#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
শুক্রবার! বহু আকাঙ্খিত সেই শুক্রবার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছাতেই সিয়ার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ে। কিশোরী বয়সটা এখন আর না থাকলেও সে ঠিক কিশোরী বয়সের মতোই এক সমুদ্র অনুভূতিতে ডুবে মরছে যেন। লজ্জায় কুঁকড়ে উঠছে। সিয়া ছোটশ্বাস ফেলে কেবল। আজ রাত পোহালেই শুক্রবার। তার বিয়ে! এই এইটুকু ছোট্ট অনুভূতি তাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। ছটফট করিয়ে মারছে। সিয়া বিছানায় এপাশ ওপাশ করল প্রায় রাত চারটা অব্দি। অবশেষে যখন ঘুমঘুম চোখ ঠিক তখনই তার ফোনটা বেঁজে উঠল। সিয়া ভ্রু কুঁচকে দেখতেই সাদের নামটা দেখে আবারও সেই অস্থিরতায় অস্থির হয়ে গেল। মনে পড়ল সকাল হলেই তার বিয়ের আয়োজন। সিয়া কল তুলল। আস্তে করে বলল,
“ এখনও ঘুমোননি? এত রাতে কল? ”
সাদ হাসল কথাটা শুনে। বলল,
“ তুমিও তো দেখছি ঘুমাওনি। ”
“ হ্যাঁ। ”
“ কেন? বিয়ের আনন্দে?”
সিয়া চুপসে গেল। পরমহুর্তে বলল,
“ এত রাতে কল দিয়েছেন? ”
সাদ এবারেও হাসে। বলে,
“ তুমি তো দাও নি সিয়া। তাই আমাকেই দিতে হলো। ”
এবারে অতি নরম স্বরে প্রশ্ন এল,
“ কিছু বলবেন? ”
“ তোমার জানালা খুলে একবার দাঁড়াবে? বিয়ের আগে শেষ একবার দেখে যাই সিয়া নামক মেয়েটাকে। ”
সিয়ার বুক কেমন করে উঠে মুহুর্তেই। অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছুুয়ে যায় সারা শরীরময়। মৃদু হাসল সে। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলল। ঘরের আলো জ্বালাল। সাদ বলল,
“ সিয়া? ”
সিয়া উত্তর করে,
“ হু। ”
সাদ উত্তর পেয়ে কিছুটা সময় চুপ থাকে। তাকিয়ে থাকে জানালার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। পরনে একটা সাধারণ শাড়ি।অথচ এতোটা চমৎকার লাগছে মেয়েটাকে সাদের কাছে। কেন লাগছে তাও জানে না। সাদ শান্তস্বরে জানাল,
“ আমার বোধহয় তোমাকে আরো আগে বিয়ে করা উচিত ছিল। কত সময় চলে গেল আমার লাইফের। আমার বিবাহিত লাইফের সময়কালও তো কম পড়ল জীবনে। ”
সিয়া হেসে ফেলল কথাটা শুনে। পরমুহুর্তেই শান্তস্বরে শুধাল,
“ এখন আর কি করার? ”
সাদ আপসোস করে জানাল,
“ আপসোস হচ্ছে। ”
“ তাহলে বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে যান এবার। কাল তো আবার সকালে ডাকাডাকি পরবে। আপনার ঘুম থেকে উঠতে লেইট হলে আবার যদি বিয়েতে লেইট হয়? বিবাহিত জীবন তো কম পড়বে। শুভ রাত্রি। ”
এটুকু সিয়া হেসে হেসেই বলল। সাদ তাকিয়ে থাকল এক দৃষ্টিতে। শুধাল,
“ উমমম!জেগে থাকব আজ। ”
“ কেন? ”
“ নিচে এসো,বলছি। ”
সিয়া ভ্রু কুঁচকায়। জানায়,
“ এখন? ”
“ হ্যাঁ। ”
“ কিসব বলছেন? ”
সাদ ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“কয়েকবছর আগে কিন্তু আমায় দেখে রাতের বেলাতেই শাড়ি পরে বেরিয়েছিলেন। বায়না করছিলেন রাতের শহর দেখবেন? ”
সিয়ার মনে পড়ে সবটা। ঠপাস করে থাপ্পড়টাও মনে পড়ে। বলে,
“ তো?”
