প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
78

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪ (শেষ)

ফোনের অপর প্রান্তে রোদ্দুর তখন নিশ্চুপ। মুনার ভাঙা কণ্ঠস্বর যেন গভীরভাবে ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সমস্ত অভিমান ভুলে গিয়ে ওকে কাছে টেনে নিতে। কিন্তু, অবর্ণনীয় ক্ষোভ আর মনের বাঁধা যেন কোনোভাবেই তাকে সেটা করতে দিচ্ছে না। তবুও, নিজের ভিতরের এই তুমুল ঝড়কে চেপে রেখে বলল,
— তোমার কী মনে হয়? এতদিনের অবহেলা ভুলে তোমার কাছে ছুটে যাব?
মুনা লজ্জিত, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,
— জানি, ভুল করেছি। কিন্তু একবার আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন না প্লিজ, আপনি ছাড়া অন্য কাউতে ভাবতে গেলেই পৃথিবী শূন্য মনে হচ্ছে।
রোদ্দুর একটু চুপ করে থেকে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি এনে বলল,
— এই কথাগুলো এতদিন কোথায় ছিল মুনতাহা? যখন আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে? আমার অনুভূতি তো আলাদা ছিল না, ঠিক এরকমই ছিল!
মুনা হতাশ ও অসহায় গলায় উত্তর দিলো,
— বুঝতে পারতাম অনেক আঘাত দিয়ে ফেলেছি আপনাকে যা ক্ষমার অযোগ্য! কিন্তু আমি আমার ধর্তব্যের বাইরে গিয়ে বোঝাতেও পারিনি পরিস্থিতি কীভাবে আমায় এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
রোদ্দুর তিক্ত হাসি দিয়ে বলল,
— পরিস্থিতি! তুমি তো সেই পরিস্থিতির দোহাই দিয়েই বারবার এড়িয়ে গেছো আমায়। আর এই ভালোবাসা রক্ষার দায়িত্ব কি শুধু আমার একার? তোমার কিছু করার নেই? নিজের মনের কথা কাউকে বলার সাহস নেই?
মুনার বুকের মধ্যে শব্দ করে উঠল। সমস্ত ইগো গুঁড়িয়ে দিয়ে বলল,
— সেজন্য আপনাকে আমার লাগবে, শুধু আপনাকে।
রোদ্দুর এক মুহর্তের জন্য থমকে গেল। মুনার কণ্ঠের কম্পন, তার কান্নার আহ্বান, এতদিনের বেদনা তাকে একটু একটু করে আবার সেই সুন্দর অনুভূতির সাথে এক করে দিচ্ছে। রোদ্দুর গম্ভীর গলায় বলল,
— আমাকে তোমার লাগবে মানে?
মুনা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
— লাগবে মানে লাগবে। আমি সত্যিই পাশে চাই আপনাকে। আপনার হাতে হাত রেখে আমি সেটুকু ভরসা অনুভব করতে চাই, যতটুকু ভরসা পেলে আমি ভাইয়াকে সবটা বুঝিয়ে বলতে পারব!
রোদ্দুরের মনে শীতল দখিনা বাতাসের প্রফুল্লতা ছড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি,
— তাহলে বলো ভালোবাসি।
— ভালোবাসি।
— ঘুষ দিচ্ছ?
— আপনার সেটা মনে হলে তাই…
রোদ্দুর ফোনের এপাশে সূক্ষ্ম হাসল। কঠিন গলায় বলল,
— নির্লজ্জ ভাবতে পারো, তবুও ভালোবাসা পাওয়ার লোভে শেষবারের মতো আছি।

কথাটুকু বলে রোদ্দুর এক নিঃশ্বাসে ফোনটা নামিয়ে রাখল। মুনার উচাটন কন্ঠ তাকে শান্তি দিচ্ছে প্রচুর। আবার একটা জিনিস ভাবাচ্ছেও ওকে, এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষটা কি আসলেই সুন্দর হবে? নাকি প্রতিবারের মতো বিষাদমাখা?

.

