প্রেমে পরা বারণ পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
41

#প্রেমে_পরা_বারণ
#Nosrat_Monisha
#অন্তিম_পর্ব

–রুহান!!
–ইয়েস, রুহান দ্যা গ্রেট রুহান খন্দকার। হোয়াট হ্যাপেন্ড সারপ্রাইজড? কাম অন সুইটহার্ট আমার উপর তোমার এতটুকু বিশ্বাস নেই?
রুহানের কথায় চোখ মুখ-শক্ত করে নির্জনা প্রশ্ন করে,
–অর্ক কোথায়?
–যেখানে থাকার কথা অন দ্যা ওয়ে অফ ডেথ।
–আমার হাসবেন্ডের কিছু হলে তোকে আমি খুন করবো।
–আমার ভাই কোথায় রুহান?
আরশির প্রশ্নে রুহান বাঁকা হেসে বলে,
–তোমার কোন ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছো? যে পাশের রুমে বন্দী নাকি যে তোমার বাবাকে নিয়ে আসছে?
–ম..ম..মানে কে আসছে? আপনি কি করতে চাইছেন?
–আরে না আমার সো কলড ওয়াইফ। আমি কিছু করছি না। এসব তোমার বাবার করা পাপ। আমিতো শুধু ওদের একটু ফিনানশিয়ালি ব্যাকআপ দিয়েছি।

প্রকৃতপক্ষে জাফর সিদ্দিকী যাদের গুম ও খুন করেছে তাদের একত্রিত করে অর্থায়ন করেছে রুহান। ফলাফল সেই দলটি এখন তীব্র প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে গেছে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য জাফর সিদ্দিকী ও তার পরিবারের বিনাশ। তবে রুহান ওদের অর্থায়ন করেছে এই শর্তে যে, তারা নির্জনা ও ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আরশির বাচ্চাকে তার হাতে তুলে দিবে। তাই এখন ওরা আলাদা।
সবটা জানতে পেরে নির্জনা ও আরশির পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যায়।
–আপনি যতই চেষ্টা করুন জিততে পারবেন না। মানছি আমার বাবা অন্যায় করেছে, তার সাজা তিনি ভোগও করবেন কিন্তু আমার ভাইয়েদের কিছু হবে না।
–কে বাঁচাবে তোমার ভাইদের? তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড মাহের হুদা?
আরশির চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে ব্যঙ্গ করে রুহান বলে,
–কি ভেবেছিলে তোমার বয়ফ্রেন্ডের কথা আমি কখনো জানতে পারবো না? আচ্ছা এতো ভালোবাসো তাহলে ছেড়ে দিলে কেন?

স্বাভাবিক গলায় আরশি বলে,
–রুহান কান খুলে শুনে রাখুন মাহের আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড না, আমাদের মধ্যে সেরকম কোন সম্পর্ক কখনো গড়েই ওঠে নি। যদি সম্পর্ক গড়ে উঠতে তবে আপনি ফালতু ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে বিয়ে করতে পারতেন না। আর একটা কথা ,মাহের আমার বয়ফ্রেন্ড হলেও আমি তার কাছে সাহায্য চাইতাম না কারণ আমি বিয়েকে সম্মান দিতে জানি। যে মুহূর্তে আমি বিয়ে করেছি সেইমুহূর্তে আমি আমার সমস্ত অতীত ভুলে গিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা সাহায্য করার মালিক আল্লাহ। আর তিনি যদি চান তাহলে আপনি বা ওই লোকজন কেউ আমার আর আমার ভাইদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

তাচ্ছিল্যের সাথে নির্জনা বলে,
–কাকে কি বলছো আরশি? এই অমানুষটাকে এসব বলে কোন লাভ আছে? আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম একে ছেড়ে দাও, কিন্তু তুমি তো বিয়ের কালামের উপর ভরসা করে বসে আছো।
নির্জনার কথার কোন জবাব না দিয়ে আরশি রুহানকে প্রশ্ন করে,
–আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন বাইরের ঐ লোকগুলো যদি আপনার কথা না শুনে আমাকে মেরে ফেলতে চায় তবে আপনি কি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? না-কি নির্জনার জন্য নিজের প্রেগন্যান্ট ওয়াইফকে ওদের হাতে তুলে দিবেন। অবশ্য বাচ্চা হওয়ার পর তুলে দেওয়া আর আগে তুলে দেওয়া একই। তা-ই না মি.খন্দকার?

