘বিদেশে কেউ শাড়ি পড়ে যায়?’
তখনই সেখানে উপস্থিত হলেন জান্নাতুল খাতুন। তিনি আমানের কথার উত্তরে বেশ ভারী গলায় বললেন,
‘আমরা বাঙালি। বিদেশে যাচ্ছি জন্য কি সাহেবদের মতো সেজে যেতে হবে নাকি? আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই সুন্দর আছে। তাই ছোয়া যেভাবে চাইছে সেভাবেই যাবে।’
আমান চুপ হয়ে গেল নিজের মায়ের কথা শুনে এবং এভাবেই রওনা দিল ছোয়াকে নিয়ে।
ঢাকা থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে রওনা দিলো আমান এবং ছোয়া।কয়েক ঘন্টা উড়ান দেওয়ার পর অবশেষে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে অবতরণ করল তারা। অতঃপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলো। যাওয়ার পথে ব্যাংককের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল ছোয়া। ব্যাংকক শহরটা বেশ সুন্দর আর গোছানো। রাস্তার মাঝে অনেক গাড়ি, বাস রয়েছে। ঢাকায় রাস্তার মধ্যে যেমন ফুচকা, ঝালমুড়ি পাওয়া যায় তেমনি ব্যাংককের রাস্তার ধারেও বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড রয়েছে। তবে এগুলোর নাম ছোয়ার জানা নেই। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বহুতল ভবন ও মার্কেট।
কিছু সময়ের ব্যবধানে তারা পৌছে গেল নোভা সিটি হোটেলে। এটি ব্যাংককের অন্যতম পরিচিত হোটেল। হোটেল থেকে আশেপাশের অনেক সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায় এবং এখানে অনেক সুযোগ সুবিধাও রয়েছে।
প্রথমেই আমান ছোয়াকে সাথে নিয়ে রিশেপসনে গেল। সেখান থেকে নিজেদের জন্য বুক করা রুমের চাবি নিয়ে রওনা দিল রুমের দিকে। রুমে প্রবেশ করেই ছোয়া দেখল এটা একটা ডবল বেড রুম। যা দেখে বেশ অবাকই হলো সে। কারণ বাড়িতে তো তারা একই বেডে থাকে। তাই এখানে এসে আলাদা বেডের ব্যবস্থার কোন কারণ খুজে পেল না। আমানকে এই নিয়ে প্রশ্ন করার সাহসও পেল না ছোয়া। অগত্যা চুপটি করেই রইল।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সর্বপ্রথম ছোয়া এসে দাড়ালো থাই গ্লাসের পাশে। সেখান থেকে বাইরের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলো ছোয়া।
পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো আমান মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়েই রয়েছে তার পানে। ছোয়াও তাকিয়ে রইল আমানের দিকে। যেন কিছু হবে তাদের মধ্যে এমন সময়ই দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। এত সুন্দর একটা মুহুর্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমানের বেশ রাগ হলো। আমান গিয়ে দরজা খুলতেই একজন হোটেল বয়কে দেখতে পেল। সে ইংরেজিতে বলল,
‘এই নিন স্যার, আপনাদের খাবার।’
আমান তাকে ভেতরে আসতে বলল। হোটেল বয় ভেতরে এসে খাবার রেখেই চলে গেল। আমান তখনো মনে মনে হোটেল বয়ের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে ব্যস্ত ছিল। এরমধ্যেই ছোয়া এসে দেখল তাদের জন্য একটি নুডলস পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন লুডুলস বা কি দিয়ে তৈরি সেটা ছোয়া জানে না। ছোয়ার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমান বলল,
‘এটা প্যাড থাই নুডলস। মুরগী এবং গরু দিয়ে তৈরি, তুই খেতে পারিস।’
আমানের বলতে দেরি কিন্তু ছোয়ার খেতে মোটেই দেরি হলো না। চটজলদি একটি প্লেট উঠিয়ে খেতে শুরু করল। নতুন খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে! এবং বেশ তৃপ্তি করেই খেয়ে নিলো ছোয়া।
৫২.
