প্রেমে পরা বারণ পর্ব-২৭+২৮

0
161

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২৭
ফজরের সময় ঘুম ভাঙলো নির্জনার। অর্কর দিকে তাকিয়ে দেখে অবুঝ শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে । অথচ এই মানুষটাকে দেখলে বুঝা-ই যায় না সে নিজের মধ্যে কতো বড়ো একটা ঝড় নিয়ে বেড়াচ্ছে। গত রাতেই অর্ক তার অন্ধকার অতীত নির্জনার সামনে উন্মুক্ত করেছে।
অর্কর মা-বাবার বিয়েটা তার দাদি দেখেশুনে দিয়েছিলো। জহুরা বেগম বেশ চিন্তায় পরে গিয়েছিলো ছেলে জাফর সিদ্দিকীকে নিয়ে। ছেলে ভবঘুরে রাজনীতি করে তাই ব্যবসা আর নাম-ডাক থাকলেও ভালো ঘরের মেয়ের সমন্ধ আসছিলো না। তাই তিনি গ্রামে খোঁজ করা শুরু করলেন। এক সময়ে মনমতো সমন্ধটি পেয়েও গেলেন তাই তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য তাগাদা করলেন। অদ্ভুত ভাবে অর্কর নানা বাড়ির লোকজন তাতে রাজি হয়।
একে একে তিন নাতি-নাতনিদের নিয়ে জহুরা বেগমের চাঁদের হাট। সব ঠিক চলছিলো কিন্তু ব্যাঘাত ঘটায় একটা চিঠি। যেখানে লেখা ছিলো অর্কর মা আসরার চারিত্রিক সমস্যা আছে। যদিও চিঠিটা জাফর সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছিলো কিন্তু সেটা পায় জহুরা। তাই তিনি সত্যতা যাচাই করতে সেইবার পুত্রবধূ সাথে তার বাপের বাড়িতে যান। অর্কর তখন দশ কি এগারো বছর বয়স মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মা’কে পাশে না পেয়ে খুঁজতে বের হয়ে দেখে তার মা আসরা নিজের মা-বাবা, ভাই শ্বাশুড়ি ও আরও একটা অপরিচিত মানুষের সামনে চিৎকার করছে আর বলছে,
–হ্যাঁ করেছি আমি অন্যায়, পাপ। কিন্তু এর জন্য কে দায়ী আপনি আর আমার পরিবার। বিয়ের আগে আপনি একবার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি রাজি কি-না?
জহুরা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। বিয়ের আগে মেয়ের মতামত জানা উচিত এসব কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।
এদিকে আসরা থেমে নেই। সে বলেই চলেছে,
–মা-বাবা বড়লোক দেখে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলো। তাদের নিজের ভালোবাসার কথা জানাতেই তারা সেই ছেলে গরীব বলে জেলে পাঠিয়ে দিলো। আমাকে তার বাড়ির লোকজন দিয়ে খবর দিলো সে মারা গেছে। আর তুমি (সেই অচেনা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে) হোক পালিয়ে ছেলে খেলার বিয়ে কিন্তু বিয়ে তো ছিলো। তুমি জেল থেকে বের হয়ে একবার আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে আমার চরিত্রে দাগ লাগানোর চেষ্টা করছো। আজকেও জানতে চাইছো না আমি কেমন আছি, তোমার সেই সন্তান কেমন আছে যাকে আমি অন্য কারও পিতৃ পরিচয়ে জন্ম দিয়েছি।
ঐ সময়টাতে অর্ক নিতান্তই অবুঝ হলেও একটু বোঝার ক্ষমতা তার ছিলো যে তার মা অতি সাংঘাতিক সত্য উন্মোচন করেছেন। তাই তো অপরিচিত লোকটি হাতের বন্দুক ফেলে নিচে বসে যায় আর তার দাদি চিৎকার করে বলতে থাকে,
–কি এতো বড়ো ধোঁকা? আমার বাড়িতে বেজন্মা বড় হইতেছে।
আসরাও দমে যায় না।
–মুখ সামলে কথা বলবেন। অর্ণব বেজন্মা না। আমার আর শিহাবের বিয়ে হয়েছিলো, তাকে আমি মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনেছিলাম, ওর মৃত্যুর খবর না পেলে আমি কখনোই আপনার ছেলেকে বিয়ে করতাম না । আমি আপনার ছেলেকে কোন দিনও মেনে নিতে পারি নি, ওমন আত্মঅহংকারী আর দাম্ভিক মানুষ কারও স্বামী হওয়ার যোগ্য না।
