প্রেমে পরা বারণ পর্ব-৩৪

0
33

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
পর্ব- ৩৪
আরশির ক্লান্ত মুখশ্রীটার দিকে তাকিয়ে মাহেরের বুকের বাঁ পাশে চিন চিন ব্যাথা হলো। মাতৃত্ব মেয়েদের অন্য রকম রূপ প্রদান করে যার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আরশি। রুহান পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আরশি মাহেরকে ভালো আছেন মি. হুদা বলে রুমে চলে যায়।
এদিকে রুমে ফিরে আসার পর রুহাকে উদ্দেশ্য করে আরশি বলে,
–থ্যাংকস,আমার জন্য এতোটা ভাবার জন্য।
রুহান তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দেয়,
–তোমার জন্য কে ভাবে? আই এম ওয়ারিড এবাউট মাই চাইল্ড।
ক্ষণিকের জন্য রুহানের প্রতি যে ভালোলাগা আরশির মনে কাজ করেছিলো তা দপ করে নিভে গেলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় রুহানের উদ্দেশ্য বলে,
–আমি তো ভেবেছিলাম আপনি এই বাচ্চাটা চান না।
–হোয়াট রাবিশ! আমার বাচ্চা আমি কেন চাইবো না।
আরশি রুহানের চোখে চোখ রেখে বলে,
– তাহলে আমাকে কেন চান না? আমি তো আপনার ওয়াইফ।
আরশির প্রশ্নে রুহান কঠোর গলায় বলে,
–তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি কেন তোমাকে চাই না।
–হ্যাঁ তা জানি তবুও(চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) । আচ্ছা এসব কথা বাদ দিন, আজকে ডক্টর বেবির জেন্ডার ডিটেক্ট করবে আপনি যাবেন?
–জেন্ডার ডিটেক্টের প্রয়োজন নেই আমার বাচ্চা, ছেলে -মেয়ে হোক যাই হোক, আমারই থাকবে।
–কিন্তু আমি জেন্ডার ডিটেক্ট করতে চাই আর যদি বাচ্চাটা মেয়ে হয়, তাহলে আমি কোনদিনও চাইবো না, সে এই পৃথিবীর আলো দেখুক।
–হাউ ডেয়ার ইউ!(বলে আরশির গলা চেপে ধরে রুহান) আমার বাচ্চাকে নিয়ে এমন কিছু বলার সাহস কি করে হয় তোমার?
অতি তাচ্ছিল্যের সাথে নিজের গলা থেকে রুহানের হাতটা সরিয়ে আরশি বলে,
–বাচ্চাটা আমারও। তাই আমি চাইনা সে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে এই দুনিয়ার পুরুষদের হাতে লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত হোক। এই দুনিয়ায় নারীর কোন মূল্য নেই। সব নারীর কথা বাদ দিন, শুধু আমার আর নির্জনার কথা একবার ভাবুন,শুধুমাত্র আপনার জেদের জন্য আমরা দুজন জীবনের যে সব কষ্ট ভোগ করছি তার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট যদি আল্লাহ আপনার মেয়ের ভাগ্যে লিখে
আরশিকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে রুহান,
–অসম্ভব সে হবে আমার মেয়ে হবে, রুহান খন্দকারের মেয়ে। আমার মেয়ের ভাগ্যে কোনদিনও এসব থাকবে না ।
–আমার বাবাও একদিন নির্জনাকে বলেছিল আমার ভাগ্যে কখনো প্রীতি আর নির্জনার কষ্ট থাকবে না কারণ আমি জাফর সিদ্দিকীর মেয়ে। মিস্টার রুহান খন্দকার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি চিরকাল থাকে না। তাই মিছে অহংকার করবেন না।

আরশির এরূপ কথায় রুহানের ভেতরটায় অজানা একটা ভয় দানা বাঁধে।
আরশি সেটা অনুভব করে বলে,
–জানেন আমার এক জ্ঞানী টিচার একটা কথা সবসময় বলতো, কর্মফল এমন একটা জিনিস যা নিজে না হলেও পরবর্তী জেনারেশন ঠিকই ভোগ করে।
এরপর সে আর কথা না বাড়িয়ে রুহানকে একা থাকতে দেয়।


