প্রেয়সী পর্ব-৩০+৩১

0
254

#প্রেয়সী 🤎(৩০)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৫৮.

হলুদে হলুদে পুরো বাড়ি এখন হলুদময় হয়ে আছে। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই হলুদ। চোখেও এখন শষ্যে ফুল দেখছি। কেননা সেটাও হলুদ। এত হলুদ আর হলদেটে ভাবের মধ্যে নজর কাড়ল একটি মেয়ে। সে এই হলুদের নিয়ম ভঙ্গ করেই টকটকে লাল একখানা গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে। সুইমিং পুলের পাশে দাঁড়িয়ে কাউকে একটা ফোন করছে। দেখে বেশ রা-গা-ন্বিত লাগছে। তার রা-গ-টা আসলে কিসের জন্য সেটা নিরীক্ষণ করতেই হলুদের বাটি হাতে এগিয়ে গেলাম আমি। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দরী। এমনি ভীষণ ফর্সা তার উপর রোদের প্রখরতায় তার সাদা গাল দুটো র-ক্তি-ম হয়ে উঠেছে। তাই এখন দেখতে আরও বেশি কিউট লাগছে। বয়সটা বোধ করি আমার কাছাকাছি বা বড়ও হতে পারে। আজকাল চেহারা দেখে বয়স বিচার করা একদমই সম্ভব হয় না। মেয়েটার রা-গে-র সাথে সাথে বিরক্তিটাও ধাপ দিয়ে বেড়ে চলেছে। কারনটা হয়ত আমি বুঝতে পারছি।

—-” হাই আপু। এতো রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো? ঘেমে-নেয়ে তো একাকার হয়ে যাচ্ছো?ভেতরে যাবে?”

আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই মেয়টাকে দু-চারটে প্রশ্ন একসাথেই করে ফেললাম। মেয়েটা ব্যাপারটা কিভাবে নিলো বোঝা গেলো না। সে আমার দিকে তাকিয়ে আমার পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলালো। অতঃপর মেয়েটা মৃদু হেসে বলল,

—-” নিধি.. রাইট?”

আমার স্বাভাবিক ভঙ্গিমা এবার অস্বাভাবিক হলো। কপালের মাঝে এসে জুটল অসংখ্য ক্ষুদ্র ভাজ। আমি বিরস মুখে বললাম,

—-” তুমি আমায় চেনো?”

মেয়েটা বিগলিত হাসল। মাথা নেড়ে বলল,

—-” হু খুব ভালো করে।”

আমি ভাবনায় আঁটকে গেলাম। মেয়েটা যেহেতু আমাকে খুব ভালো করে চিনে সেহেতু আমারও কি তাকে চেনাটা খুব জরুরি ছিলো না?

আমি মৃদুস্বরে বললাম,

—-” আচ্ছা আচ্ছা। আপু ভেতরে এসো না। এখানে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তো ড্রেসের মতোই লাল হয়ে উঠেছো। তোমার সাথে কি আর কেউ এসেছে?”

আমার শেষ প্রশ্নে মেয়েটার বিগলিত হাসির ইতি ঘটল। মেয়েটা হঠাৎই ভীষণ রে-গে গেলো। একপ্রকার ক্ষে-পা গলায় বলল,

—-” আমি একাই এসেছি। তবে যার জন্য এসেছি তাকে বাদে এক এক করে সবার সাথে দেখা হয়ে গেলো।”

—-” কার জন্য এসেছো? তুমি কি রিম্মি আপুর বান্ধবী? ইশশ, আগে বলবে না? আর ওখানে একা একা কেন দাঁড়িয়ে ছিলে? কাউকে না চিনলে তো ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতে?”

মেয়েটা জবাবে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। আমার সাথে সাথেই পা চালিয়ে রুক্ষ স্বরে বলল,

—-” না গো। রিম্মির আপুর বান্ধবী নই। রিম্মি আপুর ভাইয়ের বান্ধবী আমি। ও আমাকে ইনভাইট করে ডেকে পাঠিয়েছে। অথচ দেখো ওকে বাদে সারা দুনিয়ার লোকের সাথে দেখা হয়ে গেলো। এমনকি তোমারও দেখা পেলাম। অথচ ঐ অ-স-ভ্যে-র দেখা মিলল না।”

আমি হেসে উঠলাম মেয়েটার কথায়। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ! খুব রা-গ হচ্ছে তো ওর উপর তাই একটু…”

আমি মৃদু হেসে আস্বস্ত করলাম মেয়েটাকে। না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,

—-” সমস্যা নেই আপু আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা।”

—-” তুমি কিন্তু সত্যি ভীষণ কিউট নিধি। ফাহিম আমাকে সবসময় তোমার কথা বলে। ওর সাথে যখন কথা হবে তখনই নিধি এই করেছে,নিধি ঐ করেছে এটা সেটা বলতে বলতে কানের পোকা বের করে দেয়। ওর থেকে তোমার কথা শুনতে শুনতে একদম মুখস্থ করে ফেলেছি।”

কথাটা বলেই মিষ্টি হাসল মেয়েটা। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

—-” আমার ভাইটা আমার কথা বলে তোমায় খুব বিরক্ত করে তাই না?”