আগামীকাল সারাদিন আমান মিটিং নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। সেই কারণেই আজ ছোয়াকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আজকে তাদের প্ল্যান ব্যাংককে অবস্থিত গ্রান্ড প্যালেসে ঘুরতে যাওয়া। গ্রান্ড প্যালেসে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠে পড়ে দুজনে। কারণ সেখানে নৌকায় করেই যেতে হয়। তাদের সাথে রয়েছে ব্যাংককের স্থানীয় একজন ট্রাভেল গাইড।
নৌকায় করে যাওয়ার সময় অদ্ভুত ভাবে গ্রান্ড প্যালেসের সৌন্দর্য সবার চোখে পড়তে লাগল। ট্রাভেল গাইড তাদের উদ্দ্যেশ্যে ইংরেজিতে বলল,
‘এই প্যালেসটি থাইল্যান্ডের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ১৭৮২ সাল থেকেই এই প্যালেস থাইল্যান্ডের রাজা ও রয়্যাল কোর্টের সরকারি ভবন।’
গ্রান্ড প্যালেসে গিয়ে অনেকটা রাজকীয় বেশেই আমান ও ছোয়ার কিছু ছবি তুলে দিল ট্রাভেল গাইড। আমান এবং ছোয়া থাইল্যান্ডের রাজকীয় পোশাক পড়েই এসেছিল এখানে। তাদেরকে বেশ সুন্দরই লাগছিল। আশেপাশের অনেক পর্যটকই তাদের মুগ্ধ হয়ে দেখে এবং প্রশংসা করে।
গ্রান্ড প্যালেস ভ্রমণ শেষে তাদের হাতে কিছুটা সময় বেচে ছিল। তাই দুজনে ঠিক করে আপাতত খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে আবার কোথাও ঘুরতে যাবে। ট্রাভেল গাইডকে সাথে নিয়ে পাশেই একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢোকে দুজনে। চিকেন ফ্রাই এবং ফ্রাইড রাইস খায় সকলে। অতঃপর রওনা দেয় থাইল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ ওয়াট অরুনের দিকে। গ্রান্ড প্যালেসের বিপরীতে পুরো চাও ফ্রায়া নদী জুড়ে এই মন্দিরের বিস্মৃতি। এটি মূলত ব্যাংককের একটি বৌদ্ধ মন্দির(প্যাগোডা)। মন্দিরটির কারুকার্য এবং নির্মাণশৈলি অনেক সুন্দর যা সকলকে মুগ্ধ করে।
ট্রাভেল গাইড আমান ও ছোয়ার উদ্দ্যেশ্যে ইংরেজি ভাষায় বলে,
‘এই ওয়াট অরুন মন্দিরটি অনেকের কাছে টেম্পল অফ ডন নামেও পরিচিত। পাশেই চাও ফ্রায়া নদী। এই মন্দিরে একটি ঘন্টা আছে। অনেকের বিশ্বাস এই ঘন্টাটি বাজালে মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয়। আপনারা চাইলে এটা করতে পারেন।’
আমান ছোয়াকে বলে,
‘তুই কি ট্রাই করে দেখবি?’
