#প্রেম_ও_অসুখ
|পর্ব ৪|
– নবনীতা শেখ
দোকানি বইয়ের দাম বলল,
-“সাড়ে চারশো ট্যাকা।”
সাঁঝ এবার আর বোকামি করবে না। রিকশাভাড়া দশটাকা কম বলেছিল। এবার পঞ্চাশ টাকা কম বলবে। খুব করে বলতেই যাচ্ছিল, মুখটা খুলল কেবল। আর তখনই তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটা বলে উঠল,
-“এটা দুইশ বিশ টাকা। এর বেশি দিলে বোকা হবেন।”
সাঁঝের নিঃশ্বাস গলার কাছে এসে আটকে গেল, হৃৎপিণ্ডটা হয়ে উঠল বেপরোয়া। আওয়াজটা কেমন চেনা নয় কি? মনের ভেতর যে দ্বিধার ঢেউ খেলছে, তা দৃঢ়তার তীরে এসে থামার সুযোগ পেল না।
সাঁঝ আড়চোখে তাকাল পাশে। হালকা নীল রঙের শার্ট, অফ হোয়াইট রঙের প্যান্টের সাথে ইন করে পরা এক অতিমাত্রিক সুদর্শন, স্মার্ট লোক! বয়সের হিসেবে এলে ত্রিশের দ্বারেই যেন দাঁড়িয়ে সে। চোখ দুটো শক্ত, গলার স্বর শান্ত। সাঁঝের বেহায়া নজর বেশ কয়েকটা মুহূর্ত ওখানে আটকে রইল। লোকটা এর মধ্যে দরদাম করে বই কিনে সাঁঝকে বলল,
-“পে করুন।”
বাতাসের শাঁইশাঁই শব্দ, এত লোকের কোলাহল, যান্ত্রিক গাড়ির হর্ন কিংবা থমকানো মনের বেলাল্লাপনা না-কি কী, ঠিক জানা নেই সাঁঝের। সে কেন যেন লোকটার কথা শুনতে পারল না। তাই প্রশ্ন করে উঠল,
-“জি?”
-“দুইশ বিশ টাকা? বই কিনবেন না? পয়সা নেই?”
পর পর তিনটা বাক্য, উর্ধ্বক্রমে যেন অপমান সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। পয়সা নেই মানে? কী বলে লোকটা? গত পরশুই তো তার স্বামী তাকে হক আদায়ের মনোভাবের সাথে ত্রিশ হাজার টাকায় এবং দশ টাকা সেন্ড মানি চার্জের খোঁটাও দিয়েছে। সে আবার গরিব হয় কী করে?
মুহূর্তে সাঁঝের মেজাজ খেপে গেল। ফুঁসে উঠে বলল,
-“আশ্চর্য লোক! আপনাকে কি আমি বলেছি আগ বাড়িয়ে আমার হেল্প করতে? বলিনি নিশ্চয়ই? কথা বলতে আসছেন কেন? রাস্তায় মেয়ে দেখলেই ছুকছুকানো স্বভাব.. তাই না?”
অবিশ্বাস্য চোখে দু সেকেন্ড তাকিয়ে রইল লোকটা। চোখের গ্লাসটা ঠিক করে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। আর তারপর সাঁঝকে যেন ভুলেও দেখেনি, এমন এক ভান করে উলটো রাস্তা ধরে চলে গেল। সাঁঝ ঠোঁট ওলটালো। মনের বিষণ্ণতা নাকি বুকের অস্থিরতা, ঠিক বুঝতে পারছে না সাঁঝ। তার আর কিছু ভালো লাগল না। বইয়ের টাকা দিয়ে অন্য দোকানে চলে গেল।
তার সব বই কেনা শেষ, অদিতিও নাগালের কাছে চলে এসেছে, রিকশায় দরদাম করে এবার সে ত্রিশ টাকায় বাসায় এসছে। তবু অন্তরটা কেমন খচখচ করছে তার। লোকটাকে ওভাবে না বললেও চলত! আচ্ছা, বলেছে তো বলেছে। লোকটাও তার সাথে পালটা জবাবে কিছুক্ষণ তর্ক চালিয়ে যেত! তবেই না মনে শান্তি পেত সাঁঝ। তা না করে কী করল? ইগনোর? সাঁঝের অস্তিত্বকে অনস্তিত্বসূচক চিহ্ন লাগিয়ে চলে গেল ওখান থেকে? এইখানে এসেই তো তার ফিমেল ইগো দ্রিমদ্রিম শব্দে রেগে আগুন!
অবশেষে সাঁঝ নিজের ফোন হাতে তুলল। রাগ, তেজ, ঝাঁজ, জেদ যা আছে, সব মেটানোর জন্য তো লিগ্যালি এক ব্যাটাকে পেয়েই গেছে। আপাতত এ-ই সই।
সাঁঝ টেক্সট করল না, কল করল সোজা। ও-ধারে রিসিভ হলো কল। প্রথমেই এলো সালাম। সাঁঝ সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-“কই আছেন?”