কিন্তু কোন কথা আগেই একটা ছেলে রুমের ভেতরে এসে বলে,
–আপনি বাইরে যান ওরা চলে এসেছে। আমি এখানে আছি।
সম্মতি দিয়ে রুহান চলে যায়।

অর্ক অজ্ঞান অবস্থায় চেয়ারে বাধা রয়েছে রুহানকেও সেখানে এনে পাশাপাশি একটা চেয়ারে এনে বেঁধে দেওয়া হলো ।
অর্ণব নিজের বাবাকে নিয়ে নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে। মাহের তাদের সাথে আসে নি।
–আমার বোন আর ভাইয়ের বউ কোথায়?
অর্ণবের প্রশ্নে কিডন্যাপারের দলের একজন বলে,
–সবাই আছে আগে মুক্তিপণ আমাদের হাতে তুলে দিন তারপর সবাইকে এক এক করে আপনাদের কাছে দিব। ওই দেখুন আপনার বোন, ভাইয়ের বউ।
শেষ লাইনটা শুনে চমকে উঠে রুহান। কারণ রুহানের সাথে কিডন্যাপার দলের কথা ছিলো নির্জনা ও আরশিকে ওরা স্পর্শ করবে না। আরশির ডেলিভারি পর্যন্ত তাকে আটকে রেখে বাচ্চা জন্মের পর তা রুহানের হাতে তুলে দিয়ে তারা আরশিকেও শেষ করে দিবে।
নির্জনা ও আরশির গলায় ধারালো ছুরি চকচক করছে। আর একটু হলেই গলা কেটে যাবে।
ক্রোধে চিৎকার করে উঠে রুহান,
–এগুলো কি করছিস তোরা? আমাদের ডিলের কথা ভুলে গেছিস? ওদের ছাড়।

রুহানের মাথায় পিস্তল ধরে থাকা লোকটা খুব স্বাভাবিক গলায় তার কানের কাছে বলে,
–খন্দকার সাহেব জাফর সিদ্দিকীর কোন রক্ত পৃথিবীতে জীবিত থাকতে পারবে না। আপনার প্রেমিকাকে কেউ কিছু করবে না কিন্তু আপনার স্ত্রী বাঁচবে না।
–যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বাচ্চা জন্ম না নেয় ওকে কেউ টাচ করতে পারবে না।
বলেই রুহান নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়।
–চিৎকার করলে আপনার প্রেমিকার গলাটাও কেটে যাবে।
রুহান চুপ হয়ে যায়।
এদিকে জাফর সিদ্দিকীকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে।

তখন সেখানে থাকা একজন হুংকার করে উঠে,
–ওখানে দাঁড়িয়েই নিজের করা পাপের প্রতিফল দেখ জানোয়ার। আর অনুভব কর নিজের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলে কেমন লাগে। এই তোরা গুলি কর, গলা কাট।
কিন্তু কেউ গুলি কিংবা গলা কাটার আগেই অর্ক নিজের হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে, অনেকক্ষণ তার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু সে অজ্ঞান হওয়ার ভান ধরে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টায় ছিলো। মাহেরও ততক্ষণে পিছনে থেকে এসে নির্জনাও আরশির গলায় ছুরি ধরে থাকা লোক দুটোকে কৌশলে ফেলে দিয়ে তাদের নিরাপদ স্থানে দাঁড় করায়।

