#প্রেয়সী 🤎🥀(২৬)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৫০.
অস্থির মনটাকে শান্ত করেই বাবার আদরের ডাকে সাড়া দিলাম।
—-” কেমন আছো তুমি বাবা?”
—-” নিধি কি কাঁদছে?”
—-” না, নিধি কিন্তু কাঁদেনা! বাবা কি তা জানেনা?”
বাবা ছোট্ট করে হাসলো। বাবার হাসির শব্দে মন জুড়ালো আমার। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বলে উঠলাম আমি,
—-” নিধিকে ছেড়ে ওখানে আর কতদিন থাকার মতলব করছো বলবে একটু? তুমি তো দেখছি দিন দিন ভীষণ সেলফিশ হয়ে উঠছো খান সাহেব? তোমার নামে আজই আদালতে মা-ম-লা ঠু-ক-তে যাবো দেখে নিও।”
বাবা আবারও হেসে উঠলো খানিক। আদুরে কন্ঠে বলল,
—-” ডক্টরই যে আমাকে ছাড়ছে না মা। তবে আমিও এই হসপিটালের পাট চুকিয়ে দিয়েছি আজ। ডক্টরকে এক ধমক দিয়ে বলেছি, অনেক হয়েছে আপনার ডাক্তারি পেশার পাঠশালা। এবার আমাকে যেতে দিন দেখি মশাই। আর কতদিন থাকব এখানে? ওখানে যে আমার প্রাণ ভোমরাটা বাবাকে ছাড়া ভীষণ একলা পড়ে গেছে।”
চোখ থেকে গড়িয়ে দু’ফোটা জল পড়লো বুঝি। খেয়াল করলাম না। বাবার বাচ্চামো টাইপ কথা শুনে এবার আমিও বকে উঠলাম,
—-” শুনো খান সাহেব? নিধি তোমায় একটু মিস করে ঠিকই তবে তাই বলে ডক্টরের উপর থেকে তোমার রায় দেওয়া মোটেই বরদাস্ত করবে না বুঝলে? ডক্টর যা বলবেন একদম বিনাবাক্যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
—-” নিধি কি বাবাকে একটুই মিস করে নাকি তার থেকেও সামান্য বেশি?”
—-” নিধি বাবাকে একটু নয় অনেক বেশিই মিস করে। আর নিধির এই বাবাকে ছাড়া ক-ষ্টে-র সময়টা ঠিক করে দিতে হলেও তো বাবাকে আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে তাই না? ও বাবা? সত্যি করে একটা কথা বলবে তুমি?”
—-” হ্যাঁ মা। বলনা কি কথা?”
—-” তুমি মাকে আজও ভীষণ মিস করো তাই না?”
—-” তোর মাকে? আরে ধুর কি যে বলিস না তুই? ওকে তো আমি সেই কবেইইই ভুলে গ..গেছি! আমি এখন আর ওকে একটুও মনে করিনা। এখন আমার নিধি মা আছে না? আমার নিধির মতো একটা মেয়ে থাকতে আর কারোর কথা ভ..ভাবতে হয় নাকি? সেই সময়ই পাই না আমি!”
বাবার কন্ঠটা কিঞ্চিৎ কাঁপল বুঝি। কথা গুলো বেশ বাঁধছিলো গলার কাছে। আমার ভেতরটা মোচড় দিলো। প্রশ্নটা করে কি বাবার ক-ষ্ট-টা আরও দু’গুন করে দিলাম? মায়ের কথা ভেবে বাবার ক-ষ্ট পাওয়াটাই কি খুব স্বাভাবিক নয়?
—-” কি রে মা? তুই আবার চুপ হয়ে গেলি কেন?”
—-” বাবা, মানুষ একবার হারিয়ে গেলে আর কখনও ফিরে আসেনা তাই না?”
—-” কেন এসব কথা তুলে নিজের ক-ষ্ট-টা বাড়াচ্ছিস মা? তোর মা আর এই দুনিয়াতে নেই রে। বহুবছর আগে নিজের অস্তিত্ব গুটিয়ে হারিয়ে গিয়েছে সে। আর কখনও ফিরেনি। ফিরবেও না। তাই বলে কি আমরা বোকার মতো তার ফেরার আসায় প্রহর গুনবো?”
—-” সরি বাবা! আমি না বুঝেই বোকার মতো তোমায় এমন একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি! আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা!”
ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
—-” আমার পা-গ-লি মেয়েটা। এই শোন, নিধি নাকি কাঁদেনা? এই মাত্র কে যেন খুব বড় মুখ করে আমাকে বলল, নিধি যে কাঁদেনা তা কি তার বাবা জানেনা? কি রে মা? কাঁদছিস তুই?”
আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম। কান্নার বেগটা নিয়ন্ত্রণ করা যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবুও চেষ্টা চালালাম। অবশেষে সামান্য হলেও সফল হলাম। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
—-” নিধি বাবাকে ভীষণ মিস করছে খান সাহেব। জলদি ফিরে এসো তার কাছে।”
—-” আসবো মা। আজই ডিসচার্জ হলো। পারলে আজই চলে আসতাম। কিন্তু রাহিয়ানের বাবা বললেন যে আজই যাওয়া যাবেনা। যেহেতু আজই ছাড়ল হসপিটাল থেকে। তো একদিন বেড রেস্ট না করে হঠাৎ জার্নি করা ঠিক হবে না তাই আজ থেকে গেলাম। কাল ঠিক আমি আমার মা-টার সামনে থাকব দেখে নিস। আর কখনো তোকে একলা করে বাবা কোথাও যাবে না মা। বাবাও যে তার নিধিকে ছাড়া খুব একলা পড়ে গেছে।”
—-” বাবা? কাল তুমি কি খাবে বলো? নিধি তোমার সব পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে। কতদিন পর তুমি আসছো বলোতো? কি খাবে জলদি জলদি বলো? তোমার ফেভারিট খিচুড়ি, বিরিয়ানি, চিকেন পাস্তা, আলুপরোটা, আলুপোস্তা, মুগের ডাল, হাসের মাংস, ঝাল মাংস, পোলাও? কি খাবে বাবা? তোমার যা যা ভালো লাগে সব বলো? কাল শুধু একদিনের জন্য তোমার সকল স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সব কিছু খাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিলাম।”
বাবা বাচ্চাসুলভ কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” সত্যি বলছিস মা? কাল আমি সব খেতে পারবো তো?”
