#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৪৩
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সাদ সেই অনেক বছর আগেকার সময়ের মতোই প্রথম প্রেম পড়া মুহুর্তের সেই রমণীকে দেখার জন্য যেভাবে বিল্ডিংটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকত প্রিয় নারীকে দেখার জন্য? আজ এতবছর পর দ্বিতীয় প্রেমে পড়া নারীটির প্রতিও একই অনুভূতির টানে একই বিল্ডিংটার সামনে এসেই গাড়ি থামায় সে। গ্লাস নামিয়ে প্রবল আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকছে সে নারীটির রুমের জানালায়। সিয়া প্রথম কয়েকদিন খেয়াল না করলেও আজকাল বিষয়টা সে খুব করে খেয়াল করছে। সে সেদিন বাসায় এসেই সাদের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাবটা সম্পর্কে শুনেছিল।শুনেছে সাদ নাকি এখন কোন কোম্পানির খুব উচ্চপদে আছে।স্যালারি ভালো, কোম্পানি তাকে গাড়ি দিয়েছে এই সেই। আগে সে নিজেকে অযোগ্য ভেবেই নাকি পালিয়ে গিয়েছিল। সবই সুহা বলেছে। বহুবার তাকে অনুরোধও করেছে যাতে রাজি হয়ে যায়। অথচ সিয়া সময় চেয়েছে। কি করবে বুঝে না উঠে সে হা না কিছুই জানাল না আজ পর্যন্ত। অথচ সাদ নিয়ম করে তাকে প্রতিদিন কল করে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছে তার মতামতটা কি। সন্ধ্যায় কিংবা রাতে এসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে। এমনকি তার কলেজ ছুটির পর অব্দি পুরুষটি গেইটের ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ যেচে সিয়ার সাথে সরাসরি কোন কথা বলছে না সে। শুধু দেখছে। আর কলে কয়েক সেকেন্ডে শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করে যে সে রাজি কিনা। সিয়া আজও অপেক্ষা করছিল সাদ বিল্ডিং এর নিচে আসবে। অপেক্ষা করতে করতে অবেশেষে রাত আটটায় সাদের দেখা মিলল। গাড়িটা এসে থামল। কাঁচ নামল। অতঃপর সে মুখটা এদিক করে তাকাল। সিয়া পর্দার আড়াল থেকে দেখল। অতঃপর হুট করেই কল দিল সাদকে। কল রিসিভড হওয়া মাত্র শুধাল,
“ প্রতিদিন আপনার গাড়িটা এখানে থামিয়ে কি বুঝান সাদ ভাই? কোম্পানি আপনাকে খুব ভালো মানের একটা গাড়ি দিয়েছে তা? ”
সাদ হুট করেই এমন একটা কথা শুনে মুখ গম্ভীর করল। কেমন করে যেন উপরে তাকিয়ে বলল,
“ তুমি নিজ থেকে কল দিয়েছো সিয়া। রাজি তুমি? ”
সিয়া হঠাৎই প্রশ্ন ছুড়ল,
” আমাকে কি লোভী মনে হয় সাদ? লোভী মেয়েদের মতো আমি? ”
সাদ ভ্রু কুঁচকে নেয়। হঠাৎ এই প্রশ্ন? সাদ কি কখনো বলেছে মেয়েটা লোভী? সাদ মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল,
“ এই প্রশ্ন কেন? ”
“ আগে উত্তর দিন। ”
সাদও ফের বলল,
“ আগে বলো এই প্রশ্ন কেন উঠল? ”