–বেশ তাহলে করতে হবে না তোকে আমার ছেলের সংসার আমি এখনই জাফরকে ফোন করছি।
বলে যেইনা জহুরা সিদ্দিকী ল্যান্ড লাইনের দিকে এগিয়ে যাবে তখনই ঠাস করে বুলেটের আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পরে। গুলি চালিয়ে ছিলো অর্কর নানা। কেউ কোন কিছু বোঝার আগে তিনি মেয়ের দিকে বন্দুক তাক করে বলে,
–তুই আমার সারাজীবনের সম্মান ধুলোয় মিশাতে পারিস না।
কিন্তু তিনি কিছু করার আগেই শিহাব নামে লোকটি আসরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের বুকে পেতে গুলি নেয় ।
অন্তিম নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে লোকটি একটা কথাই বলে,
–আমার ছেলের পিতৃ পরিচয় পৃথিবীর কারও সামনে এনো না তাহলে সে এই সমাজে কোন দিন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না।
শিহাব নামের লোকটির লাশ দেখে আসরার পিতা কিছুটা শান্ত হয়। তিনি মেয়েসহ সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলে,
–এসব কথা যদি পাঁচকান হয় তবে সব কয়টাকে নিজে হাতে মারবো।
তখনই তার নজর পরে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্কর দিকে। ভয়ার্ত চোখে সব ঘটনার নীরব সাক্ষী।
শয়তান ভর করলে মানুষ বুদ্ধি-বিবেক হারিয়ে ফেলে। আসরার বাবা আজগর আলীরও সেই অবস্থা হয়। তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে অর্কর দিকে বন্দুক তাক করেন সবাই মিলে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে আসরা কান্নাকাটি করে বার বার বলেছিলো,
–বাবা আমার ছেলেটাকে মেরো না। ও কাউকে কিছু বলবে না। আমি বোঝাবো ও যদি এসব নিয়ে কথা বলে তবে অর্ণবের ভালো হবে না।
কিন্তু আজগর আলী কোন কথা শুনতে নারাজ।
একপর্যায়ে অর্ককে বাঁচাতে আসরা তাকে ধাক্কা দেয়। অর্ক অজ্ঞান হয়ে যায়। ছয়মাস পর অর্কর যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে স্মৃতি হারা। এর কিছুদিন পর অর্কর কিছু কিছু স্মৃতি মনে পরে। যাতে তার মনে পরে কেউ তার দাদির দিকে বন্দুক তাক করেছে। যা জাফর সিদ্দিকীকে জানাতেই তিনি অর্কর মামার বাড়ি কল দেয়। অর্কর নানি অর্কর সাথে দেখা করতে এসে তাকে বোঝায়,
–তোমার যদি কখনও সব মনে পরে তবে চুপ থেকো। এতেই সবার ভালো। তোমার মা নিষ্কলঙ্ক থাকবে।
এরপর অর্কর স্মৃতি ফিরে এলেও বড় ভাইয়ের ভালের কথা আর মায়ের চরিত্রে দাগ লাগবে এইজন্য অর্ক সারাজীবনের মতো পাগল আর স্মৃতিহারা হয়ে থাকবে বলে স্থির করলো।
নির্জনা অর্ককে প্রশ্ন করেছিলো,
–তোমার মা আর নানা কিভাবে মারা গিয়েছিলো।
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিয়েছিলো,
–নানিকে একদিন এইপ্রশ্নটা করেছিলাম । তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,
আমার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে মা নিজেকে সামলাতে পারে নি। সে নানাকে গুলি করে, নানাও রাগের বশে মায়ের উপর গুলি চালায়। আমি তোমার অপরাধী। কিন্তু আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে নির্জনা? নিজের মা’কে চরিত্রহীন বানিয়ে দিতে?সত্যি বলে বড় ভাইকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করতে? আমি পারি নি। তাই তো নীরব হয়ে গেছিলাম, কারণ আমার সবসময় মনে হতো সেদিন আমি সেখানে না গেলে মা বেঁচে থাকতো। তুমি জীবনে আসার আগে ভালো হওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু এখন নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে।

