প্রেয়সী পর্ব-২৮+২৯

0
259

#প্রেয়সী 🤎(২৮)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৫৪.

রাত ৯টা। রান্নার কাজ সব কমপ্লিট করেই এসে বসলাম আমার ছোট্ট ব্যালকনিতে। নিজের রুম, নিজের বিছানা, নিজের ব্যালকনি সব কিছুতেই যেন অন্যরকম শান্তি। এতোদিন ধরে ঐবাড়িতে পড়ে না থাকলেও আহামরি কিছু ঘটে যেত না। বরং ওমন র/গ/চ/টা মানুষের থেকে নিজের দূরত্ব ঠিকই বজায় রাখতে পারতাম। উনি অযথা আমার সাথে এমন ব্যবহার করবেন এটা আমি কিছুতেই মেনে নিবোনা। কেননা উনারও এবার বোঝা উচিত নিধির আত্মসম্মান বোধ সদাসর্বদা একটু বেশি।

দুপুরের ব্যাপারটা মনে পড়লে মনের মধ্যে এখনও এক অসহ্য য-ন্ত্র-ণা হচ্ছে। আমারই ভুল! সব কিছুতে নিজেকে এতোটা ছোট করে ফেলা কখনোই উচিৎ নয়। আগে নিজের আত্মসম্মান পরে অন্যকিছু।

—-” নিধি আফা আফনের কল আইছে। নিতু আফা কল দিছে?”

নীচতলা থেকে রানির মুখে নিতুর আপুর কলের কথা শুনতেই জলদি করে নীচে নেমে এলাম। কিন্তু আমার ফোনতো অফ! কিসে কল দিলো তবে?

—-” আমার ফোন তো অফ! তবে নিতু আপুর কল কি করে এলো?”

গলা উঁচিয়ে রানিকে এমন প্রশ্ন করতেই রান্নাঘর থেকে ওর জবাব এলো,

—-” খালুর ল্যান্ডলাইনে কল দিছে!”

চাচার ল্যান্ডফোনে কল দিয়েছে? অদ্ভুত!! নিতু আপু কি করে জানল আমি এ বাড়িতে আছি? মনের মধ্যে খানিক অস্বস্তি নিয়েই এগিয়ে গেলাম সোফার রুমে। রানিকে অযথা প্রশ্ন করে লাভ নেই। তার থেকে বরং নিজেই দেখে নিই। ধীরগতিতে ধাপ ফেলে প্রথমেই ল্যান্ডফোনের দিকে তাকালাম। ফোনটা স্বাভাবিক ভাবেই রাখা আছে। অন্যসময় কল এলে তো পাশে উঠিয়ে রাখা হয়। তবে কি কল কেটে দিলো?

—-” নীলাদ্রিতা?”

বেশি দূরে নয়। গুনে গুনে আমার থেকে ঠিক পাঁচ হাত দূরেই অপ্রত্যাশিত মানুষটা বসে আছেন। আমি তার দিকে তাকাতে তাকাতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ উনাকে আবিষ্কার করব ভাবতে পারিনি। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল দু’তিনবার। বুকে হাত চেপে ভ-য়া-র্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে ভালো করে তাকালাম। শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে না দুপুরের পর থেকে এখনও অব্দি অন্য গ্রহণ করেছেন। বাসায় ফিরেছেন তাও মনে হচ্ছে না। দুপুরে যেই ড্রেসে ছিলেন এখনও সেই একই ড্রেসে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো উনি এখানে কেন এসেছেন?

—-” আপনি?”

কন্ঠে ভারী বিরক্তির রেশ ঢেলে জিজ্ঞেস করলাম উনাকে। উনি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। শুঁকনো মুখেই চমৎকার হাসলেন। উনার হাসিতে আমারও মনটা শীতল হয়ে উঠল। কিন্তু উনাকে বুঝতে দিলাম না। মুখের ভাব একই রাখলাম, বিরক্তিকর! উনি কিছু বলার প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আচ্ছা উনি কি কোনো কারনে আমাকে সরি বলতে চাচ্ছেন? নাকি আমার মস্তিষ্ক একটু বেশি বেশি ভাবছে।

—-” রে-গে আছো আমার উপর?”

শোনো কথা? একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়ে যে কিনা আমাকে একলা রেখে হুড়মুড় করে চলে গেলো তার উপর রে-গে থাকবো না তো কি খুশি হয়ে লুঙ্গি ডান্স মা-র-বো? সারা বাড়িতে খুশিতে পিঠেপুলির উৎসব করে বেড়াবো? ফালতু লোক একটা! ঢং করে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে!

আমাকে একই ভাবে চুপ থাকতে দেখে উনি ধাপ ফেলে এগিয়ে এলেন কিছুটা। মুখে এখনও সেই চমৎকার হাসি। উনার মেয়েলি ধরনের চোখ জোড়া হঠাৎ চিকচিক করছে। ভারি পল্লব ঝুঁকিয়ে বারবার চোখও ঝাপটাচ্ছেন। হাত জোড়া এবার ঝুলিয়ে দাঁড়ালেন। সরি বলার জন্য খুব আটঘাট বেঁধে দাঁড়ালেন। কিন্তু উনার সরি বলার সুযোগ আর আমিই দিলাম না। গলা উঁচিয়ে রানিকে ডেকে উঠতেই উনি অস্বস্তিতে পড়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। রানি ওড়নার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

—-” হ আফা কন?”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে রানিকে দিলাম এক ধমক। রানি ধমক খেয়ে চমকে উঠে মুখ কালো করে ফেললো। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার রাহিয়ানের দিকে। মুখটাকে কালো করেই কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আমি আবারও ধমকের সুরে বলে উঠলাম,

—-” তুই একজন বাইরের লোকের জন্য আমাকে মিথ্যে বললি? এতো সাহস বেড়ে গিয়েছে তোর হ্যাঁ? হ্যাঁ রে,তুই চিনিস এই লোককে?”