মেয়েটা গোলগাল চোখ পাকিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে হাসল। আমার গালে হাত রেখে বলল,

—-” একদমই নয়। আমি তো বলব তোমার ভাই তোমার প্রশংসা আমার কাছে একটু কমই করে। তোমার মতো আমার একটা বোন থাকলে আমি হয়তো ওর থেকেও বেশি বেশি বলতাম।”

—-” এতো হাওয়া দিওনা না গো। পরে দেখবে বেলুনের মতো ফুলে উঠে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি!”

মেয়েটা হেসে ফেলল ফিক করে। আমি তাকে বসতে ইশারা করে বললাম,

—-” সরি টু সে ফাহিম ভাইয়া বাসায় নেই। দুই ভাই মিলে একটু বেরিয়েছে। মেঝ খালু, মানে ফাহিম ভাইয়ার বাবার খুব কাছের একজন বন্ধু আছেন। শুনেছি উনি ভীষণ অ-সু-স্থ। বিয়েতে আসতে পারবেনা বলে না করে দিয়েছেন। তাই মেঝ খালুর ক’টা দিন ধরে খুব মন খারাপ। আর তাই তারা দুই ভাই খালুকে কিছু না জানিয়েই তাকে নিতে চলে গেছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে হয়তো চলেও আসবেন তাকে নিয়ে। তুমি প্লিজ রে-গে থেকো না আমার ভাইটার উপর। কারন আমার ভাইটা কিন্তু ততটাও কেয়ারলেস নয় বুঝলে?”

মেয়েটা মাথা নীচু করে মুচকি হাসলো। আমি আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললাম,

—-” আপু তুমি দু’মিনিট বসো আমি তোমার জন্য একটু জুস নিয়ে আসি। তুমি অনেক্ষন রোদে বসে ছিলে। নিশ্চয়ই গলা শুঁকিয়ে গেছে। একটু জুস খেলে ফ্রেশ লাগবে।”

আমি উঠতে নিলেই মেয়েটা বাঁধ সাধল। বলল,

—-” কোথাও যেতে হবেনা তোমায়। তুমি বসো তো।”

—-” একটু জুস নিয়ে আসতাম?”

—-” উঁহু, লাগবে না। আমি ঠিকাছি। আমরা বরং একটু গল্প করি কি বলো?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,

—-” সে না হয় করছি কিন্তু মেহমানকে এভাবে খালি মুখে বসিয়ে রাখতে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে আপু। তুমি একটু বসো আমি যাবো আর আসব।”

” নিধি কি করছ গো? মা ডাকছে তোমায়?”

বউমনির গলা ভেসে আসতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম দু’জনেই। বউনি প্রথমে মেয়েটাকে খেয়াল না করলেও হঠাৎ দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি হাসি মুখে বললাম,

—-” বউমনি এটা হলো আমাদের ফাহিম ভাইয়ার ফ্রেন্ড। আপু, এই হলো আমাদের সবার একমাত্র বউমনি।”

দু’জনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। বউমনি বলল,

—-” আই থিংক আমি তোমাকে চিনি।”

মেয়েটা লজ্জামিশ্রিত হেসে বলল,

—-” হু।”

—-” তুমি হিয়া তাইনা?”

মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই আমারও চোক জোড়া গোলাকার হয়ে এলো। আমি হিয়ার আপুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

—-” তুমিই সেই হিয়া আপু। মানে ফাহিম ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড।”

হিয়া আপু এবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। জবাবে কিছু বলতে নিলেই আমি তীক্ষ্ণস্বরে বললাম,

—-” তাহলে এতক্ষণ কেন বললেনা আমায়? আমি তো আরও ভাবলাম তুমি ভাইয়ার কমন ফ্রেন্ড বা কিছু।”

হিয়া আপু মৃদুস্বরে বলল,

—-” আমি তো তোমার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছি আমি কার ফ্রেন্ড আর কার গার্লফ্রেন্ড!”

হিয়া আপুর কথায় হেসে ফেললাম আমি আর বউমনি। বউমনি আমার কাছে এসে আমাকে আগলে ধরে বলল,

—-” খুবই স্বাভাবিক হিয়া। আমাদের এই মেয়েটা এতো ভীষণ সুইট যে সবাই তার কথার ফাঁদে পড়ে সব ভুলে যায়।”

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,

—-” হু বলেছে তোমায়। আমি মোটেও সুইট নই আর হিয়া আপুর মতে কিউটও নই। দেখো, তোমরা দুজন কত কিউট দেখতে। দেখলে যেন সারাজীবন দেখতেই ইচ্ছে করবে।”

হিয়া আপু আমার দিকে এগিয়ে এসে আস্তে করে বলল,

—-” কে বলল এই কথা? আমি তো শুনেছি, রাহিয়ান ভাইয়া এই মেয়েটাকে হারানোর ভ-য়ে সারাদিন কেবল হু-ম-কি-র উপরই রাখে, এই ছেলের সাথে কথা বলবে না! ঐ ছেলের সাথে কথা বলবে না! এই ছেলে কিছু বললে ফিরে তাকাবে না! ঐ ছেলের থেকে একশ হাত দূরত্ব রেখে চলেবে! যার বউয়ের প্রতি এতো কেয়ার সে বউ কিউট আর সুইট না তো কি বলোতো?”

এই দুজন মিলে এখন আমায় লজ্জায় ফেলার ফন্দি আঁটছে। আমি নড়েচড়ে উঠে বললাম,

—-” খালামনি আমায় ডাকছে না? আমি য..যাই তার কাছে।”

কথাটা বলেই কোনো মতে বেরিয়ে এলাম তাদের ছেড়ে। পেছন থেকে অবশ্য তাদের হাসির শব্দ হাওয়ার সাথে তাল খেলে ভেসে আসছিলো।

৫৯.

গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন রাহিয়ান। রে-গে আছেন নাকি ক্ষে-পে আছেন বোঝা যাচ্ছে না। ছেলের হঠাৎ এতো গম্ভীরতা খালামনি ধরতে না পেরেই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন সিং-হে-র গুহায়। আমি এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর উনি বেডের উপর মাথা চেপে বসে আছেন। এই নিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছি কি হয়েছে? কিন্তু বান্দা মুখ খুলছে না। উনার রা-গ-টা বরাবরই খুব বেশি। হঠাৎ এমন ভ-য়ং-ক-র ভাবে রে-গে যান যে বড় খালামনিও ছেলের ধারে কাছে ঘেঁষতে ভ-য় পান। রিম্মি আপুর হলুদের সব নিয়ম শেষ হলো ঘন্টাখানিক পেরিয়েও গেলো। ফাহিম ভাইয়া আর উনি মেঝ খালুর বন্ধু খোরশেদ আলম সাহেবকে নিয়ে এসেছেন আরও দু’ঘন্টা আগে। খোরশেদ আলম সাহেব আপাতত বিয়ের ক’টা দিন আমাদের সাথেই থাকবেন বলে স্থির করল মেঝ খালু। হিয়া আপু আর ফাহিম ভাইয়া একসাথেই বের হলো হলুদ শেষ হতে। সবাই এখন যার যার রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। আমার একান্ত ব্যক্তিগত রুমটা দখল হয়েছে ফাহিম ভাইয়ার দাদা বাড়ি গোষ্ঠীর আণ্ডাবাচ্চা দিয়ে।

মোটমাট আটজন থাকবে ঐ রুমে। এখন আমার থাকার জায়গা ঠিক কোন রুমে হবে আমার নিজেরও অজানা। খানিক্ষন আগে কেশব এসেছিলেন। ভালো ভালো বক্তব্য দিয়ে গেলেন আমার আর রাহিয়ানের আগামি জীবন নিয়ে। কথা গুলো শুনতে ভালো লাগলেও হজম করতে পারেননি রাহিয়ান। কেশব একটা ঝা-মে-লা পাকাবে বলে তার ধারনা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, কেশব ঝা-মে-লা পাকালেও বা কি লাভ? রাহিয়ানের হাতে একটা ঘু-ষি খেলেই উনি জায়গায় ফিট হয়ে যাবে। অযথা ঝা-মে-লা করে নিজেই ঝা-মে-লা-য় পড়ার কোনো মানে আমি দেখছি না। সব ভাবনাগুলো একত্রে শেষ করেই গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। উনার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

—-” আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? আমি কি আপনার জন্য একটু লেবুর শরবত করে আনবো? নাকি আদা দিয়ে চা করে আনবো? দু’টোতেই আশা করি উপকার হবে।”

—-” না! আমার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে মায়ের রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। সারাদিন অনেক কাজ বাজ করেছো। নিশ্চয়ই শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে।”

গম্ভীর স্বরে জবাব এলো উনার। আমি ছোট্ট করে হাসলাম। আস্তেধীরে তার পাশে গিয়ে বসে তার কাঁধে হাত রাখলাম। মৃদুস্বরে বললাম,

—-” খুব বেশি চিন্তিত? আচ্ছা বলুন তো পৃথিবীতে কি এমন ভ-য়া-ন-ক ব্যাপার ঘটে গেলো যে আপনি চিন্তায় মুখই তুলতে পারছেন না? হয়েছে টা কি একবার বলা যায় না হু? যা ঘটেছে তা শুনলে কি ফিট খাবে নিধি?”

উনি সোজা হয়ে বসে আমার মুখ চেয়ে ম্লান হাসলেন। আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় বন্ধি করে নিয়ে বললেন,

—-” যা ঘটেছে তা পুরোটা আমিও জানিনা। তবে এটুকু জানি তার পুরোটা জানলে পরপর অনেক গুলো লা-শ পরবে।”

আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়ল। আমি থমকানো গলায় বললাম,

—-” কি বলছেন এসব?”

উনি কোমল শান্ত চাহনি দিয়ে বললেন,

—-” তুমি,
ভাদ্রের আকাশের উড়ো চিঠি,
মিটমিট হেসে ভেসে চলা শুভ্র মেঘ,

তুমি,
এলোমেলো চাওয়ায় পিতল হৃদয়
শীতল করা দখিণা হাওয়া~~

তুমি,
পালতোলা নৌকায় চলা বহুদূর
মোহিত করা আশ্বিনের ঘন কাশফুল।

তুমি, প্রেয়সী~~~ হে মোর প্রেয়সী!

(প্রেয়সী 🥀অংশবিশেষ)

আমি কপাল খানা কুঁচকে ফেললাম তৎক্ষনাৎ। প্রথমে হুমকি পরক্ষনেই শান্ত ভঙ্গিতে কবিতা আবৃত্তি! আমি বুঝিনা এই মানুষটাকে। কখন কি যে করে আর কখন কি যে বলে সত্যি বুঝতে পারিনা!