—-” একদম পারবে। বলো তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি সব রাঁধব।”
বাবা আমোদিত গলায় বলে উঠলো,
—-” তোর যা যা রাঁধতে সুবিধা হবে তুই সেগুলোই রাঁধিস কেমন?”
—-” আমার কোনো কিছুই রাঁধতে অসুবিধা হবে না বাবা। তুমি শুধু নাম গুলো বলো?”
বাবা মিনমিনে সুরে বলল,
—-” তাহলে সবই রাঁধিস।”
আমি হেসে ফেললাম। আদুর কন্ঠে বললাম,
—-” আচ্ছা ঠিকাছে বাবা। কাল আমি তোমার পছন্দের সব খাবারই রাঁধব। খুশি?”
বাবা সন্দিহান সুরে বলল,
—-” হ্যাঁ রে মা? তুই কি আসলেই এতো ভালো হয়ে গেছিস?”
আমি তীক্ষ্ণস্বরে বললাম,
—-” কেন? আমি খারাপ ছিলাম নাকি কখনো?”
—-” না না! আসলে আগে তো খুব কড়াকড়ি করতিস আমার সাথে! এই যেমন, বাবা তুমি এটা খাবে না, বাবা তুমি ওটা খাবে না। এটাতে এলার্জি আছে,ওটাতে ফ্যাট আছে। আজ হঠাৎ সব রাঁধবি বলছিস তো তাই একটু সন্দেহ হচ্ছে!”
—-” এতো এতো বারন করেও কখনো তোমাকে একটা কথাও শোনাতে পেরেছি বলো তো? তুমি তো তোমার ইচ্ছে মতোই খেয়ে এসেছো!”
বাবা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। বাবা আমার আজও ছেলেমানুষী ছাড়তে পারলো না।
৫১.
সূর্য মামা সময়ের স্রোতে ডুবে গিয়েছে অনেক্ষন। প্রকৃতির বুক চিঁড়ে আঁধার নামলেও মেঘেদের যে মন খারাপ তা ঠিকই ধরা যাচ্ছে। সূর্যাস্ত হওয়ার পর প্রকৃতির হলদেটে রূপ ছাপিয়ে অন্ধকারে ঢেকে উঠছে সময়ের আগেই। আজ বৃষ্টি হবে। এবছরের প্রথম বৃষ্টি। মনটা আনন্দে নাচ পেড়ে উঠলো। বছরের প্রথম বৃষ্টি আর আমি ভিজব না সে যেন অসম্ভব! আগেই বলেছিলাম আমার ঠান্ডার ব্যামো আছে। কিন্তু বাবার মতো আজ আমারও একটু অনিয়ম করতে ইচ্ছে করছে!
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনন্য রূপে বিমোহিত হয়েই রুমে চলে এলাম। সামনেই নবীন বরন। নাচের প্রোগ্রামে টিম লিডার আমি। যেহেতু বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ আসছে সেহেতু অনন্যা আপুর সিলেক্ট করে দেওয়া গানটা কয়েকবার শুনে নেওয়া যাক। কয়েক লাইন মুখস্থ হলেও হবে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই প্রাকটিস করব। উফফ ভাবতেই কি যে আনন্দ হচ্ছে। গানটা ছেড়ে বাবার দেওয়া নুপুরটা পায়ে জড়লাম। নুপুরটা বেশ আগের হলেও এই যুগে এসেও এমন সুন্দর কাজ পাওয়া মুশকিল। এক কথায় অসাধারণ। নুপুরটা মায়ের। বাবাই মা কে উপহার দিয়েছিলো। আজ মা নেই তাই মায়ের সব জিনিস আমার।
খাটের উপর বসেই পা দুটো নাচাতে লাগলাম। সাথে সাথে নুপুরের ঝনঝন শব্দে মুখরিত হচ্ছে চারিপাশ। খাট থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে গানের তালে তালে নাচ ধরলাম। নাহ্, কোনো স্টেপই ভুলিনি। সবই ঠোঁটের আগায় মুখস্থ।
বাইরে দমকা হাওয়ার ছুটেছে। বাতাসের তোড়ে রুমের সব পর্দাগুলো উড়ছে। দৌড়ে গেলাম ব্যলকতি। ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। মনটা আর আটকালো না রুমে। ফোনের গান টা কোনো রকমের বন্ধ করেই এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির হলাম। দুনিয়া অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালাম। ঘুরে ঘুরে ভিজতে লাগলাম। কত না আনন্দ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হাতে গোনা ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়ই বৃষ্টির সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসে শরীরে কাঁপুনি উঠে গেলো। তবুও ভিজছি, ভিজতে ভিজতে বৃষ্টির গন্ধে মাতাল হয়ে তাও ভিজছি।
—-” হেই ইডিয়ট! এই সন্ধ্যা বেলায় বৃষ্টিতে কেন ভিজছো?”
কারোর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে! স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। চোখ দুটো আশেপাশে ঘোরাতেই নজরে এলো রাহিয়ানকে। মনের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। উনি এখানে কি করছেন?
—-” কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? ভেতরে এসো! কাম ফাস্ট?”
রীতিমতো ধমকে উঠলেন। বুঝিনা বাপু, এই লোকের আমার সব কিছুতেই এতো সমস্যা কেন?
ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে চিলেকোঠার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বোধকরি উনি ছাঁদেই ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি আসায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
—-” বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? জ্বর, ঠান্ডা না বাঁধালেই কি চলছিলো না?”
