#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
রাতের নিস্তব্ধতা যেন সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। হাওয়ায় যেন অদ্ভুত শীতলতা! রোদ্দুর গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে হালকা স্বরে বলল,
— তুমি আমার সাথে খেলছ, তাই না, মুনতাহা?
— মাফ করুন। আমি কখনোই আপনার সাথে খেলিনি৷ এতটা দুঃসাহস আমার নেই।
রোদ্দুর তাচ্ছিল্যভরে হাসল,
— তোমার কতটা দুঃসাহস আছে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। যতবার রিজেক্ট করেছ ভালোই দুঃসাহস দেখিয়েছ। এবার ঝটপট কারণ বলো। যদিও আমি জানি তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
মুনা যতটা সম্ভব কথা গুছিয়ে নিল। এরপর মৃদু স্তিমিত স্বরে বলল,
— আপনার মনে আছে সাহিল ভাইয়ের রক্তদান কর্মসূচিতে আপনি, আমি ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলাম? আংকেল বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন। সেদিন একসাথে কাজ করতে গিয়ে আপনি-আমি ক্লোজ ছিলাম। আপনি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছিলেন, ছোট ছোট বিষয়ে অনেক কেয়ারও করেছিলেন। মোটকথা, আপনার মনোভাব বা চোখের ভাষা সেদিন কারোর চোখই এড়ায়নি। যেমন আমার এড়ায়নি তেমন আপনার বাবারও বোধহয় না। সেদিনের পর থেকেই তিনি আমার প্রতি রুষ্ট। আমায় সরাসরি কখনো বলেননি আপনার থেকে দূরে থাকতে। সবসময় ভদ্র ভাষায়ই আমার চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছেন চাঁদের দিকে হাত বাড়ালে শূন্যতা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না৷ তাই নিজেকে যাতে সংযত রাখি।
রোদ্দুর তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
— তাই নিজেকে সংযত রেখে আমার উপকার করলে, তাইতো?
মুনা উত্তর দিল না। নাক টানলো। রোদ্দুর তীব্র স্বরে বলল,
— সত্যিই যদি ভালোবাসতে তাহলে তোমার বলা উচিৎ ছিল আমাকে। একবার বলতে, বলেই দেখতে…
মুনা বিগলিত স্বরে বলল,
— ছেলের কাছে বাবার নামে নালিশ করার ব্যাপারটা জঘন্য মনে হয়েছে আমার। আসলে কিছু অনুভূতি কখনো আমরা চাইলেও অন্যকে বোঝাতে পারি না। সেখানে ভালোবাসি স্বীকার করাটা বিলাসিতা। এমন স্পর্ধা দেখানোর সাহসও পাইনি।
মুনতাহা বলছে এই কথা? এতটা ভীতু তো সে নয়। সবসময় কড়া গলায় প্রতিবাদী হিসেবেই তো দেখে এসেছে। সেখানে আজ এসব কী বলছে? বড্ড অচেনা লাগছে, মেয়েটাকে বোধহয় এখনো ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারেনি সে। রোদ্দুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিক্ত গলায় বলল,
— চালাক মেয়ে, এখনো সব বলোনি তুমি।
মুনা হকচকিয়ে গেল। আসলেই ঠিক, মুনা সবকিছু বলেনি। সত্যি কথাগুলোই গোপন করেছে।
ইনামুল সাহেব ওকে নিজের অফিসে ডেকে সরাসরিই বলেছিলেন রোদ্দুরের দিকে না হাত না বাড়াতে। ওকে আশকারা না দিতে। নিচু স্তরের মুনা যদি তার ছেলের দিকে হাত বাড়ায় তাহলে তিনি মুনাকে নিঃস্ব করে দেবেন। আর তার একটা নমুনাও তিনি দেখিয়েছিলেন। এমনভাবে কলকাঠি নাড়িয়েছিলেন যে তুচ্ছ একটা কারণে মঈনের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। চার-পাঁচ মাসের মতো চাকরি থেকে সাসপেন্ডও করে দেয়। দিনগুলো বড্ড খারাপ কেটেছিল। সংসারের অবস্থা ছিল বেহাল। নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে তখন মুনা চেয়েও পারেনি রাহাকে পড়ানো বাদ দিতে। অন্য টিউশনিও তখন পাওয়া যাচ্ছিল না৷ তাছাড়া রিমু বেগম আর রাহাও নাছোড়বান্দা ছিলেন৷ সবকিছু মিলিয়ে মুনা খানিকটা বেহায়া হয়েই রাহাকে পড়ানো অব্যাহত রাখে কিন্তু ইনামুল সাহেবের কারণে বাদ দেয় নিজের ভালোবাসা আর অনুভূতিকে মূল্য দেওয়া!
