#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩
এ বাড়িতে রাহাকে পড়াতে আসার ব্যাপারটা মুনার জন্য নিতান্তই কাকতালীয় হলেও রোদ্দুরের সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে। সিডনি শেলডনের একটা বই নিতে গিয়ে দু’জনের মধ্যে অসামান্য বাকবিতন্ডা তৈরি হয়েছিল সেদিন। মেজাজ চড়ে গিয়েছিল রোদ্দুরের। চটেছিল মুনাও। তথাপি লাইব্রেরির নিয়ম ভঙ্গ করা ও পড়ুয়াদের মনোযোগ নষ্ট করার দায়ে ওদের দুজনকেই লাইব্রেরি থেকে বের করে দিয়েছিল সেদিন। এরপর
একে-অপরের উপর চোটপাট চালিয়ে দুজনেই নিজেদের রাস্তা মেপেছিল। রোদ্দুর মনে মনে
চেয়েছিল এই মেয়ের সাথে যেন কস্মিনকালেও আর দেখা না হয় ওর! কিন্তু ওর প্রার্থনা কবুল হয়নি।
ঠিক একমাস পর একটা হাসপাতালে ব্লাড ডোনেট করতে গিয়ে মুনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর। সেদিনই জেনেছিল এই শ্যামলা গড়নের ছোটখাটো গড়নের ঝগড়ুটে মেয়েটা নিয়মিত ব্লাড ডোনেটও করে।
তৃতীয় দেখাটা একটু নাটকীয়। এক বৃষ্টিমুখর দিনে বাসে দেখা হয়েছিল দু’জনের। পাশাপাশি সিটে বসলেও কথা হয়নি একটাও। বাসটা প্রায় খালিই
ছিল। মগবাজার মোড়ে নেমে প্রচন্ড বর্ষণে মুনা ওকে নিজের ছাতা দিয়ে নিজে ভিজে ভিজে বাড়ির পথ ধরেছিল! একটা মেয়ের এমন সহৃদয়বান মনোভাব ভীষণ টেনেছিল ওকে। আগ্রহটা মূলত সেদিন থেকেই শুরু। প্রেমে পড়েছিল চতুর্থবারের দেখায়। শাহবাগ মোড়ে। পহেলা ফাল্গুনের দিন। হলুদ-সাদা মিশেলে শাড়ি পরিহিত মুনার খোলা চুলের মায়ায় পড়েছিল
রোদ্দুর। প্রেম নামক গভীর কুয়োয় ডুব দিয়েছিল সেদিনই। এরপর আরো বহুবার নানান জায়গায় দেখা হয়েছিল তাদের। কখনো লাইব্রেরিতে, কখনো যাত্রী ছাউনিতে বা বেইলি রোডের কালচে পিচঢালা পথে।
রোদ্দুর বরাবরই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ছেলে। যা বলে সরাসরি মুখের উপর বলে দেয়। মনে এক বাইরে আরেক এই স্বভাব তার নেই। লুকোচুরি এবং গোপনীয়তায় বিশ্বাসী নয় বলে সরাসরিই প্রেম
নিবেদন করেছিল মুনাকে। তবে বিনিময়ে পেয়েছিল ওর কাজল চোখের রক্তিম সৌন্দর্য আর তুলতুলে হাতের চড়!
চড় খেয়েও তিনটা বছর মুনার পেছনে ব্যয় করেছে রোদ্দুর। এরপরেও মেয়েটার মনে জায়গা নিতে ব্যর্থ সে। ইতোপূর্বে বহুবার মুনার এই বিরুপ প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রতিজ্ঞা করতো এই মেয়ের ধারেকাছেও সে ঘেঁষবে না৷ কিন্তু পরবর্তীতে নিজস্ব অনুভূতির টানে বা মুনার স্নিগ্ধ হাসির প্রেমে পড়ে কথা রক্ষা বারবার ব্যর্থ হতো। কিন্তু এবার নিজের প্রতিই ভীষণ হতাশা কাজ করছে রোদ্দুরের, রাগও হচ্ছে। চুলোয় যাক মুনা। যা খুশি, যাকে খুশি বিয়ে করুক। যে তাকে দু-পয়সারও মূল্য দেয় না তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না বলে
মনে মনে রোদ্দুর কঠিন প্রতিজ্ঞা করল!
