প্রেম ও অসুখ পর্ব-২৬

0
21

#প্রেম_ও_অসুখ
|পর্ব ২৬|
– নবনীতা শেখ

সময়ের কাটা ঘুরে পেরোল বছর দুই। ডাক্তার অনয় আহমেদের বদলি হলো ময়মনসিংহ মেডিকেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে সাঞ্জিনা আফরিন তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করল। উদয় আহমেদ রোদ বুয়েট ক্যাম্পাসে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। অদিতি কোনো আশা-ভরসা ছাড়াই নিয়মমাফিক অর্ণবের খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। অর্ণবও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আগের তুলনায়, তবে গাম্ভীর্যও বেড়েছে সমপরিমাণে। আর বাকি রইল পূর্বিকা? একাডেমিক লাইফ শেষে এখানেই কর্পোরেট ফিল্ডে জব করছে।

ছোট থেকেই আমরা জেনে এসেছি, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। পৃথিবী যদি উলটেও যায়, এক ঘন্টা পর ষাট মিনিট পেরোবেই। ঘটনার প্রবাহ যেদিকে যাওয়ার, তা যাবেই। যারা মেনে নিতে পারে না, আটকে থাকে অতীতে… তারাই মূলত হিমশিম খায় বর্তমানে গা ভাসাতে।

পূর্বিকা ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। আর তাই তো গত পরশু গ্রামে যাওয়ার পর মা যখন তাকে বলল—আজ দেখতে আসবে… সে অনায়াসে মেনে নিয়েছিল। তাকে দেখে আংটি পরিয়ে রেখে গেল।

সেই সোনার আংটিটাই জ্বলজ্বল করছে পূর্বিকার অনামিকা আঙ্গুলে। সেদিকে তাকিয়ে ক্রমাগত ফুঁসছে উদয়। রাগে দিশা হারাচ্ছে। দুইদিন চোখের আড়ালে গেল কি গেল না, মেয়েটা তো বিয়েই করতে বসে গেছে! কী সাহস!

পূর্বিকা বলল,
-“রুমে যাব।”

উদয়ের ত্যাড়ামি মাখানো জবাব,
-“ধরে রেখেছি আপনাকে?”

পূর্বিকা শ্বাস ফেলল। ছাদের এককোণায় একদম দেয়াল ছুঁইছুঁই হয়ে দাঁড়ানো সে। সামনে ছেলেটা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কোণা দিয়েই বেরোনোর জো নেই। আবার বলে কি না, ধরে রেখেছি? দিন দিন ছেলেটা বেয়াদব হচ্ছে। অত্যন্ত বেয়ারা ধরনের বেয়াদব।

পূর্বিকা মনে মনে কত কী যে বলে যায়, সামনাসামনি বলার অবকাশ পায় না। এমনই গভীর ভাবনায় মত্ত পূর্বিকা আচমকা কেঁপে উঠল। উদয় বলল,
-“পূর্বিকা? আপনি কি বোঝেন না? নাকি আবেগ নিয়ে খেলতে আপনার মজা লাগে?”

বোঝে না? বুঝবে না? একটা ছেলের চোখের দিকে তাকালে পুরো মনটা পড়ে নেওয়া যায়, আর এদিকে তো জনাব উঠতে বসতে নিজের সকল কাজে তা প্রকাশ করে যাচ্ছে। পূর্বিকা কিছুটা সময় নিয়ে হাসল,
-“যেহেতু বুঝেও অবুঝ সাজছি, তাই তোমার উচিত আমাকে কো-অপারেট করা। হু? রাস্তা ছাড়ো।”

উদয় রাস্তা ছাড়ে না। মাঝের দুইহাতের দূরত্বটাকে দেড়হাতে কমিয়ে এনে মুখোমুখি দাঁড়াল, চোখে চোখ রেখে বলল,
-“অবুঝ কেন সাজছেন?”
-“কারণ তুমি আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট।”
-“তো? এছাড়া আর কিছু?”