একটা মানুষ ছোট বয়স হতে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তা নির্জনার জানা ছিলো না।
নির্জনা অজু করে এসে অর্ককে ধীরে ধীরে ডাক দেয়। অর্ক আড়মোড়া ভাঙলে নির্জনা অর্কর কপালে নিজে ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বলে,
–মি.হাসবেন্ড অজু করে আসুন, একসাথে নামাজ আদায় করে আমাদের বিবাহিত জীবনের নতুন সূচনা করি। আর আল্লাহর কাছে আরশির জন্য দোয়া করি যাতে ঐ শয়তানটার হাত থেকে আপুকে বাঁচানোর একটা উপায় বের করতে পারি।
নির্জনার এমন ব্যবহার দেখে অর্ক স্তব্ধ হয়ে যায়। সে বোকার মতো প্রশ্ন করে,
–তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো?

নির্জনার অবশ্য স্বামীর এই বোকামি ভালোই লাগে।
–নাহ আমি আমার হাসবেন্ডকে ক্ষমা করেছি। আপনাকে তো আমি চিনি না।
বলে যে সে উঠতে যাবে অর্ক তাকে হেঁচকা টানে বুকের উপর ফেলে বলে,
–তোমাকে খুব পবিত্র লাগছে।
–হুম।
–আর ইনোসেন্টও।
–হুম।
কানের কাছের চুলগুলো সরিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–I want to run your innocence very badly. শুধু নামাজটা শেষ হতে দাও।
এরপর ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
নির্জনা একটা শুকনো ঢোক গিলে। লজ্জায় তার কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। এই ছেলে এতো সহজে এমনভাবে রোমান্টিক কথা বলবে তা তার ধারণার বাইরে।
তখনই ওয়াশরুম হতে গলা বাড়িয়ে অর্ক বলে,
–এভাবে লজ্জা পাওয়ার মতো আমি এখনো কিছুই বলি নি। তবে একটা কথা তোমার কোমড়ের ঐ তিলটার কিন্তু আজকে রক্ষা নেই।

–চলবে?

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব-২৮

কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙে অর্ণবের। তাকিয়ে দেখে প্রীতি আল-কোরআন পড়ছে। শেষ কবে সে কাউকে আল-কুরআন পড়তে দেখেছিলো তা ভুলে গেছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মা-মারা যাওয়ার পর বাবার নির্বাচনী কাজ ছাড়া ঢাকার বাইরে আসা হয় নি অর্ণবের। প্রীতিদের বাড়িটা গ্রামও না আবার শহরও না, পৌরসভা এলাকায় কেবল নগরায়নের ছোঁয়া লেগেছে। রাস্তা কোথাও কাঁচা, কোথাও পাকা কোথাওবা ভাঙা। রাতে প্রীতিদের বাড়ি আসতে একটা ব্রিজ দেখেছিলো অর্ণব। প্রীতিদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পনের মিনিটের রাস্তা । তাজা হাওয়ায় সবকিছু গুছিয়ে একবার ভাবতে চায় অর্ণব,তার জীবনের সবকিছু। এতো হটকারিতায় সবকিছু ঘটছে যে, সে কেন কিছুর হিসাব মিলাতে পারছে না। প্রথমে রুহান খন্দকারের নির্জনার এক তরফা প্রেমিক হওয়ার কথা প্রকাশ পাওয়া, পরে অর্কর ভালে হয়ে যাওয়া, তার নিজের বিয়ে, আরশির বিয়ে এখন আবার প্রীতির ভাইয়ের সন্ধান। অর্ণবের কেন যেন মনে হচ্ছে এসব কিছু কেউ ইচ্ছে করে করছে।
নদীর পাশে একটা টঙ দোকান, ছোট একটা ছেলে বোধহয় দোকানে কাজ করে সে কেবল ঝাড়ু দিচ্ছে।
নদীর ফুরফুরে হাওয়া আসছে টঙের উপর বসে অর্ণব একের পর এক সিগারেটে আগুন দিয়ে জীবনের অঙ্কগুলো মেলাতে ব্যস্ত।
–আমরা মেয়ে স্মোকিং পছন্দ করে না। বড় দুই মেয় বা পাপড়ির মা অনেক মানা করলেও কখনো শুনি নি কিন্তু প্রীতির জেদের কাছে হেরে স্মোক করা বাদ দিয়েছি। তোমার মতো একজন চেইন স্মোকারের জন্য সিগারেট বাদ দেওয়া মনে হয় না ইহজীবনে সম্ভব হবে।
ফরিদ রহমানের কথায় চিন্তার তারাগুলো কেটে গেলো অর্ণবের।
সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হাতের সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে না নিভিয়ে দেয়।
–আপনার মেয়ের জন্য সিগারেট কেন এমন অনেক বদঅভ্যাসই বাদ দিতে পারবো।
ফরিদ রহমান তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন,
–একটা অর্ধ জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলে কি প্রমাণ হয়ে যায় যে তুমি স্মোক ছেড়ে দিবে।
বিনয়ী কন্ঠে অর্ণব বলে,
–আমি মুখে বলে কিছু প্রমাণ করতে চাই না সঠিক সময়ে আপনি দেখতে পাবেন প্রীতির জন্য আমি কতটা কি করতে পারি।

