#প্রেমের_সমর
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
বিয়ের রাতেই যে বর বউকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল সে স্বামীকেই আজ চারবছর পর প্রথমবারের মতো নিজের সামনে দেখে থমকায় সুহা। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখে ছেলেটার সাঁজ-পোশাক।সুহা আগেও দেখেছে এই মানুষটাকে তবে শুধু ছবিতেই! এমনকি বিয়ের দিনেও সে তার স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি লজ্জায়। আজ তাকাচ্ছে। পরণে ব্লেজার, তাও ব্লেজারের ভেতরে শার্টের খোলা অংশটুকুতে উঁকি দিচ্ছে ফর্সা লোমবিহীন বুক। চেহারার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল এই ছেলের জন্য এত মেয়ে পাগল হওয়ার কারণ! শুধু চেহারাই কি পাগল হওয়ার কারণ? এই ছেলের গলা আর কথাগুলো ও তো দারুণ ছিল। যে কন্ঠের সাথে তার বহুদিন আগে পরিচয় হয়েছিল। যে কন্ঠ আর কন্ঠ দ্বারা বলা কথা গুলো তাকে কাবু করেছিল বহুদিন আগে। আর তার দরুণই তো প্রথমে বিয়েটা নাকোচ করলেও পরবর্তীতে সুহা রাজি হয়েছিল বিয়েটা করতে। কিন্তু কে জানত তাকে দুর্বল করাটাও যে এই ছেলের একটা টোপ ছিল কেবল? সুহা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। স্বচ্ছর চোখজোড়ায় তাকিয়ে বোধহয় সুহাও এই মুহুর্তে পাগল পাগল অনুভূতিটা টের পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে?সে তো এই মানুষটার জন্য ঘৃণা জমিয়েছিল।অথচ এতকাল এই পাড়ার মেয়েদের কাছে আর স্বচ্ছর কাজিনদের কাছে এই ছেলের রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে এতোটাই অভ্যস্ত ছিল যে আজ নিজেও মনে মনে এই ছেলের রূপ দেখে বাহ বাহ দিল! কিন্তু মনের ঘৃণা টুকু তো মুঁছে ফেলবার নয়।তাই তো এতকাল পর স্বামীকে কাছে থেকে দেখেও একপ্রকার এড়িয়েই চলে যেতে লাগল সে। অথচ পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে না যেতেই দেখতে পেল সুন্দরী এক মেয়েকেও।সাথে দুইজন ছেলেও । মেয়েটা স্বচ্ছের হাত জড়িয়েই এক প্রকার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠল,
“ স্বচ্ছ?মনে হচ্ছে তোর বাবা মা আজ বাসায় নেই। আমরা বরং আজকের দিনটা তোর ফ্ল্যাটেই কাঁটাতে পারি। বল?”
সুহা নিরবে মেয়েটার হাত ধরা দেখল। গা জ্বলে উঠল যেন। নিজে গিয়ে মেয়েটার গালে চড় বসাতে মন চাইল। অথচ পারল না। স্বচ্ছ ততক্ষনে তাকাল মেয়েটার দিকে। হাত ছাড়িয়ে বিরক্ত সুরে বলল,
“ ফ্ল্যাটে কাঁটালে আমি কষ্ট করে নিজের বাসায় আসলাম কেন? বাসায় এসেছি যখন বাসাতেই থাকব। ঐ মেয়েকে শায়েস্তা করতে তো হবেই আমার! ”
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“ কে? তোর ক্ষ্যাত বউটা? যদি এতদিন পর হাজব্যান্ডকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে তোকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে দোস্ত? তুই কি করবি তখন? ”
সুহার মেজাজ চিরচির করল। সে ক্ষ্যাত? তাকে ক্ষ্যাত বলল এই মেয়ে? সুহা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শুনল কেবল। সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে যেতে স্বচ্ছ বলল,
“ গর্দভ! তোকে এনেছি কি করতে তাহলে? ”
সুহা বুঝল, স্বচ্ছ কথাটা ঐ মেয়েটাকেই বলেছে এবং কেন এনেছে তাও বুঝল। তবে নিজ স্বামীর সাথে এহেন সুন্দরী নারীর কথোপকোতন তার সহ্য হলো না। রাগে নাক ফুলে উঠল। আরেকবার, আরেকবার তাকিয়ে দেখল মেয়েটাকে। ইচ্ছে হলো ঘাড় মটকে দিতে। অথচ কিছুই করল না ও। সুন্দর ভাবে নজর সরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে লাগল। আর ঠিক তখনই স্বচ্ছ তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“ এই যে মিস? শুনছেন? এই বাসায় কেউ নেই আজ? তালা দেওয়া কেন বলতে পারেন?”
