#প্রেমের_সমর
#অন্তিম_পর্ব
#প্রথমাংশ
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
ছুটির সামনে ফোনের স্ক্রিনে হাসিমুখটা সাদাফের। কিছুক্ষন আগে স্বচ্ছও কল করে তাকে একগাধা কথা বুঝিয়েছে যে আবির তার অনুভূতিকে ব্যবহার করেনি। স্বার্থের জন্য কাজে লাগায়নি৷ স্বচ্ছর কথাগুলোতে যুক্তি ছিল। ছুটি বিশ্বাসও করল। অতঃপর আবারও সাদাফ কল করে একই বিষয়গুলোই বুঝাতে লাগল। ছুটি ছোটশ্বাস টানে। বলে,
“বুঝলাম। কিন্তু সে যদি আমায় ভালোইবাসত তবে এত অবহেলা কেন করল এতগুলো বছর? হতেও তো পারত এতবছরে আমি বিয়ে করে তিন বাচ্চার মা হয়ে গেলাম। ”
ঠিক তখনই আবির রুমে এল। ছুটির কথাটা শুনে গলার আওয়াজ দৃঢ় করে বলল,
“ তুই বিয়ে করলে সে খবরটা আমি পাবই এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। এবং, তোর বিয়ে যে অন্য কারোর সাথে হতেই পারে না তা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। ”
ছুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়৷ আবিরের সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত দেখাল সাদকেও। ছুটি ভ্রু কুঁচকে চাইতেই সাদ সামনে এসে দাঁড়াল। গড়গড় করে পাখির মতো সেদিনকার আবিরের ফোন দিয়ে রাহাকে ডাকার বিষয়টা খুলে বলল। ছুটি তা শুনে যখন ড্যাবড্যাব করে চাইএ তখনই উশখুশ করে বলল,
” জানিস তো রাহাকে ভালোবাসি। বেলকনিতে ওকে দেখতে পাব বলে কত রাত ঘুরফির করি ঐ বাসার সামনে। সেদিনও এমনই ছিল। ”
ছুটি সাদকে চেনে। খুবই ভালো বন্ধু তারা। রাহার জন্য এই ছেলেটা পাগলের মতোই পাগল তা সে জানে। কিন্তু আবির ভাইকে নিয়ে যা ভেবে সে এতকাল কষ্ট পেয়েছে তা যে আসলে সত্য নয় তা ভেবেই আপসোস হলো। এত গুলো দিন কষ্ট পাওয়া বৃথা তবে? শুধু শুধুই সে কষ্ট পেয়েছে?কিন্তু আবির ভাই তো সত্যিই তাকে অবহেলা করেছিল। হসপিটালের অবহেলাটুকু নিশ্চয় মিথ্যে নয়?ছুটি এসব ভাবতে ভাবতেই যখন বিভোর তখন সাদ বিদায় নিল। আবির তখন দুই পা এগিয়ে ছুটির সামনে দাঁড়িয়ে শুধাল,
“ ওদের কথাও যদি মিথ্যে মনে হয় তাহলে বল, নিজের প্রাণটাই বরং দিয়ে দেই। এই ভালোবাসাহীন এবং অবিশ্বাসে ঘেরা জীবন আর ভাল্লাগছে না। ”
বোকা ছুটি বোকার মতোই প্রশ্ন ছুড়ল,
“কেন? ”
আবির কাছে এগোয়। আচমকা ছুটিকে কাছে টেনর হাত রাখে তার কোমড়ে।মুগ্ধ নজরে মেয়েটার চোখে দিকে তাকিয়ে বলে,
“ কারণ আমি তোকে চাইছি সে বহুকাল আগ থেকে। যখন পেলাম তখন তোর ভালোবাসা আর বিশ্বাস পাচ্ছি না। ”
ছুটি হেসে বলে,
“ আমিও আপনাকে চেয়েছিলাম বিনিময়ে আপনার বিরক্তি আর অবহেলা পেয়েছিলাম আবির ভাই। ”
আবির একটু ঝুঁকে এবারে।দুই হাতে ছুটির মুখটা আগলে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“ তোকে অবহেলা করার সাধ্য কোনকালেই ছিল না বোকাপাখি। হয়তো সম্মুখে অবহেলা দেখিয়েছি কিন্তু আড়ালে সেই তোকেই আমি শতভাগ গুরুত্ব দিতাম। ”
ছুটি ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
“ তাই নাকি? ”
আবির শান্তস্বর এবার টানটান হয়। কিঞ্চিৎ রাগ হয়। এই যে কথায় কথায় মেয়েটা তাচ্ছিল্য করছে এটা সহ্য হয় না। কঠিন স্বরে বলে,
” আজকাল আমার প্রতি তোর বিশ্বাসটা বড্ড ঠুনকো হয়ে গেছে তাই না?কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না? ”
ছুটি ছোটশ্বাস ফেলে জানায়,
“ কিন্তু অবহেলাটা সত্যই ছিল আবিরভাই। হসপিটালে যখন আপনাকে সাপোর্ট দিতে চাইছিলাম আমি স্পষ্ট আপনার মুখে বিরক্তি দেখেছিলাম। অথচ রাহার সাথে আপনি সাচ্ছন্দ্যেই কথা বলছিলেন। ”
আবির চুপ থাকে এবারে। মনে করে হসপিটালের কথাগুলো। স্বচ্ছকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা ছিল মাথায়। সে চিন্তায় মরিয়া হয়ে ছুটির প্রতি অবহেলা বা বিরক্তি দেখিয়েছিল ভেবে আপসোস হয়। ক্ষুদ্র শ্বাস টানে শীতল স্বরে বুঝায়,
“ স্বচ্ছর অবস্থা খারাপ ছিল। জানতিস তো?সেসব শুনে সুহাও কেমন করতে লাগল। স্বচ্ছর আব্বু থাকলেও আমাকে আর সাদাফকেই বেশিরভাগটা সামলাতে হচ্ছিল ছুটি। সেদিক থেকে একসাথে স্বচ্ছ এবং সুহা দুইজনকে সামলানোটা কঠিন ছিল না? এদিক থেকে রাহা আমাদের সাহায্য করেছিল তো। সুহাকে সামলে নিতে ওর সাথে কথা বলাটা লাগত না বল?এটা অপরাধ? ”
