#প্রেম_ও_অসুখ
|পর্ব ২৪|
– নবনীতা শেখ
সাঁঝের শ্বশুর চলে গেলেও উদয় বাড়িতেই রয়ে গেছে। তার এইচএসসি শেষ হয়েছে। আপাতত বড়োসড়ো ছুটি। ছুটি না ছাঁই! ভাইয়া কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। এডমিশনের প্রিপারেশন নাকি এইচএসসি এক্সাম যেদিন শেষ হয়েছে, সেদিন থেকেই শুরু করে দেওয়া লাগে। কথাটাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে হৃদ উদয়ের এহেন দশা করে ছাড়ল।
সন্ধ্যার দিকে হাপিত্যেশ করে উদয় সাঁঝকে বলল,
-“ভাবি, তোমার বর অন্য মহিলার বরের সাথে এমন অনাচার করে যাচ্ছে, তোমার খারাপ লাগছে না?”
সাঁঝ ঠোঁট উলটে বলল,
-“লাগছে না তো।”
-“সঙ্গদোষে দূষিত তুমি।”
-“হ। চা খাবা?”
সাঁঝ অন্যান্য খাবার যতটা বিষ বানায়, চা-টা ততটাই অমৃত যেন। উদয় চনমনে হয়ে বলল,
-“আচ্ছা, ভাবি।”
উদয়ের আজ অন্যদিনের তুলনায় ভালো লাগছে। চা খেয়েই সে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল। পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল পূর্বিকার সাথে। উদয় একহাতের দূরত্ব রেখে খানিকটা পিছে হাঁটতে লাগল। তার উপস্থিতি পূর্বিকা টের পেয়ে মুচকি হাসল,
-“উদয়?”
উদয়ের ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো,
-“ইয়েস, ম্যাডাম! ইটস উদয়, ফরএভার এট ইওয়োর সার্ভিস..”
উদয়ের বলার ভঙ্গিমায় পিছে মুড়ে তাকাল পূর্বিকা। লক্ষ করা গেল, পূর্বিকাকে অন্যান্য দিনের মতো অত বিষণ্ণ আজ লাগছে না। কেমন অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে। তার হাসি চোখ ছুঁয়েছে। কী যে প্রশান্তি লাগল উদয়ের! এমন শীতল অনুভূতিকে গায়ে জড়ানোর সময় পূর্বিকা সামনে ঘুরে গেল, জিজ্ঞেস করল,
-“কী অবস্থা?”
মাথা চুলকে হেসে ফেলল উদয়,
-“আর অবস্থা! চলছে, যাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে.. আপনার?”
-“আমারও।”
-“আপনি ভালো আছেন?”
উদয়ের কিশোর কণ্ঠটা অনেক বেশিই রূঢ় শোনাল, কথা বললে মনে হয় ধমকে-ধামকে বলছে। অথচ শব্দগুলোয় গঠিত বাক্যটা শুনলে আবার লাগবে, নাহ! আন্তরিক বাক্য। এমন আন্তরিক বাক্য কে এভাবে উচ্চারণ করে? অত্যন্ত দুঃখবোধ করল পূর্বিকা। অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় নতমুখী হয়ে মনে মনে কাঁধ উঁচাল। সম্মুখে বলল,
-“হ্যাঁ, ভালো। তুমি?”
-“পূর্বিকা, থামুন!”
পূর্বিকার পা থেমে গেল। লক্ষ করল সে ভুল রাস্তা ধরেছে। তার গন্তব্য উলটো দিকের রাস্তায়। ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয়ে গেল উদয়ের। ভড়কে গেল সামান্য। কেন যে এমন হলো, জানে না। তবে মনে হলো সে ধরা পড়ে যাবে।
উদয় আবারও জিজ্ঞেস করল,
-“কেমন আছেন?”
চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা বহু তপস্যার ব্যাপার। পূর্বিকা খামোখা চেষ্টা করল না। অনিমেষ তাকিয়ে বলে গেল,
-“বেঁচে থাকতে গেলে সবসময় ভালো থাকাটা জরুরি নয়। মাঝেমধ্যে মন্দও থাকতে হয়।”
নিজের যুক্তিসাপেক্ষে স্থির ও দৃঢ় উদয় বলে উঠল,
-“বেঁচে থাকতে হলে ভালো থাকাটা কেবল জরুরিই নয়, আবশ্যিক ব্যাপার। ধরুন, আপনি আগামীকাল সুখী হওয়ার আশায় আজ দুঃখী.. আর কাল এলোই না আপনার জীবনে…”
কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে গেল পূর্বিকা। চিরপরিচিত এই চোখ দুটো বড়ো অপরিচিত লাগছে তার। ছেলেদের চোখ পড়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে মেয়েরা জন্মেছে। কোন ছেলের চোখে তার জন্য কী আছে, এটুকু বোঝা মেয়েদের জন্য সহজ। পূর্বিকা প্রথমে মানতে চাইল না। পরবর্তীতেও মানল না। ফিচকে এক হাসির সাথে বলে উঠল,
-“কেউ কেউ চিরদুঃখিনী।”
পরপর আবার বলে উঠল,
-“থাকো! আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে…”
পূর্বিকা রিকশায় উঠে পড়ল। ওধারে স্থির দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চোখে উদয় পূর্বিকার যাত্রাপথে তাকিয়ে রইল। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল,
-“পূর্বিকা, আপনাকে দুঃখিনী হিসেবে আমি মানব না কখনো। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকুর বিনিময়ে হলেও আপনার জন্য সুখ কুড়াবো…”
______
অর্ণব গাজিপুর শহরের একটি শান্তিপূর্ণ লেকের ধারে বসে আছে। তার মস্তিষ্ক শান্ত, মন বিক্ষিপ্ত। বুকের ভেতরটা তীব্র বিক্ষোভে ফেঁটে যাচ্ছে। উপমাটা কেন যে এমন করল!
তাদের ভালোবাসার সূচনাটা কখন হয়েছে, তা ঘটা করে বলা সম্ভব নয়। কিছু একটা অনুভব করা, খেয়াল রাখা, একে-অপরকে আঁড়চোখে খোঁজা, কাছে আসার বাহানা, একবুক ধুকপুকানি আর চোখেতে মান-অভিমানের হাতছানি নিয়েই তারা এগোচ্ছিল। দুইবছর আগে উপমা যখন মাধ্যমিক দিলো, তখন এক ফ্যামিলি গেট টুগেদারে তারা একে-অপরকে নিজেদের মনের কথায় জানায়। তখন থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কে জড়ায়।
উপমা মেয়েটা বরাবরই বেশ ভীতু ছিল। নিজের প্রেমের ব্যাপারে ছিল তার অগাধ লজ্জা। তারপর যখন আচমকা তার বিয়ে ঠিক করা হলো, সে বলতে পারেনি অর্ণবের কথা। সম্মতি দিয়ে দেয় বিয়েতে। এরপর মধ্যরাতে অর্ণবকে কল দিয়ে ব্যাপারটা জানায়। অর্ণব তাকে বলে,
-“আমি ফুপাকে কল দিচ্ছি..”
-“নাহ! প্লিজ না। বাবা মানবে না। ঝামেলা হবে অনেক।”
-“তাহলে তুমি বলো!”
-“আমি পারিনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম, বিশ্বাস করো।”
-“তাহলে পালিয়ে এসো।”
উপমা বরাবরই সবার চোখে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিল, সবার কথা শুনত, সবাইকে মান্য করত, বাবা-মায়ের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না বলে যাওয়া তার পরিমিত স্বভাবের কারণে এমনিতে সবার ভীষণ পছন্দের সে। এখন পালিয়ে গেলে তাকে সবাই খারাপ মেয়ে বলবে। আর তা একদমই মানতে রাজি নয় উপমা।
তাই একবুক ভয়, অস্বস্তি, সংকোচ ও গলার স্বরে কম্পন মিশিয়ে উপমা বলে,
-“পালিয়ে আসা, সম্ভব না।”
অর্ণব আবারও বলে,
-“আমি আব্বা-আম্মাকে জানাই? তারা ফুপা-ফুপিকে রাজি করি……”
ত্বরিতে উপমা বলে উঠল,
-“তাহলে আমি সবার চোখে খারাপ মেয়ে হয়ে যাব!”