সাদ হেসে বলে,
“ আজ নাহয় আবদারটা পূরণ করে দিই। সঙ্গ দিবে আমায়? ”
সিয়া হাসল এবারে। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে উত্তর করল,
“ দিলাম নাহয়, কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন। ”
এটুকু বলেই সিয়া নিজেকে আয়নায় দেখল একবার। এলোমেলো চুলগুলে ঠিকমতো আঁছড়ে নিয়ে খোঁপা করল। অতঃপর শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বেরিয়ে গেল। যখন নিচে গেল দেখা গেল সাদকে। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। সিয়া এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়৷ সাদ তখন সোডিয়াম আলোতে এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে। কিছুটা ঝুঁকে এক হাতে সিয়ার খোঁপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিল।অতঃপর সিয়ার গোলগাল মুখটা নিজের দুই হাতে নিয়ে আচমকাই নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়াল। ফিসফিস স্বরে বলল,
“ আমার এই অপূর্ণতার জীবনে পূর্ণতা হওয়ার জন্য ধন্যবাদ মিস সিয়া!আমি, আমি সত্যিই ভাবিনি কখনো এমন একটা সুখ আমি পাব। এমন একটা দিন আদৌ আসবে৷ আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে বউ হিসেবে করার অধিকার আমার থাকবে। আমার সবটুকু সুখ, সবটুকু সুখ দিয়ে আজ আমায় সুখী অনুভব করানোর জন্য ধন্যবাদ সিয়া৷ ”
সিয়া খুব মনোযোগ দিয়েই কথাগুলো শুনল। প্রথমবারের মতো পুরুষালি ওষ্ঠাধরের স্পর্শে সে স্তব্ধ হয়েই চাইল। সাদ হাসল। হাত এগিয়ে বলল,
“ আজ রাতের শহর দেখার সঙ্গীর হওয়ার সাথে আমার লাইফের পথচলার সঙ্গী হওয়ার জন্য রাজি হওয়ার কারণে আপনাকে ধন্যবাদ মিস সিয়া। ”
.
সুহা খুব সকালেই এলার্ম দিয়েছিল উঠার জন্য। অথচ এলার্ম যখন বাজল তখন স্বচ্ছ জেগেই ছিল। দ্রুত সুহার যাতে ঘুম না ভাঙ্গে সেজন্য এলার্ম অফ করল। তাকাল বউ এর দিকে। অন্যপাশটায় স্নিগ্ধ একদম মাকে জড়িয়ে রেখে ঘুমোচ্ছে। স্বচ্ছ ছেলেকে দেখে হাসল।আলতো করে ছেলেকে সরিয়ে ঘুমন্ত সুহাকে আগলে নিয়ে জড়িয়ে ধরল। চুমু দিল টপাটপ। ততক্ষনে সুহা চোখ কুুচকে তাকিয়েছে যেন। নিজেকে স্বচ্ছর বুকে আবিষ্কার করে কপাল কুুঁচকে নিয়ে বলল,
“ কয়টা বাজল? সকাল হয়ে গিয়েছে? ”
স্বচ্ছ তাকায়।এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার কি দরকার তার বউ এর বুঝে পায় না।মাত্রই সে জড়িয়ে ধরল আর মাত্রই ঘুম থেকে উঠে গেল? স্বচ্ছ বলল,
“ সকাল হলেও তুমি কি করবে উঠে? কোন কাজ আছে তোমার? ”
সুহা ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ তো কত কাজ! একমাত্র ননদের বিয়ে আমার। ”
“তার থেকেও বড় কাজ স্বামীকে ভালোবাসা। কতক্ষন এভাবে থাকে সুহাসিনী। ”
সুহা এবারে সরু চাহনিতে তাকায়।বলে,
“ কি আশ্চর্য! বাড়িতে এমন একটা অনুষ্ঠান। অথচ আপনার মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই। ”
” সব দেখাশোনার জন্য আমি তো আছিই, আর কাজ করার জন্য লোক রাখা হয়েছে সুহা। ঘুমাও। তুমি কিন্তু বলেছো এইবারে তুমি সাবধানতা বজায় রেখে চলাফেরা করবে।প্রেগনেন্সিতে নিজের সর্বোচ্ছ কেয়ার নিজে করবে। ”
সুহা তাকিয়ে বলে,
“ করছি না? ”
স্বচ্ছ কপাল কুঁচকে বলে,
“ কোথায় করছো? কালও হলুদে তাড়াহুড়ো করেছো। পারোনি কেবল অন্যদের সাথে গিয়ে তুমিও নাচ করতে। ”
সুহা মুখ ফুলিয়ে বলে,
“ স্বচ্ছ! ”
স্বচ্ছ পাত্তা দিল না। উল্টে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ কি? এত রাতে এসে ঘুমিয়েছো, এখন আবার উঠে পড়ছো কেন? আমার বাচ্চারও তো রেস্টের দরকার, তাই না? ”
“ মানুষ কি বলবে আমি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমালে? ”
” কি বলবে? ”
“আপনি কেন এখনো উঠেননি? বাইরে কত কাজ!”