“ আমি আপনাকে কখনোই অপরাধী প্রমাণ করিনি আবির ভাই। কিংবা কখনও এটাও বলিনি আপনি অপরাধী। ”
“কাজে কর্মে সবকিছুতেই তো বুঝিয়ে দিচ্ছিস আমি অপরাধী। ”
ছুটি তাচ্ছিল্য স্বরে জানায়,
“ হাসালেন। ”
আবির এবারে ছুটির মুখ ছেড়ে দেয়। চোয়াল শক্ত করে জানায়,
“ আজকাল খুব তাচ্ছিল্য করে কথা বলা শিখেছিস। ”
“ শিখলাম। ”
আবির টানটান স্বরে ফের জানাল,
“ তোকে কোনকালে অবহেলা করিনি আমি। যাকে সবটুকু দিয়ে চাইতাম, আড়াল থেকে সবসময় পর্যবেক্ষণ করতাম তাকে অবহেলা করা যায় না। ”
ছুটি শুধায়,
“ যায়না বলছেন? অথচ আমি আপনার মুখে তীব্র বিরক্তি দেখেছিলাম। ”
আবির কপাল ঘেষে। নিজের রাগ হচ্ছে নিজের প্রতিই।বিরক্ত লাগছে সবকিছু৷ রাগটা কপাল ঘেষে থামানোর চেষ্টা করল সে। আচমকা সুহার মুখটা আবার আগের মতো আগলে নিয়ে চুমু বসাল কপালে৷ বলল,
“ সেসময় মানসিক ভাবে ডিস্টার্বড ছিলাম। বিরক্তিটা তোর উপর নয় ছুটি, পরিস্থিতির উপর হয়েছিলাম। তুই নিশ্চয় বুঝিস প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে জেনে ঐ মুহুর্তে মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হবে? ”
ছুটি হাসে। সে সবটাই বুঝল। তবুও এতক্ষন এমনি এমনিই অভিমান দেখাল। যে অভিমান গলে গেল স্বচ্ছর ঠোঁটের ছোঁয়ায়। হেসে বলল,
“ আচ্ছা, বুঝে নিলাম। ”
আবিরও এইবারে হাসে। বহুদিন পর আজ মেয়েটার হাসিটা দেখে মনে হচ্ছে এটাই আগের ছুটি। এই মেয়েটাই তো!মাথায় চুমু এঁকে শুধায়,
“ বোকাপাখি! ”
ছুটি নরম গলায় জানতে চায়,
“ ভালোবাসেন আবির ভাই? ”
“ এইটুকু যদি এখনও না বুঝাতে পারি তবে বুঝব আমি ব্যর্থ ভালোবাসার ক্ষেত্রে। ”
“ মানুষের মনে অনেককিছুই তো থাকে। মুখে না বললে তা কি করে বুঝে নিব? ”
আবির তাকায় গাঢ় নজরে। বলে,
“ ভালোবাসি এটা মুখে বলতে হয় না। বুঝাতেই হয়। ”
ছুটিও তাকিয়ে থাকে একই দৃষ্টিতে। উৎসুক হয়ে বলে,
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি আবির ভাই। বসন্তের সেই প্রথম হাওয়ার মতোই আপনি আমার জীবনে ফুরফুরে এক অনুভূতি, রঙ্গিন এক স্বপ্ন যাকে ছোঁয়ার ইচ্ছায় আমি দিনরাত বিষাদে ডুবতাম। ”
আবির হাসে। মেয়েটার হাত নিয়ে নিজের গালে ছোঁয়ায়। বলে,
“ ছুঁয়ে দিলি। শান্তি?
ছুটির চোখ তখন টলমল করে। কান্নারা যেন বেরিয়ে আসবে।অনেকটা সময় কান্নায় রোধ হওয়া স্বরে বলে,
“ আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরব আবির ভাই? ”
“ কে নিষেধ করল? ”
কথাটা বলতে দেরি হলো কিন্তু ছুটির জড়িয়ে ধরতে দেরি হলো না। মুহুর্তেই প্রিয় পুরুষটির বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। আবির হাসে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ আমি অতোটা ভালো নই ছুটি। এভাবে জড়িয়ে ধরে পরে আমার মনের ভেতর অন্য চিন্তা আসলে সামলাতে পারবি? ”
ছুটি অনেকটা সময় নিশ্চুপে কাঁদে। একইভাবেই জড়িয়ে থাকে। তারপর মাথা উঠিয়ে বোকা স্বরে বলে,
“ কি চিন্তা? ”
আবির ঠোঁট বাঁকায় এবারে। এই মেয়েটা সত্যিই একটা বোকাপাখি। বলে,
“ তোর ভাষায় কোন মেয়ের সাথে হাবিজাবি করা। ”
ছুটি মুহুর্তেই চোখমুখ কুঁচকায়। বলে,
“ ছিঃ! ”
আবির মুহুর্তেই শুধায়,
“ ছিঃ কি? প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আমি। চিন্তা আসতেই পারে। তার উপর যার উপর আমার অধিকার আছে, যে আমার বউ তাকে নিয়ে চিন্তা আসবে না বলছিস? ”
ছুটি দূরে সরে সঙ্গে সঙ্গেই। বলে,
“ বাইরে যাচ্ছি। ”
আবির হাত টেনে ধরে। উত্তরে বলে,
“ যাবি না। ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়েছি তোকে কাছে পাওয়ার জন্যই। এখন তুই দূরে দূরে থাকলে কি করে হবে? ”
” বাসাতেই তো আছি। ”
টানটান গলায় উত্তর এল,
“ আমার সামনেই ঘুরঘুর করবি। শোন বোকাপাখি? নিজেকে প্রস্তুত করে নে আজ রাত্রির জন্য। সময় দিলাম তিন চারঘন্টা।এরপর আর ছাড় দেওয়া হবে না। এর মধ্যে স্বচ্ছর হলুদের অনুষ্ঠানটা এটেন্ড করে আসব।”
ছুটি শুকনো ঢোক গিলে শুধায়,
“আমি? ”
“ তুই বিয়েতে যাবি। ”
ছুটি ফ্যালফ্যাল চাহনি ফেলে বলে,
“ যাব না সুহার হলুদে? ”
“না, যাবি না। ”
ছুটির মুখটা চুপসে যায়। আবির হাসে। ফের ছুটির মুখে চুমু এঁকে যেতে যেতে বলে,
“ মাথা রাখিস কেমন? ফেরার পরের সময়টুকু ভিন্ন কাটবে। পরে যদি বলিস আমি প্রস্তুত নই তখন মানা হবে না। ”
.