পূর্বিকা চোখ সরালো না এবার, দৃঢ় চাহনিতে তাকিয়ে বলল,
-“রাফির সাথে আমার ব্রেকআপ কেন হয়েছিল, জানো? কারণ আমি সংসার চেয়েছিলাম আর ও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সংসারটা তুমিও আমাকে এখন দিতে পারবে না। তোমার তো ওর চেয়েও অনেক বেশি টাইম লেগে যাবে। চার, পাঁচ বছর! আমি বুড়ি হয়ে যাব ততদিনে। আমাকে আর তখন তোমার পছন্দও হবে না। এখন যতই আমার পিছে পিছে ঘুরো না কেন উদয়, পেয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে…”

পূর্বিকাকে কথা শেষ করতে দিলো না উদয়, মাঝপথে বলে বসল,
-“আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
-“হ্যাঁ, তোমার প্রতিষ্ঠিত হতে হতে আমার বয়স আটকে থাকবে না।”
-“আগামীকাল।”

কিছুটা চমকে উঠল পূর্বিকা,
-“কী?”

উদয় পূর্বিকার চোখের সামনে এসে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো ডান হাতের তর্জনী দ্বারা কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে সুস্থির গলায় বলল,
-“বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে, পূর্বিকা। আগামীকালই। তৈরি থাকুন মিসেস উদয় আহমেদ হতে।”

_____
অভিমানী সাঁঝ আজ এক ছটাকও ঘুমোয়নি। তার এই প্রায় তিন বছরের সংসার জীবনে একটা পাকাপোক্ত সংসার এখনো তার হয়নি। ডাক্তারটা খালি পালিয়ে পালিয়ে বাঁচে! আচ্ছা, তার মতো বিলাসিনীকে এমন উদাসিনীবেশে দেখতে কি লোকটার ভালো লাগে? লাগে নিশ্চয়ই? নাহলে কেন এমন ব্যস্ততার বাহানায় বুক জ্বালানো অসুখ দেয়। প্রেমাসুখে সুখ কেন নেই?

হৃদের সাথে তার শেষ দেখা হয়েছে তিনটা মাস আগে। সেমিস্টার ব্রেকে সে ময়মনসিংহ গিয়ে পনেরো দিন থেকে এসেছিল। সেই দিনগুলো, সেই সময়গুলো, সাঁঝের একান্ত সংসার, হসপিটাল থেকে ফেরা জার্বেরা, মধ্যরাতের উষ্ণ আদর, ভোরের ঘুম ঘুম চুমু, কাছে আসার বাহানা, দূরে যাওয়া লজ্জা, ভাতের প্লেটের ভাগাভাগি আর অনেকটা গিন্নিপনা! এসব থেকে ফিরে এসে কি কিছু ভাল্লাগে? মন শান্ত থাকে? খালি খালি লাগে না?

উদ্দীপ্ত সাঁঝ মধ্যরাতে উঠে শাড়ি পরল। সে আর অদিতি এখন হৃদের ফ্ল্যাটে থাকে, হৃদ থাকে ময়মনসিংহে, উদয় ইউনিভার্সিটি হলে। তার আগের ফ্ল্যাটে পূর্বিকা থাকে, আর পাশের রুমে উঠেছে তাদের আরেক বন্ধু আয়াত আর রাঈন। মোটামুটি দুটো ফ্ল্যাটে মিলেঝুলে বেশ জম্পেশ আড্ডায় তারা দেড়টে বছর কাটিয়েছে।

অদিতিও জাগ্রত ছিল। অর্ণবের ভাঙন তাকে এক নিমিষেই বড়ো ও দায়িত্বশীল বানিয়ে তুলেছে। বুকেতে ঝড় লণ্ডভণ্ড, অথচ ঠোঁটে কোণে এক চিমটে হাসিও এনে দিয়েছে। চোখে চোখ রেখে সে দুঃখ লুকোতে শিখেছে, মিথ্যে বলতে জেনেছে অকম্পিত শব্দে। এত এত নাটকীয়তা, জীবন নিজেই হাতে কলমে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে।