–রাজনীতি ছাড়তে পারবেন মি.সিদ্দিকী?
ডা.প্রীতির প্রশ্নের সহসাই কোন উত্তর দিতে পারে না অর্ণব।
অর্ণবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। যদি গুলিটা অর্ণবের হাত ছুঁয়ে চলে গেছে কিন্তু রক্তক্ষরণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে। খবর পেয়ে ফরিদ রহমান নিজেই মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। যতটা আশা ছিলো অর্ণব সেই তুলনায় অনেক বেশি যোগ্য প্রমাণ হয়েছে। তবে মেয়েকে সেই কথা বুঝাতে ব্যর্থ ফরিদ রহমান। প্রীতির একটাই কথা, ভাইয়ের খুনির ছেলের সাথে সে সংসার করবে না।
অর্নবের নিরবতায় মলিন হেসে ডা.প্রীতি বলে,
–আমার বাবা ও আমার পরিবারের সবাই চায় আমি আপনার সংসার করি। কিন্তু নিজের ভাইয়ের খুনির ছেলের সাথে সংসার করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই গত কয়েক মাসে আপনার চেষ্টার দরুনই আপনার বাবার করা অপকর্মগুলো প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তাতে আপনি নিজেও রাজনীতির নোংরা খেলায় যুক্ত তা ঢাকা পরে যায় না। অনেক ভেবে দেখলাম আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারলেও নিজের জীবনসঙ্গীর রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়াটা আমি মেনে নিতে পারবো না। তাই আপনাকে আমি আবার জিজ্ঞেস করছি, রাজনীতি ছাড়তে পারবেন?
প্রীতির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই হন্তদন্ত হয়ে অর্ণবের কেবিনে তার সহযোগী মিরাজ প্রবেশ করে,
–ভ…ভাইইইই। অর্ক ভাই, তার বউ আর আরশি ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
–কি?
প্রীতি আর অর্ণব একযোগে প্রশ্ন করে।
–তুই সত্যি বলছিস? এসব কি করে হলো?
–হ্যাঁ ভাই আমি সত্যি বলছি, আপনার কথা মতো প্রীতি ভাবিসহ সবার উপর নজর রাখছিলাম। অর্ক ভাই আর তার বউকে আপনাকে দেখতে আসার সময় গাড়ি থেকে আর আরশি ম্যাডাম হাসপাতাল থেকে গায়েব হয়ে যায়। শুধু তাই নয় আপনার বোনের হাসবেন্ডও মিসিং।
তখনই অর্ণবের ফোনে একটা এসএমএস আসে,
“নিজের ভাই-বোনকে বাঁচাতে চাইলে জাফর সিদ্দিকীকে নিয়ে *** ঠিকানায় চলে এসো, পুলিশ আনলে কেউ বাঁচবে না। “
সাথে সাথে অর্ক,নির্জনা, আরশি, রুহানের মুখ বাঁধা ছবিও তার ফোনে আসে।
হাতের স্যালাইনটা একটানে খুলে হাসপালের বেডটা ছেড়ে দাঁড়ায় অর্ণব।
প্রীতি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে,
–একি কি করছেন, আপনি আরও অসুস্থ হয়ে পরবেন। প্লিজ শান্ত হোন।
প্রীতির হাত ধরে অর্ণব বলে,
–আমি সবাইকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি, প্লিজ ততক্ষণ নিজের খেয়াল রেখো। কথা দিচ্ছি যদি ফিরে আসি তবে তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই সব হবে। আমি আর কখনোই রাজনীতির ওই নোংরা খেলায় ফিরে যাবো না।
এরপর মিরাজের দিকে তাকিয়ে,
–প্রীতিকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করবি না।


