#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮
মুনা হা হয়ে গেল ওর কথা শুনে। বিয়ে না করা
স্বত্তেও এখন ও অন্যকারো বউ হয়ে গেল?
এ লোক উল্টাপাল্টা বকছে কেন? মাথা গেছে নাকি? মুনা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— অন্যের বউ মানে? মজা করছেন?
আমি বিয়ে করিনি।
— তবুও দূরত্ব বজায় রেখে বসা উচিৎ মনে হয়েছে আমার।
রোদ্দুর গম্ভীর কণ্ঠে বলল। মুনা আশ্চর্য হলেও কথা বাড়াল না। রোদ্দুর তো কিছুমাস ধরেই অপরিচিত আচরণ করছে, এ আর নতুন কী!
রিকশাটা দুটো গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় উঠল। এরমধ্যে বৃষ্টি হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেল।
মুনা হাফ ছেড়ে বাঁচল! দোকানপাট অন্যান্য দিন এগারোটা অবধি খোলা থাকে, কিন্তু আজ বৃষ্টির
রাত বলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছে। তবে রাস্তায় গাড়ি, মানুষজন কম নেই। হর্ণের শব্দে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। চারপাশের আলোআঁধারিতে বৃষ্টিভেজা পিচঢালা কালচে রাস্তায় হুট করেই মুনাদের রিকশাটা যানজটের কবলে পড়ল।
মিনিট দু’য়েক সময় আটকে থেকে বিরক্ত হয়ে
উঠছিল রোদ্দুর। মুখে স্পষ্ট করে না বললেও ওর পা নাড়ানো দেখে প্রকাশ পাচ্ছিল দেখে তা। তাই মুনার নিজেরও এবার অস্বস্তি হতে শুরু করল। কিন্তু চুপচাপ বসে রইল৷ একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে অনেকক্ষণ ধরেই হাতে করে ফেরি করছিল বেলী ফুলের মালা। মুনা সেদিকেই দৃষ্টি দিলো।
আচমকাই বাচ্চা ছেলেটা এসে দাঁড়াল ওদের
রিকশার সামনে। এসেই হাঁকডাক ছেড়ে বলল,
— অই ভাই? ফুলের মালা লইবেন নি?
রোদ্দুর স্থির হয়ে বসল।। এরপর বাচ্চাটাকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করল,
— এই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়েছিস কেন?
ঠোঁট উল্টে ছেলেটা বলল,
— কি করুম? রোজগারপাতি করবার পারতেছি না। একটা লইবেইন নি?
— না, প্রয়োজন নেই।।
— তাজা আছে এহনো।
— লাগবে না রে!
ছেলেটা অনুরোধ করতে লাগল,
— একটা লইন ভাই! নয়ত নষ্ট হইয়া যাইব। বাড়ি
গেলে ভাত দিতো না, ক্যালাইব মায়ে!
আহারে, কী জীবন! রোদ্দুর মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল,
— এটা নে।
ছেলেটা খুশি হয়ে বলল,
— মালা?
— লাগবে না!
ছেলেটা এরপর মুনাকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করল,
— ভাবি রাগ করব না?
রোদ্দুর চট করে পাশ ফিরে মুনাকে একবার দেখে নিয়ে এরপর কড়া মেজাজে বলল,
— পাগল! এনাকে কোনদিক থেকে তোর ভাবি মনে হয়?
— না মানে দেইখা তো ভাবি মনে হইল!
রোদ্দুর হো হো করে হেসে বলল,
— মাথাখারাপ না হলে কেউ এই ম্যাডামকে বিয়ে করবে না। করলেও এই ম্যাডামের কপালে দুঃখ আছে!
রোদ্দুরের করা এই ঠাট্টা, তাচ্ছিল্য মুনার গায়ে ফোস্কা ফেলে দিল। তেড়েফুঁড়ে বলে ওঠল,
— নিজে চেয়েও পাননি তাই ব্যর্থতা ঢাকতে আমাকে অভিশাপ দেওয়া হচ্ছে?
ওর কথা শুনে রোদ্দুরের হাসি মিলিয়ে গেল। চেহারায় কাঠিন্যতা এনে বলল,
— আপনার মতো ভুল মেয়ের পিছনে ছুটেছিলাম বলেই তো নিজেকে দামী ভেবে আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। এখন সময়-সুযোগ বুঝে অন্যের গলায় ঝুলতে যাচ্ছেন। শেইম অন মি!
মুনা হতবাক কন্ঠে বলল,
— ইনডিরেক্টলি আমাকে লোভী বলছেন?
রোদ্দুর বিস্মিত গলায় বলল,
— আমি কখন লোভী বললাম? ওকে।
আপনার ছোট্ট মস্তিষ্কে যা বোঝেন তাই!
মুনার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। রাগে-অভিমানে ওর কথা হারিয়ে গেল। রোদ্দুর এতটা? এতটা খারাপ ভাবছে ওকে? অথচ এত খারাপ ও কস্মিনকালেও নয়। এদিকে ওদের দু’জনের কথা কাটাকাটিতে ফুল বেচা ছেলেটি ভয় পেয়ে বহু আগেই চলে গেছে। রিকশাওয়ালা যানজট ছাড়িয়ে যেতেই মুনা কান্না গিলে বলল,
— মামা থামেন। আমি এখানেই নামব।
এরপর রোদ্দুরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আপনি চলে যান। বাকি পথ আমি যেতে পারব। এটুকু সহমর্মিতা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ।
রিকশা থামতেই নিচ্ছিল, কিন্তু রোদ্দুর খটোমটো স্বরে বলল,
— মামা আপনি যেতে থাকুন। আমি বললে তবেই থামবেন।
অতঃপর রিকশা চলতেই থাকল। মুনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— একটা লোভী মেয়ের পাশে বসে যাচ্ছেন,
আপনাকে মানায়? নাকি নিজেকে মহান প্রমাণের চেষ্টা?