.
সকাল দশটা। পরিবেশ শান্ত। আবহাওয়া ঠান্ডা।
মিষ্টি রোদে চিকচিক করছে রোদ্দুরদের বাড়ির সামনের ছোট বাগানটা। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। এখনো গাছের পাতা, ফুল আধভেজা। ফুলের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। লনের সামনের চেয়ার-টেবিলে বসে কফির মগে চুমুক বসাচ্ছে রোদ্দুর। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। চোখমুখ ফুলে আছে। ফর্সা নাকের ডগা লাল হয়ে আছে তার। কিছুটা রাগে, বিরক্তিতে।। রাগটা অবশ্য তার নিজের উপরই। কারণ তার বেহায়া চোখদুটো বারবার চলে যাচ্ছে দোতলায় রাহার ঘরের জানালার পাশে বসে থাকা মুনার উপর। রোদ্দুর অবশ্য মনের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করে ফেলল।
আর কোনোভাবেই দুর্বল হওয়া যাবে না। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে মন দিলো।
রাহাকে পড়ানো শেষ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রোদ্দুরের সামনে পড়ে গেল মুনা৷ আর সাথে সাথেই ওর চেহারার হাসিখুশি ভাবটা মিলিয়ে গেল। ওর চেহারার হাসিখুশি ভাব বদলে যাওয়াটাকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে রোদ্দুর নিজের মতো ওকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। একবারে তাকালও না মুনার দিকে, যেন মুনাকে সে দেখেইনি।
মুনা ভীষণ অবাক হলো। যে ছেলে ওকে সামনে
দেখলে একবার হলেও তাকায়, সে আজ ওকে
এভাবে এড়িয়ে গেল? এ যেন পৃথিবীর অষ্টম
আশ্চর্যের বিষয়। ও চুপচাপ বাড়ির পথ ধরল
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে।
এরপর মুনা হঠাৎ করেই খেয়াল করল যে রোদ্দুর
আর ওকে জ্বালাচ্ছে না। আগের মতো দেখা দিচ্ছে না। আননোন নাম্বারের কলও আসছে না। কয়েক সপ্তাহ তো রোদ্দুরকে সে এক পলকের জন্যও দেখেনি।
রোদ্দুরের এধরণের কাজের সাথে পরিচিত নয় বলেই ব্যাপারটা মুনাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল।
তবে জোর করে নিজেকে বোঝাল, অসভ্য লোকটা এবার সভ্য হয়েছে। ও স্বাভাবিকভাবেই রাহাকে
পড়াতে লাগল। কিন্তু কোথাও একটা দ্বিধা যেন রয়েই গেল।
____
আহিল আর রাইমার কান্ডে তাদের দুই পরিবারই ভীষণ ক্ষেপেছে। বান্ধবীর জন্য ঠিক করা পাত্রকে কী করে রাইমা বিয়ে করতে পারল তা ভেবেই ওর মা-বাবার ধিক্কার ওর প্রতি। পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনরাও ছি ছি করছে। আহিলের ক্ষেত্রেও তাই। সেজন্য দু’জনের পরিবারই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা এ বিয়ে মেনে নেবে না, তাই নিজেদের ব্যবস্থা যাতে নিজেরা করে নেয়। আহিলের বাবা তো পারিবারিক ব্যবসা থেকেও বের করে দিয়েছে ওকে। কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে রাইমাকে নিয়ে সেখানে উঠেছে আহিল। মানিব্যাগে বিশ হাজার টাকা নিয়ে রাইমাকে বিয়ে করেছিল সে। বিয়ের তিন সপ্তাহ পেরিয়েছে মাত্র, এখন সম্পূর্ণরুপে হাত খালি।
এক বন্ধুর থেকে কিছু টাকা ধার চেয়েছে, দেয় কি-না সেটা নিয়েই ভীষণ টেনশনে আছে সে।
