প্রেমের সমর পর্ব-২৭+২৮+২৯+৩০

0
1

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_২৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আশপাশে ঝুম বৃষ্টি বইছে। স্বচ্ছ তখন বেলকনিতে বসা। ঠান্ডা পড়ছে। আবহাওয়া শীতল। অথচ স্বচ্ছর মনের ভেতর তখন উষ্ণ আবহাওয়া। রাগে নাকমুখ লাল ঠেকছে তার। বাম হাতটা মুঠো করা। অপর হাতে সিগারেট ফুকছে ইচ্ছে মতো৷ স্বচ্ছ বিরক্ত হয়।রাগে বেলকনির দেয়ালে দুয়েকবার ঘুষি বসাতেই হাত গড়িয়ে ঝড়ল লালচে রক্ত৷ সুহা ততক্ষনে ছুটে এসে আওয়াজ শুনে। এই নিয়ে স্বচ্ছ কম হলেও পনেরোটার উপর সিগারেট শেষ করেছে। সুহা কিছু বলেনি রাগে। শুধু দেখে গেছে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে সত্যিই তার রাগ হলো। স্বচ্ছর রক্তাক্ত হাতটাকে আগলে নিয়ে দ্রুত বলল,

“ দুদিন আগেও অসুস্থ ছিলেন স্বচ্ছ। একটা মেজর অপারেশন হয়েছে আপনার। মাসখানেক ও তো হলো না। তার উপর এমন করছেন কেন হুহ? ”

স্বচ্ছ হাতটা একঝাড়ায় ছাড়িয়ে নেয়।হাতটা থেতলে আছে। রক্ত ঝরছে। স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চিবিয়েই বলে,

“ তা জানার তোমার প্রয়োজন নেই সুহাসিনী! দয়া দেখিও না। দয়া দেখাতে বলিনি আমি। ”

সুহার এই পর্যায়ে কান্না আসে কেবল। গলায় জমে থাকে কান্নারা। ঢোক গিলে নরম গলায় বলে,

“ এমনটা কেন করছেন স্বচ্ছ? শরীরের ক্ষতি হবে তো। কয়েকদিন আগে ও তো অসুস্থ ছিলেন। বুঝার চেষ্টা করুন। ”

স্বচ্ছ ক্রুর হাসে। বলে,

“ ইচ্ছে হচ্ছে তাই। আমার এখন মনে হচ্ছে সেদিন মারা যাওয়াটাই সবচাইতে বেটার অপশন ছিল।তার চেয়েও ভয়ংকর ঠেকে এই ভেবে যে, একটা মানুষ কি করে মৃত্যুর সাথে লড়ে যাওয়া মানুষের সাথে মিথ্যে বলতে পারে? কি করে?”

সুহা মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,

“ আমি? ”

স্বচ্ছ বিড়বিড় স্বরে আওড়ায়,

“ ছলনাময়ী!

সুহার চোখে মুখে বিস্ময়। মুহুর্তেই শুধায়,

“ আমি? ”

স্বচ্ছ হাসে। বা হাতে পড়ে থাকা সুহার দেওয়া সে ঘড়িটা খুলতে লাগে সময় নিয়ে। পরমুহুর্তে আচমকায় সুহার সামনে তা ছুড়ে মারল ফ্লোরে। অবহেলা নিয়ে বলে,

“ তোমার ঘড়িটা এতদিন আগলে রেখেছিলাম অমূল্য সম্পদের মতো করে। ইভেন আজ সকালেও! এখন মনে হচ্ছে আমি সত্যিই ভুল মানুষের ভুল জিনিস আগলে রেখেছিলাম। তাই ফেলে দিলাম।”

সুহা যেন বিশ্বাস করতে পারল না।একটা মানুষ হুট করেই কিভাবে এতোটা বদলে যায়?কিভাবে?এই যে এতদিন এত পাগলামো দেখালো? জ্বালাতন করল? সব মিথ্যে?সুহা বলে,

“ আজকে সকালেও তো পাগলামি দেখাচ্ছিলেন স্বচ্ছ। ভালোবাসা দেখাচ্ছিলেন। এক মুহুর্তেই এখন আমি ভুল মানুষ হয়ে গেলাম? ”

স্বচ্ছ তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

“ সঠিক মানুষ তাহলে? ”

সুহা তখন চোখ টলমল। কান্না গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। মুহুর্তেই উত্তর দেয়,

“ দাদাজান ঠিকই বলে স্বচ্ছ। আপনি আসলেই আমায় সারাজীবন কেবল কষ্টই দিবেন। আপনার সাথে থাকলে আমি কেবল কষ্টই পাব স্বচ্ছ। ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই রাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে যেন। রোহানের কথাটাই সুহা বলল। কেন? কেন স্বচ্ছ ভালো রাখতে পারবে না? স্বচ্ছ মুহুর্তেই বলে,

“ তো কে কষ্ট না দিয়ে কেবল সুখ দিবে? ঐ রোহান? তোমার দাদাজান এর পছন্দের পাত্র? ”

সুহা চুপ থাকে। চোখের পানি মুঁছে জানতে চায়,

“আমি তিহানের কাজিনটার সাথে কথা বলছিলাম এই কারণেই এত রাগ আপনার? আমাকে এক্সপ্লেইন করার সময়টা দিন প্লিজ। আমি বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। ”

স্বচ্ছ সুহার ঠোঁটে আঙ্গুল রাখে। গম্ভীর স্বরে বলে,

“ প্রয়োজন নেই সুহাসিনী। তুমি কি ভেবেছো? তুমি আর তোমার দাদাজান যে ষড়যন্ত্র করছো আমি জানি না? ঐ রোহানের ফেমিলির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ তোমার দাদাজানের জানি না? বিজন্যাস ও তো একসাথে তোমাদের। তাই তোমার দাদাজান চাইছেন অবশ্যই অবশ্যই ঐ পরিবারের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে। তাই তো? খবর অবশয আমি খুব আগেই পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আর এখন তো সব জলের মতোই পরিষ্কার। ”

সুহা কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম তার স্বচ্ছকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। এই রেগে যাওয়া স্বচ্ছকে শান্ত করতে ইচ্ছে করছে। ভালোবাসায় আগলে নিতে ইচ্ছে হচ্ছ৷। তবুও সে শক্ত স্বরে বলল,

“ ভুল ভাবছেন স্বচ্ছ। আমাকে বলার সুযোগটা দিন।

স্বচ্ছ হাসে৷ সুহাকে পাত্তা না দিয়ে রুমে চলে যেতে যেতে বলে যায়,

“ কি শুনব? দয়া দেখাচ্ছো তা? নাকি আবার একগাঁধা মিথ্যে? ”

কথাটা বলে চলে যেতে নিয়েও স্বচ্ছ ফের ফিরে আসে। বলে,

“ আমি তোমায় বিচ্ছেদ দিব না সুহাসিনী৷ তোমায় অন্য কারোরও হতে দিব না। তবে এই অভিযোগ আমার সবসময় থাকবে যে তুমি আমায় ঠকিয়েছো। ঠকিয়েছো তুমি আমায়।এক্সিডেন্টের কারণে আমি তিন মাস ভ্যাকেশনে আছি৷কিন্তু আমার মন চাচ্ছে আমি এখনই চলে যাই। বিরক্ত লাগছে এই দেশটা।অথচ আমি কি বোকা সুহাসিনী? নিজের ক্যারিয়ারে শূণ্যে ডুবানোর চিন্তা করে ভেবেছিলাম তোমার জন্য এখানে থেকেই সুখে সংসার করব। ”

স্বচ্ছর কথা গুলো সুহার বুকে লাগে যেন। হালকা হেসে শুধায়

“ চলে তো যাবেনই। স্কলারশিপে পড়তে গিয়েছেন ওখানে৷ এতবছর কষ্ট করে শেষের দিকে এসে দেশে বসে থেকে নিশ্চয় নিজের লস করবেন না তাই না? ”

স্বচ্ছ যেতে যেতে উত্তর করল,

“ অথচ তুমি চাইলে আমি আমার সবটা বিসর্জন দিতাম সুহাসিনী! ”

সুহা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আশ্চর্য! কি থেকে কি হয়ে গেল না? সুহা তো কিছুই করল না। মাঝখান দিয়ে স্বচ্ছ তাকে ভুল বুঝছে। কি দোষ ছিল তার? কিই বা করল সে?

.

তখন ইউকে তে সন্ধ্যে।বাইরে তুষারপাত হচ্ছে অবিরাম।আবির সদ্য বাসায় ফিরেছে। তারপর ঘন্টাখানেক শাওয়ার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে সর্বপ্রথম কফি বানাল। মগটা হাতে নিয়ে পরমুহুর্তে ফোন হাতে নিল। ছুটির আইডিটা বরাবরের মতো ঘুরপাক খেল। কিন্তু আপসোসের বিষয় ছুটি এখন আর ওকে ম্যাসেজ দেয় না। এখন আর আগের মতো বিরক্ত করে না। ম্যাসেজের পাহাড় করে রাখে না। আবিরের বিরক্ত লাগে। কেন ম্যাসেজ দেয় না? কেন কথা বলে না? একটাবার তো পারে তার খোঁজ নিতে। আবির অবশ্য ছুটির খোঁজ নেয় আগের মতোই। সরাসরি ম্যাসেজ না করলেও স্বচ্ছর কাজিন তিহান আর সিয়ার থেকেই ইনিয়েবিনিয়ে খোঁজ নেয় ছুটির ব্যাপারে। যেহেতু ছুটি স্বচ্ছদের বিল্ডিংয়েই থাকে।আবির আগেও এমন করত৷ সরাসরি নিজের দুর্বলতাটা সে কখনোই ছুটির কাছে প্রকাশ করেনি। উল্টে আগে কাজিনদের দিয়ে খোঁজ খবর নিত। আবির হালকা হাসে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ তুই আস্ত এক যন্ত্রনা ছুটি! যখন জ্বালাস তখনও বুক চিনচিন করে, আবার যখন জ্বালানো কমিয়ে দিলি তখনও আমার অস্থির অস্থির লাগে। আমাকে এত যন্ত্রনা দিয়ে কোন লাভটা হচ্ছে তোর? শুধু তোকে আমার করে পাই ছুটি,শুধু পাই।প্রমিজ, তোকে শুধে আসলে সবটা ফেরত দিব দেখে নিস। ”