অর্ণব থমকে যায়, নিস্পৃহ গলায় বলে,
-“তুমি কি সত্যিই বিয়েটা করে নেবে?”
উপমা মাথা নেড়ে বলে,
-“আমার হাতে কিছু নেই। আমি চেষ্টা করেছিলাম খুব…”
তাচ্ছিল্যভরে হেসে উঠল অর্ণব, হ্যাঁ চেষ্টা! এমন চেষ্টা করেছে মেয়েটা যে মুখফুটে তাকে নিয়ে একটা শব্দও নিজের পরিবারের কাছে বলতে পারেনি। সবশেষে অর্ণব কেবল একটা কথাই বলেছিল,
-“যেই ভালোটা থাকার জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে, স্রষ্টা তোমায় সেই ভালোটা রাখুক।”
তারপর কল কেটে দেয়। মেয়েটা নির্বোধ! তাই হয়তো এমন ধারার কথা বলতে পারল। নয়তো কেবলমাত্র চরিত্রের মন্দতার ভয়ে সে প্রেমিককে ছেড়ে দিলো? আচ্ছা, ভিতু মেয়েটা তা প্রেম করার আগে ভাবেনি?
অর্ণব জানত, সেই কলটাই উপমার থেকে আসা শেষ কল৷ এরপর কখনো কল আসবে না। সারারাত জেগে মেয়েটা অর্ণবের স্মৃতিগুলোকে নষ্ট করবে। সব ধরনের কনভারসেশন, গিফটস.. সব নষ্ট করে দেবে ভবিতব্যের সামনে কৈফিয়ত দেওয়ার ভয়ে। এরপর ভুলে যাবে সবকিছু।
অর্ণব তবু সেই ফোন কলের অপেক্ষায় ছিল। সে মনে-প্রাণে চাইছিল, মেয়েটা আসুক। কবুল পড়ার এক সেকেন্ড আগেও যদি সে আসতে চায়, অর্ণব তাকে নিয়ে আসবে। অথচ ভাগ্যে যা ছিল, তা তো হওয়ারই….
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও থেমে গেল অর্ণব। তার ফোন ভাইব্রেট করে উঠেছে। যার কলের জন্য সে অপেক্ষমাণ, সে কল করেনি। তার কলের অপেক্ষায় যে অপেক্ষিতা, সে কল দিয়েছে। অর্ণব রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে বলে উঠল,
-“অর্ণব ভাই? আমি গাজিপুর শহরে এসেছি। একটু দেখা করুন।”
______
সাঁঝের আজ বড়ো অভিমানিনী সাজতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছের বিশেষ কোনো কারণ তার জানা নেই। গুমোট লাগছে বেশ। সেই সাথে চোখ ফেঁটে বয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য অশ্রু। বিলাসিনী সাঁঝ উদাসিনী সেজে বসে রইলো বারান্দার দোলনাটিতে। গত পরশু হৃদ এটা লাগিয়ে দিয়েছে।
সাঁঝের পরনে কামিনীফুলের মতো সাদা রঙের আটপৌরে সুতির শাড়ি। শাড়ির আঁচল মেঝে ছড়িয়ে আছে। হাঁটু লম্বা চুলগুলো ছেড়ে রাখা। শ্যামাঙ্গিনীর দুই চোখে লেপটানো কাজল, ঠোঁটের ভাঁজে মিহি হাসি। সে মেঝেতে পায়ের সংঘর্ষে দোলনাটা খানিক দুলিয়ে নিল। মাথা এলিয়ে দিলো পেছনে। আটকে গেল কারো চওড়া বুকে।
সাঁঝের চোখদুটো বন্ধ। মুচকি হেসে সে জানতে চাইলো,
-“হৃদ?”
ওপাশের গম্ভীর পুরুষটি সাড়া নিল,
-“হু, শুনছি..”
সাঁঝের হাসি প্রশস্ত হলো,
-“কখন এলে?”
-“এ-ই তো… দুই, পাঁচ.. তিন মিনিট..”
