#প্রেম_ও_অসুখ
|পর্ব ২৫|
– নবনীতা শেখ
-“অর্ণব ভাই? আমি গাজিপুর শহরে এসেছি। একটু দেখা করুন।”
কল রিসিভ করে অদিতির কণ্ঠে এমন বাক্য শুনে অর্ণব মোটেও বিচলিত হলো না। শান্ত হলো, স্থির গলায় একটা লোকেশন জানিয়ে কল কেটে দিলো।
গুনে গুনে তার সাতান্ন মিনিটের মাথায় মুখোমুখি হলো অর্ণব, অদিতি। অর্ণবকে বড়ো শ্রান্ত দেখাল। চাহনিতে মলিনতা প্রখরভাবে ছেয়ে। অদিতি বেশ সাহস করে অর্ণবের হাত ধরল, এগিয়ে যেতে লাগল পার্শ্ববর্তী ক্যাফেতে। অর্ণব বাঁধা দিলো না। নতমুখী রাস্তার দিকে, চেয়ে আছে অদিতির প্রতিটি পদক্ষেপে, পা ফেলছে একদম বাচ্চাদের মতো পদচিহ্ন মিলিয়ে।
তারা ক্যাফেতে বসল। অর্ণব এখনো তাকায়নি অদিতির দিকে। তাকালে হয়তো দেখতে পারত, কীভাবে এক ছুটে দৌড়ে এসেছে মেয়েটা! সবসময়ের পারিপাট্য এবড়োখেবড়ো হয়ে, চুলগুলো কোনোমতে বাঁধা, ঘর্মাক্ত মুখে ঔদাসিন্য! আর এর ভেতরে তার আকাঙ্খায় স্পন্দিত হওয়া হৃৎপিণ্ডটা… এসবের কোনোকিছুই অর্ণব দেখতে পারল না। তাকাল না অবধি।
অদিতি স্মিত হাসল, প্রথম বাক্যটা নিজ থেকেই বলে উঠল,
-“অর্ণব ভাই, জানেন?”
-“উঁহু। জানি না।”
অর্ণবের বাচ্চামো কণ্ঠ! অদিতির হাসি প্রসারিত হলো। গালে হাত ঠেকিয়ে সে তাকিয়ে রইল। আনমনে বলে যেতে লাগল কিছু অপ্রাসঙ্গিক শব্দগুচ্ছ,
-“জীবন একটা গোলকের মতো; বৃত্তাকার পথ। যেখান থেকে শুরু করা হয়, সেখানে এসেই থেমে যাওয়া লাগে। যেখানে সমাপ্তি, সেখানেই নতুন সূচনা। অর্ণব ভাই?”
-“হু?”
-“সমাপ্তি আদতে অন্ত নয়। নতুন সূচনা…বুঝতে পারছেন, কী বোঝাতে চাইছি?”
দু-ধারে মাথা নাড়ল অর্ণব, সে বুঝতে পারছে না..কিংবা বুঝতে চাইছে না। অদিতি তাকে সেটুকু বোঝার জন্য সময় দিলো। অনেকটা সময়। অ-নে-ক-গুলো সেকেন্ড! ততগুলো সময় অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইল তার এত সাধের ভঙ্গুর পুরুষটার দিকে। হ্যাঁ, সে একটু কষ্ট পেত অর্ণব অন্য কারো হলে। কিন্তু সেই কষ্টটা এখনকার তুলনায় খুবই সূক্ষ্ম ছিল। এই যে, এখন তার বড়ো আকাঙ্ক্ষিত মানুষটা নুইয়ে পড়েছে! এটা কি চেয়ে দেখা যায়? কষ্ট না?
সেই কষ্টটাই গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থেকে শুষে নিচ্ছে অদিতি। এরমাঝে অর্ণব ডেকে উঠল,
-“অদিতি?”
বোধহয় ধরনীতে এমন কোনো রমনী নেই, যে প্রিয় পুরুষের মুখে নিজস্ব নাম শুনে স্থিরতা না হারিয়েছে। অদিতি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডাকশোনা জবাবে বলল,
-“হু?”
-“যে যাকে ভালোবাসে, সে কেন তাকে পায় না?”
অদিতি কিঞ্চিৎ ভাবুক হলো,
-“ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। কেউ পায়, কেউ পায় না। ভাগ্যের ওপর ডিপেন্ড করে। যার ভাগ্যে যে আছে, তাকেই তো সে পাবে। এই সত্য আমি অনেক আগেই মেনে নিয়েছিলাম। শুধু মানতে পারিনি—মনে যাকে ধরল, ভাগ্যে কেন তার ঠাঁই হলো না..”
মেয়েটা যেই ছেলেটাকে ভালোবেসেছে, সেই ছেলেটা অন্য এক মেয়েকে ভালোবেসেছে; অহেতুক কারণবশত সেই মেয়েটা আবার অন্য এক ছেলেকে বিয়ে করেছে! চক্রাকারে আবর্তিত গল্প। মেয়েটার শোকে ছেলেটা নির্জীব হয়ে বসে আছে। সেই ছেলেকে ভালোবাসা মেয়েটা অনায়াসে ভালোবাসা না পাওয়ার গল্পটা বলে যাচ্ছে। বড়োই থ্রিলিং ব্যাপার বইকি!