কথাটা বলেই সে কল দিল তিহানকে। কল রিসিভড হতেই আরাম করে বলে উঠল,

“ কি ছোট ভাই? কেমন আছো? ”

ওপাশ থেকে তিহান সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল,

“ আমি কেমন আছি জানতে কল দিয়েছেন নাকি ছুটি আপু কেমন আছে জানতে কল দিয়েছেন ভাই? ”

আবির এবারে হাসে। ঠোঁট চওড়া করে শুধায়,

” ঐ যে তোমার কলেজ ফ্রেন্ড ফিহা? ও কিন্তু কাজিন হয় আমার। ভেবে দেখো, একটু খোঁজ খবর দিলে কিন্তু তোমার ফিউচারের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ”

তিহান এই পর্যায়ে হাসে। হেসে উত্তর করে,

“ ছুটি আপু নাকি পরের মাসে বাসা চেঞ্জ করবে ভাইয়া। শুনেছেন? ”

আবির আপসোস করে বলে,

“ কিভাবে শুনব, কথা হয় না তো। ”

“কথা বলেন না কেন? ঝগড়া তো নেই আপনাদের। ”

আবির হেসে উত্তর করে,

“ আমাদের আসলে আর দশটা কাপলের মতো প্রেম নেই ছোটভাই। কিন্তু আমরা জানি, আমরা দুইজনই দুইজনকে ভালোবাসি। কথা না হলেও ভালোবাসি। ”

তিহান তখন ব্যঙ্গ স্বরে বলে উঠে,

” হু, কথা না বলতে বলতে, যোগাযোগ না করতে করতে কোনদিন দেখবেন ছুটি আপুর বিয়ে হয়ে যাবে। ”

আবির তখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর করে,

“তোমার ছুটি আপুকে কিছু না বলা সত্ত্বেও এতকাল অপেক্ষা করেছে আমার জন্য। আর এবার তো আসার সময় সরাসরিই বলে এলাম।আশা করি,আমায় ঠকানোর সাহস তার হবে না তিহান। ”

.

তখন গভীর রাত। ছুটি নিশাচর প্রাণির ন্যায় অনলাইনে থেকে সময় কাঁটাচ্ছিল। কারণ ঘুম আসে না আজকাল আর তার। আবির ভাইয়ের বিরহে সূক্ষ্ম এক যন্ত্রনা বুকে বয়ে নিয়ে সব কাজ করলেও ঘুমটা ঠিক নিজ থেকে আসতে চায় না যেন। ছুটি এই নিয়ে অনেকদিন ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। ছুটি দীর্ঘশ্বাস টানে। আজও ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করতে নিতেই হুট করে হোয়াটসএ্যাপে কল এল। মানুষ আবির ভাই। ছুটি বিস্ময় নিয়ে তাকায়। আশ্চর্য! এত রাতে? এত রাতে আবির ভাই? যে মানুষটা অন্য দেশে গিয়ে এতদিনে একটা কল অব্দি করল না, সিঙ্গেল ম্যাসেজ অব্দি দিল না, খোঁজ নিল না সে মানুষটা আজ কি বুঝে কল দিল? ছুটি কল তুলল। কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আবির বলে উঠল,

“ দিনরাত অনলাইনে পরে থাকিস কেন? কাজ নেই তোর ? ”

ছুটি চুপ থাকে। প্রথমেই কেমন আছে, কি অবস্থা কিছু জিজ্ঞেস না করে এই উত্তরটা পেয়ে হতাশ হয়। শান্ত স্বরে বলে,

“ এরপর থেকে আর থাকব না অনলাইনে। ”

“ থাকবি না মানে?

ছুটি ছোটশ্বাস টানে। উপেক্ষা করে বলে,

“ কিছু না। আপনার কথা বলুন? কেমন আছেন? হঠাৎ কি মনে করে নক করলেন? কোন প্রয়োজন?

আবির রেগে শুধায়,

“ এমন ভাবে বলছিস যেন তুই প্রয়োজনের ভান্ডার আর আমি প্রতিবার প্রয়োজন পড়লেই তোকে নক করি। ”

ছুটি হাসে তখন। উত্তরে বলে,

“ সচারচর তো আপনাকে নক করতে দেখি না আবির ভাই। করলেও তার পেছনে অবশ্য অবশ্যই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। তো এখন কোন স্বার্থে নক দিয়েছেন যদি সরাসরিই বলে দিতেন আমার সুবিধা হতো। ”

“ ইনডিরেক্টলি তুই এটা বুঝাতে চাইছিস যে আমি তোকে নক দিলে অবশ্যই কোন না কোন স্বার্থ পূরণের জন্যই দিই তাই তো? ”

ছুটি ঠোঁট এলিয়ে হাসে। গলা শক্ত করে বলে উঠে,

” ডিরেক্টলিই বলছি। আসলে বোকা মানুষ তো আমি। তাই বুঝে উঠি না কে কোন স্বার্থে আমায় ইউজ করছে। ”

আবির বিস্মিত হয়। ছুটি বলছে এসব? সে ছুটিকে ইউজ করেছে? আবির তৎক্ষনাৎ ধকম স্বরে বলে উঠে,

“ তোকে আমি ইউজ করেছি? ”

ছুটি অবহেলা নিয়ে উত্তর দেয়,

” সেটা তো আপনি ভালো জানেন আবির ভাই। যায় হোক বাদ দিন, ভালো আছেন? ”

আবির দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেল যেন। হজম হয়ে উঠল না ছুটির ধারালো জবাব। মনে হয় ছুটি বদলে গেছে। সত্যিই তো। আগের ছুটি তো এভাবে কথা বলত না। এভাবে কথা শোনাত না। আগের ছুটি ছিল বোকা। আগের ছুটি ছিল সহজ সরল। আবির অবিশ্বাস্য স্বরে ডাক দেয়,

“ ছুটি? ”

এবারেও দৃঢ় স্বরে উত্তর আসে ,

“ বলুন। ”

আবির কিছুটা সময় চুপ থেকে ভাবে। শুরু থেকে ভাবে৷ সে কি ছুটিকে বেশি কষ্ট দিয়েছে? বেশি অবহেলা করেছে? শুধায়,

“ আমি কি তোকে কোন কারণে কষ্ট দিয়েছি? আমার কেন মনে হচ্ছে তুই পাল্টে গেছিস? ”

ছুটি হেসে বলে,

“ পাল্টাইনি, হয়তো আপনার মনের ভুল। ”

আবির দৃঢ়তার সঙ্গে এবারে উত্তর করে,

“ আমি তোকে খুব ভালো করে চিনতাম ছুটি। তুই বদলেছিস তা আমার চাইতে
ভালো কেউ জানবে না। ”

ছুটির চোখ তখন টলমল করে এপাশে। বুকে গহীন ব্যাথা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস টেনে উত্তর করে,

“ এটা আপনার মনে হচ্ছে। কারণ আগে বেহায়াপনা দেখাতাম। এখন তো দেখাচ্ছি না তাই। ”

কথাটা বলেই ছুটি মুখের উপর কল রেখে দিল। আবির অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে চেয়ে থাকে। এই প্রথম সে টের পায় তার ছুটি তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে!

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_২৮
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

একটু আগেই গোসল সেরে বের হয়েছে স্বচ্ছ। পরনে তখন শুভ্রা রঙা টিশার্টরআর টাউজার। চুলগুলো বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অল্পবিস্তর পানি। স্বচ্ছ একহাতে চুৱগুলোতে ঝাড়া দেয়। ভেজা তোয়ালেটা খাটের এককোণায় ছুড়ে মেরে বেলকনিতে যেতেই নিতেই রুমে এল সুহা। হাতে তার গরম কফির মগ। সুহা হাত বাড়ায়৷ কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ আন্টি পাঠাল। আপনার জন্য৷ ”

স্বচ্ছ কেমন করে যেন তাকায় সুহার মুখে আন্টি ডাক শুনে। বলে,

“ দুদিন পর ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছো না মনে মনে? এইজন্যই তো বিয়ের চারবছরেও আমার আব্বু আম্মুকে তুমি আঙ্কেল আন্টি ডাকো। ”

সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। কফির মগটা স্বচ্ছর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ চারবছরে তো জানা ছিল না আপনার সাথে আমার আদৌ সংসার হবে কিনা! চারবছর ধরে তো জানতামই না আপনি ফিরবেন কিনা, ফিরলেও আদৌ বউ হিসেবে মেনে নিবেন কিনা। তবুও উনারা আমায় যথেষ্ট স্নেহ করতের স্বচ্ছ। আপনার কাজের জন্যই বোধহয় কখনো আমায় আম্মু আব্বু ডাকার অনুরোধ করেনি। আমিও ডাকিনি। চারবছর যাবৎ আঙ্কেল আন্টি ডেকে এসেছি তাই এখনও অভ্যেসটা পাল্টাচ্ছে না। কিন্তু আপনি আপনার আম্মুকে জিজ্ঞেস করে আসুন? আমি সত্যিই উনাকে আম্মু ডাকি এখন। মাঝেমাঝে আন্টিও ডাকি। ”

স্বচ্ছ হাসে এবারে। তাকিয়ে দেখে সুহাকে। সুহার চুলও ভেজা দেখাচ্ছে। বোধহয় চুল শুকোয়নি। মুখটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। স্বচ্ছ কফির মগে চুমুক বসায়। বলে,

” ডেকে লাভটা কি হবে?যাকে আম্মু ডাকছো তার ছেলেকে তো জীবনে রাখার পরিকল্পনা নেই তোমার। অন্য কাউকে রাখতে চাইছো! অন্য কাউকে মনে জায়গা দেওয়ার সুযোগ খুঁজছো।”

ফের একই অভিযোগ! রোহানের সাথে ছাদের কথা বলার মুহুর্তটার পর থেকেই স্বচ্ছ আবোল তাবোল বকছে। সুহার প্রথমে রাগ হলেও পরমুহুর্তে যখন বুঝতে পারে স্বচ্ছ তার চেয়ে দ্বিগুণ রেগে আছে এবং পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ পর্যায়ে আছে তখনই তার রাগ নিভে যায়। উল্টে স্বচ্ছকে বুঝাতে সুযোগ খুুজল যে সে কেবল স্বচ্ছকেই ভালোবাসে। তাই তে সুহা ছোটশ্বাস ফেলে শুধায়,

“ মনে আপনাকে জায়গা না দিলে চারবছর যাবৎ অপেক্ষায় থাকতাম না। এমন কি এখনও এখানে পরে থাকতাম না স্বচ্ছ। ”

স্বচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলে,

”বাহ! খুশি হবো নাকি কথাটা শুনে?”