সুহার হলুদের অনুষ্ঠান। বেশ সুন্দর ভাবেই সাজানো হয়েছে সুহাদের বাড়িটা। মাঝে রোহান একপাশে এসে সিগারেট ফুকছে।মূলত সুহার দাদাজানের সাথে বিজন্যাসের খাতিরে যোগাযোগ এবং অতিথেয়তা পেয়েই সে এসেছে। অন্য দিকে আবার রাহার সাথে বিয়ের কথাবার্তা! রোহান নিজের প্রিয়তমার হলুদ অনুষ্ঠানে এসে নিশ্চুপ থাকল। বোধহয় বুক চিনচিন করছে তার। জীবনে একটা মেয়েকেই সে ভালোবেসেছিল আর সে মেয়েটিকেই অন্য কারোর ব্যাক্তিগত সম্পদ হতে হলো?বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন? রোহান আপসোস করে। ঠিক তখনই পেঁছন থেকে কেউ একজন আসে। বলে উঠে,
“এইযে রোহান ফোহান? এভাবে পাব্লিক প্লেসে সিগারেট ফুঁকছেন কেন?”
রোহান তাকায়। এটা রাহা। নবনী মাহমুদ রাহা। যার সাথে তার বিয়ের কথা চলমান! রোহান কেন জানি না দুয়েকবার তাকিয়েও মেয়েটার মাঝে কোন ভালো লাগা খুঁজে পায় না। ক্ষুদ্রশ্বাস টেনে জানায়,
“হোয়াট ইজ রোহান ফোহান? ”
রাহা হেসে বলে,
“ মানে রোহান ফারাবী আরকি। আপনি না তিহানের কাজিন? সে হিসেবে আপনার উচিত স্বচ্ছ ভাইয়ের হলুদে থাকা৷ আপনি এসেছেন আমার আপুর হলুদে?”
রোহান মুহুর্তেই শুধায়,
“ কারণ ওপাশ থেকে অতোটা আন্তরিক ভাবে ইনভাইট করা হয়নি যতোটা এদিক থেকে আপনার দাদাজান করেছেন। ”
রাহা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ দাদাজান আপনার প্রতি এত আন্তরিকতা দেখাবেই বা কেন? ”
রোহান সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ফেলে দেয়। পা দিয়ে পিষে নিতে নিতে বলে,
“ সম্ভবত উনার ছোট নাতনির সাথে আমার বিয়েটা দিবেন বলে। ”
রাহা বিস্ময় নিয়ে বলে,
“ছোট নাতনি? ”
“ ইয়েস, নবনী মাহমুদ রাহা! ”
ফের বিস্মিত স্বর,
“ অ্যাাঁ!আমার বিয়ে আমিই জানি না? ”
রোহান হাসে এবার রাহার মুখটা দেখেে।বলে,
“ আপনি চাইলে বিয়েটা ভাঙ্গতেও পারবেন ম্যাম। কারণ আমি আপনার আপুকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম বললে ভুল! ভালোবাসি। ”
রাহা ভ্রু কুচকে বলে,
“ আপনি আপুকে ভালোবাসেন? তার মানে আজীবন ভালোবাসবেন?”
রোহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়,,
“ হয়তো! ”
রাহা মুহুর্তেই উচ্ছাস নিয়ে বলে,
“ গুড! তার মানে আপনাকে বিয়ে করলে এইসব সাংসারিক ঝামেলা অতোটাও পোহাতে হবে না বলুন? আপনি কখনো টিপিক্যাল স্ত্রী হিসেবে আমায় দেখবেন না নিশ্চয়? ”
রোহান অসন্তোষ স্বরে জানায়,
“ একদমই না নবনী। আমি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মানবই না দেখা তো দূর।”
রাহা ফের উচ্ছাস নিয়ে বলে,
“ গুড গুড। তাহলে বিয়েটা আপনাকেই করা যাক।
রোহান ভ্রু কুঁচকে নেয়। মেয়েটা পাগল?বলে,
“ হোয়াট? ”
রাহা বিষদ ব্যাখ্যা দেয় এবারে,
“ বিয়ের পর আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমি আমার মতে থাকব৷ দেখুন এমনিতেও আপনাকে আজ নাহয় কাল ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন বউ যখন আপনাকে অধিকার চেয়ে চেয়ে কান জ্বালা পালা করে ফেলবে ওটা তো যন্ত্রনার বিষয় হবে। সেইমভাবে আমিও এতকাল চাইছিলাম শুধু নামমাত্র বিয়েটাই করব এমন একটা জামাই পাই যাতে। সে আমার বিষয়ে নাক গলাবে না, আমিও কার বিষয়ে নাক গলাব না। সে তার মতো থাকবে। আমিও আমার মতোই থাকব।ধরুন সে হাজারটা মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকলেও আমি কিছু বলব না, আবার আমি হাজারটা ছেলে নিয়ে পড়ে থাকলেও সে কিছু বলবে না। সুন্দর স্বাধীন জীবনযাপন। বিয়ে করে অতো স্বাধীনতা হারাতে চাই না আমি। ”
শেষদিকটা কেমন লাগল রোহানের। হাজারটা ছেলে নিয়ে পড়ে থাকবে মানে? রোহান ফারাবীর বউ হাজারটা ছেলে নিয়ে পড়ে থাকবে বিষয়টা কুৎসিত!শক্ত স্বরে বলে,
“ গুড। কিন্তু হাজারটা ছেলে নিয়ে পড়ে থাকা যাবে না। ”
কথাটায় অধিকারবোধ প্রকাশ পেল নাকি?রাহা বুঝে না। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে,
“ কথার কথা ওটা ভাই। সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন আজব?”
.
