প্রেম প্রতীক্ষার রঙ পর্ব-০৯

0
3

#প্রেম_প্রতীক্ষার_রঙ
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

দুপুর বারোটা। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় বেলা করে ঘুমাচ্ছে মুনা। গভীর ঘুমের মধ্যে বিরক্তিকর ফোনের রিংটোন ওকে জাগিয়ে তুলল।
বিরক্তি নিয়ে বালিশের নিচে হাতড়ে ফোনটা বের করে ঘুমভরা চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে আফ্রার কল দেখে খানিকটা অবাকই হলো। বিচলিত হলো মনটা। এতগুলো ফোন করার কারণ কী? চিন্তিত হয়ে কলটা ধরল মুনা দ্রুত। আফ্রা চেঁচিয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ।
— একশো ফোন দেওয়ার পর ধরলি তাইলে!! কী করছিলি?
মুনা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— ঘুমাচ্ছিলাম রে ভাই। কী হয়েছে? তুই ঠিক আছিস? এতগুলো ফোন দিলি কেন?
— রিলাক্স বান্ধবী। আমি অলওয়েজ ওকে আছি।
মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। খারাপ কিছু হয়নি তাহলে।
— ইয়ে শোন মুনা!
— কী? বল।
— তোকে একটা জরুরি খবর দেওয়ার ছিল।
থমথমে কন্ঠে কথাটা বলে উঠল আফ্রা। ওর কথায় খানিকটা ভীতি আর দুশ্চিন্তা মিশে ছিল যা সহজেই বুঝতে পারল মুনা। কিন্তু কীসের জরুরি খবর? বিষয় কী? মুনা পুরোপুরি ধাঁধায় পড়ে গেল। আফ্রার থেকে বিস্তারিত শোনার আশায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল।
— কী বলবি?
— তুই আবার রেগে যাস না, কথাটা রাইমাকে নিয়ে।
মুহূর্তেই মুনার রাগ উঠে গেল। রাইমা? আবার ওর প্রসঙ্গ কেন টানছে আফ্রা? মুনার বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ নেই রাইমার প্রতি, ওর জীবন ও চালচলনের প্রতি, ওর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি। তাই মুনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— আমি রাইমার কোনো কথাই শুনতে চাই না।
বুঝলি? তুই জানিস কেন!
আফ্রা ইতস্তত করল,
–সেসব তো আমি ভালই জানি। কিন্তু তুই আগে আমার কথাটা শোন, একটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে রে।
মুনার ভ্রু কুঁচকে এলো,
— সমস্যা হয়ে গেছে মানে?
— হ্যাঁ, রাইমা হঠাৎ করে গতকাল রাতে আমার মেসে এসে উঠেছে। ব্যাগ পত্র নিয়ে আহিলকে ছেড়ে এসেছে। এমনভাবে আমাকে ধরল যার ফলে আমি ওকে আশ্রয় না দিয়ে পারিনি। ও তোর সাথে একবার কথা বলতে চায়।
হুট করে রাইমার ব্যাপারে এমন কিছু শুনে মুনা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাইমা আহিল কে ছেড়ে এসেছে? তাও মাত্র ক’মাসে? সবাইকে ঠকিয়ে, পালিয়ে গিয়ে যার সাথে বিয়ে করল এত তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে আসতে পারল রাইমা? এত ভালবাসা তাহলে পালালো কোথায়? গুরুতর কিছু কি হয়েছে? মুনার মন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। পরক্ষণে নিজের ভাবনা চিন্তাকে সংযত করার চেষ্টা করল। এসব ব্যাপারে ওর নাক না গলানোই ভালো, কৌতূহল না দেখানোই ভালো। রাইমার মুখ দর্শন পর্যন্ত করতে চায় না ও। এজন্য নয় যে ও আহিলকে বিয়ে করেছে, এজন্য যে রাইমা ওকে বিশ্রি ভাবে ধোঁকা দিয়েছে। মুনা দৃঢ় কন্ঠে আফ্রাকে বলল,