আমি ঠোঁট উল্টে তাকালাম। এটা তো বছরের প্রথম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে তো মানুষ সখেও ভিজে।
—-” বৃষ্টিতে ভেজা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।”
উনি বুঝি হোঁচট খেলেন আমার আজগুবি কথায়। ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। কি বলবেন বুঝতে না পেরে বোকা গলায় প্রশ্ন করলেন,
—-” হোয়াট।”
—-” জ্বী৷ কেন আপনি জানেন না?”
আমার বুকভরা আত্নবিশ্বাস দেখে উনি চটে গেলেন। একে তো আজগুবি কথা তার উপর উল্টে পাল্টে উনাকে কনফিউজড করা! উনি ক্ষে-পে গিয়ে আমার হাত টেনে ধরলেন। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো কারেন্ট বয়ে গেলো শরীরে। আমি সম্পূর্ণ বরফ আর উনি সম্পূর্ন আগুন। ঠান্ডা শরীরে আরও যেন ঠান্ডা জমে গেলো। উনি আর কোনো কথা না বলেই আমার হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চিলেকোঠার এই ঘরটাতে আমার প্রথম পদচারণ। এর আগে একবারও আসা হয়নি এ-ঘরে। এখানে মুলত এই মানুষটারই আসা যাওয়া বেশি চলে তাই বাকিরা তেমন আসেন না। চিলেকোঠায় দুটো ছোট ছোট রুম। দুটোতেই উনার প্রয়োজনীয় অপ্রোয়জনীয় জিনিসপত্রে ভরপুর হয়ে আছে। উনি আমাকে একটা রুমের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
—-” এই ভিজে কাপড়ে তো নীচে যাওয়া সম্ভব নয়। তুমি ভেতর থেকে যেকোনো একটা ড্রেস নিয়ে ঝটপট চেঞ্জ করে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে এন্ড দ্যেন জ্বর আসতে সময় লাগবে না।”
আমি বোবা চোখে তাকিয়ে আছি। কত শখ করে এসেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু লোকটা তাতেও বাগড়া দিয়ে দিলেন। উনার সমস্যাই সমস্যা। আমি আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলাম। আমার সামনে বড় বড় দুটো আলমারি। একটা আলমারি খুলতেই দেখি এখানে সব শাড়ির দুনিয়া। ভরপুর শাড়ি। অন্যটাতেও একই অবস্থা! শাড়ি ব্যাতিত একটা সুতোও নেই! বাহ্!
দুঃখে হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। হামলে পড়লাম আলমারির উপর এই আশায় যদি শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো ড্রেস কপালে জুটে। কিন্তু জুটলো না। হাতড়ে হাতড়ে যা পেলাম সবই শাড়ি। সব রেখে একখানা কালো শাড়ির উপর চোখ পড়ল। শাড়ি পড়তে পারিনা জেনেও এই শাড়িটা পড়ার জন্য মনটাও বিচলিত হলো। শাড়িটা পড়ার জন্য রুমটাই ব্যবহার করলাম। রুমের দরজা লক করে শাড়ি পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। বউমনির টেকনিক গুলো মনে করে করে শাড়ি পড়ায় উত্তির্নও হলাম একসময়। কিন্তু এই শাড়ি এভাবেই ঠিক কতক্ষন টিকবে সঠিক আন্দাজ করা গেলো না। চারপাশে পানি পিপাসুদের মতো আয়না খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পো-ড়া কপাল, ঘরের এক কোনেও একটা আয়না নেই। তাই নিজেকে ঠিকঠাক না দেখেই বাইরে বের হতে হলো।
দুটো রুম ছাড়িয়ে সামনের রুমটাতে পা রাখতেই রাহিয়ান ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। মনের মধ্যে খুশির ঝিলিক মারলো। উনাকেই আয়না হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মনে সাহস জুগিয়ে উনাকে ডাকতে পারলাম না। তাই আস্তে করে গলা খাঁকারি দিলাম। যেন উনি বুঝতে পারেন আমি এসেছি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আস্তে করে গলা খাঁকারি দিতেই ফোনের থেকে ধ্যান সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন উনি। কি হলো বুঝলাম না কিন্তু উনি আমাকে দেখতেই দাঁড়িয়ে গেলেন। গভীর চোখে আমার পা থেকে মাথা অব্দি তাকাতেই আমি নড়েচড়ে উঠলাম। উনি এভাবে কেন দেখছেন? শাড়িটা কি ঠিকমতো পড়া হলো না?
আমার ভাবনার মাঝেই উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,
—-” মেয়েদের ভেজা চুল নিয়ে কোনো ছেলের সামনে আসা বারন! একথা জানা নেই তোমার?”
আমি করুন চোখে তাকালাম তার দিকে। আমার চুল থেকে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। চুল মোছার জন্য তো তেমন বিশেষ কিছুই পায়নি! তবে কি করে মুছতাম?
—-” কোনো তোয়ালে তো পাইনি! তাই….”
—-” তোমায় দেখে আমার বুকের ভেতরটায় একটা অসহ্যনীয় ব্যা-থা হচ্ছে নীলাদ্রিতা। এর জন্য কি শা-স্তি দেওয়া যায় তোমায়?”
‘নীলাদ্রিতা’ নামটা শুনতেই ধাক্কা খেলাম বুঝি। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠতেই উনি আবারও বলে উঠলেন,
—-” তোমার ভেজা চুল গুলো মুছিয়ে দেওয়ার এই ছোট্ট অনুমতিটা কি পাওয়া যাবে প্লিজ?”