সুহার হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয় এগারোটার দিকেই। যেহেতু কাল বিয়ে তাই তাড়াতাড়িই শেষ করা। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন সুহা। ফোনটা ধরা হয়নি সারাদিনেও। এখন নিল। দেখল স্বচ্ছর শতের উপরে কল। তাও এই আধঘন্টাতেই। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কল ব্যাক করে বলে,
“কি চাই? এতবার কল করছেন কেন ভাই? ”
একে তো কল ধরেনি। তার উপর ভাই ডাকছে। স্বচ্ছ নিরব রাগ নিয়ে বলল,
“ আবার বলো। ”
সুহা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ কি? ”
স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
“ভাই হই আমি? ”
সুহা এবারে নরম গলায় জানাল,
“ ওটা মুখে সবসময়ই থাকে স্বচ্ছ। রাগছেন কেন ওভাবে? ”
স্বচ্ছ টানটান গলায় উত্তর করে,
“ বাকি সবাইকে ভাই বলবে কিন্তু আমায় বললে একদিন আগের ঘটনাটা বারবার রিপিট করিয়ে মনে করিয়ে দিব যে আমি তোমার বর হই। মনে থাকবে? ”
সুহা বুঝতে পারে স্বচ্ছ একদিন আগের ঘটনা বলতে কি বুঝিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে রেগে বলে,
“ স্বচ্ছ!”
স্বচ্ছ এই রাগকে পাত্তা দিল না। বরং বলল,
“ রাগ হচ্ছে আমার।”
সুহা কারণ না পেয়ে শুধায়,
” ভাই বলাতে?”
ফের কঠিন গলায় উত্তর এল,
“ না, তোমার হলুদে ঐ রোহান কেন আসবে? ”
সুহা এবারে বুঝতে পারল। ছোট শ্বাস টেনে জানায়,
“ দাদাজান ইনভাইট করেছে। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট গোল করে শ্বাস টেনে বলে,
“ মানতে পারি না ওকে আমি৷ ও নিশ্চয় তোমাকে চেয়ে চেয়ে মুগ্ধ নজরে দেখেছে? আমার আগেই? আমি এখনও আমার বউয়ের সাজ দেখিনি। হতভাগা কপাল আমার।”
সুহার হাসি পায়। বলে,
“ আপসোস হচ্ছে? ভিডিও কল দিব?রাহাকে তো বলেছিলাম কিছু ছবি তুলে আপনাকে পাঠাতে। বোধহয় পাঠানো হয়নি। ”
স্বচ্ঠ হাসে এতক্ষনে গিয়ে। মৃদু হেসে জানায়,
“সমস্যা নেই, সরাসরিই দেখব। ”
“ পাগল নাকি? এতটুকু পথ জার্নি করে আসবেন? ”
স্বচ্ছ জানায়,
“ এসেছি। ”
সুহা খুশি হলো। তবুও খুশিটা না দেখিয়ে বলল,
“ কাল আবার বিয়ে। রাতে আবার ফিরতে হবে আপনাকে। বেশি জার্নি হয়ে যাচ্ছে না?শরীর খারাপ করলে? ”
“ তোমাকে দেখলে ভালো হয়ে যাব সুহাসিনী। ”
সুহা ভ্রু কুঁচকায়,
“ আমি কি মেডিসিন? ”
স্বচ্ছ ঠোঁট এলিয়ে হেসে জবাব দেয়,
“ হু, আমার ব্যাক্তিগত মেডিসিন আপনি। ”
“ এতরাতে জার্নি করে এতদূর এসে এসব বলার মানে কি? কি চাই জনাবের শুনি?
উত্তর আসে,
“ তোমাকে সুহাসিনী। ”
সুহা মৃদু হেসে বলে,
“ আমাকে তো সে কবেই পেয়ে গেলেন। চার চারটি বছর আগেই। ”
স্বচ্ছ শোনায়,
“ সবসময়ই পেতে চাইছি! ”
সুহাও বলে,
“ সুহাসিনী সবসময়ই আপনার স্বচ্ছ। ”
#চলবে….
#প্রেমের_সমর
#অন্তিম_পর্ব
#শেষাংশ
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
স্বচ্ছ অনেকটা কষ্টে সুহাদের ছাদে আসল। বলতে গেলে এত রাতে গেট টপকেই ভেতরে ডুকেছিল সে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছাদে। নিচে দাঁড়ানো আছে আবির। স্বচ্ছ কিঞ্চিৎ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল তখন রেলিং এ। অপেক্ষায় থাকল কবে তার প্রেয়সী এসে দেখা দেয় তাকে। কারণ একটু আগেই কলে বলেছিল আসতে। স্বচ্ছ যখন এই রাতের আঁধারে মশার কামড় খেয়ে সময় কাটাঁতে নিল ঠিক তখনই মৃদু অন্ধকারে নারী অবয়বটি দেখে তার মুখে হাসি ফুটে। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে সে গুণগুণ স্বরে গেয়ে উঠে,
“ তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, কি দোষ দিবি তাতে…. ”
সুহা সামনে এসে দাঁড়ায়৷ স্বচ্ছকে বিড়বিড় স্বরে গান করতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। বলে,
“ কার জন্য গান গাইছেন একা দাঁড়িয়ে? ”
স্বচ্ছ হাসে না। বরং মুখচাহনি স্থির রেখে শান্তভঙ্গিতে বলে,
“ বউয়ের জন্য। ”
সুহা মুহুর্তেই কাটকাট স্বরে জবাব দিল,
“ বউ এখানে উপস্থিত ছিল না ।সুতারাং কার জন্য গান করছিলেন বলুন। ”
স্বচ্ছ হাসে এবারে। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচু করে সে৷ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“ সন্দেহ করছো নাকি সুহাসিনী? ”
সুহা বিরক্তি নিয়ে শুধাল,
“ আপনি পুরোটাই গোলমেলে।আপনার ভালোবাসাও গোলমেলে। সন্দেহ করব না তো কি করব? ”
“ গোলমেলে?আমি গোলমেলে ঠিক আছে, আমার ভালোবাসা গোলমেলে এটা তুমি বলতে পারো না সুহাসিনী। ”
সুহা মাথা তুলে তাকায়৷ বলে,
“ বললে? ”
স্বচ্ছ গমগম স্বরে উত্তর দিল,
“ মেনে নিব না। ”
“ কি করবেন? ”
এবারেও উত্তর আসে,
“ যা ইচ্ছে! ”
সুহা ভ্রু উঁচু করে বলে,
“ এত শখ? ”
স্বচ্ছ সুহার হাত টেনে ধরে। কাছাকাছি এনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“ আপাতত চুমু খাওয়ার শখ হয়েছে। ”
সুহা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। বাড়িভর্তি মানুষ তার। এমতাবস্থায় সে যে ছাদে এসে দেখা করল এটাই তো অনেক। কিন্তু চুমু খাওয়াটা বাড়াবাড়ি৷ কেউ এসে দেখে ফেললে কি লজ্জাজনক কাহিনী রটবে। সুহা তড়াৎ করে দু পা পিছিয়ে যায়। বলে,
“ সম্ভব নয়। দেখতে চেয়েছেন, দেখা হয়েছে, এবার সোজা সোজা বাড়ি চলে যান। ”
স্বচ্ছ এবার নিজেই এগোল। সুহার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রাখল। তারপর দুই হাতে মুখটা আগলে নিয়ে বলে,
“ আমি অতো সরল নই যে তোমার কথা মেনে নিব সুহাসিনী। ”
“ দাদাজান দেখলে কথা শুনাবে৷ ”
স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চাপে এবারে। বলে,
“ ঐ বুড়োর কথায় কি বউকে ভালো না বেসে থাকব নাকি? আশ্চর্য! ”
কথাটা বলেই ঠোঁট ছোঁয়াল সুহার কপালে। বিয়েবাড়ির ঝলমলে আলোর ছায়ায় কোথাও কোন আবছায়ায় এক পুরুষ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকল তারই প্রিয়তমা নারীটির দিকে। ভালোবাসার স্পর্শ দিল কপালে, নাকে, গালে এবং সর্বশেষ ঠোঁটে।
.
