#প্রেমপ্রতারণা – ৫ ও ৬ ( শেষ পর্ব)
৫
দিশা জানতে চাইল,
— ‘ওসব বাদ দে? তোর বউয়ের খবর কী? কথা হয়েছে? কী বলেছে?’
—- ‘ও একেকবার একেক কথা বলছে, আমি বুঝতে পারছি না সেসব!’
—- ‘কীরকম?’
—- ‘একবার মনে হচ্ছে, এত ভালো বউ আমার, পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই। আরেকবার বলছে, মরে গেলেও সে আমার কাছে আর ফিরে আসবে না!’
—- ‘আছে কোথায় এখন?’
—- ‘ঢাকা।’
—- ‘ঢাকা কোথায়? কার সাথে?’
—- ‘কোনো ছেলের সাথে না। কোনো একটা হোস্টেলে মনে হলো। সাথে আরো মেয়েরা আছে।’
—- ‘আর তোর ছেলে? সে কার কাছে?’
—- ‘ছেলেকে নাকি আমাকে দিয়ে দেবে!’
—- ‘আর ও?’
—- ‘ও ওখানে চাকরি করবে! একবার বলল ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে, আবার বলল ছেলেকে নিয়েই চাকরি করবে! আমি আসলে বুঝতে পারছি না। এত চেষ্টা করছি, এত বোঝাচ্ছি, একবার গাড়িতে উঠে বসুক! আমি নিশ্চিন্ত!’
—- ‘এ তো বিরাট ঝামেলা! ও কি তোকে ভয় পাচ্ছে?’
—- ‘পেতে পারে। আমার রাগ তো জানোই!’
—- ‘হুম। একটা কথা বলি?’
—- ‘বলো।’
—- ‘তুই কি সব ভুলে ওর সাথে আবার সংসার করতে পারবি? সম্মান দিতে পারবি? ভালোবাসতে পারবি?’
—- ‘পারতে তো হবেই। আমি আবার বউ পেতে পারব, ও বিয়ে করলে স্বামী পাবে, কিন্তু আমার ছেলেটা তো বাবা হারাবে নইলে মা হারাবে।’
—- ‘সেটাও একটা ফ্যাক্ট! কিন্তু সবার আগে এটা ভেবে দেখ, তুই সাথীকে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনতে চাইছিস কেন? যে প্রতারণা করল, তার সাথে একসাথে থাকতে চাইছিস কেন? সেটা কি সোসাইটিকে ফেস করতে পারবি না বলে, নাকি সত্যি সত্যিই এটাকে একটা ভুল ভেবে ভুলে যেতে পারবি? যদি সত্যিই ভুলে যেতে পারিস, তবে ওকে এশিউর কর। তুই যে ওর সাথে ক্ষিপ্ততা দেখাবি না, সেটা এশিউর কর!’
— ‘আমার শাশুড়ি বলছিলেন, ওই ছেলেটা ওকে তাবিজ করেছে। এই তাবিজের এমন জ্বালা, ও যদি না বেরোতো সেদিন তবে ও মরে যেত। এখন যতদিন তাবিজের আছর থাকবে, ও বাড়ি আসবে না!’
আমি জানি দিশা ফোনের ওই প্রান্তে হাসছে। হাসুক। সাথীর মা বলেছিল বটে তবে হাইপোথিসিসটা আমি নিজে দাঁড় করিয়েছি নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য। প্রাক্তনের চোখে এতটা অক্ষম পুরুষ প্রমাণিত হতে আমার আর ভালো লাগছে না।
পরের দিন আবার ফোন করলাম দিশাকে
—- ‘সাথী ফিরে আসবে বলেছে।’
—- ‘বাহ, সুসংবাদ!’
— ‘কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই ওর। আমার সাথেই ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়েছিল।’
— ‘এটাও ভালো কথা! গাড়িতে উঠেছে? রওনা করেছে?’