সুহা কপাল কুঁচকে উত্তর করে,

“ এত খোঁচা দিয়ে কথা শোনান কেন স্বচ্ছ? আমার সাথে সত্যিই তিহানের ঐ কাজিনের কিছু নেই। কিছুই না। আপনার সাথে আমি মোটেও নাটক করছি না। তবুও যদি মনে হয় আমি নাটক করছি, ওকে ফাইন। চলে যাচ্ছি আমি আমার বাসায়। এমনিতেও আমায় দেখলে আপনার অসহ্যই লাগছে তাই না? ”

স্বচ্ছ ভ্রু উঁচায়। টানটান স্বরে বলে,

“ কেন? ও বাসায় গিয়ে যাতে তোমার দাদাজানের কথামতো ঐ রোহানের বাচ্চার সাথে বিয়েটা করে নিতে পারো তাই? শোনো সুহাসিনী, তুমি আমার বউ মানে, একান্তই আমার। এবং আমি জানিও তোমার মনে কেবল আমিই আছি। কিন্তু, যদি অন্য কাউকে মনে প্রবেশ করার চিন্তাও করো না? মে’রে কবরে রেখে আসব। ”

স্বচ্ছ কথাগুলো রাগান্বিত স্বরে বলেই গিয়ে বসে বেলকনিতে। একহাতে কফির মগটা নিয়ে চুমুক বসায় আরামে।আর তখনই ঠিক চোখ পড়ে নিচে চা দোকানটায় বসে থাকা রোহানের দিকে। এদিক পানেই বোধহয় তাকাচ্ছে। স্বচ্ছ তা দেখে বিরক্ত হয় যেন৷ টগবগ করে রক্তকণিকা সমূহ। রাগে বিরক্তে স্বচ্ছ কফির মগটা ছুড়ে ফেলে বেলকনির ফ্লোরে। বিড়বিড় স্বরে বলে,

“ শা’লা এই হ্যাংলা, ক্যারেক্টারল্যাস কুত্তাটার জন্য এক সেকেন্ডও দেখি মেজাজ ভালো রাখতে পারছি না। শুধু শুধুই মাথা খারাপ লাগে এই শা’লাকে দেখলে। ”

স্বচ্ছ বিড়বিড় স্বরে বলেই একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরায়। জ্বলন্ত সিগারেটটা দুই আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ায় মুহুর্তে। অপরদিকে রুমে বসে থাকা সুহা ততক্ষনে বেলকনিতে কিছুর আওয়াজ পেয়ে কৌতুহলী হয়ে তাকায়। দু পা বাড়িয়ে আসতে নিতেই চোখে পড়ে বিছানায় পড়ে থাকা ভেজা তোয়ালেটা। সুহা একহাতে তোয়ালেটা নিয়েই বেলকনিতে আসে। স্বচ্ছকে আরামে বসে থেকে সিগারেট ফুকতে দেখে কপাল কুঁচকে আসে তার। একটা ছেলে কিভাবে এত সিগারেট ফুকতে পারে? বুকে যন্ত্রনা হয় না? স্বাস্থ্যের দিকটাও তো ভাবতে পারে। ছেলেটা এমন কেন? সুহা রাগ দেখিয়ে মুহুর্তেই টেনে নেয় স্বচ্ছর মুখের সিগারেটটা। টানটান গলায় বলে উঠে,

“ এতকালও কি এভাবেই সিগারেট টানতেন? ফুসফুস আদৌ ভালো আছে আপনার?নাকি দিনরাত এত সিগারেট ফুঁকে ফুসফুস, হার্ট সবকিছু বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন? ”

স্বচ্ছ তাচ্ছিল্য টেনে হাসে যেন। শুধায়,

“ ফুসফুসের কথা বলতে পারছি না, তবে হার্টের বারোটা টা তো এখানে এসে তোমাকে ভালোবেসেই বাজল।”

সুহা তখনো এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেটটা ধরে রেখেছে। শক্ত গলায় শুধায়,

“ আমাকে ভালোবেসে নয়।দিনরাত এসব অখাদ্যে মেতে আছেন বলেই বারোটা বাজছে।এই বিদ্ঘুটে গন্ধময় নিকোটিনে সুখটা কি বলুন? লাভটাই বা কি হচ্ছে বলুন? কি শান্তি পান এসবে?”

স্বচ্ছ মুখ গম্ভীর করে হাত বাড়ায়। সিগারেট নেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“ তুমি বুঝবে না সুহাসিনী। দিয়ে দাও সিগারেটটা। ”

সুহা দেয় না। বরং জেদ ধরে বলে,

“ আগে বলুন, কি শান্তি পান?”

“ খুব শান্তি! বুঝানো যাবে না।অন্তত জ্বালা তে মেটে। ”

“ কি এত জ্বালা আপনার?বলুন,শুনি। তবুও সিগারেট ছুঁবেন না আর। ”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে ক্রুর হাসে। সুহার দিকে তাকিয়ে চোখে হেসে শুধায়,

“ সিগারেট না ছুঁলে তোমায় ছুঁতে দিবে নাকি সুহাসিনী? ”

আকস্মিক কথাটা শুনে সুহা চুপ থাকে। কথাটার অর্থ বুঝে উঠে কান জোড়া উষ্ণ অনুভব হয় তার। সুহা তবুও উত্তর দেয় না। ভাবে সে। এই একমাসের মতো সময়ে সে স্বচ্ছর সাথে একঘরে থেকেছে। এক বিছানায় ঘুমিয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছ কখনে তাকে কামনা নিয়ে চায়নি।কখনে কামুক নজরে ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু চুমু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল স্বচ্ছর জ্বালানোটা। অথচ স্বচ্ছর তো অধিকার আছে তাকে ছোঁয়ার। স্বামী হয় তার। সুহা এই পর্যায়ে অন্য পাশ ফিরে ভেজা তোয়ালেটা মেলে দিতে লাগে বেলকনিতে থাকা দড়িটায়। ধীর স্বরে বলে,

“ আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি আমি স্বচ্ছ, একঘরে থাকছি আপনার সাথে। স্বামী হিসেবে আপনি আপনার অধিকার ফলাতেই পারেন। সেইক্ষেত্রে ছুঁতেও পারেন আমায়।জিজ্ঞেস করার কিছু নেই এতে। ”

স্বচ্ছ এবারে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে৷ সে জানে এই মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। এই যে এক্ষুনি এই কথাটা বলল এটাও বলে দেয় যে সুহা মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। সেদিনকার হসপিটালে অপারেশনের আগ মুহুর্তে বলা কথাগুলোও বলে সুহা তাকে ভালোবাসে। শুধু মাঝখান থেকে তালগোল পাকিয়ে দিল রোহনটা বেয়াদবটা। যার কারণে বউয়ের সাথে ঝগড়াজাটিও হয়ে গেল তার। স্বচ্ছ মনে মনে রোহানকে কয়েকটা গা’লি দেয়। পরমুহুর্তেই সুহার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা সুহাকে পেঁছন থেকেই আচমকা আগলে নিল। এক কামিজের ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে দিল সুহার মসৃন উদর।আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। অপর হাতে সুহার ভেজা চুল গুলো কাঁধ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে চুমু খেল। একটা নয়। বার কয়েক চুমু দিয়ে সেভাবেই কাঁধে ঠোঁট রেখে শুধাল,

“ ছুঁয়ে দিলাম। নেহাৎ তুমি বললে তাই।”

সুহা তখন অনুভূতিতে নাজেহাল। অন্যদিনের সুহা আর আজকের সুহাকে একদমই ভিন্ন দেখাল যেন। অন্য দিনের সুহা লজ্জ্বা লুকিয়ে রাগ দেখাতে পারত। এক সহস্র অনুভূতিকে দামাচাপা দিয়ে ছ্যাত করে উঠতে পারত। কিন্তু আজকের সুহা তা পারল না। বরং যতবারই স্বচ্ছ ঠোঁট ছুঁইয়ে সুহার কাঁধ ছুুয়ে গেল ততবারই সে কেঁপে কেঁপে উঠল। মসৃন উদরে স্বচ্ছর হাতের ছোঁয়াতে হাঁসফাঁস লাগল। নিঃশ্বাস ঘন ঠেকল তার।স্বচ্ছ চুম খেল আলতো ভাবেই অথচ তার অনুভূতি বইয়ে দিল সুহার লোমকূপে কূপে। সুহা সামলাতে পারে না যেন। স্বচ্ছ তখনও কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে। শেষ চুমুটা মুখ ঝুঁকিয়ে গলার দিকেই বসাল সে। পরপরই দাঁত দাবিয়ে একটা কামড় বসাল।সুহা দাঁতে দাঁত চাপে।ব্যাথায় চিনচিন করে উঠে। স্বচ্ছ এমনই ভাবে দাঁত বসাল যে ব্যাথা পেতে বাধ্য। সুহা সহ্য করার চেষ্টা চালাল ঠিক কিন্তু এর পরপরই মনে পড়ল যে তারা দিনের বেলাতেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছেে।কেউ তাকালে? তাদের এই অবস্থায় দেখলে? সুহা হাঁসফাঁস স্বরে বলে উঠে,

“ব্যাথা পাচ্ছি স্বচ্ছ, ছাড়ুন।”

স্বচ্ছ হাসে তখন। কামড় ছেড়ে সুহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফিচেল স্বরে বলল,

“ তুমি ছুঁতে বললে কেন? এখন কামড়াতে ইচ্ছে করলে আমি কি করব?”

