#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩১
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
ছুটির সাথে যোগাযোগ হয়ে উঠেনি সপ্তাহখানেকের উপরে। সবকিছু থেকে আবিরকে ব্লক করেছে তো করেছে, পরপরই সব একাউন্ট ডিলিট করে হারিয়ে গিয়েছে।আবির অনেক খোঁজ করেও যখন ছুটির খোঁজ মেলাতে পারল না তখন পুরাতন কৌশল অনুযায়ী নিজের কাজিনদেরই কাজে লাগাল। কিন্তু কাজ হলো না। ছুটিরা নাকি বাসাতেও নেই! আবির বিস্মিত হয়। ছুটি এতোটা জেদি হতে পারে?বিশেষ করে তার ক্ষেত্রে? যে আবির বলতে সে এতোটা পাগল ছিল সে আবিরকেই সে এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে?এটা যেন আবিরের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে মাঝেমাঝে। কফির মগে চুমুক বসিয়ে নিধি আর সাদাফের দিকে তাকায় সে। দুইজনকে এক মগে চুমুক বসাতে দেখে মুখ কুঁচকে বলে,
“ একটা মেয়ে! কেবল একটা মেয়ে আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। আর তোরা বসে বসে আমার দুঃখ দেখছিস৷ স্বার্থপর বন্ধুবান্ধব।”
সাদাফ মুখ কুঁচকাল আবিরের কথা শুনে। কফির মগে চুমুক বসিয়ে সেও আরাম করে বলে,
“ তোমার মনে এক বাইরে এক৷ বুঝবে কি করে সে মেয়ে? মনে মনে যে ভালোবেসে এসেছো তা এতকাল বলোনি কেন তা? এখন ভুল বুঝে বসে আছে। ”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
“তোর জন্যই শা’লা। অনুভূতি ব্যবহারের প্রসঙ্গ নয়তো আসতই না। ও বোধহয় তোর সেই প্রস্তাবটাই কারোর থেকে শুনে নিয়েছে।নয়তো ও কেন বলল ওর অনুভূতি আমি ব্যবহার করেছি? ”
সাদাফও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করে,
“ আসলেই তো ব্যবহার করেছিস। আমরা বলার পর তুই নাটক করলি কেন হারামি? ”
আবির তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ঠোঁট চেপে উত্তর করে,
“ ওটা নাটক না, সত্যিই আমি ভালোবাসতাম ওকে। কিন্তু প্রকাশটা করেছি তোদের কথাতে। ভাবলাম যে কোন এক ভাবে প্রকাশ পেলেই তো হচ্ছে। আজ হোক বা কাল এমনিতেও তো প্রকাশ করব। ”
সাদাফ সঙ্গে সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
“ এই যে আমাদের থেকে লুকিয়ে গেলি? এর শাস্তি। একেবারে ফাইন হয়েছে। তোর বউ ভেগে যাক কারোর সাথে, তাও দুঃখ করব না। শা’লা কত বড় মীরজাফর যে এক মেয়েকে এতদিন ধরে ভালোবাসছিস আর আমাদেরকেই বলিসি নি। তুই বন্ধু ভাবিস তো আমাদের? ”
“ তোরা যা হা’রামি এই কারণেই বলিনি। ”
আবির কথাটা বলেই বিরক্ত হয়ে চলে যায়। অপর দিকে সাদাফ হা হুতাশ করতে করতে নিধির দিকে তাকায়। বলে,
“ আমি হা’রামি ? এই নিধি? তুই বল আমি হা’রা’মি? ও আমায় এটা বলতে পারল? ”
নিধিও দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর করে,
“ না,তুই তো মহান! তোর মতো ভালো ছেলে দুনিয়ায় আছে? ”
সাদাফ যেন খুশি হয়। হেসে শুধায়,
“ তবে তোর বাপ হলো চরম লেভেলের হা’রামি! স্বচ্ছ বিয়ে করে ফেলেছে, আবিরও একই লাইনে৷ আমি সে কতবছর আগে থেকে প্রেম করেও বিয়ে করতে পারছি না তোর বাপের জন্য। বয়স তো হচ্ছে নাকি!”
নিধি এই পর্যায়ে সিরিয়াস ভাবে চাইল। বলে,
“ আব্বু তো কোনকালেই মানবে না। তাই বলে কি কখনোই বিয়ে করবি না আমায়? ”
সাদাফ মজা করেই বলে এবারে,
“ করব না, তোরা বড়লোক মানুষ। পরে বলবে উনাদের সহজ সরল মেয়েটাকে আমি ফাঁসিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি। এসব বলে যদি কেইস মামলা দিয়ে দেয়? নিশ্চায়তা আছে নাকি? ”
নিধি এবারে রেগে তাকায়। যেন সাদাফের গলা চেপে ধরবে। ধারালো চাহনিতে বলে,
“ বিয়ের বয়স পেরিয়ে এসেছি শুধু তুই বিয়ে করবি বলে। এখন যদি বিয়ে না করিস তাহলে কিন্তু.. ”
“ কি করবি? মে’রে দিবি? ”
তৎক্ষনাৎ নিধি গলা চেপে ধরে সাদাফের। রেগে বলে,
“ হু! মে’রে ফেলব। ”
.
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরর।একটা লোক ওখানে পড়ে আছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে ক্লান্ত,ব্যাথিত হয়ে আছে। পা দুটোতে বেশ মারার কারণে উঠে দাঁড়াতে পারছে না যেন৷ স্বচ্ছ দুই পা এগিয়ে যায়। ভেঙ্গে থাকা পা দুটোতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“ এতকাল ভাবলে আমি আর দেশে ফিরব না।ছন্নছাড়া হয়ে কাঁটিয়ে দিব। সংসারী হবো না। বিজন্যাসে নাক গলাব না। বিজন্যাস সবটাই তোমার থাকবে তাহলে। কিন্তু যখনই দেখলে আমি তো সংসারী হয়ে যাচ্ছি, বউবাচ্চা নিয়ে সংসার করে এখানে থাকারই প্ল্যান করে ফেলছি তখনই সোজা মেরে ফেলতে চাইলে আমায় চাচ্চু? সেদিন যদি আমি মরে যেতাম? বা আমার বউটা মরে যেত? তোমার এতোটা সাহস কি করে হলো চাচ্চু? আমার বউকে সহ তুমি মেরে ফেলতে চেয়েছো চাচ্চু? ও কি করেছে তোমার? ”
সারোয়ার সাহেব দৃঢ় নজরে তাকান। রাগে উনার গা জ্বলছে যেন। ইচ্ছে হচ্ছে স্বচ্ছকে এই মুহুর্তেই মেরে ফেলতে। কিন্তু পারলেন না তা। বললেন,
“ কিচ্ছু করিনি আমি। ”
স্বচ্ছ হাসে। বলে,
“ করেছো! আমার কাছে প্রুভ আছে চাচ্চু। শুধু থানা পুলিশে জড়াচ্ছিনা তোমায় পরিবারের কথা ভেবে, তিহানের কথা ভেবে।”
সারোয়ার সাহেব আবারও জেদ নিয়ে বলেন,
“ আমি সত্যিই করিনি কিছু। ”
স্বচ্ছ ফের হাসে। উত্তর করে,
“ তুমি সে ট্রাক ড্রাইভারকে কল করেছে, টাকা দিয়েছো সব প্রুভ আছে চাচ্চু। সব! কেন নাটক করছো বলো?”
সারোয়ার সাহেব এবারে চোখ গরম করে তাকায়। ধমকে বলে,
“স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছ হাসে। চাচ্চুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ চোখ গরম করলে সত্যিটা মিথ্যে হবে? তোমায় কত ভালোবাসতাম বলো তো? সেই তুমিই আমায় একটুও ভালোবাসতে না? মানতে কষ্ট হচ্ছে। চাইলে বলতেই পারতে যে বিজন্যাসে নাক গলাবি না। গলাতাম না। বউ নিয়ে জলে যেতাম দেশের বাইরে। তুমি তো এমনটা নাও করলেও পারতে চাচ্চু। ”
.
স্বচ্ছ তখন বাইরে থেকে এসেছে। ঘামে চিপচিপে হয়ে লেপ্টে আছে শার্টটা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। চোখমুখ দেখে বুঝা যায় সে খুব ক্লান্ত। স্বচ্ছ বাসায় এসেই গা এলিয়ে দিল বিছানায়৷পরপরই অনুভব হয় পাশে এসে বসেছে সুহা। স্বচ্ছ সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকায়। সুহাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুধায়,
“ কি?চুমু খাবে? ”
সুহা মুহুর্তে রেগে তাকায়। একটু তাকাতেও শান্তি নেই এই লোকের জন্য। জেদি স্বরে শুধায়,
“ সবসময় কি এসবই ভাবেন অস্বচ্ছ সাহেব?
স্বচ্ছ ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,
“ তুমি যেভাবে তাকিয়ে আছো এসবই মাথায় আসে। ”
সুহা অন্যদিক ফিরে উঠে দাঁড়ায়। রেগে বলে,
“মাথাটাও স্বচ্ছ না। ”
কথাটা বলেই পা বাড়ায় সে। একটা শাড়ি আর তোয়ালে নিয়ে যায় ওয়াশরুমে গোসলের উদ্দেশ্যে। স্বচ্ছ সেদিক পানে একবার তাকিয়েই হাসে। পরমুহুর্তেই কিছুক্ষন গড়াগড়ি করে পা বাড়ায় ছাদের দিকে।
.