আমি যেন না বলতে চাচ্ছি। কিন্তু পারছিনা! আমি আমার অদ্ভুত অনুভূতিগুলোর কাছে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে চাচ্ছি কিন্তু তাও যে পারছিনা। উনি ধরে নিলেন মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। উনার হাতের পাশেই সাদা তোয়ালেটা উনি হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন। উনার কাছে আসাতে আমার শরীর অবস হয়ে আসতে চাচ্ছে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সুযোগ পেলেই দৌড়ে পালাবো এখান থেকে। মনে মনে এমন আউলাঝাউলা বুদ্ধি করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন আমায়। আমি না চাইতেও চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম। উনি তোয়ালে পেঁচালেন আমার চুলে। কোমল ভাবে আমার চুল মুছতে লাগলেন। আমি চোখ বুঁজেও ঠিক অনুভব করতে পারছি উনার গভীর চোখ জোড়া আমাকেই দেখছে।
আচমকাই ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠলেন তিনি,
—-” সে রাতে একটা কবিতার জন্ম হয়েছিলো,
খোলা বারান্দায় হাসনাহেনার সুবাস এসেছিলো~~
চাঁদ-মেঘের লুকোচুরি আর ঝুম বরষার বৃষ্টিপাতে,
আমার মনের কাগজ-কলম, কাব্যে ভরেছিলো~~
সে রাতে মৃদু বাতাস ছিলো,
এক টুকরো অলস আকাশ, একাই কেঁদেছিলো~~
ঘোর লাগানো মাতাল হাওয়া, হৃদয় ছুঁয়েছিলো,
চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষে,ভীষণ ভেবেছিলো!
সে রাতে মেঘের আঁধার ছিলো,
অল্প আলোর ক্যানভাসে, এক রঙিন ছবি ছিলো,
ইচ্ছে মতো রঙ লাগিয়ে, কল্পনাতে মন ডুবিয়ে,
মেঘলা আকাশ,জোৎস্ন্যা নিয়ে,
ঝুম বৃষ্টির সুর মিশিয়ে,
হৃদয় যেন কেমন করে,
তোমায় এঁকেছিলো🥀
উনার কবিতার লাইন গুলো এক ধাক্কায় অপরিচিতর কল দেওয়ার প্রথম দিন থেকে সবটাই যেন মনে করিয়ে দিলো। তার মানে উনিই সেই অপরিচিত! অসম্ভব এক ভালোলাগায় শরীর কাঁপতে লাগলো আমার। অদ্ভুত এক শিহরণে মনখানা মত্ত হতেই চোখ খুলে উনার চোখের দিকে তাকালাম। মোহাচ্ছন্নতায় ছেপে আছে উনার চোখ আর ঠোঁট। আমি বেশ বুঝতে পারছি উনার এই অনুভূতিতে একই ভাবে আসক্ত বোকা আমিও। আমি চোখ ঝাপটে উনাকে কিছু বলতে নিলেই উনি আমার দু’গালে হাত চেপে মুখটা আরেকটু উঁচিয়ে ধরে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালেন আমার ঠোঁটে। এ যেন এক
ভ/য়ং/ক/র অনুভূতি। আমার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে উঠলো অদ্ভুত যা/ত/না/য়। শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে শিহরনে লুটেপুটে যাচ্ছে। আমার চেতন ফিরতেই নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। কিন্তু আমার চেষ্টাকে বৃথা করে দিলেন উনার হাতজোড়া। উনার শক্তির কাছে পেরে ওঠা আমার সাধ্যে নেই প্রমান দিয়েই আমার কোমর চেপে মিশিয়ে নিলেন নিজের সাথে।
#চলবে____________________
#প্রেয়সী 🤎🥀(২৭)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৫২.
অডিটোরিয়ামে ফাটিয়ে প্রাকটিস চলছে। আমার সাথে আমার পেছন দাঁড়িয়ে ছয়জনে নাচ তুলছে। আমি সবার তাল ধরে দিচ্ছি। অনন্যা আপু আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সব কিছুর তদারকি করছে। সাথে রাইও আছে। ঐদিকে কাজ করার বাহানায় রাহিয়ান ভাইয়াও আছেন। তবে কাছাকাছি নয়, একটু দূর থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছেন আমায়। উনি ভেবেছিলেন এখানে থেকে উনি আমার মনোযোগ ন-ষ্ট করবেন। কিন্তু উল্টে আমিই যে উনার মনোযোগে বারবার ব্যা-ঘা-ত ঘটাবো তা হয়তো উনি কল্পনাতেও আনেননি।
নাচ তোলার মাঝেই আমার চোখ গেলো দরজার কাছে। কেউ আমায় ওখান থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখছেন। ভেতর থেকে তার চেহারা ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমি নাচ থামিয়েই উঁকি মা-র-লা-ম। কেশব দাঁড়িয়ে! আমাকে উঁকি মা-র-তে দেখেই মৃদু হাসলেন। দূর থেকেই হাত ইশারা করে বোঝালেন চমৎকার নাচছেন। আমি আঁড়চোখে রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনিও আমার মতোই দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার মনে ভ-য় আর উনার চোখে রা-গ। এই হলো, এবার এক কে-লেং-কা-রী নিশ্চিত হবে।
উনি উঠলেন না চেয়ার ছেড়ে। নিজের রা-গ-টা-কে যথাসম্ভব কব্জায় রেখে আমার দিকে তাকালেন। নিশ্চয়ই আরেকদফা হু-কু-ম-জা-রি-র মতলব আঁটছেন। জীবনের এতো ধরাবাঁধা নিয়ম আমার পছন্দ না। তাই উনার চোখের ভাষা বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকলাম। উনাকে বা কেশবকে কাউকেই আর বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নাচ প্রাকটিসে মনোনিবেশ করলাম।
ঘন্টাখানিকের মাঝে প্রাকটিস শেষ করে রাইকে নিয়ে চলে এলাম ক্যানটিনে। ক্ষিদেয় রীতিমতো পেট জ্বা-লা-পো-ড়া করছে। এই মুহুর্তে পেটে কিছু না দিলে আর দেখতে হচ্ছে না। তাই একটু ভারী খাবারই অর্ডার করে বসলাম টেবিলে। রাই গাল ফুলিয়ে আছে। অনেক্ষন যাবৎ কিছু একটা বলার তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমি ওর কোনো কথাই শুনছিনা। এমনকি শোনার আগ্রহও দেখাচ্ছি না। তাই বেচারি না পেরে রা-গে দুঃখে গাল ফুলিয়ে রয়েছে। আমি ওর অসহায় মুখটা দেখে অবশেষে পারমিশন দিয়ে বললাম,
—-” বল কি সমস্যা? অনেক্ষন ধরে কি এমন চেপে আছিস পেটের ভেতর যে পেট এবার ফুলেফেঁপে উঠে ফেটে পড়ার উপক্রম?”