আহিল চিন্তাগ্রস্ত। রাইমাকে বিয়ে করাটা তার ভুলই হয়েছে। অন্তত পরিবারে জানিয়ে বিয়ে করলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না। কিন্তু কী করবে? মুনাকেই বাবা-মায়ের ভীষণ মনে ধরেছিল। আর বাবার কথার উপর ‘না’ বলাটা মোটেও সাহসে কুলোয়নি ওর।
রাইমার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ছিল মাত্র বাইশ দিনের। মেয়েটা আগুন সুন্দরী। চলনবলন, কথাবার্তা সবকিছু অন্যরকম। খানিকটা বোকা ধাঁচেরও। আহিলের এরকম মেয়েই পছন্দ। এ ধরণের মেয়েরা মুখে মুখে তর্ক কম করে। মুনার সাথে পার্কে ওকে যখন প্রথম দেখেছিল তখনই রাইমাকে মনে ধরেছিল ওর। এরপর কৌশলে ফোন নাম্বার নিয়ে কল-ম্যাসেজ করতে করতে কিছুদিনের মধ্যে এত কাছাকাছি এসে পড়ল যে আহিল ওকে হাতছাড়া করতে চায়নি। সৌন্দর্যের দিক থেকে মুনা রাইমার থেকে পিছিয়ে থাকলে অন্য সবকিছুর দিক দিয়ে সেরা। এটা স্বীকার করতে আহিলের অবশ্য দ্বিধা নেই। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে এখন যে পস্তান পস্তাচ্ছে তাতে আহিল ভীষণই কনফিউশনে ভুগছে!
রান্নাঘর থেকে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা আহিলের কাছে গেল রাইমা। চিন্তায় ডুবে থাকা আহিলকে ডাকল দু’বার। কিন্তু তাতে সাড়া না পেয়ে কাঁধে ছোট্ট করে ধাক্কা দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল রাইমা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। আহিল প্রচন্ড রেগে ধমকে উঠল ওকে,
— তোমার কোনো কাজ নেই? বিরক্ত করছো কেন? যাও দু-চোখের সামনে থেকে।
প্রচন্ড ধমক খেয়ে চমকে উঠল রাইমা। হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল ওর। গরম চা গিয়ে পড়ল ওর পায়ে। ব্যথাতুর শব্দ করে উঠল ও। আহিল দু-সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে এরপর বিরক্ত ভঙ্গিতে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সেটা দেখে রাইমা বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল। চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে পায়ে পানি ঢালল অনেকটা সময় ধরে। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে ওর। ব্যথার্ত পা নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখল আহিল আগের মতোই শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ করে।
রাইমা গিয়ে বসল ওর শিয়রে। অনেকক্ষণ ইতস্তত
করে এরপর ডাকল আহিলকে,
— শুনছেন? আপনি কী ঘুমিয়ে পড়েছেন?
সাথেসাথেই জবাব এলো না। কয়েকবার ডাকার পর বিরক্তিকর সুর ভেসে এলো,
— ঘুমিয়ে আছি দেখছ না? ডাকছ কেন?
— বার্নল ক্রিম লাগতো।
— টাকা নেই।
বলে আহিল অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ল। রাইমা
এরকম জবাব আশা করেনি। ও আর কোনো কথা বলল না। আকস্মিক এই ঘটনায় ও মনের দিক দিয়ে বিধস্ত হয়ে পড়ল। এই আহিলকে ও কোনোভাবেই
চিনতে পারছে না।
___________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…