পর্ব- ২, ৩ ও ৪
পুরো দুটো বছর দিশার সাথে প্রেম ছিল আমার। একসাথে লাইব্রেরিতে পড়া করতাম। ক্লাস শেষে আমাকে টিউশন পড়াতে যেতে হতো, অল্প সময় পেতাম একটু দেখা করার, দুটো কথা বলার। সমস্ত ব্যস্ততার ভেতর থেকে ওই সময়টুকু যেন আমরা চুরি করতাম আর প্রচন্ড উপভোগ করতাম। একটা মূহুর্তও যেন ছুটে যেতে দিতাম না!
কলেজে চাউর ছিল, আমি আর দিশা নাকি আলো-ছায়া। একটাকে ছাড়া অন্যটাকে ভাবাই যায় না!
কিন্তু শেষ দিকে এসে আমার কী যে হলো, দিশাকে আর ভালো লাগছিল না। লম্বাটে একটা মেয়ে, সালোয়ারের উপর সাধারণ ফতুয়া বা একটু কম ঝুলের কামিজ চড়িয়ে, ওড়ানাটা সামনের দিকে কলার কাঁদির মতো দুইপাশে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটাকে আর আকর্ষণীয় মনে হতো না। কেউ ডাকলেই দুম করে টাউন সার্ভিসে চড়ে বসে পরোপকার করতে ছুটত, রাত কিংবা দিন তার হিসেব থাকত না।
আমার তখন একটু মেয়েলিটাইপ মেয়ে ভালো লাগতে শুরু করল। বেশ, সাথীর মতো মেয়ে ভালো লাগত। সাথীকে ভালো লাগত। গালে লাল আভা, হাসলে ঠোঁটের নাচনে চোখও হাসে। চুলগুলোকে একটু ফুলিয়ে বেঁধে, কয়েকগাছি দিয়ে আবার কপাল ঢাকা। কানে দুলের ঝিকিমিকি আর বুকে পাতলা ওড়নার লুকোচুরি!
দ্বিতীয় দফা প্রেমে পড়েই আমি দিশাকে হটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
প্রতিদিন বাড়ি থেকেই ক্লাস করতে শুরু করলাম আর ক্লাস শেষে বাড়িতেই ফিরে আসতাম। সাথীর সাথে তখন চুটিয়ে প্রেম আমার। এক দিন না দেখলে ভালো লাগে না, তেমন রকম প্রেম!
দিশার সাথে দেখা হতো না৷ ফোনেও আমাকে পাওয়া যেত না।
কোনো দিন ক্লাস শেষে দিশা টেনে ধরলেও আমার দিক থেকে সাড়া পেত না।
কষ্ট পাচ্ছিল দিশা, মেসেজে প্রায়ই কাঁদছে লিখে পাঠাত। আমার কোনো ভাবান্তর হতো না। আরও বেশি করে বিরক্ত হচ্ছিলাম। ও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ওকে আর চাইছি না আমি। ওর সাথে মিলে দেখা স্বপ্নগুলো অন্য কারো চোখের কাজল হয়ে গেছে!
অনেক রকম করে যখন আর এড়াতে পারলাম না, নাটার ফলের মতো আমার সাথে আটকেই রইল ও। তখন আমি ছল করেছিলাম।
সাথী ছিল পাশের গ্রামের মেয়ে। ওর কথা কলেজে জানাজানি হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই সেটা খোলাসা করলাম না।
আমি মায়ের বরাত দিয়ে দিশাকে বলেছিলাম,
—- ‘মা তোমাকে পছন্দ করছে না, দিশা! তুমি নাকি ছেলেদের মতো। এমন মেয়েকে তিনি ছেলের বউ করবেন না!’
ভীষণ শক্ত ব্যক্তিত্ব ছিল মেয়েটার। সেদিন খেই হারাল। ছলছল চোখে বলেছিল,
—- ‘আমি কথা বলি আন্টির সাথে। দেখা করি?’
আমি গলে গেলাম না ওই চোখের পানি দেখে। বলেছিলাম,
—- ‘মা সুন্দরী বউ চায়! মেয়ে দেখে ফেলেছে!’
— ‘তুই বিয়ে করবি? অন্য কাউকে?’
দিশার গলা রুদ্ধ হয়েছিল,
— ‘মা কসম দিয়েছে আমাকে। অন্যথা হলে তার মরা মুখ দেখব!’
দিশা আমার পথ থেকে সরে গিয়েছিল!
কী আর করতাম আমি! সরাসরি যদি বলতাম, তোমাকে আর ভালো লাগছে না দিশা, লোকে কী বলত আমায়? কলেজে আর থাকতে পারতাম? যে প্রভাব ছিল দিশার তখন! বাঘা ছাত্রনেতারাও ওর কথায় উঠত বসত! পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে! আমি বাধ্য হয়েছিলাম ওর সাথে প্রেমের নাটক করতে।
৩
— ‘তুই চাকরি করিস এক জায়গায়, বউ গ্রামে কেন থাকত? সাথে রাখিসনি কেন?’
মনে মনে নিজের কপাল আর একইসাথে বিবেচনাবোধকে ধিক্কার দিলাম। বললাম,
—- ‘সাথীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। ওর বাবা বেঁচে নেই। মা আর একটা ছোটো বোন। সংসারের আয় বলতে একটা মুদী দোকান। গ্রামের মুদী দোকান থেকে আয় খুবই সামান্য। সেটার সাথে আমি আর কিছু মিলিয়ে দিলে সবার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হয়ে যায়। সাথীকে নিয়ে গেলে তো ওর বাড়িতে আলাদা করে কিছু দেওয়া সম্ভব হতো না। ওর মা, বোনের জন্যই ওকে এখানে রেখেছিলাম!’