সুহার পরনে আজ শাড়ি। গোলাপি রংয়ের শাড়িকে হালকা সাদা রংয়ের কাজ। সুহাকে অবশ্য শাড়িটায় সুন্দর মানাচ্ছে। একদম মিষ্টি এক বউ লাগছে। সুহা যখন শাড়িটা পরে সর্বপ্রথম রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল তখনই এগিয়ে এল সিয়া। উচ্ছাস নিয়ে বলে উঠল,
“ তোমায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবি! ভাইয়া দেখেছে? ও, ভাইয়া তো ছাদে। ডেকে আনি ভাবি? ”
সুহা হাসে মৃদু। বলে,
“ এতোটা খুশি কেন আজ? কি ব্যাপার শুনি সিয়া বুড়ি? ”
সিয়া এই পর্যায়ে লাজুক হাসে। উত্তরে কিছুই বলে না। তবে পরমুহুর্তেই বলে উঠে,
“ তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে৷ সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবি। খুব জলদি জলদি ফুফু হওয়ার আনন্দটাও দিয়ে দাও দেখি। ”
সুহা সিয়ার গালে হাত রেখে শুধায়,
“ তাই নাকি? পিচ্চি থেকে দেখছি বড় হয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে সিয়া বুড়ি? ”
সিয়া হাসে। বলে,
“ তোমার বন্ধুকে দেখলাম নিচে দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন নাম? সাদ। প্রতিদিনই দেখি দাঁড়িয়ে থাকে। কেন থাকে বলো তো? ”
“ তা তো ঠিক জানি না। ”
“ আমি যখন প্রশ্ন করি তখনই তোতলামো স্বরে উত্তর করে। তুমি কি জানো ছেলেদের তোতলানোর মানে কি? ”
সুহা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ কি? ”
সিয়া তখন অভিজ্ঞদের ন্যায় শুধাল,
“ কোন ছেলে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোতলাচ্ছে মানে সে কোন বিষয়ে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পরছে বুঝলে? হতে পারে না সে তোমার প্রতি দুর্বল বলেই তোমার সামনে কথা বলতে তোতলায়? ”
সুহা ভাবে, সাদ তো রাহাকে পছন্দ করে। সিয়া বোধহয় ভুল ভাবছে।হয়তো সিয়া সাদকে পছন্দ করে। সুহা কি বলে দিবে সাদ যে রাহাকে পছন্দ করে?সুহা ভাবতে ভাবতেই আনমনে শুধায়,
“ হতেই পারে। তবে সাদ তো…”
সিয়া বলে,
“ কি?
সুহা পরমুহুর্তেই ভাবে সিয়া যদি মন খারাপ করে?তাই আর বলে না। উল্টো বলে,
“ কিছু নয়, আমি বরং তোমার ভাইয়ার কাছে যাই হুহ?”
সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে শোনা গেল গম্ভীর পুরুষালি স্বর,
“ যেতে হবে না, চলে এসেছি। ”
সুহা আনমনে বলে,
“হ্ হু? ”
স্বচ্ছ তাকিয়ে দেখে তার শাড়ি পরিহিতা বউটিকে। নজর যেন সরে না। ভেজা চুলোগুলো খোলা। টপটপ পানি গড়াচ্ছেে।স্নিগ্ধ মুখশ্রী। সাথে গোলাপি সুতির শাড়িটা। যেন একদম বউ বউ! স্বচ্ছ ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরতে এই মেয়েটাকে। কিন্তু ধরে না। বরং বলে,
“ শাড়ি পড়লে ভুলেও ছাদে যাবে না। আমি ছাদে থাকলেও যাবে না। মনে থাকবে? ”
সুহা হাসে। বলে,
“ ইনসিকিউরড ফিল করছেন? ”
স্বচ্ছ এবারে ভ্রু উঁচায়। ইনসিকিউরড শব্দটা তো রোহানও ব্যবহার করেছিল। স্বচ্ছ তা মনে করেই টানটান স্বরে জানায়,
“ তোমার সে তথাকথিত প্রেমিকও একই কথাই বলল। ইনসিকিউরড ফিল করছি নাকি আমি। দুইজনের শব্দভান্ডারও মিল আছে দেখছি। ”
কথাটা বলেই স্বচ্ছ রুমে এল। সুহার মন খারাপ হয় ফের।স্বচ্ছ এখনও ভুল বুঝছে? এখনো? সুহা কতোটা ফুরফুরে মেজাজে আজ শাড়ি পরেছিল। কতোটা আনন্দিত ছিল৷ সব আনন্দকে মাটি করতে স্বচ্ছর এক মিনিটও সময় লাগে না যেন। সুহা পিছু পিছু রুমে আসে। দৃঢ় জবাবে বলে,
“ ভুল বুঝছেন স্বচ্ছ।সে আমার প্রেমিক নয়।”
স্বচ্ছ এবারে তাকায় কেমন করে। সুহা বুঝে উঠে না, একটা ছেলে একটু আগেই কত ভালোভাবে কথা বলছিল আর এখন? কি হলো? সুহা বুঝার চেষ্টা চালাতেই স্বচ্ছ বলে,
“ হাসছিলে কেন তাহলে সেদিন ওর সাথে? রাহার জম্মদিনে এত ছেলে থাকতে ও কেন ইনভাইটেশন পেল? কি হলো? বলো! ”
সুহা ছোটশ্বাস টানে৷ স্বচ্ছর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে,
“ স্বচ্ছ? আপনি সত্যিই একটা বাচ্চা ছেলে। একটা মেয়ে চারটা বছর আপনার জন্য অপেক্ষায় ছিল। চারটা বছর সে আপনি বিনা অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়নি। আপনার কেন মনে হয় যে আমি রোহানকে ভালোবাসব? দেখেছেন কখনো উনার জন্য ভালোবাসা আমার চোখে? ”
স্বচ্ছ এবারে আচমকায় কোমড় জড়িয়ে ধরে সুহার। কাছে টানে। কিছুটা ঝুঁকে বলে,
“তবুও আমার পছন্দ নয়।যে ছেলে তোমায় চায় সে ছেলের আশেপাশে থাকবেই বা কেন তুমি? ”
সুহা এবারে উত্তরে বলে,
“ রোহান আমায় পছন্দ করে প্রথমদিকে এটা সঠিক ছিল স্বচ্ছ। তবে আপনি আসার পর এই যে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথাবার্তা যা আপনার বাবার থেকে শুনেছেন বা বিভিন্ন ভাবে শুনেছেন সেসব মিথ্যে বা নাটক ছিল। যেমনটা প্রথবার আপনাদের বাসায় এংগেইজমেন্ট একটা নাটক হয়েছিল আপনার আব্বু আম্মুর কথাতে তেমনই।একপ্রকার রোহান সাহায্য করেছিল ওসব যাতে আপনি আরেকটু অনুভূতিপ্রবন হোন। এবং যেদিন উনাকে মারলেন সেদিনও মেবি বড়বড় স্বরে এটাই উনি জানাচ্ছিলেন যে উনি আমাকে ভালোবাসেন। আর আপনি নাকি নাক ফুলিয়ে উঠে রেগে মারধর করছিলেন বারবার।যতই আপনাকে বলা হচ্ছিল ততই তান্ডব করছিলেন,মুখ খারাপ করছিলেন। আপনাকে এসব বলে জ্বালাতে নাকি উনার অনেক ভালোই লাগছিল। এসবই বলছিল।পরে বলল কেমন জ্বলে উঠেন আপনি তার সরাসরি দেখব কিনা? আমি কিছুই উত্তর করলাম না। তার আগেই উনি আপনাকে কল দিলেন। কত কথা বললেন। আর আপনি তো রেগে রেগে কথা শুনাচ্ছিলেন সাথে কিছু গা’লি ছুড়িছিলেন। আমি আপনার সেসব কান্ডকারখানা শুনে হাসছিলাম। সত্যি বলতে হাসি চলে আসছিল! একটা ছেলে কতোটা বাচ্চা হলে এমন বাচ্চামো দেখাতে পারে? কেউ বলছে আর আপনিও বিশ্বাস করে নিচ্ছেন। কতোটা বোকা ভাবুন!প্রথমে সাদকে মারধর করলেন, পরে রোহানকে। এখন বলুন, হাসা কি অন্যায় হয়েছে সেদিন আমার? আপনাকে নিয়েই তো হাসলাম।”
স্বচ্ছ গলে না তবুও। মুখ তখনও কঠিন। সুহাকে সেভাবে জড়িয়ে রেখেই বলে,
“ডিভোর্স লেটার যে পাঠালে? চার বছর যাবৎ ভালোবাসলে ডিভোর্স লেটার পাঠানোর সাহস হলো কি করে? ”
“ ওটা দাদাজান করেছে। দাদাজান ব্যাতীত বাকি সবাই, আমি, সিয়, আপনার আব্বু আম্মু, রাহা সবাই এই বিয়েটার পক্ষে ছিলাম স্বচ্ছ। মুখে যাই বলি। ”
স্বচ্ছ এবারে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“ শুধু শুধুই জ্বালিয়ছো? ”
“ প্রাপ্য ছিল আপনার ওটা।”
“ যাই হোক ঐ রোহানকে আমার পছন্দ নয়।দূরে থাকবে ওর থেকে। আর তোমার ভিলেইন দাদাজান? এখনও চাল চেলে যাচ্ছে। রোহানের ঐ বেহায়া পরিবার তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল কেন হুহ?”