রানি মাথা নীচু করে না সূচক মাথা নাড়ল। আর যা দেখে আমার মেজাজটা আরও খানিক বিগড়ে গেলো। আমি পূর্বের ভঙ্গিমাতেই বলে উঠলাম,

—-” না চিনে বাসায় কেন ঢুকতে দিয়ছিস? এই শিক্ষা পাস এ বাড়ি থেকে?ছোট থেকে বড় হলি এই বাড়িতে, অথচ মিনিমাম নিয়ম রক্ষা করতে পারিস না? যাকে তাকে যখন তখন বাড়ি বয়ে নিয়ে আসছিস? তোকে আমি শেষবার বারন করে দিচ্ছি রানি, এর পরের বার যদি এমন আর করেছিস তো আমার চেয়ে বেশি খারাপ আর কেউ হবেনা। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে রানি, তুই একজন অপরিচিত লোককে বাসায় ঢুকিয়ে আবার আমাকেই মিথ্যে বলছিস? তোর এমন কাজ যদি চাচি ঘুনাক্ষরেও টের পায় ভাবতে পারছিস কতটা রে-গে যাবে চাচি?”

রানি ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” আর কুনো দোষ নাই আফা! উনিই কইল আফনে হেতেরে চেনেন! খুব ভালা সম্পর্ক আফনে গো। আফনে নি রা-গ কইরা আছেন উনার প্রতি তাই….”

—-” তো? তাই বলে তুই যাকে তাকে বাসায় ঢুকতে দিবি? তুই বিশ্বাস কি করে করতে পারছিস এসব আমিতো সেটাই বুঝতে পারছিনা?”

—-” ছোরি আফা আই আর এমন কাম জীবনে করুম না! আফনে খালাম্মারে কিছু কইয়েননা আফা!”

—-” কথা কম বল আর যা এখান থেকে।”

রানি চলে যেতে লাগল। আমি ওকে আবারও থামিয়ে দিয়ে বললাম,

—-” শোন, একটা প্লেট নিয়ে অল্প কিছু বিরিয়ানী আর মুরগীর রোস্ট থেকে দুই টুকরো রোস্ট উঠিয়ে রাখ। আর টেবিলের পাশে কিছু টাকা আছে, টাকা গুলো নিয়ে মতি চাচার দোকানে চলে যা। বলবি দুটো কোঁক দিতে।”

রানি চোখের জল মুছে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো বটে। কিন্তু আমি আর তাকালাম না ওর দিকে। রাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে রীতিমতো লোহার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই তার চমৎকার হাসি খানাও আর দেখলাম না। রানিকে বকতে সময় হয়তো সে হাসিরও অবসান ঘটেছে।

—-” তুমি অযথাই রানিকে বকাঝকা করলে! আসলে আমিই ওকে… আমি নিজেই বুঝতে পারিনি! আ’ইম সো সরি! আমি চলে যাচ্ছি। এন্ড যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু বলতে চাই! আ’ইম সরি নীলাদ্রিতা! দুপুরের ব্যাপারটার জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। প্রবলেমটা আসলে আমার নিজেরই। দ্যাট ওয়াজ মাই ফল্ট।”

কথা গুলো বলেই হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান। আমি জায়গায় স্থির থেকেই কঠিন স্বরে বলে উঠলাম,

—-” আমি আপনাকে এখানে আসতে বলেছি নাকি এখন এখান থেকে যেতে বলেছি?”

উনি পেছন মুড়ে তাকালেন না। সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,

—-” কোনোটাই বলোনি তবে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার এখানে আসাটা একদমই ঠিক হয়নি। তাতে আমি তোমাকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি।”

—-” সত্যি কথা বলতে, আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রবলেম আসলে আপনারই। আর সেটা হলো ওভার থিংকিং এর প্রবলেম।”

পেছন মুড়ে তাকালেন উনি। চোখমুখ থেকে অপরাধ বোধ টা উঠে গিয়ে একরাশ বিস্ময় ধরা দিচ্ছে। আমি দুই পা হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকে ভালো করে আরেকবার দেখতে দেখতে বললাম,

—-” সিঁড়ি ভে-ঙে সোজা উপরে উঠে যান। হাতের ডানে গিয়ে দেখবেন পরপর তিনটা রুম। প্রথমটা বাবার আর তার পরের টা রান্নাঘর, আর তার পরেরটা… না জানলেও চলবে। প্রথম ঘরটা তে ঢুকে বামে গেলেই ওয়াশরুম পাবেন। গিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে দুই মিনিট জিরিয়ে নিবেন ফ্যান ছেড়ে। দুঃখিত, এর জন্য যে আপনার রুমের মতো স্পেশালিটি এখানে পাবেননা। আমাদের গরীবের বাসায় এসি নেই। মাথার উপর ফ্যান আছে। ক-ষ্ট করে সেখানেই আপনাকে কিছুক্ষণ কাটাতে হবে। ঠিক পাঁচ মিনিট থেকে নীচে নেমে আসবেন। আপনার জন্য খাবার দিচ্ছি টেবিলে। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে। এখন এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে জলদি চলে যান।”

উনি মাথা নীচু করে মুচকি হাসলেন। ডান হাতটা তুলে মাথা চুলকে মৃদুস্বরে বললেন,

—-” ভাবছি মাকে বলবো ছোট মনির মেয়েটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যদি নিজে থেকে রাজি হও তো ধুমধাম করে বিয়েটা সেরে ফেলব, অন্যথা বছর দুয়েকের জন্য তাকে নিয়ে দেশান্তর হবো।”

আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল তার কথায়। আমি মুখে ভেংচি কেটে বললাম,

—-” এতো শখ ভালো নয় মশাই! আমি আপনাকে বিয়ে করব এটা আপনি ভাবছেন কি করে হ্যাঁ?”