– এসব করে লাভ নেই আজকে সবাই মরবে। আমাদের পরিবারে যখন হাসি নেই তখন খুনি জাফর সিদ্দিকীর পরিবারের কেউ বাঁচতে পারবে না।
দুই উঠতি বয়সি যুবকের হুমকিতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো উপস্থিত সবার। কেউ কোন কিছু বোঝার আগে গোলাগুলি শুরু হয়। ভয় পেয়ে আরশি ও নির্জনা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। আক্রমণকারীদের মধ্যে কেউই ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলো না তাই কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত মাহের সবাইকে সহজে ধরাশায়ী করে ফেলে। এরমধ্যে রুহানও মুক্ত হয়ে যায়। অর্ক ও অর্ণব মাহেরকে সহায়তা করে।
সব ঠিক থাকলেও দুটো ছেলে আরশি ও নির্জনার দিকে নিশানা তাক করে, যা রুহানের চেখে পরে। সে নির্জনাকে বাঁচাতে সেদিকে দৌড়ে যায়,নির্জনাকে সরিয়ে দেয় ফলে নির্জনার দিকে আসা গুলিটি রুহানের ঘাড়ের পিছনে লাগে, সে মাটিতে লুটিয়ে পরে। অন্যদিকে মাহের আরশির দিকে নিশানা তাক করা ছেলেটির হাতে শুট করে। ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পরে, কিন্তু মাহেরের পিস্তলের গুলি শেষ হয়ে যায়। সেই দেখে অন্য ছেলেটি নির্জনার বুকে গুলি চালিয়ে দেয়। এবার সে আরশির দিকে নিশানা তাক করলে মাহের এক দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির হাত মচকে দেয়।
এম্বুলেন্সে রুহান ও আরশিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
পুলিশ এসে জাফর সিদ্দিকীসহ বাকি অপরাধী সবাইকে জেলে নিয়ে যায়।


হাসপাতালে নির্জনা আর রুহান দুজনেরই পাশাপাশি অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে মাহেরসহ খন্দকার আর সিদ্দিক পরিবারের সদ্যরা অপেক্ষা করছে।
কিছু সময় পর নির্জনার অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে ,
– হার্টে গুলি লেগেছে ইমিডিয়েট হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া বাঁচানো সম্ভব না।
–দ্যান ডু ইট।
অর্কর কথায় ডাক্তারটি বলে,
–মি.সিদ্দিকী হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ম্যাচিং হার্ট প্রয়োজন যা আমাদের কাছে নেই। তার পেশেন্টের ব্লাড গ্রুপ খুব রেয়ার । আমরা অলরেডি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিচ্ছি।
তখনই রুহানের অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে বলে,
–সরি! ব্রেইন ডেড।
যা শুনে তমিজউদদীন খন্দকার ও আরশি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসপাতালের বেঞ্চে বসে পরে। তাদের চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। অন্য দিকে মাইমুনা খন্দকার বিলাপ করে।
–ডাক্তার প্লিজ আমার ছেলেকে বাঁচান। আমার একমাত্র ছেলে।
–ম্যাম, শান্ত হেন নিজেকে সামলান ইটস টাইম, লেট হিম গো।

রুহানের মৃত্যুতে শোকে জর্জরিত খন্দকার পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে নির্জনার বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তায় সিদ্দিক বাড়ির প্রতিটি সদস্য উদ্বিগ্ন। যত সময় যাচ্ছে তত যেন নির্জনার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। ঠিক তখনই একজন ডাক্তার ও সিদ্দিকীর সদস্যদের সামনে একটি প্রস্তাব রাখল যা শুনে মাইমুনা খন্দকার খেকিয়ে ওঠে ,
–ওই রাক্ষসী মেয়েটার জন্য আমার ছেলেটার জীবন তছনছ হয়ে গেল। আমার ছেলেটা শান্তি পেল না, ওই মেয়েটার জন্য আমার ছেলেটা মারা গেল আর এখন আপনারা বলছেন ওই মেয়েটার জীবন বাঁচানোর জন্য আমার ছেলের হার্ট দিয়ে দিতে। অসম্ভব আমি মাইমুনা খন্দকার বেঁচে থাকতে তা কখনোই হবে না। ওই মেয়ে বাঁচলো কি মরলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।