সুহার রাগে দাঁত কিড়মিড় করছিল। একটু হলেই যেন স্বচ্ছকে সে রাগে ঝলসে দেবে সে। অথচ সুহা সে রাগের ছিটেফোঁটাও প্রকাশ না করে শান্ত হয়ে দাঁড়াল। ভ্রু কঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বচ্ছর দিকে তাকাল। তাকাল পাশের ছেলেমেয়ে গুলোর দিকেও। পরমুহুর্তেই টানটান স্বরে উত্তর দিল,
“ না, এই বাসার পুত্রবধূকে আজ দেখতে আসছে তো ছেলেপক্ষ। তাই সবাই রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। ওখানেই দেখাদেখি হবে। বুঝেনই তো, আশপাশে পাড়াপ্রতিবেশী যদি পাত্রপক্ষের কান ভাঙ্গায় সে কারণেই.. ”
স্বচ্ছর টনক নড়ল। পুত্রবধূ?তার নিজেরই বউ? এই কারণেই মেয়েটা তাকে শেষ দুই সপ্তাহ জ্বালাচ্ছে কল করে করে?ডিভোর্সের হুশিয়ারি দিচ্ছিল? স্বচ্ছ বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ এই বাসার পুত্রবধূ মানে? কোন পুত্রবধূ?”
সুহা উত্তর দিল,
“ একটাই তো পুত্রবধূ এই বাসার। জানেন না? ছেলে তো একটা অকর্মা! তাই ছেলের বাবা মা ভাবল ছেলের বউয়ের নতুন করে আরেকটা বিয়ে দিক। ”
স্বচ্ছর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটাও বিস্ময় নিয়ে বলল,
” কত বড় সাহস মেয়েটার দেখেছিস? কত বড় সাহস! আমার এত সুন্দর বন্ধুকে ভুলে ওই মেয়ে নতুন সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখছে?ছলনাময়ী!”
স্বচ্ছর অপর বন্ধু স্বচ্ছর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াল। চাপা হেসে বলল,
“ বন্ধু? পাখি তো ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে ! এই তোর বউয়ের ভালোবাসা? আমরা ভাবলাম তোর বউ তোকে ভালোবেসে গলায় ঝুলে পড়বে আর এখন দেখি বউ নিজেই তোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত!”
স্বচ্ছ বন্ধুদের সামনে এহেন অপমান মেনে নিতে পারল না। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠল,
” মেরে গাল লাল করে দিব ঐ মেয়ের। আমায় না জানিয়ে বিয়ে করার শখই বা জাগল কি করে ঐ মেয়ের? ভাগ্যিস! এতকাল কোন এক গোপন গুপ্তচরের কাছে বউয়ের এসব অবাধ্যকতার খবর পেতাম। এখন তো দেখছি সত্যিই মেয়েটা অবাধ্য হয়ে গেছে। ”
সুহা মনে মনে হাসে। গোপণ গুপ্তচরটাও যে সে নিজেই এটা ভেবে পেট ফেটে হাসি পায়। অথচ সামনাসামনি হাসে না। কৌতুহল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ আপনার বউ নাকি ভাই? বাধ্যগত বউ ছিল আপনার?”
