#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
নীল আকাশে সাদাকালো মেঘের ঘনঘটা। অনেক উপরে দলবেঁধে কিছু চিল উড়ছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে, তবে তাপ ছড়াচ্ছে না তেমন। মিষ্টি এক ধরনের রোদ ঝলকানি দিচ্ছে। কুচি করা সেই রোদ বারান্দা ভেদ করে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে মুনার ঘরের মেঝেতে। ধূসর পর্দা ভেদ করে আসছে শীতল বাতাস। হৃদয় জুড়ানো আবহাওয়া। অথচ মুনার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ। ওর হাতে একটা নীল রঙের শাড়ি। একটু আগে নিপা এসে দিয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিল আজ রাহার জন্মদিনে যাবে তাই হয়তো ভাবি এই সুন্দর শাড়িটা ওকে দিয়ে গেছে। কিন্তু না!
নিপাকে জিজ্ঞেস করতেই আসল কারণটা জানতে পারল। পাত্রপক্ষ নাকি আজই ওকে দেখতে আসবে। খবরটা শুনে মুনা নির্বাক হয়ে গেল। নিপা জানাল ওরা আগে থেকে কিছু জানায়নি। গতকাল রাতে মঈনকে জানিয়েছে। মঈনের নিজের শরীরও ভালো নয়। দু’দিন ধরে জ্বর উঠে শরীর দুর্বল। তবুও সে পাত্রপক্ষকে আসতে বলে দিয়েছে! মুনা ঘুমিয়ে পড়ায় নিপা ওকে কিছু জানাতে পারেনি। শুনে মুনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলো। সেজেগুজে পাত্র পক্ষে সামনে বসে থাকতে ওর কোন ইচ্ছাই করছে না। আর না কোন আগ্রহ আছে এই বিয়ে করতে। পাত্রপক্ষের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কেন তোরা আগে থেকে কিছু জানিয়ে আসবি না, আশ্চর্য! ওদের উপর মুনার খুব রাগ হচ্ছে। সেই সাথে হচ্ছে নিজের উপরও। বিয়ে তো কোন ছেলে খেলা নয়। তাহলে ও কেন এই বিষয়টা নিয়ে খামখেয়ালিপনা করছে?কেন এসব বিষয়ে তাল মেলাচ্ছে? কেন না করতে পারছে না? কেন মন থেকে কোন সায় পাচ্ছে না? কাউকে কিছু জানাতে পারছে না বলেও বিষয়টা ওকে মন থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মুনা বিরক্ত বোধ করল নিজের উপর। মনটা আসলে কী চায়? কিছুই তো বুঝতে পারছে না। নিজেকে তো এতদিন মুনা যথেষ্ট ম্যাচিউর মনে করে এসেছে, তাহলে আজ কেন নিজের মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে নিজেকে অতি ঠুনকো মনে হচ্ছে? মুনা হতাশ হয়ে গেল। মনে হলো খুব বাচ্চামো করছে।
দুপুরে রাগ করে ভাতও খেল না। নিপা অনেক জোরাজুরি করল, কিন্তু কাজে দিল না। মুনা শুধু একগ্লাস পানি খেল। পানিটা শেষ করার পরই ফোনে রাহার মেসেজ এল। ও মুনাকে তাড়াতাড়িই চলে যেতে বলেছে। মেয়েটা ওর হাতে সাজতে চায়, ওকে নিয়ে পুরো ডেকোরেশনটা করতে চায়। যেহেতু ওর কোনো কাছের বোন বা ফ্রেন্ড নেই তাই সব আবদারটা রাহা মুনার কাছেই করে। মেয়েটা অবশ্য আরো নানা প্ল্যান করেছে। মুনা গেলেই নাকি সেসব ঠিকঠাক করবে। ম্যাসেজ পড়ে মুনার মন খারাপ হয়ে গেল। না ও নিজের বড় ভাইকে না করতে পারবে না রাহাকে মানা করতে পারবে। এত করে বলার পর ও যদি না যায় তাহলে মেয়েটার খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। মুনা বুঝতে পারল না এখনো কী করবে! ও ফোনটা বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে দিল।