স্বচ্ছ ঠোঁট গোল করে শ্বাস নিল। বলল,
“ ভোর পাঁচটায় বউ দেখা ছাড়া আর কোন কাজ করার মতো আছে বলে মনে হচ্ছে না আমার। একটু পর এমনিতেই যাব।কিন্তু তুমি কোন অসাবধানতা করতে পারবে না। তোমাকে কাজ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আগেরবারের মতো রিস্ক আমি নিতে পারব না। মনে থাকে যেন। ”
সুহা নিরব দৃষ্টি ফেলে বলে,
“ কেমন কঠিন আচরণ করছেন? আপনি সত্যিই খুশি নন না আমি এবারে কনসিভ করাতে?”
স্বচ্ছ কেমন শীতল দৃষ্টিতে চাইল যেন সুহার দিকে। পরমুহুর্তেই উঠে পড়ল। সুহার পেটের দিকে ঝুঁকল। অল্প হেসে সুহার পেটে চুমু বসিয়ে বলল,
“ আমি আপনার আগমণের বার্তা পেয়ে প্রথমে মন খারাপ করলেও আপনার অস্তিত্বকে আমি ভালোবাসি বুঝলেন? আল্লাহ আমায় দু দুটো সন্তান দিয়েছে, আপনি সহ তিনটে। আমি এই তিনটে সন্তানকেই আজীবন ভালোবাসব , আমার থেকেও বেশি। কিন্তু আপনাদের আম্মুর থেকে কম ভালোবাসব।আম্মুকে বলবেন সাবধানে থাকতে, যাতে আপনি সুস্থ ভাবেই পৃথিবীতে আসেন এবং আপনার আম্মুও যাতে সুস্থ থাকেন।”
অতঃপর স্বচ্ছ সুহার দিকে ঝুঁকে সুহার দুই গালে চুমু দিল। হেসে,
“ সুহাসিনী? আমি আমাদের বাচ্চাদের ভালোবাসি, তবে বাচ্চাদের আম্মুকে তার চেয়ে ও অত্যাধিক ভালোবাসি। আমার বাচ্চার আগমনে আমি মোটেই অখুশি হইনি, তবে তাদের আম্মুকে নিয়ে ভীত ছিলাম,ভীত আছি। বুঝলে? ”
সুহা হাসল কেবল। চোখ বুঝে নিল। স্বচ্ছ ও তা দেখে হাসল কেবল।
.
রাহা তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। মেয়ে ঘুমোচ্ছ৷ তখনও। পাশাপাশি ঘুমোচ্ছে রোহানও। রাহা তাকাল দুয়েকবার। বাবা মেয়েকে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমোতে দেখে সে হাসল। ওয়াশরুমে গিয়ে সময় নিয়ে গোসল সারল। অতঃপর বের হয়ে বেলকনিতে গিয়ে কাপড় মেলে দিতেই আচমকা একটা উষ্ণ স্পর্শ টের পেল নিজের কাঁধ বরাবর। রাহা অল্প কেঁপে উঠল যেন। চিনল এই স্পর্শটা কার। উষ্ণ পুরুষালি ঠোঁটের স্পর্শ স্থির নয়। বরং বিচরণ করছে। সঙ্গে দুই হাতজোড়াও দখল করল কামিজের নিচে রাহার মসৃন উদর। রাহা নিজেকে সামলে নিয়ে কাপড় মেলে দিল। বলল,
“ উঠেই কি এসব মাথায় ঘুরে হু?”