—- ‘এটা ভালো কাজ হয়নি। তোর বউ, তোর কাছে থাকা তার অধিকার ছিল। তোর শাশুড়ি কী বলছেন এখন?’
— ‘কী আর বলবেন উনি! আমাকে, আমার ছেলেকে খুব ভালোবাসেন উনি। তাছাড়া, সাথীর বদনাম হয়ে গেলে তার ছোটো মেয়েটাকেও তো বিয়ে দিতে পারবেন না!’
—- ‘সাথীর সাথে ফোনে কন্টাক্ট করতে পারছিস যখন, তখন বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত আন। আর তার আগে ভেবে দেখ, ওর সাথে আর সংসার করবি কি না! আবার বাচ্চাও আছে তোদের। সব দিক ভেবেই কথা বলিস!’
—- ‘থ্যাঙ্কিউ দিশা! তোমার সাথে কথা বলে শক্তি পাচ্ছি। কল দিলে বিরক্ত হবে না তো?’
— ‘না, বিরক্ত হব কেন? আমি নিজেও আপডেট জানতে ফোন করব, কেমন?’
৪
এত স্ট্রেস যাচ্ছে দুটো দিন ধরে, এতটা সামলানোর ক্ষমতা আমার ছিল সেটা এখন বুঝতে পারছি। এমনিতে আমার কাছের মানুষেরা আমাকে রগচটা আর অধীর হিসেবেই চেনে। সবাইকে ডেকে ডেকে এনে আজ দেখাতে ইচ্ছে করছে, ‘দেখো, আমার কত ধৈর্য। কত ঠান্ডা মাথা আমার!’
কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারি না। একা একা গুমরে মরছি।
বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যাওয়াটা একটা পুরুষের জন্য সবচেয়ে বড়ো অক্ষমতার সাক্ষী।
লোকে লোকে ডেকে তো আর আমি বলতে পারি না, আমি অক্ষম। এরচেয়ে কষ্টদায়ক গালি পুরুষের জন্য আর নেই। কাউকে বলতে পারি না, কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমি।
আমি তাই দিশার ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। হুট করে কল করেছিল বলে, দুর্বল সময়ে ওকেই সবটা বলে ফেলেছি। এখন বাকিটাও ওকেই বলা যায়। নিজেকে উজার করে বলার জন্য ওই একটা মানুষকে এখন আমার চাইই!
আমি ফোন করলাম দিশাকে।
ভীষণ ব্যস্ত মনে হয় ও। আগেও সবসময়ই ও ব্যস্তই ছিল। কোথায় বন্যা হচ্ছে-ত্রাণের চাঁদা তুলতে হবে, কোথায় রক্তদান শিবির হবে, লাইব্রেরিতে বই আনতে হবে, কে পরীক্ষা দিতে পারছে না-তার সমস্যার সমাধান করতে হবে, লিংক বের করে কাউকে চাকরি পাইয়ে দিতে হবে, যৌতুক বিরোধী আন্দোলন করতে হবে, গ্রুপ করে ব্যাচমেটদের নিয়ে দুর্নীতি বিরোধী শপথ নিতে হবে, বাল্যবিবাহ শুনলে ইউএনও পর্যায়ে গিয়ে সেই বিয়ে বন্ধ করতে হবে, কোথাও এক্সিডেন্ট শুনলে জানা নেই চেনা নেই সেখানে গিয়ে সাহায্য করতে লাফিয়ে পড়তে হবে, আর পথশিশুদের পড়ানোর স্কুল তো আছেই। মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, ওর দিন মোটেও চব্বিশ ঘন্টায় নয়, আটচল্লিশ ঘন্টা না পেলে এত কাজ করা একদম সম্ভব নয়।
এখনো নিশ্চয়ই সেই স্বভাব চলে যায়নি। সংসার করে সমাজসেবা করার সময় কি পায় ও? ওর হাজবেন্ড এলাও করে? বিয়ে কি করেছে? নাকি আমাকে ভেবে…
ভাবতে খুব ভালো লাগছে। নইলে এত দিন পরে কেন আমাকে ফোন করবে? আমাকে ভাবে বলেই তো!
আমি সরাসরি বললাম,
—- ‘তোমার ফোন এক্সপেক্ট করেছিলাম। খুব ব্যস্ত?’
—- ‘একটু ব্যস্তই আসলে। অফিস ডে তো!’
— ‘তুমি চাকরি করো?’
— ‘ঠিক চাকরি নয়…!’
—- ‘তবে বরের অফিসের জন্য গুছিয়ে দিতে হয়? এইজন্য ব্যস্ত ছিলে? বেশ সংসারী হয়েছ তো তুমি!’
—- ‘কাল বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত করে ফেলেছিলাম। দশটার দিকে ভেবেছিলাম একবার কল দেবো। কিন্তু অতরাতে ফোন করাটা ঠিক মনে হয়নি!’
— ‘আমার সাথেও ফরমালিটি তোমার?’’
অভিমানী হলাম আমি।
জোরে জোরে হাসার অভ্যাস দিশার৷ এখনো হাহা করে হাসল। আমি কান পেতে সেই হাসির শব্দ শুনলাম। একদিন সত্যিই ভালোবেসেছিলাম আমি ওকে। তারপর যে কী হলো আমার!
— ‘’ওসব বাদ দে। তোর বউয়ের খবর পেয়েছিস?’
চলবে…
আফসানা আশা