এসব শুনলে রোদ্দুর নিশ্চয় নিজের বাবাকে ঘৃণা করবে, তাই মুনা কখনোই বলতে পারবে না কথাগুলো। তাছাড়া নিজের পরিবারের বেলায় মুনার মনমানসিকতা অনেকটাই দুর্বল। তাই ঝামেলা এড়াতে আমতাআমতা করে অস্বীকার করল,
— তেমন কিছু না।
রোদ্দুর ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠল,
— স্বীকার করো আর না করো তুমি যে আমাকে ভালোবাসো না এটা তীব্র সত্যি। কেন সত্যি আমি বলি? প্রতিবার তুমি অহেতুক ও অন্যায়ভাবে যেমন আমায় প্রত্যাখ্যান করেছ তারচেয়ে বেশি আঘাত
করেছ শত শত মিথ্যে কথা বলে। আমার মানসিকতা নষ্ট করে দিয়েছ। এটা যে সে আঘাত নয়। একদম মন মরে যাওয়ার মতো আঘাত! ভালোবাসলে সেটা পারতে না। মিথ্যে বলতে গলা কাঁপত। এরপরেও দেখ, আমি এত্ত বেহায়া, এত্ত বেহায়া যে এই গভীর রাতেও তোমাকে একবার দেখার জন্য আমার শ্বাস আটকে আসছে! তুমি আমায় আবার কনফিউজড করে দিচ্ছ।তোমায় বিশ্বাস করতে যেয়ে প্রতিবার আমি ভুল প্রমাণিত হয়েছি। আর নেয়া যাচ্ছে না। মিথ্যেবাদী মেয়ে!
এরপরে আর কথা শোনা গেল না। তীব্র নীরবতা। মুনা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করেও বিপরীত দিকের প্রতিত্তোর না পেয়ে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখল রোদ্দুর ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। ওকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি। মুনা চেষ্টা করল আবার, কিন্তু বন্ধ পেল। অতি আশ্চার্যান্বিত হয়ে মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেক চিন্তাভাবনা করে, সাহস যুগিয়ে, সব একপাশে রেখে লোকটাকে মনের কথা বলেছে সে৷ অথচ রোদ্দুর বিশ্বাস করল না। অবশ্য করবেই বা কেন? প্রতিবার মুনার দ্বারা যেভাবে প্রত্যাখ্যান হয়েছে অন্য কেউ হলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতো সেই কবেই, রোদ্দুর বলেই নিদ্বির্ধায় এখনো স্বীকার করেছে মুনাকে সে ভালোবাসে।কখনো বলা হয়নি, প্রতিবার রোদ্দুরকে অপমান করার পর মুনা নিজেও কষ্ট পেয়েছে, চোখের জল ও ফেলেছে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে আর দহনে পুড়েছে। যে দহন সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। সেসব কেউ জানে না। না কাউকে বুঝতে দিয়েছে। এসবের একমাত্র সাক্ষী মুনার এই ঘর, বারান্দা, বিছানা-বালিশ। এসব কী করে বোঝাবে সে রোদ্দুরকে? মুনার বাকি রাত নির্ঘুম কাটলো। চোখ লেগে এলেও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠল। রোদ্দুরের ফোনে ট্রাই করে সুইচড অফ দেখে অস্থির মনটাকে তীব্রভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করল মুনা।
.