রোদ্দুর দুনিয়ার সমস্ত বিরক্তি নিয়ে বলল,
— আপনার কাছে নিজেকে মহান বানানোর প্রচেষ্টা করতে বয়েই গেছে ম্যাডাম! আমি যাচ্ছি কারণ,
পথে কোথাও আপনার রেইপটেইপ হয়ে গেলে আমার মা আমায় জেলে পাঠাবে!
মুনা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল,
— হোয়াট ডু ইউ মিন?
রোদ্দুর তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
— আই মিন টু সে, আমি আমার কর্তব্য পালন করে ফিরে যাব৷ ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার উর্বর মস্তিষ্কটা কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাভাবনা করা থেকে
দূরে রাখুন। আন্ডারস্ট্যান্ড?
নাছোড়বান্দা রোদ্দুর! ওর কথার ধাঁচ দেখে মুনার ইচ্ছে করল ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে ওকে। কিন্তু
সেটা করা সম্ভব নয় বলেই ফুঁসতে লাগল। এরপর আর কথা হলো না দু’জনের। রিকশা মুনাদের বাড়ির সামনে পৌঁছল আরো মিনিট দশেক পর। মুনাকে বাড়ির গেইটে নামিয়ে দিয়ে সে রিকশা নিয়েই ফিরে গেল রোদ্দুর। মুনা ওর ভাবলেশহীনতা নিতে না
পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— এই বদ লোক জীবনেও আমায় ভালোবাসেনি৷ আমি থাউজ্যান্ড পার্সেন্ট শিওর!
.
রাত এগারোটা। রোদ্দুর বাড়ি না গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে চায়ের দোকানে বসে রইল অনেক সময় পর্যন্ত। দু’বার চা নিলো, দুটো সিগারেট ধরাল। এরপর দোকানি চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— করিম চাচা, দোকান বন্ধ করবে না?
— হ করুম বাবা। তোমরা বইয়া আছ যে তাই…
রোদ্দুর বলল,
— চাচী এতরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে? বিরক্ত হয় না?
করিম মিয়া ফোকলা হেসে বললেন,
— হ্যায় বোহাসোহা মাইয়্যা মানুষ।
পতি পরম ভক্ত। আমারে সম্মান করে খুউব। বাড়ি গেলে দেখুম এহনো আমার জন্য না খাইয়্যা বইয়া রইছে।
রোদ্দুর চকিতে তাকাল,
— যান চাচা বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে বউয়ের আদর-ভালোবাসা নিন। আপনার কপাল ভালো।
করিম মিয়া লাজুক হেসে বলল,
— তোমারও ভালা একখান বউ হইব!
— বিয়ে করব না চাচা।
রোদ্দুর তিক্ত কন্ঠে বলতেই ওর বন্ধুরাও হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল৷ করিম মিয়া অবাক হয়ে বলল,
— ক্যান? বিয়া করা তো এই কালের পোলাপানগো লাগি ফরজ।
রোদ্দুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে গম্ভীর
কণ্ঠে বলল,
— দুটো সিগারেট দেন চাচা, বাড়ি গিয়ে ভাবব
আমার জন্য বিয়ে ফরজ কিনা! ফরজ হলে বউ
দেখা শুরু করব।
বন্ধুরা ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে একে-অপরের উপর লুটিয়ে পড়ল!
তবে রোদ্দুর চোখ গরম করে তাকাতেই ওরা চুপ করে ইশারায় কথাবার্তা চালিয়ে নিতে লাগল।
এরপর মুনার সাথে রোদ্দুরের দেখা হলো তিন দিন পর। ওকে দেখেই অচেনাদের মতো করল রোদ্দুর। ফোনে কথা বলছিল কারো সাথে। এবার বিড়বিড় করে ওপাশের ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে মূলত মুনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
— জানিস, কেউ কেউ বড়লোক বিয়ে করবে না বলে সারাদিন বুলি কপচায়, অথচ তারাই সবার আগে বড়লোক ছেলেদের সামনে সেজেগুজে বসে পড়ে। একেই বলে গোল্ডডিগার মেয়েমানুষ!
______
রাত আটটা। বাইরে থেকে ফিরে সদর দরজা খোলা দেখে আহিল অবস্ক হলো। ঘরে ঢুকে রাইমাকে না পেয়ে বিছানার উপর চিঠি দেখে আহিল ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চিঠি খুলে পড়ে আহিল বিস্মিত হলো। রাইমা লিখেছে সে আর আহিলের অবহেলা, অত্যাচার নিতে পারছে না। তার সাথে থাকতে চায় না। যা করেছে ভুল করেছে, অন্যায় করেছে। মুনাকে ঠকিয়েছে বলেই এখন সে এসব অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছে। তাই রাইমাকে সে যেন আর না খুঁজে। চিঠিটা পড়ে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে মাথা চেপে ধরে বসে রইল আহিল। এসব কী হচ্ছে? কেন করছে রাইমা এরকম? নাহয় দুটো চড়, ধমকই দিয়েছে তাতে একেবারে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে চলে যাবে? পরক্ষণেই মনের ভেতর খটকা লাগল! ওর তো কারো সাথে যোগাযোগ নেই। না বাড়ির কারো সাথে, না বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বাড়িতে তো ওর বাপ-চাচারা ওকে জায়গা দেবে না, তাহলে ও গেল কোথায়?
আহিলের অস্থির লাগল। বুঝতে পারল মেয়েটা অভিমান নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে খোঁজ নেবে এবার সে?
_____
চলবে….