#প্রেমে_ডুবি
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি
#পর্ব_১৭ ( সমাপ্ত )
ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপিনে নিরবতা। কারোর মুখে কথা নেই। সেহরিশ সোফার কোনে গম্ভীর মুখ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রফিক মির্জা ছেলের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট। তিনি জানতেন এমন টাই হবে। তার ছেলেটা যে বড্ড জেদি। তিনি টেনশনে আছেন সেহরিশ কি আদো রাজি হবে। সরলতা মির্জা গিয়ে ছেলের পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে। সেহরিশ নিচ থেকে মাথা তুলে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আম্মু তুমি কাজটা মোটেও ঠিক করোনি। এ ব্যাপারে বলার আগে আমার সাথে কথা বলতে পারতে। এমন একটা ডিসিশন নিজে কিভাবে নিলে।
ছেলের কথায় টানা নিঃশ্বাস ফেলেন সরলতা মির্জা। খানিকটা করুন সুরে বলেন,
” বাবা রে তোর ভালোর জন্যই এমন একটা ডিসিশন নিয়েছি। শায়রা খুব ভালো মেয়ে। আর মেইন কথা সিফাতের বোন শায়রা এর থেকে বড়ো কিছু তো হতে পারে না।। আর সেদিন তুই খামাকা সিনক্রিয়েট করছিলি। এখানে শায়রার কোনো দোষ ছিল না। মেয়েটা অনেক ভালো।
” ধ্যাত কিছু ভালো লাগে না। যা ইচ্ছে তাই করো গে কিচ্ছু বলব নানে বলে গটগট পায়ে দোতালায় চলে যায়।
” সরলতা মির্জা চেচিয়ে বলেন, পরশু তোদের বিয়ে। প্রস্তুতি নে।
রফিক মির্জা আর সরলতা মির্জা দুজনে হেসে ওঠেন। হাসি থামিয়ে রফিক মির্জা বলেন,
” এভাবে আগে থেকেই কিছু করো না। জানোই তো তোমার ছেলেটা কেমন বদমেজাজি।
” অতো কিছু তোমার না ভাবলেও চলবে। তুমি সব কিছুর ব্যবস্থা করো বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।
” যা ভালো মনে হয় করো।
*******
সিফাত আর শায়রা বিশ মিনিট আগেই চলে গেছে তাদের বাড়ি। শায়রা বাড়ি এসে সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একটু পর সন্ধ্যা নেমে আসবে সেজন্য বিছানা থেকে না নেমে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।
____________________
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের বিয়ের খবর শুনে চমকে ওঠে শায়রা। সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসছিল। তখন ভাইয়ের কথা শুনে তার দিকে তাকায়।
” বনু কাল তোর বিয়ে। সেহরিশ আর তোর। জানিস বনু সেহরিশ খুব ভালো ছেলে। ও তেোকে সুখে রাখবে। এখনকার সময় মানুষ চেনা বড্ড কঠিন বনু। আমি সেহরিশের সাথে তিনটা বছর থেকেছি। আমি সেহরিশের ব্যাপারে সব জানি। এজন্যই ওর সাথে তোর বিয়ে দিতে রাজি হয়েছি।
ভাইয়ের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শায়রা। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। সিফাত আবারও বলে,
“বনু শুধু একটা দিক থেকে একটু সমস্যা আছে। তাছাড়া কোনো সমস্যা নেই।
” কি সমস্যা ভাইয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
” সেহরিশের বিষাক্ত কালো অতিত আছে। সেটা তুই জেনে নিস। আমার থেকে না শুনলেও হবে।
মিনিট কয়েক নিরব থেকে ফের বলে,
” বনু তোর কি অমত আছে এই বিয়েতে।
শায়রা ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
” তুমিই তো আমার সব ভাইয়া। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। এই পৃথিবীতে আপন বলে থাকলে তুমি আছো ভাইয়া। তুমি যা বলবে তাই হবে বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে শায়রা।
সিফাত বোনকে আগলে নেয়। চোখের পানি মুছিয়ে বলে,
” তুই ছাড়া আমারও যে আর কেউ নেই বনু। আমার এক দিকে তুই আরেক দিকে পৃথিবী। যাই হয়ে যাক না কেন তোর জন্য আমি সব করতে পারি বনু। আজ যদি আব্বু আম্মু বেঁচে থাকতো বলে থেমে যায়। এর শায়রা নিজেকে সামলাতে পারবে না।
আর কাদিস না বনু। তোর বান্ধবী দের কে আসতে বল। খুব ঘরোয়া ভাবেই তোদের বিয়ে হবে। নিধিকে আমি সব বলছি। আপন বলতে তো কেউ ই নেই। মামা মামি থেকেও নেই। নানা নানি তো কবেই চলে গেছে। আর চাচা চাচির কথা কি বলব। সরলতার সুযোগ নিয়ে বেইমানি করল। সিফাত সোফা থেকে উঠে চলে যেতে গেলে শায়রা’র কথায় পিছু ফিরে বলে,
” কিছু বলবি?