মুনা জানে, সবটা যদি ঠিক করতে হয় তাহলে এবার ওকেই কিছু করতে হবে। মঈন আর নিপাকে সবকিছু বলতে হবে। যদিও মুনা সন্দিহান ওদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে, তবুও একবার চেষ্টা করে দেখার জন্য মনেপ্রাণে নিজেকে প্রস্তত করল। আর কোনো অপেক্ষা, দ্বিধা আর অপমানের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, একদমই না। মঈন বাড়ি নেই, অফিসে। নিপা রান্নাঘরের সব কাজ গুছিয়ে যখন একটু হালকা হলো তখনি মুনা সাহস করে ওর কাছে গিয়ে বসল। বুকের মধ্যে তখন ওর প্রচণ্ড ধুকপুকুনি চলছিল। হাত কাঁপছে, মুখে শুকনো হাসি। মনে মনে হাজারো কথা গুছিয়ে নিলেও নিপা যখন ভ্রু কুঁচকে ইশারায় ওকে কাহিনি কী জিজ্ঞেস করল মুনার যেন মুহূর্তেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
— ভাবি একটা কথা বলতে এসেছি!
— কী কথা?
একটা প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে কীভাবে অন্তিম মুহূর্তে এসে ভেঙে দেয়ার কথা বলবে সে? এই ভেবে
মুনার গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে। অপ্রস্তুত, আড়ষ্ট কন্ঠে মাথা নিচু করে বলল,
— আমি এ বিয়েটা করতে চাই না ভাবি। পারব না, একদম না।
নিপা বিস্মিত হলো না। আগাগোড়া কিছু জিজ্ঞেস না করে ভাবলেশহীন ভাবে জিজ্ঞেস করল,
— কেন?
— অন্য একজনকে ভালোবাসি।
— সে কে?
এ পর্যায়ে এসে মুনা আবার উলটপালট হয়ে গেল। বহুকষ্টে লজ্জিত মুখে বলল,
— রাহাকে পড়াই না? ওর ভাই…
— রোদ্দুর নাকি নাম?
— হ্যাঁ। তুমি কি করে জানলে….
নিপা বিস্ময় নিয়ে বলল,
— সেই তো গতরাতে ফোন দিয়ে তোর ভাইকে জানিয়েছে তোকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে তুই নাকি মরে যাবি, তাই ওর সাথেই যেন তোর বিয়ে দেই আমরা! আচ্ছা, এ কথাটা অন্য কারো কাছ থেকে কেন শুনতে হলো আমাদের? আমাদের বললে কি মানা করতাম? আমরা কী তোকে বিয়েতে জোর করেছি কখনো? তোর ভাই তো গত রাত থেকেই মন খারাপ করে আছে। অফিসেও গেছে না খেয়ে।