সিয়া হাসল অল্প। বলল,
“ আমি যদি আপনাকে বিয়ে করতে রাজিও হই এখন, তবুও আমি আপনাকে কখনো বিয়ে করব না সাদ। ”
“ কেন? ”
“ মানুষ ভাববে আমি লোভী! আপনি আমার জন্য এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যেখানে প্রতিদিন নিয়ম করে জিজ্ঞেস করছেন আমি রাজি কিনা, অথচ রাজি হওয়ার পথ আপনিই বন্ধ করে দিয়েছেন। ”
সাদ আশ্চর্য হলো। কি করেছে সে? সিয়ার সাথে কিছু করেছে বলে তো মনে পড়ছে না তার। অথচ সিয়া এটা কেন বলল? সে মুহুর্তেই বলল,
“ কি করেছি আমি? ”
সিয়া উত্তর করে না। সাদ পুণরায় ফের ডাকে,
“ সিয়া? ”
সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে। উত্তরে বলে,
“ বিশ্বাস করুন সাদ, আমি লোভী না। আমি আপনাকে কখনোই অযোগ্য ভাবিনি সাদ। আমি আপনাকে খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে অনেকগুলো বছর আগে ভালোবেসেছিলাম। ”
সাত যেন কিছুতেই মেলাতে পারল না। লোভী সম্বোধন কেন এল তাও বুঝতে পারল না যেন। ভালোবাসার সাথে লোভী সম্বোধন কেন আসবে?এখন কি ভালোবাসে না আর? তাই বলল? সে বলল,
” আর এখন? ”
“ এখন ভালোবাসা প্রকাশের সক্ষমতা হারিয়েছি।”
সাদ মুহুর্তেই বলল,
“ ভালোবাসা তো হারাওনি? ”
সিয়া হেসে উত্তর করল,
“ ভালোবাসা এতোটা তুচ্ছ নয় যে কথায় কথায় হারিয়ে যায় সাদ। ”
সাদ বুঝে গেল উত্তরটা। মুহুর্তেই কি এক ভালো লাগা হৃদয়ে বয়ে গেল যেন। হেসে বলল,
“ তাহলে বিয়ে করতে রাজি নও কেন? তুমি কি কোনভাবে মাসকয়েক প্রেম করতে চাইছো সিয়া? তারপর বিয়ে? ”
সিয়া নাক মুখ কুঁচকে নিল। মুহুর্তেই বলে উঠল,
“ আমি কি কচি খুকি এখন যে প্রেম করতে চাইব? ”
সাদ হাসল কথা বলার ধরণ দেখে। বলল,
“ আমিও অবশ্য কচি খোকা নই, দ্রুত বিয়েশাদি করতে হবে। বয়স হচ্ছে তো বলো? ”
“ সেটাই তো। বয়স হচ্ছে তো। বিয়ে করছেন না কেন সাদ? এতদিনে বিয়ে করলে তো দুই তিনটে বাচ্চার বাপ হয়ে যেতেন। ”
সাদ ভ্রু বাঁকায়। জানালার দিকে চেয়ে শুধায়,
“ ঐ দুই তিনটে বাচ্চার মা কি তুমি হতে? ”
সিয়া হেসে বলে,
“ চাইলে তো হতাম সাদ। আপনি তো সেই পথ রাখলেন না। লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলেন। ”
“ এখন হয়ে যাও তবে,বিয়ে করেই বেবি প্ল্যানিং শুরু করে দিব,প্রমিজ! ”
কথাটা সাদ হেসে হেসেই বলল। অথচ তার বিনিময়ে কি ভীষণ গম্ভীর এক উত্তর দিল সিয়া,
“ এখন আমি আপনাকে মরে গেলেও বিয়ে করব না সাদ। ঐ যে বললাম? আমি লোভী না। সময়টা যদি সাত বছর আগে হতো, আমি অবশ্যই নেচে নেচে বিয়ে করতাম আপনাকে। ”
সাদের হাসি হাসি মুখটা হঠাৎই কেমন যেন শান্ত হয়ে এল। নির্লিপ্ত স্বরে শুধাল,