ড্রয়িং রুমে পানি খেতে এসে নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ শুনে অদিতি সাঁঝের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বারান্দায় এক ছায়ামূর্তি! সূর্যোদয় হচ্ছে.. এমন এক মুহূর্তে বারান্দায় লাগানো দোলনাটিতে বসে আছে এক নারী অবয়ব। পায়ের সাথে মেঝের সংঘর্ষে সে দুলছে, থামছে, হাসছে। চুলগুলো খুলে রেখেছে। আটপৌরে আঁচল, মেঝেতে ছড়িয়ে। হাতে পরা কাঁচের চুড়িগুলো দিয়ে যতবার সে চুল ঠিক করছে, ততবারই এক অদ্ভুত ঝঙ্কার মিলেমিশে একাকার হচ্ছে সময়ের সাথে, শূন্যের সাথে, স্রোতের সাথে, সংহারের সাথে..

অদিতি ভেতরে প্রবেশ করল। বারান্দার দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-“তুই ঘুমাস না কয় রাত, সাঞ্জি?”

সাঁঝ বন্ধরত চোখ খানিকটা খুলল। মিহি হেসে বলল,
-“আমি তো দিনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নিই। তুই কেন বৈরাগী?”

সাঁঝ পাশে সড়ে খানিকটা জায়গা করে দিলো। অদিতি সেখানে বসে সাঁঝের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
-“ঘুম পায় না।”

সাঁঝ একহাতে ওর মাথার চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“অদি, একটা সত্য বলবি?”
-“হু?”
-“ভালো তো আমিও বেসেছি, তবু তোর ভালোবাসায় এমন কি আছে—যা দেখে আমার ভালোবাসায় এত খামতি লাগছে?”

অদিতি প্রথমত বিস্মিত হলো, পর পর হেসে ফেলল,
-“কী যে বলিস!”
-“উহু!”

সাঁঝ থামল, ঠোঁট উলটে নিয়ে বলতে লাগল,
-“আমি কেন ডাক্তারটাকে এমন ভালো বাসতে পারছি না… যে ভালোবাসায় মরন আছে, যে ভালোবাসায় দম আটকে দেওয়া সুখ আছে, যে ভালোবাসায় বুকের মধ্যে চিনচিনে জ্বালা আছে! যে ভালোবাসায় চোখে আগুন, শব্দে প্রাণহীনতা ও চলনে প্রহেলিকা আছে? এমন বৈরাগ প্রেম আমার কেন আসে না? কী খামতি আছে আমার? আমি উত্তর খুঁজে পাই না, হিমসিম খাই। তোকে হিংসে করে ফেলি খানিকটা। তুই না চাইতেও কাউকে এমন ভালোবাসতে পারলি, যে ভালোবাসা আমি এত চাওয়ার পরও বাসতে পারছি না।”

অদিতি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল, এক চিলতে হাসিও বেরোল উপহাসের,
-“তুই না চাইতেও সেই ভালোবাসা পেয়ে গেলি, যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি মরছি; প্রতিনিয়ত!”

সাঁঝ অদিতির মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলে যেতে লাগল আস্তে আস্তে করে কিছু শব্দ, কিছু গল্প। ওর আওয়াজটা একটু সরু ধরনের, চুড়ি-নূপুরের রিনিঝিনি শব্দের সাথে দিব্যি মানিয়ে যায় এমন,
-“অদি, আমার সবচেয়ে ভালো সই, আজ তোকে একটা কথা বলি, হু? শোন! বাংলায় একটা প্রবাদ আছে… রবী ঠাকুরের—
‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ওপারে।’
বুঝলি কিছু? এটাই মূলত জীবন। জীবনই মূলত এটা। এইটুকু যদি বুঝে যাস, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব আর কষতে হবে না। অদি, শুনছিস? অদি? রুবাইয়্যাত অদিতি? ঘুম?”

