প্রেয়সী পর্ব-৩৪+৩৫

0
204

#প্রেয়সী 🧡(৩৪)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৬৬.

গাল বরাবর পরপর দু’টো থাপ্পড় পড়তে আমার সামনেই হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে গেলো অরিন আপু। ভ*য়ং*ক*র রাগে আ*গু*নের লা*ভা গলে গলে পড়ছে রাহিয়ানের চোখ থেকে! আমি ভ*য়া*র্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বিছানা থেকে নেমে ঝাপটে ধরলাম উনাকে! কাশতে কাশতে গলা থেকে বুঝি র*ক্ত বেরিয়ে আসবে এক্ষনি। উনি অস্থির হয়ে শক্ত করে আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরলেন! আমার ভাবনাতেও ছিলো না উনি এমন সময় আমার ঘরে আসতে পারেন। আর অরিন আপুও হঠাৎ এমন কান্ড করে ফেলতে পারে! অবশ্য ইদানীং আমার ভাবনাকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, আজকাল যা কিছুই ঘটছে সবই আমার ভাবনার বাইরে।

রাত ৮টা বেজে ১৩ মিনিট। ঘড়িতে সময়টা দেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রাতে ঘুমটা ঠিকঠাক না হওয়াতে এখন বেশ ক্লান্তই লাগছে শরীরটা। শপিং থেকে বাসায় ফিরে আর রেস্ট নেওয়া হয়নি! তাই হয়তো আরেকটু বেশি ক্লান্ত লাগছে। বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে অনুযায়ী ছেলেরা খুব সহজেই আসতে পারলেও মেয়েদের বেলায় সবাই একটু গোড়ামি সবাই করে। হিয়া আপুর বেলায় তার বাবা যেমন করলেন ঠিক তেমনি অরিন আপু এবং অনন্যা আপুর বেলাতেও করলেন। গতকালই আরফান ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া আসতে পারলেও, আসতে পারলোনা অরিন আর আর অনন্যা আপু। তবে একদিন পেরোতেই তারাও এসে হাজির হলেন। পুরনো কথা আর মনে না রেখেই আমি অরিন আপুর সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললাম। একই ভাবে রাহিয়ানও নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার খাতিরে ভুলে গেলেন সেদিনের কথা। যদিও অরিন আপুর বলা একটা কথাও আমি তাকে জানায়নি! কেবল বলেছিলাম অরিন আপু তাকে ভালোবাসে। তবে সেটা সত্যিই ভালোবাসা ছিলো নাকি কেবলই কেশবের উসকানি ছিলো সে-ই হয়তো ভালো জানে।

আমি বিছানায় শুইয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে যেন ঘুম আসবে কিন্তু আসলে ঘুম আসছে না। ব্যাপারটা চরম অশান্তির। হঠাৎই আগমন ঘটল অরিন আপুর। আমি ঘুমাবো ভেবে এক এক করে সবাই রুম খালি করে দিয়ে চলে গেলো। উনাকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি উঠে বসলাম তৎক্ষনাৎ! মুখে মলিন হাসি দিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে তাকে ডাকলাম। সেও এগিয়ে এলো শুঁকনো মুখে। আমি আবারও ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

—-” কাউকে খুঁজছেন আপু?”

শুঁকনো মুখ করে থাকা মানুষটা আচমকাই ক্ষে*পে গেলো আমার উপর। আশেপাশে নীরবতা বুঝেই আচমকা গলা চেপে ধরল আমার। আমি বোকা মানুষ ভ*য়া*র্ত চোখে তার আ*ক্রো*শ দেখে ছটফট করতে লাগলাম। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আমি হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি! বাবাকে হারানোর মতোই তেমন এক কঠিন দুঃস্বপ্ন! দুর্বল শরীরটা এমন অকেজো হয়ে গেলো যে উনাকে ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারছিলাম না! কেবল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলাম। উনি হিং**স্র চাহনি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন,

—-” বলেছিলাম না বিয়েটা ক্যানসেল করে দাও!! শুনোনিতো আমার কথা? তাহলে এবার ম**রো তুমি! তুমি ম**র**লে তো বিয়েটা এমনিতেও ভন্ডুল হবে।”

বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার সময়টা ফুরিয়ে আসছে! চোখে জলের বদলে খন্ড খন্ড র**ক্ত জমাট বাঁধছিলো! গলার আওয়াজটা কেমন ফ্যাচফ্যাচ শোনাচ্ছিলো! আর তারপর হঠাৎ করেই রাহিয়ানের আবির্ভাব ঘটল! উনি কোত্থেকে এলেন জানিনা। কিন্তু উনি যে আমার জীবন বাঁচাতে ফেরেশতার মতো হাজির হলেন তা হলফ করে বলত পারি! আমি এখনও কাশছি! ভীষণ ক**ষ্ট হচ্ছে। গলার কাছটাতে এখনও মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চেপে আছে। এখনও নিঃশ্বাস নিতে ভারী ক**ষ্ট হচ্ছে! উনাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি! আমার কান্নার শব্দ কানে যেতেই উনি পা*গ*লে*র মতো করতে লাগলেন! আমাকে নিজের থেকে টেনে তুলে জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন,

—-” খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার জান? প..পানি! পানি খাবে! বসো?বসো বসো। আমি পা..নি দিচ্ছি তোমায়! প্লিজ কেঁদো না নীলাদ্রিতা! কেঁদো না! প্লিজ কেঁ,,দো না!”