—- ‘না। কী চাকরি নিয়েছে, সেখান থেকে এক মাসের আগে নাকি বেরোতে পারবে না!’
— ‘কী চাকরি? আর বেরোতে পারবে না কেন? আর চাকরি করলে ছেলেকে কার কাছে রেখেছে?’
—- ‘অনলাইনে চাকরি নাকি। কী কোড বসাবে আর টাকা পাবে।’
—- ‘ওহ, আচ্ছা!’
—- ‘আমাকে শর্ত দিয়েছে।’
—- ‘কী শর্ত?’
—- ‘স্টাম্পে লিখে দিতে হবে, ওর সাথে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার করব না। ঝগড়া করব না। আর চুক্তিতে স্বাক্ষী থাকবে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আর মেম্বার, আমার অফিসের বস। সেই কাগজটা আবার নোটারি করাতে হবে। তারপর সেই কাগজটা নিয়ে গেলেই আমার সাথে ফিরে আসবে ও।’
—- ‘বাহ, সবই তো ভালো সংবাদ।’
—- ‘সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ও আমাকে চিট করে নাই! কী লজ্জাটাই পাইতেছিলাম বলো!’
— ‘হুম।’
— ‘আমি চুক্তিপত্র তৈরি করেই ঢাকায় আসছি।’
— ‘অল দ্য বেস্ট!’
—- ‘দিশা, একটা কথা বলি…!’
— ‘বল?’
— ‘সাথী যে ভোগান্তিটা দিলো, আমি মনে হয় ওকে আর মন থেকে ভালোবাসতে পারব না!’
—- ‘তবে তো ওকে ফিরিয়ে আনা উচিত হবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দে।’
— ‘তোমার সাথে কথা বললে মনে কেমন যেন শান্তি পাই। মাঝে মাঝে একটু কথা বইলো আমার সাথে। যখন খুব অস্থির লাগবে, আর সহ্য করতে পারব না, তোমাকে ফোন দেবো। একটু কথা বইলো আমার সাথে! এই যে কয়েকটা দিন যে ঝড় গেল মাথার উপর দিয়ে, তোমার দুটো কথাতেই যেন আমি এখনো বেঁচে আছি মনে হচ্ছে। প্লিজ!’
দিশা নিশ্চুপ। আমি জানি, আমার অনুরোধ পায়ে ঠেলতে পারবে না ও। আমাকে ভালোবাসত ও, সেই ভালোবাসা তো ধুয়ে মুছে যায়নি। হয়তো এখনো ভালোবাসে আমাকে।
আমি আবার বললাম,
—- ‘সামনের সপ্তাহে ঢাকা আসছি। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখা করি? যেকোনো জায়গায়, তুমি যেখানে বলবে, প্লিজ!’
৬
ঢাকায় নেমেই স্যালনে গিয়েছিলাম। জেলশেভ করেছি। একটা হেড-নেক-শোল্ডার-শোল্ডার মাসাজও নিয়েছি। শরীরটা চনমনে হয়ে গেছে। মনও ফুরফুরে।
সাথীকে আনতে যাব। তিন দিন আগেই ও ঠিকানা দিয়েছে। তবে প্রথমে যাব দিশার বাসায়। দেখা করার আগ্রহ আমিই দেখিয়েছিলাম কিন্তু বাসায় যাওয়ার প্রস্তাবটা দিশারই। একদম বাসায় দেখা করতে বলায় আমি শুরুতে অবাকই হয়েছিলাম। ওর হাজবেন্ড কিছু বলবে না?
একটা ফুলের বুকে নিয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ আমি হাজির হয়ে গেলাম দিশার ফ্ল্যাটে। আবাসিক এলাকায় ছিমছাম বাসা। খুব বেশি বড়োলোকি ব্যাপার স্যাপার নেই। থাকলেই বরং অবাক হতাম। যে এমন পুরুষালী আচরণ দিশার তাতে খুব হোমড়া চোমড়া কারো সাথে বিয়ে হওয়াটাই অস্বাভাবিক!