সবকিছু মিলিয়ে এমন একটা বিশ্রি আর অভাবনীয় কান্ড ঘটার পর রাহাকে পড়ানোর ব্যাপারটা দ্বিধায় পড়ে গেল মুনা। এখন যে পরিস্থিতি তাতে আরো বেশি অপমানিত হবে মুনা। ইনামুল সাহেব হয়তো ঘাড়ধাক্কা দিয়েই বাড়ি থেকে বের করে দেবে ওকে। সবকিছু মিলিয়ে মুনা সিদ্ধান্ত নিলো রাহাকে আর পড়াবে না সে। ফোন করে কথাটা বলতে গিয়ে খুব খারাপ লাগল ওর। রিমু বেগম শুনে চুপ করে রইল৷ কথা বলল না।
অনেকক্ষণ পর ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,
— আমার আপত্তি থাকলেও তোমায় জোর করার সাধ্য নেই মা৷ পরিস্থিতি বুঝতে পারছি আমি৷ তুমি রাহাকে বুঝিয়ে বলো। মেয়েটা আমার মন খারাপ করে ফেলেছে।
মুনা রাহার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ওকে নিজের সমস্যার কারণ বুঝিয়ে বলল। রাহা প্রথমে শুনেই গেল। কিছুই বলল না ওকে। ফোন রাখার আগে বলল,
— ওকে ফাইন। আমাকে পড়াতে হবে না। শুধু ভাইয়াকে বিয়ে করে নাও, তাহলেই হবে। তোমার প্রতি আমার একফোঁটাও দাবিদাওয়া থাকবে না।
মুনা লজ্জায় পড়ে গেল। সেভাবে রোদ্দুরের বিষয়ে রাহার সাথে কখনো কথা বলেনি ও। থতমত খেয়ে বলল,
— কী বলছ এসব? পাগ..
মুনার কথা শেষ হবার আগেই রাহা উত্তেজিত স্বরে বলল,
— কাউকে যদিও ভাইয়া নিজের ওয়ালেটে ধরতে দেয় না, তবে আমি দেখেছি ওর ওয়ালেটে তোমার একটা ছবি আছে, সবসময় থাকে। অলমোস্ট দুই বছর ধরে। অনেক ভালোবাসে তোমাকে আমার ভাইয়া। প্লিজ তোমরা বিয়ে করে নাও, আমি বাবাকে বোঝাব। বাবা কখনো আমার কথা অপূর্ণ রাখেনি…
মুনার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ওর কাশি উঠে গেল। ওরই ছাত্রী কিনা নিজের ভাইয়ের সাথে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে? আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে বলে কথা! মুনা কথা বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,
— তোমার ভাইয়ার খোঁজ পেয়েছ?
— হ্যাঁ৷ বন্ধুদের ফ্ল্যাটে উঠেছে। মাহিন ভাই ফোন করে মাকে জানাল একটু আগে!
শুনে মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, ভালো আছে তাহলে খ্যাটখ্যাটে লোকটা! এরপর আর কথা এগুলো না। মুনা অযু্হাত দেখিয়ে ফোন রেখে দিলো৷ বারান্দায় গিয়ে রোদে বসল কিছুক্ষণ। নীল আকাশ, শান্ত প্রকৃতিজুড়ে বিচরণ করা চিল-শালিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার যাত্রা দেখতে মগ্ন হতেই নিপা এলো ওর ঘরে। খুঁজে খুঁজে ওকে পেল বারান্দায়। পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে উজ্জ্বল চেহারা বানিয়ে নিপা ওকে বলল,
— বিয়ের কনের চোখের নিচে কালি কেন? সারারাত চিন্তা হয়নি নাকি হবু বরের চিন্তায়? এখনই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে কাল দিন পর স্বামীর বাড়ি গেলে তোকে তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না রে…
মুনা ভ্রুকুটি করে বলল,
— আজেবাজে সব কথা…
— আজেবাজে আবার কি? ওদিকে পাত্রপক্ষ কাল আসবে দিনতারিখ ঠিক করতে আর তুই হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিস? পার্লারটার্লারে যাবি না?
