প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-১০

0
3

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

প্রকৃতির মন ভালো নেই। আকাশ বিবর্ণ। ঠিক মুনার জীবনের মতোই! যেমন আজ— রাহাকে পড়িয়ে আসার সময় ওদের বাড়ির সামনে থেকে রিকশা নিয়েছিল মুনা। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে রিকশাসহ উল্টে পড়ে গেছে মুনা। মাথায় আঘাত পেয়েছে, পা মচকে গেছে। গুরুতর আহত হয়েছে রিকশাওয়ালা। কাকতালীয়ভাবে ওই পথ দিয়ে রোদ্দুর যাচ্ছিল বলেই মুনার দুর্ঘটনায় কবলিত হওয়াটা তার চোখে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে। পিচ ঢালা রাস্তার একপাশে পড়ে কোঁকাতে থাকা মুনাকে দেখে রোদ্দুর প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। এতদিনের জমিয়ে রাখা সব রাগ অভিমান ভুলে ছুটে যায় কাছে। এরপর লোকজন জড়ো করে রিক্সাওয়ালাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে মুনাকেও নিয়ে নিজে যায় হাসপাতালে। বিপদের উপর বিপদ রাস্তায় তখন কোন গাড়ি পাচ্ছিল না রোদ্দুর। বাধ্য হয়ে ফোন করে নিজেদের গাড়ি আনায়। মুনা হাঁটতে পারছিল না দেখে রোদ্দুর পাঁজাকোলা করে ওকে নিয়ে গাড়িতে বসালে সেটা মুনা ভালোভাবে নেয়নি। বরংচ নিজের আঘাতের কথা ভুলে গিয়ে ওকে দু একটা কথা শুনিয়ে দেয়। সাহায্যের বিনিময়ে ওমন তিরস্কার পেয়ে রোদ্দুর প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। কিন্তু একটা কথাও বলে না। চুপচাপ সব হজম করে নেয়। কারণ এখন মান অভিমান নিয়ে পড়ে থাকার সময় নয়। তাছাড়া এই মাথা খারাপ, অহংকারী মেয়ের কথা কানে না তোলাই ভালো। তবুও মুন্নার কিছু কথা একদম গায়ে জ্বালা ধরানোর মত ছিল। সেগুলো শুনেই রোদ্দুরের রাগ চরমে পৌঁছায়। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও তার মুখ চোখ লালচে হয়ে ওঠে। রোদ্দুর
শুধু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, এখন রাগারাগির সময় নয়। সময় হলে সেও ফিডব্যাক দেবে। আপাতত পরিস্থিতি সামলানো যাক।

নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক জানায় মুনার তেমন কিছু হয়নি। পায়ে সামান্য লেগেছে আর মাথায় একটু কেটেছে। নিয়মমাফিক ঔষধ খেলে আর রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ রিকশাওয়ালার অবস্থা বিশেষ একটা ভালো না৷ গুরুতর ইনজুরি হয়েছে। যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। এমনটা শুনে রোদ্দুরের বুক কেঁপে উঠায় সে অবচেতন মনে, আবেগগ্রস্ত হয়ে মুনাকে বুকে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত রোদ্দুর কী করতো? কীভাবে ঠিক থাকতো? ওতো নিঃস্ব হয়ে যেত। নাহোক মুনা ওর। না ওকে ভালোবাসুক, কিন্তু সে তো ভালোবাসে। শত মান-অভিমানের পর, শত অবহেলা-অপমানের পরেও সে এই মেয়েটাকেই চেয়েছে। এ সমস্ত ভাবনায় যখন অতিষ্ঠ ওর মন-মস্তিষ্ক তখন ওর এ ব্যবহারটাকে ভালোভাবে না নিয়ে, অন্য মানে বের করল৷ ঝটকা দিয়ে রোদ্দুরকে ছাড়িয়ে ধারালো আর তিক্ত কন্ঠে বলে ওঠল,
— হোয়াট দ্যা হেল? এসবের মানে কি?
রোদ্দুর কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে শুধায়,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড? আর ইউ ওকে?
মুনা কঠিন গলায় বলল,
— আমি তো ঠিক আছি কিন্তু আমার মনে হচ্ছে
আপনি ঠিক নেই।
রোদ্দুর অবাক হয়ে গেল,
–মানে?
— মানেটা আপনি বুঝতে পারছেন না?
রোদ্দুরের পছন্দ হচ্ছিল না মুনার ভণিতা। তাই তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— সোজা সাপটা কথা শুনতে পছন্দ করি আমি।
— ঠিক আছে। সোজা সাপ্টা বলছি। এত বছর ধরে চিনি আপনাকে,কিন্তু কখনো আপনার এই রূপটা ধরতে পারিনি।
— আমার রূপ?
রোদ্দুর যেন আকাশ থেকে পড়ল!
মুনা শ্লেষাত্মক গলায় বলল,
— মেয়ে দেখলেই আপনার ছোঁকছোঁকানির অভ্যাস আছে এসব তো আগে জানতাম না! এখন যেই না সুযোগ পেয়েছেন নিজের আসল রূপটা দেখিয়ে দিলেন তো? একটা অসভ্য, ম্যানারলেস আর নোংরা মনের পুরুষ মানুষ আপনি….
রোদ্দুর হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল ওর পানে। এক মুহূর্তের জন্য চিনতেই পারছিল না মুনাকে। হ্যাঁ, ভুল তার হয়েছে! ওমন আবেগে ভেসে গিয়ে জড়িয়ে ধরার কোন মানেই ছিল না! কিন্তু এটা কোন মুনা? সে কী চেয়ে এই মেয়েকে? মুনতাহা কী করে এতটা নিম্ন মানসিকতার হয় যে স্বাভাবিক স্নেহ প্রদর্শনেরও অন্য কোনো মানে বের করে? রোদ্দুর বুঝে পেল না। মুনা যদি এরকম মেয়েই হয় তাহলে
সে কেন চিনতে পারেনি এতদিন? তাহলে কি মেয়েটাকে সে ভুল চিনেছিল? রাগে-ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে মুহূর্তের জন্যও ওখানে থাকেনি। মুনাকে রেখেই ঘৃণা নিয়ে বেরিয়ে গেছে হসপিটাল থেকে। যাওয়ার আগে অবশ্য মঈন আর নিপাকে খবর দিয়েছে। আর ঘৃণা ভরা কন্ঠে বলে গেছে,
— তোমার মতো নিচু মানসিকতার মেয়েকে ভালোবেসে আমি যে কত বড় ভুল করেছি, তা আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। নিজের
প্রতি বড্ড রিগ্রেট ফিল হচ্ছে আমার, তোমার মতো নোংরা মনের মেয়ের জন্য এতকিছু সহ্য করলাম বলে। তোমাকে নিয়ে আমি প্রচুর সময় নষ্ট করেছি, লাইফলেস তকমা পেয়েছি। বহুবছর তোমার পিছু ঘুরেছি কুকুর-বেড়ালের মতো। এরপরেও মন পাইনি। কারণ দেখিয়েছ, আমি বড়লোকের ছেলে। বিগড়ে যাওয়া। আমাদের মেলে না। আরো নানা কিছু। যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই৷ এসব অবহেলা, কষ্ট দেওয়ার পরেও কোনোদিন তোমাকে ছুঁয়েছি? ব্যাড টাচ করেছি তোমায়? আমার কথার মাঝে নগ্নতা, যৌনতার ছোঁয়া ছিল?
মুনা হঠাৎ মাথা নিচু করে ফেলল। মিনমিন করে বলল,
— না, ওমন কিছু ছিল না। সরি।
রোদ্দুর অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা চেপে ধরল,
— উফ মুনতাহা! আজ তুমি আমাকে যা যা বললে তার জন্য তোমাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না, কক্ষনো না। আর কক্ষনো যদি তোমরা প্রতি আমার অনুভূতি জাগে তাহলে ট্রাস্ট মি, নিজেকে কাপুরুষ ছাড়া অন্যকিছু ভাবব না আমি। শেইম অন মি।

