#প্রেমের_সমর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৪
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সুহাকে নিয়ে স্বচ্ছ বের হয়েছিল মূলত হসপিটালের উদ্দেশ্যেই।মেজাজ চিড়চিড়ে হয়ে আছে খুবই ছোট একটা কারণেই । স্বচ্ছ বাসা ছেড়ে বেরিয়েছিল সে সকালেই। সুহাকে বলেও গিয়েছিল সময়মতো খাবার খেতে, ঔষুধ খেতে। এমনকি সে কল করে খোঁজও নিয়েছিল৷ সুহা বলেছে সে সময় মতো সব খেয়েছে। অথচ বাসায় এসে শুনল কাহিনী ভিন্ন। সুহা দুপুরে খাবার খেল না, কারণ তার পেট ভরা ভরা লাগছে।অনেক বলে কয়েও স্বচ্ছর মা এই কাজটা করতে পারল না। সিয়া অবশ্য বহু কষ্টে সন্ধ্যায় নাস্তা করিয়েছে। আর তারপরই সুহা হুট করেই দুর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে গেল। কারণটা কি না খাওয়ার কারণেই তা জানে না তারা। ভাগ্যিস সিয়া আর ওর মা ছিল। নয়তো ফ্লোরে বা কোথাও যদি সেন্সলেস হয়ে পড়ত তার বউটা? কতটা রিস্ক! স্বচ্ছ খুবই চিন্তিত এই নিয়ে। সাথে ধারণা তার এটাই যে সুহা ভাই খায়নি বলেই এই অবস্থা৷ এই কারণেই সুপ্ত রাগ মনে পুষে রেখেছে সে। কেবল সুযোগ ফেলেই ঝাড়বে। আপাতত ডক্টরের কাছে গিয়ে চ্যাকআপ করানোটা তার কাছে জরুরী। অথচ সুহাে তেমন ভাবান্তর নেই। সে তার মতো স্থির৷ একটু অজ্ঞান হতেই পারে সে, এটা আহামরি কোন রোগ তো আর না। এই নিয়ে কি এত চিন্তা করবে সে?সুহা নিজের মতোই জানালার কাঁচে বাইরের শহর দেখছিল । হঠাৎ মাঝে পথে ফুসকাওয়ালা দেখেই সুহা গাড়ি থামাতে বলল। স্বচ্ছ কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়ে গাড়ি থামালেও সুহাকে ফুসকা এনে দিল না। গম্ভীর মুখ করে জানাল,
“ প্রথমত দেরি হয়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয়ত ফুসকা বাইরের খাবার। আমি চাই না এইসময়ে তুমি অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাও সুহাসিনী৷ ”
সুহা মানল না। বরং ছোট বাচ্চার মতো জেদ ধরে বলে উঠল,
“ অসুস্থ আমি হবো। আপনার কি? ”
স্বচ্ছ ভ্রু উঁচু করে তাকায় এবারে। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,
“ বউটা আমার,বাচ্চাটা আমার।আমার কি মানে? ”
সুহা যেন প্রচুর বিরক্ত এমন ভঙ্গিতেই বলে উঠল এবারে,
“ তাই বলে আপনার কথামতো চলব কেবল?সবসময় এমন অধিকার ফলান কেন হুহ? এই যে এখনও রাতদুপুরে ধরে বেঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছে ডক্টরকে দেখাতে। সামান্য একটু অজ্ঞান তো সবাই ই তো হলাম। ”
স্বচ্ছর আচমকায় রাগ জম্মায়। নাক লাল হয়ে উঠে ফুলে গিয়ে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শুধায়,
“ অধিকার না ফলাতে বলছো? ”
সুহাও বিপরীতে উত্তর করল,
“ বলছি। এমন শাসন বারণ আমার দমবন্ধ লাগে। ”
ব্যস। স্বচ্ছ শীতল চাহনিতে তাকায় কেবল। রাগ দমিয়ে একদম শান্ত স্থির চাহনিতে চেয়ে একদম শীতল স্বরে বলে,
“ ওকে, এজ ইউর উইশ।কিন্তু আমার আম্মুজান অথবা তোমার কোন ক্ষতি হোক অথবা তোমার ক্ষতি হলে একটুও ছাড় দিব না। যাও, তুমি যদি চাও ফুসকা খোয়ে আসতো পারো সুহাসিনী। প্লিজ যাও। ”
কন্ঠটায় বোধহয় কি যেন ছিল। সুহা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। কাঁপা স্বরে বলে,
“ হ্ হু?”