সুহার তখন লজ্জ্বায় মুখ কান লাল হয়ে উঠে যেন। সাথে উষ্ণ অনুভূতি! সুহার গাল কান উষ্ণ ঠেকে। উত্তর দিতে পারে না যেন। অপরদিকে স্বচ্ছর সামনে নিজের এহেন দশা দেখে নিজেরই মাটির নিচে লুকোতে মন চাইছে যেন। সুহা হাঁসফাঁস করে তখন। অপরদিকে স্বচ্ছ তাকে আরেকটু লজ্জ্বায় ফেলতে শুধায়,

“ এভাবে লাল হয়ে লোভ বাড়াচ্ছো সুহাসিনী! ”

ঠিক পরমুহুর্তেই আবার দুই হাতে আগলে ধরে সুহার মুখ। বলে উঠে বহু আকাঙ্ক্ষিত কন্ঠে,

“ ক্যান আই কিস ইউ সুহাসিনী? জাস্ট ওয়ান টাইম! ”

সুহা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় এবারে। কাঁপা স্বরে উত্তর করে,

“হ্ হু?”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে আর অপেক্ষা করে না। দড়িতে মেলে দেওয়া তোয়ালেটা নিজেদের আড়াল করার মতো করে টেনে দিল যাতে রাস্তা থেকে মানুষ না দেখে। তারপর একমুহুর্তও দেরি না করে আঁকড়ে নিল সুহার নরম অধর। স্বচ্ছ বোধহয় তখন দিশেহারা। উম্মাদ অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে সুহার ঠোঁটজোড়া সে ছাড়তেই চাইল না যেন। সুহার ঠোঁট তখন পুরুষালি পুরু ঠোঁটের দখলে। তারপর অনেকটা সময় পর সে ছাড় ফেল। হাঁপাতে লাগল নিজের মতো। পরমুহুর্তেই আবার লজ্জ্বায় লাল নীল হয়ে উঠল মুখচোখ। স্বচ্ছ তা দেখে হালকা হাসে। কৌশলে চুমু দেওয়ার মাঝখানে সুহার হাত থেকে কেড়ে নিল জ্বলন্ত সিগারেটটাও। প্রায় শেষের দিকেই। স্বচ্ছ সে অংশটুকুতেই ঠোঁট ছুইয়ে বলে,

“বাহ! ভালোই উন্নতি হয়েছে আমার বউয়ের। আগে কাছে আসলে রেগে মার বসাতে আসত, আজকাল লজ্জ্বায় লাল হয়ে উঠছে! ”

সুহা বোধহয় এবারেও লজ্জ্বায় নুইয়ে যেত। কিন্তু যখনই দেখল স্বচ্ছ কৌশলে তার হাত থেকে সিগারেটের অংশটুকু নিয়ে নিয়েছে তখনই রাগে ফোঁসফোঁস করে। বলে,

“ আপনারও উন্নতি হয়েছে। মাঝেমাঝে চুমু দিতেন আপনি। তখন তো মনে হতো এই আদুরে চুমুর মতোই আপনার ভালোবাসাটাও আদুরে৷ অথচ, এখন তো দেখছি সুকৌশলে ছলনা করেও চুমু দিতে পারেন। যেমনটা আগে ছলনা করে ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন। চার বছর আগে!”

“ আপাতত একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি।তাই নিকোটিনেই শান্তি খুঁজছি। যখন প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব তখন তোমাতে শান্তি খুঁজব নাহয়। ঠিকাছে?”

কথাটুকু বলেই স্বচ্ছ মুখের নিকোটিনের ধোঁয়াগুলো ছুড়ে দিল সুহার মুখের উপর। সুহা তাতে রেগে তাকায়।বলে,

“ এখনও কিছু করছি না স্বচ্ছ। সিগারেটের প্রসঙ্গ নিয়ে কোন স্টেপ নিচ্ছি নাহ। শুধু আপনার এই ত্যাড়ামো শেষ হোক তারপর দেখাব।

স্বচ্ছ এবারেও বাঁকা হাসে। উত্তরে বলে,

” কি দেখাবে সুহাসিনী? তুমি চাইলে ত্যাড়ামি শেষ করে এই মুহুর্তেই দেখতে পারি আমি।প্লিজ দেখাও। ”

সুহা দাঁতে দাঁত চেপে শুধায় এবারে,

“ অস্বচ্ছ মন! ”

স্বচ্ছ হেসে উঠে শব্দ করে। বলে,

” কি করব! এমনিতেও খু্ব একটা স্বচ্ছ তো তুমি আমায় ভাবো না সুহাসিনী। ”

.

ছুটি সব জিনিসপত্র নিয়ে নিজ বাসাতে চলে এসেছে। আজকাল কোনকিছুই ভালো লাগে না তার। ঘুম হয় না ঠিকমতো। শারিরীা, মানসিক উভয় অবনতির কথা শোনামাত্রই তার আম্মু নির্দেশ দিয়েছে বাসায় ছুটে যেতে। ছুটিও অবশ্য তাই করল। কারণ আজকাল ওখানে তার দমবন্ধ লাগত। রাহাকেও অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল। একটু থেকে একটুতেই রাহার প্রতি চিরচিরে রাগ জম্মাতে শুরু হয়েছিল। আর সে রাহার সাথেই একসাথে থাকতে গিয়ে বারংবার কান্না পেত তার। বারংবার মনে হতো সে কেন পেল না আবির ভাইকে? কেন রাহাকেই আবির ভাই পছন্দ করল? ছুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বাসায় এসে সর্বপ্রথমই যত্ন করে নিজেকে শাড়িতে সাঁজিয়ে নিয়ে চোখে কাজল টানে। তারপর ঘুরঘুর করতে করতে ছাদে উঠে। এর ঠিক পাশাপাশি বিল্ডিংটাই আবিরদের। আগে প্রায়সই দেখা হতো আবিরের সাথে এই ছাদে।ছুটি তখন শাগি পরতে পারত না। অথচ কত ইচ্ছে ছিল শাড়ি পরে এই লোকের সামনে হাজির হবে সে। এই লোক তাকিয়ে থাকবে ড্যাবড্যাব করে৷ এখন অবশ্য তা কেবলই স্বপ্ন। আজ চারবছর তো হলো আবির ভাইয়ের সাথে এই ছাদে তার দেখাই হয় না। ছুটি দীর্ঘশ্বাস টানে। আবিরদের ছাদটায় আবিরের দাদীকে বসে থাকতে দেখে হাসে আলতো। কার্নিশ ঘেষে বলে,

“ কেমন আছো বুড়ি?সব ভালো তো? ”

আবিরের দাদী তখন আলতো হাসে৷ ছুটিকে পরখ করে দেখতে দেখতেই মিষ্টি হেসে বলে,

” কি মিষ্টি দেখতে লাগছে রে তোকে শাড়িতে। না জানি বউ হলে তখন তোকে কতোটা সুন্দর মানাবে রে ছুটি। ”

ছুটি দুঃখ লুকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে এবারে। বলে,

“ বউ হতে তো বহু দেরি। ”

” আমার নাতিটা ভালোয় ভালোয় পড়াটা শেষ করে দেশে ফিরলেই বিয়ে দিয়ে দিব। মানে, তোর মতো একটা মেয়ে খুঁজেই বিয়ে দিব আরকি। কি বলিস হুহ?”

ছুটির চোখেমুখে তখন বিষাদ নামে। তবুও হেসে বলে,

“ তোমার নাতি তো সুন্দর! কত মেয়ে লাইন ধরে আছে। তা এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে আমার মতো মেয়ে খুঁজবে কেন শুনি?”

আবিরের দাদি শোনাল,

“কারণ তুই তো ছুটি। ”

ছুটি ক্লান্ত গলায় শোনায়,

“ছুটি তো কি? ছুটিরা আবিরদের বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না বুড়ি। ”

.

ছুটি সন্ধ্যের দিকে ল্যাপটপে একটা মুভি দেখছিল। কিন্তু আচমকাই অনলাইনে তার আবির ভাইয়ের কল আসা দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। সচারচর এই লোক তাকে কল করে না। খোঁজ নেয় না। ম্যাসেজ করে না। তবে এই পরপর দুইদিন কল করছে? তাও নিজ থেকে? ছুটি বিস্ময় নিয়ে কল রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে আবির বলে উঠে,

” আমি নেই আর তুই শাড়ি পরে টই টই করিস ছাদে ছাদে? কার জন্য শাড়ি পরে টই টই করিস শুনি? ”

ছুটি নিঃশ্বাস টানে। টানটান গলায় বলে উঠল,

“নিজের জন্য। সবসময় যে অন্যের জন্য শাড়ি পরে টইটই করব এমনই কেন মনে হলো আপনার?”

ছুটির টানটান স্বর শুনে আবির থমকায়। তবুও রাগ নিয়ে শুধায়,

“ শিওর নিজের জন্য?”