” ভাইয়া কাল তো চাচা কে কোর্টে নেওয়ার কথা ছিল। চাচার কি রায় হলো। সিফাত তাচ্ছিল্যের হেসে বলে,
” বাকিটা জীবন জেলে পঁচে মরার ব্যবস্থা করে আসছি। আল্লাহ কখনো বেইমান কে ছেড়ে দেন না। ঠিক তার একটা না একটা ব্যবস্থা করেই দেন।
শায়রা ভাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিধির ডাকে ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে।
” কিরে বিয়ের কনে। কি এমন ভাবনায় চলে গেলি রে।
মৃদু হেসে বলে,
” আপু তুমিও না। শায়রা উঠে এসে নিধি র দিকে তাকিয়ে বলে,
” আপু তুমি কষ্ট পাচ্ছো না তো।
” ধুর পাগলী কি বলিস। আমি কেন কষ্ট পাবো।
” তোমার কষ্ট কিন্তু আমার সহ্য হয় না। তুমি সবসময় হাসি খুশি থাকবা বলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।
” শুধু কি কান্না কাটিই হবে হ্যা। বিয়ে বাড়ি এমন হলে চলে।
কারোর কথার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় দু’জনে। শায়রা পিছনের মানুষ গুলো কে দেখে অবাক হয়ে বলে,
” তোরা—-
তোরা আমাদের বাড়িতে।
” বান্ধবীর বিয়ে আমরা না এসে পারি উহু। তাই তো বান্ধবী র বিয়ে খেতে চলে আসলাম।
” কিন্তু তোরা জানলি কিভাবে?
” কেন ভাইয়া বলছে।
” ওহ তাই বল।
বিয়ে বাড়িতে জমিয়ে আড্ডা হবে। এখন সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও। নিধির কথায় সহমত হয় সবাই।
_________________
দেখতে দেখতে একটা দিন পেরিয়ে গেলো। আজ সেহরিশ আর শায়রা’র বিয়ে। বরপক্ষ থেকে পাচ ছ’জন লোক আসবে। শায়রা কে কালকে অল্প করে হলুদ ছোঁয়ানো হয়েছিল।
জেসমিন বেগম আগে থেকে অনেকটা সুস্থ। তিনি সিফাত আর শায়রা’র কাছে ক্ষমা চেয়েছে। দুজনেই ক্ষমা করে দিছে। মায়ের ব্যবহারে নিধি খুব খুশি হয়েছে। সেটা মুখে প্রকাশ করেনি। প্রথমে মায়ের সাথে কথা না বললেও শায়রা জোর করে কথা বলিয়েছে। মা মেয়ে কথা বলবে না এটা তো হতে পারে না।
জেসমিন বেগম এক হাতে সবার জন্য রান্না করছেন। সবাই টুকটাক সাহায্য করেছে তাকে।
শায়রা কে লাল রঙের শাড়ি পরানো হয়েছে। মুখে হালকা সাজ। মূলত শায়র সাজেনি। শায়রা ন্যাচারাল থাকতে পছন্দ করে।
****
সন্ধ্যার পর পরই বর পক্ষ চলে আসে। শিলা বরপক্ষের সাথে এসেছে। এসে সোজা শায়রা’র কাছে চলে যায়।
সেহরিশ সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরছে। কাজী সাহেব আসলে সেহরিশ আর শায়রা’র বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করে। তারপর খাবারের পাট চুকিয়ে শায়রা কে বিদায় দেওয়া হয়।
________________
বাসর ঘরে বসে আছে শায়রা। বাসর ঘর বললে ভুল হবে শায়রা সেহরিশের রুমের বেলকনিতে বসে আছে। সেহরিশের জন্য অপেক্ষা করছে। একটুপর সেহরিশ এসে শায়রা কে না দেখে ভয় পেয়ে যায়। পরমুহূর্তে বেলকনির কথা মাথায় আসতেই ছুটে আসে সেখানে। শায়রা কে বসে থাকতে দেখে বলে,
” এই মেয়ে তুমি এখানে কেন? অনেক রাত হয়েছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
” ঘুমাবো মানে —
” ঘুমাবে না মানে কি বলছো তুমি? বাই এনি চান্স তুমি কি বাসর করার কথা ভেবেছো। তুমি নিজেই তো একটা পিচ্চি। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো এসব।
সেহরিশের কথা শুনে লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া ওঠে শায়রা’র। শায়রা কে চুপ থাকতে দেখে দুষ্টু হেসে বলে,
” কি হলো চুপ করে গেলে যে।
শায়রা লজ্জা সাইডে ফেলে রাগি ফেস নিয়ে তাকিয়ে বলে,
” আপনি একটা যা তা। মুখে যা আসছে তাই বলছেন। ছিহ আমি কি কখনো বলেছি আমি বাসর করার জন্য বসে আছি। আমি তো আপনার সাথে একটা কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নইলে কবেই এই শায়রা ঘুমিয়ে পড়তো মুখ বাকা করে বলে।
” কি কথা গম্ভীর কণ্ঠে বলে।
” আমি আপনার অতিত জানতে চাই।
” হোয়াট।
” দেখুন ভনিতা করবেন না। সোজাসাপটা যা বলছি তা বলেন।
শায়রা’র কথা বলার ধরণ দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সেহেরিশ। পরক্ষণে ভাবে এ তো সিফাতেরই বোন এমন তো হওয়ারই কথা।
আচ্ছা কি জানতে চাও বলো?