“ বাধ্যগত বউ ছিল না, তবে আমার জন্য পাগল ছিল ঐ মেয়ে। এক ঘন্টা কথা না হলেও পাগল পাগল ব্যবহার করত! ”
সত্যিই তো! সুহা পাগল পাগল আচরণ করত৷ বিয়ের আগে একটা মাস সময় দিয়েছিল কেবল স্বচ্ছ। আর তাতেই সুহা গলে জল হয়ে গিয়েছিল। নতুন নতুন প্রেমে পড়ে সে কি পাগলামি। অথচ দুঃখের বিষয় হলো তাদের সরাসরি একটাবারও দেখা হয়নি। প্রথমে তো সুহাই বিয়েটা নাকোচ করে ছেলের মুখ দেখতে চায়নি। পরবর্তীতে স্বচ্ছ ইগো নিয়ে মেয়েকে দেখেনি। শুধু একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল যে মেয়েকে সে তার প্রেমে পাগল করে ছাড়বেই! অবশেষে পাগল করেছিলও। বিয়েও করল। তারপর সে নিজেই ছেড়ে দিয়ে বদলা নিল মেয়েটার উপর। সুহা ভেবে দুঃখ পেল। কঠিন স্বরে বলল,
“ কি করে বুঝলেন যে পাগল ছিল? ”
স্বচ্ছ হেসে উত্তর দিল,
“ কারণ আমি পাগল বানিয়েছিলাম তাকে। এখন বলুন, আমার বাসার সবাই কোথায় তা জানেন? জানলে ফটাফট বলুন। ”
সুহার মেজাজ খারাপ। তার উপর স্বচ্ছর এহেন প্রশ্ন পছন্দ হলো না। রূঢ় স্বরে বলল,
“ এই বাসায় কে কখন থাকবে তা জানার দায়িত্ব নিশ্চয় আমি নিয়ে রাখিনি বলুন?বাসায় কেউ আছে নাকি নেই না জেনে কোথায় থেকে টপকে এসেছেন? এসেছেনই যখন আগে থেকে বলে আসেননি কেন?দ্বিতীয় কথা, কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলে সুন্দরভাবে জিজ্ঞেস করবেন।”
এমন উত্তর পেয়ে স্বচ্ছর মুখটা বোধহয় চুপসে গেল। সুহার দিকে চেয়ে সরু চোখে চাইল এবারে। মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না তার। মনে মনে ভেবেই নিল যে হয়তো বাসার ভাড়াটিয়া হবে এই মেয়েটা।এবারে সুন্দর ভাবেই বলল,
“ আমি এই বাসার মালিকের ছেলে। আপনি কি জানেন উনারা কোথায় গেছেন? ”
সুহা আগের মতোই মেজাজ খারাপ দেখিয়ে বলল,
“ বাসার মালিকের ছেলে বললে কি আমি আপনাকে আলাদা সম্মান করব ভাবছেন? ”
স্বচ্ছ ভদ্রতা দেখিয়েও যখন ভদ্র উত্তর না পেল তখনই বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
“ না করলে আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিব বেয়াদব মেয়ে। ”
সুহা ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলল,
“বের করে দিবেন? বাবাহ! ভয় পেলাম আমি। ”
স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ কি মনে হচ্ছে? বের করতে পারব না আপনাকে? ”
” আপনি বের করে দিলেই বা আমি বের হয়ে যাব কেন? টাকা দিয়ে আছি। এমনি এমনি তো আর থাকছি না ভাই। আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিন!”