স্বচ্ছ হাসে এবারে। পুরোপুরি রাগ সে কখনোই দেখায় না এই মেয়েটার প্রতি। অথচ শীতল স্বরই জানান দিতে সক্ষম যে সে রেগে আছে। হেসে বলে,
“ এনে দিব ফুসকা? ”
সুহা মুখ ফুলায়। বলে,
“ কথায় কথায় রেগে যান স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছও ফের উত্তর করে,
“ রাগ করিনি।ওয়েট এনে দিচ্ছি। চুপচাপ বসে খাবে কেবল। প্লেট শেষ হলে প্লেট পাবে। চিন্তা করো না। ”
কথাটুকু বলেই স্বচ্ছ গাড়ি ছেড়ে বের হলো। এগিয়ে গেল ফুসকাওয়ালার দিকে। রাতে বেলা তবুও কম বেশি ভীড় জমে বোধহয়। স্বচ্ছ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকেই ফুসকা নিয়ে এল প্লেট ভর্তি। সুহাকে এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“ নাও। শেষ করো। ”
সুহা তাকায়। স্বচ্ছর দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে গলায় জোর দিয়ে বলল,
“ খাব না স্বচ্ছ আমি। ”
“ কেন? ”
সুহা তখন পেটে হাত রাখমিনিমনে স্বরেে বলে,
“ ক্ষতি হবে তো ওর। ”
স্বচ্ছ হাসে এবারে সহজ স্বীকারোক্তিতে। বলে,
“ তো আমিও নিশ্চয় এটাই ভেবেই বলেছিলাম তাই না? ”
” হ্যাঁ বলেছিলেন। বুঝলাম এখন। ”
.
ভার্সিটি জীবন সমাপ্তির পরপরই সুহা, ছুটি, সাদ সবারই এই কয়েকমাস দেখা হয়ে উঠেনি। সুহার প্র্যাগনেন্সি নিয়ে নানা রকমের জটিলতা, ছুটির নিজের জীবনে হুট করেই সুখ পেয়ে আবারও বিষাদে ডুবে থাকা অপর দিকে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বেকার সাদের অবসন্ন জীবন!এই কয়েকমাস যে যার মতো ডুবে গিয়েছে নিজ নিজ জীবনে। এসব ভেবেই ছুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর দিন পনেরো হয়তো বা। অতএব ছুটিও স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাবে অন্যত্র। আবির ভাই যেমন নিরুদ্দেশ হয়ে তার একটু খোঁজ অব্দি নিল না? তেমনই সেও নিরুদ্দেশ হয়ে নিজের খোঁজটুকুর লেশমাত্রও রাখবে না আর। যাতে আবির ভাই শত খুঁজেও আর না পায় তাকে। এসব ভেবেই কাগজ আর কলম নিয়ে লিখতে বসল। জানালার ধারে একাকার ভেবেচিন্তে লিখল গুঁটিকয়েক শব্দ,
“আবির ভাই? আপনি খুশি? আমি বোধহয় ঢেউ হারা নদীর মতো স্থির কোন বস্তুতে পরিণত হচ্ছি তিলে তিলে। অনুভূতিরা আজকাল ঝিমিয়ে মরছে। অথচ একটা সময় কি তীব্র অনুভূতিতে আমি আসক্ত ছিলাম আপনার প্রতি। আজকাল কি মনে হয় জানেন? মনে হয়, আপনি মানেই দুঃখ আবির ভাই। আপনি মানেই এক সমুদ্র বিষাদ। আমায় এতটুকু বিষাদে ডুবালে তবেই বুঝি আপনার শান্তি? আচ্ছা? আপনি আমায় কোনকালে ভালোবেসেছিলেন তো আবির ভাই? নাকি যেটুকু ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম বলে ধরে নিয়েছিলাম ওটুকুও আপনার খামখেয়ালিপনা ছিল আবির ভাই? ”
.
