প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-০৫

0
4

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

রোদ্দুর অবশ্য ফোন করল না মুনাকে। কী দরকার আবারো ছোট হওয়ার? অহেতুক নিজের যন্ত্রণা বাড়ানোর? সে ফোন করল নিজের বন্ধু মাহির, সজলদের। মুনার থেকে অপমানিত হওয়ার চেয়ে বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলে সময় কাটানো
ভালো।বন্ধুরা অবশ্য ওকে বাইরে বেরুতে বলল।
আজ রাতটা ওরা ক্লাবে কাটাবে। ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করা হবে। বৃষ্টির রাতে এরকম আড্ডাবাজিতে যোগ দেওয়ার চেয়ে কাঁথা-কম্বল
মুড়ি দিয়ে ঘুমানোটা রোদ্দুরের কাছে বেশি প্রিয়
হলেও নিজের বিষাদ মনটাকে ডাইভার্ট করতেই
রোদ্দুর জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হলো ক্লাবের
উদ্দেশ্যে।

রাত সাড়ে দশটা। ড্রইংরুমে আসতেই রোদ্দুর তার বাবাকে দেখতে পেল। ইনামুল সাহেব সোফায় বসে আজকের দৈনিক পত্রিকাটায় চোখ বুলাচ্ছেন। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ উঁচিয়ে তাকালেন তিনি। রোদ্দুরকে রেডি হয়ে বাইরে বেরুতে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— কোথায় যাচ্ছ?
রোদ্দুর ছোট্ট করে বলল,
— একটু বেরুচ্ছি।
— সেটাই তো জানতে চাইছি। কোথায় যাচ্ছ?
— ক্লাবে।
— ক্লাব মানে? নাইট ক্লাবে?
ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে রোদ্দুর উত্তর দিল,
— না। সজল, মিহিরদের ক্লাবে।
ইনামুল সাহেব শুনেই নাক সিঁটকানোর ভঙ্গি করলেন।
ছেলেকে হাস্যরসাত্মক কন্ঠে বললেন,
— ওটাও আবার ক্লাব? হুহ! তো এত রাতে ওখানে কী?
রোদ্দুর সোজাসাপটা কন্ঠে বলল,
— ছোটখাটো পার্টি হবে।
ইনামুল সাহেব এবার পুত্রের দিকে অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে চাইলেন। এরপর তাচ্ছিল্যভরে বললেন,
— পার্টি? ওসবকে আবার পার্টি বলে নাকি?
তাছাড়া তোমার পার্টি মানেই তো ওই ছোটলোক, বস্তিগুলোর সাথে আড্ডাবাজি। এতরাতে ওসব আড্ডাবাজিতে না গিয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমাও। কাজে
দেবে। নয়তো কোনো ভালো নাইট ক্লাবে যাও,
ভালো এনজয় করতে পারবে।
রোদ্দুরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তার বাবা দাম্ভিক, অহংকারী সে খুব ভালো করেই জানে। কথায় কথায় ওর বন্ধুদেরকে বাবা গরিব, ছোটলোকের বাচ্চা বলে।বাবার এই স্বভাবটা রোদ্দুর মোটেও পছন্দ করে না। মানুষ তো মানুষই হয়। ছোটলোক, বড়লোক আবার কী? শ্রেণি দেখে কী বন্ধুত্ব হয়? হলেও সেটা কী লয়্যাল? বছর কয়েক আগে বাইক এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে যখন ও ভর্তি ছিল, যখন ওর রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল তখন তো কোনো বড়লোক বন্ধু ওকে সাহায্য করতে আসেনি। বরংচ তথাকথিত ছোটলোক বন্ধুগুলোই ওর পাশে ছিল প্রথম থেকে
শেষ পর্যন্ত। বাবা কী সেসব ভুলে গেছে? মানুষ কেন এত অদ্ভুত হয়? রোদ্দুর কঠোর গলায় বলল,
— তোমার ওসব নাইট ক্লাবগুলো নোংরামির আখড়া আব্বু। বাবা হয়ে তুমি আমাকে সেখানে যেতে কীভাবে বলতে পারো? শেইম অন ইউ!
ছেলের কথা শুনে ইনামুল সাহেব বেজায় রেগে
হম্বিতম্বি শুরু করলেন। তার ছেলে তার মুখের উপর কথা বলছে কোন দুঃসাহসে? স্বামীর চেঁচামেচি শুনে রিমু বেগম আর রাহা ছুটে এলো। ততক্ষণে অবশ্য রোদ্দুর বেরিয়ে গেছে৷ এমনিতেই মনমেজাজ আজকাল চটে থাকে এক মেয়ের কারণে, তার উপর বাবা হয়ে কেউ যদি এমন অবান্তর কথা বলে তাহলে
কী মেজাজ ঠিক থাকে? না চাইতেও খারাপ ব্যবহার হয়ে যায়। রোদ্দুর রাস্তায় পড়ে থাকা একটা প্লাস্টিকের বোতলে লাথি দিয়ে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে পথেই
বসে পড়ল। পকেটে থাকা হ্যান্ডফোনটা ঠিক তখনি বেজে উঠল। বিরক্তির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গিয়ে কল রিসিভ করতেই মাহিরের গলা শোনা গেল,
— মামা কই তুই?
— পথে বসে আছি।
মাহির লাফিয়ে উঠল যেন,
— ক্যান? কোনো সুন্দরীরে দেইখা আটকায় গেছ নাকি? মুনারে ঠকাইবা নাকি?
রোদ্দুরের মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল,
— পৃথিবীটা স্বার্থপর। মুনতাহা সবচেয়ে বেশি স্বার্থপর। তাই ও ঠকবে। আমার ঠকানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
মাহির কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
— কী কও মামা? বুঝি না।
— তোর এতকিছুর বুঝতে হবে না। ফোন রাখ।
— ওকে। বাট ক্লাবে আসবি না?
— আসছি!
ফোন রেখে রোদ্দুর উঠে দাঁড়াল। প্যান্টে ধুলোময়লা লেগে আছে। ঝাড়তে ঝাড়তে তিরিক্ষি মেজাজে
রোদ্দুর বলে উঠল,
— মুনতাহা তুমি আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছ।