অদিতির ধারণা—পুরুষ মানুষ বড়োই ছাগল প্রজাতির মানুষ হয়। তাদেরকে মুখ ফুটে বলেও তারা বোঝে না। এমনকি যদি কাগজে লিখে তা পানি দিয়ে গুলিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়, তারা তবু বুঝবে না। অদিতির সেই ধারণায় একছটাক বালি পড়ল যেন। অর্ণব তার চোখে চোখ রাখল। তার চাহনিতে নিশ্চয়তা ও গভীর অনুরাগ, সমানে সমানে যন্ত্রণা ও হার, ঠোঁটের ভাঁজেও ঠিক প্রশ্ন নয়, তবে তেমনই কিছু,
-“ভালোবাসো কেন আমায়?”
অদিতির রুহ অবধি পৌঁছাল সে ধ্বনি, সে কম্পন। ঠোঁটের কার্ণিশে এঁটে গেল হাসি। উত্তরের প্রেক্ষিতে বলে ফেলল খামখেয়ালি কিছু কথা,
-“এমনিই! ইচ্ছে হয়েছিল, তাই।”
-“পাবে না জেনেও কেন?”
-“নিষেধের ওপর আমাদের এতই আকাঙ্খা, অর্ণব ভাই। বিষের প্রতি এতটাই লোভ। ভালোবাসাও তেমন, জ্বলন্ত অঙ্গারের ভেতরে যেমন এক খণ্ড নিঝুম চন্দ্রালোক!”
অর্ণবের দীর্ঘশ্বাসগুলো প্রকট শোনাল। টেবিলের ওপর দুইহাত গুঁজে, তাতে মাথা লুকিয়ে ফেলল আনমনে। অস্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠল,
-“অদি? আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?”
অসম্ভব মলিন এই আওয়াজে এমন কথা শুনে অদিতির বুকটা কেঁপে উঠল। কম্পনরত হাতটা সে অর্ণবের মাথায় রাখল। অপরিপক্বভাবে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে অদিতির মনে হলো, তার জনম সার্থক! কেবলমাত্র এইটুকু মুহূর্ত সুখের বিনিময়ে সে অনায়াসে কবুল করে নিতে পারে আমৃত্যু দুঃখ।
_____
ঊর্মির মৃত্যুতে শকুনতলার বাতাস যেন গুমোট, আকাশটাও কাঁদছে। বাড়ির পুরুষেরা জানাজার ওখানে। উঠানের এককোনায় পাথর বনে বসে আছে মর্জিনা। থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তার আহাজারি প্রতিধ্বনিতে হচ্ছে বাড়ির সবটায়। তাকে ঘিরে বসে আছে বাকি মহিলারা।
সাঁঝ তাকিয়ে থেকে দেখল কেবল। মৃত্যু কী অদ্ভুত জিনিস! কেউ কিছু পায়, কেউ হারায়। কেউ বেঁচে থাকার কারণ হিসেবে ভীষণ সুখ পেয়ে যায়, আর কাউকে তো মরতেই হয়। এই যেমন ঊর্মি যদি তার হৃদকে পেয়ে যেত, তবে সাঁঝের কী হতো? অসুখে জর্জরিত এমন সুখ না পাওয়ার দুঃখে তখন সাঁঝের বুকেতেই বোধহয় মৃত্যুর বসতি হতো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাঁঝ। তার কান্নাকাটি ভালো লাগে না। যে নেই, তাকে ভেবে কান্নাকাটি অহেতুক। এমন অহেতুক কাজ তার ঠিক পছন্দ নয়। সে উঠে চলে গেল দোতলায়, সোজা হৃদের রুমে।
সব কাজ শেষে হৃদ রাতে রুমে ফিরল। সাঁঝ তখন বারান্দায় বসে সন্ধ্যের আকাশ দেখছিল। হৃদ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে এলো। সাঁঝ টের পেল তার উপস্থিতি, তবে তাকাল না। দৃষ্টি সম্মুখে স্থির রেখেই শুধাল,
-“কিছু বলবে?”
হৃদ কিছু বলল না। সাঁঝের হাতটা ধরে তাকে বিছানায় নিয়ে গেল,
-“বসো!”
সাঁঝ কথা শুনে বসল। হৃদ আরাম করে সাঁঝের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বলল,
-“মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমি ঘুমাই। হু?”
সাঁঝ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“ঊর্মি আপু তোমাকে ভালোবাসত, হৃদ। তুমি জানতে?”
হৃদের ঘুম জড়ানো আওয়াজটা শোনা গেল কিছু সময় পর,
-“জানতাম।”
-“কবে থেকে?”
-“শুরু থেকেই।”
-“তার ভালোবাসায় কোনো খামতি ছিল না। তারপরও কেন আমাকে চ্যুজ করলে?”
-“চ্যুজ করার প্রসঙ্গই আসে না। আমার লাইফে কখনো আমি সেকেন্ড কোনো অপশন রাখিনি।”
-“তাকে পেলে তুমি বোধহয় ভালো থাকতে, হৃদ।”
-“তোমার সাথে ভালো আছি।”
-“সে ম্যাচিউর ছিল।”
-“আমিও ম্যাচিউর। বৈপরীত্যে আমার মানুষটার বাচ্চামোই মানানসই।”
সাঁঝ আরও কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হৃদ নড়েচড়ে উঠল, অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-“ঘুমোতে দিন, সন্ধ্যা। গতরাতে যেই মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে, তার মৃত্যুর একমাত্র কারণ আমি। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। দেখি…”
হৃদ সাঁঝকে শুইয়ে দিয়ে, তার গলায় মুখ গুঁজে নিয়ে বলল,
-“ঘুমাও তুমিও। গতরাতে ঘুমাতে দেইনি একটুও।”
চলবে..