উনি এবার সাদা দাঁতের ঝলক দিয়ে হাসলেন। চমৎকার হাসি তার। চোখ দুটো সরু করে বললেন,

—-” বিয়ে না করতে চাইলে জো-র করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। দেন খুব ট-র্চা-র করবো! উঠতে বসতে ট-র্চা-র চলবে তখন।”

আমার ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো তার কথায়। আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললাম,

—-” আচ্ছা? তো আপনি কি ভাবছেন শুনি? বিয়ের পর আপনি আমাকে ট-র্চা-র করবেন আর আমি অবলা নারীর মতো সয়ে যাবো? আমিও আপনাকে ট-র্চা-র করব! আপনাকে আমি না খাইয়ে ট-র্চা-র করব। না রেঁধে না খাইয়ে ট-র্চা-র করব।”

উনি ফিক করে হেসে দিলেন। একটু এগিয়ে এসে আমার কোমরে হাত চেপে গভীর চোখে তাকালেন। ঠোঁটের কোনে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,

—-” তবে কি স্বীকার করে নিচ্ছো বিয়েটা আমাকেই করবে?”

আমার টনক নড়তেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম তাকে। বুঝতে পারছি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি আমি। কোনো রকম উনার থেকে পালানোর বাহানায় বললাম,

—-” অসম্ভব! আমি আপনার মতো এমন একটা মানুষকে বিয়ে করব সে প্রশ্নই উঠেনা!”

উনি হেসে উঠলেন শব্দ করে। আমি তার সামনে থেকে দৌড়ে চলে আসতেই সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

—-” আমার বড় স্বাধ হয় নীলাদ্রিতা,
একবার তোমার নিঃশ্বাস আঁটকিয়ে দেখি।”

৫৫.

বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমার টলমল করা চোখ জোড়া এই দৃশ্য যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকছে। কিন্তু আমি বাবার কাছে যেতে পারছিনা! আমার শরীর শ-ক্ত হয়ে জমে আছে। ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে বাবা। আর আমি বাবার থেকে সামান্যই দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা চলছে। সাথে মিটমিট করে জ্ব-ল-ছে শতাধিক তাঁরা। বাবা সবসময় চাঁদের থেকেও তাঁরা বেশি পছন্দ করে। সবসময় বলে তোর মা ঐ তাঁরাদের সাথেই থাকে। তাই চাঁদের চেয়েও আমার তাঁরা বেশি পছন্দ।

ঘন্টা খানিক আগে একটা খবর এলো! বড় খালামনি রাহিয়ানকে কল করেছেন। বাবা নাকি আর নেই! হঠাৎ কিভাবে কি হয়ে গেলো কেউ কিছু বলতে পারছেনা। বাবার সুস্থ স্বাভাবিক শরীরটা নাকি হঠাৎই নিথর হয়ে গেলো। এই খবরে আমার বিশেষ ভাবাবেগ ঘটাতে পারলাম না। ঠিক ঠাহরেই উঠতে পারলাম না বড় খালামনি হঠাৎ এমন মজা কেন করছেন? বাবা আর নেই মানে? এটা কেমন মজা? তারা কি জানেনা, নিধি আর যাই হোক তার বাবাকে নিয়ে মজা সহ্য করতে পারেনা! আচ্ছা আমি কি এখন নীচে গিয়ে বড় খালামনিকে জিজ্ঞেস করবো, তিনি হঠাৎ এমন মজা কেন করলেন? আর বাবা যদি নাই থাকে তবে এই যে বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে! সেটা কি করে সম্ভব হয়? আমার কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ? নাকি উচিৎ না?

—–” বাবা? ও বাবা? কি হয়েছে গো তোমার? ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো? আমার পাশে এসে দাঁড়াও না! দেখো না আজ আকাশে কত তাঁরাদের মেলা বসেছে? মাও এসেছে আজ! তোমার সাথে বুঝি কথা বলতে চায়? দেখো বাবা, ঐ যে তাঁরা টা? কিরকম করে জ্ব-ল-ছে দেখো? ঐ টা বুঝি মা তাই না বাবা? আচ্ছা বাবা! আমি যদি এখানে বসেই মাকে ডাকি, মা-কি শুনবে আমার ডাক? বুঝবে কি, তার নিধি তাকে ডাকছে? কথা বলবে আমার সাথে?”

বাবা মুচকি হাসছে আমায় দেখে। আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল। বাবার চুপ করে থাকাটা যেন আমাকে দু-ম-ড়ে-মু-চ-ড়ে দিচ্ছে! রা-গে দুঃখে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছে। বাবা কেন কিছু বলছে না আমাকে? আমিও যে পা-থ-রে-র মতো জমে আছি জায়গায়। বাবার কাছে এগিয়ে যেতে পারছিনা! আচ্ছা বাবার কি ক্ষিধে পেয়েছে?

—-” বাবা তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? চলো খাবে চলো? আজ তো সব তোমার পছন্দের খাবার রেঁধেছি। তুমি কাল বললেনা? খেতে চাইলে যে? আমি তো আজ সব রেঁধেছি বাবা। জানো, আজ কিন্তু চাচির কোন হেল্প নেইনি। সব নিজের হাতে রেঁধেছি। রানি একটু আধটু কুটতে বাটতে সাহায্য করেছে। বাকি সব আমি একাই করেছি। চেখে দেখবেনা স্বাদ কেমন হলো? আমি জানি খারাপ হয়নি! বাবার জন্য রেঁধেছি খারাপ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কি বলো?”

কথা গুলো বলে নিজে নিজেই হেসে উঠলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি পা-গ-ল হয়ে গেছি। পা-গ-লে-র মতো করে হাসছি। এই মুহুর্তে আমার আশেপাশে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলত,

—-” এই দেখ তোরা! এই মেয়েটা পা-গ-ল হয়ে গেছে। একদম পা-গ-লে-র মতো হাসছে!”