ছোয়া সরাসরি জানিয়ে দেয়,
‘না। এসব বিশ্বাস করা মানে শিরক। একটা ঘন্টা বাজালে কখনো মনের ইচ্ছা পূরণ হতে পারে না। আল্লাহর কাছে মোনাজাতে কিছু চাইলে তখন তিনি আমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করে দেন। থাইল্যান্ডের মানুষের এটা বিশ্বাস হতে পারে, তারা এটা মান্য করে, কিন্তু একজন মুসলিম হিসাবে ইমানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কাজ করা আমাদের উচিত নয়।’
ছোয়ার কথা শুনে অভিভূত হয়ে যায় আমান। অতঃপর ট্রাভেল গাইডকে জানিয়ে দেয় তারা এখন এখান থেকে যেতে চায়। ট্রাভেল গাইডকে সাথে নিয়ে দুজনে ফিরে আসার পথে রওনা দেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨
#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ২৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আমানের আজ অফিসে কিছু জরুরি মিটিং ছিল৷ সেই মিটিংগুলো শেষ করে হোটেলে ফিরে কিছু সময় বিশ্রাম। অতঃপর ছোয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল থাইল্যান্ডের পাতায়া শহরের দিকে। ব্যাংকক থেকে ১৫৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর। শহরটি হানিমুন স্পট হিসেবে বেশি পরিচিত। আমানের কোন ইচ্ছা ছিল না সেখানে যাওয়ার। তবে আব্দুল হোসেন আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই পাতায়ার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো দুজনে। ব্যাংকক থেকে ফ্লাইটে করে পাতায়া শহরে নামলো আমান ও ছোয়া।
পাতায়া শহরে পৌছে প্রথমে দু’জনেই তাদের বুক করে রাখা হোটেলে বিশ্রাম করে নিল। অতঃপর বেরিয়ে পড়লো পাতায়া শহরের মূল আকর্ষণ পাতায়া বিচের দিকে।
পাতায়া বিচে এসে অবাক হয়ে গেল ছোয়া। বিচের পরিবেশ কত সুন্দর, কোথাও কোন ময়লার চিহ্ন পর্যন্ত নই। সমুদ্রের পানিও কত পরিস্কার। যা দেখে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। ছোয়া আমানের উদ্দ্যেশ্যে বলেই ফেলে,
‘এখানকার মানুষ কত সচেতন। নিজেদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে যত্ন করে রাখতে জানে। অথচ আমাদের দেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত আমরা কতটা নোংরা করে রাখি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি, আমাদের তো এখানকার মানুষদের থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।’
আমানও সহমত জানিয়ে বলে,
‘তুই একদম ঠিক বলেছিস।’
এসবের মধ্যে ছোয়ার নজর যায় আকাশের দিকে। কিছু মানুষ প্যারাগ্লাইডিং এর মজা নিতে ব্যস্ত। যা দেখে ছোয়ার খুব ভালো লাগে। আমান ছোয়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই কি প্যারাগ্লাইডিং করতে চাস?’
ছোয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে,
‘হ্যা অবশ্যই।’
আমান মুখ ভেঙিয়ে বলে,
‘থাক, তোর সাহস আমার জানা আছে। এসব তোর দ্বারা হবে না।’
ব্যাস, এটাই যথেষ্ট ছিল। ছোয়া ভীষণ অপমানিত বোধ করে এবং বলে ওঠে,
‘আমি প্যারাগ্লাইডিং করবোই। আপনি কি ভেবেছেন আমি ভয় পাই? আমার কত সাহস আজ দেখিয়ে দেব। ছোট থাকতে কতবার গ্রামের মেলায় নাগরদোলায় উঠেছি, আমার সব বান্ধবীরা ভয়ে চিৎকার দিত আর আমি টু শব্দ পর্যন্ত করতাম না। সেখানে এই প্যারাগ্লাইডিং আর এমন কি ব্যাপার।’
আমান ক্রুর হাসি দিয়ে বলল,
‘নাগরদোলায় চড়া আর প্যারাগ্লাইডিং এক কথা নয়। ওয়েল, দেখি তোর দম কত।’
আমান ছোয়ার প্যারাগ্লাইডিং এর সব ব্যবস্থা করে দিল। আমান ছোয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কি করতে হবে। কারণ সে আগেও প্যারাগ্লাইডিং করেছে। আমান বলল,
‘দেখ এটা হলো হারনেস৷ এখানে তুই বসে থেকে বা দাড়িয়ে প্যারাগ্লাইডার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবি। এই রেডিও, ভেরিয়োমিটার এবং জিপিএস নিজের সাথেই রাখ এগুলোর প্রয়োজন পড়বে। আর শোন এই প্যারাগ্লাইডার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য তোকে তোর শরীরের ভর বা ওজন ডানার উপর সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আর এটা হলো স্পিড বার। এটা পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে গতি বাড়াতে পারবি। আর ব্রেক কিভাবে করতে হবে সেটা তো জানিসই।’
ছোয়া মাথা ঝাকিয়ে হ্যা জানাল। এবার পালা তারা প্যারাগ্লাইডিং এর!