–ভারি মিষ্টি কথা বলতে পারো তুমি। এজন্যই প্রীতি তোমার ফাঁদে পা দিয়েছে।
বলে ফরিদ রহমান সেখান থেকে চলে যায় তখন অর্ণবও তার পিছু নেয়। ব্রীজের উপর এসে ফরিদ রহমান অর্ণবকে খেয়াল করে বলেন,
–আমাকে ফলো করার কোন বিশেষ কারণ?
– চায়ের দোকানে কোন কথা বললে তা ছড়িয়ে পরতে সময় লাগে না, আপনাকে কিছু কথা জানাতে চাই। আপনার কি পাঁচ মিনিট সময় হবে?
–তোমার সাথে কথা বলার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
বলেই ফরিদ রহমান আবার সেখান থেকে চলে যেতে নিলে অর্ণব একটু জোরালো কন্ঠে বলে,
–প্রীতি আমাকে ভালবাসে না, বিয়েটা সে বাধ্য হয়ে করেছে।
ফরিদর রহমানের পা দুটো থেমে যায়। অর্ণব আশপাশটা ফাঁকা দেখে ধীর পায়ের তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রীতি আর তার বিয়ের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে এবং এটাও বলে রুহান তাদের বাড়িতে নির্জনাকে নিয়ে ঠিক কি কি বলেছে।
–স্যার আপনার মেয়ের কোন দোষ নেই, ইনফ্যাক্ট সে আমাকে ভালোই বাসে না। প্রথম থেকে সে আমাকে রিজেক্ট করেছে। তাছাড়া সে কখনো আমাকে হাসবেন্ডের মর্যাদা দিবে কিনা সেটাও আমি জানিনা।
ফরিদ রহমানের কাছে রাজনীতিবিদ আর আদম ব্যাবসায়ী সমান, দুটোই মিথ্যাবাদী-দালাল। তবে এই মুহূর্তে অর্নবের কথাগুলো তিনি ফেলে দিতে পারছেন না।তাছাড়া ছেলেটাকে তার দেখে আর পাঁচ জনের মত ভাওতাবাজও মনে হচ্ছে না।
–আমার ছেলের মার্ডার কেসে তোমার বাবার নাম এসেছে কথাটা জানো তো?
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় অর্ণব।
–যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তবে সেক্ষেত্রে তুমি কি করবে?
স্থির কন্ঠে অর্ণব বলে,
– যদি সত্য প্রমাণিত হলে কিংবা মিথ্যা প্রমাণ হওয়ার পরও যদি আমি জানতে পারি আমার বাবা দোষী তাহলে,আমি কি করবো সেটা সময় বলে দেবে। এখন শুধু একটাই কথা বলতে পারি,অর্ণব ইর্তেজা সিদ্দিকী অন্যায়ের সাথে কোনদিন আপোষ করেনি আর করবেও না।