যাকগে, আমার রিজেকশনের পরে দিশা কতটুকু সুখী হয়েছে, সেটা দেখাই আমার উদ্দেশ্য। তবে বিশেষ কিছু বোঝা গেল না, সেই একইরকম আছে ও। সেই সাধারণ প্যান্ট আর শর্ট কামিজ। ওড়নাটাও ছুটে গেছে, সেখানে জ্যাকেট জায়গা করে নিয়েছে। চশমার ফ্রেমেও ভারিক্কি একটা ভাব যোগ হয়েছে। চুল কেটে ফেলেছে ও। কপালে একটা টিপ। আমি ঠাট্টা করে এইরকম সাজপোশাককে ‘নারীবাদী লেবাস’ বলি।
সে যাই হোক না কেন ওর চোখেমুখে দীপ্তি৷ এটাকেই কনফিডেন্স বলে সম্ভবত । সমীহ জাগে।
কুশল বিনিময় শেষ করে ও বলল,
— ‘সাজ্জাদ, তুই মনে হয় জানিস না, আমি কী করছি এখন। মানে আমার পেশা কী?’
— ‘তুমি আমাকে তুই বলাটা ছাড়তে পারো না?’
দিশা হাসল,
— ‘অভ্যেস ছিল তো!’
— ‘তোমার ওইসব অভ্যেসেই আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারলাম না!’
— ‘তুই হয়তো আমাকে অভ্যাস করতে চাসনি। কিংবা আমাকে অভ্যাস করাতেও চাসনি!’
— ‘কঠিন কথা। বাদ দাও। তোমার হাজবেন্ড কী করে?’
— ‘আমি বরং আমি কী করি সেটা বলি!’
হাসি পেল আমার। বেশ বড়োসরো কোনো চাকরি বাগিয়েছে মনে হয়, সেটা বলতেই উতলা হয়ে উঠেছে। তা যতই কিছু হোক না কেন, সেই তো আমার কাছ থেকে রিজেক্টেড হওয়া মালই! এখনো একটু খেলিয়ে তুললে আমাকে ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকবে!
— ‘আমার একটা সেইফ হোম আছে।’
— ‘সেইফ হোম!’
— ‘হ্যাঁ এবানডন্ড চাইল্ড যারা আমার সংস্থা তাদের দায়িত্ব নেয়।’
— ‘অরফানেজ?’
— ‘হ্যাঁ, সেটাও বলা যায়। তবে একটু আলাদা। আমরা সেসব বাচ্চাদের দায়িত্ব নেই, যাদের বাবা মা আছে কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাইছে না। অনেক সময় হয় না, বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, দুজনের কেউই বাচ্চাকে কাছে রাখতে চাইছে না? আবার এমনও হয়, বাবা মারা গেছে, মায়ের আবার বিয়ে হচ্ছে, সেখানে হয়তো বাচ্চার জন্য জায়গা হচ্ছে না। আবার মা মরে গেছে, সৎমায়ের কাছে বাচ্চা অত্যাচারিত হচ্ছে। কিংবা সিঙ্গেল মাদার, তার হয়তো ফিনানশিয়াল সাপোর্ট নেই বাচ্চাকে টেক কেয়ার করার। আমরা এসব বাচ্চাদের নিয়ে আসি। খাদ্য, নিরাপদ আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা এইসব বেসিক নিডগুলো সার্ভ করি। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার অঙ্গিকার আছে আমাদের।’
— ‘বাহ, চমৎকার। তোমার যে লাইফস্টাইল ছিল, তাতে তোমাকে ভাবলে এমনটাই হওয়ার কথা!’