আমি মনের কথায় পাত্তা দিলাম না। নাকের ডগা লাল করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এতক্ষণ হাঁটতে না পারা আমি হঠাৎ কি করে বাবার সামনে এসে দাঁড়াতে পারলাম তা আমায় ভাবালো না। আমি বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা দেখতে কিন্তু আমার মতোই। শ্যামা উজ্জ্বল গায়ের রং। কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে যেন বাবার চেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পারছিনা! খুব রা-গ হচ্ছে নিজের উপর। বাবা এতদিন পর সুস্থ হয়ে আমার কাছে ফিরল আর আমি কিনা বাবাকে একটা বারের জন্য জড়িয়ে ধরতে পারছিনা? মনে হচ্ছে আমার হাত পা যেন খ-সে পড়ছে শরীর থেকে। শরীরের মাংস গুলোতে অস্বাভাবিক ভাবে জ্বা-লা-পো-ড়া করছে। এক বি-দ-ঘু-টে গন্ধে বারবার গা গুলিয় উঠছে আমার! হঠাৎ বাবার দিকে চোখ পড়ল। বাবা আমার য-ন্ত্র-ণা দেখে হাসছে। দাঁত বের করে হাসছে। বাবার হাসি অদ্ভুত! ভ-য়ং-ক-র লাগছে। খুব ভ-য়ং-ক-র লাগছে। আচমকাই আমি শূন্যে ভেসে উঠলাম। আশপাশে কিছু ধরার জন্য হাত বাড়াতেই মাথায় খুব শ-ক্ত ভাবে আঘাত লাগল। ব্যা-থা-য় কুঁকড়ে গেলো আমার শরীর। জ্ঞান হারাতে বসেও অবচেতন মনটা বারবার বলে উঠছে, “আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি। আমার বাবা ঠিকাছে। আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি!

ঘরের আনাচে কানাচে ম-রা কান্না জুড়েছে মানুষ! আমি ঘুমচ্ছি না! কিন্তু কোনে এক ঘোরের মধ্যে আছি। ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিনা! নিজের শরীরের ভারটা মনে হচ্ছে দশজন মানুষের চেয়েও বেশি। শরীর নাড়িয়ে নড়তেও পারছিনা! আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি মস্তিষ্ক ধারন করতে পারছে। কিন্তু মন বলছে সব ঠিকাছে। মাথার উপর কারোর শীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে মনে মনে হাসলাম! হাতটাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেই বলতে লাগলাম,

—-” বাবা, এই মাঝরাতে আর কত রেডিও শুনবে বলোতো? দেখো কিভাবে মরা- কান্না জুড়েছে? শুনতে ভালো লাগছেনা বাবা! প্লিজ বন্ধ করো?”

আমার কথাটা শেষ হতেই কারা যেন হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। রেডিওতে কাঁদলে সবটা এমন বাস্তব কেন মনে হবে? সবটা এতো জীবন্ত কেন লাগছে? আমার ঘোর তখনও কাটল না। চোখ খুলে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু ঘরের কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কান্না গুলো এখনও বাজছে আমার কানে। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলাম। বাবা রুমে নেই! রেডিও নেই! কিন্তু কাঁদছে টা কে?

ডানে বামে চোখ বুলাতেই দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। ঘড়ির কাঁটা চারটার উপর আঁটকে আছে। এখন কি বিকেল নাকি ভোর?

আচমকাই চোখের সামনে এক এক করে সব পরিচিত মুখ গুলো ভেসে উঠছে। রাই,রিম্মি আপু,নিতু আপু, ফাহিম ভাইও আছে দেখছি। ওরা কখন এলো? সবাই আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। সবার চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে ফুলে আছে। হঠাৎ মনে হলো রাই আমার হাত ধরে আমার পাশেই বসে আছে। আরে ও না এক্ষনি ওখানে ছিলো?

কোত্থেকে রানি এসে হাজির হলো। আমায় রেখে বাকি সবার সাথে কথা বলছে। আমি ওর কথা শুনছি না! শুধু দেখছি ও বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে। মেয়েটা অনেক কালো। আর এখন যেন আরও বেশি কালো লাগছে। রানি কথা শেষ করে একবার আমার দিকে তাকাল। আবার চলেও গেলো। রানি যেতেই রাই আর নিতু আপু আমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। আমাকে নিয়েও কোথায় একটা যাচ্ছে তারা। পেছন পেছন আরও অনেক মানুষজন আসছে। সবাইকে আমি চিনিও না। আজ সবাই কাঁদছে। পরিবেশটা আমার খুব বিরক্ত লাগছে! আমি কেবল সবার কান্নাই দেখছি কিন্তু কারোর কথা শুনছিনা! বড় অদ্ভুত পরিবেশ। সিঁড়ি ভে-ঙে নীচে নামতেই আরও শতাধিক মুখ আবিস্কার করলাম। সবাই একটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছুকে ঘিরে বসে আছে। অনেকে কাঁদছে, অনেক তিলাওয়াত করছে। অনেকে আবার তছবিহ্ পড়ছে।

হাত ইশারা করে কে যেন ডাকছে আমায়! আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম দেয়ালে টানানো ছবিটির অনুরূপ কেউ বসে আছে সাদা কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটির পাশে। মুখজুড়ে রয়েছে তার মায়াবী হাসি৷ আমি তাকে দেখতেই সে আবারও হাত ইশারায় ডাকল আমায়। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। সে মিষ্টি হেসে আমার দু’গালে হাত রেখে বলল,

—-” কি রে ক-ষ্ট হচ্ছে?”