সুহা উত্তর দেয়,
“ রাহাকে দেখতে। উনারা নাকি রাহার সাথে রোহানের বিয়েটা দিতে চাইছেন। ”
স্বচ্ছ এবারে দাঁতে দাঁত চেপে শুধায়,
“ শা’লা বড়বোনকে না পেয়ে এবার ছোটবোনের দিকে হাত বাড়াচ্ছে? মে’রে ওর হাত যদি না ভেঙ্গে দিই। ”
“ সবকিছুতেই মা’রপিট আসে কেন?পারিবারিক আলাপ হচ্ছে। বিয়েটা তো হয়ে যাচ্ছে না। আর আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব যাতে রাহার বিয়েটা দাদাজান এখানে ঠিক না করেন তা নিয়ে৷ বুঝলেন? এবার শান্ত হোন। ”
স্বচ্ছ শান্ত হয় যেন। সুহার দিকে তাকায় এবারে প্রেম নজরর। কিছুটা ঝুঁকে ঠোঁট বসায় সুহার কপালে। বলে,
“ হলাম শান্ত, স্যরি ভুল বুঝার জন্য। প্রথমে ভেবেছিলাম এক্সিডেন্টটা রোহান করিয়েছিল। আর কেন জানিনা তোমায় ছাদে কথা বলতে দেখে মনে হয়েছিল তুমিও ওকে ভালোবাসো। মূলত ও কথাগুলো বলেছিলই ওভাবে। ”
সুহা ফের বলে,
”কথাগুলোও উনি আমার সামনেই আপনাকে ফোনে বলছিল। দেখাচ্ছিল আপনার ভাষা কেমন চেঞ্জ হয়ে যায়। আর আমার সম্পর্কে বললেই আপনি কেমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেন। মূলত সে কারণেই আরো হাসি পাচ্ছিল আমার। আমি আপনার রাগ দেখে হেসেছিলাম ঠিকই কিন্তু আপনি যে আমায় ভুল বুঝে বসে থাকবেন এটা সত্যিই বিশ্বাস ছিল না। পরে দেখলাম সত্যিই ভুল বুঝে নিয়েছেন,ঐ ছেলের সামনেই যেভাবে সেভাবে প্রশ্ন ছুড়ছিলেন। মাথা গরম হয়ে গেল। ব্যাস! আমিও কত কি বলে ফেললাম। কিন্তু কষ্ট ফেলাম যখন বুঝলাম যে আপনি আমায় এক্সিডেন্টটার জন্য দোষারোপ করছিলেন। আমি সত্যিই এক্সিডেন্টটটা করাতে পারতাম?কিভাবে ভাবতে পারলেন এটা?”
স্বচ্ছ বোকাবোকা চোখে তাকায়। সুহার গালে চুমু বসিয়ে বউকে মানানোর জন্য বলে,
” কারণ ঐ রোহান ওভাবে বলেছিল। আমার দোষ নেই। ”
সুহা দৃঢ় স্বরে জানায়,
“ আমায় কতগুলো দিন এড়িয়ে গিয়েছেন। ”
স্বচ্ছ হাসে সুহার অভিমান দেখে। বলে,
“ তুমিও তো এড়িয়ে গেলে। ভাগ্যিস এড়িয়ে গিয়েছিলাম। নয়তো তো কখনোই আর এমন ভালোবাসার রূপ দেখাতে না, সবসময়ই এড়িয় যেতে। ”
.
আবির তখন ঘুমে। বার কয়েক কল এসেছে ফোনে। বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েই আবির চোখ মেলে তাকায়। ফোনে কাজিন ফিহার নাম্বার দেখে তড়িঘড়ি করেই কল রিসিভড করে। বলে,
” এমন ছাগলের মতো কল করছিস কেন? খোঁজ পেয়েছিস ছুটির? ”
ওপাশ থেকে ফিহা জানায়,
“ পেয়েছি বড়ভাইয়া। ”
আবির রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। বলে,
“ আছে কোথায় ঐ বেয়াদব? ”
“ গ্রামের বাড়ি। মানে ছুটি আপুদের গ্রামের বাড়িতে ভাইয়া। ”
ফের রেগে শুধায়,
“ ওর সাথে যোগাযোগ হলে বলবি ও যে সবকিছু থেকে আমায় ব্লক করে এভাবে সবকিছু থেকে হারিয়ে গিয়েছে তার শাস্তি আমি কানায় কানায় পূর্ণ করে দিব ওকে। একটুও ছাড়ব না। ”
ফিহা উত্তর দেয় না। কিছুটা সময় চুপ থেকে কাচুমাচু স্বরে বলে,
“ ভাইয়া? ”
“ কি হয়েছে? ”
ফিহা বলে,
“ ছুটি আপুর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।তাও উনার কোন এক কাজিনের সাথে। ছোটনের থেকেই শুনলাম। ”
ছোটন ছুটির ছোট ভাই। ওর থেকে শুনেছে যেহেতু মিথ্যে শুনেনি নিশ্চয়?তবুও আবির অবিশ্বাস নিয়ে বলে,
”কি বললি? আবার বল। ”
” ওদের পুরো ফেমিলিই বাড়িতে গিয়েছে।ছোটন কাল এল। ওর থেকেই জানলাম যে ছুটি আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামীকাল নাকি আপুর এইংগেইজমেন্ট! ”
আবিরের রাগে মাথা ধপধপ করে। টগবগ করে শিরা উপশিরায় বহমান রক্তকণিকা। শুধায়,
“ ছুটির এত সাহস? ”
ফিহা আরো বলে,
“ ছুটি আপু নিজেই বিয়েটা করার জন্য মাতামাতি করছে। পুরো পরিবার বলছে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে, কিন্তু আপু নাকি একাই জেদ ধরেছে বিয়ে সে করবেই। ”
আবির দাঁতে দাঁত চাপে। বলে,
“ করাচ্ছি ওকে বিয়ে! ”
কথাটা বলেই ফোনটা ছুড়ে মারে আবির। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“খুব সাহস দেখিয়ে ফেলেছিস ছুটি। খুব বেশি! ভেবেছিলাম এবার ভালোবাসার অধ্যায়টা শুরু করব তোকে নিয়ে। তুই হতে দিলে তো? মেজাজটাই খারাপ করে দিলি। তুই কি ভেবেছিস? এত সহজ নাকি অন্য একজনকে বিয়ে করে নেওয়া? আমি টের পাব না? শুধু দেখ তোকে আমি কতোটা কষ্ট দিই এবারে। শুধু দেখবি! ”
#চলবে….
#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩২
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
স্বচ্ছ আগে আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে গেল আজ। সকালে আবিরকে আনতে যাবে। আবির একটু আগেই তাকে জানিয়েছে যে ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে সে দেশে ফিরছে।এবং কেন ফিরছে সে কারণ টুকুও বলেছে। খবরটা শুনে স্বচ্ছ নিজে বিস্মিত হয়। মনে মনে ভাবে নারী আসলেই অবহেলা পেয়ে সব করতে পারে। যেমন সুহাও ভালোবেসে তাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেনি। স্বচ্ছ ভাবে যদি কখনো সুহাও এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়? যদি কখনো সেও সুহাকে অবহেলা করে বসে? না, না! সে এবার থেকে দরকার হলে বউকে সারাক্ষণ ভালোবাসবে। তবুও বউ হারাতে দিলে চলবে না। স্বচ্ছ এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বুঝে। অপরদিকে সুহা কিঞ্চিৎ অবাক হয়। স্বচ্ছের অসময়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণ কি তা চিন্তা করে। তারপর নিজেও খাওয়ার সময়ে খেয়ে এসে আলো নিভিয়ে একপাশে শোয়। একদিকে কাত হয়ে শুঁয়ে স্বচ্ছর ঘুমন্ত মুখটা মৃদু আলোতে পর্যবেক্ষন করে কিছুটা সময় ধরে। পরমুহুর্তেই অপর পাশে মুখ করে শোয় সুহা। ঠিক তখনই টের পায় সে স্বচ্ছ ঘুমোয় নি।বরং জেগে আছে।গোলাপি সুতি শাড়িটার তলেই অবস্থান নিয়েছে স্বচ্ছর অবাধ্য হাত।স্পর্ষ করেছে সুহার উদরের মসৃন ত্বক। পরক্ষণেই কিছুটা কাছে টেনে নিল নিজের দিকে।খোঁচা দাঁড়ি সমেত মুখটা ঘেষে সুহার পিঠে। সুহা তখন কিঞ্চিৎ কাঁপে। মিনমিনে স্বরে বলে,
“ না ঘুমিয়েও এমন মরার মতো পড়ে থেকে ঘুমের অভিনয় করার মানে কি স্বচ্ছ? সবসময় ঘুমের অভিনয় করেন আপনি। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে এবারে। সুহারে পিঠে সেভাবেই মুখ ঘেষে থেকে ঠোঁট নাড়িয়ে শুধায়,
“ দেখছিলাম তুমি আমার ঘুমের মাঝে কি কি সুযোগ নাও।তুমি যা সুতরাং সুযোগসন্ধানী!”
কথাগুলো বলার সাথে সাথেই স্বচ্ছর ঠোঁটজোড়া বারংবার স্পর্শ করে সুহার পিঠ। সাথে খোঁচা দাঁড়ির আলতো সংঘর্ষ! সুহা চোখ খিঁচে। কন্ঠে রাগ নিয়ে শুধায়,
“ আমি সুযোগসন্ধানী?”