-“উঁহু, তুমি এসেছো সাতচল্লিশ মিনিট হয়েছে।”
হৃদ হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। এতটা সময় কখন কাটল? সাঁঝ ঠোঁট টিপে হাসল। হৃদ বলল,
-“এত সেজেছ যে?”
-“এমনিই! ভালো দেখাচ্ছে না?”
-“না, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।”
সাঁঝ ঘাড় ফিরিয়ে মাথা উঁচিয়ে তাকাল হৃদের দিকে,
-“আমার চোখের দিকে তাকাও।”
-“হুঁ।”
-“এখন বলো, এখনো বিষণ্ণতা?”
-“উঁহু।”
-“কেমন দেখাচ্ছে?”
-“ভয়ঙ্কর রকমের বিষণ্ণ।”
সাঁঝের হাসি সংকীর্ণ হলো। মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকাল। মাথা হেলে আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলো বৃষ্টিস্নাত আসমানের দিকে। পূনরায় মিহি হাসিতে ঠোঁট রাঙিয়ে সে বলল,
-“আমার মন ভালো আছে। তুমি ভালো আছো?”
-“আমি ভালো আছি।”
-“দেখো, ওইযে ওই স্ট্রিটলাইটের পাশ দিয়ে যাওয়া তারের ওপর একটা পাখি বসে আছে। দেখতে পাচ্ছো?”
-“পাচ্ছি।”
-“ও বিগত দেড়ঘন্টা ধরে এখানে বসে আছে।”
-“কেন?”
-“কারণ ও সঙ্গী হারিয়েছে, ও মারা যাবে। স্বেচ্ছায়, অভিলাষে..”
সাঁঝের নিষ্প্রাণ আওয়াজের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো হাসিতে সবকিছু কেমন অদ্ভুতরকমের অবসন্ন। হৃদ ভড়কে গেল। সরু চোখে তাকিয়ে শুধাল,
-“কী হয়েছে?”
-“কি-ছু-না।”
সাঁঝের ভেঙে ভেঙে বলা কথায় হৃদ আরও উতলা হয়ে উঠল,
-“কোনো সমস্যা? আমি সলভ করে দেবো সব…”
-“পারবে না তো, হৃদ। পারলে বলতাম।”
-“বলে দেখো…”
সাঁঝ বলল না সে কথা। অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলল,
-“দোলনাটা হালকা করে দোলাতে পারবে?”
-“হু।”
-“আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম আবার।”
-“তুমি কিছু নিয়ে টেনসড, আমাকে বলছো না…”
সাঁঝ আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি হাসছে। অথচ সেই হাসিতে সুখ নেই, প্রশান্তি নেই, স্বস্তি নেই। আছে একরাশ বিষ। বিষাদে আচ্ছাদিত কণ্ঠে সে বলল,
-“আচ্ছা হৃদ, একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে পায়নি বলে গোটা দুনিয়ার সব সুখ কেন ঠুকরে দেয়? প্রকৃতি তার থেকে কেবলমাত্র একটি মানুষকে নিয়েছে, বিনিময়ে দেওয়া অগাধ ভালোবাসা কেন তাদের চোখ এড়িয়ে যায়? তারা কেন মানতে চায় না, সব পেলে নষ্ট জীবন? হৃদ, সঙ্গী হারালে কেন পাখি উপোসে মরে?”
হৃদ দোলনা থামিয়ে দিল। পেছন থেকে সাঁঝের মাথার ওপর থুতনি ঠেকিয়ে নিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
-“কারণ তারা নির্দিষ্ট জিনিসকে কেন্দ্র করেই বাঁচতে চেয়েছে, বড়ো সাধ করে তাদের প্রাণ বানিয়েছে। জোড়াতে বাঁচার স্বপ্ন দেখা পাখি, বিচ্ছেদযন্ত্রণা মানতে অনিচ্ছুক। মনের ভার বিশাল, সন্ধ্যা। মন ভাঙলে নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসে।”
সাঁঝের ঠোঁট ছুঁয়ে বেরোল তাচ্ছিল্যের হাসি, অস্ফুটে সে বলল,
-“নির্বোধ!”