রাই ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বেশ আগ্রহের সাথে বলে উঠলো,
—-” আজ একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছি জানিস তো? হায়! কি যে সুন্দর দেখতে। উনাকে দেখতেই তো আমার চোখ রসগোল্লা। উনাকে দেখতেও অনেকটা রসগোল্লা টাইপ। ইচ্ছে করছিলো টুপ করে গিলে খেয়ে নিই।”
—-” ছিঃ তুই তো বহুত খারাপ? চোখের পর্দা কর বেদ্দপ! রূপ ভাইয়া তোর এই কান্ড দেখলে পরে তো আটা খেয়ে ম//রে যাবে।”
রাই মুখ কুঁচকে বলল,
—-” এভাবে কেন বলছিস। শুধু ভালোই তো লেগেছে! আর…”
—-” ভালো লেগেছে তাতেই রসগোল্লার মতো টুপ করে গিলে খেতে চাচ্ছিস! না জানি এর আগে পরে কিছু হলে কি করতিস!”
—-” আরে ইয়ার ট্রাস্ট মি…”
—-” হ্যালো গাইস! ক্যান আই জয়েন?”
পেছন থেকে দু’টো চেয়ার রেখেই কেশব দাঁড়িয়ে। কথাটা আমাদের উদ্দেশ্যেই ছোড়া। উনাকে দেখতেই রাইয়ের চোখ ছানাবড়া। ও এতক্ষণ যাবৎ কেশবের কথাই বলছিল। উনাকে হঠাৎ আবারও দেখতে পাবে তা হয়তো ভাবেনি। উত্তেজনার বসে আমার ডান হাতটা খামচে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
—-” দোস্ত দিজ গাই!”
আমি বিরক্তভরা চোখে তাকালাম একবার রাইয়ের দিকে। কেশব অনুমতির অপেক্ষায় রইল না। ধীর গতিতে এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারটাতেই বসলো। রাইয়ের এবার ফিট খাওয়ার পালা। চোখ জোড়া আলুর মতো গোল করে তাকিয়ে আছে কেশবের দিকে। আমি অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছি দুজনের দিকেই। কেশব মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
—-” ডিস্টার্ব করলাম?”
আমি জোরপূর্বক হাসলাম। কিছু বলব তার আগেই রাই আমাকে হেঁচকা টান মে/রে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
—-” ইয়ার কি ভয়েস!!”
আমি রাইয়ের দিকে কটমট চোখে তাকালাম। রাই চুপসে গেল। কেশব রাইয়ের চোর চোর বিহেভ দেখে বলল,
—-” আপনাদের মেই বি সত্যি ডিস্টার্ব করলাম নিধি। আম এক্সট্রিমলি সরি!”
আমি তড়িঘড়ি মাথা নাড়লাম। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,
—-” নাথিং লাইক দ্যাট। ও আসলে আপনাকে দেখে একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছে।”
কেশব রাইয়ের দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে বলল,
—-” কেন কেন? আমাকে দেখতে কি কোনো হিরোদের মতো লাগছে হা?”
রাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
—-” তার থেকেও কম নয়।”
কেশব মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলল,
—-” শুকরিয়া।”
রাই চোখ ঝাঁপটালো। ফর্মালিটির খাতিরে জিজ্ঞেস করল,
—-” আপনি কিছু খাবেন? কফি, বার্গার? অর্ডার করি?”
আমি ভাবলাম এই লোকও ফর্মালিটির খাতিরে বাঁধ সেধে বলল, নো থ্যাংক্স। কিন্তু সেরকম কিছু না বলে উল্টে হাসি মুখে বলল,
—-” আপনি যখন অফার করলেন তখন শিওর কিছু খাওয়া যায়!”
রাই বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে আমার দিকে তাকালো। বলল,
—-” আমি তাহলে অর্ডার করে আসছি।”
রাই উঠে যেতেই কেশব আমার দিকে পূর্নদৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল,
—-” আমি কিন্তু একটা কথা না বলে থাকতেই পারছিনা নিধি, ইউ আর রিয়েলি সাচ আ গুড ডান্সার। আমি তো মুগ্ধ!”
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। ভদ্রতা দেখিয়ে ছোট্ট করে হেসে জবাব দিলাম,
—-” ধন্যবাদ।”
—-” আমি তোমায় যত দেখি ততই মুগ্ধ হই। আর কি কি গুন লুকিয়ে রেখেছো বলো তো?”
লোকটা প্রয়োজন ব্যতীত অধিক কথা বলছে। আমি কথার তাল ঘুরিয়ে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
—-” আপনি হঠাৎ আমাদের ভার্সিটিতে? এনি রিজনস?”
—-” বিশেষ কিছু নয়। শুনলাম তুমি এখানে আছো তাই…”
—-” মানে?”
—-” আব… তোমরা! আই মিন রাহিয়ানও তো এখানেই আছে। আমি এখান থেকেই ক্রস করছিলাম আর কি,তো ভাবলাম এ পথ ধরে যখন যাচ্ছি একবার না হয় তোমাদের দর্শন করে যাই।”
—-” ওহ আচ্ছা!”
—-” ডান্সটাকে পার্মানেন্টলি প্যাশন করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে? নাকি এভাবেই?”
—-” না! সেরকম কিছুই না। জাস্ট এভাবেই!”
—-” তোমার ডান্স দেখে আমি সত্যি ফিদা নিধি। এই সুবাদে তোমাকে ছোট্ট একটা ট্রিট দিতে চাই! অনলি কফি ট্রিট। যদি তোমার মত থাকে? ক্যান ইউ জয়েন উইথ মি?”