— ‘সপ্তাহ দুই আগে আমার অফিসে একটা মেয়ে আসে। সাথে তিন বছরের একটা বাচ্চা। ওই মেয়েটারই বাচ্চা। মা এখানে এসেছে তার বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে রেখে যেতে। কিন্তু আমরা তো হিস্ট্রি জেনে বাচ্চা রাখি। তদন্ত হয় এ টু জেড। বাবার ব্যাপারে জানতে চাইলাম, তার কন্টাক্ট ডিটেল চাইলাম। তখন বুঝতে পারলাম, আমাদের যে ক্যাটাগরি আছে বাচ্চা এডাপশনের, এই বাচ্চাটি সেই হিসেবে পরিত্যক্ত নয়। বাচ্চাটির বাবা আছে। বাবা কেয়ারিং। বাচ্চার মা সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, বয়ফ্রেন্ড আছে – এইরকম একটা ব্যাপার! আমরা বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলাম!’
— ‘তারপর?’
— ‘আমার সংস্থা ছোটো। ছোটো হলেও আমাদের একটা সিস্টার কনসার্ন আছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, রেপ কেস – এসব নারীদের আইনি এবং সামাজিক সুবিধা দিয়ে থাকি আমরা। ওই মা এসব কোনো ক্যাটাগরিতেই পরেন না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এটা ফ্যামিলি ইস্যু এবং অডাল্টারি কেইস। আমরা কোনোভাবেই বাচ্চাটার দায়িত্ব নেবো না জানিয়ে দিলাম। সে চলে গেল!’
— ‘তারপর?’
— ‘পরদিন সকালে আমরা আমাদের কম্পাউন্ডের বাইরে বাচ্চাটিকে সত্যি সত্যি পরিত্যক্ত অবস্থায় পেলাম!’
— ‘সর্বনাশ!’
— ‘হুম। একদম। আমাদের বেশিরভাগ কেইসগুলো সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যায় বলে তারা তাকে তাকে থাকে কীভাবে আমাদেরকে ট্র্যাপ করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। আমরা তাই সবসময় সাবধানে থাকি, কোনোভাবে যেন কোনো ভুল না হয়। এরকম পরকীয়ার কেইসে আমাদের সম্পৃক্ততা পেলে, আমাদেরকে বিপদে ফেলা তাদের জন্য সহজ হয়। তবুও বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারলাম না! বাচ্চাটার মা একটা ভালো কাজ করেছিল, সেটা হচ্ছে বাচ্চার বাবার ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিল। তার দাবী হচ্ছে, সে তার আর বাচ্চার জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজছে, পেয়ে গেলেই বাচ্চাটাকে নিয়ে যাবে। আর যদি সেটা সম্ভব না হয়, সে এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাবে অথবা ব্যর্থ হলে বাচ্চাটাকে আমরা তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দেবো। যদি বাচ্চার বাবা, বাচ্চাকে নিতে না চায়, তবে যেন আমরা বাচ্চাটার টেক কেয়ার করি!’
— ‘এইসব মেয়েরা মা হয় কীভাবে? চিন্তা করো পরকীয়া কীভাবে বেড়েছে! একজনে সন্তুষ্ট থাকে না এরা! ছিঃ!’
— ‘কত জনই তো একজনে সন্তুষ্ট থাকে না, সে বিয়ের আগে প্রেমে হোক বা বিয়ের পর সংসারে! আচ্ছা, কথা শেষ করি। আমি ঠিকানা এবং নাম দেখে চমকে উঠলাম। নামটা আমার বহু চেনা। ফোন ডিরেক্টরিতে নম্বরটা সেইভ করাও আছে। যেহেতু আমার সংস্থার সাথে যাচ্ছে না, বাচ্চার বাবা আমার পূর্বপরিচিত, কেইসটা আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখলাম। সেইফ হোম নয় বাচ্চাটার দায়িত্ব আমি নিলাম!’
আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। গল্পটা আমার চেনা লাগছে খুব। দিশা আবার বলল,
— ‘আমি তোকে ফোন করলাম আর শুনলাম বাচ্চার মায়ের সাথে তোর যোগাযোগ হচ্ছে। যেহেতু বাচ্চাটা সেইফ আছে আমার কাছে, আমি একটু সময় নিলাম। তোদের পারিবারিক সমস্যাটা যেন তোরা নিজেরাই সমাধান করে ফেলতে পারিস সেজন্য অপেক্ষা করলাম। আমি চাইছিলাম, বাচ্চাটা ওর পুরো পরিবার ফিরে পাক!’
আমি বজ্রাহত হয়ে গেলাম।
এক গ্লাস পানি চেয়ে খেলাম।
স্থিতধী হয়ে বললাম,
— ‘আমার ছেলে কোথায়?’
— ‘আমার কাছেই আছে। ভেতরের ঘরে আছে।’
— ‘এনে দাও ওকে, আমি চলে যাচ্ছি!’
— ‘অবশ্যই।’
আমি মরিয়া হলাম,
— ‘এই কয়দিন আমাকে ঘোরাল কেন তবে? শুরুতেই কেন বলে দেয়নি?’
— ‘সাথী দেশের বাইরে যাওয়ার সব রকম ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। আমার ধারণা, তুই যদি পুলিশ কেস টেস করিস বা এইরকম কিছু, তাই ও এই কয়েকদিন তোর সাথে যোগাযোগ রেখে গিয়েছে। আমিও ব্যাপারটা এক দিন আগে ধরতে পেরেছি। এয়ারপোর্টে গিয়ে আমাকে ফোন করে মাফ চাইল, এসব কিছুতে আমাকে জড়ানোর জন্য! ছেলের ব্যাপারটাও এজন্যই গোপন রেখেছিল। আমাদের কাছে সময় নিয়েছিল, একটা আশ্রয় পেলেই ছেলেকে নিয়ে যাবে, এটা ওর ধোঁকাবাজি ছিল। আমি যেন তোকে না জানাই, তাই!’
— ‘ওর মায়ের কাছে কেন ছেলে রেখে আসেনি?’
— ‘এটাও আমি ভেবেছি। ভেবে ভেবে মনে হয়েছে, মায়ের কাছে ছেলে রেখে আসলে সাথীকে ইমোশনালি দুর্বল করে ফেলতি তোরা, তাই ও একইসাথে ছেলের নিরাপত্তা ও নিজের পথ সহজ করেছে!’
— ‘আমাকে এমন ধোঁয়াশায় কেন রাখল? তুমি বোঝাতে পারোনি?’
— ‘একচুয়ালি, আমি ফ্যামিলি কাউন্সেলিং করাই না, আর এসব ব্যাপার বুঝিও না। এটা আমার কাজ ছিল না। আর যেটা কাজ ছিল আমি সেটাই করেছি।’
— ‘মানে?’
— ‘সাথী এখানে এসেছিল আমার সম্পর্কে সব রকম খোঁজ খবর নিয়েই। আর আমাকে ও নতুন নতুন চেনে না। তোদের বিয়ের আগে থেকেই চেনে। শুরু থেকেই চেনে। তুই চিনিয়েছিলি আমাকে। তুই তোর একটা চার্মিং ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছিলি ওর কাছে। তুই যে কলেজে সবার ক্রাশ, ভীষণ পপুলার তুই এটা প্রমাণ করেছিলি। সেটা করতে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলি তোর ফ্যানগার্ল হিসেবে। আমি তোর জন্য কতটা আগ্রহী কিন্তু তুই ক্রমাগত ফিরিয়ে দিচ্ছিলি আমাকে। সেসব জেনে বুঝেই ও আমার কাছে এসেছিল, যেন তোর উপর রাগ থেকে আমি ওকে সাহায্য করি। তোদের বাচ্চাটার দায়িত্ব নিই। কিন্তু আমি ওকে সাহায্য করিনি। আমি শুধু কয়েক দিনের জন্য বাচ্চাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। আমি চাইছিলাম তোদের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু ও যে একেবারে মন ঠিক করেই বেরিয়েছে সেটা আমি ভাবতে পারিনি। আর তোর কাছেও শুনেছিলাম ও ফিরছে…!’