এমনভাবে কথাটা বলল যেন মুনাকে আস্ত চিবিয়ে খেতে পারলে তার মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হতো!
.

হুট করে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার বিষয়টা জানার পর থেকেই মুনার মন বিক্ষিপ্ত। আহিলের সাথেও ঠিক এমনিভাবেই বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে দুই পরিবার বিয়েটা পাকাপাকি করে ফেলেছিল। কোনো ঝুটঝামেলা হয়নি।
মুনা যদিও মন থেকে রাজি ছিল না কিন্তু রোদ্দুরকে দূরে সরাতে এবং বড় ভাইয়ের কথা রাখতে মত দিয়ে দিয়েছিল। আহিলের সাথে মুনার দু-বার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রথমবার বাড়িতে, পরেরবার পার্কে।
সেদিনই রাইমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।
আর তাতেই আহিলের মন এমন পরিবর্তন হয়ে যায়
যে রাইমাকে সে বিয়েই করে ফেলেছে। মানুষের মন কত আজব জিনিস! মুনা দ্বিধায় পড়ে গেছে। কিছুই
ওর ভালো লাগছে না। ভরদুপুরের এই সুন্দর রোদটাও না। এসব বিয়ে শাদী নিয়ে চিন্তা ওর মাথা খারাপ করে দিবে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনি সব কাহিনী দফারফা করে সবকিছুতে ফুল স্টপ বসিয়ে দিতে।
কিন্তু বড় ভাইকে সে সমীহ করে চলে। ভাইয়ের মুখের উপর সে কিছুই বলতে পারে না। তার মানে এই নয় যে, মঈন ওকে কড়া শাসনে রাখে। বরং অনেকটা শ্রদ্ধাবোধ আর কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই মুনার এমন স্বভাব হয়েছে। পিতৃ-মাতৃহীন এই মানুষটা বহু কষ্ট করে ওকে এতদূর পর্যন্ত এনেছে। নিজে না খাইয়ে ওকে খাইয়েছে, বড় করেছে, পড়ালেখা শিখিয়েছে! এরপরেও যদিও মুনা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়, তার কথার অবাধ্য হয় তাহলে সেটা তার ভাইকে অসম্মান করানোর মতোই ঘৃণ্য।
মুনা তাই পারতপক্ষে এবং জ্ঞাতসারে কোনোদিনও ভাইয়ের অবাধ্য হয়নি। এরপরও সাহস করে মুনা ঠিক করে মঈনকে গিয়ে বলবে, এখনি ও বিয়েটিয়ে করতে পারবে না। পাত্রপক্ষকে না করে দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভাবনাটাও আর বাস্তবে রুপ দিতে পারে না, যখন মঈনকে এই বিয়ের ব্যাপরে খুবই উৎসাহী দেখায়!
ভাইয়ের ঘরের সামনে গিয়েও ফিরে আসে এ কারণে
ঘরে ফিরে মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে রাহার ম্যাসেজ। মুনা ম্যাসেজ ওপেন করল। রাহা ওকে আপু বলেই সম্বোধন করে। সেভাবেই লিখেছে।
— আপু পরশু আমার বার্থডে। তুমি কিন্তু বিকেলেই
চলে এসো। আমাকে সাজিয়ে দিবে। তুমিও সাজবে। মানা করলে চলবে না কিন্তু আগেভাগেই বলে রাখলাম। একেবারে বাড়িতে গিয়ে ধরে নিয়ে আসব!