” আপনার অতিত।
সেহরিশ এক নজর শায়রা’র দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে দুর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
” প্রতিটা মানুষের জীবনেই প্রেম আসে। তেমনি আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। আমিও পাগলের মতো একটা মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলাম।অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। কিন্তু দিনশেষে আমি ঠকে গেছি, হেরে গেছি ভালোবাসার কাছে। আমার চোখের সামনে দিয়ে সে অন্য এক পুরুষের হয়ে গেলো।
সেই দিনের ঘটনার পর কোনো মেয়েকে আমার সহ্য হয় না। মেয়েদের দেখলেই গা জ্বলে ওঠে। সেই ঘটনায় আমার বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয় যেটা আজও মুছেনি। ভেবেছিলাম তার প্রেমে ডুবে আমি বাকিটা পথ পার করে দিতে পারব কিন্তু ভাগ্য না থাকলে কি হয়। দেখো শেষ মেষ তোমাকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিল।
সেহরিশের কথা এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল শায়রা। কিন্তু লাস্টের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলে,
” কি বললেন আপনি। আমাকে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
কথা অন্য দিকে যাচ্ছে দেখে সেহরিশ জিভে কামড় দিয়ে বলে,
” ধুর কি যে বলো না। আমি কথাটা বলতে চাইনি মুখ ফসকে বলে ফেলছি।
” ঠিক তো কিছুটা টেনে।
” হ্যা। কি জল্লাদ মেয়েরে বাবা।
” কিছু বললেন।
” না না আমি আবার কি বলব।
লাস্টের কথা আস্তে বলায় শুনতে পায় নি শায়রা।
শায়রা সেহরিশের হাত ধরে বলে,
” শুনুন, আমি চাই না আমার স্বামী অন্য নারীর কথা ভেবে কষ্ট পাক। বিয়ের আগে যা হয়েছে সব ভুলে যান। অতিত আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না। অতিত কে ছুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিন। যে গেছে সে আপনার অতিত ছিল। এখন আমি আপনার বর্তমান। আর বর্তমান কে আঁকড়ে বাঁচতে হয়। আপনি চেয়েছিলেন তার প্রেমে ডুবে বাকিটা পথ পার করবেন। এখন আমি বলছি আপনি আমার প্রেমে ডুবে বাকিটা জীবন কাটাবেন।
সেহরিশ ভাবতে পারেনি শায়রা এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। শায়রা’র কথায় মুগ্ধ হয়ে শোনে সে। সেহরিশ কে কিছু বলতে না দেখে কিছুটা সাহস নিয়ে সেহরিশের কাঁধে মাথা রাখে। সেহরিশ কিছু বলে না। কারণ সে বলতে পারে না। এটাই হয়তো স্বামী স্ত্রী র পবিত্র সম্পর্কের জোর। যা থেকে চাইলেও দুরে আসা যায় না। সেহরিশ মুচকি হেসে নিজের হাত শায়রা’র কোমড়ে রাখে।
শায়রা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে লাজুক হেঁসে বলে,
❝ প্রেমে ডুবি, তোর সাথে
প্রেমে ডুবি আমি
তোর মায়ার বাঁধনে
সারাটাজীবন ❞
[ সমাপ্ত ]