রোহাস হাসল। বলল,
“ উঠেই যদি দেখি সুন্দরী বউ গোসল সেরে ঘুরঘুর করছে চোখের সামনে তাহলে তো মাথায় এসব ঘুরবেই। আমার দোষ কি?”
রাহা মুখচোখ কুঁচকে জানাল,
“অবশ্যই আপনার দোষ। ”
রোহান ভ্রু বাকায়। বলল,
“ হু, দোষী তুমি আর দোষের দ্বাারপ্রান্তে পৌঁছালেই আমি দোষী।”
রাহা ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ আমিই দোষী, হয়েছে?”
এটুকু বলেই চলে যেতে নিলে টান পড়ল হাতে। রোহান আগের মতোই রাহাকে জড়িয়ে রাখল। শুধাল,
“ না,হয়নি। এভাবেই থাকো। একটু জড়িয়ে ধরে থাকি। ”
“ কেন?”
রোহান রাহার কাঁধে নাক ঘষে জানাল,
“ ইচ্ছে হচ্ছে নবনী৷ আজকাল আমি সম্ভবত তোমার প্রেমে ডুবে মরছি। অথচ তুমি পাত্তা দাও না। ”
রাহা হাসল। অথচ বাহিরে কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,
“ মেয়ের মা হয়েছি, এখনও কি আমি প্রেমিকা সত্ত্বা নিয়ে ঘুরে বেড়াব আর আপনাকে গুরুত্ব দিয়ে মেয়ের সামনেই আপনার এইসব রোমান্সে গা ভাসাব? ”
রোহানও তৎক্ষনাৎ জানাল,
“ আমি মোটেই মেয়ের সামনে আক্কেলজ্ঞান হীনদের মতো বউকে ভালোবাসতে যাই না। ”
রাহা হাসে। পিছু ঘুরে রোহানের কাঁধ আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“ তাও ভালো।”
.
আবিরদের বাসায় সাদাফরাও এসেছে।মূলত আবির সহ সিয়র বিয়েতে যাবেই বলে এসেছে। আবির তখন তোর ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।অবশ্য তার মেয়েটা ঘুমোচ্ছেই। চব্বিশঘন্টায় বিশঘন্টাই ঘুমায় তার মেয়েটা। এতোটা ঘুমকাতুরে। আবির বসে বসে সে ঘুমন্ত ফুলো ফুলে মুখটাই পরখ করছিল। অথচ সাদাফের ঐটুকু বাচ্চারা তখন তার ছোট্ট সেই পরীর মতো মেয়েটাকে নিয়ে ঝগড়া করার পর্যায়ে একে অপরে।আবির ছোট ছোট চোখে কেবল তা পরখ করছিল দুইজনকে। দুইজনই তার মেয়েকে বেশ উৎসুক। ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু হলো এই ছোট্ট পুতুলটা কার হবে?এর, নাকি ওর? আবির হতাশ! এটা তার মেয়ে, কোন পুতুল টুতুল নয় রে! আবির ফের হতাশ! কি ভাগাভাগি শুরু হয়ে গেলরে তার মেয়েকে নিয়ে এখনই। এই ছেলে বলছে ওর, ঐ ছেলে বলছে ওর। সাদাফের ছেলেগুলাও না। আবির ঠোঁট চেপে ওদের কার্যকলাপ পরখ করে এক পর্যায়ে কঠিন গলায় বলল,
“ বাপ ও আমার মেয়ে। কোন পুতুল না। আর পুতুল হলেও তোদের কারোরই না বাপ। এই পুতুলটা আমার। বুঝলি? ”
আবিররের কঠিন স্বর শুনে দুইজনের কেউ আর কোন উত্তর করতে পারল। তবে মুহুর্তেই দুই ছেলে দৌড়ে গেল ছুটির কাছে নালিশ করল এমনটা বলেছে আবির এটা। সাথে কান্নাও জুড়ল ভীষণ! আবির আর সাদাফ দুইজন দুইজনের দিকে তাকাল তখন। আবির শেষ অব্দি হেসেই ফেলল। বলল,