স্বচ্ছ তখনও মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সুহার পিঠে। উত্তরে বলে,
“ সেদিন তো ঘুমের মধ্যে পুরো মুখেই হাত বুলিয়ে দেখলে। গলায় এ্যাডামস এ্যাপলে তো আটকেই গেলে। ”
সুহা এবারে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়েই বলে,
“ স্বচ্ছ! ”
“কি? ”
“মুখ ঘেষছেন কেন এভাবে? আপনার খোঁচা দাঁড়িগুলো লাগছে। ”
স্বচ্ছ এবার মুখ নিয়ে ঠেকাল পিঠ থেকে সুহার কাঁধে। ফিসফিস স্বরে শুধায়,
“ লাগুক। ”
ফের আবার শুধায় গাঢ় স্বরে,
“ সুহাসিনী? ”
“ হু? ”
স্বচ্ছ সেভাবেই জড়িয়ে রেখেই গমগম স্বরে শুধায়,
“ শাড়ি পরেছো কেন আজ?”
সুহাও তৎক্ষনাৎ উত্তর করে,
“ইচ্ছে হয়েছে তাই। ”
স্বচ্ছ হাসে এবারে। কাঁধে নাক ঘেষে শুধায়,
“ নাকি আমায় পাগল করার জন্য? ”
সুহা এবারে ফিরে তাকায়। স্বচ্ছর মুখোমুখি করে মুখ রেখে বলে,
“ আপনি পাগল হয়েছেন? ”
স্বচ্ছ আবছা আলোয় তাকায় তার সুহাসিনীর দিকে। মোহময় লাগছে বোধহয় এই মেয়েটাকে। স্বচ্ছর তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয় যেন। ইচ্ছে হয় এই মেয়েটাকে কাছে টানতে, ছুঁয়ে দিতে। কে বলেছিল সারাটা দিন শাড়ি পরে পরে টইটই করে ঘুরে বেড়াতে তার আশপাশে? বলেছিল স্বচ্ছ? এই যে এখন রাত্রিতে এসে তার বউ বউ ফিলিংস হচ্ছে বউয়ের প্রতি? দোষ কার? স্বচ্ছ বিড়বিড় স্বরেই জানায়,
“ হতে মন চাইছে। ”
সুহা হাসে এবারে। স্বচ্ছর মাথার চুলে হাত রেখে বলে,
“ আপনি তো এমনিতেও পাগল।”
কথাটা শুনে স্বচ্ছ শান্তভাবেই চেয়ে থাকে। মিনিট খানেক পর আগের মতোই সুহাকে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠে,
“ তুমি কখনো হারাবে না সুহাসিনী। আমার থেকে কখনো হারাবে না। চিন্তাও করবে না। কথা দাও হারাবে না!”
হুট করে এই কথার অর্থ বুঝে উঠে না সুহা। তবুও শুধায়,
“কেন মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাব? ”
স্বচ্ছ তখন উত্তরে বলে,
“ অবহেলা পেয়ে নারী নাকি জেদ করে সব করতে পারে। যদি কখনো তোমায় অবহেলা করি তবুও মেনে নিবে, আমার থাকবে।আমার প্রতি ভালোবাসা যাতে না পুরায় সুহাসিনী!”
“অবহেলা করবেনই কেন? ”
স্বচ্ছ এবারে ঠোঁট বাঁকায়। সুহার নাকে নিজের নাক ঠেকিয়ে ফিচেল স্বরে শুধায়,
“ ভালোবাসা উচিত তাহলে? ”
সুহা এতক্ষন দৃঢ় স্বরে জবাব দিয়ে আসলেও এই একটা প্রশ্নেই বোধ করল তার উত্তর আসছে না। গলা আটকে আসছে। লজ্জ্ব্ পাচ্ছে কি সে? সুহা তবুও কোনরকমে শুধায়,
“ যা ইচ্ছে। ”
স্বচ্ছ এবারে আবারও হাসে। নাকে নাক ঠেকিয়ে আগের মতো করেই ফিচেল গলায় জিজ্ঞেস করে,
“যা ইচ্ছে? শিওর তুমি সুহাসিনী? যা ইচ্ছে করার অনুমতি দিচ্ছো তাহলে?”
সুহার এই পর্যায়ে ইচ্ছে হয় লোকটার মাথায় ঠাস করে এক থাপ্পড় বসাতে। বারবার তাকে লজ্জায় ফেলছে। বারবার ইচ্ছে করেই এমন ভাবে বলছে কথাগুলো। সুহা রেগেই শুধায়,
“ স্বচ্ছ! ইচ্ছে করেই এমন করছেন তাই না? লজ্জায় ফেলছেন আমায়? ”
স্বচ্ছ মজার স্বরে শুধায়,
“ লজ্জ্বা পাচ্ছো তুমি? সুহাসিনী লজ্জাও পায়? ”
সুহা তখন ধমকে বলে উঠে একমুহুর্তে,
“ মজা করবেন না একদম! ”
.
আবির ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে দেশে ফিরেছে ভোরভোরই। তখনও বাংলাদেশে সকাল হয়ে উঠেনি৷ আবির তখনও রাগে হাঁসফাঁস করে। কিভাবে যে এতোটা সময় সে নিজেকে শান্ত রাখছে তা বোধহয় সে নিজেই বুঝে উঠে না। আবির শান্ত প্রবৃত্তির ঠিক। তবে প্রচন্ড রেগে গেলে ওকে মানানো কঠিন। ছুটির বোধহয় ধারণাও নেই আবিরের এই রাগটা কতোটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে তার উপর। আবির স্বচ্ছকে আগেই জানিয়েছিল যে দেশে ফিরছে। স্বচ্ছও সে অনুসারে গাড়ি নিয়ে এসেছিল বন্ধুকে নিয়ে যেতে। অবশেষে যখন বন্ধুকে দেখতে পায় তখনই এগিয়ে আসে। হেসে শুধায়,
“ তোর বউ তো আমার বউয়ের থেকেও ডেঞ্জারাস রে আবির। এতকাল সহজ সরল সেঁজে এখন এই কঠিন রূপ! সাংঘাতিক! ”
আবিরের মন মেজাজ ভালো নেই। সঙ্গে ব্যাগপত্র তেমন কিছুই আনে নি সে। মন মেজাজের এই তিরিক্ষি অবস্থার মাঝে স্বচ্ছর কথাটা তার কাঁটা গায়ে নুন ফেলার মতোই বোধ হলো। শক্ত গলায় গাড়িতে উঠতে উঠতে শুধাল,
“ তোর বউয়েরই তো বান্ধবী৷ আগে ছুটি বেয়া’দব এমন ছিল না। আমি নিশ্চিত তোর বউই ছুটিটাকে এমন বেয়াদব বানিয়েছে। ”
স্বচ্ছ নিজের বউয়ের এহেন অপমান মেনে নিতে পারে না যেন। মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,
“ হু, এখন যত দোষ সব আমার বউয়েরই তাই না?”
আবিরও দাঁতে দাঁত চেপে শুধায়,
“ সব দোষ তোদের। তোর বউ খোঁজার চক্করে আমার ফিউচার বউ আমায় ভুল বুঝে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছে হা’রামি। ”
স্বচ্ছও বিরোধী স্বরে বলে,
“ মোটেই না। বরং আমার বউ খোঁজার চক্করে তোর সাথে ছুটির সম্পর্ক ভালোই হয়েছিল। মাঝখানে তুই কি করেছিন তুইই ভালো জানিস। ”
আবির ভাবে। সত্যিই তো। সম্পর্ক তো সুন্দর হচ্ছিল। ছুটি তো তখনও ঠিকঠাক ছিল। কথা বলত। এমনকি হসপিটালেও তো ঠিক ছিল। তারপর? তারপর হুট করে কি হয়ে গেল ছুটির? সেদিন যে হসপিটালে এই ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে ছুটির প্রতি সে নিরাগ্রহতা দেখিয়েছে তার কারণেই কি? এই অবহেলা টুকুর কারণেই এমন শাস্তি? আবির বুঝে উঠে না। পরমুহুর্তেই বন্ধুদের উপর দোষ চাপিয়ে বলে,
“ কিছুই করিনি। সব তোদের বদের হাড্ডিগুলার দোষ। এখন আমার বউ আমায় ফিরিয়ে দিবি, যেভাবেই হোক। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“মনে হচ্ছে যেন বিয়ে করা বউ তোর। ”
আবির তৎক্ষনাৎ উত্তর করে,
“ বিয়ে করা বউয়ের থেকেও ইম্পোর্টেন্ট। তুই বুঝবি না। ”
“হু, সব তো তুইই বুঝিস।
আবির রেগে তাকায়। বলে এবারে,
“ তো তুই বুঝিস? ”
স্বচ্ছ এবারে ঝগড়া এগোয় না। বরং শুধায়,
“ মাথা ঠান্ডা করে আগে ভাব ছুটির এংগেইজমেন্ট হয়ে গেল কিনা। ”
আবিরের দাঁত কিড়মিড় করে। ছুটির এংগেইজমেন্ট হলে সর্বপ্রথম সে ছুটিকেই মেরে ফেলবে। দ্বিতীয়ত নিজে মরবে। বলে,
“ হবে না, এই সাতসকালে এংগেইজমেন্ট অবশ্যই হবে না। ”
স্বচ্ছ ফের বলে,
“ ধর হয়ে গেলে? ”
আবিরের এই মুহুর্তে স্বচ্ছর গালে চড় বসাতে ইচ্ছে হয়। অথচ বসায় না। বলে,
“ তুই কি আমার সঙ্গে ফাইজলামি করছিস?”