মাহেরের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয় তমিজউদদীন খন্দকার।
–আরশি কোথায়? রুহান কোথায়?
মাহের কি উত্তর দিবে? ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে ছিলো সে। কিন্তু একঘন্টা পার হয়ে যাবার পরও যখন আরশি ফিরে আসে না তখন ভেতরে গিয়ে ডাক্তার কিংবা আরশি কাউকেই সে দেখতে পায় না। তবে চেম্বারে একটা চোরা দরজা দেখতে পায় মাহের। প্রথমে সে ভেবেছিলো কাজটা রুহান করিয়েছে কিন্তু যখন জানতে পারে রুহানও কিডন্যাপ হয়েছে তখন তার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।
–আমার ছেলে আর ছেলের বউয়ের যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।
মাইমুনা খন্দকাের কথা শেষ হবার আগেই অর্ণব করে খন্দকার বাড়িতে প্রবেশ করে,
– কাকে ছাড়বেন, কাকে ধরবেন সেসব বোঝাপড়া পরে হবে। আগে আমাদের সবাইকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে।
–ওদের কোন খোঁজ পেয়েছো?
তমিজউদদীন খন্দকারের প্রশ্নে অর্ণব তাকে কিডন্যাপারের ডিমান্ডের কথা জানায়।
–আঙ্কেল আমি বাবার বেল করাতে পারি নি। লিগ্যালি কিছু হবে না। বাবাকে বের করতে আপনার হেল্প লাগবে। ইউ নিড টু টক পিএম। উনি আপনার কথা ফেলতে পারবে না।
–কিন্তু
তমিজউদদীন খন্দকারের কিন্তুর প্রেক্ষিতে খেই খেই করে উঠে মাইমুনা খন্দকার।
–তুমি কিন্তু কিন্তু করছো কেন? এতো কিছু ভাবনার সময় নেই। তুমি শুনতে পেলে না অর্ণব কি বললো? জলদি করো।
অতঃপর তমিজউদদীন খন্দকার জাফর সিদ্দিকীকে নিজের ক্ষমতা বলে সবার অলক্ষ্যে বের করে আনে৷ এবং অর্ণব মাহেরকে দিয়ে কিডন্যাপারের ঠিকানায় পাঠায়।


আবছায়া একটা ঘরে জ্ঞান ফেরে আরশির। চোখ মেলেই সে আবিষ্কার করে সে একটা চেয়ারে বাঁধা।তাছাড়া এখানে সে একা নয় নির্জনাও একই অবস্থায় বাঁধা রয়েছে।
মাথায় মৃদু যন্ত্রণা নিয়ে নির্জনাকে ডাকে,
–ভাবি!
নির্জনাও চোখ মেলে।
–তুমি এখানে কি করে? আমি কোথায়?
–জানি না। আমি ডাক্তারের কাছে আল্ট্টার জন্য গিয়েছিলাম। ডাক্তার আমাকে বেডে শুইয়ে ছিলো এরপর একটা মিষ্টি গন্ধ আর কিছু মনে নেই।
আরশিও কিছু একটা মনে করে বলে,
–ভাইয়াকে দেখার জন্য আমি আর অর্ক গাড়িতে করে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম হঠাৎই গাড়ির ড্রাইভার একটা জায়গায় ব্রেক করে আমাদের উপর কিছু একটা স্প্রে করে। এরপর আর কিছু মনে নেই।
–অর্ক তোমার সাথে ছিলো কিন্তু এখানে তো নেই। অর্ক কোথায়?
অর্কর কোথায় এই প্রশ্নে অস্থির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে অর্কর নাম ধরে ডাকতে থাকে নির্জনা। তখনই ধীর পায়ে কেউ সেই ঘরে প্রবেশ করে,
–অর্ককে না দেখতে পেয়েই এভাবে কাঁদছো সুইটহার্ট। এরপর যখন অর্কর ক্ষত-বিক্ষত লাশ নিজের চোখে দেখবে তখন কি করবে?
আগন্তুকের দিকে একরাশ হতাশা নিয়ে আরশি এবং ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে নির্জনা তাকিয়ে একত্রে বিষ্ময়ে বলে উঠে,
–রুহান!

–চলবে