উনি হঠাৎ তার মাথার সিল্কি চুলগুলোকে হাতের ন্যায় আচঁড়ে দিতে দিতে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলেন,

—-” এভাবে কি দেখছো? হঠাৎ প্রেমে পড়লে না কি আমার? মাই গুডনেস, নীলাদ্রিতা কি তবে রাহিয়ানের প্রেমে পড়েই গেলো? এই কে কোথায় আছো দেখে যাও শুনে যাও…”

আমি লাফ মে/রে উঠে গেলাম উনার কাছ থেকে। উনার ছেলেমানুষী দেখে উপরে উপরে রা/গে ফেটে পড়লেও ভেতরে ভেতরে হাসিতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আমি তেতে উঠে বললাম,

—-” নীলাদ্রিতার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তাই না? পৃথিবীতে এতো এতো ছেলে থাকতে সে কিনা প্রেমে পড়বে এমন একজন একরোখা মানুষের। যে কিনা সারাদিন হু/ম/কি/ধা/ম/কি দিয়ে ভালোবাসে। আমার বয়েই গেছে আপনার প্রমে পড়তে! আমি তো প্রেমে পড়ব হুমায়ুন আহমেদ স্যারের মতো মানুষের। যে তার প্রেয়সীকে ভেবে উপন্যাসের গোটা গোটা অসংখ্য বই লিখে ফেলবে! যার কাছে তার প্রেয়সীর প্রশংসার শেষ থাকবে না! যে কিনা শুধু তার প্রেয়সীকেই ভাববে!তাকে ভাবতে ভাবতে একসময় ম/রেও যাবে।”

—-” ম/রে যাবে?”

—-” নাআ.. না মানে ম/র/বে না! বেঁচে থাকবে। অজস্র বছর বেঁচে থাকতে চাইবে তার প্রেয়সীর জন্য।”

উনি মুচকি হেসে উঠে এলেন। আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল ভেদ করে পেটের উপর হাত রাখতেই কেঁপে উঠলাম আমি। উনার থেকে ছাড়িয়ে আসতে নিলেই আরও শক্ত করে জড়িয়ে দাঁড়ালাম উনি! অতঃপর আমার কাঁধে উপর মুখ রেখে আস্তে করে বলতে লাগলেন,

—-” সবাই তার প্রেয়সীর সাথে অজস্র বছর বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু আমি চাই ম/র/তে! নি-ষ্ঠু-র-তা-য় ছাপিয়ে যাওয়া এই পৃথিবীকে ছেড়েছুড়ে তোমায় নিয়ে এমন এক জায়গায় বাস করতে চাই যেখানে মানুষ একবার গেলে আর কখনও ফিরে আসে না। যেখানে জন্ম আছে তবে মৃত্যু নেই। সেখানে সুখ আছে কিন্তু দুঃখ নেই। আমি তোমায় সেখানে নিয়ে যেতে চাই প্রেয়সী। যাবে আমার সাথে?”

মানুষ টা বড্ড অদ্ভুত রকমের কথা বলছে। বুকের ভেতর কাঁপছে উানর কথায়। ভ/য় লাগছে! আবারও কি কিছু খারাপ ঘটতে চলেছে আমার জীবনে? আবারও কি কোনো প্রিয়জনকে হারাতে হবে?

পেছন থেকে আমার খোলা চুল গুলোকে পাশে সরিয়েই ঘাড়ে মুখ ডুবালেন রাহিয়ান। আমি কেঁপে উঠে তার থেকে দূরত্ব করতে নিলেই কোমর চেপে আরও কিছুটা লেপ্টে নিলেন নিজের সাথে। ভ-য়া-ন-ক অনুভূতিতে দম ব-ন্ধ হয়ে এলো আমার। শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় উনার ছোঁয়ায় কিলবিল করে উঠলো র-ক্ত। ভালো লাগায় চোখ জোড়া আপনাআপনিই ব-ন্ধ হয়ে গেলো আমার। উনি ঘাড় থেকে মুখ তুলে আমার চুল গুলো আবারও ছেড়ে দিলেন আমার পেছন দিকে। চুল গুলোর মাঝেই উনার কোমল ঠোঁটে চুমু খেয়ে গাঢ় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। নিজের অনুভূতি গুলোকে আঁটকে নিয়েই মৃদুস্বরে বললেন,

—-” আম সো স্যাড নীলাদ্রিতা। প্লিজ ডোন্ট লিভ মি! আই লাভ ইউ সো মাচ।”

আমার সারা শরীর শিউরে উঠল তার কন্ঠে। কিছু বলতে নিলেই উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। কাঁধ থেকে হাত জোড়া তুলে আমার দু’গালে আলতো করে রাখতেই আমি আরেকদফা কেঁপে উঠলাম। মনের ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজ গুলো হয়তো উনিও শুনতে পাচ্ছেন। অনুভব করতে পারছেন। তাই আমাকে আর অস্বস্তি তে না ফেলে কপালের মাঝে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিলেন বুকে। উনার বুকে মাঝে মাথা রাখতেই কান খাড়া হয়ে গেলো আমার। উনার বুকের মাঝের ঢিপঢিপ শব্দ যে আমার অনুভূতিকেও হার মানাবে। কান পেতে এই শব্দের সাক্ষী হতে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করল। তাই আমিও দুহাতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম তাকে। না চাইতেও মনটা ফাল পেড়ে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,

—-” ভালোবাসি।”

উনি বুঝি প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তৎক্ষনাৎ উনার হাতের বাঁধন টুকু আরেকটু শক্ত হলো।

#চলবে____________________

#প্রেয়সী 🤎🥀(৩১)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৬০.