রাহিয়ান দৌড়ে গেলেন পানি নিতে। পানি নিয়ে আবারও এসে হাজির হলেন আমার সামনে! আমার হাতে পানিটা দিতে দিতে ততক্ষণে উঠে দাঁড়ালেন অরিন আপু! আমার দিকে তেড়ে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলেন রাহিয়ান। অরিন আপুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আর পেছন ফিরে আমার দিকে না তাকিয়েই শান্তস্বরে বললেন,

—-” পানি টা খেয়ে নাও নীলাদ্রিতা।”

উনার দিকে ক্ষে**পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল অরিন আপু,

—-” খুব দরদ নীলাদ্রিতার জন্য তাই না? একটা দুইদিনের মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা কোথা থেকে আসে বল? এতগুলো বছর ধরে যে পা*গ*লের মতো করে তোকে ভালোবেসে এসেছি কই কখনো তো এমন দরদ করিসনি? কেন বলত? কেন তোর জন্য এতকিছু করেও তোর থেকে ভালোবাসা পাইনি! কেন তুই কখনও আমাকে ভালোবাসিসনি রাফিদ?(চিল্লিয়ে) ঐ বিশ্রী কালো দেখতে মেয়েটার মধ্যে তুই এমন কি পেয়েছিস যা তুই আমার মধ্যে পাসনি? আমি তো ওর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী! তবুও কেন ভালোবাসতে পারলি না আমাকে?”

রাহিয়ান থমথমে মুখে কতক্ষণ চেয়ে থেকে আবারও ঠাসস করে একটা চড় বসাল অরুন আপুর গালে। অরিন আপু ঢলে পড়ল খানিকটা! পূনরায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গালে হাত চেপে হিং**স্র চোখে তাকালো! দ*হ*নের আ*গু*নে পুড়তে পুড়তে আবারও তেতে উঠল সে।

রাহিয়ানের কলার চেপে রা*গে ফুঁসে উঠতেই আবারও এক রাম চড় মা*র*লে*ন রাহিয়ান! আমি এবার গ্লাস ফেলে দাঁড়িয়ে গেলাম! থাপ্পড়ের আ*ঘা*তে অরিন আপুর দু’টো গালেই স্পষ্ট দাগ বসে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরে আকুতি ভরা চোখে তাকালাম! কি হচ্ছে এসব? অরিন আপু অ*ন্যা*য় করলেও উনি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে কিছুতেই একটা মেয়ের উপর হাত উঠাতে পারেননা! এটা ঠিক নয়! যদি শা*স্তি দিতে হয় তবে অন্য ভাবে দিক! তবুও এভাবে নয়। আমার আকুতিভরা চাহনিতে উনি ভ্রুক্ষেপ ঘটাতে পারলেন না। আমাকে পাশ কাটিয়ে আচমকাই অরিন আপুর গলা চেপে ধরলেন উনি! আমি আঁ*ত*কে উঠে মুখ চেপে ধরলাম। অরিন আপু ছটফট করতে লাগলেন তৎক্ষনাৎ! অরিন আপু হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেও উনাকে নাগাল পাচ্ছেন না। আমি আবারও ছুটে গেলাম উনার দিকে। উনার শক্ত হাতটা ধরে টানাটানি করতে লাগলেই উনি হিং*স্র চোখে তাকালেন আমার দিকে! আমি ভ*য় পেয়ে চুপসে গেলাম। উনার চোখে দাউদাউ করে আ*গুন জ্ব*ল*ছে। উনি অরিন আপুকে এতো সহজে কিছুতেই ছাড়বেন না।

—-” তোর প্রশ্নগুলো বেশ ছিলো। কেন আমি তোকে ভালোবাসিনি? কাউকে ভালোবাসতে হলে তার মধ্যে রূপ নয় যেটা প্রয়োজন সেটা হলো তার সুন্দর মনমানসিকতা! যা তোর আজও নেই আর আগেও কখনো ছিলো না! তুই ভাবলি কি করে তোর মতো এত নীচু মন-মানসিকতার একটা মানুষকে রাহিয়ান রাফিদের মতো একটা ছেলে ভালোবাসবে? সব সময় তো বেশ বড়াই করে বলিস আমি হলাম বিশ্ব সুন্দরী, আমার মতো এতো সুন্দরী দুনিয়াতে আর দুটোও নেই! আচ্ছা কখনও তোর মাথায় এটা আসেনি রূপ তো আল্লাহর বরকত দানে পেয়ে গিয়েছি কিন্তু মানসিকতাটা নিজের থেকেই পরিবর্তন করতে চেষ্টা করি! আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি অরিন যেদিন তুই রাইয়ের ব্যাপারে রূপের কাছে উল্টাপাল্টা কথা বলে ওদের সম্পর্কটা ভে/ঙে দিয়েছিস। আজ যে রাই আর রূপ আলাদা সেটা কেবলই তোর জন্য!”