— তাদের জীবন, তারা যেভাবে চায় সেভাবেই চালাক। আমার সেসব জানার আগ্রহ নেই। কিন্তু রাইমা যদি আমার সাথে কথা বলতে চায়, তাহলে ওর সঙ্গে আমার কোনো কথা বলার নেই এটা ওকে জানিয়ে দিস। আমি ফোন রাখছি।
কথাটা বলে কল কেটে দিতেই যাবে তখন ওপাশ থেকে আফ্রা তড়িঘড়ি কন্ঠে বলে উঠল,
— আমার কি মনে হয় জানিস আহিলের সাথে ও সুখী নয়। হয়তো প্রতিনিয়ত ওকে মারধর করে। কাল রাতে যখন আমার এখানে এলো, তখনই দেখলাম গালে থাপ্পড়ের দাগ, ঠোঁটের এক পাশে জখম। চেহারায় কোন লাবণ্যতা নেই, চোখের নিচে কালি। আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি এটা রাইমা। অনেকবার এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছি কিন্তু মেয়েটা কিছু বলতেই চাইছে না। শুধু বলছে তোর সঙ্গে একবার কথা
বলতে চায়।
সবকিছু শুনে মুনা হতভম্ব হয়ে গেল। আহিল এতো খারাপ? যদিও রাইমার নিজের দোষ ছিল কিন্তু আকিল তো নিজে পছন্দ করে, বলা যায় রাইমার সৌন্দর্য দেখে, ওকে ফুঁসলিয়ে বিয়েটা করেছে। তাহলে এ অল্পদিনের মধ্যে সম্পর্কের এমন অবনতি কেন?
প্রেম কি এতটাই ভঙ্গুর যে কয়েকদিনের সংসারেই সব ভেঙে যায়? একটা সময় গিয়ে পড়ে মনে হয় সব কিছু ভুল? মুনা কিছু ভাবতে পারল না। মোট কথা সবদিক বিবেচনা করে রাইমার সাথে কথা বলতে রাজি হলো মুনা। তবে ফোনে নয় সরাসরি। মুনা আফ্রাকে বলল বাইরে কোথাও বসতে। কাছাকাছি একটা পার্ক আছে। ওখানে যেতে। মুনা বিকেলে যাবে বলে ফোন রাখল। মনের ভেতর ভারাক্রান্ত ভাব রলো। জীবনের কী এক টানাপোড়েন, কে জানে ভবিষ্যতে কী ঘটবে!
অথচ এই রাইমার সাথেই দশ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ওর। সবথেকে প্রিয় বান্ধবী ছিল। যাকে মুনা সব কথা বলতো, কিচ্ছু লুকাতো না। এমনকি রোদ্দুর যে ওকে ভালোবাসে, ওকে চায় এই ব্যাপারটা পর্যন্ত আর কাউকে না বললেও রাইমা জানে। তেমনি ছিল রাইমা। মেয়েটা কোনো কথা গোপন করতে পারত না। সব কথা গড়গড় করে বলে দিত মুনাকে। এমনকি বাড়িতে কি রান্না হয়েছে সেটাও। দু’জন ছিল দু’জনের বেস্ট ফ্রেন্ড। ওদের এই মিলমিশ দেখে অনেকেই হিংসা করতো, কিন্তু ওরা পাত্তা
দিতো না। অথচ সেই রাইমাই মুনার বিশ্বাস নিজ হাতে নষ্ট করল। একবার যদি বলতো, আহিলকে ও চায় বা ওরা দু’জন দু’জনকে চায় তাহলে মুনা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতো না সরে আসতে।
কিন্তু নাহ! ওরা প্রতারণার আশ্রয়ই নিয়েছে।
যা মুনা কোনোদিন ভুলতে পারবে না আর না
পারবে মাফ করতে!