সকাল থেকেই মনটা ভীষণ খচখচ করছে আমার। মনে হচ্ছে আজ বিয়ে উপলক্ষে মানুষগুলো একটু অতিরিক্তই মাতামাতি করছে। ঘড়ির কাটা ৯টার ঘরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাতিরেকেই ৯টার ঘরে তার অস্তিত্বের জাগরন ঘটবে। ঠিক সাড়ে আট টার দিকেই ফাহিম ভাইয়ার ছোট চাচার ছেলে জিতু আ-গু-ন লাগিয়ে দিলো সিড়ির কাছটাতে। মজার ছলে দিয়াশলাই নিয়ে আ-গু-ন খেলতে খেলতে সিঁড়িতে সাজানো ঝুলিয়ে রাখা পর্দায় ধাপ দিয়ে আ-গু-ন ধরে গেলো। যার জন্য প্রস্তুত ছিলো না উপস্থিত কেউ! বেচারা ভ-য়ে গুটিশুটি মে-রে ডাইনিং টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ল। আর তাদের সঙ্গী সাথীরা যে যেখানে পারল লুকিয়ে পড়ল।

এই আণ্ডাবাচ্চােদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলো তৈশি আপুর মেয়ে রাফামনি! তৈশি আপু রিম্মি আপুর ফুপুুর মেয়ে। বছর ছয় আগে বিয়ে হয়েছে। তার একমাত্র কন্যা রাফামনি। বয়স বোধকরি ৪ হবে। সবার উঠেপড়ে দৌড়ে পালানো দেখে ও হতভম্ব হয়ে ওখানেই বসে রইল! আমি সিঁড়ির পাশ থেকেই গতকালের রং খেলার রং গুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম বাইরে ফেলার উদ্দেশ্যে। এমন সময় নাকে কিছু পো-ড়া-র গ-ন্ধ পেতেই দেখি সিঁড়ির গোড়ায় এমন দশা। বেচারি রাফমনি দাঁড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে আর আ-গু-নে-র তী-ব্র-তা পর্যবেক্ষণ করছে। বারে বারে মাকে ঠোঁট ফুলিয়ে ডেকেও উঠছে। আগুন ওর থেকে সামান্যই দূরে ছিলো। আমার আসার আর কিছুক্ষণ দেরি হলে ওর গায়ে লেগে যেতেও সময় নিতো না। আমি হাত থেকে সব ছুঁড়ে ফেলেই দৌড়ে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। আগুন দেখলেই আমার বড্ড গা গোলায়। রোগটা মায়ের থেকে পাওয়া। মায়েরও নাকি আ-গু-নে ফো/বি/য়া ছিলো!

গলা ফাটিয়ে কাউকে ডাকার বদলে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম রাফামনিকে নিয়ে। কথায় আছে বিপদের সময় কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা! তেমনই ঘটল। আ-গু-ন বাড়তে লাগল অথচ আমি আর রাফামনি বাদে একটা মানুষও নেই আশেপাশে। রাফামনি আমার গলা জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে লাগল। চোখের সামনে আ-গু-নে-র তেজ বাড়ছে! কিন্তু থামানোর জন্য কাউকে পাচ্ছি না।

আমাকে আর রাফামনিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ডাইনিং টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো জিতু। দৌড়ে এলো আমাদের দিকে। আমি ওকে দেখতে পেয়ে ওর দিকে হাত তুলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম কাউকে ডেকে আনতে! ও আর এগোলা না আমাদের দিকে। দৌড়ে গেলো বাইরে। গলা ফাটিয়ে সবাইকে জানান দিলো ঘরের মধ্যে সিঁড়িতে আ/গু/ন লেগেছে! ওর কথাতেই সবাই এক দৌড়ে এসে হাজির হলো। সিঁড়ির পাশেই আমাকে আর রাফামনি পড়ে থাকতে দেখে অর্ধেক মানুষ আমাদের কাছে দৌড়ে এলো। তৈশি আপু কেঁদে ফেললেন মেয়ের কান্না দেখে। মেয়ের কোনো জখম হয়েছে কিনা সেই দুশ্চিন্তায় হাস ফাঁস করতে লাগলেন তিনি। আমাকে রাহিয়ান আর রাই ধরল। নিজের শরীরের ভার নিজেরই বহন করতে ভীষণ ক-ষ্ট হচ্ছে। কম্পিত হাতে রাহিয়ানের হাতটা চেপে ধরতেই উনি জড়িয়ে ধরলেন আমায়। অস্থির কন্ঠে সান্ত্বনা দিতে দিতে জানতে চাইলেন আমি ঠিকাছি কিনা!

আগুন নেভালেন আরফান ভাইয়ারা! সিঁড়ির একপাশেই সব ফুল,পর্দা খুলে আবারও নতুন করে লাগানো হলো। এখন সব ঠিক আছে। আধঘন্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা আর কেউ মনে রেখে বসে নেই। আবারও আগের উৎসাহে মেতে উঠেছে সবাই! একমাত্র আমিই স্বাভাবিক নই ওমন ঘটনার পর! ভেতরটা কেমন থেকে থেকেই কাঁপছে আমার! আবার কোনো অনাচারের পূর্বাভাস পাচ্ছি! কিন্তু মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি আর যেন কোনো অ/ঘ/ট/ন না ঘটে! সবটা যেন ঠিকঠাক ভাবে মিটে যায়।

—-” ন’টা বাজে। এখনও কিছু খেলিনা! রাহিয়ান ভাইয়া জানতে পারলে কিন্তু খুব বকবে নিধু!”