উনি থামলেন। রা*গে,হিং*স্র*তা*য় উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে! এদিকে আমি হতবিহ্বল চোখে কেবল উনার কথা শুনে যাচ্ছি। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল রাই আর রূপ ভাইয়ার কথাটা শুনতেই! তার মানে এই মেয়েটার জন্য রাই আর রূপ ভাইয়ার এই বিচ্ছেদ!

উনি আবারও বলতে লাগলেন,

—-” বুুঝলাম, তুই না হয় আমাকে ভালোবাসিস বলে নিধির সাথে এমন জ*ঘ*ন্য আচরণ করেছিস কিন্তু রাই আর রূপের দোষ কি ছিলো? আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি যেদিন জানতে পেরেছিলাম অনন্যা আর ইভানের সম্পর্কটা ভে*ঙে যাওয়ার পেছনেও কেবল একমাত্র তু-ই দায়ী! ইভানের কাছে গিয়ে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের নামে এমন সব কথা বলেছিস যে ইভান অনন্যার সাথে ওর সম্পর্ক ভে*ঙে দিতে বাধ্য হয়েছে! এরপরও তুই জানতে চাস আমি তোকে কেন ভালোবাসিনি? কারন গুলো তোর সামনে সব তুলে ধরলাম। এবার বল এরপরও আমি তোর মতো এমন একটা নোং**রা মনের মানুষকে কি করে ভালোবাসতে পারি? শুধু এখানেই শেষ নয় অরিন! তুই এতোটাই খারাপ যে কেশবের মতো একটা ছেলের সাথে হাত মিলিয়েছিস! নিধিকে এই বিয়ে ভে*ঙে ফেলার জন্য নানান ভাবে মানসিক ট*র্চা*র করেছিস! কেশবের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দিতে বলেছিস! আমি এই সব কিছু জানা স্বত্বেও তোকে কোনো দিনও একটা পাল্টা প্রশ্ন করিনি! ভেবেছিলাম মানুষ সবসময় এক থাকে না! তুইও থাকবি না। একদিন ঠিকই তুই পাল্টাবি, তোর এই স্বভাব গুলো পাল্টাবে। কিন্তু না, আমি ভুল! তুই বরাবরের মতো আজও আমাকে ভুল প্রমান করে দিলি! আজ তোর সত্যি আর বাঁচার পথ নেই। আমার হাত থেকে তোকে বাঁচাতে পারবে এমন কারোর জন্ম আজও অব্দি হয়নি! তুই আমার কলিজায় হাত রেখেছিস! আমার কলিজাকে তুই আ*ঘা*ত করেছিস! মে**রে ফেলতে চাইতেও তোর বাঁধল না বিবেকে। কিন্তু নিয়তি বলেও কিছু হয় তাই না? যেখানে তুই শুধু আ*ঘা*ত করেই যাবি আর পাল্টা আ*ঘা*ত কখনও পাবিনা তা তো হয় না!”

উনার মুখে একটার পর একটা কথা শুনতে আমার মাথায় চক্কর কেটে উঠল! কি বলছে মানুষটা। অরিন আপু মানুষটা এতোটা নোং*রা মনমানসিকতা কি করে পো*ষন করে! কখনও কি নিজের মধ্যে অপরাধ বোধও কাজ করে না?

আমার পা থেকে মাথা অব্দি কাঁপতে লাগল। আমি আর নিতে পারছিনা এসব। নিজেকে কেমন পা*গ*ল পা*গ*ল লাগছে আমার! ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়তেই দৌড়ে এলো অনন্যা আপু,ফাহিম ভাইয়া, নিতু আপু রাই! আমি চমকে উঠে তাদের দিকে তাকাতেই দরজার সম্মুখে একগাদা মানুষ চোখে পড়ল। তারা কখন এলো? আমি তো কোনো শব্দ পাইনি! পেছন থেকে ভীর ঠেলে দৌড়ে এলো আরফান ভাইয়া, জিয়ান ভাইয়া, আর রাফিন ভাইয়া। রাহিয়ানকে আরফান ভাইয়া আর রাফিন ভাইয়া ধরে টেনে পেছনের দিকে আনার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন। ততক্ষণে অরিন আপুর ম*র*ন দশা! ফর্সা মুখখানা র*ক্তশূণ্য হয়ে বি*ভৎ*স লাগছে। আরফান ভাই রাহিয়ানকে একটু সরাতে পারলেই অরিন আপুকে হেঁচকা টানে বের করে আনলেন জিয়ান ভাইয়া! অরিন আপুর গলা থেকে হাত সরে যেতেই কাশতে কাশতে বেহাল অবস্থা হয়ে গেলো তার। রাহিয়ান আবারও তার দিকে তেড়ে যেতেই আরফান ভাই তাকে টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

—-” রাফিদ কি করছিস টা কি তুই? পা*গ*ল হয়ে গেলি নাকি? মেয়েটা ম**রে যাবে তো!”