—-” কে তুমি? আর হঠাৎ ক-ষ্ট হওয়ার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”

উনি হাসল। আমার কপালে আদর মাখানো ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

—-” আমি তোর মা! আজ তোর বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি আমার সাথে করে। অভিমান রাখিস না মা। তোর বাবাই বড্ড জে-দ করেছিলো যাওয়ার জন্য! আমায় ছাড়া নাকি সে জীবন্ত লা-শে-র মতো হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি। তুইও তৈরি থাকিস! একদিন সময় করে তোকেও নিয়ে যাবো।”

বুকের ভেতর টা খা খা করে উঠল। আমি শক্ত করে সাদা কাফনের কাপড় টা চেপে ধরলাম। শরীরে যত শক্তি ছিলো সব মিলিয়েই চিৎকার করে বলে উঠলাম,

—-” আমি আমার বাবাকে কিছুতেই তোমার সাথে যেতে দিবো না। চলে যাও তুমি৷ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। তুমি একজন স্বা-র্থ-প-র মহিলা। তুমি কখনোই আমাকে ভালোবাসোনি আর আজও ভালোবাসতে পারোনি! তুমি আজ আমার বাবাকেও আমার থেকে কেঁড়ে নিতে এসেছো! আমি যেতে দিবো না আমার বাবাকে! ছাড়ো, ছাড়ো আমাদের! আমার বাবাকে ধরবেনা তুমি! একদম ধরবেনা! আ..আমার বাবাকে প্লিজ ছেড়ে দাও! প্লিজ ছেড়ে দাও আমার বাবাকে! দেখো না মা, আমার যে বাবা ছাড়া আর কেউ নেই! আ..আআমার বাবা আমার থেকে হারিয়ে গেলে আমি কি করে বাঁচব? আমি যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো মা। আমার যে যাওয়ার মতো আর কেউ রইল না। ও মা, মা? শুনোনা, আমি ত..তোমার পায়ে পড়ি মা! প্লিজ আমার বাবাকে আমার থেকে আলাদা করে দিওনা! আমি বাবাকে ছাড়া এক দন্ডও বাঁচতে পারবো না মা! ও বাবা? বাবা? বাবা উঠো, উঠো তুমি? এভাবে কেন শুয়ে আছো? কেন শুইয়ে আছো? দেখো তোমার নিধি কিন্তু কাঁদছে বাবা! তোমার নিধির খুব ক-ষ্ট হচ্ছে! বাবা? ও বাবা? উঠছো না কেন? তুমি উঠে এই মহিলাকে বলে দাও তো, তুমি কিছুতেই উনার সাথে যাবেনা? তুমি আমার কাছে থাকবে? আমার সাথে থাকবে! সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে। আমায় আগলে রাখবে! বাবা তুমিও যদি চলে যাও তবে আমার কি হবে? তোমার নিধি কি করে বাঁচবে! ও বাবা!! বাবা উঠো! উঠো বাবা উঠো, তোমার মিসেস খানকে জবাব দাও বাবা! কড়া জবাব দিয়ে বলো তুমি শুধু আমার কাছে থাকবে, তুমি উনার সাথে যাবে না! একদম যাবে না! বাবা উঠোওওও (চিৎকার করে)

আমার গলার স্বর আমি আর নিজেই শুনতে পেলাম না! গলা ভেঙে এখন শুধু ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ আসছে। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছি না। আশপাশের সবাই দেখছে আমায়। হয়তো খুব আফসোসও করছে,

—-” হায় রে, এই অ-ভা-গী-র কপালে তো বাপটাও আর রইলো না!”

#চলবে____________________

#প্রেয়সী (২৯)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৫৬.

বাবা মা//রা গেলো আজ ২১দিন। আগের থেকে সব কিছু এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। সবাই সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বার্তা বলতে পারছে। একভাবে দেখতে গেলে আমিও স্বাভাবিক। বাবার দাফনকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে টানা ১৫ টা দিন, নিজেকে একরকম ঘর বন্ধিই করে ফেলেছিলাম। নিজের সাথে কোনো ক্রমেই এমন ঘটনা মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। কি করে মানাবো? ওমন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ টা এভাবে হঠাৎ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে কেই-বা ভেবে ছিলো? বুঝতে তো আমিও পারিনি। কত খুশি ছিলাম ঐ দিনটা। বাবা আসবে, বাবার জন্য কত তোড়জোড় ছিলো আমার! কিন্তু এখন আর সেসব নেই। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে সেই আশা টুকুও যে বাবার কাফনের কাপড়ের সাথে মুড়িয়ে বিদায় করেছি। আর সে আশা করতে সাহস করি না। এ’কদিনে বাবা বেশ ক’বার স্বপ্নে এসেছে। নিজের বিছানায় শুইয়ে শুইয়ে অনেক্ষন গল্প করে গিয়েছে আমার সাথে। আমায় ভালে মন্দ অনেক কথা বলেছে। নিজেকে শক্ত করতে বলেছে। বলেছে, “ভাব না মা যে কিছুই হয়নি! সব কিছু ঠিকাছে?” বাবা বললেও আমি ভাবতে পারলাম না। এখন যে ইচ্ছে করলেই দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারিনা! এখন যে আর চোখের দেখাটুকুও দেখতে পারিনা! তার বেলা?
মনে মনে তো প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, আর কখনোও কাউকে নিজের প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসব না। যাকেই ভালোবাসি সেই হারিয়ে যায়। লোকে তো ঠিকই বলে, আমি অপয়া!

—-” কি রে কি ভাবছিস? চল জলদি? নীচে কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছে।”

বড় খালামনিরা এসেছেন নীচে। বলছেন তো সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাবার শেষ স্মৃতি গুলো থেকে আলাদা হতে যে মন মানছে না। আমি শক্ত চোখে তাকালাম নিতু আপুর দিকে। তপ্ত গলায় বললাম,

—-” আমি কোথাও যাবো না নিতু আপু। তুমি নীচে গিয়ে খালামনিদের বলে দাও। আমি এখানেই থাকব। বাবা কে ছেড়ে আমি কিছুতেই নড়ব না এখান থেকে। আমি চলে গেলে বাবার সব জিনিসপত্র গুলো অবহেলায় পড়ে থাকবে। তাতে বাবা খুব ক/ষ্ট পাবে। প্লিজ আমায় কোথাও যেতে বলো না আপু।”

নিতু আপু গেলো না কোথাও। আমার পাশেই বসে রইল। মুখে ম্লান হাসি তার। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-” তুই না থাকলে চাচার জিনিসগুলো হেলায় পড়ে থাকবে তা তুই ভাবছিস কি করে বলতো? আমি কি তোদের কেউ না হু? আমি কি কিছুদিনের জন্য চাচার জিনিসগুলো যত্নে রাখতে পারব না?”

—-” সেরকম কোনো ব্যাপার নয় গো আপু। আমি আসলে আমার মনটাকেই মানাতে পারছিনা! কি করে যাই বলোতো?”