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। মুখের উপর না বলাটা অভদ্রতা! তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম,
—-” ভেবে দেখবো।”
কেশব বাঁকা ঠোঁটে হাসলেন। বললেন,
—-” শুকরিয়া! আম ওয়েটিং।”
আমি আর কথা বাড়লাম না। পানির বোতল খুলে পানি খেতে লাগলাম, এরই মধ্যে রাই এসে পড়ল। খানিকক্ষণের মধ্যে উনার খাবারও এসে গেলো। বাকি সময় টুকু রাই আর উনি কথা বলে গেলেন। আমি শুধু ভদ্রতা দেখিয়ে হু হা করলাম। লোকটার তাকানোর ধরন, কথা বলার ধরন কোনোটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন উনি আসলে যা তা দেখান না। উনি যা নন তাই দেখান। ঘাপলা ঘাপলা গন্ধ হচ্ছে। এই প্রথমবার মনে হচ্ছে রাহিয়ান ভাইয়ার কথা মেনে নেওয়াই শ্রেয়। উনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ।
কেশবের পাট চুকিয়ে অনন্যা আপুর ডাকে আবারও এসে হাজির হলাম অডিটোরিয়াম রুমে। নাচের শেষ ধাপ গুলো আমার তুলতে সহজ হলেও বাকিরা প্রায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে তাদের স্টেপ বোঝাতে বোঝাতে আপাতত ভীষণ চটে আছে অনন্যা আপু্। এখন শেষ ভরসা আমি। আমি তাদের স্টেপ বোঝাতে স্বার্থক হবো বলে আপুর ধারনা। আমি আপুর ভাবনার মুল্য রেখেই সবাইকে আবারও শেখাতে লাগলাম। সবাইকে হাতে কলমে বোঝাতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো রাহিয়ান ভাইয়ার কথা। উনি দূরে ঠিক আগের জায়গা নিয়েই বসে আছেন। বিশেষ আলোচনা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে বিরতিও দেওয়া হচ্ছে কিন্তু উনি বিরতির মাঝেও আমাকে দেখছেন না। ভুল করেও একবার এদিকে তাকাচ্ছেন না। এমন ভাব নিয়ে আছেন যেন মনে হচ্ছে নিধি নামের কোনো প্রানীই পৃথিবীতে বাস করেনা। হলো টা কি? কোনো কারনে কি মেজাজ খুব কড়া উনার? তাই তো মনে হচ্ছে! আচ্ছা কেশবের ব্যাপারটা নিয়ে রে-গে নন তো? ইয়া খোদা! সহায় হও! যদি সত্যি এমন কিছু হয় তবে তো আমি শেষ।
৫৩.
হুতুমপেঁচার গাড়িতে দুনিয়ার সেরা অসহায়ের খেতাব নিয়ে বসে আছি। উনি হুতুমের মতো গাল ফুলিয়ে চোখ জোড়া একদিকেই আবদ্ধ করে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাসায় ফিরছি। কিন্তু রোড তো অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে না উনি বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন । সেই থেকে মা-রা-ত্ম-ক পর্যায়ে রে-গে আছেন। তখন থেকে এখনও অব্দি অ থেকে আ পর্যন্ত কোনো শব্দই করেননি। ভ-য় হচ্ছে, কেননা কোনো ঝ-ড়ে-র পূর্বাভাস প্রথমে এমন থমথমেই হয়! আঁড়চোখে উনাকে দেখে চলেছি ঘন্টা খানিক হবে। রা-গী রা-গী লুকে উনাকে বেশ লাগছে দেখতে। ব্লু রঙের শার্টটাতে নিদারুন মানিয়েছে। রা-গে চোখে মুখে যেন লালচে রঙ উপচে পড়ছে। নাকের ডগা,চোখের সাদা অংশ, ঠোঁট, কপালের মাঝ খানে সব জায়গাতেই টগবগ করছে রা-গ। বাম হাতে একটা কালো বেল্টের ঘড়ি ছিলো। আমি কোমল স্বরে বলেছিলাম,
—-” আপনার ঘড়িটা খুব সুন্দর।”
ব্যস,এর প্রতিত্তোর ছিলো গাড়ির পেছনের সিট। উনি রা-গে কটমট করতে করতে হাত থেকে ঘড়িটা খুলেই ছুড়ে মা-র-লে/ন পেছনে! ভাগ্যিস, বাইরে ফেলেননি! অহসায় ঘড়িটা এখানে ওখানে বারি খেতে খেতে সিটের মাঝে আঁটকে গেলো। আর আমি? ভ-য়া-র্ত হরিণীর মতো বাঘের থাবা থেকে পালানোর পাল্টা পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু আখেরে লাভ হওয়া আর কপালে জুটলো না। উনার চোখের গরম চাহনিতেই হাত,পা, মস্তিষ্ক সব ঠান্ডা করে লেপ্টে রইলাম সিটের সাথে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? আর যে এভাবে চুপ করে থাকতে পারছিনা! পেটের মধ্যে কথারা শুধু আফসোসই ম//রে যাচ্ছে। কত কত কথা যে মিস হয়ে যাচ্ছে!
সমস্ত ভয়কে পাশে চাপিয়েই ঠোঁট উল্টে তাকালাম উনার দিকে। গলার স্বরটা অসহায়ত্বের চূড়ায় পৌঁছে নিয়ে বলে উঠলাম,
—-” আমি পানি খাবো প্লিজ! অনেক্ষন যাবৎ পানি পিপাসায় গলা শুঁকিয়ে কাঠের মতো খটখট করছে।”
উনি কিছু না বলেই আচমকা গাড়ির ব্রেক কষলেন। পরিস্থিতি কিছু আন্দাজ করার পূর্বেই সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেলাম আমি। যতক্ষণে সোজা হয়ে বসলাম ততক্ষণে উনি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ কিছু না বলেই আমার পাশের দরজাটা খুলে আমাকে হেঁচকা টেনে বের করে আনলেন। যা ঘটছে তার কিছুই আমার মস্তিষ্ক ধারন করতে সক্ষম হচ্ছে না!! আমি হেলতে দুলতে নিজেকে সামলে নিতেই, উনি আমাকে উনার রূপে এসে শক্ত করে গাড়ির দরজার সাথে চেপে ধরলেন। চোখের মাঝে আ-গু-নে-র ফুলকি গুলো নাচছে যেন। ভ-য়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল হাওয়া বইছে। আমি ঢোক গিললাম। কথা বলার জো তো নেই এখানে। বরং উনার হাতে কষিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় খাওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া উত্তম।
—-” তোমাকে পৈপৈ করে বারন করার পরও তোমার আমার কথা শুনতে ইচ্ছে হয়না তাই না? তুমি তো ঠিকই করে নিয়েছো রাহিয়ান যা বলবে তা আমাকে বিনাবাক্যে অমান্য করতে হবে। করতে হবে মানে করতেই হবে। রাহিয়ান যদি বলে বামে হাঁটবে না তবে তোমার কাছে মনে হবে ডানে কাটা বিছিয়ে আছে অতএব আমাকে বামেই হাঁটতে হবে!”