ক্ষে*পা*র উপর পাল্টা জবাব দিলেন রাহিয়ান,

—-” আমার সামনে থেকে সরে যা আবির! ওকে আজ আমার হাতে ম*র*তে*ই হবে। ও যা করেছে তা…”

—-” মানছি ও অ*ন্যা*য় করেছে রাফিদ কিন্তু তাই বলে তো ওকে আমরা এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা!”

রাফিন ভাইও কথার রেশ টানলেন আরফান ভাইয়ের।

—-” একদমই তাই রাফিদ। ওর যেকোনো ভুলেই আমরা ওকে এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা।”

রাহিয়ান মানলেন না কারোর বারন। উনি হিং**স্র চোখে অরিন আপুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললন,

—-” রাহিয়ান রাফিদ চাইলে সব পারে।”

অবস্থা বেগতিক বুঝেই জিয়ান ভাইয়া অরিন আপুকে রুম থেকে বের করে দিলেন। রাহিয়ান অরিন আপুর যাওয়ার পানে তেড়ে যেতে নিলেই তার হাত ধরে ফেললাম আমি। টলমলে চোখে উনার সামনে দাঁড়াতেই মানুষটা নরম হয়ে গেলেন মুহুর্তেই। হয়ত বুঝলেন তার এই কঠিন রুপে আমার ভীষণ ভ*য় হচ্ছে। উনি আমার দু’গালে হাত রেখে কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ একে শান্ত কন্ঠে বললেন,

—-” কিচ্ছু হয়নি নীলাদ্রিতা। সব ঠিকাছে। ভয় নেই আমি তো আছি সবসময় তোমার জন্য।”

আমি মুখ উঁচিয়ে উনার তাকাতেই আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল উনার হাতে। উনি কোমল হাতে আমার চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে সবার সামনেই আলতো করে জড়িয়ে নিলেন।

৬৭.

হলুদের জন্য স্টেজ করা হয়েছে ছাদে। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির বাইরের গেট থেকে শুরু করে বাড়ির গার্ডেনও সাজানো হয়েছে চমৎকার রূপে। আর এসব কিছুর মাঝেই হলুদের বিশেষ উপলক্ষে ছাদটাকে করে তুলেছে ছোট্ট একখানা তাজমহল। চারপাশে ফুল,লাইটিং,বিভিন্ন রঙ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে ছাদটাকে।

সময় ঠিক ৭টা। আমি নিজের ঘরেই আছি। সাজসজ্জার পর্ব চলছে। নিয়ম মাফিক আমার পোষাক আজ সবই হলুদ। হলুদ রঙের দুই পার্টের লেহেঙ্গাটা রাহিয়ানের পছন্দে কেনা। উনার পছন্দের তারিফ এখন লোকমুখে। লেহেঙ্গার ডিজাইনটা যেই দেখছে সেই হা করে মিনিমান পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আমায় দেখে। অতঃপর ছোট্ট একখানা মুচকি হাসি দিয়ে বলে রাহিয়ানের পছন্দ আছে কিন্তু। গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠার কথা হলেও বিপরীতে লজ্জায় লাল হতে হয় আমাকে। আমার পাশে অতিশয় ভদ্রমহিলারা লজ্জায় মে*রে ফেলছে আমায়। দেখেছো, হলুদ রঙ গায়ে উঠতেই ভীষণ ফুটেছে মেয়ের চেহারা,আমাদের রাহিয়ান দেখলে তো আজই বিয়েটা করে ফেলতে চাইবে গো! লাল বেনারসি অব্দি হয়তো আর ক/ষ্ট করতে হবে না!

লাইক এমন টাইপ কথা গুলো যখন শুনি তখন মনের ভেতর কি বি*ভ*ৎ*স রমকের যে হাতুড়ীর বারি পরতে থাকে তা কেবল আমিই জানি! এই অতিশয় ভদ্রমহিলা গুলো যাও একটু চুপ করে থাকবেন কিন্তু আজ আর চুপ থাকবেনা রাই,নিতু আপু,রিম্মি আপু,হিয়া আপু আর অনন্যা আপু। তারা আমাকে লজ্জায় লজ্জায় মে*রে ফেলবেন বলে বিক্ষোভ শুরু করেছেন একেবারে। সত্যি বলতে আমার এখন রুম থেকেই বের হতে ইচ্ছে করছেনা!

তাজা গাঁদাফুলের টিকলিটা ক্লিপ দিয়ে আঁটকাতে আঁটকাতে হঠাৎ মুখ টিপ হাসতে লাগলেন অনন্যা আপু। আমি প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন ছুড়লেন নিতু আপু,

—-” কি গো অনু, হাসছ কেন?”

অনন্যা আপু টিকলির কাজ শেষ করে মুখে হাত চেপে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল,

—-” নিধিকে আজ এত্তো বেশি কিউট লাগছে কেন বলোতো? তবে কি বিয়েটা আজই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?”

পেছন থেকে রিম্মি আপু অনন্যা আপুর কথার রেশ টেনে বলল,

—-” আমি তো জানি মেয়েদের বিয়ের দিনই সবচেয়ে বেশি কিউট লাগে। এটাই নিয়ম!”