ছুটি ফের শান্ত স্বরে বলে,

“ মিথ্যে বলছি বলে তো মনে হচ্ছে না। ”

আবির মেনে নিল। তবে ছুটির এমন কথাবার্তা তার পছন্দ হলে না একটুও। কেমন শান্ত স্বরে, টানটান গলা! কেমন যেন! একটুও উচ্ছাস নেই কেন এই মেয়েটার কন্ঠে? একটুও আনন্দ নেই কেন? আগে তো থাকত। আবির ফের বলে,

“ ঠিকাছেে।কিন্তু তুই দাদীকে কি বলেছিস দাদীকে শুনি? এক্ষুনি বল। ”

ছুটির যেন মনে পড়ে না। বলে,

“ কি বলেছি? ”

“ ছুটিরা আবিরদের বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না? এই সত্যি করে বল তো, কি চলছে তোর মনে? যদি খারাপ কিছু ঘুরে থাকে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিলাম। ”

ছুটি হেসে শুধায়,

“ অধিকারবোধ দেখান? ”

আবির গম্ভীে স্বরে জানায়,

” অধিকারবোধ হলে অধিকারবোধ।তুই তো অধিকারবোধও দেখাতে পারিস না। আজ পর্যন্ত এখানে আসার পর থেকে একটা কল ম্যাসেজ করে আমার খোঁজ পর্যন্ত নিসনি। ”

ছুটি মুহুর্তেই উত্তর দেয়,

“ যদি বিরক্ত হতেন? বিরক্ত করার চাইতে চুপ থাকাটা শ্রেয় নয়?”

আবির মুহুর্তেই উত্তর দেয়,

” না শ্রেয় নয়।তুই কি জানিস? তোকে চুপ থাকলে খুব বিচ্ছিরি লাগে ছুটি। ”

#চলবে….

[#প্রেমের_সমর
#পর্ব_২৯
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সন্ধ্যার একটু পরের সময়টা তখন। স্বচ্ছ চায়ের টং দোকানটায় বসা। পাশাপাশি এসে বসেছে ততক্ষনে রোহানও। একটা আদা চায়ের জন্য দোকানদারকে বলেই স্বচ্ছকে রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করেই বলে,

“ ডিভোর্সের এপ্লাইটা সুহা আমার জন্যই করেছিল বড়ভাই! আপনি বোধহয় জানেনও না আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়ার কতোটা পসিবিলিটি ছিল! শুধু মাঝখান থেকে এক্সিডেন্টটা হয়েই তালপাক পাকিয়ে দিয়েছে। ”

স্বচ্ছর গা জ্বালা করে রোহানের সেধে এসে বলা কথাটা শুনে।রোহানের কথা বলার ভঙ্গিটা দেখে ইচ্ছে হয় এক ঘুষিতে চোয়াল ভেঙ্গে দিতে। স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চাপে। এক হাত দিয়ে রোহানের পিঠে চাপড় মেরে কাঁধে হাত রাখে। যেন অনেক কালের সুসম্পর্ক তাদের। তারপর ক্রুর হেসে বলে,

“ গ্রেট জব ছোটভাই। তো তারপর বল, টং দোকানে বসে হ্যাংলার মতো অন্যের বউ দেখার জন্য তাকিয়ে ছিলি কেন? তাকাবি আর? চোখ উপড়ে নিব এরপর তাকালে। ”

রোহান এই পর্যায়ে হাসে। উত্তরে বলে,

“ বড়ভাই দেখি খুবই ইনসিকিউরড ফিল করছেন বউ নিয়ে। ”

স্বচ্ছ ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,

“ তোর মতো গর্দভের কথাতে ইনসিকিউরড ফিল করব? আমি জানি আমার বউ আমায় ভালোবাসে। তোর দুই মিনিটের কথাতে আমি রেগে গিয়ে বউ ছেড়ে দিব তা ভাবাটা বোকামো!”

কথাটা বলেই পরমুহুর্তে আবার কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতেই ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠে,

“ তোর পরিবার কাল সুহাদের বাড়ি গিয়েছিল না? কি ছ্যাঁ’চড়া রে তুই ! সাথে তোর পরিবারটাও! আমি তো ভাবতেই পারি না ছোট চাচীর বোনটা এমন এক ছ্যাঁ’চড়া ছেলের জম্ম দিয়েছে। ”

রোহান যেন এতক্ষনে গিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট হলো। উত্তরে বলে,

“ আম্মা তুলে কথা বলবেন না ভাই। কষ্ট লাগে। ”

স্বচ্ছ খোঁচা দিয়ে শুধায়,

“ নিজেকে সেভাবে বানিয়েছিস কেন শুনি? ”

রোহান ততক্ষনে মুখ ভার করে উত্তর করে,

“ কিভাবে বানিয়েছি?সত্যিই তো বলছি। আপনি তো সুহাকে ভালোবাসেন না অতোটা, ভালোও রাখতে পারবেন না আমার মতো করে।শুনেছি আপনাদের বিয়েটাও খেলনা বিয়ে ছিল। তাহলে? শুধু জেদের টানে এমনটা করছেন কেন বলুন? দিয়ে দিন না সুহাকে আমায়।”

স্বচ্ছর এই পর্যায়ে পুরো শরীর টগবগ করে রাগে। হাত নিশপিশ করে। ইচ্ছে করে রোহানের মুখশ্রীটা কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে এবড়োথোবড়ো করে দিক। স্বচ্ছ রোহানের কলার চেপে ধরে এই পর্যায়ে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,

“শুধুমাত্র চাচীর দিকে তাকিয়ে তোকে আবার কে’লাতে পারছি না। নয়তো এখনই তোর হাড্ডি গুলো গুড়ো গুড়ো করতাম। একজন হাজব্যান্ডের কাছে তার বউকে চাইছিস? তোর সাহস কত নির্লজ্জ! ”

রোহান হালকা হেসে ততক্ষনে শুধায়,

“ ভালোবাসা লজ্জ্বা মানে না বড়ভাই! ”

স্বচ্ছ হাসে। রোহানের কলার ছেড়ে বুঝানোর ন্যায় সুন্দর করে বলে,

“ ভুল ভালোবাসা বেসেও লাভ নেই জানিস তো? তোর ক্ষেত্রেও লাভ দেখছি না। তুই বরং হাল ছেড়ে দে।”

.

সন্ধ্যার একটু পরই এসেছে স্বচ্ছ।লোক আনিয়ে বেলকনির মাপজোখ করেছে কিছুটা সময়। উদ্দেশ্য বেলকনিতে থাইগ্লাস লাগানো। চারদিকে যেভাবে শকুনের উপদ্রব দেখা দিচ্ছে বউ যদি ফসকে যায়? স্বচ্ছ লোকগুলোকে সবকিছু বলাবলি করে বুঝিয়ে দেওয়ার পর যখন লোকগুলো চলে গেল তখনই আলো নিভিয়ে দিল বিছানায় শুঁয়ে চোখ বুঝে রইল। মাথাটা ধরেছে সামান্য। অন্যসময় হলে হয়তো সুহাকে জ্বালাতন করার উদ্দেশ্যে সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলত। মাথাটা টিপে দিতে বলত। কিন্তু এখন বিপরীত। বরং স্বচ্ছ এখন সুহাকে এড়িয়ে এড়িয়েই চলার চেষ্টা চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার খোঁচা দিয়ে কথাও শোনাচ্ছে। তবুও বেশির ভাগ সময় সে সুহাকে এড়িয়েই চলছে বলতে গেলে। স্বচ্ছ শ্বাস ফেলে। মাথা চিড়চিড় করলেও সুহাকে একটা ডাক পর্যন্ত দিল না সে। সুহাও তখন সিয়ার সাথে গল্পগুজব করছিল বাইরে।স্বচ্ছর হুট করে জ্বালানো কমিয়ে দেওয়াটা যেন তার সহ্য হচ্ছে। হুট করে কথা কম বলাটাও অপছন্দনীয় ঠেকছে। আর অবহেলা কিংবা এড়িয়ে চলাটা তো বুকে সরাসরিই আঘাদ করে তার। এই একটা মাস কত পাগলামো দেখাল ছেলেটা! কতোটা জ্বালাতন করল। ইচ্ছে করেই তাকে রাগাত। সুহার এখন মন খারাপ হয় এসব ভেবে। কান্না পায় কেমন জানি যখন স্বচ্ছর এড়িয়ে চলাটা দেখে। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।রুমে এসে বাতি নিভিয়ে স্বচ্ছকে শুঁয়ে থাকতে দেখে চুপ থাকে সুহা। মনে প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ কি হলো? এতোটা নিরব পরিবেশ? স্বচ্ছই বা এত তাড়াতাড়ি না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল? সুহা ধীর পায়ে পা বাড়ায় যাতে স্বচ্ছ ঘুমালেও ঘুম না ভাঙ্গে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার এককেণে বসেই সর্বপ্রথম হাত রাখে স্বচ্ছর কপালে। তাপমাত্রা বুঝার চেষ্টা চালায়।জ্বর এল না তো? নাহ! শরীরের তাপমাত্র টুকু তো স্বাভাবিকই আছে। তাহলে? মাথা ব্যাথা করছে কি? সুহা হাত এগিয়ে এবারে স্বচ্ছর চুল ছুঁয়ে দেখে। মাথায় হাত বুলাতে লাগে।এক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অন্য হাতে স্বচ্ছর মুখে রাখতেই চোখ বুঝে থাকা স্বচ্ছ বলে উঠে,

“ তুমি আমার কাছে সত্যিই ভালো থাকবে না সুহাসিনী? সত্যিই কি আমি তোমায় ভালো রাখতে পারব না? ”

সুহা ফিটফিট করে তাকায় এবারে। গালে রাখা হাতটা মুহুর্তেই সরিয়ে নেয় সে। স্বচ্ছর বলা কথাগুলো কেমন যেন শোনায়। যেন স্বচ্ছর কন্ঠে সহস্র বিষাদের উপস্থিতি! সুহা ছোট শ্বাস টানে এবারে। স্বচ্ছর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উত্তর দেয়,

“ আলো নিভিয়ে চোখ বুঝে শুঁয়ে থেকে কি এসবই ভাবছিলেন? ”

স্বচ্ছ তখনও চোখ বুঝে আছে। গম্ভীর স্বরে বলে,

” যেটা বলেছি তার উত্তর দাও। তোমাকে আমার চাইতেও অন্য কেউ আরো বেশি ভালো রাখতে পারবে? ঐ রোহান পারবে?কি হলো বলো? ”

সুহা হাসে এবারে। মৃদু হাসি৷ স্বচ্ছর মাথায় গতিশীল হাতটা স্থির করে উত্তর দেয়,

” অন্য কেউ তো চাইলে আপনার চাইতেও শত সহস্রগুণ ভালো রাখতে পারবে স্বচ্ছ। কিন্তু সে শত সহস্র গুণ ভালো রাখলেও আমি ভালো থাকব কিনা তা হলো প্রশ্ন। বুঝলেন? ”

স্বচ্ছ তখন বোকার মতো চোখ মেলে তাকায়। শুধায়,

“ ভালো রাখলে ভালো থাকবেনেই বা কেন?”