“ ছিঃ! তোর এই বিপদে আমি ফাইজলামি করব? মনে হয় তোর? ”
“ তাই-ই তো মনে হচ্ছে আমার! ”
স্বচ্ছ এবারে রেগে তাকায়। বলে উঠে,
“ আবিরের বাচ্চা আবির, সাতসকালে বউ রেখে চলে এসেছি তোর বউ উদ্ধার করত। ফাইজলামি করার হলে নিশ্চয় আসতাম না? ছোটনকে পাঠাতাম না অনুষ্ঠান আটকাতে?”
আবির এবারে আগ্রহ নিয়ে শুধায়,
“ ছোটনকে কি বলে পাঠিয়েছিস? ”
স্বচ্ছ দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
“ কিছুই বলিনি, ওকে বাসে তুলে দিয়ে বলেছি ওর আপুর এইংগেইজমেন্টটা যাতে জমিয়ে খেয়ে আসে। কি? ভালো বলেছি না?”
“ তোর উচিত ছিল ওকে এইংগেইজমেন্ট আটকানোর জন্য বলা। ”
.
আবির আর স্বচ্ছরা ছুটিদের গ্রামের বাড়িতে পৌছায় দুপুরের আরো পরে। রাস্তায় জ্যাম ছিল। আবির ততক্ষনে কপাল চাপড়ায়। যদি এইংগেইজমেন্টটা হয়ে যায়? এই রাগে তার গাড়ি অব্দি ভেঙ্গে ফেলতে মন চাইছিল। রাস্তায়ই বা আজই এত জ্যাম থাকতে হবে কেন? আজই এত লেট হতে হবে কেন? আবির ভেতরে ভেতরে রাগে গিজগিজ করলেও বাইরে তাকে দেখায় শান্ত। চোখ দুটো রক্তিম ঠেকছে। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে এই মানুষটা এই মুহুর্তে সবচাইকে কঠিন রূপ ধারণ করে আছে। আবির পা বাড়ায়। ছোটনের থেকে জেনে নিয়ে ছুটির জন্য বরাদ্ধকৃত রুমে গিয়েই চোখে পড়ে ছুটিকে। বিছানায় বসে আছে। পরণে খয়েরি রংয়ের দামী শাড়ি। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। সাথে আবার কানে গুঁজেছে গোলাপ ফুল। নিঃসন্দেহে সুন্দর দেখাচ্ছে ছুটিকে। তবে আবিরের কাছে এই মুহুর্তে সব চাইতে তিক্ত দৃশ্য ঠেকে ছুটির এই সাজগোজটাই। অসহ্য ঠেকের।অন্য পুরুষের জন্য সেঁজেছে? অন্য পুরুষের জন্য এত বেশি টান ওর? আবির এগোয়। গম্ভীর মুখচাহনি নিয়ে ছুটিকে কয়েক সেকেন্ড দেখে নিয়েই আচমকা হাত চেপে ধরে। দাঁড় করায় তার সামনে। পরমুহুর্তেই এক হাত দিয়ে ছুটির গাল চেপে ধরে। গমগম স্বরে শুধায়,
“ বলেছিলাম না আমায় ঠকানোর সাহস করিস না ছুটি? বলেছিলাম কিনা?তুই সেই সাহসটাই করলি? এত সাহস তোর? ”
ছুটির গালটা এত জোরেই চেপে ধরা হলো যে ব্যাথায় কুকড়ে উঠল সে। আবিরকে এই মুহুর্তে প্রত্যাশা করেনি এটা যেমন ঠিক তেমনই আবিরের এমন আক্রমনও প্রত্যাশা করেনি সে। সাথে আবিরের শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলা কথাগুলো যেন হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে। ছুটি ব্যাথায় টলমল স্বরে শুধায় এবারে,
“ আবির ভাই? ব্যাথা পাচ্ছি আমি মুখে। ”
আবির হাসে। শান্ত গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ এইটুকু ব্যাথাই সইতে পারছিস না? অথচ তুই জানিসও না এই দুঃসাহস দেখানোর জন্য তোর কপালে ঠিক কতখানি দুঃখ লেখা আছে ছুটি! সইতে পারবি তো?”
#চলবে….
#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৩
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আবিরের কথাটা মুহুর্তেই ছুটিদের পরিবারের সবাই জানল। বাড়ির প্রত্যেকটা লোক যখন বহিরাগত এই ছেলেটার এবং ছেলেটার কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে পারল তখনই ছুটির বাবাও বিষয়টা জানতে পারল। হুড়মুড় করে মেয়ের ঘরে আসতেই চোখে পড়ল মেয়ের টলমল করা চাহনি। আরেকটু হলেই বোধহয় কান্না করে দিবে। আবির তখনও ছুটির গাল চেপে দাঁড়িয়ে কিছু বলছিল। তোফায়েল সাহেব মেয়ের চাহনি আর নিরব কান্না সইতে না পেরে মুহুর্তেই ছুটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আবিরের হাত ধরে সরানোর চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠল,
“ আবির! তোমার সাহস কি করে হলো আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার? তোমাকে এতটুকু সাহস হয় কি করে যে আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকেই তুমি শাসাচ্ছো? ”
আবির এই মুহুর্তে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ছুটির গাল ছেড়ে হাত ঠিক করে তাকায় তোফায়েল সাহেবের দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে টানটান স্বরে বলে উঠে,
“ আপনার সাহস হলো কি করে ওকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দিতে? প্রস্তাব দিই নি আমি? দেয় নি আমার পরিবার? রিজেক্ট করেছেন আপনি। বললেন মেয়ে এখন বিয়ে করতে চাইছে না। আর এদিকে চুপিচুপি মেয়েকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছেন? আমাকে কি যোগ্য মনে হয় নি আপনার? ”
তোফায়েল সাহেব এবারে গম্ভীর দৃষ্টিতেই তাকালেন আবিরের দিকে। সচারচর ছেলেটাকে এভাবে রাগতে উনি দেখেননি। কখনো এইভাবে কথা বলতেও দেখেননি। আজ দেখলেন। তবুও গম্ভীর স্বরে বললেন,
“ কাকে যোগ্য মনে হবে সেটা তো আমাদের বিষয় আবির। তুমি প্রস্তাব দিয়েছো মানেই যে তোমার সাথে বিয়ে দিতে হবে কথা ছিল? তাছাড়া যেখানে আমার মেয়ে রাজি নয় সেখানে কিসের বিয়ে? ”
আবির হাসে আর ছুটির দিকে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে ছুটির দিকে চেয়ে থেকে শুধায়,
“ আপনার মেয়ে কি এখানে রাজি? শিউর আপনি? ”
তোফায়েল সাহেব এবার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর করলেন,
“ পাত্র ও নিজেই পছন্দ করেছে। এবং বিয়ের আয়োজনটাও আমরা ওর কথাতেই করছি আবির। ”
কথাটুকু শুনেই আবির ছুটির দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। বাহ! এত বছরের ভালোবাসা উধাও! নিজের পছন্দেই বিয়ে করছে তাহলে? নিজেই পাত্র পছন্দ করেছে? আবির ছুটির দিকে তাকায়। ব্যঙ্গ স্বরে বলে উঠে,
“ তাই নাকি? তো তোর পছন্দ করা সে লাল টুকটুকে বরটা কোথায় রে ছুটি? একটু দেখা। এতদূর ছুটে এলাম, বর না দেখে চলে যাব নাকি? ”
ছুটি টলমল চাহনিতেই তাকায় আবিরের দিকে। চোখ জোড়া অসম্ভব লাল ঠেকছেে।চুলগুলো অগোছাল হয়ে পড়ে আছে কপালে। কেমন অগোছাল, উম্মাদ লাগছে এই আবিরকে। ছুটি মনে মনে ভয় পায় এই আবিরকে দেখে। চোখের শীতলতা বলে দিচ্ছে মানুষটার ভেতরটা ঠিক কতোটা ভয়ানক ঠেকছে এই মুহুর্তে। ছুটি শুকনো ঢোক গিলে। ধীর গলায় শুধায়,
“ আসে নি। ”
আবির এবারে হেসেই উঠে। মূলত স্বচ্ছ যখন ছোটনকে সকালে পাঠিয়েছিল বরকে আটকানোর জন্যই পাঠিয়েছিল। বেচারা বর মাঝখান দিয়ে ফেঁসে গেল। আবির অবশ্য তা জানে না। তবে বর আসে নি শুনে ব্যঙ্গ স্বরেই বলতে লাগল,
“ আসেই নি? বাহ বাহ! কি বর পছন্দ করলি? আসলই না একেবারে? আমি তো ভাবলাম তুই এইংগেইজমেন্ট সেরে বসে বসে রিং দেখছিলি। ”
কথাটা বলেই হাসে সে। ছুটির হাতটা টেনে নিয়ে দেখে রিং আছে কিনা। ছুটি এমন আচরণ দেখে কিঞ্চিৎ ইতস্থত বোধ করে। রোধ হয়ে আসা গলায় কোনরকমে শুধায়,
“ আবির ভাই। ”
আবিরের মাথায় তখন আগুন জ্বলছেে।বলা চলে রক্ত টগবগ করছে যেন। রাগে জেদে যখন মাথার ঠিক নেই ঠিক তখনই ছুটির এই ডাকটা তার রাগ দ্বিগুণ করল। চিৎকার করে ধমকে উঠল আবির,
“ চুপ। কথা বলবি না তুই৷ ”
তোফায়েল সাহেব বিস্ময় নিয়ে চাইলেন। তারই সামনে তার মেয়েকে এই ছেলেটা এমন ভাবে ধমক দিচ্ছে কোন অধিকারে? এই ছেলের কাছে উনি মেয়ে দিবেন? এই ছেলের তো রাগেরই শেষ নেই। তোফায়েল সাহেব মুহুর্তেই বলে উঠলেন,
” তুমি আমার মেয়েকে আমার সামনে ধমকাচ্ছো আবির? ”
আবির হাসে। ঠোঁট এলিয়ে বলে উঠে,