_____

রাত গভীর। চারপাশের নিশূতি শব্দে ঝিম ধরা ভাব।
আকাশে বড় একটা পূর্ণিমার চাঁদ। কাচের জানালা ভেদ করে আসা মুগ্ধতা ছড়ানো আলো মুনাকে কিছুতেই মুগ্ধ করতে পারছে না। ভার করা মুখে লেগে আছে বিষাদের ছায়া। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু গালগলা ভিজিয়ে বালিশ ভেজানোর পায়তারা করছে। মুনা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এতটা অসহায় ওর কখনো লাগেনি। শত কষ্টে ও না। আচ্ছা কাউকে ভালবাসলে কি এরকমই কষ্ট হয়? ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার আগে সে নিজেই যে কষ্টে কষ্টে বিলীন হয়ে যায় এসব কি পৃথিবীবাসী জানে? না জানে না। যদি জানতো তাহলে সবাই নিজেদের ভালবাসার মানুষকে পেয়ে যেত। জাদুর মতো! চাইলেই যদি পৃথিবীর সব ভালোবাসা এক হয়ে যেতে পারতো, পৃথিবীতে আর তো কোন দুঃখ কষ্টই থাকতো না!
মুনার মনের ভেতরটা তোলপাড় করছে, সব পাগল পাগল লাগছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু নষ্ট করে দিতে। কিন্তু পারছে না। রোদ্দুর নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে ওর এই কথাগুলো শুনে। কিন্তু মুনা কী করতো? ও তো নিরুপায়! নিজেকে লোভী প্রমাণ করতে পারবে না রোদ্দুরের বাবার কাছে!

এদিকে রোদ্দুর মা’কে জানাল সে বিয়ে করতে চায় এবং অতি শ্রীঘ্রই। তার কোনো পছন্দটছন্দ নেই, মা যাকে এনে দেবে তাকেই গ্রহণ করবে। হোক কানা-ল্যাংড়া বা ডানাকাটা পরী! রিমু বেগম হঠাৎ ছেলের কথা শুনে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না৷ পৃথিবীতে বোধ হয় তাঁর ছেলে রোদ্দুরই প্রথম ছেলে যে হুমকি দেওয়ার স্বরে মাকে বলেছে বউ খুঁজতে। রিমু বেগমের ধারণা তার ছেলে প্রেমে বড়সড়ো ধরনের ছ্যাঁকা খেয়েছে। তাই তার এ অবস্থা। বেশ কিছু মাস যাবত ছেলের উপর গবেষণা চালিয়ে তিনি এই ফলাফল নির্ধারণ করতে পেরেছেন। যদিও ছেলের প্রেমিকার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, বা আদৌ জানেনই না সত্যিই রোদ্দুরের প্রেমিকা আছে কি-না! তবুও তার এমন মনে হয়। যদিও রোদ্দুরের পাশে মুনাকে মানায় বলেই তার অবচেতন মন বিশ্বাস করে! হঠাৎই তার মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেল। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন তিনি ব্যাপারটা নিয়ে৷ বিয়ের কথাবার্তা চলছে ঠিক, কিন্তু বিয়ে তো হয়ে যায়নি! এরমধ্যে আরেকটা প্রস্তাব যেতেই পারে ভেবে তিনি ছুটলেন ছেলের ঘরে।
গিয়েই হন্তদন্ত হয়ে বললেন,
— তাহলে মুনের বাসায় প্রস্তাব দিই?
রোদ্দুর ভুল শুনল বলে মনে হলো ওর,
— কার কথা বললে?
— রাহার ম্যাম।

_______

চলবে….