জনাবের কণ্ঠস্বর অত্যাধিক শীতল, বহমান নদীর মতো প্রশান্ত আর… যে কথা সাঁঝ মোটেও মানতে চাইছে না সেটা হলো—আফিমের মতো নেশাক্ত গলার স্বর…
সে বলল,
-“কোনো সমস্যা?”
সাঁঝ বড়ো করে একটা দম টেনে নিয়ে বলা শুরু করল,
-“সমস্যা? সমস্যার গোডাউন। যেই দুনিয়াতে পুরুষ মানুষ থাকবে, সেই দুনিয়াতে মহিলাদের সমস্যা হবে না, এ কথা ভাবলেন কেমনে? ভাবতে কষ্ট হয়নি?”
-“আর ইউ ওকে? কিছু হয়েছে?”
-“আপনারে আমার মনে ধরা বাদে দুনিয়ার সব অসাধ্য সাধন হয়েছে। কাঁচা বাজারের দাম কমেছে। ডিমের দাম হালিতে চল্লিশ টাকা। মানা যায়?”
জনাবের থমকানো আওয়াজ, “নাহ!”
কল পাওয়া মাত্র ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ক্রমাগত পায়চারির সাথেও কী শান্ত স্বরে কথা বলে যাচ্ছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে! এ মুহূর্তে তার কপালে দুটো আঙ্গুল চলমান। সে ধীরস্বরে শুধাল,
-“ম্যাডামের মেজাজের এ দশা কেন?”
-“আমার দিন আর দুনিয়ার কোনো কিছু ঠিকঠাক রাখছেন আপনি? ভাল্লাগে? একটা বিড়াল এসে মিয়াও করলেও আমার মনে হয়, আপনার সাথে আমার বিয়ে না হলে ওই হতচ্ছাড়িটা মিয়াও বলত না।”
নতমুখী হয়ে হাসল সে। সে হাসির রেশ কলের এপাশে রণচণ্ডী রূপ ধারণ করা সাঁঝ অবধি পৌঁছাল না। বরঞ্চ মেয়েটা চেতে গেল,
-“কী আশ্চর্য! কথা বলছেন না কেন? আমারে কী ভাবছেন আপনি? কী? আপনার সাথে কথা বলার জন্য পড়ে থাকি? এখনো চুপ আছে! কথা কানে যায় না?”
-“গো অন ম্যাডাম, আ’ম অল ইয়ার্স।”
একটু স্ন্যাকি, হালকা ঠাট্টা মিশ্রিত, স্বল্পভাষী লোকটার অত্যাধিক শীতল আওয়াজ। সাঁঝ থমকে গেল। নিথর আওয়াজে বলল,
-“আপনি…আপনার নাম কী?”
ফিঁচকে এক গা জ্বালানো হাসির সাথে কটাক্ষ-বানে মারতে উদ্যত ভদ্রলোক বলে উঠল,
-“সিরিয়াসলি? সাড়ে ছ’সপ্তাহ পর?”
তাই বলে সবসময় এভাবে কথা বলবে? এভাবে? একটা কথার কি সোজা উত্তর আশা করা যায় না? বিয়ে পড়ানোর সময় বা সাইন করার সময় অবশ্য নামটা শুনেছিল, দেখেছিল… প্রচণ্ড ট্রমাটিক ব্রেইন তার সে মুহূর্তে নামটা মাথায় ধরে রাখতে পারেনি। এতে নিশ্চয়ই তার দোষ নেই? সব দোষ এই লোকটার।
সাঁঝ শুনল না তার নাম। দরকার নেই নাম জানার। এমন তো নয় যে তার নাম জানলে সে ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়ে যাবে কিংবা দুনিয়ার উপকারে আসবে… যত্তসব!
________
দীর্ঘদিন ধরে সাঁঝ রাতে অনিদ্রা, দিনে ঝিমুনি, চোখ-ব্যথা, কাঁধব্যথাসহ যাবতীয় বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ভেবেছিল, ঢাকা এসে সবার আগে ডাক্তার দেখিয়ে নেবে। অথচ আলসেমি করতে করতে সপ্তাহ কেটে গেল। না দেখে, না শুনে, কিছু না বলতেও কীভাবে কীভাবে যেন তার বিবাহিত স্বামী ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে। গতরাতের টেক্সটে তাই ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করেছে,
-“ডাক্তার দেখানো হয়েছে?”
বিস্মিত সাঁঝ বিরক্তির সাথে জানতে চাইল,
-“কী উপলক্ষে?”
-“ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে শোনো, একটা ক্লিনিকের এড্রেস দিচ্ছি। আগামীকাল বিকেল চারটায় ওখানে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বসবেন। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখছি আমি। সময়মতো চলে যেও।”
সাঁঝ দুটো থমকানো শ্বাস ফেলে লিখল,
-“আচ্ছা।”
কোত্থেকে যেন মায়া আর দায়িত্ববোধের মিশেলে এক ছোট্ট বীজের দানা তার মনে এসে গেঁথে গেল, সে জানে না তা। এরপর ধীরে ধীরে বীজ থেকে চাড়া, চাড়া থেকে গাছ… মনের ভেতরটা অবধি শিকড় গেঁড়ে নেবে, বাইরের সবটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে ডালপালা। আর তারপর একদিন সাঁঝ আচমকা টের পাবে, সে আটকে গেছে এই মানুষটার সাথে, তাকে ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই…
নির্বোধ সাঁঝ আবার টাইপ করতে লাগল,
-“মনের ভীষণ অ-প্রিয় মানুষ, শুনুন। বড়ো অদ্ভুত আপনি! চিনি না, জানি না.. মুখোমুখি দুটো কথাও কোনোদিন হয়নি। তবু আপনি কেন আমার এত খেয়াল রাখেন, কেন এত যত্ন? এগুলো কি শুধুই কাগজে লেখা দায়িত্ব কেবল? তবে কেন না বলতেও বুঝে যান আমার মনের সবটা?”