“ হ্যাঁ, ধমক দিচ্ছি আঙ্কেল।কি করব বলুন? আপনার মেয়েকে যত্ন করে বললে তো শুনে না। কত যত্ন করে যাওয়ার আগে বললাম বিয়ে করবি আমায়? বউ হবি? আপনার মেয়ে সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেল।আবারও ভয় পেলাম হারিয়ে ফেলব না তো মেয়েটাকে। বাসায় বলে প্রস্তাব পাঠালাম তাও কৌশলে আপনারা আমায় ঠকালেন। আর এখন তো একপ্রকার ষড়যন্ত্র করেই ঠকাচ্ছেন।ঠকাচ্ছেন না বলুন? ”
তোফায়েল সাহেবকে এবারে বিভ্রান্ত দেখাল। ঠকাচ্ছেন? কিভাবে ঠকাচ্ছেন? এমন তো কথা ছিল না যে ছুটি আর আবিরের বিয়েটা হবেই। কিংবা ছুটি আর আবিরের কোন সম্পর্কও ছিল না। তাহলে? উনি বললেন,
“ তোমার আর ছুটির কোন সম্পর্ক ছিল না আমার জানামতে। ”
আবির এবারে রাগে কপাল ঘষে রাগ শান্ত করার চেষ্টা করে। অতিরিক্ত রাগ লাগছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথাটা নিজেই ফাঁটিয়ে ফেলুক। আবির রাগ থাকা স্বত্ত্বেও শান্ত স্বরে বলতে চাইল,
“ আপনার মেয়ে আমায় এতবছর যাবৎ ভালোবেসেছে। বলেছিলাম আমি ভালোবাসতে? ভালোবেসেছে যেহেতু বিয়েও করতে হবে এখন। এখন বলুন, এখানে কাজী পাওয়া যাবে কিনা? না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই, স্বচ্ছ আর ছোটন গেছে কাজী আনতে। ”
তোফায়েল সাহেব এই পর্যায় রেগে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে শুধালেন,
“ এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে আবির। তামাশা করার একটা লিমিট থাকে। ”
আবির ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। কন্ঠ গম্ভীর করে চাহনি টানটান করে শুধায়,
“ আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি তামাশা করছি? তামাশা করলে এতদূর ছুটে আসতাম আমি? ”
তোফায়েল সাহেব এই পর্যায়ে আবিরের রাগের কাছে চুপ হলেন। বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় সামলানোর বুদ্ধি খুঁজলেন।আবিরকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে শান্ত স্বরে জানালেন,
“ গ্রামের লোকজন খারাপ বলবে। তুমি এখন বাসায় যাও। আমরা পরে এই বিষয়ে কথা বলব আবির। ”
আবির মানল না। বহু মেনে এসেছে সে। কিন্তু বিনিময়ে তাকে বারবার মিথ্যে বলে দমিয়ে রেখেছে। কি নিশ্চায়তা আছে যে সে যাওয়া মাত্রই ছুটি বিয়েটা করে ফেলবে না? শক্ত স্বরে জানাল,
“ কোন পরের টরের কাহিনী নেই। আজ হয়তো আপনার মেয়েকে বিয়ে করে বাসায় ফিরব আর নয়তো আপনার মেয়েকে খু’ন করে রেখে যাব। দুটোর একটা। ”
তোফায়েল সাহেব এবার শক্ত গলাতেই বললেন,
“ আবির! ”
ঠিক তখনই স্বচ্ছ আর ছোটন এল মধ্যবয়স্কা এক কাজীকে নিয়ে। আবির তা দেখে হাসে। বলে,
“ কাজী এসে গেছে। অনুমতি দিয়ে দিন আঙ্কেল। বিয়েটা করে নিই। ”
তোফায়েল সাহেব এই মুহুর্তে কি করবেন বুঝে উঠলেন না যেন। একবার ছুটির দিকে চাইলেন, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে বোধহয়। আবার আবিরের দিকেও তাকালেন। এই রাগ, জেদ বলে দিচ্ছে ছেলেটা উনার মেয়েকে ভালোবাসেন। কিন্তু, তবুও একটা কিন্তু তো থেকেই যায়।বাবা হন তিনি। তাই তো শান্তভাবে বিষয়টা ঘুরানের জন্য একগ্লাস পানি এনে আবিরের সামনে ধরে বলেন,
“ দেখো আবির, মাথা ঠান্ডা করো। পানিটা খাও, শান্ত হও। আমরা বড়রা আছি বিষয়টা আলোচনা করতে। আমার মনে হয় আমাদের আরেকটু সময় নেওয়া উচিত। ”
আবির পানির গ্লাস টা হাতে নিল ঠিক তবে শান্ত হলো না। তাকাল ছুটির দিকে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই দৃষ্টি সরাল মেয়েটা। আবির সেভাবে থেকেই শুধায়,
“ হলে আজই হবে বিয়েটা। ”
এই পর্যায়ে তোফায়েল সাহেব একটা কঠিন কথা বলে ফেললেন,
“ ছুটি তোমায় বিয়ে করতে রাজি নয়! ”
ব্যস! এই কথাটা শুনেই আবিরের হাত পা চিরচির করে উঠল। ছুটির প্রতি জম্ম নিল ক্ষোভ। ইচ্ছে হলো এক থাপ্পড়ে গাল লাল বানিয়ে দিতে। আজীবন ভালোবেসে এখন এসব নাটকের মানে হয়? নাটকই যখন করবি ভালোবাসলি কেন? আবির সরাসরি দাঁড়ায় ছুটির সামনে। পকেটে হাত গুঁজে ছুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ সত্যি করে বল? রাজি নোস তুই? তোকে কেউ বাধ্য করেছে ছুটি? কেউ কি জোর করেছে তোকে? বল। ”
ছুটি তাকায় আবিরের দিকে। ভয়ার্ত সে লাল রঙ্গা চোখে তাকাতে ভয় হয় তার। কেঁপে উঠে। সে এই শীতল চাহনি কত কি ভয়ানক গল্পের সমন্বয় ঘটাচ্ছে। ছুটি কাঁপা স্বরেই উত্তর করল,
“ ন্ না। ”
আবির উত্তরটা শোনার আশায় ছিল না। তবুও শুনতে হলো। দাঁত কিড়মিড় করে তার রাগে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বলে,
“ তাহলে রাজি নোস তুই? বিয়ে করতে চাস না? শিউর তো? ”
ছুটি এবারেও কাঁপা স্বরে উত্তর করে,
“ শ্ শি শিওর! ”
কথাটা বলতে দেরি হলো ঠিক তবে আবিরের হাতের কাঁচের গ্লাসটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে সময় লাগল। হাতের মধ্যে সেভাবেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল। মুহুর্তেই ধারালো কাঁচগুলো বিঁধল আবিরের হাতে। লাল টকটকে রক্তে রক্তাক্ত ঠেকল হাতটা। টপাটপ রক্ত পড়ে রক্তিম হচ্ছে ফ্লোরটাও। তবুও যেন ব্যাথা নেই। আবির শক্তপোক্ত স্বরেই জবাব দিল,
“ ওকে ফাইন। হয় আজ তোকে বিয়ে করব, আর নয়তো মরব। দুটোর একটা। তুই জানিস ছুটি, তুই জানিস না আবিরের কতোটা জেদ।”
ছুটি ভয় ভয় চোখে তাকিয়েই কেঁদে ফেলে। কতগুলো রক্ত পড়ছে। কতগুলো কাঁচ এখনো আবিরের হাতের মুঠোয়। ছুটি হাত বাড়ায়। টলমলে চাহনি ততক্ষনে কান্নায় রূপ নিয়েছে। কোনরকমে বলে,
“ আবির ভাই? হাত কেঁটে রক্ত পড়ছে। কষ্ট হচ্ছে তো আপনার, এদিকে দিন।”
আবির হাত এগোয়না। বরং তাচ্ছিল্য হেসে জবাব করে,
“ পড়ুক। তোকে ভাবতে হবে না। ”
#চলবে…
#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৪
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আবিরের হাত থেকে তখনও টপাটপ রক্ত গড়াচ্ছে। গ্রামের মানুষের মাঝেও ততক্ষনে জানা হয়ে গেছে এই বাড়ির কাহিনী। কিছু মানুষ আবার উৎসাহ নিয়ে রুমে এসে ভীড়ও করেছে কাহিনী দেখার জন্য। ছুটি সেসবের তোয়াক্কা করল না। বরং বোকা ছুটি প্রিয় পুরুষের এহেন আঘাত সহ্য না করতে পেরেই ছটফট করল। চোখ গড়িয়ে পড়ল নোনা পানি। মেয়েটার ফর্সা মুখ ততক্ষনে রক্তাভ হয়ে উঠল। আহাজারির স্বরে এগিয়ে এসে আবিরের হাত ধরার প্রচেষ্টায় বলে উঠল,
“ এসব পাগলামি আপনাকে মানাচ্ছে না আবির ভাই। এসব করে লাভ হবে কিছু?বুঝুন একটু।”
আবির হাতটা ঝারা দিয়ে সরিয়ে নেয়। কঠিন স্বরে শুধায়,
“ বললাম না তোকে না ভাবতে? কথা কানে যায় নি? ”
ছুটি টলমল চোখে চেয়েই থাকে। নরম গলায় বলে,
” ব্যান্ডেজ করা উচিত হাতটা। ”
আবারও কঠিন স্বর আবিরের,
” সেটা আমি বুঝব। ”
ছুটির এই পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিভ ভিজিয়ে সহজ করে উত্তর করে,
“ আবির ভাই। অযথাই জেদ করছেন। ”
আবির তিরিক্ষি মেজাজে শুধাল,
“ আমাকে ছোট বাচ্চা লাগছে? ”
ছুটি মায়াময় চাহনিতে তাকায়। কি ভীষন নরম গলায় ডাকে,
“ আবির ভাই, ”
অন্যদিন হলে হয়তো ডাকটা শুনে আবির খুশি হতো। তবে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে ডাকটা আবিরের সহ্য হয় না। গা জ্বলে উঠে যেন এই ডাকটায়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,
“ ভুলাবি না আমায়। একদম ভুলাবি না। এতবছর যে বোকা বোকা চাহনি দিয়ে আমায় ভুলিয়ে এসেছিস তা মনে করছিস? আমি আর ভুলব না তোর মায়াময় চাহনিতে।”