ড্রইংরুমের সোফায় পাত্রপক্ষের সামনে , চুড়ি পরে
বসে আছে মুনা। নিপা অবশ্য আরেকটু ভালোভাবে সাজতে বলেছিল ওকে। কিন্তু মুনা আমলে নেয়নি। যেখানে মনের সায় নেই সেখানে সাজগোজ বিলাসিতা। যাইহোক, পাত্র নিয়ন। সে তার দুইবোন আর দুলাভাইদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। দেখতে ভালোই। কথাবার্তা মার্জিত। এছাড়া বাকিরাও সহজভাবে কথাবার্তা বলছে ওরা মঈনের সাথে।
মুনার সাথেও নম্র ভাবেই কথাবার্তা সেরেছে। নিয়নের দুই বোন মুনার সাথে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারল মেয়েটা বুদ্ধিদীপ্ত, খানিকটা আত্মকেন্দ্রিক। সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করে। ওরা ভাইয়ের জন্য পছন্দ করে ফেলল মুনাকে। কথাবার্তা এগুতে লাগল সেভাবেই। এদিকে ওদের পজেটিভ সাইন বুঝতে পেরে মুনা বিস্মিত হলো।
ও তো কথাবার্তা বলেছে খানিকটা রুঢ় ভাবে। যাতে করে বিয়ের কাহিনী এখানেই থেমে যায়। অথচ? তাদের আচরণ দেখে সব উল্টো মনে হচ্ছে।
_____
রাহা অনেকক্ষণ যাবত মুনাকে ফোনে ট্রাই করছে, কিন্তু পাচ্ছে না। এদিকে অনেকটা সময়ও পেরিয়ে গেছে। রাহা দ্বিধাগ্রস্ত হল। ম্যাম কী আসবে না? রাহার মন খারাপ হলো। মা’কে বিষয়টা বলতেই রিমু বেগম ওকে বললেন মুনার বাড়ি চলে যেতে। গিয়ে সাথে করে নিয়ে আসতে। আগেও কয়েকবার ওদের বাসায় যাওয়া হয়েছে রাহার। নিপার সাথেও পরিচয় আছে ভালোই। মায়ের কথা শুনে রাহা তাই করল। রওয়ানা হলো মুনার বাড়ির উদ্দেশ্য। তবে ওখানে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে মুনাকে বসে থাকতে দেখে রাহা ভীষণ অবাক হলো। নিপা ওকে মুনার ঘরে নিয়ে বসালো। এরপর সবটা জানাল। ম্যামের বিয়ে হয়ে যাবে শুনে রাহার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। চুপচাপ বসে রইল। পাত্রপক্ষ কথাবার্তা শেষ করে চলে গেল আরো ঘন্টাখানিক পর। মুনা নিজের রুমে এসে রাহাকে দেখতে পেয়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুড়ি, দুল খুলতে খুলতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে খানিকটা হেসে বলল,
— অনেকক্ষণ ধরে বসে আছো তাই না?
রাহা মুখ ভার করে বলল,
— তুমি তো বলনি তোমাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে!
— হঠাৎ করেই জানাল আজ আসবে তাই তোমাকে কিছু বলতে পারিনি।
রাহা প্রশ্ন করল,
— তুমি বিয়ে করে ফেলবে এত তাড়াতাড়ি ভাবি নি।
— আমিও ভাবিনি।
— তোমাকে অনেকগুলো কল করেছি ধরোনি কেন?
মুনা কী বলবে বুঝতে পারল না। এসব কি বলা যায়, যে আমি তোমার জন্মদিনে যেতে পারব না বলে
ফোন ধরিনি? তাই কথা এড়াতে বলল,
— দেখেছো! তোমার আজ জন্মদিন, কোথায় তুমি আনন্দ ফুর্তি করবে তা না, এখানে এসে বসে আছো!আন্টি বকা দেবে না?