—-” পা/গ/লি! তুই কি সারাবছরের জন্য যাচ্ছিস নাকি রে? মাত্র কয়টা দিনের জন্যই তো যাবি। আবার চলেও আসবি! এতো কেন ভাবছিস?”

—-” আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে, আমি একবারের জন্য যাচ্ছি ঐ বাড়িতে। আর বোধহয় কখনও ফেরা হবেনা!”

—-” ধ্যাৎ পা/গ/লি। এ আবার কি কথা শুনি? তুই জানিস সামনেই রিম্মি আর আসিফ ভাইয়ের বিয়ে। তাই তো ওরা তোকে নিতে এসেছে। ওখানে কত মানুষ জন থাকবে! কত মজা হবে ভাব? তুই ওখানে গেলে তোর মনটা ঠিক ভালো হয়ে যাবে সোনা। না করিসনা লক্ষীটি। বড় বোনের কথা ফেলিস না! বলছি ওদের সাথে চলে যা। আমিও কিন্তু থাকছি এই বিয়েতে। আমরা খুব মজা করব দেখিস! তোর খুব ভালো লাগবে।”

আমি ছোট্ট করে হাসলাম। নিতুর আপুর দিকে একবার তাকিয়ে লাগেজটা হাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

—-” এখন আর আমার কোনো কিছুতেই ভালো লাগা নেই আপু! আমার সব ভালো লাগা গুলো দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। বাবার মতোন একদিন আমিও হারিয়ে যেতে চাই। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। যদি কখনো সুযোগ হয় তবে বাবাকে বলব, তুমি ভীষণ স্বার্থপর বাবা! ভীষণ স্বার্থপর!”

পেছন মুড়ে আর তাকালাম না। লাগেজ নিয়ে নীচে নেমে আসতেই এগিয়ে এলো ফাহিম ভাইয়া, আর বউমনি। সবার মুখই ভার হয়ে আছে। কারোর মুখে হাসি নেই। সবাই মনমরা। ফাহিম ভাইয়া আমায় একহাতে আগলে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—-” খাওয়া দাওয়া কি একদম বন্ধ? এমন রো-গা হচ্ছিস কেন দিন দিন?”

আমি মেকি হাসলাম। বউমনিও মাথায় হাত বুলালো আমার। ছোট্ট করে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,

—-” অনেক অযত্ন হয়েছে নিজের। এবার রোজ আমি নিজ হাতে তোমায় খাওয়াবো। দেখবো কেমন না খেয়ে দেয়ে দিন কাটাও?”

সবার পেছনে শুঁকনো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন রাহিয়ান। তার দৃষ্টি পুরোটাই আমাতে নিবদ্ধ। যা এদিকেও নড়ছেনা ওদিকেও নড়ছেনা।

বড় খালামনি আর বড় খালু পাশাপাশি বসে আছেন। তাদের পাশেই চাচাও আছেন। তারা কোনো এক বিষয়ে কথা বলছেন। যা আমার কানে স্পষ্ট না। আমি আর খেয়ালও করলাম না তাদের দিকে। কোনো কিছুই এখন আর ভালো লাগেনা। চারপাশটা বাবাকে ছাড়া বড় শূন্য হয়ে আছে। এখন আর কান্না পায়না। তবে, আমার একাকীত্ব বড় দং-শ-ন করে আমায়। মাঝে মধ্যে মনে হয় নিঃসঙ্গতা খুব বাজে ভাবে নিগড়ে নিচ্ছে আমায়। আমার একমাত্র সঙ্গী আমার বাবা। তবে আজ আর নেই। নেই বাবা নেই!

—-” মা, তোমরা কথা বলে এসো আমরা না হয় নিধিকে নিয়ে বের হই?”

রাহিয়ানের মুখ চেয়ে তাকালেন বড় খালামনি। মৃদু হেসে বললেন,

—-” ঠিকাছে যাও। আমরা আসছি খানিক বাদে।”

কথাটা “আমরা” বললেও “আমরা” গেলাম না। আমাকে নিয়ে তিনি একাই বের হলেন। বাকিরা পরের গাড়িতে আসছি বলে বাহানা করে থেকে গেলো। হাতের লাগেজটা তারাই রেখে দিলো নিয়ে আসবে বলে। আমিও আর কিছু বললাম না। চুপচাপ চলে এলাম উনার সাথে। গাড়ি কোন পথ ধরে যাচ্ছে জানা নেই। আমি চুপচাপ করে বসে আছি সিটের সাথে হেলান দিয়ে। দৃষ্টি গাড়ির কাচ ভেদ করে পেছনের দিকে ছুটে চলা ঘাস আর বনের দিকে। উনিও চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন।

—-” পানি খাবে?”

উনার ছোট্ট প্রশ্নে ভাবান্তর হলো না আমার। আমি একই ভাবে বসে রইলাম। জবাবেও কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। উনি হালকা স্বরে কাশলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও বলে উঠলেন,

—-” কোথাও দাঁড়াবে? সামনেই ছোট্ট একটা পার্ক আছে। তুমি চাইলে গাড়িটা ওখানে রাখবো। আজ ওয়দারটা খুব সুন্দর। কিছুক্ষণ বসলে তোমার ভালো লাগতে পারে। বসবে….”