সারারাত নির্ঘুম থাকার পর ভোরে চোখটা লেগেছিলো আরশির। কিন্তু তাতেও শ্বাশুড়ি মাইমুনা বেঘাত ঘটান।
সকাল সকাল তিনি আরশিকে ডেকে রুহানের কথা জিজ্ঞেস করেন। আশরি, “কোথায় জানি না”, “রাতেও ঘরে ছিলো না” এই দুটো লাইন বলতেই মাইমুনা খন্দকার কর্কশ গলায় বলে উঠেন,
–তা জানবে কি করে? স্বামীকে আঁচলে কিভাবে বেঁধে রাখতে হয় তা শেখানোর মতো কেউ তো আর বাপের বাড়িতে কেউ ছিল না। তাই খেয়ে খেয়ে আলুর বস্তার মতো মোটা হয়েছো। শোন মেয়ে আমি স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, নিজেকে শরীর স্বাস্থ্য ঠিক করো আমার ছেলের মন জয় করার চেষ্টা করো। আমি জানি, নির্জনা নামের মেয়েটার কাছাকাছি থাকার জন্য রুহান তোমাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু ওই মেয়েটার নাম রুহানের জীবন থেকে মুছে দিতে হবে। যেভাবে হোক রুহানের মনে নিজের জন্য জায়গা করে নাও। নাহলে এ বাড়ি থেকে বিদায় হও। আমার ছেলের জন্য আমি যোগ্য কাউকে নিয়ে আসি।
মাইমুনা খন্দকার চলে গেলে নিজের উপর খুব ধিক্কার হয় আরশির। এই যোগ্যতার পরীক্ষায় সে সবসময়ই হেরে যাচ্ছে। প্রথম মাহেরের যোগ্য ছিলো না আর এখন রুহানের যোগ্য নয়।

এসব ভাবনার মধ্যে তার ফোনে রিং হয়। প্রীতির নাম্বারটা ভেসে ওঠে।
–হ্যাঁ প্রীতি বলো। কেমন আছো হঠাৎ আমাকে কল দিলে? রাগ কমেছে?
কিন্তু প্রীতি আরশির কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের মতো কিছু ঘটনা বলল। যা শুনে আরশির পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল।
প্রীতির ভাস্যমতে মাহেরকে যেদিন আরশি প্রপোজ করেছিল সেদিন রাতে জাফর সিদ্দিকীর ঘরে মাহেরকে প্রবেশ করতে দেখে প্রীতি। কৌতুহল বসত জাফর সিদ্দিকীর দরজার বাইরে আঁড়িপাতে সে এবং সেখানেই মাহের আর জাফর সিদ্দিকীর মধ্যকার ভয়াবহ কথাবার্তা শুনতে পায়।
যেগুলো ঠিক এমন ছিলো,
–আমার মেয়েকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে,আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছো আমি কেন তোমার বোনের চিকিৎসা বন্ধ করেছি? শোন তুমি কাল থেকে আর আমার এখানে আসবে না। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু সেটা পাওয়া যায় না । কি এটা ভেবেছিলে আমার মেয়েকে একবার পটিয়ে ফেললেই, রাজকন্যা আর রাজত্ব সব পাবে আর আমি কিছু টের পাবো না? ভুল। আমার মেয়েকে আমি তোমার মত ভিখারির সাথে কখনোই বিয়ে দিবো না।
–স্যার আমি আরশিকে ভালোবাসি।
–এসব ভালোবাসার কথা তোর মতো হা-ঘরের ছেলেদের মুখে মানায় না। কান খুলে শুনে রাখ তুই যদি আমার মেয়ের সাথে কোন রকম সম্পর্কে জড়াস তবে তুই কোন টাকা পাবি না।