” সাতবছর আগের ভালোবাসা এখন আর নেই তা বললেই তো হয় সিয়া। সাঁজিয়ে গুঁছিয়ে মিথ্যে বলার প্রয়োজন কি? এক্চুয়েলি সাতবছর আগের তোমার ঐ ভালোবাসাটা আবেগ ছিল রাইট? ”
সিয়া এবারে দৃঢ় স্বরেই উত্তর করে,
“ না! ”
“ ছিল। ”
সিয়ার স্বর আরো দৃঢ় শোনাল,
“ আমার ভালোবাসায় আঙ্গুল তোলার সাহস করবেন না সাদ। আমার লাইফের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা তা। ”
সাদ মেনে নিল এবারে। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বলল,
“ তবুও এত কেন বাঁধা? ”
“ বুঝবেন না। ”
সাদ চুপ থাকল। কপালে আঙ্গুল চালিয়ে শিথিল করার চেষ্টাল চালাল। অতঃপর বলল,
“ বুঝতে চাইছি ও না। জীবনের অনেকগুলো দিন একা হেঁটেছি সিয়া, একা চলেছি। এত নিঃসঙ্গতা নিয়ে কি করে বাঁচি বলো? প্রথম যাকে ভালোবাসি ভাবলাম তাকে হারিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার ও কঠিন রকমের প্রেমে পড়তেছি বলে সরে পড়লাম। অথচ আমি শুধু ভালোবাসাই নয়, সাথে সাথে মারাত্মক মায়ায় ও পড়ে গেলাম সে দ্বিতীয় নারীটির। কেবলই মনে হলো আমাকে পৃথিবীতে এমনভাবে কেউ চায়নি, এমনভাবে কেউ ভালোবাসে নি।ইশশ, সে মেয়েটা যদি আমার হতো?চোখ বুঝলেই ফুটে সে মেয়েটার সে টলমলে চাহনি। হসপিটালে শুয়ে থাকা সে অসহায় ভঙ্গি! আমি এই কয়েকটা বছর শুধু এই আপসোস নিয়ে বাঁচলাম, ইশশ!এই মেয়েটাকে যদি আমি পেতাম। আমার লাইফে যদি এই মেয়েটা সত্যি সত্যিই জুটে যেত আমার ভাগ্যটা কত ভালো হতো। আমি কতোটা ভালোবাসা পেতাম। অথচ আশা হারানো আমি যখন সুযোগ পেলাম এতগুলো বছর পর তখন তুমি বলছে তুমি বিয়ে করবে না কখনো আমায়? ”
সিয়া হেসে বলল,
” আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবেসেছি সাদ,এখনও ভালোবাসি। কিন্তু আপনাকে এখন বিয়ে করলে মানুষ কি বুঝবে জানেন? আপনার অবস্থান এখন ভালো বলে আমি বিয়ে করছি।এটা আমি কখনোই মানতে পারব না সাদ। লোভী নই আমি। ”
“কেউ বলেছে এমন? ”
সিয়া জানাল,
“ বলার সুযোগ দিব কেন আমি? ”
সাদ চোখ বুঝে গাড়ির সিটে। বুঝিয়ে বলে,
“ বলবে না কেউ,তুমি শুধু আমার হও। বাকিসব গুরুত্ব দিতে হবে না। ”
সিয়া চুপ। উত্তর করে না। সাদ যেন এবারে ধৈর্য্যহারা হয়েই শুধাল,
“ সিয়া? আর কতবার বললে আমার হবে? রাগ হচ্ছে, জেদ হচ্ছে এখন আমার। এখন মনে হচ্ছে এই দেখাটা না হলেও হতো। আমি শিওর এই কয়েকবছরে আমি মরে গেলেও তুমি লোকে কি ভাববে ভেবে দেখতে যেতে না আমায় একটিবারও। তুমি এক্চুয়েলি ইগো দেখাচ্ছো তাই না সিয়া? আমি তখন তোমায় এবয়েড করতাম বলে এখন তুমি আমাকে এবয়েড করছো রাইট? সুন্দর! এই ইগোটা নিজের মধ্যে না পুষে রেখে প্রার্থনা করতে পারতে আমার এই দুর্ভাগা জীবনের যাতে সমাপ্তি হয়। ”
সিয়া মুহুর্তেই উচ্চারণ করল,
“ সাদ!”