উনি ক্রমাগত কথা বলেই গেলেন। উনার কথা গুলো প্রথম দিকে শ্রবণগোচর হলেও পরে যেন সব হাওয়ায় ভেসে উড়ে যেতে দেখলাম। কিছুক্ষনের মাথায় হঠাৎই উনি গাড়ি থামালেন। গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশে এসে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি কিছুক্ষন তার হাতের দিকে তাকিয়েই রইলাম। উনি বুঝি অধৈর্য্য হয়েই নিজের থেকে আমার হাতটা টেনে নিলেন। আর আমায় অগত্যাই বের হতে হলো। আমি বের হতেই উনি অন্য হাতে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অতঃপর হাতের বাঁধন শক্ত রেখেই সামনের দিকে এগোতে লাগলেন। পরিবেশটা খুব শান্ত, গম্ভীর। কিন্তু মন মাতানো। উনি কিছুদূর এগিয়ে একটা বসার জায়গা দেখে আমাকে বসতে ইশারা করলেন। আমি বসতে বসতে উনি আমার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিলেন। ঠোঁটের কোনে এক চিলতি মিষ্টি হাসি জুড়ে বললেন,

—-” ক্ষিধে পেয়েছে ম্যাডাম? নিতু তো বলল দু’দিন আগে জোর করাতে অল্প কিছু খাবার খেয়েছিলে! আর এই দু’দিনে কেউই তোমায় কিছু খাওয়াতে পারল না! তাই মাকে বলেই চলে এলাম সব ব্যবস্থা করে। কিছু খাবে? তোমার পছন্দের কোনো খাবার? আচ্ছা তোমরা মেয়েরা তো ফুচকা ভীষণ পছন্দ করো? ঐ যে দেখো? ঐদিকটাতে ফুচকা মামাদের ভীড় লেগে আছে। আইসক্রিমও আছে। তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই খাবে। বলো কি খাবে? ফুচকা নাকি আইসক্রিম? এই মেয়ে, এভাবে চুপচাপ আর কতদিন থাকবে বলোতো? তোমার এই চুপচাপে যে কারো বুকের র-ক্ত-ক্ষ-র-ন দিগুণ হারে বৃদ্ধি পায় তুমি জানো কি সে কথা? তোমার এই মলিন মুখটা দেখলে যে কারোর শ্বা-স-ক-ষ্ট হয়! নিঃশ্বাস আঁ-ট-কে যায়! এতো চাঞ্চল্য যার স্বভাব তার নিরবতায় যে প্রকৃতিও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে! পৃথিবীও তার সব নিয়ম কানুন ছেড়ে কেমন গুমরে ম-র-ছে দেখোনা একবার? এই নীলাদ্রিতা? তাকাও একবার? শোনো আমার কথা, মানুষের জীবনটা কিন্তু খুব বেশি সুন্দর তবে নিজেদের ইচ্ছে মতো নয়! প্রকৃতির ইচ্ছে মতো। তুমি সারাদিনে এই নিজের জীবনটাকেই অসুন্দর বলে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করে ম/রে যাবে। কিন্তু সেই তুমিই দেখবে কখনও না কখনও ঠিক বলে উঠবে, জীবনটা কত সুন্দর! আজ ছোট খালু আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বলে কিন্তু কারোর দিন ঠেকে নেই। সবাই নিজের মতো সবটা মানিয়ে নিয়ে আবারও আগের মতো হয়ে উঠেছে। তবে তার ছোট্ট মেয়েটা কেন তা পারছেনা? কেন বাবার কথা ভেবে শুধু ক-ষ্ট-ই পেয়ে যাচ্ছে হু? বাবা কি তার মেয়েকে এই শিখিয়েছে হ্যাঁ? যে কোনো ছোট খাট ধাক্কা তার মেয়েকে মাঝপথেই পথভ্রষ্ট করে দিবে? আমার তো মনে হয় ছোট খালু তার মেয়েকে এত সহজে ভে-ঙে পড়তে শেখায়নি। আরে সে তো কখনও কাঁদতেই শিখেনি। কত বড়বড় ঝড় সে একা হাতে হ্যান্ডেল করে ফেলেছে তবে আজ কেন এভাবে চুপচাপ হয়ে আছে। কেন লড়াই করছেনা মনের বিরুদ্ধে? কেন নিজেকে এতটা অসহায় ভাবছে? কেন ভাবছে সে একা? সে কেন ভাবছে তার আপন বলতে আর কেউ রইল না? বলো?”

আমি মুখ তুলে তাকালাম উনার দিকে। উনার চোখজোড়া টাটকা জলে চিকচিক করছে। উনার ডার্ক রেড ঠোঁট জোড়াও মৃদু কাঁপছে। আচ্ছা উনারও কি ক-ষ্ট হচ্ছে? বাবা হারানোর ক-ষ্ট? সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টাকে হারানোর ক-ষ্ট? যাকে ছাড়া তার কোনো শুভ কাজের সূচনা ঘটে না তাকে হারানোর ক-ষ্ট? হয়তো হচ্ছে আবার হচ্ছে না! কিন্তু আমার ভীষণ ক-ষ্ট হচ্ছে!! আমার বাবাকে হারিয়ে আমার ভীষণ ক-ষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কান্না পেতে লাগল। গলার কাছে তীক্ষ্ণ ব্যা-থা-য় গোঙানির আওয়াজ বের হতে লাগল। উনি আমার অবস্থা দেখে আমায় বুকের সাথে চেপে ধরলেন। মাথায় কপালে বারবার হাত বুলাতে লাগলেন। আমায় নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন,

—-” কিচ্ছু হয়নি! সব ঠিকাছে্! কিচ্ছু হয়নি। এই মেয়ে, এতো কেন ক-ষ্ট পাচ্ছ হ্যাঁ? আমি আছি না?? আমি থাকতে তোমার কোনো ক-ষ্ট-ই হতে পারেনা। কখনও না।”

৫৭.