–প্রয়োজন নেই আপনার টাকার। আমি কোন না কোন উপায়ে টাকার ব্যবস্থা করবো। অন্য হাসপাতালে মিলির চিকিৎসা করাবো।
–বেশ তাহলে বোনের চিকিৎসার ব্যবস্থাও দেশের বাইরে-ই করিস। কারণ আজ থেকে বাংলাদেশের কোথাও যাতে তোর বোনের চিকিৎসা না হয় সেটা আমি জাফর সিদ্দিকী দেখবো।
–স্যার প্লিজ এতটা নির্দয় হবেন না, আমি আরশিকে ভালোবাসি।
– নিজের বোনের জীবন না আরশি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাবি। আর হ্যাঁ যদি আমার কথায় রাজি থাকিস তাহলে আরশিকে রিজেক্ট করার ভিডিও করে আমার ফোনে পাঠিয়ে দিস। তবেই তোর বোনের চিকিৎসা আবার শুরু হবে।

প্রীতি ফোন রাখার সময় বলে,
–আমি সেদিন প্রথম তোমার বাবাকে আমি ব্ল্যাকমেল করি যে, তিনি যদি আমাকে আমার ভাইয়ের সন্ধান না দেয় তাহলে আমি তোমাকে সব জানিয়ে দেবো। তোমার বাবা আমার কাছে পনের দিন সময় চেয়েছিল। তাই আমি তোমাকে বলেছিলাম মি. মাহেরের ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ১৫ দিন সময় নিতে। আমি পনের দিন পরই তোমাকে সবটা বলে দিতাম কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেছে৷
প্রীতি ফোন রাখলে নীরবে দু’ফোটা অশ্রু ঝরিয়ে আরশি ঘরে রাখা ড্রেসিং টেবিলে ভেসে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
–বাবা তুমি অনেক ভুল করেছো,মানুষকে ছোট করেছো, না-জানি প্রীতি, নির্জনা, মাহেরের মতো কতে অসহায় মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছো। আল্লাহ তোমার এসব পাপের শাস্তি হয়তো তোমার মেয়ে হিসেবে আমাকে দিচ্ছেন। তুমি অন্যের মেয়ের খারাপ চেয়ছো তাই আজ তোমার মেয়ের সাথে খারাপ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সেই রুমে রুহান এসে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–এই যে, ‘ডেডিস প্রিন্সস’ রেডি হও।
–কোথায় যাবো?
–আমার শ্বশুর বাড়ি।
–আমাদের বাড়ি? কিন্তু কেন?
–তোমার হবু সতীনকে দেখতে।
অদ্ভুতভাবে রুহানের এমন কথায় আরশির রাগ কিংবা হিংসা কোনটাই হয় না সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
–আমার হবু সতীনকে দেখতে যাচ্ছেন নাকি নিজের প্রেজেন্ট সতীনকে দেখতে যাচ্ছেন, সেটাতো জোহরা মঞ্জিলে যাওয়ার পরই বুঝা যাবে। তবে, মি.খন্দকার একটা কথা তো ক্লিয়ার ভাবি আর অর্কর ডিভোর্স হবে না। তাই বলছিনির্জনা নামটা নিজের জীবন থেকে যত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলবেন ততই ভালো।
সাথে সাথে রুহান আরশির গলা চেপে ধরে বলে,
–যতদিন রোহান খন্দকার বেঁচে থাকবে তার জীবন থেকে কেউ নির্জনাকে মুছে ফেলতে পারবেনা। তোর ভাইকে কি করে আমাদের জীবন থেকে দূর করতে হয় তা আমার ভালই জানা আছে।
আরশির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তবু সে বলে,
–আপনি চেষ্টা করতেই পারেন কিন্তু বার বার হেরে যাবেন।
যা শুনে রুহান আরও রেগে যায় এবং আরশিকে ধাক্কা দিয়ে খাটের কোণা বরাবর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। । যার ফলে আরশির কপাল কেটে যায়।
আরশি ব্যাথায় উহ্ করতেই রুহান তার মুখ চেপে ধরে বলে,
–এরপর কোনদিন আমার মুখের উপর কথা বললে শুধু কপাল না তোর পুরো শরীরটাই রক্তাক্ত করে দিবো।