ছুটি রাত তিনটা অব্দি জেগে ছিল। ভেবেছিল আবির আসবে। যাওয়ার সময় একটা নতুন লাল টকটকে শাড়ি দেওয়া হয়েছিল তাকে। বলা হয়েছিল এটা পরতে। অথচ সেই শাড়িটা ছুটি কতোটা যত্ন নিয়েই না পরল। সময় দিয়ে চোখে কাজল, কানে গোলাপ গুঁজল। অতঃপর এতোটা সময় যাবৎ প্রিয় পুরুষের জন্য অপেক্ষা করার পরই তার মনে বিশাল অভিমান জমল। বুকের গহীনে ফের অবহেলার বিষাদ ব্যাথায় চিনচিন করল । চোখ টলমল করে। এই যে তার আবির ভাই যাওয়ার সময় এই ভালোবাসাটা দেখিয়ে গেল? যদি এতোটাই ভালোবাসত মেয়েটাকে এতক্ষন অপেক্ষা করাত না নিশ্চয়? ছুটি অবশেষে টলমলে আঁখিতে অশ্রু ছেড়ে দেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে আরো কিছুটা সময় পর।
অন্যদিকে আবির স্বচ্ছর সাথে অতদূর গিয়ে ফের এই শহরে ফিরতে ফিরতে তাদের অনেকটা দেরি হলো৷ বারবার ঘড়ি চ্যাক করছিল সে। সময় দেখছিল। নিশ্চয় ছুটি ঘুমিয়ে গিয়েছে?মন খারাপ করেছে কি ও?আবার অবহেলা করছে ভাবছে না তো মেয়েটা? আবির ছোটশ্বাস টানে। বন্ধুর হলুদ অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে এতদূর জার্নি করে ক্লান্ত শরীরে সে যখন বাসায় ফিরল তখন রাত বেশ। প্রায় সাড়ে তিনটে। বেচারা আবির পা টিপে টিপে যখন রুমে ডুকল তখনই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল ঘুমন্ত ছুটির দিকে। লাল শাড়িতে এলোমেলো হওয়া ঘুমন্ত এক রমণী। যে রমণীটি এখন তার সব সুখের একমাত্র কারণ। হৃদস্পন্দের মালিক। আবির হাসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। যাওয়ার সময় যা বলে গিয়েছিল তা পালন করতে না পারায় ফের দ্বিধায় ভুগল। অভিমান করে নি মেয়েটা? আবির দীর্ঘশ্বাস টানে। এতদূর থেকে এসেও ফ্রেশ না হয়ে এগোল ছুটির দিকে।বিছানায় ঘুমন্ত ছুটির দিকে কিছুটা ঝুঁকে কপালে চুমু এঁকে হাসে নিঃশব্দে। পরমুহুর্তেই ঘুমন্ত ছুটির মুখশ্রীটা খেয়াল করে মনোযোগ দিয়ে। চোখের কার্নিশ বেয়ে গালে পানির চিকন ধারা এর শুকনো চাপ!আবির ভ্রু কুঁচকায় সঙ্গে সঙ্গেই। ছুটি কেঁদেছে? কি কারণে? সে দেরি করল বলে? মুহুর্তেই এক আকাশ সমান অনুশোচনায় দগ্ধ হয় আবিরের হৃদয়। নিজের উপর রাগ জম্মে বিশাল পরিসরে। অতঃপর কপাল কুঁচকে নিয়ে কিছুটা সময় সে থম মেরেই বসে থাকে। শরীর ক্লান্ত, ঘুম প্রয়োজন। এদিকে যে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছেেসে মেয়েটা ঘুমে। ফের আবারো কিভাবে অভিমান মানাবে তাই নিয়েই ভাবল আবির। অতঃপর ক্লান্ত শরীরে ওভাবেই ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিটা নিয়ে কোনরকম চেঞ্জ না করেই বউকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুঝল সে। স্নিগ্ধ মুখশ্রীটায় আবারো কিয়ৎক্ষন চেয়ে থেকে কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস স্বরে শুধায়,
“ তুই আমার আস্ত এক সুখের ভান্ডার ছুটি। তুই আমার কত শত অনুভূতির মালিক তুই তা অনুমানও করতে পারবি না বোকাপাখি। এই এইটুকু একটা মেয়ে হয়ে কি করে আমায় এমন অনুভুতিতে বাঁধলি বল তো?”
যদিও ছুটির থেকে উত্তর এল না। কারণ ছুটি তো তখন ঘুমে ডুবে গিয়েছে।আবির হাসে। একদম আদুরে বাচ্চার ন্যায়ই ছুটিকে আগলে নিল নিজের বুকের মধ্যে খানে। যেন সদ্য জম্মানো এক ছোট বাচ্চা মেয়েকে সে কোলে তুলেছে। আগলে নিয়েছে উষ্ণ আবেশে।
.