নিতু আপু বলল,

—-” আমিও তো তাই জানি! তবে কি…”

নিতু আপুর কথার মাঝেই রাই বলে উঠলো,

—-” না গো না! আমাদের নিধিকে আজ হলুদে এতো সুন্দর লাগছে ভাবো কাল লাল বেনারসিতে কতটা মা*রা*ত্ম*ক সুন্দর লাগবে। আজকের চেয়েও অধিক সুন্দর লাগবে।”

আমি গোলগাল চোখ করে সবার দিকে তাকালাম। আস্তেকরে বললাম,

—-” তোমরা আমায় নিয়ে এতো গবেষণা করছো কেন বলোতো? প্লিজ এবার তো চুপ করো!”

আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো সবাই! অনন্যা আপু হাসতে হাসতে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,

—-” বিয়ের কনে হলে তাকে এগুলো শুনতে হয় সোনা। শুধু এগুলো নয় আরও অনেক কিছু শুনতে হয়। কি গো বলবো না কি? হু হু? বলি?”

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে বললাম,

—-” ধ্যাৎ!”

আর ওমনি দেখা মিলল তাদের ঝংকার তোলা হাসি। হাসতে হাসতে সবাই ঝাপটে ধরল আমায়।

স্টেজের মাঝ বরাবর পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছি আমরা দুজন। উনিও হলুদ শেরওয়ানী পড়ে আছেন। দেখতে বেশ লাগছে কিন্তু। দুই হাতে জায়গা পেয়েছে হলুদ রঙের দুটো ফুল। মাথার চুল গুলো ছাদের মৃদু বাতাসে বার-বার উড়ে এসে কপালের সাথে লেপ্টে বসে পড়ছে। চোখ জোড়া চিকচিক করছে খুশির আমেজে। মুখে মন কাড়ানো মিষ্টি হাসি। চঞ্চল ঠোঁট জোড়া একজন আরেকজনের উপর চেপে আছে। এক এক করে সবাই হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছেন সেই সাথে তার কানে কানে কিছু বলেও যাচ্ছেন। বিশেষ করে তার বন্ধুগন। উনি কথাগুলো শুনতে শুনতে আঁড়চোখে আবার আমাকে দেখে নিচ্ছেন। অতঃপর মুচকি হাসি দিয়ে পলক ঝাপটাচ্ছেন। এমন কান্ড দেখে স্টেজের নীচে বেশিরভাগ মানুষই মুখ টিপে টিপে হাসছেন। আমি বুঝতে পারছিনা সবাই হঠাৎ করে আমাকে এতো লজ্জায় কেন ফেলছে!

#চলবে____________________

#প্রেয়সী ♥️(৩৫)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৬৮.

গায়ে হলুদের পর্ব সারল রাত ঠিক ১১টা নাগাদ। বাড়ির সবাই আমাদের দুজনকে সারপ্রাইজ দিতে নাচ,গান এবং কবিতা আবৃত্তির অসাধারণ ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। আমি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না! হঠাৎ করেই রাই এবং আরফান ভাইয়া একসাথে মিলে গেয়ে উঠলেন অসাধারণ এক গান। আর সেই গানেই তাল মিলিয়ে নাচ ধরল রিম্মি আপু আর নিতু আপু। রাহিয়ানও এই সারপ্রাইজের আংশিক ছিলো। তার বরাবর প্রসংশনীয় কবিতা দিয়েই সবার মন কাড়ল। বিশেষ করে আমার। উনার কবিতার লাইন গুলো এতোটা নেশা ছড়াচ্ছিল যে আমি সেই নেশায় নিজেকে মাতাল না করে পারছিলাম না।

বউমনি আর হিমাদ্র ভাইয়াও নাচের অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছে। আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম যখন বড়-খালামনির এবং বড়-খালু গান গেয়ে একসাথে তালে তাল মিলিয়ে নেচেছেন। নিজেকে তখন বড্ড ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছিলো। সত্যি বলতে এমন অসাধারণ পরিবার কয়জন মেয়ের ভাগ্য থাকে?

—-” কফি।”

রাহিয়ানের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলাম! পাশ ফিরে তাকে দেখতে দেখতে সে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” কিছু ভাবছিলে? হঠাৎ চমকে উঠলে!”

আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে উনার হাত থেকে একটা কফির মগটা নিয়ে বললাম,

—-” তেমন কিছু নয়। আপনি হঠাৎ এসে পড়লেন খেয়াল করিনি তাই একটু…”

উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। ফিচেল গলায় বললেন,

—-” আর ইউ সিওর?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দূর আকাশে দৃষ্টিপাত করলাম। তাঁরাদের মাঝে ঝলমলে আকাশ। আজ চাঁদের দেখা নেই! শুধু তাঁরাদের বিচরণ আজ।খন্ড খন্ড ঘন কালো মেঘের পাশ থেকেই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে শতাধিক তাঁরা। উনি আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে শীতল কন্ঠে বললেন,

—-” মন খারাপ?”

আমি দৃষ্টি ফেরালাম না। আকাশের পানে একই ভাবে তাকিয়ে থেকে বললাম,

—-” আজ বাবা থাকলে ভীষণ খুশি হতো বলুন!”