অদি ঘুমিয়ে গেছে। সাঁঝ নিজের পায়ের ছন্দ মেঝেতে ছড়িয়ে দোলনার দোলন কমিয়ে আনল, তবে থামাল না। বিড়বিড় করে বলে গেল আবারও নিজস্ব শব্দ,
-“আমরা মানুষ যা চাই, তা পাই না। আমরা তাই পাই, যার জন্য অতিক্রম করতে পারি সকল পরিহদ্দ। আমি জানি, তুই পারবি। কিন্তু আমি পারব না। আমারটা তো একতরফা দাবির আগেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়ে গেছে।”

শেষ কথা বলতে গিয়ে সাঁঝ মুচকি হাসল, ভান করল এমন যেন খুব দুঃখ পেয়েছে। অথচ যন্ত্রণার ছিটেফোঁটাও তো ছিল না।

ঘন্টা খানেকের ঘুমের পর অদিতি দেখতে পেল সে সাঁঝের কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। সাঁঝ বসে বসে ফোন চাপছে। বহু সময় পর এমন অল্প একটু ঘুমে অদিতির ভেতরটা ভালোই উচ্ছ্বসিত হলো। সে দ্রুত উঠে পড়ল। দৌড়ে চলে গেল নিজের রুমে। এই ঘুমটাকে এভাবেই যেতে দেওয়া যায় না। সুযোগ পেয়েছে, তো আরও কিছুটা হয়ে যাক। রেশ কাটার আগেই আরেক দফা ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

অদিতির উঠে-পড়ে লাগানো দৌড়ে সাঁঝ ওর পিছে তাকিয়ে হাসল। হৃদ কল দিলো ঠিক তখনই। এতক্ষণে লোকটার সময় হলো তবে?

সাঁঝ কল রিসিভ করে কোনোরূপ সম্ভাষণ ছাড়াই বলে উঠল,
-“ডাক্তার সাহেব, তুমি এ মুহূর্তে ঢাকা আসবে। আসবে মানে আসবে। আমি বিগত বাহাত্তর ঘন্টা ধরে এক সেকেন্ডের জন্যও ঘুমোতে পারিনি। তুমি এলে আমি ঘুমাব। আসবে না? ’না’ বললে তোমার খবর আছে। তুমি…”

সাঁঝের কথার মাঝখানে হৃদের ক্লান্তস্বর ভেসে এলো,
-“এসেছি, দরজা খোলো।”

তৎক্ষণাৎ, এক মিলিসেকেন্ডেরও দেরি নয় এমনভাবে সাঁঝের হৃৎস্পন্দন অনিয়ন্ত্রিত গতিতে ছুটে চলল। সে নিজেও ছুটল একই গতিতে৷ দরজা খুলতে গিয়েও খুলছে না। সাঁঝের হাত কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে, গায়ের শক্তি হারাচ্ছে। দরজার ওপাশে সেই প্রাপ্তি তার, যার জন্য জমানো এতটা অনুভূতি! সম্মুখে এলেই সাঁঝ প্রাণ খোয়াবে নিশ্চিত, ঢলে পড়বে প্রশস্ত বুকটায়!

দরজা খুলল অবশেষে। সাঁঝ যা ভেবেছিল তাই। সে জ্ঞান হারাবে। তার গায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু নেই। সে সত্যিই ঢলে পড়বে তার প্রীতমের বুকে।

হৃদ সেটুকুর অপেক্ষায় থাকল না। আদুরে বউটাকে বুকে জড়িয়ে নিল, কাঁধে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“আজ নাইট ডিউটি ছিল। হসপিটাল থেকে বের হয়েই ছুটে চলে এলাম। তোমাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পেলে মরে যেতাম, আই সয়্যার। তোমার গায়ের এই তুমি তুমি স্মেলটা আমার কত প্রিয়!”

হৃদ বুক ভরে শ্বাস টানল। সাঁঝ নিজের ভর ছেড়ে দিয়েছে। হাসি ঠোঁটে আঁটছে না। গাল ব্যথা করছে। এমন হাসির সাথে সে ছোট্ট করে বলল,
-“আমি জানি, আমি জানি।”

চলবে…