“ কারণ মানুষ যার সাথে ভালো থাকতে চায় তাকে না পেলে অন্য কারোর সাথে মন থেকে ভালো থাকতে পারে না। পারলেও হয়তো পরবর্তীতে মানিয়ে নিতে নিতে ভালো থাকতে হয়। ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই ফের প্রশ্ন ছুড়ে,

“ তুমি কি আমার সঙ্গে ভালো থাকতে চাও না সুহাসিনী? ”

সুহা উত্তর দেয়না। যদি সে বলেও থাকতে চায় তবুও এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ কি তা বিশ্বাম করবে? সুহা নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুটা ক্ষণ। উত্তর দেয় না। কারণ তার ভাবনা মতে স্বচ্ছ হয়তো তাকে সেদিনকার এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী করে। হয়তো ভাবে সেই এক্সিডেন্টটা ঘটিয়েছে। নাহলে সেদিন ওভাবে জিজ্ঞেস করত তাকে?অথচ সুহা তো এই স্বচ্ছ নামক মানুষটার এইটুকু ক্ষতির কথাও ভাবতে পারে। এইটুকু খারাপ হোকও চায় না। সুহা কিভাবে বুঝাবে তা? সুহার মন খারাপ হয় স্বচ্ছ তাকে এমনটা ভাবে ভেবে। তাই তো প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে উত্তর করল,

“ মাথা ব্যাথা করছে আপনার? তাহলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমান। ”

স্বচ্ছ শুধায়,

“ এড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। ”

সুহা ক্লান্ত চাহনিতে তাকায়। একটু হেসে বলে,

“ কারণ আপনার খুঁজতে থাকা সেই প্রশ্নের উত্তরটা না পাওয়া অব্দি আপনি আমাকে দোষীই ভাববেন স্বচ্ছ।এক্সিডেন্টের পেছনের মানুষটা আমিই ভাববেন।এদিকে আমার কাছেও তো কোন উপযুক্ত প্রমাণ নেই বলুন।আপাতত আপনার চোখে আমি একপ্রকার খু’নী হিসেবেই আছি তাই না?আর সে খু’নীই আপনার সাথে ভালো থাকতে চায় এটা শুনলে আপনি হাসতেন৷ ভাবতেন আমি অভিনয় করছি। তাই এড়িয়ে গেলাম। কারণ সত্যিটা বললেও আপনি পাত্তা দিবেন নাহ। ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই শুধায়,

” তোমায় অবিশ্বাস করিনি আমি।তোমায় খু’নীও ভাবিনি সুহাসিনী। ট্রাস্ট মি! ”

সুহা হাসে। এই পর্যায়ে কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। কান্না পায়। নিজেকে বিনা দোষে অভিযুক্ত হিসেবে দেখছে সে, স্বচ্ছ বিনা কারণেই তাকে অভিযুক্ত করর এড়িয়ে যাচ্ছে কি নিদারুণ ভাবে। তাহলে এই এক মাস এতোটা ভালোবাসা দেখানোরই কি দরকার ছিল? কি প্রয়োজন ছিল? সুহা কান্না আটকানো স্বরে উত্তর দেয়

“ কিন্তু আপনার কাজকর্ম বুঝাচ্ছে যে আপনি আমায় অবিশ্বাসই করছেন স্বচ্ছ। সত্যি বলব? আমি আপনাকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না স্বচ্ছ৷ আমি মা’রার হলে আপনাকে সরাসরিই মা’রতাম, আমার স্বভাবে অতোটা বেইমানি নেই যে আমি আপনাকে ওভাবে মারতে চাইব। ”

স্বচ্ছ হাত বাড়ায় এবারে। সুহার গালের পাশে একহাত রেখে বলে,

“ তোমায় তো এইজন্য দোষারোপ করিনি সুহাসিনী।আমি জানি তুমি আমায় মা’রার কথা ভাবতে পারো না। আমি জানি তুমি আমার ক্ষতি করবে না সুহাসিনী! ”

সুহার এই পর্যায়ে সত্যিই কান্না পেল যেন। চোখ টলমল করে৷ সুহা নিজেকে এতোটা ভঙ্গুর হিসেবে বোধহয় কখনোই কল্পনা করেনি। কখনোই এভাবে কারোর সামনে কেঁদে ফেলা মেয়ে হিসেবে ভাবেনি সে। তবুও কেঁদে দিল। চোখ গড়িয়ে পানি পড়ল। নিজেকে নির্দোষ হিসেবে উপস্থাপনের জন্যই বলল,

” আমি, আমি সত্যিই আপনার ক্ষতি করতে চাই না স্বচ্ছ।কখনোই চাই না। সেখানে আপনাকে মে’রে ফেলার কথাটা ভাবা তো আমার জন্য দুঃসাধ্যময় কাজ। আমি যা করিনি তার জন্য আমি শাস্তি পাচ্ছি তবুও । কেন আমায় শাস্তি পেতে হবে বলুন? ”

“ তোমায় শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবতে পারি না আমি সুহাসিনী। তুমি তো প্রাণ হও আমার। ”

সুহা এই পর্যায় ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায়। উঠে যেতে নিতেই স্বচ্ছ সুহা উঠতে দিল না। উল্টে সুহার কোলে মাথা রাখে এগিয়ে। সুহার হাতটা মাথায় রেখে শুধায়,

“ হাত বুলিয়ে দাও। তোমার কান্না সুন্দর বোধ হচ্ছে না সুহাসিনী! ”

সুহা অন্য পাশ ফিরে কান্না থামাতে চায়৷ চোখ মুঁছে। বলে,

“ আমি এতোটা অবহেলা বোধহয় নিতে পারছি না। সত্যিই পারছি না। ”

স্বচ্ছ চোখ বুঝে। দুই হাতে সুহার কোমড় আঁকড়ে ধরে মাথা রাখে সুহার কোল ঘেষে। বলে,

“ তোমায় অবহেলা করার সাধ্য নেই আমার।”

সুহা আচমকায় বলে,

“ আমার সাথে কি গেইম খেলছেন ? আবারও ভালোবাসার জালে ফাঁসিয়ে চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়ে পালিয়ে যাবেন রাইট? এক মাস নিশ্চয় আমাকে আপনার প্রতি দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়েছেন তাই না?”

স্বচ্ছ এবারে হাসে। বলে,

“ তুমিও তো বিশ্বাস করছো না আমায়। ”

“ কারণ আপনি আমার উপস্থিতি পছন্দ করেন না স্বচ্ছ।এড়িয়ে যান আমায়। ”

স্বচ্ছ হাসে। শুধায়,

“ তুমি আজকাল ধরা দিয়ে দিচ্ছো, ছোঁয়ার অধিকার দিচ্ছো নিজ থেকেই, আশপাশে থাকছো। এড়িয়ে না গেলে তো বিপদ আমারই বলো।”

সুহা এই পর্যায়ে টানটান গলায় শুধায়,

“ দূরে থাকলেই খুশি? ”

উত্তর আসে,

“তুমি তো দূরেই থাকতে চাইলে সবটা সময়।তাই সুযোগ দিলাম আপাতত। পরবর্তীতে ছাড় দিব না আর সুহাসিনী। ”

সুহা চুপ থাকে। স্বচ্ছ ততক্ষনে সুহা হাতটা মাথায় চেপে রেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

“ মাথায় হাত বুলাও। বড্ড যন্ত্রনা! ”

.