না তাকালেও বেশ বুঝতে পারলাম উনার শান্ত দৃষ্টি এসে ঠেকল আমার চিকচিক করা চোখের গোড়ায়। শুঁকনো ঠোঁটখানা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে জোরপূর্বক হাসতে চেষ্টা করলেন উনি। যদিও চেষ্টা সফল হলো না। তাই আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে স্মিত হেসে এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ালেন আমার চোখের পাতায়। তার ছোঁয়া পেয়ে অনুভূতির জাতাঁকলে নিজেকে পিষে কেঁপে উঠলাম কিঞ্চিৎ। উনি আবারও পিছিয়ে গেলেন উনার জায়গায়। মুখে চমৎকার হাসি রেখে বললেম,

—-” আজ বাবা নেই কে বলল তোমায়? বাবা তো অলওয়েজ তোমার সাথেই আছে নীলাদ্রিতা। তুমি বাবাকে অনুভব করতে চাইলেই বাবা তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে। কথা বলবে, হাসবে,বকবে,মজা করবে। তুমি যা চাও তাই করবে নীলুপাখি!”

আমার ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো সঙ্গে সঙ্গেই। “নীলুপাখি”! আবার সেই নীলু! আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন,

—-” আই লাভ দিস নেইম নীলুপাখি!”

আমি ক্ষে*পা চোখে তাকিয়ে উনার বুকে কিল ঘুষি বসাতেই উনি “আউচ” বলেই আমার হাতটা চেপে ধরলেন। ব্যা*থা হজম করে লোকটা হেসেই চলেছে। তার হাসি দেখে আমার গায়ে জ্বা*লা ধরে যাচ্ছে যেন। আমি চোখ মুখ কুঁচকে রেখেই উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ বাদে উনি হাসিটাকে কোনোমতে চেপে বললেন,

—-” কফিটা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে জান। টেস্ট করে বলো কেমন হয়েছে?”

আমি আর জবাব দিলাম না উনাকে। উনি আমার হাতটা ছাড়তেই আমি মা*র দেওয়ার ভঙ্গি করে ছোট্ট করে হাসলাম। উনি আমার মা*র থেকে বাঁচতে কফির মগটা তুলে ধরলেন। অতঃপর সেও হেসে উঠলেন আমার সাথে। দুজনে একসাথেই কফিতে চুমুক বসালাম। উনার তৈরি করা কফি বরাবরই প্রশংসনীয়। সেদিনের ভুলবশত খাওয়া উনার কফির স্বাদটা যেন আজও মুখে লেগে আছে। সেই একই স্বাদ। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ যখন কফিতে উনি আচমকাই আমার হাত থেকে কফিটা টেনে নিলেন উনার দিকে। আমি আচমকা ভড়কে গেলাম এমন কান্ড দেখে। আমার অবাক দৃষ্টি উনার মনোযোগ নষ্ট করতে পারল না। উনি আমার কফিটার সাথে উনার কফিটা পাল্টাপাল্টি করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই উনি চোখ টিপে বললেন,

—-” ভালোবাসা বাড়বে।”

আমি বিরস মুখে বললাম,

—-” একপাত্রে খেলে ভালোবাসা বাড়ে এভাবে এক্সচেঞ্জ করে নয়!”

উমি পড়লেন ভারী চিন্তায়। চোখেমুখে চিন্তাগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে যেতেই উনি আশেপাশে তাকালেন। কিছু খুঁজছেন হয়তো। আমি প্রশ্ন সূচক মুখ করে উনার দিকে তাকাতে তাকাতে উনি একটা ছোট্ট টুলের উপর রেখে দিলেন নিজের কফিটা। আর তারপর দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে আমার কফিটা কেড়ে নিয়ে বললেন,

—-” আগে স্বামীর খাওয়া উচিৎ। এম আই রাইট?”

আমি বোবা চোখে তাকিয়ে বললাম,

—-” কফি কি করে একপাত্রে খাওয়া যায়?”

—-” একপাত্রে খেতে অসুবিধা হলে আমার ব্যক্তিগত পাত্র থেকে নিতে পারো। আই মিন টু স্যে…(উনার ঠোঁটের দিকে ইশারা করে)।”

আমি থতমত খেয়ে উনার থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। আমতাআমতা করে বলতে লাগলাম,

—-” আ্ আপনি তো ভারী অ*স*ভ্য লোক!”

উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

—-” বউয়ের সাথে অবশ্যই অ*স*ভ্য হতে হয় সুইটহার্ট। নয়তো প্রেমটা জমবে কেমন করে?”

—-” ধ্যাৎ!”