উনার ঠান্ডা গলার আওয়াজে রাগের বহিঃপ্রকাশ বিন্দু মাত্র নেই। আমার বেশ সুবিধা হবে কথা বলতে। আমি মনে মনে খুশি হয়ে আসমান ছুঁয়ে কিছু বলতে যাবো তার মধ্যেই উনি আমার সমস্ত খুশিতে এক বালতি কাঁদা ছিটিয়ে ধাম করে বারি বসালেন গাড়ির উপর। আমি আঁতকে উঠে লেপ্টে গেলাম গাড়ির সাথে। ভ/য়া/র্ত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলাম। উনি নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরেই আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরলেন। আমরা দু’জনেই কাঁপছি, উনি কাঁপছেন রা-গে আর আমি কাঁপছি ভ-য়ে। উনি রা-গে-র বিশাল বিশাল কু-ন্ড-লী পাকিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মে-রে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—-” খুব শখ না কেশবের সাথে খেজুরে আলাপ করার। সেদিন থেকেই দেখছি ওর সাথে তোমার হেলেদুলে আলাপ। আমি তোমাকে বারন করেছি নিধি ওর সাথে তুমি কোনো কথা বলবেনা! ওর থেকে তুমি দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু না! তুমি আমার কথার তোয়াক্কা না করে ওর সাথে ক্যানটিনে গিয়ে একসাথে বসে খাবার খাচ্ছো। হেসে হেসে কথা বলছো! আচ্ছা তোমার সমস্যা কি বলো? তুমি কেন ওর সাথে কথা বলছো? ওকে তোমার ভালো লেগেছে? বিয়ে করবে ওকে? ইয়াপ, ভালো না লাগারও তো কারন নেই! হি লুক লাইক আ হিরো! এজ লাইক মেয়েদের স্বপ্নের নায়ক! তোমারও মেইবি তাই? তো যাও না ওর কাছে? কেন এসেছো আমার সাথে আলগা পিরিত দেখিয়ে কথা বলতে? কেন বসেছো আমার গাড়িতে? এখন তো তোমার ওর সাথে ঘোরার কথা। সে তো তোমাকে কফির জন্য ট্রিট দিতে চেয়েছে! গেলেনা কেন ওর সাথে? তোমার স্বপ্নের হিরোর সাথে? একটা কথা জানো তো? তোমাদের মতো মেয়েদের থেকে না এর থেকে বেশি আশা করাও বোকামো! কোনো একটা ছেলে এসে একটু হেসে হেসে কথা বলেছে কি? তোমরাও ফিদা হয়ে যাও! গায়ে পড়ে আলগা পিরিত শুরু করে দাও।”
কথা না বললেও বেশ বুঝতে পারলাম আমার গলা জড়িয়ে এসেছে৷ চোখ জোড়াও টলমল করছে পানিতে। জড়ানো গলায় ঢোক গিলে উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,
—-” ম্ মানে! আপনার আমাকে এমন মেয়ে মনে হয় রাহিয়ান? আপনার মনে হয় আমি কোনো ছেলের সাথে নিৃ থেকে গিয়ে আলগা পিরিত করি! আপনি সবার সাথে..”
কথাটা শেষ হলো না আমার! তার পূর্বেই দিগুন রাগ নিয়ে তাকালেন আমার দিকে! আমার গলা থেমে গেলো ঠিক ওখানেই! উনি আমাকে নিজের সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাতাসের গতি থামিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। আমি বোকার হদ্দ দাঁড়িয়ে রইলাম। দুই মিনিটের মাথায় রাস্তা টা পুরো ফাঁকা হয়ে গেলো। আমাদের গাড়িটা ব্যতীত আর কোনো গাড়িও ছিলো না৷ জনমানবশূন্য জায়গাটা। কাঠফাটা রোদের মধ্যে আমি এক অসহায় ব্যতীত দূর-দূরান্ত অব্দি একটা পাখিও দেখা যাচ্ছে না।
চোখ জোড়া আমার জ্ব-লে-পু-ড়ে যাচ্ছে। মানুষটার এতো কিসের রা-গ আমার উপর? খুব বিশ্রি ভাবে কান্না পাচ্ছে আমার। বার বার ফুঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে কান্নার বেগ চাপাতে। কিন্তু আমি কাঁদতে চাচ্ছি না! নিধি এতো সহজে কারোর জন্য চোখের জল ফেলেনা। অসম্ভব! যে পথ ধরে এলাম সে পথেই হাঁটা ধরলাম। সামনের পথ জানা নেই! তাই পেছনের পথ ধরে গেলেই কোনো কিছু ঠিকই পেয়ে যাবো!
হাঁটতে হাঁটতে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালাম। সময় ঠিক ৩ টার উপর স্থীর হয়ে আছে। আশেপাশে রোদের ভ্যাপসা গরম ব্যতীত কিছুই নেই। একটা ঠ্যালা গাড়িও চোখে পড়ছে না। চাতক পাখির মতো দৃষ্টি ঘুরিয়েও বিশেষ লাভ হলো না। পায়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে আবারও ভার্সিটির সামনে এসে পৌছলাম। আশেপাশে তাকাতে দেখি এখানেও কোনে রিক্সা নেই! এবার সত্যি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে এর আগে কখনি পড়িনি আমি। আর এরকম একটা মানুষ জীবনে থাকলে এর থেকে ভালো পরিস্থিতি আশা করাও পা-প। উনার এতো রা-গ, এতো ধারালো কথা আমি কিছুতেই স-হ্য করবো না। অসম্ভব! আবারও হাঁটতে লাগলাম!