রাইয়ের মুখ ভার! কি জানি কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করায় বলেছিলো সব ঠিকাছে! রূপ ভাইয়া বিয়েতে আসেননি! শুনেছিলাম সে পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছে! নিশ্চয়ই সেই বিষয় নিয়েই মেয়েটার মন খারাপ! আমি জানালা ছেড়ে সরে এলাম। বিছানার উপর বসতে বসতে রাই মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানার চেষ্টা চালালো। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,

—-” রূপ ভাইয়ার সাথে ঝা/মে/লা কি করে পাকালি? ছেলেটা তো এতটাও ঝ/গ/ড়ু/টে টাইপ নয়!”

রাই তাচ্ছিল্য করে হাসল। কথা ঘোরানোর তালে বলল,

—-” উঠেছিস সেই ভোর ছ’টায়। রাহিয়ান ভাইয়া অনেকবার করে বলে দিয়েছেন তোর সঠিক সময়ে খাবারের কথাটুকু যেন আমি মনে করিয়ে দেই! দরকার পড়লে নিজ হাতে খাইয়েও যেন দেই! কি খাবি বল? আমি নিচে গিয়ে তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

—-” কথা ঘোরাচ্ছিস কেন? আজকাল বড্ড পরপর ভাবিস দেখছি!”

—-” কি যা-তা কথা বলিস বলতো? জলদি বল কি খাবি? একটু পর আবার রিম্মি আপুকে নিয়ে পার্লারে যেতে হবে! কতগুলো মানুষ বলতো? এক এক করে সবার সাজতেও তো….”

—-” রিম্মি আপুকে পার্লারে নিয়ে যাওয়ার অনেক লোক আছে। তুই এতো ভাবিস না! এবার চটপট বল কি হয়েছে তোর?”

—-” উফফ নিধি! তুই কিন্তু দিনদিন বড্ড বেশি জেদী হচ্ছিস! বললাম তো সব ঠিকাছে!”

—-” রূপ ভাইয়া বিয়েতে কেন এলো না?”

রাই হঠাৎই ক্ষে-পে গেলো! ক্ষে-পা গলায় বলল,

—-” রূপ হলো রাহিয়ান ভাইয়ার বন্ধু! সে কেন বিয়েতে এলো না তা রাহিয়ান ভাইয়াই সঠিক জানবে! আমি কি সবার খোঁজখবর রেখে বসে আছি নাকি?”

—-” তুই রে-গে যাচ্ছিস কেন! আমি তো এমনিই…”

—-” আমি মোটেই রা-গ-ছি না নিধি! সোজাসাপটা কথা হলো রূপ আর আমার মাঝে বিচ্ছেদ ঘটেছে! কারন সে তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে! আমার সাথে তার এতোটাও লাগাপড়া নেই যে সে আমায় জানিয়ে বিয়ে করবে! যেখানে তার নিজের বন্ধুরাই জানেনা সেখানে আমি দু’দিনের মেয়ে হয়ে কি করে জানবো বল?”

আমি আহাম্মক হয়ে গেলাম! রূপ ভাইয়া বিয়ে করে ফেলেছেন? মানে কি! রূপ ভাইয়া আর রাইয়ের বিচ্ছেদ ঘটেছে আর আমি সেসব জানিওনা! রাই আমায় কিছুই জানালো না?

—-” এতকিছু ঘটে গেলো আর তুই আমাকে জানালিও না রাই? মনের ভেতর পাথর চাপা রেখে কি বিন্দাস আছিস! কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দিসনি! আমাকেও না!”

রাই ছলছল চোখে তাকালো। আমার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে জড়ানো গলায় বলল,

—-” কি করে বলতাম বলতো? তুই নিজেই তো স্বাভাবিক ছিলিস না! আঙ্কেলের হঠাৎ চলে যাওয়া তোকে এতোটা পা-থ-র করে দিয়েছিলো যে আমি নিজেই আমার ক-ষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম! জানিস, রূপের এমন কাজে আমি বিন্দু মাত্র অবাক নই! কারন আমার ভাগ্যটাই এমন! কেউ আমায় ধোঁকা না দিয়ে থাকতেই পারেনা! আর আমার সাথে সবার থেকে ধোঁকা খাওয়াটাই বেশি স্যুট করে! কেন তোর মনে নেই অলি ভাইয়ার কথা!”

অলি রাইয়ের প্রথম প্রেম! ক্লাস টেনে ওদের সম্পর্ক হয়! টানা দুই বছর সম্পর্ক করার পর খুব বি-শ্রি ভাবে রাইকে ধোঁ-কা দেয় ছেলেটা! হঠাৎ এসে রাইয়ের নামে যা-তা বদনাম দিয়ে ছেড়ে যায়! রাই মানতে পারেনি সেই ক/ষ্ট! এক তো আবেগি বয়স তারউপর খুব কাছের কেউ ছেড়ে যাওয়ার ব্যা/থা! সব মিলিয়ে মেয়েটা বড্ড বেশি ক/ষ্ট পেয়েছিলো!