মুনা একটু ফ্যাসাদে পড়ে গেল। রাহা বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে বলেছে মানে যেতেই হবে। মানা করলেও মেয়েটা শুনবে না। রিমু বেগম তো আছেই। বারবার ফোন করতে থাকবে। না গিয়ে কোনো উপায় নেই।
কিন্তু রাহার বাবা ইনামুল সাহেব? তিনি আবার অন্য মাইন্ডে নেবেন না তো? যদি অনুষ্ঠানের অবমাননা
হচ্ছে বলে সিনক্রিয়েট করে? এই লোক ভীষণ অহংকারী মানুষ। মিডেল ক্লাস, লো ক্লাস মানুষদের দু’চোখে দেখতে পারেন না। তাছাড়া বছর কয়েক
আগে রোদ্দুর আর মুনাকে রাস্তায় একসাথে দেখেছিলেন তিনি, সেই থেকে মুনাকেও পছন্দ করেন না তিনি। সুবিধাবাদী মেয়ে করেন। শুধুমাত্র আদরের মেয়ে রাহার আবদারের কারণেই মুনা ওই বাড়িতে
টিকে আছে। টিকে আছে বলতে ভুল হবে, অনেকটা রিমু বেগম আর রাহা জোরটোর করে, আবদার করেই মুনাকে রাজি করিয়েছে পড়াতে৷ রাহাকে যে টাইমে পড়াতে যায় সে টাইমটাতে ইনামুল সাহেব অফিসে থাকে৷ তাই সচরাচর লোকটার মুখোমুখি হয় না মুনা। এসব ভেবে মুনা একটু কনফিউজড হয়ে গেল।
তার উপর রোদ্দুর! অনুষ্ঠানে গেলে নিশ্চয় ওর সামনাসামনি পড়তে হবে? গত কয়েক মাসে যার
সাথে একটা বাক্য বিনিময়ও হয়নি তার সামনে
পড়তে মুনার এই প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।

.

আহিল আজ রাইমাকে সপাটে চড় মেরেছে। খুব তুচ্ছ একটা কারণে। কারণটা হলো তরকারিতে লবণ কম হয়েছে আর ভাতে একটা চুল পাওয়া গেছে তাই।
রাইমার রান্না করা সব খাবার ডাস্টবিনে ফেলে বাইরে থেকে খেয়েদেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে আহিল। জিজ্ঞেস ও করেনি একবার রাইমা খেয়েছে কিনা!
চড় খেয়ে রাইমা ঘন্টাখানিক যাবৎ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ব্যলকনিতে। আহিলের আচরণ ওকে এতটাই হতবাক করেছে যে রাইমা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কঠিন সিদ্ধান্ত!

________

চলবে….

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]