লেখাগুলোতে কিছু ইতিবাচক অনুভূতির ছাপ পাওয়া গেল নাকি? বুঝতে পেরেই সাঁঝ ব্যাকস্পেসে সবটা মুছে ফেলল। ব্যাকস্পেসের গায়ে লেখা থাকে এক আকাশ সমান অভিযোগ, অভিমান ও মুছে নেওয়া গল্প…
সাঁঝ পরদিন বিকেলে ক্লিনিকে চলে এলো। রিসিপশনে যেতেই এক মহিলা রিসেপশনিস্ট এগিয়ে এলো। সাঁঝ নিজের নাম বলতেই সে বলল,
-“আপনি সাঁঝ? আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল। ভেতরে যেতে পারেন। ডাক্তার আপনার অপেক্ষা করছেন।”
সাঁঝ “থ্যাংক ইউ” বলে চেম্বারে দরজায় খানিকটা নক করল।তারপর দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। সেকেন্ড কয়েক থমকানো মুহূর্তের পর ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক ভরাট পুরুষালি কর্কশ আওয়াজ,
-“আসুন।”
সাঁঝ ভেতরে প্রবেশ করে প্রথম ঝটকা খেলো ডাক্তারকে দেখে। কয়দিন আগে নীলক্ষেতে এই লোকটার সাথেই না তার একদফা না হওয়া তর্ক চলেছিল? হতভম্ব সাঁঝকে চোখ তুলে দেখার মতো আগ্রহবোধ জনাব করল না।
রুমটা সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। দেয়ালে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হালকা বোঝাপড়ার ছবি সাজানো। সামনে কাঠের টেবিলের এক কোণায় চকচকে একটা নেমপ্লেট।
Dr. Anay Ahmed Hrid
MBBS, FCPS (Medicine)
Consultant, Internal Medicine
মনে মনে বিড়বিড় করল সাঁঝ, “হৃদ… হৃৎপিণ্ড… অসুখ…”
হৃদ বলল,
-“বসুন।”
সাঁঝ চেয়ার টেনে বসে পড়ল। কে জানে কেন, কোনো কারণ ছাড়াই, ওই সেদিনের নীলক্ষেতের কথা মনে করে বলে উঠল,
-“আপনি…”
বিশেষ আগ্রহ এবারও দেখাল না হৃদ, ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“সমস্যা কী?”
বোধহয় ভুলে গেছে। কিংবা আহামরি মনে তাকে রাখেনি। সাঁঝ আর মাথা ঘামাল না ওই ব্যাপারে। যে সমস্যা নিয়ে এসেছিল, তাই বলল,
-“ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত টান ধরে থাকে। মাঝে মাঝে চোখটাও ঝাপসা হয়ে আসে… রাতে ঘুম হয় না ঠিকমতো।”
হৃদ এবার তার দিকে তাকাল। চোখে চোখ রাখল। হৃদের বাদামি বর্ণের ঘোলাটে চোখ দুটো সাঁঝের গাঢ় কাজলচোখে আটকে রইল তিনটা সেকেন্ড মাত্র। অথচ সাঁঝের মনে হলো, লোকটা যেন চোখ হয়ে তার ভেতরটা ঝেঁকে নিয়েছে…
-“ঘাড় সোজা হয়ে বসুন, চোখের দিকে তাকান।”
সাঁঝ আড়ষ্টভাবে তাকাল। হৃদ একবার তার কাঁধে টোকা দিলো। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-“স্ট্রেস থেকে হচ্ছে। সাথে স্লিপ ডিজওর্ডার। চোখে সমস্যা নেই। তবে ভেতরের কথা বের হয়ে যাচ্ছে।”
শেষোক্ত কথাটায় সাঁঝ আহাম্মকের মতো জিজ্ঞেস করল,
-“হু?”
হৃদ সরাসরি এবার তার দিকে তাকাল। সেই চোখ থেকে সাঁঝ স্পষ্ট বুঝতে পারল সে তাকে চিনেছে। আর মনে মনে এতক্ষণ ধরে যা ভাবছিল, তা-ও যেন বুঝে গেছে। সাঁঝ ইতস্তত করল,
-“আমি ভেবেছি আপনি আমাকে মনে রাখেননি।”
হৃদ প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ফের এক নজর তাকাল সাঁঝের দিকে,
-“মনে রাখি না। ভুলে যেতে পারি না… দুটো আলাদা।”
চলবে…