আমিও এতো সহজে হার মানার মেয়ে নই! উনার রা-গ, অভিমান সবই একদম ঠেসে ভরপুর। তবে উনারও বোঝা উচিৎ নিধিও কিছু কম যায় না! কেউ অযথাই নিধিকে ভুল বুঝে একশটা কথা শুনিয়ে যাবে আর নিধি সেটা মুখ বুঝে সহ্য করবে সেটা তো হতে পারেনা!
বাসার কলিং বেল চাপতেই তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে এসে দরজা খুলল রানি। দরজার এপাশে আমাকে দেখবে তা যেন ওর কাছে অকল্পনীয় ছিলো। খুশিতে উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরেই চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
—-” নিধি আফা আফনে আইসচেন বাড়িত। কদ্দিন আফনেরে দেখিনই আফা। আর যে কি খারাব লাগত কি খারাব লাগত কিতা কইতাম আর আফা। ডেইলি ডেইলি আফনে গো রুমেত গিয়া সব ঝাড়পোঁছ দিয়া রাইখা আহি। কবে আবার আফনেরা আইবেন হেই চিন্তায় মন খারাব কইরা বইসা থাকতাম আফা।”
আমি রানির মুখ চেয়ে ম্লান হাসলাম। ওর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বললাম,
—-” আমিও তোকে খুব মিস করেছি পা-গ-লী। বাসার বাকিরা কোথায়? নিতু আপু, হিমেল ভাই, চাচা-চাচী?”
রানি আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাকে বসতে বলে বলল,
—-“আফনে বহেন আগে আফনের পানি দেই! কয়ডা দিনে কেমনে করি শুগায় গেছেন আহারে! ঐবাড়িত কি আপনার যত্নআত্তি কেউ করে নাই?”
আমি হেসে ফেললাম। ব্যাগ আর ফোনটা পাশে রাখতে রাখতে বললাম,
—-” ও বাড়িতে আমার যে যত্নআত্তি হয়েছে তা মনে কর এই এত বছরেও নিজে করতে পারিনি! কি রে বললি না তো বাসার সবাই কোথায়?”
রানি পানি আনতে ছুটে গেলো। পানি নিয়ে এসে আমার পাশে বসতে বসতে বলল,
—-” হিমেল ভাইজান আর খালাম্মা-খালু দাওয়াতে গেছে কার বাড়িত জানি। নাম কইতে পারি না। আর নিতু আফা হের বন্ধুর বাড়িত গেছে। আইজকা মনে হয় কেউই ফিরব না!”
—-” বলিস কি? কবে ফিরবে তাহলে?”
—-” হেয়া তো কয়নাই। আমারে খালি কইয়া গেছে আমার থাহনের যদি বেশি সমস্যা হয় তালে জানি আই আর দাদীরে ফোন করায় আনি। এহন তো আর লাগতো না! আফনে আইসা গেছেন। এহন আই নিশ্চিন্ত।”
আমি ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বাসায় কেউ নেই। দুই এক দিনে আসবেও না! কিন্তু আজই তো বাবা আসবে। আর বাবার জন্য সব খাবার গুলোও তো রাঁধতে হবে। আমি একা একা কি করে সবটা সামলে রাঁধব!
—-” ও আফা কি ভাবেন?”
রানির ডাকে ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আমার। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লানমুখে বললাম,
—-” আর দুই ঘন্টা বাদে বাবার ফ্লাইট! বাবা দেশে ফিরছেন। আর আমি কাল বিকেলে বাবাকে বলেছি আমি তার জন্য সব পছন্দের খাবার গুলো রাঁধব। সেটাই ভাবছি! চাচী থাকলে আমার একটু সুবিধা হতো। কিন্তু এখন যে চাচীও নেই!”
রানি মুখ টিপে হাসলো। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল,
—-” এই নিয়া আফনের এতো চিন্তা? আরে আমি থাকতে আফনের কোনো চিন্তা করা লাগব এ যে অসম্ভব! হুনেন আফা আই হইলাম আফনের এসিস… এসএস… ঐ কি জানি কয়না?”
—-” এসিস্ট্যান্ট?”
—-” হ হ ঐডা! আমি আফনের এসিস্ট্যান্ট হইমু! ঠিকাছে?”
আমি হেসে উঠে বললাম,
—-” আচ্ছা ঠিকাছে। তুই থাক আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে দুজনে মিলে জমিয়ে রান্না করব কেমন?”
রানিও হেসে মাথা দুলালো। আমি ব্যাগ আর ফোন নিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে। চেঞ্জ করে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ চোখ পড়ল আমার ডান হাতের মাঝে ছোট্ট তিলটা। তিলটা দেখতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বেশ অনেকদিন পর আবারও এই তিলের দর্শন মিলল। তিলটাকে নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করবো এমন সময় বেজে উঠলো ফোনটা। গবেষণা মাঝপথেই বন্ধ করে ফোনটা হাতে তুলে দেখলাম আননোন নাম্বার! নিশ্চয়ই রাহিয়ান! মেজাজটা হঠাৎই বিগড়ে গেলো। উনার কল ধরার প্রশ্নই আসেনা। কলটা কেটে দিয়ে বড় খালামনির নাম্বারে টেক্সট করলাম,যেন বাবাকে নিয়ে সরাসরি আমাদের বাড়িতেই আসা হয়!
ম্যাসেজ সেন্ড হতেই ফোনটা সুইচঅফ করে দিলাম। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা ওখানেই ফেলে রেখে নীচে চলে গেলাম বাবার জন্য রান্না গুলো কমপ্লিট করতে।
#চলবে____________________