হ্যাঁ, যাকে নির্জনা কখনোই ভালবাসতে পারেনি হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তার সাথে সেই রুহানের হার্ট ম্যাচ করেছে। এখন একমাত্র মৃত রুহানের জেগে থাকা হৃৎপিন্ডটিই পারে নির্জনাকে নতুন জীবন দিতে। সবাই এতে মত দিলেও মাইমুনা খন্দকার তাতে রাজি হচ্ছে না। অর্ক মাইমুনা খন্দকার ও তমিজউদদীন খন্দকারের পা ধরে বসে নির্জনার জীবন ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে না, তমিজউদদীন খন্দকার ভালো মন্দ কিছু বলছেন না তবে মাইমুনা খন্দকার নিজের কথায় অনড়।
ডাক্তারটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
–ম্যাম আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি কিন্তু আপনিও একবার চিন্তা করুন যদি হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হয় তাহলে মেয়েটা বেঁচে যাবে।
–আমি এসব কিছু জানি না আমার ছেলের হার্ট আমি ঐ রাক্ষসীকে দিবো না।
ডাক্তার হতাশ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ডাক্তারটি কিছুদূর যেতেই আরশি পিছন থেকে ডাক দিয়ে তাকে থামায়।
–ডক্টর হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের জন্য কার অনুমতি জরুরি প্যারেন্ট না ওয়াইফ?
ডাক্তারটি স্পষ্ট জানায়,
– বিবাহিত ব্যাক্তির জন্য হাসবেন্ড অথবা ওয়াইফ ফাস্ট গার্জেন।
আরশি নিজের মুখাবয় শক্ত করে রুক্ষ কন্ঠে বলে,
–দ্যান, আমি আরশি সিদ্দিকী ওয়াইফ অফ রুহান খন্দকার এই ট্রান্সপ্লান্টের অনুমতি দিচ্ছি। আর দেরি না করে আপনারা ব্যবস্থা করুন আমি সব ফরমালিটি ফর্মে সই করবো।
ডাক্তারটি একটু আমতা আমতা করে বলে,
–কিন্তু ম্যাম, আপনার শ্বাশুড়ি!
–আই উইল হ্যান্ডেল হার। চলুন আগে ফর্মালিটিসগুলো শেষ করি।
ফর্মালিটিস শেষে আরশি ডাক্তারকে অনুরোধ করে, রুহানের হার্ট নির্জনাকে দেওয়া হচ্ছে এই কথাটি আপাদত গোপন রাখতে। ডাক্তারও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরশির কথায় সায় দেয়।
অর্ণব প্রীতির সাথে মিলে বিভিন্ন জায়গায় হার্টের সন্ধান করছে।
অর্ক এখনো মাইমুনা খন্দকারকে রিকোয়েস্ট করে চলেছে। তখন আরশি রুমে এসে অর্ককে বলে,
–অর্ক তুমি এখানে কি করছো? চলো নির্জনার অপারেশন শুরুর জন্য বন্ড সই করতে হবে। ডাক্তার তোমাকে খুঁজছে।
–হার্ট পাওয়া গেছে?
–হুম।
বলতেই অর্ক এক দৌড়ে বেরিয়ে যায়।