মুনা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। অপরাধবোধ হলো। ভাই-ভাবি এত সাপোর্টিভ অথচ সে এতক্ষণ এসব কী ভাবছিল? ছিহ! আর রোদ্দুরই বা কি? মুনাকে সব করতে বলে নিজেই আগেভাগে জানিয়ে বসে আছে! অথচ ওকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করল না? মুনা আর ভাবতে পারল না,
— আমি সত্যিই ভাবিনি এতকিছু। আগেই জানানো উচিৎ ছিল আমার। এরজন্য ক্ষমা চাইছি ভাবি। পাত্রপক্ষকে কি বলবে এটা নিয়ে আমি….
— ওদের যা বলার তোর ভাই বুঝিয়ে বলবে। এখন তুই তোর ভাইকে কি বলে বুঝাবি সেটা ভাব! এতটা পর মনে করিস আমাদের ভাবিনি….
নিপা খানিকটা মুখ ভার করে উঠে চলে যেতে লাগলে মুনা তাকে জড়িয়ে ধরে রাগ কমানোর চেষ্টা করল। আর নিপাও সহজসরল তাই রাগ ভাঙাতে বেশিক্ষণ সময় নিল না। কিন্তু মঈন টানা এক সপ্তাহ মুনার সাথে কথা বলল না। মুনা অনেকবার চেষ্টা করেও সফল হলো না। রোদ্দুরের সাথেও কথা হলো না। এক সপ্তাহ পর হঠাৎ এক বিকেলে রোদ্দুরের মা রিমু বেগম, বাবা ইনামুল সাহেব আর রাহা এসে উঠল মুনাদের বাড়ি! বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মুনা তো ইনামুল সাহেবকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। রাহাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল অবশ্য কাহিনীটা। ওর ভাষ্যমতে, বাবাকে আমি একটু ব্ল্যাকমেইল করেছি। বলেছি বাবা যদি জোর করে বা নিজের ইচ্ছেমতো ভাইয়াকে বিয়ে দিতে চায় তাহলে সেই বিয়েতে আমরা কেউই থাকব না। আর সেই বাড়িতেও না৷ এবং আমিও আমার মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নেব, সেখানে বাবার অনুমতির অপেক্ষা করব না। মোটকথা, বাবার কোনোকিছুই আমরা নেব না, সেটা হোক টাকাপয়সা, নাম বা অন্যান্য ফ্যাসিলিটিস। তাছাড়া বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসে। বাবার কাছে আমি কিছু চেয়েছি আর তা পাইনি সেটা আমার জ্ঞাত হওয়ার পরে কখনো হয়নি। এসবকিছু মিলিয়ে বাবাকে এমনভাবে বোঝালাম যে বাবা মত দিতে বাধ্য হলো আর প্রমিজ করল তোমাকে সরি বলবে, কখনো তোমাকে ছোট করে দেখবে না। পুত্রবধূর মতোই ট্রিট করবে। আসলে কী জানো তো, ভাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকেই বাবা কমপ্লেক্সে ভুগছে। ইনসিকিউরড ফিল করছে আমাদের নিয়ে, ভাবছে আমরাও যদি চলে যাই তাঁকে ছেড়ে তাহলে তো সে একা হয়ে পড়বে! আর সোসাইটিতেও তার সম্মান কমে যাবে। এসব কারণেই মূলত বাবা তোমাদের বিয়েতে মত দিয়েছে। বুঝলে ম্যাম সাহেব? উপস, ভাবি….

বলে খিলখিল করে হেসে ফেলল। সবকিছু যেন মুনার মাথার উপর দিয়ে গেল। রাহার সাথে ছোট্ট করে হাসল শুধু।

নানান জটিলতা শেষে অবশেষে ইনামুল সাহেব বিয়েতে মত দিলেন। দুই পরিবারের মতের ভিত্তিতে এক সপ্তাহ পর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর মুনা রোদ্দুরকে ফোন করল,
— আপনি কোথায়?
— আমি একটু বিজি আছি। তোমার কিছু বলার থাকলে বলো।
মুনা রেগে বলল,
— এসবের কোনো মানে হয়? ভাইয়ার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হলো না, তাহলে কীভাবে কী? মজা হচ্ছে?
— ওটা আমার ব্যাপার, আমি বুঝব!
মুনা অভিমানী গলায় বলল,
— এতই রাগ আমার উপর যখন বিয়ে করছেন কেন? নাকি আমি এতদিন অবহেলা করেছি বলে শোধ নিচ্ছেন?
রোদ্দুর অতিষ্ঠ গলায় বলল,
— তোমার মতো এত জটিল চিন্তাভাবনা আমার নেই। সত্যিটা শুনবে? রিকশা থেকে পড়ে পা মচকে ফেলেছি। ভাঙা পা নিয়ে তোমার বাড়ি গেলে তোমার পরিবার নিশ্চয় আমাকে পছন্দ করতো না। আমি ছেলেমানুষ, রিজেক্ট হওয়ার কলঙ্ক ঘাড়ে চাপাতে চাই না….
মুনা ওর ফাজলামো না ধরে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— আগে বলবেন না? এখন কী অবস্থা পায়ের?
— দু’দিন রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাব। চিন্তার কিছু নেই।
এরপর মুনা কিছুটা অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
— রাহার কাছ থেকে শুনলাম, আংকেল তার ভুল বুঝতে পেরেছে, আপনাকে বাড়ি ফিরতে বলেছে। আপনি যাননি কেন?
রোদ্দুর ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
— তোমাকে নিয়ে ফিরব বলে!