নির্জনা ঘুম ভেঙে নিজের অর্ধবিবস্ত্র শরীরটাকে চাদরে লেপ্টানো অবস্থায় দেখে ভীষণ লজ্জা পায়। ঘড়ি দেখে বুঝতে পারি নিজের স্বামীকে একান্ত আপন করে পাওয়ার কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এতোক্ষণ ঘুমানোর কারণটা মনে পরতেই একটু লজ্জা পায়। ঘরের এদিক ওদিক খুঁজে অর্ককে না পেয়ে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে অর্ক খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বিছানার উপর বসে আছে।
ভেজা চুলের তলে পেঁচিয়ে নির্জনা অর্কর পাশে বসে তাকে প্রশ্ন করে,
–কোথায় গিয়েছিলে? আর কি এতো ভাবছো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অর্ক বলে,
–বাবা ডেকেছিল, রুহান আর আরশি আসছে এটা জানাতে।
–বাবা কি বিয়েটা মেনে নিয়েছে?
–তাতে কিছু যায় আসে না কারণ আমি জানি রুহান নিজেই কোনদিন বিয়েটা মেনে নেবে না।
–তবে আরশি আপুর কি হবে? ওই সাইকোটা তো আপুর জীবনটা পুরো ধ্বংস করে দিবে ।
–আমিও সেটাই ভাবছি। কিন্তু কি করবো তা বুঝতে পারছি না। এমন সময় প্রীতি কিংবা ভাইয়াও নেই যে তাদের সাথে আলাপ করবো। আর ফোন করারও সাহস পাচ্ছি না কারণ আমার জন্য তাদের সম্পর্কটা ব্লেন্ডার হয়ে গেছে। এদিকে বাকি রইলো আমার বাবা, তিনি খুব ডিপ্লোমাটিক মানুষ। আর যাই হোক খন্দকারদের সাথে শত্রুতা তিনি করবেন না।
–সব ঠিক হয়ে যাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অর্ক নির্জনার হাত ধরে বলে,
–আমিও জানি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কিভাবে ঠিক হবে সেটা বুঝতে পারছি না।
–তুমি একটু ভাবো নিশ্চয়ই কোন উপায় বের হবে।


মিলি নিজের ভাইয়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? আজ কতগুলো দিন ধরে দেখছি তুমি আর আগের মতো নেই।
নিজের বোনের কথা শুনে শুকনো হেসে মাহের বলে,
–আমি আগের মতই আছি। তুই আমাকে নিয়ে একটু বেশি ভাবছিস।
–মোটেও বেশি ভাবছি না। আমার বুঝি চোখ নেই? আমি বুঝি দেখতে পাই না? বলো না কি হয়েছে।
কিন্তু মাহের তার কথার কোন উত্তর দেয় না।
–ও আমাকে বুঝি বলা যায় না? বেশ একবার ভালো হয়ে নেই। তারপর যাকে বলা যায় তাকে দ্রুত তোমার জীবনে আনার ব্যবস্থা করব।
বোনের কথার ইশারা বুঝতে পেরে মাহের বলে,
–এসব পাকামি বন্ধ করে খাওয়ায় মনোযোগ দে।
তখনই মাহেরের ফোনে একটা এসএমএস আসে। যা পড়ে মিলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়৷

রেস্টুরেন্টে মাহেরের সামনে অর্ক বসে আছে। হ্যাঁ মাহেরকে অর্কই এসএমএস করে ডেকে পাঠিয়েছে।
কারণ অনেক ভেবে সে আর নির্জনা মিলে আরশির মুক্তির একটা উপায় পেয়েছে কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব যদি-না আরশি নিজে থেকে মুক্ত হতে চায়। সেজন্যই সে মাহেরকে ডেকেছে। অর্ক বিশ্বাস করে আরশি মাহেরের সব কথা শুনবে।
তাই কোন প্রকার ভনিতা ছাড়া অর্ক প্রশ্ন করে,
–আরশি যদি রুহানকে ছেড়ে দেয় তবে কি আপনি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবেন মি.হুদা?

–চলবে?

বিঃদ্রঃ বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।