স্বচ্ছ আর সুহার বিয়েতে যাওয়ার জন্যই তৈরি হলো ছুটি। নিজের অভিমানের কথা এইটুকুও প্রকাশ করা হয়নি তার আবির ভাই এর কাছে। ছুটি ছোটশ্বাস ফেলে। নিজেকে গোলাপি রংয়ের জামদানিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আবিরের সামনে। হেসেই বলল,
“ আমরা সুহাদের বাড়িতে না যাব আবির ভাই? নাকি স্বচ্ছ ভাইদের বাড়িতে গিয়ে তারপর বরযাত্রী হিসেবে যাব? ”
আবির এতক্ষন হাতা গুঁটাতে গুঁটাতে ছুটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পরখ করছিল। অসম্ভব মায়াবী মেয়েটাকে শাড়িতে আরেকটু বেশিই মায়াবী লাগে। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় একাধারে।আবির হাসে। হাতা গুঁটোতে গুটোতে বলে
“ তুই কোথায় যাবি? ”
ছুটি উচ্ছ্বাস নিয়েই বলে,
“ সুহাদের বাড়িতেই। কারণ ওইতো আমার বান্ধবী। ”
আবির এবারে ঘড়ি লাগাতে লাগাতে উত্তর করে,
“ আর স্বচ্ছ আমার বন্ধু। ”
ছুটি ছোটশ্বাস ফেলে। আবির এমনই কাটকাট স্বরে কথার জবাব দিচ্ছে যেন সে সুহাদের বাড়িতে যেতেই হবে এমন বায়না ধরেছে। সে তো কেবল বলেছে মাত্র। শুধাল,
“ আপনি যদি ওখানে নিয়ে যেতে চান সমস্যা নেই। এমনিতেও গন্তব্য তো সুহাদের বাড়িই!আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন প্রথমে ওখানেই যাব। ”
আবির ভ্রু বাঁকায়। বলে,
” স্যাক্রিফাইস করছিস নাকি? ”
ছুটি হেসে বলে,
“ আপনাকে ভালোবাসি যেহেতু আপনার জন্য স্যাক্রিফাইস করাটা তো উচিত আমার।”
আবির মুখ কঠিন করেই তাকায়। এমন নয় যে সে রেগে আছে।তবে কাটকাট স্বরে কথা বলছে ছুটি তাকে তার অভিমানটুকু প্রকাশ করছে না বলেই। এই যে মনে মনে অভিযোগ পুষেও উপর দিয়ে ছুটি স্বাভাবিকতা দেখায় এটা আবিরের কাছে ছুটির একটা খারাপ গুণ বলেই মনে হলো। হতেই তো পারে সে নিজের অজান্তেই কোন ভুল করল, আর ছুটি সে কষ্ট আজীবন মনের মধ্যে চেপে রাখবে আর কষ্ট পাবে।যেমনটা আগেও হয়েছিল। জেদ ধরে অন্য এক ছেলেকে বিয়ে পর্যন্ত করে নিচ্ছিল এই মেয়ে। এটা কেমন অভ্যাস? এমনিতে তো বাকিসব নেচে নেচে প্রকাশ করে ফেলে শুধু অভিযোগ গুলোই জানায় না। আবির ছোটশ্বাস টানে। বলে,
“ কথায় কথায় ভালোবাসি বলে কি বুঝাস? আমার থেকে তুই বেশি ভালোবাসিস? ”
ছুটি হেসে উত্তর করে,
“ আপনি তো কোনকালে ভালোবাসি বলেনন না আবির ভাই। প্রথমবার যে ম্যাসেজে বলেছিলেন তাও আপনি নয় আপনার বন্ধু সাদাফ ভাই লিখেছিল। ”
আবির এবারে ছুটির দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরায়। শান্তস্বরে বলে,
“ কেবল ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়? ”
ছুটি শুধায়,
“ আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? ”
আবির এই পর্যায়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
“ কারণ আমি খারাপ। তোকে অবহেলা করি। আমার জন্য তোকে কান্না করতে হয় প্রতিবার। ”
ছুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কালকের কথা বুঝাল নাকি? ছুটি বলে,
“ তো? এখন কি দূরে সরে যাবেন খারাপ বলে?নাকি আমায় দূরে সরিয়ে দিবেন?”
আবির মুহুর্তেই দৃঢ় স্বরে জানাল,
” কক্ষনোই না! মরে গেলেও তোকে দূরে সরতে দিব না। ”
ছুটি হাসে। বলে,
“ আপনি বড্ড অস্পষ্ট আবির ভাই। ”
উত্তর আসে,
“ তুই বড়ই স্পষ্ট আমার কাছে।আমার ধারণা আমি তোর সবটুকুই চোখ বন্ধ রেখেই জানি।”
.
স্বচ্ছ আর সুহার বিয়ের অনুষ্ঠানটা সম্পন্ন হয়েছে দুপুরেই।এখন রাত। অতঃপর স্বচ্ছর রুমে ফুলে ফুলে সজ্জিত খাটটায় সুহা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে এক সদ্য বিবাহিত রমণী হিসেবে। যার পরনে লাল শাড়ি, ভারী বিয়ের সাঁজ।সুহা এত সাঁজ তুলে নিবে কি নিবে না তা নিয়ে দ্বন্ধে ভুগতেই রুমে এল স্বচ্ছ। দরজা লাগিয়ে সুহার সামনে এসেই প্রথমে হাসে সে। সুহার মুখটা দেখে নিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ অপেক্ষা করছিলে নাকি আমার জন্য? ”
সুহা মাথা তুলে তাকায়। কিছু বলার আগেই স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে ফের বলে উঠে,
“ সুহাসিনী? দ্বিতীয় বাসরের জন্য শুভকামনা। দোয়া করি তোমার জীবন স্বামীর ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ হোক।”
সুহা ভেবেছিল স্বচ্ছ একটু ভালো কথা বলবে এসে। কিন্তু এসেই এই লোকের এমন কথা শুনে সরু চাহনিতে তাকায় সে। বলে,
“মাথায় কি কেবল বাসরই ঘুরে আপনার? ”
স্বচ্ছ খাটের এক কিনারায় বসে দাঁত কেলিয়ে বলে,
” আজ বাসর, অবশ্যই মাথায় কেবল বাসর আর তুমিই ঘুরবে তাই না? স্বাভাবিা বিষয় এটা। ”
সুহা মুহুর্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠে,
“অস্বচ্ছ! ”
স্বচ্ছ ফের হাসে দাঁত কেলিয়ে। ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
“ জ্বী, তোমারই তো অস্বচ্ছ সাহেব। তাই না?”