— তুমি ফোন ধরছিলে না বলে মা-ই তো আমাকে পাঠাল।
— ওহ! কিন্তু আমি তো যেতে পারবো না। দেখলেই
তো বাড়িতে একটা….
রাহা মন খারাপ করে বলল,
— সেটা তো হতে দিচ্ছি না। তুমি এখনই আমার সাথে যাবে।
— না এখন রেডি হয়ে যেতে যেতে অনেকটা লেট হয়ে যাবে।
রাহা পাত্তা দিল না,
— যা পরে আছো তাতেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে! এভাবেই চলো।
— না না, এভাবে কীভাবে!
— ধুর কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া আমি তো ঠিক করেছিলাম তুমি আমি দুজনেই শাড়ি পরব। এখন কথা পাল্টালে তো চলবে না। তাছাড়া আজ আমার জন্মদিন। আমি যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে। ধরে নাও এটাই আমি চাই তোমার থেকে।
রাহার সাথে মুনা কথায় পারল না। মেয়েটা জোর জবরদস্তি আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সঙ্গে নিয়ে চলল মুনাকে। শাড়িটা পর্যন্ত পাল্টাতে দিল না।
রাহাদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। মেহমানের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। রাহা ওকে প্রথমেই নিয়ে গেল রিমু বেগমের কাছে। ডাইনিং টেবিলে তিনি তখন প্লেট বাটি সাজিয়ে রাখছিলেন। রাহা গিয়ে রিমু বেগমকে মুনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার বিষয়টা বলতে লাগল।
রোদ্দুর সোফায় বসে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল। বোনের কথাবার্তা কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকে ঘাড় বাকিয়ে তাকাল সে। খোলা চুলে নীল শাড়ি পরা, অপ্রস্তুত মুখে হাসি টেনে রাখার চেষ্টায় রতো মুনাকে দেখেই ওর শরীর, মন শীতল হয়ে গেল। বুকে কাঁপন ধরল। আপনা আপনি কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ফেলল। কিন্তু রাহার কথাগুলোর মানে বুঝতে পেরে সাথে সাথে অন্যদিকে নজর ঘুরাল৷ রাগে হাত পা নিশপিশ করতে থাকলেও কিচ্ছু বুঝতে দিলো না। উঠে চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে স্পষ্ট কানে এলো রিমু বেগমের আফসোসের সুর, যেটা তিনি মুনার বিয়ের কথা শুনে করছেন! রোদ্দুরের মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো ছোট্ট গালি,
— আমিই অ্যাসহোল! নয়তো অন্যের হবু স্ত্রীর দিকে তাকাই কেন?
এরপরের বাকি সময়টা রোদ্দুর দূরে দূরেই থাকল। মুনারও কেন জানি না সাহস হলো না ওর দিকে তাকানোর।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। ড্রয়িং রুমে সাজসজ্জা ভিড়ে চমকিত হচ্ছে সবকিছু। কেক কাটার পর্ব একটু আগেই মাত্র শেষ হয়েছে। এখন সব মেহমানরা যে যার জায়গায় বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছে। রাহার ক্লাসমেটরা ওকে ঘিরে গল্পগুজব করছে। মুনার রিমু বেগমকে রান্নাঘরে করে একআধটু হেল্প করছে। যদিও রিমু বেগম দিচ্ছে না। তবুও মুনা জোর করেই করছে। শাড়ির আঁচল কোমরে প্যাঁচিয়ে কাজ করছে। দেখতে পুরোদস্তুর গৃহিনীর মত লাগছে। রিমু বেগম কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটাকে তার কাছে এত ভালো লাগে কেন তিনি সেটা জানেন না। মনে হয় নিজের কাছের কেউ। পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাইরে থেকে ইনামুল সাহেবের হাঁকডাক ভেসে আসায় তিনি আবারও নিজের কাজে মন দিলেন।
রোদ্দুর অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। ওর দুই হাতই ভরা। ক্লান্ত সে ভীষণ। তাই মায়ের কাছে এক গ্লাস পানি চাওয়ার জন্য রান্নাঘরে গেল। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়েই ও চমকিত হল। নীল শাড়ি পরা তার স্বপ্নময়ীকে মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে দেখে ওর চোখ কপালে উঠে গেল। কিন্তু পরক্ষণে তাচ্ছিল্য করে হাসল। যে মেয়ে ওর অনুভূতির কোন মূল্য দেয় না, ওর মন বোঝে না, ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে অন্যের জন্য এরকম সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে পারে, তাকে ও কেন নিজের স্বপ্নময়ী ভাবছে? রোদ্দুরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ভস্ম করা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এরপর গলা ঝেড়ে মাকে বলল,
— মা, তুমি কি ব্যস্ত?