আবিরদের বাসা থেকে হুট করেই ছুটিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসল। বিয়েটা ঠিক করে রেখে ছেলে দেশে ফিরলেই বিয়েটা সম্পন্ন করবে এমনটাই প্রস্তাব রাখা হলো। ছুটির বাবা মা দুইজনেই এই প্রস্তাবে খুশি হলেন। জানেন তারা যে, তাদের বোকা মেয়েটি কবে থেকেই এই আবির ছেলেটাকে মন দিয়ে বসে আছে৷এতকাল যে এত বিয়ের প্রস্তাব কিংবা পাত্রপক্ষকে উপেক্ষা করে এসেছে তাও যে কেবলই এই আবির ছেলেটার জন্য তা তাদের জানা কথা৷ তাই তো আবিরদের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে খুশিই হয় দুইজনে।খুশি না হওয়ার ও তো কারণ নেই। ছেলে ভালো, ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছে, পাশাপাশি আয়ও করছে। সুন্দর ফিউচার!তার উপর পাশাপাশি বাসা। মেয়ে যদি দেশেই থাকে তো তাদের কতোটা সুবিধা হবে। দিনে চব্বিশঘন্টার মধ্যে চব্বিশ ঘন্টাই মেয়েকে চোখে চোখে দেখতে পারবেন। ছুটির বাবা মা সবটা বুঝে শুনে একলাফে রাজি হতে গিয়েও শুধুমাত্র মেয়ের মত নেওয়ার জন্যই উনারা কিছু জানালেন না শেষমেষ। অবশেষে ছুটির বাবা তোফায়েল আহমেদ যখন বাড়ি ফিরলেন তখন আস্তেধীরেই ছুটিকে সবটা খুলে বললেন। ভাবলেন তার মেয়ে খুশিতে একলাফ মেরে জানাবে যে সে রাজি। অথচ ঘটল ভিন্নটাই! তোফায়েল আহমেদের আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়েই ছুটি জানায় সে আবির ভাইক পছন্দ করে না। আবিরকে সে বিয়েও করতে চায় না। আকস্মিক এই উত্তরটার পরেও ছুটির মা খুব বুঝাল ছুটিকে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। ছুটি নিজের সিদ্ধান্তেই স্থির থাকল। উল্টে জানাল মাসখানেকের মধ্যেই সে বিয়ে করবে। তাও অন্য ছেলেকে। বাবা মা যেন পাত্র দেখে তার জন্য । আকস্মিক ছুটির এহেন সিদ্ধান্তে তার পরিবার বিস্মিত হলেও মেনে নিল। ইনিয়ে বিনিয়ে আবিরের পরিবারকে জানাল যে ছুটি রাজি নয় বিয়েটায়। ব্যস! এই খবরটা পৌঁছে গেল আবিরের কানেও। আবির ততক্ষনে রেগে আগুন। দুই দুইবার বিয়ের প্রস্তাবে না করেছে ছুটি। আবির সে অপমান সহ্য করতে না পেরে হুড়মুড় করে কল দেয় ছুটিকে। অপর পাশ থেকে কল রিসিভড না হওয়াতে রাগ দ্বিগুণ হয় তার। অবশেষে শেষমেষ যখন রিসিভড হয় তখনই রাগে ধমক মেরে বলে,

“ ভাব দেখাচ্ছিস আমার সঙ্গে ছুটি? অবহেলা দেখাচ্ছিস? এতকাল যে আমি তোকে অবহেলা করেছি তার প্রতিশোধ নিতে চাইছিস? নাকি অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? আমার প্রতি আর মন টানছে না তাই তো?”

#চলবে….

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩০
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আজ শহরে রোদ উঠেছিল কড়াভাবেই। গরমে নাজেহাল অবস্থা। ভ্যাপসা গরমে সারাদিন ঘামে নাজেহাল অবস্থা হলেও রাতে স্বস্তি মিলেছে এক পশলা বৃষ্টির মাধ্যমে। ছুটি অবশ্য সেই বৃষ্টিতে রাতের আকাশ মাতিয়ে ভিজে এল। আজ অনেকটা দিন পর আবারও ঝুম বৃষ্টিতে গা ভেজাচ্ছে সে। আজ অনেকদিন পর আবারও বর্ষণের প্রতিটা কণা তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে তারই চোখে অশ্রকণার সঙ্গে। ছুটি মনে পড়ে সর্বশেষ বৃষ্টি ভেজার মুহুর্তটুকু! আবির ভাই ও ছিল সেদিন। খুব শাসিয়েছিল। সাথে নিজের পরণের ব্লেইজারটাও খুলে দিয়েছিল। ছুটি তাচ্ছিল্য করেই হাসে এবার। যাকে চেয়েছিল তাকে তো পেলই না উল্টে তার ব্লেইজারটা তার কাছে থেকে গেল। উহ! সেইদিন যে আবির ভাইকে সে দেখল এরপর আর দেখা হলো না মানুষটাকে। এরপর আর সরাসরি দাঁড়িয়ে কথা বলা হলো না।ছুটি বৃষ্টি শেষে ভিজে চুপচুপে হয়ে যখন বাসায় ফিরল তখনই ভেজা গায়ে থাকা অবস্থাতেই দেখতে পেল ফোনে অনেকগুলো কল এসেছিল। তাও আবিরেরই। হয়তো বিয়ের প্রস্তাবের প্রত্যাখানের বিষয়টা এতক্ষনে কানে গিয়েছে। নয়তো এতগুলো কল দিত? ছুটি কল রিসিভড করে। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ধমকে সুরে কথা আসে,

“ ভাব দেখাচ্ছিস আমার সঙ্গে ছুটি? অবহেলা দেখাচ্ছিস? এতকাল যে আমি তোকে অবহেলা করেছি তার প্রতিশোধ নিতে চাইছিস? নাকি অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? আমার প্রতি আর মন টানছে না তাই তো?”

ছুটি এবারে হাসে। আরাম করে ভেজা গায়ে গিয়ে বেলকনিতে বসে। পরপরই উত্তরে বলে,

“ আবির ভাই? আপনাদের প্রস্তাবে না করেছি তাই গায়ে লেগেছে খুব? তবে একটা সত্যি বলি? আপনারা বন্ধুরা বোধহয় সবাইই সেইম সেইম!তাই না?”

অপর পাশ থেকে আবির রেগে উত্তর করে,

“ তুই আমার বন্ধুদের কয়জনকে চিনিস? কয়জনকে চিনে কথাটা বলছিস?”

ছুটি ফের হাসে। উত্তর করে,

“ যে দুইজনকে চিনি সে দুইজনের একজনও এমন ভুল করেছিল অতীতে। সুহা প্রস্তাব নাকোচ করাতে ইগোতে লেগেছিল আপনার বন্ধুর। যার কারণে সুহাকে প্রেমে ফাঁসিয়ে বিয়েটা করে প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমার মনে হয় আপনিও বোধহয় একই কারণেই এমন রেগে আছেন এই মুহুর্তে। তাই না?”

আবির এই মুহুর্তে এসে রাগ থামিয়ে শান্ত হয়ে গেল। ছুটি তাকে স্বচ্ছর সঙ্গে তুলনা করছে? কেন? নিশ্চয় এমনি এমনি নয়? আবির হুট করেই আবিষ্কার এতকাল সে যে ভয়টা পেয়েছিল তাই যেন সত্যি৷ ছুটি সত্যিই পাল্টে যাচ্ছে। সত্যিই ছুটি দূরে সরে গিয়েছে।এই মুহুর্তে এসে আবিরের মনে হয় ছুটি সত্যিই তাকে আর চায় না৷আবির নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে,

“ আমাকে তোর স্বচ্ছর মতো মনে হচ্ছে কেন ছুটি? কেন মনে হচ্ছে আমি বিয়ে নিয়েও হ্যাংলামো করছি? ”

ছুটি এই পর্যায়ে চোখ বুঝে। ফোন কানে নিয়ে একগুচ্ছ অভিযোগ ঢেলে বলে উঠে,

“ আপনাকে তো স্বচ্ছ ভাইয়ার থেকেও জঘন্য মনে হয় আমার। অন্তত আপনার বন্ধু এমন একজন মেয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলেছিল যে মেয়েটার তখনও উনার প্রতি অনুভূতি জম্মায় নি। শুধু প্রস্তাবটাই নাকোচ করেছিল মেয়েটা। বিনিময়ে উনি মেয়েটার মনে তার জন্য অনুভূতি জম্ম দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল। আর আপনি? যে মেয়েটা আপনার প্রতি এতোটা অনুভূতিপ্রবণ, এতোটা সময় যাবৎ আপনার প্রতি দুর্বল। আপনি নিজেও জানের সে কতোটা পাগল ছিল আপনার জন্য। আর আপনি?আপনি স্বার্থ পূরণের জন্য তার অনুভূতিটাকেই ব্যবহার করেছেন। খুব জঘন্য নয় বলুন? ”

আবির বিস্ময় নিয়ে তাকায় এইবারে। সে ব্যবহার করেছে? সত্যিই ব্যবহার করেছে? কিন্তু সত্যিটা তো হলো সে ব্যবহার করেনি। উল্টে অনেক আগ থেকেই সে ছুটিকে ভালোবেসেছিল। শুধু প্রকাশ করেনি। সাদাফ যখন ছুটির অনুভূতিটাকে ব্যবহার করতে বলেছিল তখনও তো সে এসবে রাজি হয়নি। তাহলে? ছুটি এই কথাটা কেন বলল তাকে?আবির মুহুর্তেই শুধাল,

“ আমি ব্যবহার করেছি তোর অনুভূতিকে? ”

ছুটি কঠিন স্বরে উত্তর করে,

“ জানি না, নিজেকে প্রশ্ন করুন। ”

আবিরের এই মুহুর্তে অসহায় লাগে। কোথাও যে ছুটি তাকে ভুল বুঝছে তা তো সে বুঝতে পারছে কিন্ত কোন বিষয়ে? সে তো এমন কিছু করেনি। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝানোর ন্যায় বলে,

“ আমি তোর অনুভূতিকে ব্যবহার করিনি ছুটি। বরং যখন তোর অনুভূতি ব্যবহারের জন্য সাদাফ আমায় বলেছিল তখন আমি তার বিরুদ্ধেই বলেছিলাম।তুই একটা গর্দভ ছুটি। আজেবাজে কিছু ভেবে উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিবি না। ”

“ আমি খু্ব জেদি আবির ভাই। শুধু আপনার ক্ষেত্রেই আমি বোকা ছিলাম। মনে হতো না আমার মতো নরম মনের সহজ সরল মেয়ে বুঝি দুনিয়াতেই নেই? কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি মাত্রাতিরিক্ত জেদিও আবির ভাই।আপনার হয়তো ধারণাও নেই আমার জেদ কতটুকু। ”

আবির শুধায়,

“ কতটুকু? ”

ছুটি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসে। উত্তর করে,

” কোন একদিন দেখতে পাবেন। তার আগে বলুন, আমায় নিয়ে উপহাস করে লাভটা কি হচ্ছে আপনার? আমি নিশ্চয় কোনদিন আপনার ক্ষতি করিনি?”