সাদ এবারে বড্ড স্পষ্ট স্বরেই জানাল,
“ তোমার উত্তর ‘না’ তাই তো? আমি উত্তরটা “না’ নিয়ে নিলাম। একটা জীবন নিঃসঙ্গ কাঁটানো কোন ব্যাপার না সিয়া। জাস্ট একটু লোভ হয়েছিল বলেই তোমার প্রতি এই প্রস্তাবটা রেখেছিলাম। দুঃখিত!”
এটুকু বলেই সাদ মুখের উপর কলটা রেখে দিল। সিয়া হতবাক হয়ে তাকাল। মুহুর্তেই টের পেল রাস্তায় দাঁড়ানে গাড়িটা শো শো করে চোখের নিমিষেই চলে গেল। সিয়া অস্থিরতা নিয়ে ফের কল লাগাল। ফের পুরুষটি কল তুলতেই বলল,
” কল রেখেছেন কেন? কল করেছি আমি না? রাখার অধিকার ও আমার ছিল। ”
সাদ খারাপ মেজাজ নিয়েই গাড়ি ড্রাইভ করছিল। বলল,
“বলা শেষ? মেজাজ খারাপ সিয়া।কল রাখলাম। ”
সিয়া মুহুর্তেই বলে উঠল,
“ ওয়েট, কল রাখবেন না। ”
সাদ দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
” গাড়ি ড্রাইভ করছি সিয়া। এক্সিডেন্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি এখন। পরে যাতে কেউ না বলে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে অসাবধানতা বশত ড্রাইভ করার ফলে এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই কল রাখতে চাচ্ছি। তুমি তো আবার লোকের কথা নিতে পারবে না তাই না? ”
সিয়া বড্ড হতাশ হলে যেন। জানাল,
“ আপনাকে বড্ড ইমম্যাচিউরড মনে হচ্ছে আজ। ”
সাদ দাঁতে দাঁত চেপে ফের বলল,
” মনে হোক। ”
“ মাথা শান্ত করুন। ”
“ আমার মাথা শান্তই থাকে সিয়া। ”
সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে। কোথাও গিয়ে বুঝতে পারে সে বোধহয় সাদের মেইল ইগো হার্ট করেছে। বড্ড কাচুমাচু করে এবার জানালই,
“ বিয়ে কবে ফেলবেন? ”
উত্তর এল,
“ কার বিয়ে? ”
” আপনার সাথে আমার? ”
আচমকাই যেন সাদ ভুল শুনতে পেল মনে হলো। ফের শুধাল,
“ হু?কি বললে?”
সিয়া ফের বলল,
“ আপনার আর আমার বিয়েটা কবে ফেলছেন স্যার? ”
সাদ কিয়ৎক্ষন চুপ থাকে। পরমুহুর্তেই বলল,
” যদি বলো আজই! ”
সিয়া মুহুর্তেই জানাল,
“ কি বলছেন? ”
সাদ হাসে একটু এবারে। ফের বলল,
“ এই শুক্রবার?”
সিয়া এবার মিনমিন করে উত্তর করল,
“ হু!”
উত্তরটা দিয়েই সিয়া কল রাখল। অতঃপর মোবাইলটা অফ করে দিয়ে চোখ বুঝে নিল।এতগুলো দিন তার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না হলেও আজ এই মুহুর্তে এই সিদ্ধান্তটা জানানোর পর তার বুক টিপটিপ করছে। হুদস্পন্দ কেমন বেড়ে চলেছে। এই পুুরুষটিকে সে বিয়ে করবে? দুদিন পর সে এই পুরুষটির সাথে সংসার করবে? হায়! কি সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফেলল সে!
#চলবে….