“ তোর দুই ছেলে বড় হলেও না আমার মেয়ে নিয়ে টানাটানি লাগিয়ে দেয়! চিন্তায় পড়ে গেলাম তো। ”
সাদাফ হেসে উঠল। সঙ্গে আবিরও। সে হাসির শব্দ শুনেই আবিরের ঐটুকু মেয়েটা ঘুম ভেঙ্গে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। বাবার হাস্যোজ্জল মুখটা দেখে হয়তো সে ভড়কাল। তাকাল সেভাবেই। যেন আশ্চর্য কিছু দেখছে। পরক্ষণেই রুম কাঁপিয়ে কান্না করে উঠল। আবির মুহুর্তেই মেয়েকে বহুভাবে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা চালাল। ছুটি অবশ্য ততক্ষনে এসে হাজির হয়েছেে।মেয়েকে কোলে নিয়ে অন্য রুমে যেতে যেতে বলল,
“ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলোকে কাঁদাচ্ছেন কেবল! আশ্চর্য তো! ”
আবির ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। সাদাফদের সাথে সিয়ার বিয়েতে যাওয়ার কথা থাকলেও গেল না সে। বন্ধুদের বিদায় দিয়ে রুমে এসে ছুটিকে দেখা গেল মেয়েকে নিয়ে বসে থাকতে। তার মেয়েটা এতোটা ঘুম কাতুরে যে শান্ত পরিবেশ পেলেই তার ঘুম উপছে উপছে পড়ে। আবির হাসল তা ভেবে। এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখে ছুটিকে বলল,
“ একদম তোর মতো আমার মেয়েটা!আচ্ছা? তুই ছোট থাকতে এমন ঘুমিয়েছিস ছুটি? ”
ছুটি সরু চোখে তাকায়। এটা কি প্রশ্ন হুহ?ছুটি জানে এর উত্তর? বলল,
“ আমি ঘুমিয়েছি কি ঘুমাইনি তা মনে থাকলে তো হয়েই যেত।আপনার মনে আছে ছোটকালের কথা? ”
আবির হাসল। বলল,
“ আমার মনে হয় তুই আমার মেয়ের চাইতেও বেশি ঘুমিয়েছিস। তোর অভ্যাসবশতই আমার মেয়েটাও এই ঘুম পেয়েছে।আমি একশোভাগ শিওর!।”
ছুটি মুহুর্তেই রেগে চাইল।মেয়েকে বিছানায় শুঁইয়ে দিল আলতো করে। জানাল,
“ তো? ”
আবির পাশেই বসল। কোলে ছুটিকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে এমন ইঙ্গিত দিয়ে বলল,
“ কিছু না, এদিকে আয়। তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। ”
মুহুর্তেই প্রশ্ন এল,
“ আমি বাচ্চা? ”
আবির ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর করল,
“আমার বাচ্চার আম্মু। ”
“ তো এসব নাটক কেন?”
আবির উত্তর করল,
“কারণ তোকে আমার এখনও বাচ্চা বাচ্চা লাগে ছুটি। দেখলেই টপাটপ কয়েকটা চুমু দিতে ইচ্ছে হয়। কী ভীষণ আদুরে মুখ! একদম বাচ্চাদের মতো।এত আদুরে হলি কেন তুই হু?”
“ একেবারে বলে ফেলুন যে,আমি আপনার কাছে বাচ্চাদের মতোই!তো নিরীহ বাচ্চাকে এভাবে বিরক্ত করছেন কেন হুহ?”
আবির হাসে। ঠোঁট বাঁকিয়ে জানায়,
” কারণ এই নিরীহ বাচ্চাটা আসলে নিরীহ বাচ্চা নয়। ”
.
সিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। অতঃপর কবুল বলার পর থেকে সাদদের বাড়ি আসা পর্যন্ত সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল যেন। যেন সত্যিই তার বিশ্বাস হলো না যে তার আর সাদের বিয়েটা হয়েছে। সে সাদকর পেয়েছে। সিয়া সাদদের বাড়ি এসে এই নিয়ে তৃতীয়বার কান্না করেছে। এটা সুখের কান্না। প্রাপ্তির কান্না! সিয়া ঘড়িতে চোখ বুলায়। রাত দশটা। হয়তো একটু পরই সাদ আসবে। সিয়ার বুক কেমন করে। অথচ তখনও সে বিয়ে নামক প্রাপ্তির অপ্রত্যাশিক সুখে কান্না করছে বেলকনিতে। তার কিছুটা সময় পরই সাদ এল। সিয়াকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে এগিয়ে এল। অতঃপর সিয়ার একদম পেছনে দাঁড়িয়ে গম্ভির আওয়াজে বলল,
“ সিয়া? আমি শুনেছি তুমি কান্নাকাঁটি বহু করে ফেলেছো এখানে আসার পর? কিন্তু কেন? বিয়েতে তুমি খুশি নও সিয়া? নাকি বরের বাড়ি পছন্দ হয়নি? কোনটা? ”
সিয়া আচমকাই পিছু ফিরল। সাদের কথাগুলো শুনে কান্না যেন আরো বাড়ল তার। অথচ এটা তার কান্না করার বয়স নয়। যথেষ্ট ম্যাচিউরড সে। তবুও তার কান্না পাচ্ছে। সিয়া সাদের দিকে ফিরেই কেঁদে ফেলল ফের। সাদ অবাক হয়। সিয়ার কান্না থামানোর জন্য দ্রুত বলল,
“ তুমি কি বিয়েতে রাজি ছিলে না সিয়া? এভাবে কাঁদছো কেন? ফিরে যেতে চাইছো? তুমি যদি চাও আমি তোমায় তোমার বাড়িতে…. ”
সাদ বাকিটা বলার আগেই সিয়া তার গলা জড়িয়ে ধরল। এতোটা দ্রুত জড়িয়ে ধরল যে সাদ একটু পিছিয়েই গেল। সিয়া কাঁদতেই কাঁদতেই জানাল,
“ সাদ? আপনি আমার জীবনের প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। আমি যে কতগুলো দিন কষ্ট পেয়েছিলাম আমার এখনও মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন! এত দ্রুত সব কিভাবে পূরণ হয় বলুন?”
সাদ এবারে হাসল কিঞ্চিৎ। সিয়াকে দেখে যতোটা পরিপক্ব রমনী লেগেছে এই কয়েকদিন, সিয়া ততখানিই আগের মতো অপরিপক্বই আছেই। একদম আগের সিয়াই! আগের সে মেয়েটাই। সাদ হেসে বলল,
“ আরো অনেক কিছু তো পূরণ হওয়া বাকি! একসঙ্গে জীবনচলা থেকে অনেক স্বপ্ন, অনেক শখ পূরণ বাকি সিয়া। ”
সিয়া ওভাবেই থাকল। বলল,
“ আমায় কখনো একা করবেন না সাদ। কোন আড়াল রাখবেন না আমাদের মাঝের।কখনো, কখনো এই সম্পর্কটা ভাঙ্গার কথা মাথায় আনবেন না। আমি সত্যিই জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলব। ”
সাদ হাসে। আস্তে করে সিয়াকে কোলে তুলল সে। অতঃপর যেতে যেতে ফিসফিস স্বরে শুধাল,
” পাগলও নিজের ভালো বুঝে সিয়া। আর আমি বুঝব না?”
সিয়ার চোখে তখনই পানি। সাদ সযত্নে প্রিয় নারীকে বিছানায় নিয়ে গেল। দুই গাল আগড়ে নিয়ে চুমু বসাল কপালে। অতঃপর বলল,
“ ধন্যবাদ, আমার হওয়ার জন্য। আমার আর জীবনে কোন আপসোস রইল না। ”
#সমাপ্ত…