সাদাফ এবং নিধি সদ্য বিবাহিত দম্পতি। অথচ দুইজনেই বন্ধুর সামনে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছে। সাদাফ অনেকটা সময় চুপ থেকেই হুট করে বলে উঠে,
“ তোর অন্তত একটাবার ছুটির সাথে কথা বলা উচিত এখন শালা। এমনিতেই মেয়েটা হয়তো ভুল বুঝে বসে আছে এতদিন যাবৎ।”
আবিরের মুখখানা গম্ভীর। কিছু একটা ভাবছিল বোধহয়। হুট করই সাদাফের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে উঠে ক্লান্ত স্বরে,
“ কথা বলার সাহস পাচ্ছি না। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। শুধু ওকে কষ্ট দিয়েই এসেছি আমি।কত কত দিন পাগলের মতো কান্না করেছে হয়তো বোকাটা। ”
নিধি মুহুর্তেই উত্তর করে,
“ তোর দোষ নেই আবির। পরিস্থিতিই তেমন ছিল।ওকে বুঝালে ও অবশ্যই বুঝবে।”
আবির মৃদু হাসে। হয়তো বুঝবে। হয়তো মেনে নিবে। কিন্তু যদি না বুঝে? যদি না মানে? যদি এত এত বার অবহেলা পেয়ে মেয়েটা আর বিশ্বাস না করে তাকে? এই ভয়ে তার সত্যিই ভয় হয়। বলে,
“ ওর সামনে দ্বিতীয়বার আর যাওয়ার মুখ হয়ে উঠছে না। ভাববে এবারও অবহেলা করব হয়তো। হয়তো এবারও নিজেকে আবার গুঁটিয়ে নিয়েছে।”
সাদাফ মুখ ভেঙ্গাল যেন। বলল,
“ তো? তাই বলে বউ ছেড়ে দিবি নাকি? বউয়ের সামনে আর কখনো যাবি না? ছাগল! শোন, বউ হলো অমূল্য সম্পদ। মূল্য দিতে শিখ। ”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে আওড়ায়,
“ বোকাপাখি? তোকে বহুদিন দেখি না। বহুদিন হলো তোকে হাসতেও দেখিনি ছুটি। আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে বোকা বোকা নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখিনি। আমায় ক্ষমা করবি তো এবারে ছুটি? বুঝাতে পারব তো তোকে? মেনে যাবি তো তুই? নাকি মানবি না এবারে আর? ”
মনে মনে এইটুকু বলেই মুখে হেসে আওগাল,
“ যেতে যে হবেই। ওর কাছে যে নিজের প্রাণটাই আমার। ওকে দেখার জন্য তো এখনই ছটফচ লাগছে দোস্ত। ছুটটিটা বড্ড্ নরম স্বভাবী। ভয় হচ্ছে, কষ্ট পেয়ে কি না কি ভেবে নিয়েছে এতগুলো দিনে। ”
সাদাফ তা শুনে উচ্ছাসিত হলো যেন। মুহুর্তেই আবিরের ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে হোয়াটসএ্যাপে ছুটির নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে বলে,
“ এক্ষুনি ফোন দে। কাহিনী শেষ। কলে বলবি যে, ‘তোকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে আমার বোকাপাখি।’ ”
কথাটুকু বলেই সাদাফ কল দিল মুহুর্তেই। ওপাশের ছুটির এতদিন, এতকাল পর আবির ভাইয়ের নাম্বার থেকে কল পেয়ে বিস্মিত হয়। বিস্ময়ে তার হৃদয় কাঁপে। হাত পা কাপছে। গলা শুঁকিয়ে আসে। তবুও কল রেখে দিবে এই ভয়ই সে দ্রুত কল রিসিভড করল। চিকন রিনরিনে স্বরে বলে উঠে,
“ আসসালামুয়ালাইকুম, আবির ভাই.. ”
#চলবে…