রোদ্দুরের মনে ছিল ভালোবাসা আর মুনার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত প্রত্যাখ্যানের ভাব। কিন্তু এই সমস্ত দ্বন্দ্বকে জয় করে আজ তারা দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন অধ্যায়ের সম্মুখে।

__________

এরপরের সময়টুকু স্বপ্নের মতোই ছিল। মুনা যা কখনো ভাবেনি, কল্পনা করেনি সেগুলোই একে একে পূরণ হতে লাগল। রোদ্দুরের সাথে ওর অবশ্য দেখা হয় দু’জনের বিয়ের পর, বাসরঘরে।
রোদ্দুর তার সব দ্বিধা একটু একটু করে ভুলতে শুরু করেছে। মুনাকে দেখে তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত মায়া, একটা নরম অনুভূতি। প্রথমবার সে অনুভব করছে, মুনতাহা শুধুমাত্র তার জীবনের অংশ, অঙ্গ! কিছু মুহূর্ত কেটে যায় চুপচাপ। মুনা ছিল ভীতু আর লাজুক। তাই এক গভীর নিরবতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতিটা সহজ করে রোদ্দুরই। একসময়ে সে মুখ খুলে বলে,
— মুনতাহা, তুমি কি আমার সাথে এই নতুন পথ
চলতে প্রস্তুত?
মুনা মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ধীরস্বরে বলল,
— প্রস্তত…
উত্তর শুনে রোদ্দুরের মুখে হঠাৎ একটুকরো মৃদু হাসি ফুটল। সে ধীরে ধীরে মুনার হাত ধরতেই মুনা মৃদু কেঁপে উঠে চাইল ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর অপ্রস্তুত গলায় জিজ্ঞেস করল,
— হাসলেন যে?
রোদ্দুর গাঢ় স্বরে বলল,
–ভালোবাসা দেখছি, যেটা আগে দেখিনি।
মুনা নাক ফুলিয়ে বলল,
— ভালোবাসা দেখানোর জিনিস না।
রোদ্দুর গমগমে কন্ঠে বলল,
— হ্যাঁ, সেটা লুকিয়ে রাখার জিনিস। এমনভাবে লুকিয়ে রাখার জিনিস যে তোমার জন্য কেউ মরে গেলেও তুমি তা স্বীকার করবে না।। মিসেস রোদ্দুর, অ্যাম আই রাইট?
মিসেস রোদ্দুর! এমন আদুরে আর হুমকিসরুপ ডাক শুনে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল মুনা। লজ্জা, অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে ওকে। জানে নিজের কথাটা ভুল তবুও স্বীকারোক্তি দিতে ওর মন প্রস্তুত নয়। রোদ্দুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ওর জবাব না পেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,
— তুমি কি জানো? তোমার এই নিরব ভালোবাসা আমার হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধেছে বারবার? এর শাস্তি তুমি পাবে না ভেবেছ? বিয়েটা যখন হয়েই গেছে, একবার যখন বউ হিসেবে আমার হৃদয়ে তোমার নাম উঠেছে, আই স্যোয়ার মুনতাহা, তুমি বাঁচবে না আমার হাত থেকে…
মুনা আচমকা ওর চোখের দিকে চাইল। গভীর দৃষ্টি ফেলে ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করল,
— কেন? মেরে ফেলবেন?
— মারতেও পারি।
— কষ্ট হবে না?
— উহু! কষ্টের কি আছে? বউ করেছি মারব বলেই তো!
রোদ্দুর হাতঘড়ি খুলতে খুলতে একবার চোখ টিপে দিতেই মুনা লাল হয়ে গেল,
— ছি ছি!
রোদ্দুর বিগলিত কন্ঠে বলল,
— নাক সিঁটকানোর কিছু নেই। আসলে মেয়েদের মুখ থেকে ভালোবাসি শুনতে কেমন অন্যরকম অনুভূতি হয়! সেজন্য কয়েকজনের থেকে ট্রাই করার ইচ্ছে জেগেছে। তুমি কিন্তু অমত করো না প্রথম বউ হিসেবে….