পরক্ষণেই আবার বলে উঠল,
-“প্রকৃতি অপূর্ণতা রাখে না। অথচ তারা অপেক্ষা না করেই অপ্রাপ্তিকে অমর করে মৃত্যুকে বেছে নেয়! ওরা নির্বোধ। ওদের প্রতি আমার এক আকাশ সমান বিতৃষ্ণা…”
সাঁঝ খামখেয়ালি এবং উদাসী মেয়ে বটে, তবে এমন ধারার কাঠিন্য তার নেই। আজ হৃদ থমকাচ্ছে, অবাক হচ্ছে। সাঁঝ বলল,
-“সরে দাঁড়াও, বৃষ্টি ভিজিয়ে দেবে।”
হৃদ সরে দাঁড়াল না। বৃষ্টিও দিক পরিবর্তন করে বারান্দার এ মুখে আছড়ে পড়ল। হৃদ মাথা তুলল। সাঁঝ পিছে ঘুরে তার চোখে চোখ রেখে বলল,
-“আমি না থাকলে তুমিও কি অমন পাখির ন্যায় অনাহারী হবে? মনের ক্ষিদে নিবারণের জন্য আমার সান্নিধ্য তো পাবে না…”
-“কী জানি!”
-“আমার মনে হয় তুমি বাঁচবে। তুমি কঠিন হৃদয়ের পুরুষ। হয়তো ভালো থাকবে না, কিন্তু বেঁচে থাকবে। দূর্বল, নির্বোধ আর ভীতুরা মরে যায়। জানো, তুমি না থাকলে আমি কী করব?”
-“কী করবে?”
-“তোমায় ভুলে যাব। বেঁচে থাকব। ভালো থাকব।”
কথাটা শেষ করে শব্দ করে হেসে উঠল সাঁঝ। অবাক হলো হৃদ, কৌতূহলী গলায় শুধাল,
-“আসলেই?”
সাঁঝ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ। আসলেই। তার কাছে ভালো থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সে ভালো থাকার জন্য সর্বোচ্চ স্বার্থপর হবে। এখানে সে নিজের কাছেও চেপে গেল একটি কথা, তার ভালো থাকার শতাংশ জুড়ে হৃদের বসতি….
ওধারে বেডসাইড টেবিলের ওপর হৃদের সাইলেন্ট করা ফোনে কল এলো। বাড়ি থেকে কল। এমন ভরদুপুর বেলা সাধারণত বাড়ি থেকে কল আসে না। যখন আসে, তখন কলের সাথে কিছু বিপদ কিংবা উদাসীপনাও চলে আসে। তবে আজ হৃদ তা টের পেল না।
সাঁঝের চোখে ডুবে আছে সে, সেই চোখটা অত্যাধিক মলিন। ঠোঁট ঘেঁষা হাসিটাও ভীষণ রকমের শ্রান্ত। যেন কেটে যাচ্ছে এক অনন্ত নক্ষত্রবীথি…
আচমকা উদয় হন্তদন্ত হয়ে দরজার কড়া নাড়ল, ডেকে উঠল অস্থির আওয়াজে,
-“ভাইয়া?”
হৃদ পিছে ফিরে তাকাল,
-“কী?”
উদয় হাঁপাচ্ছে। নিঃশ্বাসের বেগের অস্বাভাবিকতায় ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। তার স্বল্পশব্দে কেউ ঠিক ঠাহর করতে পারল না। বড়ো করে দম নিল উদয়, বলে উঠল,
-“ভাইয়া, ঊর্মি আপু সুইসাইড করেছে…”
হৃদ স্তব্ধ বনে গেল। তার কানে ভাসতে লাগল সাঁঝের কিছুক্ষণ আগে বলা কথাটা, “আচ্ছা হৃদ, একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে পায়নি বলে গোটা দুনিয়ার সব সুখ কেন ঠুকরে দেয়?”
হতবিহ্বল হৃদ উদয়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সাঁঝের দিকে তাকাল। ঘাড় ফিরিয়ে সাঁঝ এদিকটাতেই তাকিয়ে আছে। তার চাহনি অত্যন্ত শীতল। চোখ দুটো এমন নিস্তব্ধতায় ঝংকার তুলে জানাচ্ছে, এমনটা হওয়ারই ছিল…
চলবে..