এই পর্যায়ে এসে ছুটি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আবির ভাই কখনো তার মায়াময় চাহনি মনোযোগ দিয়ে দেখেছিল? কখনও পাত্তা দিয়েছিল কি?কখনো কি ছুটির চাহনিকে এইটুকু গুরুত্ব দিয়েছিল? আজ হঠাৎ চাহনি দিয়ে ভুলানোর প্রশ্ন কেন? ছুটি তাচ্ছিল্য হাসে। উত্তর করে,
” আমার চাহনিতে আপনি কোনকালেই ভুলেন নি আবির ভাই।”
কথাটা বলার প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই রুমের দরজায় দাঁড়ানো গ্রামের মানুষ গুলোকে ঠেলে ডুকল এক রাগে জেদে ফেঁটে পড়া পুরুষ। সাথে তার ভদ্র ভোলা ছেলে। পরনের জামাকাপড় থেকে বুঝা যাচ্ছে ছেলেটার সাথে দস্তাদস্তি হয়েছে। শার্টে কোথাও ধুলো, কোথাও কাঁদা। আবার চোখের চশমটারও একটা গ্লাস ভাঙ্গা। ছুটি তাকায়।ছেলেটা সেই যার সাথে তার এইংগেইজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। ছেলের এহের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে গিয়েই ছেলের বাবা তেড়ে এলেন। ছুটির বাবাকে সাক্ষী করে বলে উঠলেন তেড়ি গলায়,
“ এসব কি তোফায়েল? মেয়ের যে ছেলেঘটিত এত সমস্যা আগে তো বলোনি। দেখে তো মনে হতো না তোমার মেয়ের তলে তলে এই!মাঝখান দিয়ে আমার ভোলাবালা ছেলেকে বলির পাঠা বানালে? বিয়ে যখন দিবেই না তখন নিজের ছেলেকে দিয়ে আমার ছেলেটাকে গোয়াল ঘরে আটকে রাখার মানে কি শুনি। ”
তোফায়েল সাহেব তাকালেন। ছেলেটার এহেন অবস্থা দেখে রেগে তাকালেন নিজের ছেলের দিকে। এই অবস্থা ছোটন করেছে? ছোটন? একে এত সমস্যা! তার উপর ছেলের এই কান্ডে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তোফায়েল সাহেবের। পরমুহুর্তেই আবার রাগ হজম করে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা মানুষটাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
“তুমি ভুল ভাবছো মোতাহের। ছোটন এমন কিছু করবে না কখনো।”
ততক্ষনে আবির এগিয়ে এসেছেে।ছেলেটাকে আগাগোড়ক পর্যবেক্ষণ করতে করতে ব্যঙ্গ স্বরে তোফায়েল সাহেবকে শুধাল,
“ আঙ্কেল? এই নাকি আপনার মেয়ে জামাই? স্যরি! আপনার মেয়ের পছন্দ করা ছেলে। এই উন্নতমানের ছাগলটা? ”
ছেলের বাবা এই পর্যায়ে তেতে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন,
“ তোফায়েল! তোমার মেয়ের প্রেমিক আছে এটুকুও নাহয় মেনে নিচ্ছি। একে তো অপমানিত করেছো তারপর আমার ছেলেকে অপমান করছে এই ছেলে?মেয়েকে বুঝি এসবেই উৎসাহিত করো? শাসনের দাঁড়কাছে তো আছে বলে মনে হয় না তোমার ছেলে মেয়ে দুটো। ”
আবির হাসে। ছেলেটার সামনে গিয়ে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ আহ! আঙ্কেল রাগছেন কেন? আপনার ছেলেকে মোটেও অপমান করিনি আমি। আচ্ছা আঙ্কেল, আপনার ছেলের নাকটা বোচা কেন? আমার নাকটা দেখুন। সুন্দর না? আপনার ছেলে তো আমার চাইতে একটু খাটোও। এই ছুটি, তোর পছন্দের ছেলে এই? এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে কেন তোর মতো? ”
তোফায়েল সাহেব বরাবর রাগছেন। না পারছেন রাগটা প্রকাশ করতে না পারছের হজম করতে। গ্রামের এত গুলা মানুষের সামনে নিজের পরিবারের এহেন অবনতি দেখে তোফায়েল সাহেবের ইচ্ছে হলো রাগে সব শেষ করে দিতে। তবুও পারলেন না। শীতল অথচ ধমক স্বরে আবিরকে শুধাল,
“ আবির! ”
আবির এই শীতল ধমকের অর্থ না বুঝলেও ছুটি আর ছোটন বুঝে। ছোটন এগিয়েও গেল আবিরকে মানাতে। অথচ আবির পাত্তা দিলে তো। বরং বেশ আয়েস করে বলে উঠে,
“ উহ আঙ্কেল, আপনিই বলুন? আপনার মেয়ে জামাই হিসেবে কে পার্ফেক্ট বলুন তো? আমি? নাকি এই ছাগলটা? ”
ছেলের বাবা এবারেও রাগল। মুহুর্তেই হুংকার ছেড়ে বলল,
“ তোফায়েল! এই ছেলে কিন্তু আমার ছেলেকে বারবার ছাগল বলছে। ”
তোফায়েল সাহেবের কপালের রগটা ফুলে উঠেছে ইতোমধ্যেই। নাক হয়ে উঠেছে লাল। আবির তাতেও পাত্তা না দিয়ে ব্যঙ্গ করে ছেলের বাবাকে বলে,
“ তো আপনার ছেলের কি মুখ নেই আঙ্কেল? সে বলতে পারবে না এটা? আপনি কেন তার হয়ে কথা বলছেন বলুন তো?”
কথাটা বলেই আবার ছুটিকে উদ্দেশ্য করে শুধায়,
“ ছুটি? তোর পছন্দের ছেলে আবার বোবা টোবা নয় তো ? ”
ছুটি এতক্ষন বাবার রাগ পর্যবেক্ষন করছিল। ভেতরে ভেতরে যে রাগে মানুষটা ফেঁটে পড়ছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। ছেলের বাবা আবারও বলে,
“ এসব শিখিয়েছো না ছেলেমেয়ে দুটোকে? এসব তোমার শিক্ষা?”
আবির ফের তর্ক জুড়ে,
“ আপনি কি শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেকে? অন্যের পছন্দ করা মেয়েকে টুপ করে বিয়ে করে ফেলা? ”
কথাটা বলেই ছেলেটার চুলে হাত চালিয়ে সেট করতে করতে বলে উঠে,
“ এই যে ছাগল? একি! তোমায় শার্টে ময়লা, বর বর লাগছে না তো। রিংটা কি করলে? এইংগেইজমেন্টটা সারবে না? একি চশমার একটা গ্লাসও তো ভাঙ্গা। আমি পরে দেখি তো একটু কত পাওয়ারের চশমাট…”
এই পর্যায়ে তোফায়েল সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন। চেঁচিয়ে আবিরকে বলে উঠলেন,
“ তামাশা হচ্ছে এখানে? আবির। প্রথম থেকে বলছি আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলব। বলছি কিনা? তারপরও আমাকে এভাবে সবার সামনে ছোট করছো কেন? আমি তো বলিনি ছুটিকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিব। বলেছি? ”
আবির মানল না। বরং রেগে কাঁপতে থাকা তোফায়েল সাহেবের সামনেই বিরক্তস্বরে গলা উঁচিয়ে বলে উঠে,
“ উহ, আস্তে কথা বলতে পারেন তো আঙ্কেল। এমন চিৎকার করে বলছেন কেন। তাছাড়া আমি কি ছোট বাচ্চা?আপনাকে, আপনার মেয়েকে কাউকেই আর বিশ্বাস করব না৷ হয় মেয়ে দিবেন, বিয়ে করব।নয়তো আপনাকেও দেখে নিব৷ ”
কথাগুলো বলা শেষ হলো ঠিক তবে আবিরের গালে থাপ্পড় পড়তে দেরি হলো না। মেয়েলি হাতের একটা দৃঢ় চড় গালে পড়তেই আবির অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকায়। ছুটি তখন রাগে জেদে বলতে থাকে,
“ সমস্যা কি আপনার? প্রলাপ বকছেন কেন এমন?দোষটা আমার। আব্বুকে অসম্মান করছেন কোন সাহসে? আব্বুর সাথে গলা উুচিয়ে কথা বলছেন? এত সাহস! আবির ভাই, এতক্ষন যাবৎ অনেক ভালো ব্যবহার করেছি। আর নয়, এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেন। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। যেটুকু ছিল সেটুকু আবেগ। এখন বোধ হয়েছে যে আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। ”
আবির ফোঁসফোঁস করে রাগে। বিড়বিড় স্বরে বলে,
“ ছলনাময়ী! একটু আগে আমার হাত কাঁটা দেখে কি ছলনাই টা করলি এখন আবার নিজের ফর্মে ফিরে এলি? ভালো লেগেছে না? এই ছেলেকে খুব ভালো লেগেছে? ফাইন, এক্ষুনিই এই ছেলেকে বিয়ে করবি। ”
স্বচ্ছ এতক্ষন এদের কাহিনীতে কিছু বলা উচিত কিনা বুঝে উঠছিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাহিনভ দেখছিল। কিন্তু এই পর্যায়ে মনে হলো তার বন্ধু আসলেই জেদ ধরে বিয়েটা দিয়ে দিতে পারে। হায় ঝামেলা! দ্রুত তড়িঘড়ি করে আবিরের কাছে এসে শুধায়,
“আবির। শান্ত হো। চল অন্য রুমে চল। আমরা কথা বলছি বিষয়টা নিয়ে। ”
আবির রাগে ঝাড়া মেরে স্বচ্ছর হাত সরায়। বলে,
“ কি বলবি? কিছু বলার নেই।ওর যখন ঐ ছেলের সাথে এতই বিয়ের শখ ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হবে। আজই।”
স্বচ্ছ আর ছোটন বহু কষ্টে আবিরকে মানানোর চেষ্টা চালায়। এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে বলে,
“ আচ্ছা আজই হবে, আমরা ব্যবস্থা করছি। তুই শান্ত হ। চল। ”
.