মুনা ভ্রুকুটি করে তাকাল৷ এরপর বলল,
— চরিত্রহীন! বিয়েই করাটাই ভুল ছিল আপনাকে। নিয়ন সাহেব এক্ষেত্রে লয়্যাল ছিল! আমিই ভুল করলাম তাহলে….
রোদ্দুর রেগে অন্যদিকে তাকাল। মুনা বুঝল মনে মনে বেজায় রেগে গেছে রোদ্দুর, কিন্তু প্রকাশ করছে না। ওর হাসি পেল। ইচ্ছে করেই নিয়নকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা শুরু করতেই রোদ্দুরের মুখটা দেখার মতো হলো। শেষে আর না পেরে মুনার মুখ চেপে ধরে শক্ত গলায় বলল,
— পরপুরুষের নাম মানাচ্ছে না। তুমি শুধু আমার….
মুনা কটাক্ষ করে বলল,
— আর আপনি বুঝি সবার?
রোদ্দুর হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,
— অবশ্যই না। আমিও শুধু তোমার! ওটা তো মজা করে বলেছি।
মুনা মুখ ভেংচাল,
— বিশ্বাস করি না। একবার যখন মুখ দিয়ে বলেছেন, এটা যে আপনি করবেন না তার কী গ্যারান্টি?
রোদ্দুর অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ মুনার কাছাকাছি বসে বলল,
— একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি। তিন বছরেও তোমার ভাষার তথাকথিত সুন্দরীদের মনে জায়গা দিতে যখন পারিনি, ইনশাআল্লাহ তিনশো বছরেও পারব না।
— তার মানে তিনশো বছর পরে পারবেন?
— কথার প্যাঁচে ফেলে লাভ নেই। কাজে দেবে না। কথা বলাই বৃথা হবে তোমার জন্য!
মুনা ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,
— আপনি নিজেই একে-ওকে চান, আর আমি বললেই বৃথা?
রোদ্দুর একপলক ওর দিকে তাকাল। এরপর চট করে ওর কোমড় ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
— আমার শুধু তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে…
বলেই ঘরের আবছা আলোয় রোদ্দুর যখন মুনাকে চেপে ধরে ওর কম্পিত ঠোঁটে ছোট্ট করে ঠোঁট ছোঁয়াল এক মুহূর্তের জন্য যেন পৃথিবীটা থমকে গেল।
মুনা হঠাৎ এরকম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। রোদ্দুরের হাতের উষ্ণতা ওর হৃদয়ে এক অজানা অনুভূতির সঞ্চার করল। উলটপালট করে দিলো সবকিছু। কোনো কথা নয়, কোনো প্রশ্ন নয়— যেখানে শুধু দুটো হৃদয়ের মিলন, যেখানে অপেক্ষার রঙগুলো মিশে এক নতুন আলোয় সিক্ত হয়ে গেছে।

দু’জনের চোখেমুখে সেই মুহূর্তে তখন একে অপরকে একান্তভাবে কাছে পাওয়ার অনুভূতি, আড়ষ্টতা ভেঙে ভালোবাসার সমুদ্রে বিচরণ করার অনুভূতি! বহু প্রতীক্ষার পর পাওয়া ভালোবাসার অনন্য সুখ অনুভব করার এ অনুভূতিই যেন দুজনকে আরো গভীরভাবে থেকে এক করে দিলো। তাদের দুজনের এই মিলনে রাত নামা বাতাসেও যেন বেজে উঠেছে ভালোবাসার সুর, যেখানে প্রতীক্ষা ও অভিমান, সবকিছু আষ্টেপৃষ্টে এক হয়ে মিলে গেছে এক অভিনব ভালোবাসায়। রোদ্দুরের মনে ছিল ভালোবাসা আর মুনার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত প্রত্যাখ্যানের ভাব। কিন্তু এই সমস্ত দ্বন্দ্বকে জয় করে আজ তারা এক নতুন অধ্যায় সূচনার প্রান্তে!

— সমাপ্ত

_________________