লজ্জায় বুকের ভেতরট থেকে ক্রমশই লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে ছোট্ট হৃদয়খানা। লোকটার সামনে থাকাও যেন পাহাড় সমান লজ্জার মতো ঠেকছে। শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে এখান থেকে যাওয়ারই ফন্দি আঁটছিলাম। হঠাৎই পেছনে থেকে হেঁচকা টান দিয়ে আমায় নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন উনি। আমি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে। উনি উনার ডানহাতে আমার কোমর চেপে ধরলেন। আমি ভ*য় পেয়ে কাঁপাস্বরে বলে উঠলাম,

—-” ক্ কফিটা কিন্তু গায়ে পড়বে! কি করছেন টা কি বলুনতো।”

উনি জবাব দিলেন না। হাতের বাঁধন শক্ত করেই আমাকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে মিশিয়ে নিলেন। বা-হাত দিয়ে আমার পিঠে বিছিয়ে থাকা খোলা চুল গুলো বাম পাশের কাঁধে উঠিয়ে দিয়ে আবারও খানিক মিশিয়ে নিলেন আমায়। উনার তপ্ত শ্বাস আমার ঘাড়ের উপর আচড়ে পড়তেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। উনি আমার ঘাড়ে নাক ঘসে ঘোর লাগানো কন্ঠ বললেন,

—-” আমাদের বিয়েটা আজ নয় কেন বলোতো?”

আমি কেঁপে উঠলাম। ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

—-” কফিটা কি করলেন?”

উনি আগের ভঙ্গিতেই বলে উঠলেন,

—-” পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছি। দেখো?”

আমি ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম ছোট্ট টুলটার উপরই জায়গা পেয়েছে আমাদের দুজনের কফি। হাতের মগটাও কখন ওখানে রাখলেন টেরই পেলাম না।

—-” আমরা এখানে রোমান্স করবো আর ওরা আলাদা থাকবে তা কি করে হয় বলো তো? তাই ওদেরও রোমান্স করার ব্যাবস্থা করে দিলাম।”

আমি লজ্জায় আরও কুঁকড়ে গেলাম। ইদানীং সব কিছুতেই এতো পরিমানে লজ্জা পাচ্ছি যে তা নিয়েও নিজেকে এখন ডিপ্রেসড লাগছে।

—-” হু বুঝেছি এখন ছাড়ুন আমায়! দেখুন খোলা ছাদে যেকোনো সময় যে কেউ এসে পড়তে পারে! আর এসে যদি আমাদের এভাবে দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে বলুন তো?”

উনি নড়লেন না এক ইঞ্চিও! আমাকে জড়িয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার তপ্তশ্বাসে যে আমার করুন অবস্থা হচ্ছে তা কি করে বোঝাই তাকে। আমার ভাবনার মাঝেই উনি গাঢ় কন্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলেন,

—-” তোর জন্য ফুল কুড়িয়ে নিলে,
সঙ্গে খানিক ভুল কুড়িয়ে নিলে,
ভুল করেই বললে ভালোবাসি,
তুই কি তবু হাসবি অমন হাসি?
একটুখানি ভুলের ছঁলে ছঁলে,
একটুখানি সুবাসমাখা ফুলে,
একটুখানি ডোবাই যদি ঠোঁট!
‘ঢের হয়েছে’,বলবি, ‘এবার ওঠ’!
তোর জন্য খানিক মায়া হলে,
বুকের ভেতর মেঘের ছায়া হলে,
বললে, ‘তোকে আমার ভীষণ চাই,
ভাববি কি তুই, সবটা অযথাই?
তোর জন্য ভীষণ কান্না পেলে,
তোর জন্য আস্ত আকাশ ফেলে,
তোর দুয়ারে দাঁড়িয়ে যদি রই,
বলবি কি তুই, আমি তোর নই?””

কবিতার শেষ লাইন বলেই উনি মুখ ডুবালেন আমার ঘাড়ে। ছোট্ট করে একটা ভালোবাসার পরশ একে মুখ তুলে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,

—-” বলবি কি তুই, আমি তোর নই?”

—-” না ভাই বলবে না! অনেক হয়েছে তোমাদের একান্ত, ব্যক্তিগত সময় কাটানো! এবার নীচে চলো।”

আকস্মিক অপ্রত্যাশিত কারোর গলা ভেসে আসতে ছিটকে পড়লাম দু’জনেই। উনি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন আর আমি কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলাম। আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। বউমনির পাশেই মুখ টিপে হাসতে থাকা রাই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বউমনিদের পাশে এনে দাঁড় করালো। আর ওদিকে রাহিয়ানকে ঘিরে দাঁড়ালো আরফান ভাইরা। কথাটা অবশ্য বউমনির ছিলো। তাই হঠাৎই হিমাদ্র ভাইয়া নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো,

—-” আমি বলেছিলাম এখন ছাদে এসে কাজ নেই। ভাইটা আমার একটু নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছিলো কিন্তু তোমরা? মহিলা মানুষ মানেই ঝামেলা বুঝলা!”

রাহিয়ান আঁড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই চোখ টিপলেন। আমি গোলগোল চোখ করে উনার দিকে তাকাতেই পাশ থেকে বউমনি ক্ষে*পা গলায় বলে উঠলো,

—-” কি বললে? মহিলা মানুষ মানেই ঝামেলা? এখন ভইকে পেয়ে দল চেঞ্জ হু? এতক্ষণ যে হাতে পায়ে ধরছিলে ওদের জ্বা*লা*নো*র জন্য তখন?”

হিমাদ্র ভাইয়া বউমনির কথাগুলো সম্পূর্ণ অস্বীকার করার কায়দায় বলল,

—-” আমি? কখন? কবে? কোথায়? এই আবির, জিয়ান, রাফিন ভাই তোমরা বলোতো? আমি কি এমন কিছু বলেছি?”