একটা রুমে বসে আছেন তোফায়েল সাহেব এবং স্বচ্ছ। স্বচ্ছ তোফায়েল সাহেবের গম্ভীর মুখ দেখে বুঝে উঠল না কথাগুলো বলা উচিত কিনা। কিন্তু বলতে তো হবেই। অবশেষে গলা পরিষ্কার করে স্বচ্ছ শুধায়,
“আঙ্কেল? আবির যে ছুটিকে ভালোবাসে তা নিয়ে নিশ্চয় আপনি অনিশ্চিত নন এখন আর? যদি ভালো না বাসত ও খবর পেয়ে ছুটে আসত না আঙ্কেল। বুঝুন ব্যাপারটা। ”
তোফায়েল সাহেব এই পর্যায়ে ছোট শ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন
“আমরা সবাই আবিরকে পছন্দ করি। আবিরদের থেকে যখন প্রস্তাব এল তখনও আমরা সবাই রাজি ছিলাম। কিন্তু ছুটি রাজি নয়। আমার মেয়ে ওকে বিয়ে করতে চায় না।”
স্বচ্ছ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শুধায়,
“ আপনি বোধহয় জানেন না আপনার মেয়ে আবিরের জন্য কতোটা পাগল। কতোটা ভালোবাসে। ”
“ জানতাম বিষয়টা। জানতাম ছুটি ওকে ভালোবাসে। তবে ছুটির বর্তমান কার্যকলাপ আমায় ভাবায় যে ও আর আবিরকে ভালোবাসে না। ”
স্বচ্ছ এবার ভুল ভাঙ্গিয়ে বলে,
“ ভুল আঙ্কেল। এটা একটা ভুল বুঝাবুঝি।ছুটি ভাবছে ওর অনুভূতিগুলোকে আবির ব্যবহার করেছে। বিষয়টা আসলে আমাদের বন্ধুদের একটা ফান ছিল। আমার বউয়ের পরিচয় জানার জন্যই সাদাফ এই প্রসঙ্গটা তুলেছিল। বলেছিল ছুটির অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সুহার পরিচয়টা জেনে নিতে। কিন্তু সত্যি এটা যে তার অনেক আগে থেকেই আপনার মেয়ের প্রতি আবিরের অনুভূতি ছিল আঙ্কেল। আর ছুটি কষ্ট পাবে বলে আবির এই কৌশলে প্রথমেই না বলেছিল। বিশ্বাস করুন, কথাটা সত্যিই বলছি। ”
তোফায়েল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। শুরু থেকে সবটা ভাবেন। বলেন,
“তুমি বলতে চাইছো এই কারণে ছুটি আবিরকে বিয়ে করতে চাইছে না? ”
স্বচ্ছও শুধায়,
“ হ্যাঁ, এই কারণেই ভুল বুঝে, অভিমান করে আপনার মেয়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছে।কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনার মেয়ে এখনও আবিরকে ভালোবাসে। তার প্রমাণ বোধহয় আপনি আজও পেয়েছেন যখন আবিরের হাত গড়িয়ে রক্ত পড়ছিল। তবুও আপনি যেহেতু ওর আব্বু হোন একটু ভাবুন। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তটা জানান আমাদের। জোর করছি না। ”
.
স্বচ্ছ ছুটির বাবাকে অনেকটা মানিয়েই রুম ছেড়ে বর হয়। বন্ধুর কাছে গিয়ে মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়ে। আবিরের কাঁধে চাপট মেরে বলে উঠে,
“ শা’লা থাকতি এতকাল শান্ত, ভদ্র হয়ে। হুট করেই এখানে এসে দেখি তার’ছিড়া উম্মাদ হয়ে গেছিস। তোকে সামলাতেই তো আমার আর ছোটনের অবস্থা কাহিল। ”
আবির রেগে তাকায়। স্বচ্ছর হাতের ফোনে ভিডিও কলে আছে সাদাফও।দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
“ তোকে বলেছি সামলাতে? ”
স্বচ্ছ চাপা হাসে। এখন আর চিন্তা নেই। ছুটির আর আবিরের বিয়েটা যে হবেই তা নিয়ে আশি শতাংশ নিশ্চিত সে। তাই আরাম আয়েশ করে বসে। আবিরের গালে হাত বুলিয়ে হেসে বলে,
“ বেচারা! চড় কেমন লাগল? ”
আবির কপাল কুঁচকে বলে,
“তোর সুহাসিনীর হাতেও তুই মার খেয়েছিলি।ভুলে গিয়েছি ভাবছিস? ”
স্বচ্ছ ছোটনকে বলিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স আনায়। হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে শুধায়,
“ ছাগল! আমি এমন পাগলামো করে রক্ত ঝরাইনি হাতের। তুই এখনও কন্টিনিউসলি হাত থেকে রক্ত ঝরাচ্ছিস। ”
আবির তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে এবারে,
“ তবুও ভালো। হৃদয়ের কষ্ট কিছুটা হলেও রক্তের মাধ্যমে বের তো হয়ে যাচ্ছে। ”
স্বচ্ছ পাশে বসে। মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,
“ ভন্ড! হাত দে, ব্যান্ডেজ করে দেই। ”
আবির দিল না। বরং ছোট বাচ্চার ন্যায় জেদ ধরে বলল,
“ করব না, ঐ ছুটির বাচ্চাকে যতক্ষন নিজের করতে পারছি হাত ব্যান্ডেজ করব না। ”
স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চাপে। আবিরের হাতটা জোর করে এগিয়ে নিয়ে কাঁচ আছে কিনা দেখতে থাকে। বলে,
“ নাটক কম কর শা’লা। মেরে এমনে মুখ ভেঙ্গে দিব। বিয়ে যে করবি সাইনটা করবি কিভাবে? এই রক্তে ভেজা হাত দিয়ে? ব্যান্ডেজ থাকলে তবুও একটু কষ্ট করে হলেও সাইনটা করতে পারবি। ”
.
গাড়িতে ছোটন, স্বচ্ছ, ছুটি আর আবির। দেখে মনে হচ্ছে না এই গাড়িতে নব বিবাহিতা এক দম্পতিও আছে।কারো চোখেমুখে সে উচ্ছাসটা ফুটেই উঠল না।বরং যে দম্পতির বর এবং বউ দুইজনেরই মুখেচোখে তখন বিপরীত অনুভূতি। স্বচ্ছ তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ছুটির বাবার সিদ্ধান্তেই সন্ধ্যার আগে আগেই ছুটি আর আবিরের বিয়েটা সম্পন্ন হলো। আবির তখনো ত্যাড়া হয়েই থাকল। যেন সে নামমাত্র বিয়েটা করছে। মুখ চোখ টানটান করে জেদ ধরে বসে আছে। এমনকি ছুটির সাথে এই নিয়ে একটা শব্দ অব্ধি বলে নি সে। যেন ছুটির প্রতি তার কতকালের ক্ষোভ! কতকালের শত্রুতা। এমনভাবেই থাকল আবির। অপরদিকে ছুটি নিশ্চুপ হয়ে থম মেরে আছে। বাবার কথায় বিয়েটা করেছে সে, নাও করতে পারে নি। গ্রামের সবাই তখন আবিরের বিষয়ে জেনে গিয়েছিল। বিয়েটা না হলে হয়তো আরো রটনা রটত। ছুটি তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায় আবিরের দিকে। মনে মনে শুধায়,
“ এই নাটকের প্রয়োজন ছিল কি আবির ভাই?ভালোবাসলেন একজনকে,বিয়ে করার জন্য নাটক দেখালেন অন্যজনের জন্য। হাস্যকর ঠেকল না বিষয়টা? ”
#চলবে…