কথাগুলো বলেই মুখ কেমন করে নিচে নেমে গেল সুহা। স্বচ্ছ আর ওর বন্ধুরা চেয়ে থাকল কেবল বোকার মতো। স্বচ্ছ তো বিড়বিড় করে বলল,
“ এই মেয়ে নির্ঘাত আমার বউয়ের থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেয়াদব! ”
স্বচ্ছর পাশের বন্ধুটা তখন হেসে বলল,
”কিন্তু মেয়েটা সুন্দর দোস্ত! প্রোপোজ করলে দোষ হবে না নিশ্চয়? ”
ছেলেটা কথাটা বলার পরপরই স্বচ্ছর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা এবারে বলে উঠল,
” কাকে প্রোপোজ করবি? ঐ মেয়েরে?”
“ সমস্যা কি করলে? তোরে তো আর তোর আব্বায় আমার সাথে বিয়ে টিয়ে দিবে না তাই না? তার চেয়ে অন্য একটা জুটিয়ে নেওয়াই ভালো। ”
উত্তরটুকু দিয়ে ও ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মেয়েটার দিকে। মেয়েটা নিধি। বাকি দুইজন ছেলে হলো আবির আর সাদাফ। তিনজনই স্বচ্ছর বন্ধু। স্বচ্ছ কেমন করে তাকাতেই নিধি ক্ষেপে তাকাল সাদাফের দিকে। বলল,
“ আবার বল! ”
সাদাফ এই পর্যায়ে বিড়বিড় করেই বলল,
“ কিছু না, চল স্বচ্ছর বউকেই খুঁজি আপাতত। ”
স্বচ্ছ হতাশ। সে এসেছিল মেয়েটাকে শায়েস্তা করতে। আবার ও নিজের প্রেমে হাবুডাবু খাইয়ে মেয়েটাকে গোল দিতে। অথচ এখানে এসেই শুনছে মেয়ে ফুরুৎ হয়ে যাচ্ছে তার খাঁচা থেকে। স্বচ্ছ ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলেই একটা নাম্বারে ম্যাসেজ করল। পরপরই ওই নাম্বার থেকে কল এল। স্বচ্ছও কল তুলল। ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ভেসে এল,
“ এটা কি আপনার বাংলাদেশী সিম নাকি মিস্টার অস্বচ্ছ?যায় হোক, আমার টানে অবশেষে দেশে এসে পড়লেন দেখে খুশি হলাম।বিয়েতেও এবাবে চলে আসবেন হুহ? ”
স্বচ্ছর চাপা রাগ হলো। কেন জানি না মেয়েটাকে এখন কষে থাপ্পড় দিতে পারলে শান্তি লাগত তার।তবুও টানটান স্বরে শীতল রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,
“ স্বচ্ছর দিকে সব মেয়েই আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে সুহাসিনী!অনাগ্রহ দেখানোর সাহস দেখায়নি এই পর্যন্ত কেউ। সে জায়গায় তুমি আমার বউ হয়ে আমায় ছেড়ে অন্য কাউতে ঝুঁকবে?আমার এই অপমান আমি চুপচাপ মেনে নিব ভাবলে কি করে সুহাসিনী? ”
সুহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠে,
“ খু্ব অহংকার না নিজের সৌন্দর্যের? আমি কিন্তু আগেও আপনার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়িনি অস্বচ্ছ সাহেব!আপনার কন্ঠের আর কথার প্রেমে পরেছিলাম। ”
স্বচ্ছ বাঁকা হেসে শুধায়,
“ এবারে সৌন্দর্যের প্রেমেও পরবে। আপাদমস্ত সবকিছুরই প্রেমে পড়বে।এমনভাবে প্রেমে পরবে যে আমায় ছাড়া আর কিছুই বুঝবে না সুহাসিনী। ”
সুহা হাসে। উত্তরে বলে,
“ সুহা নিজের অপমানের শোধ নিজে নিতে পারে মিস্টার অস্বচ্ছ! সৌন্দর্য দেখেই গলে যাব, অতোটাও হ্যাংলা ভাববেন না আমাকে। তাহলে দেখবেন নিজের জালে নিজেই ফেঁসে যাবেন। ”
চলবে……..…