রিম্মি আপুর গায়ে হলুদের তোড়জোড় চলছে সারা বাড়িময়। মেহমানদের আনাগোণায় গিজগিজ করছে বাড়ি। কাজের এতো চাপ যে সময় একটু দম ফেলারও জো নেই কারও। আমিও এসবের মাঝেই নিজেকে পুরোপুরি ব্যস্ত করে ফেলেছি। সারাদিন সবার সাথে খুনসুটি,হাসি মজায় সবাই আমাকেই পাবে। বলতে গেলে এমন পরিবেশে সব থেকে আমিই বেশি খুশি। সবার সাথে ঘুরেফিরে কাজে সাহায্য করা, আড্ডা দেওয়া, মজা করা সব কিছুতেই আমি। বিয়েতে রাইকেও দাওয়াত করা হয়েছে। উনি নিজে গিয়ে রাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে আমার খুশির জন্য। এখন আপাতত আমাদের দুই বান্ধবীর হই হুল্লোড়ই বাড়ি মাথায় তুলে নাচানাচি হচ্ছে।

রিম্মি আপুর হলুদের সব আয়োজন করা হয়েছে গার্ডেনে। সুবিধা মতো পাশেই সুইমিংপুল আছে। সব ঝামেলা ওখানে থেকেই চুকিয়ে নেওয়া যাবে।

—-” উহুম উহুম…”

লণ্ডভণ্ড করে শাড়ি পড়ছিলাম। আচমকা কারোর গলা পেতেই চমকে উঠে শাড়ির কুঁচি গুলো ছেড়ে দিলাম। এই অসময় জ্বা/লা/নো/র মানুষ গুলো যে কোত্থেকে টকপে পড়ে কে জানে?”

পেছন মুড়ে তাকাতে তাকাতে সামনে এসে দাঁড়ালেন
ভ/য়ং/ক/র রূপি কেউ। আমি পেছনের দিকে তাকিয়ে কারোর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে সামনে তাকাতেই তার মুখটা ভেসে উঠল। আঁ-ত-কে উঠে পেছনে হেলে পড়তেই কোমরে হাত চেপে শক্ত করে ধরে নিলেন তিনি। আমার চোখ জোড়া চড়কগাছ! এমন সময় উনি এখানে কেন? কেউ দেখে ফেললে কি কে/লে/ঙ্কা/রি যে হবে!

—-” আপনি!”

—-” হু আমি!”

—-” এখানে কি করেন?”

—-” ইচ্ছে ছিলো রোমান্স করবো, কিন্তু এই কিছুক্ষন আগেই নীচ থেকে শুনে এলাম বিয়ের আগে নাকি এসব করা ঠিক না। প্রকৃতি রু-ষ্ট হবে।”

আমি মুখ কুঁচকে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম,

—-” কোনো কালেই এসব করা ঠিক না বুঝেছেন। আপনি এখন বের হন এখান থেকে। দেখুন আমার শাড়ির কি দশা। আর এই অবস্থায় আপনার এসব প্যাঁচাল শোনার একটুও মুড নেই আমার। শাড়ি পড়ে জলদি করে নিচে যেতে হবে। খালামনি ডেকেছে আমাকে। কিছু বলবে বলছিলো?”

—-” এখনও খালামনি হ্যাঁ? মা কবে ডাকবে শুনি?”

—-” যখন সময় হবে তখন ডাকব।”

—-” সময় তো আরও সপ্তাহ খানিক আগেই হয়ে গিয়েছে নিধু। তবুও কেন?”

—-” সপ্তাহ খানিক আগে কি হয়েছে?”

আমার প্রশ্নে উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকাতেই উনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে। পূর্বের ন্যায় আমার কোমরে হাত রেখে হঠাৎ কাছে টেনে নিলেন। আমি বড়বড় চোখ করে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,

—-” এমন রিয়াকশন দিচ্ছ যেন পাশের বাড়ির ছখিনা বিবিকে ধরেছি। আরে বাবা নিজের বউকেই তো ধরেছি! এমন করছ কেন?”

—-” ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন জনাব আমি এখনও আপনার বউ হইনি! কেবল আমাদের এনগেজমেন্ট হয়েছে। তাও সেভাবে নয়। সো, যেদিন সাত কলেমা পড়ে তিনবার কবুল বলব সেদিন থেকে হবো আপনার বউ। বুঝেছেন? এবার ভাগুন তো জলদি। আমাকে শাড়িটা পড়তে দিন। ওদিকে লেট হচ্ছে!!”

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। উনি মুখে না বললেও উনার চোখ জোড়া বলছে উনি কোনো দুষ্টবুদ্ধি পাকাচ্ছেন। পরনে হলুদ পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কনুই বরাবর রেখে বেশ ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” শাড়ি পড়ায় আমি তোমায় কিছু হেল্প করি? আমার মনে হচ্ছে তোমার শাড়িটা পড়তে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। আমি তোমায় হেল্প করলে আই থিংক তোমার সুবিধাই হবে কি বলো?”

কথাটা বলেই মুচকি হেসে চোখ টিপলেন উনি। আমি হা করে উনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,

—-” আপনি তো ভারি অ-স-ভ্য লোক। আপনি এক্ষনি বের হবেন এখান থেকে। আমি আর একটা কথাও বলতে চাইনা আপনার সাথে। বের হন বলছি জলদি!”

আমার লজ্জায় ডেবে যাওয়া কন্ঠে উনি হেসে উঠলেন। বের হয়ে যাওয়ার অভিনয় করে আবারও এগিয়ে এলেন আমার কাছে। আমার মুখোমুখি হয়ে আমার দু’গালে হাত রেখে গাঢ় কন্ঠে বলল,

—-” লজ্জা পেলে তোমার গাল দুটো একদম লাল টমেটো হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে তো রসগোল্লার মতো লাগে। ইচ্ছে হয় টুপ করে গিলে খেয়ে নেই। অধিকার অবশ্য আছে। তবে শুধু সময়ের অপেক্ষা। অপেক্ষা করছি, সময় মতো সব কিছু আদায় করবো ম্যাডাম।”

উনার কথা গুলোতে বুকের ভেরতটায় অনবরত ধকধক করে যাচ্ছে। ভেতর থেকে যেন কেউ স্ব জোরে ঢোল পিটিয়েই চলেছে। লজ্জায় মাটি দু’ভাগ করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। ভুল ক্রমেও উনার চোখের দিকে তাকাতে পারছিনা! উনি হাসলেন ছোট্ট করে। আমাকে আর লজ্জায় না মে/রে কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বললেন,

—-” জলদি এসো নীচে। সবাই অপেক্ষা করছে।”

কথাটা বলে নিজেও চলে গেলেন নীচে। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে মুচকি হেসে শাড়ি পড়ায় মনোযোগ দিলাম।

#চলবে____________________