.

বিকেলের ম্লান আলো। চারিপাশ নীরব হয়ে আছে। পার্কের সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া, দেবকাঞ্চন ফুলের গাছগুলো নরম বাতাসে দুলছে। পায়ের নিচে থাকা সবুজ ঘাসগুলো মলিন। আশেপাশে খুব বেশি মানুষ নেই।
আফ্রা আর রাইমা বসেছিল পুকুরের পাড়ে।
মুনাকে দেখল ওদের খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসতে।
আফ্রা গলা চড়িয়ে ডাকল ওকে। মুনা পিছন ফিরে ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। রাইমা উদাসী ভঙ্গিতে বসেছিল। মুনাকে দেখে ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞেস করে মাথা নিচু করে ফেলল।
মুনা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল। এরপর প্রশ্ন করল,
— আমার এখানে বসবার মোটেও ইচ্ছে নেই। তবুও এসেছি। সময় নষ্ট না করলেই খুশি হব!
মুনার কাটকাট কথা শক্তপোক্ত শুনাল ভীষণ। রাইমা এতদিনের নিভিয়ে রাখা কষ্টের চাপ আর সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মুনাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
— যে আহিলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সবাইকে কষ্ট দিয়েছিলাম সেই আহিল এখন আর নেই। পাল্টে গেছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ, আমি তাকে আর চিনতেই পারি না। তোর সঙ্গে অন্যায় করেছি বলেই আমার সাথে এমন হয়েছে। আমার পাপের কারণেই শাস্তি পাচ্ছি।
মুনা প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বলল,
— এদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। কোনো এক পুণ্যের বিনিময়ে ওই প্রতারকের হাত থেকে বেঁচে গেছি আমি। তাই না, বল?
রাইমা ভেজা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ঠিক। ভালো বলেই তোকে ওর সাথে জড়াতে হয়নি। আমার মন্দ কপাল, তাই….
— স্বভাবের দোষ কপালকে দিস না।
রাইমা ফুঁপিয়ে উঠল,
— আমি বুঝতে পারিনি রে। তিনি এমনভাবে আমার চোখের সামনে পর্দা টেনে দিয়েছিল আমি তাকে ছাড়া কিছু বুঝতেই পারিনি। যেভাবে রেখেছিল, সেভাবেই ছিলাম। কোনোদিন কিছু চাইনি, মুখফুটে বলিনি। এরপরেও অমানবিক ব্যবহার আর মারধর! এরপরেও কিছু বলিনি, কিন্তু সেদিন বাবা তুলে গালি দিয়ে ফেলল, আর সহ্য হয়নি রে….
রাইমা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। মুনা বুঝতে পারল না কী বলবে৷ তাই কঠোর কণ্ঠে বলল,
— আমাকে না বলিস অন্তত আফ্রাকে বলতে পারতি। পরিবারে জানাতে পারতি…
— বিশ্বাস কর, বলতে চেয়েছিলাম। তোকেই বলব বলে ঠিক করেছিলাম। আহিল দেয়নি, এটা-সেটা বুঝিয়েছে। আর আমিও তার প্রতি অন্ধ ছিলাম।
মুনা শ্লেষাত্মক হাসল,
— যখন সত্যিটা বুঝে গেছিস, তখন পরবর্তী সিদ্ধান্ত তুই-ই নিবি। আগেও যখন আমাদের প্রয়োজন পড়েনি, আশা করি এখনো পড়বে না।
রাইমা কঠিন গলায় বলল,
— আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি। ওনাকে ডিভোর্স দেব!
মুনা চমকালেও বুঝতে দিল না,
— ঝোঁকের বশে সিদ্ধান্ত নেবার আগে পরিবারকে জানা। যদিও রেগে আছে তোর উপর, তবুও বলব হাতেপায়ে ধরে হলেও ওদের সাথে নিয়েই যা করার করবি!
রাইমা যেন বুঝল। চোখ মুছে ধাতস্থ হয়ে বসল।
— সেসব ছাড়! আমাকে মাফ করবি তো?
মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— বলতে পারছি না। তবুও যে এখানে কেন এসেছি, তা জানি না।
রাইমা আর এ বিষয়ে কথা বাড়াল না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। সবাই চুপচাপ। বিকেল মরে গেছে তখন। পুকুরের শান্ত পানিতে চোখ রেখে রাইমা শান্ত গলায় মুনার হাত ধরে বলতে লাগল,
— আহিলকে পছন্দ ছিল না তোর, সেটা আমার
থেকে ভালো কে জানে? সেজন্যই বোধহয় তাকে নিয়ে এতদূর যাবার সাহস হয়ে গেছিল। আচ্ছা, রোদ্দুর ভাই তো তোকে ভালোবেসেছে, তোকে চেয়েছে। আর তুই ভালোবাসিস। তাঁকে ছেড়ে অন্য কাউকে মানতে সায় দিতো তোর মন?
মুনা চমকে উঠে ওর মুখ চেপে ধরল,
— চুপ, একদম চুপ।
পাশেই আফ্রা বসে ফোন স্ক্রল করছিল। আচমকা এ কথাটা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল ওর দিকে। অনেকক্ষণ পর ভাষা খুঁজে পেয়ে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল,
— কী বললি? মুনা রোদ্দুর ভাইকে ভালোবাসে? কই! আমাকে তো কখনো বলে নাই। তলে তলে এতদূর?
মুনা রাগী চোখে তাকাল ওর দিকে। আফ্রার সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। রাইমা বলল,
— আসলে মুনা রানি বহু আগেই প্রেমে পড়েছে। আরে কোনো ছেলে যদি বছরের পর বছর কোনো মেয়ে পিছনে লেগে থাকে, তাহলে তার প্রেমে না পড়া সম্ভব? আমি তো বিশ-বাইশ দিনেই আহিলের…
শেষের কথাটায় ধরে এলো রাইমার গলা। চোখ
থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।
— তুই থামবি? বেশি বাজে কথা বলছিস।
মুনা জোরেসোরে ওকে ধমক দিল। কিন্তু আফ্রা বলল,
— জেনেই যখন গেছি বাকিটা জানতে ক্ষতি কী? তুই রাইমাকেই সব বলিস, আর আমাকে কিছুই জানাস না। ফালতু….
আফ্রা মুখ ঘুরিয়ে বসল। মন খারাপ করে ফেলল। মুনা ওর অভিমান বুঝে হতাশ চোখে ওর দিকে তাকাল। ম্লান কন্ঠে বলল,
— যেটার কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেটা কী মুখে বলতাম সবাইকে? বিয়ে, সম্পর্ক শুধু দুটো মানুষের নয়, পরিবারেরও বন্ধন। রোদ্দুরদের পরিবার অনেক
উচ্চ পর্যায়ের মানুষ, সেখানে আমরা কিছুই না। সম্পর্ক হয় সমানে সমানে। উঁচু-নিচুর ভেদাভেদে নয়।
আর ভালোবাসলেই সবাইকে পেতে হবে এমন
কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বুঝলি?
আফ্রা ভ্রু কুঁচকে বলল,
— মানলাম। কিন্তু সেই তো একই হলো। বড়লোক
বলে সমস্যা। কিন্তু তোর এখন যেখানে সম্বন্ধের কথা চলছে তারাও তো বড়লোক। হিপোক্রেসি হয়ে গেল না ব্যাপারটা? তাছাড়া রোদ্দুর ভাই বিত্তশালী মনোভাবের নয়। উনি ঠিক থাকলে তোর এত চিন্তা কীসের?
মুনা হাসল। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— তাঁর বাবা!

_________

চলবে….