নিপার কথায় চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে গেল মুনার,
— কাল দিন ঠিক করতে আসবে মানে?
— হুম। ছেলের বোন ফোন করে জানাল একটু আগে।ছেলে চেয়েছে ঘরোয়া আয়োজনে বিয়েটা হবে। তবে তুই চাইলে ধুমধাম করে আয়োজনও হবে। আমরা তো জানি তুইও ঘরোয়া আয়োজনে করতে চাস, তাই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। এবার তারিখ পড়লেই চলবে।
মুনা হতবিহবল হয়ে গেল৷ আরে! এই ব্যাপার তো বেমালুম ভুলে বসে আছে ও। রোদ্দুরকে নিয়ে ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে এই বিয়ের চিন্তা ওর ঘূর্ণাক্ষরেও মনে পড়েনি। মুনা বুঝল বেশ ফ্যাসাদে পড়ে গেছে সে। কী করবে ভেবে পেল না। কান্না এলো ওর। নিপা ওর দুঃখিত চেহারা দেখে অবাক বনে জিজ্ঞেস করল,
— কী সমস্যা? পরের বাড়ি যাবি বলে মন খারাপ লাগছে? আরে ওসব কিছু ভাবিস না। পরিবারটা ভালো, ঝামেলাহীন। একার সংসার হবে তোর…
মুনা ধীরস্বরে আওড়াল,
— আমায় একটু একা থাকতে দিবে, প্লিজ…
নিপা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল ঠিক কিন্তু মনে মনে সন্দেহ হলো ওর। বিয়ে ঠিক হলে মেয়েদের চোখেমুখে যে সমস্ত জৌলুস দেখা যা তার ছিঁটেফোঁটাও নেই মুনার মধ্যে। যেন প্রাণহীন মেয়ে একটা!
.
মুনার হাত-পা শীতল হয়ে আসছে। কিছু ভাবতে পারছে না৷ হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছে।
কাকে কী বলবে, করবে সব এলোমেলো লাগছে।
রোদ্দুরের ফোন গত রাতের মতোই বন্ধ। এখন যখন সব স্বীকার করে নিয়েছে তখনি লোকটা পল্টি নিল? বাধ্য হয়ে মুনা ওর বন্ধু মাহিনের ফোন কল দিল। অনেক রিকুয়েস্ট করার পর রোদ্দুরের সাথে কথা বলতে দিতে রাজি হলো মাহিন। রোদ্দুর ফোন কানে তুলতেই মুনার গলা শুনে ফোনটা কেটে দিতেই যাবে কিন্তু তার হাত থেমে গেল মুনার কান্নারত স্বরে বলা কথাগুলো শুনেই,
— কাল বিয়ের দিন ঠিক করতে আসবে। আমি কি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেব? আপনি এখনো রেগে থাকবেন আমার উপর? আমি আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না…
মুনারাণী নিজের ইগো ভুলে কাঁদছে? ভয় পাচ্ছে ওকে হারিয়ে ফেলার? এতদিনে যেন মনটা একটু স্বস্তি পেল। বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল৷ যে ভয় আর কষ্ট এতদিন ওকে ভুগিয়েছে তার কিছুটা নিজেও পাক
এই মহারাণী! তবেই না বুঝবে যন্ত্রণা কাকে বলে!
__________
চলবে….