— ‘তুমি আমাকে বলতে পারতে…’
— ‘তোর সাথে কথা বলে মনে হচ্ছিল, তোদের মাঝে সব ঠিক হচ্ছে। এই সময় ছেলের কথা জানলে তুই হয়তো সাথীকে আর নাও ফিরে পেতে চাইতি। তাই আমি চুপ ছিলাম। এমনকি তিন দিন আগে যখন বললি, ও ঠিকানা দিয়েছে, তুই ওকে নিতে আসছিস, আমি সেটাও বিশ্বাস করেছিলাম। গতকালই সব পরিস্কার হয় আমার কাছে!’
এখন কি কিছু বলা উচিত আমার? আমি বুঝতে পারছি না৷ এত মানুষ এই পৃথিবীতে, সাথী কি দিশাকেই পেয়েছিল শুধু, আমাকে ছোটো করার জন্য! এতটা অপমান কি আসলেই আমার প্রাপ্য ছিল? কী না করেছি আমি ওর জন্য! দিশাকেও ছেড়েছি। আজ দেখো, কী চকচকে জীবন দিশার। আর আমি! আমাকে কোথায় ফেলে রেখেছে জীবন! ছা-পোষা চাকুরে হয়ে বেঁচে আছি।
ছেলেকে বুকে করে বেরিয়ে এলাম। দিশা বলল,
— ‘এই কেসটাতে আমি এতটা জড়িয়ে গিয়েছি যে আমি আর কোনোভাবেই এটার সাথে নিজেকে জড়াব না। তবে আমার সংস্থা থাকবে। সব বাচ্চাদের জন্যই থাকবে। বাচ্চাটাকে আদর করে পালিস! যদি কখনো মনে হয় পারবি না, তবে আমার সেইফ হোমে যোগাযোগ করিস।’
স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিলো দিশা, আমার দিক থেকে আর কোনো যোগাযোগ ও প্রত্যাশা করছে না।
শেষ সময়ে দিশা বলল,
— ‘সাথী খুব খারাপ কাজ করেছে। অন্যায় সম্পর্ক করেছে। অন্যায় করেছে তোর সাথেও। তবে কর্মফল নামে একটা কথা আছে পৃথিবীতে, কারো অন্যায় কর্মের শাস্তি দিতে প্রকৃতিই অন্য কাউকে দিয়ে অন্যায় করিয়ে অন্যায়ের শোধ নেয়। তুই এক দিন সাথীকে বলেছিলি, কলেজের সব সুবিধা পেতে আমাকে তোর দরকার। তাই যত দিন কলেজে ছিলি, আমার সাথে প্রেমের ভান করতি তুই। কলেজ শেষ, প্রেমও শেষ! তোর কাছ থেকেই শিখেছে ও এই প্রেম-প্রতারণা! তোর সাথেও একই রকম অভিনয় করে করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তোর কাছে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে!’
আমার মাথা নিচু হয়ে গেল।
দিশা বলল,
— ‘আমার সাথে তুই যখন ছলনা করছিলি, প্রকৃতি তোর এই শাস্তির পট রচনা করছিল। সেই প্রকৃতিই হয়তো সাথীর এই প্রতারণার বদলে নির্মম শাস্তির ছকও কেটে রেখেছে নির্ভুলভাবে, কোথাও না কোথাও! সাজ্জাদ, তোদের সন্তানকে এসবের স্পর্শ থেকে দূরে রাখিস। বাচ্চাটাকে মানুষ করিস, ওকে শেখাস, প্রেমের বদলে প্রেমই দিতে হয়, প্রতারণা নয়!’
#প্রেমপ্রতারণা
সমাপ্ত
Afsana asha