আমি আর কিছু বলতে পারলামনা! রাইকে বুকে আগলে নিয়ে আমিও কেঁদে ফেললাম! রাইও আর শক্ত থাকতে পারল না। আমাকে পেয়ে যেন ওর সব কষ্ট গুলো একসাথে উপচে এলো। শব্দ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা! আমি ওকে বাঁধা দিলাম না! আজ ও যত খুশি কাঁদুক! কেঁদে ওর ক/ষ্ট গুলো একটু হলেও হালকা করুক!

৬১.

কাজী সাহেব এলেন দুপুর দুটোর দিকে। বিয়ে পড়ানো হবে ২ টা বেজে ৩০ মিনিটে। আগের সময় টুকু তাকে নিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর্ব সারতে নিয়ে গেলেন বাকি মেহমানদের সাথে!

রিম্মি আপুকে পার্লার থেকে নিয়ে ফিরল মিনিট দশেক হলো। আসিফ ভাইয়ারাও এসেছেন অনেক্ষন। তাদের মেহমানেদরই খাতিরদারি করছেন বাড়ির লোক। আমাকে আজ শাড়ি পড়তে দেওয়া হয়নি! মহারাজের আদেশে মেরুনরঙের একখানা ভারি লেহেঙ্গা পড়তে হয়েছে। লেহেঙ্গাটা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে আমার থেকে এই লেহেঙ্গার ভার বেশি হবে। এ কথা শুনে রাই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়েছে অনেক্ষন।

এখন আপাতত রিম্মি আপুর শশুর বাড়ির মহিলা মহলের খাতিরদারিতে আছি আমরা বাড়ির মেয়ে বউরা। সবাই ছোটাছুটি করে খাবার দেওয়া নেওয়া করছি। বারবার ভারী লেহেঙ্গায় আঁটকে হুমড়ি খেয়েও পড়ার দশা হচ্ছে আমার। তা দেখে আবার হাসতে হাসতে ধরে ফেলছেন বউমনি আর রাই।

খেতে খেতে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা আমায় দেখে বেশ কানাঘুঁষা করছেন। আর যার সাথে করছেন সেও তার সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলেছেন। ঘুরে ফিরে আমায় নিয়ে তাদের কানাঘুঁষা মোটে শেষ হচ্ছে না! যা দেখে অস্বস্তিতে মাথা ঘুরছে আমার। আমি ইনিয়েবিনিয়ে তাদের দু’জনকে এড়িয়ে চলছি। কিন্তু তারা দু’জন খাবারের খাতিরদারিতে আমাকেই ডেকে ডেকে তাদের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছেন! অবশেষে আমি না পেরে বউ মনিকে বলে উঠলাম “দু’মিনিটের জন্য বাইরে যাচ্ছি!” বউমনি মুচকি হেসে সম্মতি দিলেও উনাদের থেকে ছাড়া পেলাম না! তাদের মধ্যে কালো দেখতে করে মহিলা বলে উঠলেন,

—-” নাম কি তোমার?”

আমি জোরপূর্বক হেসে বউমনির দিকে তাকাতেই বউমনি হাসি মুখে বলল,

—-” মাওইমা, ও হলো আমাদের নিধি! রাহিয়ানে….”

বউমনিকে আর বলতে দিলেন না উনি। আগ বাড়িয়ে বললেন,

—-” বেশ বেশ। তা মা তোমার পড়াশোনা কদ্দূর?”

আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,

—-” জ্বী, অনার্স প্রথম বর্ষ!”

পাশের মহিল খোঁচা দিয়ে কিছু একটা বললেন! ঠিক বুঝতে সক্ষম হলাম না। তাদের কান্ড দেখে রাই বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—-” খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে নেই আন্টি! খাবার গলায় আঁটকে যাবে।”

রাইয়ের কথায় দু’জনেই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ফর্সা করে মহিলা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

—-” তোমার কি হয়েছে! খাবার দিচ্ছো দাও না!”

রাই ক্ষে/পা চোখে তাকালো তৎক্ষনাৎ! আমি রাইয়ের হাত ধরে শান্ত হতে বলে উনাদের উদ্দেশ্যে বললাম,

—-” আন্টি ও কিন্তু ঠিকই বলেছে! আপনারা বরং খেয়ে উঠুন তারপর না হয় আমরা কথা বলবো ক্ষন।”

আমার কথা মানলেন না উনারা। কালো চেহারার অধিকারী মহিলা পাশের জনকে আস্তে করে বলে উঠলেন,

—-” আমাদের কেশবের জন্য মেয়েটারে বেশ লাগবে কি বলো?”

—-” হ্যাঁ আপা! তুমি ঠিক বলছো। কেশবের মাকে বলে দেখব। না করতে পারবেনা দেখো!”

উনাদের কন্ঠ বেশ সতর্ক হলেও আমার কানে তাদের কথা স্পষ্টই আসছিলো। আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম তাদের দিকে! কিছু বলতে নিলেই পেছন থেকে ভেসে এলো কেশবের গলা।

—-” এমন সুযোগ থাকলে সবার আগে প্রস্তাবটা আমিই দিতাম খালা!”

উনার গলা পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো সবাই! রাই আমার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। কেশব ওর ক্রাশ হলেও এই মুহুর্তে ওর যেন এদের কানাঘুঁষা আর মশকরা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না!

ফর্সা মহিলা প্রশ্ন সূচক মুখ করে কেশবের দিকে তাকাতেই কেশব ফিচেল গলায় বলল,

—-” উনি কিন্তু তোমাদের আগেই আমার বেশ মনে ধরেছে।কিন্তু যতক্ষণে বলব ভেবেছি ততক্ষণে তার এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে!”