আবির এই পর্যায়ে শক্ত স্বরে উত্তর করে,

“ আমি তোকে ইগ্নোর করেছি বরাবর এটা সঠিক!তবে উপহাস করিনি কখনো ছুটি। ”

ছুটি হেসে উত্তর করে এবারে,

“ এই যে কন্টিনিউসলি করছেন। এখনো করছেন। ”

“ করছি? কিভাবে? ”

“ জানেন আপনি। ”

আবিরের মেজাজ খারাপ লাগে যেন এবারে। এই মেয়েটাকে সহজ সরল ভাবা বোধহয় ভুল ছিল তার। নয়তো এতগুলো দিন লুকিয়ে লুকিয়ে তার উপর রাগ পুষত? সরাসরি কিছু না বলে ভুল বুঝত? এভাবে বদলে যেত? আবির দাঁতে দাঁত চাপে এবারে। বলে,

“ জানি না বলেই জিজ্ঞেস করেছি। কথা ঘুরাবি না। তোর মতো ঘুরানো পেঁচানো কথা আমি বলি না। কাজেই তোর ঘুরানো পেঁচানো কথার অর্থ বুঝতে আমার কষ্ট হয়।”

“ঘুরানো পেচানো তাও ঠিক আছে আবির ভাই, কিন্তু ভেতরে এক বাইরে আরেক হলে? তখন কি করে মেনে নেওয়া যায় বলুন? ”

“ মানে? ”

ছুটি শ্বাস টানে। কিছুটা সময় চুপ থেকে ভেবে চিন্তে হুট করে বলে,

“ কিছু না।ভালো থাকুন, যাকে ভালোবাসেন তাকে নিয়ে সুখে থাকুন এই প্রার্থনাই করি আবির ভাই। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে হাসির পাত্র বানানো তো শেষ তাই না? উপহাস তো অনেকটাই করলেন বন্ধুদের সাথে নিয়ে। এবার ছাড় দিন আমায় এসব থেকে। আর হ্যাঁ, একটাই অনুরোধ! আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবেন না।এই অনুরোধটুকু রাখবেন প্লিজ!”

কথাটুকু বলেই ছুটি কল রেখে দিল। বোধহয় ওপাশ থেকে আবারও কল আসবে। বোধহয় না। অবশ্যই আসবে। ছুটি তা জেনেই মুহুর্তের মধ্যে আবিরকে ব্লকলিস্টে ফেলল। যত জায়গায় যোগাযোগ করার পথ থাকে সব কিছু থেকেই সে আবিরকে ব্লক করল। পরমুহৃর্তেই সিদ্ধান্ত নিল সে এই শহর থেকেও হারিয়ে যাবে। এই শহরও তো তার কাছে বিষাক্ত ঠেকে। প্রতিটা নিঃশ্বাস বিষাক্ত ঠেকে!

.

ভোরের দিকে সুহার যখন ঘুম ভাঙ্গল চোখ গেল স্বচ্ছর দিকে। টের পায় স্বচ্ছর এক হাত আঁকড়ে আছে তার পিঠ।জড়িয়ে রেখেছে। স্বচ্ছর সাথে এতগুলো দিন একসাথে ঘুমালেও স্বচ্ছ কখনো তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে নি। জ্বালিয়েছে ঠিক! তবে সুহার রাগের কাছে হার মেনে কখনো সুহাকে জড়িয়ে ধরার সাহসই করে উঠেনি হয়তো। আর যখনই সুহা এই প্রথম সুযোগ দিল তখনই আজ এই প্রথম স্বচ্ছ তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। ইচ্ছে করেই জড়িয়ে রেখে ঘুমানোর সময় বলেছিল,

“ তুমি চাইলে কাছে আসতে। তাই এতোটুকু কাছে টানা যায় ভাবলাম সুহাসিনী।তুমি যদি চাও আরেকটু বেশিই কাছে টানতে পারি। তবে সেটা দ্বিতীয়বার আপনাকে আমার ঘরে আনার পর ম্যাম। ”

সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল ঐ মুহুর্তে।আর সে তাকানো দেখেই স্বচ্ছ মুচকি হাসে। সুহার কপালে চুমু এঁকে বলে,

“ একবার বিয়ের অনুষ্ঠান মিস করেছি, তাই বলে বিয়ে বিয়ে ফিল না করেই বাসর সেরে ফেলব? অতোটাও অমানবিক নই সুহাসিনী। নয়তো তোমার সম্মতি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কাছে টানতাম। ”

সুহার ঐ মুহুর্তে কান মুখ গরম হয়ে এল যেন। ছিহ! স্বচ্ছ কি বুঝাল? সে বাসর করতে মরিয়া হয়ে আছে নাকি? নাকি সে স্বচ্ছকে বলেছে এমন কিছু? ছিহ! স্বচ্ছ এটা বলতে পারল? সুহার রাগ হয়। রেগে কিছু বলতে যেতেই স্বচ্ছ হাসে। ফের বলে,

“ এভাবে রেগে তাকিয়ে পাগল করে দাও সুহাসিনী। বারবার মাথার ভেতর তোমার রাগকে লজ্জায় পরিণত করার কৌশল আনতে বাধ্য করো। যায়হোক, তোমার হারামি দাদাজানকে রাজি করিয়েই বাসরটা সেরে ফেলব সুহাসিনী। আমি খুবই অপেক্ষা করে আছি। ”

সুহা মুহুর্তেই নাক মুখ কুঁচকাল। বলে,

“ছিঃ!”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে চাপা হেসেছিল। বলে,

“ কার যেন খুব অভিযোগ আমি তাকে এড়িয়ে যাই বলে? দূরে দূরে রাখছি বলি? কে যেন এটাকে শাস্তি হিসেবে নিয়ে কান্না করছিল? তাছাড়া কে যেন হসপিটালে চুমুর শোধবোধও করতে বলেছিল আমায়। তো করতে হবে না চুমুর শোধবোধ,ভালোবাসার শোধবোধ? ”

সুহা এরপর আর উত্তর করেনি যেন। চোখ মুখ খচে চোখ বন্ধ করে ছিল। নাহয় এই ছেলে আর কি যে বকবক করবে জানা নেই। সুহা কাল রাতের কথাগুলো ভেবেই শুকনো ঢোক গিলে। তাকায় স্বচ্ছর দিকে।তখনও চোখ বুঝে আছে স্বচ্ছ। তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়ে ঠেকেছে স্বচ্ছর গলায়,মুখে। সুহা এক হাতে চুলগুলো স্বচ্ছর মুখচোখ থেকে সরানোর চেষ্টা চালায়। অথচ পরমুহুর্তেই মনে হয় এই দৃশ্যটি তার দেখা অন্যতম সুন্দর একটি দৃশ্য।চোখ বুঝে আছে ছেলেটা। সুহা নড়চড় করতে গিয়েও করে না। চুল সরাতে গিয়েও সরায় না।চুপচাপ ঘুমঘুম চোখে দেখতে থাকে স্বচ্ছকে। মুখে আলতো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যেন আরো সুন্দর বোধ হয়।মুহুর্তেই তার বোধ হয় এই ছেলেটা সত্যিই সুন্দর। সত্যিই এই ছেলেটা সুদর্শন! সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সুদর্শন পুরুষটার দিকে। হাত বাড়ায় আলতো করে। স্বচ্ছর কপালে আসা চুলে হাত রেখে আলতো করে সরিয়ে দেয় তা। পরমুহুর্তেই হাত রাখে স্বচ্ছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে। হাত বুলিয়ে নিয়ে পরক্ষণে ছুঁয়ে দেয় স্বচ্ছ পুরু ঠোঁট,নাকের ডগা এবং গাল।অবশেষে গলার কাছটায় হাত নিতেই চোখে পড়ে গলায় উঁচু হওয়া জায়গাটা। অ্যাডমস অ্যাপল! সুহা যেন কেমন করেই চেয়ে থাকে। হাত এগিয়ে ছুঁয়ে দিয়েও যেন শান্তি মেলে না। সুহা ছোটশ্বাস ফেলে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেই স্বচ্ছর ঠোঁট বেঁকে উঠে এবারে। চোখ বুঝে রেখেই ঘুমঘুম স্বরে শুধায় এবারে,

“ চাইলে তো দুয়েকটা মর্নিং চুমুও দেওয়া যেত সুহাসিনী। শুধু শুধু এতক্ষন মুখ, ঠোঁট, দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে অ্যডামস অ্যাপলে গিয়ে পড়ে আছো।কাহিনী কি? ”

সুহার কাছে স্বচ্ছর ঘুমঘুম কন্ঠটা দারুণ শোনায় মুহুর্তেই। পরমুহুর্তেই কথার অর্থ বুঝে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার মানে এতোটা সময় স্বচ্ছ বুঝতে পারছিল সব? জেনেবুঝেই চুপচাপ শুয়ে ছিল? আস্ত ধূর্ত এক লোক তো। সুহা মনে মনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও উপরে উপরে ফুঁসে উঠে বলে,

“ আশ্চর্য!আমার চুল আটকে ছিল আপনার মুখে গলায়। তাই সরিয়ে নিচ্ছিলাম। ”

স্বচ্ছ তাও হাসে। সুহাকে সেভাবেই জড়িয়ে রেখে মুখ গুঁজে সুহার গলায়। ঘুমঘুম স্বরে চোখ বুঝে থেকেই বলে,

“ উহ! তোমার লজ্জা লুকানোর কৌশলটা দারুণ সুহাসিনী! ”

#চলবে….