অপারেশনের থিয়েটারের বাইরে পুলিশ নিয়ে চিৎকার করছে মাইমুনা খন্দকার। দুই নার্সের কথোপকথনে তিনি জানতে পেরে গেছেন নির্জনার বুকে রুহানের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। তাই তিনি সরাসরি পুলিশ নিয়ে এসেছেন অপারেশন বন্ধ করতে। এতো বড়ো হাসপাতালে খন্দকার ইন্ডাস্ট্রির মালকিন পুলিশ নিয়ে এসেছেন ব্যাপারটা প্রেস মিডিয়ার ল্যামলাইট পাওয়ার আগেই হাসপাতাল কতৃপক্ষ মাইমুনা খন্দকার পুলিশকে কাগজপত্র দেখায়। যেখানে ফার্স্ট গার্জেনের সম্মতি হিসেবে আরশির সই জ্বলজ্বল করছে । যা দেখে তিনি কষে আরশির গালে চড় বসিয়ে দেন। মাহের, অর্ক, অর্ণব তাকে ধরতে গেলে আরশি ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলে।
–সর্বনাশী মেয়ে, যার জন্য তোর স্বামী মরলো তাকে বাঁচাতে চাইছিস?(আরশি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে) আমিও দেখি এই অপারেশন কিভাবে হয়। প্রয়োজনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সমস্ত হাসপাতাল মাটির নিচে পুঁতে দেবো।
তমিজউদদীন খন্দকার তাকে অনেকভাবে আটকানোর চেষ্টা করেন। অর্ক, অর্ণব, প্রীতি এমনকি মাহেরও তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু মাইমুনা নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়।
এবার আরশির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে মাইমুনা খন্দকারকে হুমকি দেয়,
–নির্জনা যদি না বাঁচে তবে আপনার ছেলের শেষ চিহ্ন (সাড়ে পাঁচ মাসের ফুলানো পেটের উপর হাত রেখে) দুনিয়ার আলো দেখবে না।
মাইমুনা খন্দকার রেগে আরও একটা থাপ্পড় দিতে এলে তমিজউদদীন খন্দকার তার হাত ধরে,
–অনেক হয়েছে এবার তুমি বাড়াবাড়ি করছো।
খেঁকিয়ে উঠে মাইমুনা খন্দকার,
–আমি বাড়াবাড়ি করছি আর এই মেয়েটা? নিজের পেটের সন্তানকে মেরে ফেলতে চাইছে।
অতিমাত্রায় স্বাভাবিক গলায় তমিজউদদীন খন্দকার বলেন,
–সন্তানটা আরশির, তাই ওর অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ঠিক যেমন রুহানের উপর তোমার অধিকার আছে ।
তমিজউদদীন খন্দকারের এভাবে আরশির পক্ষ সমর্থন করায় উপস্থিত সবাই বিষ্ময়ে চমকে যায়।
–রুহানের বাবা!
মাইমুনা খন্দকারপর বিষ্ময়ে কঠোর গলায় তমিজউদদীন খন্দকার বলে,
–সিদ্ধান্ত তোমার, নির্জনার জীবন না নিজের ছেলের সন্তান।
কৃতজ্ঞতায় সিদ্দিকী বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মাথা নিচু হয়ে গেলো তমিজউদদীন খন্দকারের সামনে।
মাইমুনা খন্দকার বুঝতে পারেন যেখানে নিজের স্বামী তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেখানে তর্ক-বিবাদ কিংবা কোন ক্ষমতা কাজ করবে না।
তবে হেরে গিয়ে দমে যাবে তেমন মানুষ মাইমুনা খন্দকার নয়। তিনি সরাসরি আরশির সামনে গিয়ে বলে,
–বেশ রুহানের হার্ট দিতে আমি রাজি তাই হবে তবে আমার একটা শর্ত আছে।
তমিজউদদীন খন্দকার বাধা দিতে চাইলে আরশি বলে,
–না বাবা, মাকে বলতে দিন। মা বলুন আমি আপনার যেকোনো শর্ত মেনে নিতে রাজি।
ভাবলেশহীন গলায় মাইমুনা খন্দকার বলেন,
–যতদিন বেঁচে থাকবে তোমাকে সারাজীবন রুহানের বিধবা হয়ে আর তার অনাগত সন্তানের মা হয়ে বাঁচতে হবে। অন্য কোন পুরুষের কল্পনাও কখনো তুমি করবে না।
এমন কঠোর শর্তে তীব্র প্রতিবাদ করে উপস্থিত সবাই । এমনকি অর্ক নিজেও। অবশ্যই সে চায় নির্জনা সুস্থ হোক কিন্তু নিজের বোনের জীবন নষ্ট করে নয়। কিন্তু মাইমুনা খন্দকার নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়। অপরদিকে আরশি কোন প্রতিবাদ না করে মৃদু কন্ঠে বলে,
–যে স্বামী আমার বাচ্চাসহ আমার পুরো পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো, মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও যে স্বামী আমাকে নয় বরং অন্য একটা মেয়ের কথা ভেবেছে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেছে , এখন আপনি সেই মেয়েকে বাঁচাতে আমাকে সারাজীবন বিধবা হয়ে থাকতে বলছেন? বেশ আপনার কথা মেনে নিলাম।
–কথায় না লিখিত দিতে হবে।
–আপনি কাগজ নিয়ে আসুন আমি সই করে দিবো।
মাইমুনা খন্দকার উকিলকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে কাগজ নিয়ে আসতে বলে।
আরশি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
সবাই আরশিকে বুঝানোর চেষ্টা করে। সবশেষে মাহের।
–আমার একটা ভুলের সাজা এভাবে না দিলেও তো হয়।
মলিন হেসে আরশি বলে,
–আমি আপনাকে কোন সাজা দিচ্ছি না বরং নিজে সাজা ভোগ করতে যাচ্ছি। আমার বাবা, মা ও স্বামীর কৃতকর্মের। আমি জানি ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত তবুও আমি বলছি আমি চাই না আমার স্বামীর কৃতকর্মের ফল আমার সন্তান ভোগ করুক। আপনাকে দেখলে আমি হয়তো দুর্বল হয়ে যেতে পারি তাই আজ থেকে দয়া করে আপনি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না। নিজের জীবনে এগিয়ে যান।
–আরশি!
কিন্তু আরশি মাহেরের কোন কথাই শুনে না। তমিজউদদীন খন্দকার তাদের কথোপকথন শুনে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কেননা তিনিও আজ একটু স্বার্থপর হয়েছেন মনে মনে চাইছেন আরশি শুধুমাত্র তার ছেলের শেষচিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকুক।

কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।
জাফর সিদ্দিকী ও অন্যান্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেস চলছে।
রুহান আর আরশির জমজ ছেলে-মেয়ে কান্না করছে, এক এক জনকে সামলাতে গিয়ে আরশির কপালের ঘাম ছুটে যায়। চারজন ন্যানি রেখেছে তমিজ উদ্দিন খন্দকার তারপরেও তিনমাসের বাচ্চা দুটো মা ছাড়া কিছুই বোঝে না।
আরশি এদের দেখে আর ভাবে বাচ্চা দুটো তাকে যেভাবে চাইছে তার সিকিভাগও যদি তাদের বাবা তাকে চাইতো তবে আজ গল্পটা একটু অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু আবার এটাও ভাবে সম্পূর্ণ দোষ রুহানের নয় কারণ সেও তো কখনো রুহানকে ভালবেসে উঠতে পারেনি, তার মন থেকে মাহের হুদা নামটা তো কখনোই সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি।
এদিকে তমিজউদদীন খন্দকারের আরশি একাকিত্বের কথা ভেবে মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলেও মাইমুনা খন্দকার নিজের সিদ্ধান্তে বেশ সন্তুষ্ট। তার মতে,তখন বুদ্ধি খাটিয়ে আরশির উপর শর্তটা চাপিয়ে দিয়ে তিনি ভাল করেছেন, কারণ সেটা না করলে তার নাতি-নাতনি দুটি মা-বাবা ছাড়া অনাথ হিসেবে বড় হত।। টাকা দিয়ে তো আর মা-বাবার ভালবাসা কেনা যায় না।


ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েছে অর্ণব ও প্রীতি। বেরিয়েই প্রীতি নিজের মাকে ফোন দিয়ে নতুন অতিথি আসার সুসংবাদ জানায়। প্রীতির মা মোরশেদা খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ বলেন।
তখনই অর্ণবের ফোনে মাহেরর কল আসে ফোনটা রিসিভ করে একটু আড়ালে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে অর্ণব।
–মাহের সাহেবের বোন এখন কেমন আছে?
প্রীতির প্রশ্নের উত্তরে অর্ণব বলে,
–বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টের পর সুস্থ।
–সিঙ্গাপুর থেকে তারা কবে ফিরবেন?
–একমাস পর।
–আপনি কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
–হুম।
–আমরা সবাই মিলে যদি আর-একবার চেষ্টা করি তবে কি আরশি আর মাহেরের জীবনটা নতুন করে..
প্রীতির কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না অর্ণব তার আগেই বলে,
–এই সম্পর্কটা হোক, আমার বোন নতুন করে শুরু করুক এটা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ চায় না। (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) কিন্তু আমি চাইলে তো হবে না। আরশি জেদের বশে নিজে বন্দী জীবন বেছে নিয়েছে। কারণ সে যদি মাহেরকে বিয়ে করতে চাইতো তবে মাইমুনা খন্দকার ঐ ঠুনকো কাগজের জোরে কোন কিছু করতে পারতো না। মজার ব্যাপার কি জানো? আমি যখন আরশিকে এই ব্যাপারে জানিয়েছি তখন সে বলেছে, সে অলরেডি এসব জানে। তবুও সে মাইমুনা খন্দকারের শর্তে জীবন যাপন করছে। কারণ তারমতে মাহেরকে বিয়ে করলে, সে নতুন জীবন পাবে, হয়তো বাচ্চাগুলোও তার সাথে চলে আসবে তখন ছেলে হারা খন্দকার দম্পতি বড্ড অসহায় হয়ে যাবে। এমনিতেও রুহান মারা যাওয়ার পর আঙ্কেল বহুকষ্টে ব্যাবসাটাকে টিকিয়ে রেখেছেন।

প্রীতি অর্ণবের কথাগুলো নীরবে শুনে আর আল্লাহর কাছে আরশির সুখী জীবনের জন্য দোয়া করে।


মাঝরাতে ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের বা পাশে চেরা দাগ থাকতে হাত বোলাচ্ছে নির্জনা। যে রুহানকে সারা জীবন ঘৃণা করে এসেছে, যাকে চিরদিনের মতো জীবন থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল সেই রুহানের হৃদয়টাই এখন তার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সরাসরি বিছানায় অর্কর বুকে মুখ লুকায় নির্জনা।
রুহানের হৃদপিণ্ড নির্জনার বুকে এই সত্যিটা জানার পর প্রথম প্রথম তাকে সামলাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিলো অর্ককে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে নির্জনা বাস্তবটা মেনে নিতে শিখছে। কারণ তাকে যে নতুন জীবন দেওয়ার জন্য আরশি নিজের জীবন নষ্ট করলো এখন সেই জীবনটা নিয়ে হেলা-ফেলা করলে আরশির ত্যাগেকে অসম্মান করা হবে।

নির্জনাকে বুকে নিয়ে অর্ক তার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে,
–ওয়াইফি, আই লাভ ইউ।
নির্জনা মুচকি হাসে। কারণ শত কষ্ট আর মনখারাপের মধ্যেও অর্কর মুখে এই চারটি শব্দ তাকে শান্তি দেয়।
নির্জনা ঘুমিয়ে গেলে ডিম লাইটের আবছা আলোতে তার বুকের কাটা দাগের দিকে তাকিয়ে অর্ক মনে মনে বলে,
– রুহান, তোমার অবসেশন সত্যি প্রশংসনীয়। মরে গিয়েও নির্জনার থেকে আলাদা হও নি।

সমাপ্ত।।