কথা গুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কেশব। আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি সরে যেতে নিলেই সে আবারও বলে উঠলেন,

—-” ভালো মানিয়েছে না ফুপু?”

আমি রাগি চোখে তাকালাম কেশবের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

—-” নাইস জোক্স।”

কেশব দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠলেন। আমি তার পাশ থেকে সরে আসতেই সামনে এসে দাঁড়ালেন রাহিয়ান। কোত্থেকে, কখন তার আবির্ভাব ঘটল আমার মতোই হয়তো সবার মনেও একই প্রশ্ন। এতো কান্ড দেখে বউমনি অসহায় চোখে তাকাতে লাগলেন সবার দিকে। রাহিয়ানের কান দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। চোখ,নাক,ঠোঁট সবারই একই অবস্থা! রা-গে সে আপাতত হিতাহিতজ্ঞানশূন্য! আমি শান্ত চাহনি দিয়ে তাকে শান্ত হতে বললাম! কিন্তু উনি শান্ত হতে পারছেন না। গলার কাছে দু’পাশ দিয়ে মোটা রগ গুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে ক্রমশই! উনি কেশবের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আমি ক্ষপ করে উনার হাত ধরে ফেললাম! চোখের ইশারায় বারন করতে লাগলাম উনাকে! কিন্তু উনি তো উনি! পারলে আমাকে সহই হেঁটে যান কেশবের সামনে! পরিস্থিতির তাল ধরতে পারছেনা বেচারি বউমনি! সামাল দেওয়া তো দূর! তবুও সবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন,

—-” মাওইমা, ও হলো আমাদের রাহিয়ান! নিধি আর রাহিয়ানের এনগেজমেন্ট হয়ে আছে। রিম্মির বিয়েটা ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হলেই ওদের বিয়েটাও দিয়ে দিবো। আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু! স্পে..শাল দাওয়াত রইল!”

মহিলা দু’জনের কপাল কুঁচকে এলো। ফিসফাস করে কিছু একটা বলল! আমার কান অব্দি এলো না! রাহিয়ান আর এক সেকেন্ড সময়ও দাঁড়িয়ে রইলেন না! আমাকে সহই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন।
আশেপাশে আর দাঁড়ানো হলো না। আমাকে নিয়ে রুমে এসে ধারাম করে গেটে লক করে দিলেন উনি! আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তার দিকে! তার রূপ ভ-য়ং-ক-র! যখন তখন অঘটন কিছু ঘটিয়ে দিতে বিন্দু মাত্র সময় নিবেননা!

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে তার হাতটা ধরতে নিলেই উল্টে উনি আমায় চেপে ধরলেন দেয়ালের সাথে! চোখ মুখ শক্ত করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলেন,

—-” কেন গিয়েছো ওখানে? এতকাজ কে করতে বলেছে তোমাকে? খুব কর্তব্যপরায়ণ তুমি তাই না? কাজ করে করে একদম দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলছো দেখছি?”

শেষের কথাটা বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন উনি! আমি
ভ/য়া/র্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললাম,

—-” আ,,আপনি অযথা রা/গ করছেন! এটা বিয়ে বাড়ি। এখানে কতশত কাজ থাকে। আমি যদি সবার সাথে হাতে হাতে একটু সাহায্য করি তো তাদের উপকার হবে! আপনি এভাবে কেন ভাবছেন?”

—-” কিভাবে ভাবছি আমি? ওখানে বসে ঐ মহিলা দুজন তোমায় কেশবের বউ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন! আবার কেশব এসে তোমার আর ওর ম্যাচিং নিয়ে কথা বলছিলো! তুমি সবটাই চুপচাপ দেখলে! কিচ্ছু বললে না! এরপরও আমি কিভাবে ভাববো তুমিই বলে দাও?”

—-” কেউ আমায় কারোর জন্য পছন্দ করলেই বুঝি আমি তার ঘরের বউ হয়ে যাবো? কেউ আমার সাথে তার ম্যাচ করেছে কিনা তা নিয়ে আনন্দ পেয়ে একা একাই খুশিতে গদগদ করছে বলে আমিও খুশিতে গদগদ করবো? একদমই তা নয়! আমি শুধু এই মানুষটার জন্যই আছি! বউ হলেও আমি তারই হবো আর ম্যাচিং করুক বা না করুক তবুও আমি তার সাথে থাকবো। আমি তো আপনারই বউ! এই দেখুন? আমার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আপনার পরিয়ে দেওয়া আংটিটা কত সুন্দর জ্বলজ্বল করছে। তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে! এই প্রকৃতিও জানে নীলাদ্রিতা রাহিয়ান ব্যতীত আর কারোর হবেনা! সেটা অসম্ভব! তবুও কিসের এতো ভয়/? কিসের এতো চিন্তা?”

রাহিয়ান শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ! আমায় ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষনাৎ উল্টো দিকে ঘুরে গেলো! তার নীরবতা এবার আমাকে সত্যি বড্ড ভাবাচ্ছে। তার আচরন এবার বড্ড বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। আচ্ছা এমন কি কোনো গোপন কথা আছে যেটা উনি জানেন কিন্তু আমি জানিনা? যার জন্যই উনার এতো ভ/য়!

#চলবে____________________