সুহা সরু চাহনিতে চেয়ে বলে,
“ হাসবেন না দাঁত কেলিয়ে। ভারী সাঁজে বসে আছি এতক্ষন যাবৎ আমি। ”
স্বচ্ছ এবারে হাসি হাসি মুখটা স্থির করে শান্ত চাহনিতে তাকায়। হেসে বলে,
“ ওকে, হাসলাম না। চেঞ্জ করে আসুন জনাবা। অপেক্ষায় থাকলাম। ”
সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। আয়নার সামনে বসে নিজের এক এক করে পরা গহনা খুলতে খুলতে তাকায় স্বচ্ছর দিকে। মানুষটার নজরও তার দিকেই নিবদ্ধ। চোখে চোখ পড়তেই স্বচ্ছ চোখে হাসে। এগিয়ে এসে সুহার কানের দুলে হাত রেখে খুলে দিতে দিতে বলে,
“সুহাসিনী? অতঃপর বহু অপেক্ষার তোমাকে আমি বিয়ে বিয়ে অনুভূতি নিয়ে বউ হিসেবে পেলাম। আমার বোধহয় খুশি খুশি অনুভব হচ্ছে।”
“ বোধহয়?”
“ না, বোধহয় সত্যি সত্যিই খুশি খুশি অনুভব করছি। ”
সুহা হেসে ফেলে। বলে,
“ বউ হিসেবে অনেক আগেই তো পেয়েছিলেন কিন্তু তখন আপনার অনুভূতি ছিল না। ”
স্বচ্ছ মুখ গোল করে উত্তর করে,
” তারপর একটা মেয়ে আমার হৃদয়ের সমস্তটাতেই তার নামের অনুভূতি দিয়ে ভরিয়ে দিল। ”
সুহা হাসে। অতঃপর গহনা খুলে একটা সুতির শাড়ি নিয়ে নিয়ে পা বাড়াল ওয়াশরুমের দিকে। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে সাঁজ ধুঁয়ে গোসল করল। সুতি শাড়িটা ওয়াশরুমে অনেক কষ্ট করেই পড়ল সে যার দরুণ নিচের দিকটা ভিজেও গেল একটু। সুহা বের হলো অনেকখানি সময় পর। বেরিয়ে দেখল স্বচ্ছ পাঞ্জাবি খুলে নিয়ে টিশার্ট আর টাউজার পরেছে। সুহাকে এগিয়ে আসতে দেখেই হাসে সে৷ এগিয়ে গিয়ে সুহার ভেজা চুলগুলো খুলে দিয়ে বলে,
“ কষ্ট করে শাড়ি ওয়াশরুমের পরার কি দরকার ছিল? এখানে পরলে হতো না? ”
সুহা উত্তর দিল,
“ হতো না। ”
“ কেন?”
“আপনি আছেন রুমে তাই। ”
স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ তো? ”
সুহার উত্তর,
“ আপনার সামনে নির্লজ্জ্বের মতো শরীর দেখিয়ে শাড়ি পরব? ”
স্বচ্ছ বুকে হাত গুঁজে। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ তো একটু পর কি আমি রুমে থাকব না যখন তোমার শাড়ির ভাজ শাড়ির ভাজে থাকবে না?”
সুহার মুখ মুহুর্তেই লালাভ হয়ে উঠে যেন।উত্তর না দিতে পারায় স্বচ্ছ আবারও হেসে বলে,
“ একদিন আগেও তোমাকে নিজের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিয়ে এই রুমে ছিলাম কিন্তু। ভুলে গেলে সম্ভবত।”
সুহা এবারে বিড়বিড় স্বরে বলে,
“ নির্লজ্জ্!”
“ তোমার আমার প্রেমের সমরে লড়তে লড়তে নির্লজ্জ হয়েছি। ”
সুহা এবারেও উত্তর করে না। স্বচ্ছ হেসে সুহার মুখে দিকে চেয়ে কোলে তুলে নেয় আচমকায় মেয়েটাকে। আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হয়ে স্বচ্ছর কাঁধ আঁকড়ে ধরে সুহা। স্বচ্ছ বলে,
“ তৈরি আমার সুহাসিনী?একান্ত আমার সুহাসিনী হতে, আবারও? ”
.
ফুলে সজ্জিত ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে ছুটি অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে এপাশ ওপাশ চাইতেই বিছানার উপর দৃশ্যমান হয় একটা ফুল আর একটা চিরকুট। ছুটি এই পর্যায়েও বিস্মিত হলো। দুই পা বাড়িয়ে যখন ফুলটা আর চিরকুটটা হাতে নিল তখন তার বুক ধুকপুক করছিল। অদ্ভুত অনুভূতি। রক্তকণিকা গুলো বয়ে চলেছে অদম্য গতিতে।অসহ্য অনুভূতি! ছুটি শুকনো ঢোক গিলে।কাঁপা হাতে চিরকুটটা মেলে ধরতেই চোখে পড়ে,
“ বোকাপাখি?
আমি বড্ড অপেক্ষা করাই তাই না? বড্ড অভিযোগ তোর? এই যে আমার অপেক্ষায় থেকে গোপনে অভিযোগ পুষে কান্না করে ঘুমিয়ে গেলি ? এই গুরুতর অপরাধটা করার জন্য নিশ্চয় আমার শাস্তি প্রাপ্য? কিন্তু তুই তো শাস্তি দিলি না। তাই এই দোষ থেকে রেহাই পেতে ভেবে নিলাম তোকে একটু ভালোবাসা যেতেই পারে। মুখে না বলি, স্পর্শ দিয়ে তো বুঝাতে পারি? তাই না?তোকে বরং একটু ভালোবাসার পরশ দিলামই। কি বলিস?”