গম গমে গলার স্বর শুনে রিমু বেগম আর মুনা একসাথে পিছনে ফিরল। এতক্ষণ ধরে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি পেছনে রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে। রিমু বেগম ছেলেকে দেখে বললেন,
— কেন?
— পানি পেতে পারি?
— দাঁড়া দিচ্ছি।
মুনা তখন বক্স প্যাকেট করছিল। ও এক পলক রোদ্দুরকে দেখে আবারো নিজের কাছে মন দিল। কিন্তু বেশ অপ্রস্তুত বোধ করল। অজান্তেই নিজেকে কেমন লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করল ওর। রিমু বেগম পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিলেন। পানি খেয়ে রোদ্দুর আরেক মুহূর্তও দাড়াল না। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝড়ো বাতাস বইছে। মুনার ব্যাগে ফোন বাজছে। ও ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে মঈনের নাম দেখতে পেল। ভাইয়ের কল দেখে মুনা তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করল। সাথে সাথে মঈনের চিন্তিত গলার সুর শোনা গেল।
— হ্যালো মুনা? কোথায় তুই? কখন আসবি?
মুনা ভাইয়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শুনে বলল,
— আমি রাহাদের বাড়িতে এখনও।
— অনুষ্ঠান কি শেষ হয়নি?
— শেষ পর্যায়ে। আমি চলে আসতে চাচ্ছিলাম আন্টি আন্টি জোর করছে। বলছে একটু পরে যাওয়ার জন্য।
— কিন্তু বাইরে তো বৃষ্টি পড়ছে। বেশ রাতও হয়ে গেছে।
কথাটা সত্যি। বাইরের আবহাওয়া দেখে মুনা নিজেও চিন্তায় পড়ে গেছে। একা এতরাতে কীভাবে যাবে!
তাই ও বলল,
— ঠিক আছে। আমি চলে আসছি আন্টিকে বুঝিয়ে।
মঈন বলল,
— হুম। উনাকে বুঝিয়ে বল আমি তোকে নিতে আসছি।
উনি বুঝবে।
মুনা দ্বিরুক্তি করল,
— না না তুমি কেন আসবে? তোমার শরীরটা তো ভালো নেই! আমি চলে আসতে পারব। চিন্তা করো না।
বোনের কথা শুনে মঈন চটে গেল,
— পাগল তুই? এত রাতে তোকে আমি একা আসতে দিব? রাস্তাঘাট খালি এখন কি তুই গাড়ি ঘোড়া পাবি? আবার কোন বিপদে পড়িস। আমি আসব তোকে নিতে। একদম বেশি কথা বলবি না। সব সময় একা চলতে দিই বলে ভাবিস না তোকে আমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি। ভাই হই তোর, ভুলে যাস না।
মুনা ভাইয়ের ধমক খেয়ে চুপসে গেল। পরক্ষণেই
চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
— কিন্তু তোমার শরীরটাতো…..
মঈনের জোরালো কণ্ঠস্বর,
— উফ! আমার শরীরের কথা বাদ দে। তুই ওদেরকে বল তুই বাড়ি যাবি। আমি এসে তোকে ফোন দেব।
ভাইয়ের সাথে কথায় না পেরে মুনা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
— আচ্ছা তাহলে। ছাতা নিয়ে এসো।
— হুম।
_____
চলবে…