৫৩.
সাহস একটি প্রয়োজনীয় গুণ। ভয়কে জয় করার নামই সাহস। সাহস দেখানো ভালো হলেও দুঃসাহস দেখানো ভালো না, বিশেষ করে ভয়ানক কোন ব্যাপারে। এই বিষয়টা এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হয়ে গেছে ছোয়া। সাহস করে প্যারাগ্লাইডিং করতে চলে এসেছিল, এখন তার জীবন যায় যায় অবস্থা। নিচের দিকে তাকাতেই ভয়ে কেপে উঠছে ছোয়া। ভয়ে চিৎকার করে বলছে,
‘আল্লাহ বাচাও আল্লাহ। আমি আর কোনদিন প্যারাগ্লাইডিং করব না, এবারের মতো বাচিয়ে দাও আল্লাহ। ওহ, ওহ, মরে গেলাম। কি উচু।’
ছোয়ার অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেদে বাচি টাইপ। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সে নিচে অবতরণ করল। আমান ছোয়ার দিকে এগিয়ে এসে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো ছোয়াকে। ছোয়ার হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা ভয় পেয়েছে। তবুও আমান মজা নেওয়ার জন্য বলে,
‘কেমন মজা হলো?’
ছোয়া দাতে দাত চেপে বলল,
‘এমন মজা হয়েছে যে জন্মের মতো প্যারাগ্লাইডিং এর শখ মিটে গেছে।’
আমান আর নিজের হাসি আটকে রাখতে পারল না৷ বেশ শব্দ করেই হেসে ফেলল। ছোয়া ভ্রু কুচকে দেখতে লাগল আমানকে।
বিচ থেকে একটু দূরে এসে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করল দুজনে। রেস্টুরেন্টের মেনু কার্ড হাতে নিয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখতে লাগল ছোয়া। কারণ সবকিছু থাই ভাষায় লেখা। যার কারণে ছোয়ার বোধগম্য হচ্ছিল না কিছুই।
আমান একজন ওয়েটারকে ডাক দেয়। অতঃপর তাকে ইংরেজিতে বলে,
‘আমাদের জন্য এক কাপ কফি আর চিকেন সাতায় নিয়ে আসুন।’
খাবার নিয়ে আসার পর দুজনে খেতে শুরু করল। আমানের খাওয়া একটু আগেই শেষ হয়ে গেল। ছোয়ার খাওয়া তখনো হয়নি। আমানের একটি জরুরি ফোনকল আসায় সে একটু বাইরে গেল। যাওয়ার আগে ছোয়াকে বলল,
‘আমি পাশেই আছি৷ তুই এখানেই থাক।’
আমান চলে যাওয়ার পর ছোয়া খেয়াল রেস্টুরেন্ট টিতে তাদের সামনের টেবিলেই কিছু একটার আয়োজন চলছে। ছোয়া ঠিক বুঝতে পারল না। কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পরেই একটি ছেলে এবং মেয়ে এসে বসলো সেই টেবিলে৷ তাদের দেখে মনে হচ্ছে দুজনেই থাই। তারা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলছিল যা ছোয়া বুঝতে পারছিল না। আচমকা ছেলেটি গোলাপের একটি বুকেট হাতে নিয়ে হাটু গেড়ে বসে মেয়েটির সামনে। অতঃপর বলে ওঠে,
‘ছান রাক খু’ন।'(আমি তোমাকে ভালোবাসি)
মেয়েটি কালবিলম্ব না করে লাজুক হেসে ফুলের বুকেটটি হাতে নিয়ে বলল,
‘ছান কে রাক খু’ন।'(আমিও তোমাকে ভালোবাসি)
ছোয়া যদিও কোন অর্থ বুঝল না। তবে এটুকু বুঝল যে, দুজন একে অপরকে নিজের মনের কথা জানিয়েছে থাই ভাষায়৷ ছান রাক খু’ন, শব্দটি বারবার জপ করতে লাগল সে। ততক্ষণে তার খাওয়ায় হয়ে গেছে। আমান এসে বিল পে করে ছোয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো।
৫৪.
সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে অনেক আগেই৷ রজনী ধরা দিয়েছে পাতায়ার আকাশে। আজকে আমাবস্যার রাত। তবে এই আমাবস্যাতেও আলোয় আলোকিত পুরো পাতায়া।
আমান এবং ছোয়া পাশাপাশি হেটে চলেছে পাতায়ার অন্যতম আকর্ষণ ওয়াকিং স্ট্রিট এ। দিনের বেলা নিরব থাকা ওয়াকিং স্ট্রিট রাতে যেন এক অন্য রূপ ধারণ করেছে। বিনোদনের নানা উপকরণ তো রয়েছেই সাথে রঙিন আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছে পুরো এলাকা।
এই সময় মানুষের ভীড়ও চোখে পড়ার মতো। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। সবাই হয়তো রঙিন রাত উপভোগ করতেই বেরিয়ে এসেছে এই চন্দ্রহীন রজনীতে।
আমান ছোয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন সে এই অচেনা যায়গায় হারিয়ে না যায়। আমানের হাতে হাত রেখে ওয়াকিং স্ট্রিট হেটে বেড়াচ্ছে ছোয়া। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতির মিশেল।
ভালো এবং খারাপ দুটোই যেন একে অপরের পরিপূরক। তাই তো, প্রবাদ আছে সুখের পরেই দুঃখ আবার দুঃখের পরেই সুখ।
ওয়াকিং স্ট্রিটে আচমকা জটলা পেকে গেল। কোথা থেকে যেন একটা গুজব রটে গেল যে ওয়াকিং স্ট্রিটে বো’মা লাগানো আছে। ব্যাস, ভয়ে সব মানুষ উন্মাদের মতো দৌড়াতে লাগল। আমান ছোয়ার হাতটা আরো শক্ত করে ধরল, যাতে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে না যায়। কিন্তু অনেক ভীড় এবং ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দুজনে আলাদা হয়ে গেল। ছোয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। ফোন বের করে দেখল ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এত মানুষের ভীড়ে আমানকে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না।
আমানও ছোয়াকে খুজে না পেয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ছোয়াকে ফোন করলে নট রিচেবল বলছে। পরিস্থিতি যখন এমন তখন দুজনেই পাগলের মতো একে অপরকে খুজে বেড়াতে লাগল।
দূরত্ব বোধহয় আমাদের ভালোবাসার মূল্যটা আরো বেশি বুঝিয়ে দেয়। ঠিক যেমন এখন হচ্ছে ছোয়া ও আমানের সাথে। আমান ভাবছে একবার যদি ছোয়াকে খুজে পায় আর নিজের থেকে দূরে যেতে দেবে না। শক্ত করে ধরে রাখবে। অন্যদিকে ছোয়া ভাবছে, এবার আমানকে দেখা পেলে সবসময় তার সাথেই থাকবে।
একটানা পনেরো মিনিট এভাবেই একে অপরকে খুজতে লাগল দুজনে। অবশেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। সবাই জানতে পারে বো’মার ব্যাপারটা গুজব ছিল। জটলা কমে এবং আমান ও ছোয়া একে অপরের দেখা পায়। দুজনের চোখাচোখি হয়৷ ছোয়া আমানকে দেখামাত্রই কাদতে কাদতে দৌড়ে ছুটে আসে তার দিকে। আমানের কাছে এসে ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। জোরে চিৎকার করে বলে,
‘ছান রাক খু’ন।’
আমান বাক্যটির মানে না বুঝলেও আশেপাশে থাকা থাইল্যান্ডের অনেক মানুষই বুঝতে পারে। তারা সবাই হাততালি দিয়ে তাদের দুজনকে চিয়ার আপ করে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