ছুটির মুখে হাসির রেখা ফোটার সাথে সাথে অজানা এক অনুভূতিও খেলে যায়। সে মাত্রই রাতেন খাবার খেয়ে রুমে এসেছিল। কখন কবে ঘর সাজানো হলো টেরই পেল না যেন৷ পরনে তার সাদা রংয়ের কামিজ আর মাথায় ঘোমটা দেওয়া শুভ্র রংয়ের ওড়না৷ ছুটি এপাশ ওপাশ খুঁজেও আবিরকে না দেখতে পেয়ে বেলকনিতে গেল। দেখল নেই। ছুটি ছোটশ্বাস টানে। গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে বিছানায় গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা।ছুটি বিড়বিড় স্বরর পড়ে,
“আবির আর তার বোকাপাখির পূর্ণতা! ”
ছুটি কিঞ্চিৎ হাসে। ঠিক তখনই কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পায় সে৷ কিছু বলা বা করার আগেই মানুষটি পেছন থেকে জড়িয়ে নিল তাকে।কাঁধে মুখ রেখে বলে,
“ বোকাপাখি একান্তই আমার। জানা আছে তো? ”
ছুটি মাথা নাড়ায় উপর নিচ। যার অর্থ জানে সে। আবির হাসে। ফের বলে,
“ একান্ত আমার করেই চাইছি আপনাকে আজ।দিবেন?কিছু মুহুর্ত আপনার আমার একান্তই এই হিসেবে উপহার দিবেন আমাকে বোকাপাখি? ”
ছুটি এই পর্যায়ে শুকনো ঢোক গিলে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না যেন। আবির হাসে। ছুটিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপালে কপাল ঠেকাল। দুই হাত ছুটির কোমড়ে রেখে চোখে চোখে হেসে বলে উঠে,
“ যদি চাস তো তোকে কিছু ভালোবাসা দিতে পারি কাছে টেনে। ভালোবাসা নিবি? ”
ছুটি বোধহয় রুমের চেহারা দেখেই আগাম বার্তা টের পেয়েছিল। এখন কথাটা শুনে আরো বুকের ভেতর হৃদস্পন্দর বেড়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল,
“হ্ হু?”
আবির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টানে। বলে,
“ সোজা কথা, তুই আমার স্ত্রী। তোকে কেবল একটা মেয়ে হিসেবে নয় বরং স্ত্রী হিসেবে চাইছি এই মুহুর্তে। বুঝতে পারছিস? ”
ছুটি বুঝল ঠিকই। তবে না বুঝারই ভান তরে তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে। আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপাল চাপড়ায়। বলে,
“ বোকা মেয়ে বিয়ে করলে এই একটা জ্বালা।কিছু বুঝে না। ”
ছুটি এবারে মিনমিনে স্বরে বলে,
“ বুঝতে পেরেছি আবির ভাই। ”
আবির এবারে রেগে তাকাল। ছুটির দিকে চেয়ে বলল,
“ একটা ভালো মুড নিয়ে এসেছি ছুটির বাচ্চা ছুটি। ভাই বলে মুডটা নষ্ট করবি না প্লিজ।”
নরম কন্ঠে উত্তর এল,
“ আচ্ছা। ”
ছুটির সহজ সরল উত্তর আবিরের পছন্দ হলো না। বলল,
“ আমি কি চলে যাব? তুই কি প্রস্তুত নোস? ”
ছুটির হাত পা কাঁপছে বোধহয় তখন। কাঁপা কন্ঠে বলে,
” আ আমার বোধহয় শরীর কাঁপছে। ”
আবির স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“শুধু এইটাই তো সমস্যা? ”
“হ্যাঁ।”
আবির শান্ত গলায় বলে,
“ তাহলে রেস্ট নে, ঠিক হয়ে যাবে। আমি বেলকনিতে আছি ততক্ষন। ”
“ আচ্ছা। ”
ছুটি ভাবল আবিরের মাথার ভূত নেমে গেছে। অথচ এবারে আবির অনেকটা দৃঢ় গলাতেই বলল,
“বেলকনি থেকে রুমে আসার পর আর কোন অযুহাত দিতে পারবি না। মাইন্ড ইট। ”
কথাটা বলেই বেলকনিতে গেল। স্থির বসে থাকল অনেকটা ক্ষন। ছুটি যে কেবল একাই নার্ভাস এমন নয়, আবির নিজেও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস। প্রথম বার, প্রথমবার সে ছুটিকে স্পর্শ করার কথা ভাবছে।বলতে গেলে এই প্রথমই কোন মেয়েকে স্পর্শ করার কথা ভেবেছে তাও স্ত্রী হিসেবে। আবির কিয়ৎক্ষন স্থির থেকেই নিজেকে শান্ত করে। ফের রুমে এসে ছুটিকে চোখ বুঝে থাকতে দেখে গমগমে স্বরে বলে,
“ তোকে রেস্ট নিতে বলেছি। বেআক্কেলের মতো ঘুমোতে বলিনি আমি। ”
ছুটি মুহুর্তেই চোখ মেলে তাকায়। বলে,
“ আবির ভাই? আপনি যা মিন করছেন তা….”
আবির ঝুঁকে ছুটির মুখের উপর। পুরোটা বলতে না দিয়ে বলে,
“ তাতে তুই একমত তাই তো? ”
ছুটি এবারে উত্তর করতে পারে। কিছুটা ভয় চোখে খেলর। আবির তা দেখে বিরক্ত গলায় বলে,
“ এতকাল ভালোবেসেছিস। এখন কাছে আসাতে এমন করছিস যেন আমি তোকে মেরে ফেলব ছুটি। ওকে ফাইন। ঘুমা। আমি তোকে কখনোই জোর করব না এই বিষয়ে।”
কথাটা বলেই যখন উঠে যেতে নিবে ঠিক তখনই ছুটি কাঁপা স্বরে বলে উঠে,
“ আ্ আমি পারব সহ্য করতে। ”
আবির নাকোচ করে বলল,
“ তুই প্রস্তুত নোস। সময় হলে তোকে অবশ্যই স্ত্রী হিসেবে কাছে টানব৷ এখন ঘুমা বোকাপাখি।”
ছুটি আবিরের হাত ধরে যাতে আবির চলে না যায়। ভাবল মানুষটা কষ্ট পেয়েছে তার কান্ডে। বলে,
“ আপনার বোকাপাখি পারবে সামলাতে।”
আবির এবারে হাসে কিঞ্চিৎ। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ছুটির ঠোঁটে বুলিয়ে নিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ শিওর? সামলাতে পারবি আমায়? পরে আপসোস করবি না তো এটা বলার জন্য? ”
ছুটি চোখ বুঝে বলে,
“ যাকে ভালোবাসি তার হতে আমার কোন আপসোস নেই আবির ভাই। ভবিষ্যৎ এ ও হবে না। ”
আবির দূরত্ব কমাতে এগোয়। তার বোকাপাখিকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস স্বরে বলে,
“ ভাই শব্দটা আজকের পর যাতে আর না শুনি ওকে? মনে রাখবি কথাটা সবসময়। ”
সমাপ্ত……