হিমাদ্র ভাইয়ার কথাকে সবাই ঠিক প্রমাণ করতেই একসাথে বলে উঠলো,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ হিমাদ্র ভাইয়া ঠিক কথা বলেছে! একদম ঠিক কথা বলেছে!”

বউমনি যেন আকাশ থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ল। হিমাদ্র ভাইয়ার দিকে ক্ষে*পা দৃষ্টিতে তাকাতে মেয়েদের গ্রুপে বাকিরাও জ্ব*লে উঠল। নিতু আপু, রাই, হিয়া আপু, রিম্মি আপু সবাই একসাথে জোর গলাতে বলে উঠলো,

—-” হিমাদ্র ভাইয়া মিথ্যে বলছে, মিথ্যে বলছে।”

মেয়েরা সুর দিয়ে উঠতেই এবার ছেলেরাও সুর দিয়ে বলে উঠলো,

—-” হিমাদ্র ভাইয়া সত্যি বলছে, সত্যি বলছে।”

বলা বাহুল্য দু’পক্ষের ছোটখাটো একখানা মিছিল শুরু হলো।

৬৯.

—-” আমি রাইকে বিয়ে করতে চাই!”

বিয়ে বাড়ির সোরগোল থেমে গেলো আরফান ভাইয়ার ছোট্ট কথাটিতে। আমরা সকলেই ভ*য়া*ব*হ বিস্ময় নিয়ে তার পানে চেয়ে আছি। কাজী সাহেব আমাদের সামনে বসে আছেন। বিয়ে পড়ানো হচ্ছিলো আমাদের। হঠাৎ কোথা থেকে তার উদয় ঘটল টের পেলেননা কেউই! আমাদের ন্যায় কাজী সাহেবও বিস্মিত চোখে তাকালেন। উনার বিভ্রান্ত মনে কেবল একটা কথাই থেকে থেকে প্রশ্ন তুলছে, বিয়ে কি একটা হবে নাকি দুটো?

—-” মানে?”

গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন রাহিয়ান। আরফান ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে আবারও বললেন,

—-” আমি রাইকে বিয়ে করতে চাই! আজ আর এক্ষনি!”

—-” তোর মাথা ঠিকাছে তো? কি বলছিস এসব?”

—-” হ্যাঁ আমি সবটা ভেবেই বলছি!”

আরফান ভাইয়ের মুঠোবন্দিতে রাইয়ের হাত খানা খুব শক্ত ভাবে আঁটকে আছে। যেন আলগা হতেই রাই পালাতে না পারে। রা*গে, অভিমানে রাইয়ের ফর্সা মুখটা র*ক্তশূণ্য হয়ে উঠেছে। আমি রাইয়ের দিকে বোবা চোখে তাকাতেই রাই তেতে উঠল আরফান ভাইয়ার উপর। নিজের হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

—-” আমি আপনাকে বিয়ে করবো না! ছাড়ুন আমায়!”

আরফান ভাই নির্লিপ্ত চাহনি দিয়ে বললেন,

—-” তুমি না চাইলেও তোমায় আমাকেই বিয়ে করতে হবে রাই!”

—-” আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না!”

—-” আমি তোমাকে ভালোবাসি রাই! আর সারাজীবন আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই!”

রাই জ্ব*লে উঠে বলল,

—-” কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা! তাহলে আমি কেন আপনাকে বিয়ে করবো?”

—-” ভালোবাসো না কিন্তু ভালোবাসবে!”

রাহিয়ান স্টেজ থেকে নেমে গেলেন রাই এবং আরফান ভাইয়ার কান্ড দেখে! আমি অবাক চোখে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি। হচ্ছে কি এখানে?

—-” আবির তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই রাইয়ের সাথে জো*র করতে পারিসনা!”

—-” আমি রাইয়ের সাথে জো*র করছিনা রাফিদ! আমি ওকে ওর ক*ষ্ট গুলো থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করছি মাত্র! তুই বল, অরিনের কঠিন ষ*ড়*য*ন্ত্রে এই মেয়েটা কেন এতো ক*ষ্ট পাবে? কোনো দো*ষ না করেও সারাক্ষণ নিজেকে অপরাধী ভেবে যাবে! রূপের মতো একটা কা-পুরুষের কাছে বারবার ফিরতে চাইবে! এগুলা কি অ*ন্যা*য় হচ্ছে না ভাই? আ্ আর ভালোবাসলেই তো সবটা নিজের করে পাওয়া হয়না তাই আমি ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছি! আমিও কাউকে ভালোবেসেছি.. কিন্তু কখনও বলার সাহস করতে পারিনি! হয়তো কখনো বলতেও পারবনা!”

শেষ কথাটা বলেই আরফান ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো যেন কথাটা উনি আমাকেই বললেন! আমি উনার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেললেন আরফান ভাই। রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—-” তাই আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”

রাহিয়ান রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—-” রাই? তোমার কি মত?”

রাই মুখ তুলে তাকালো। অ*প*রাধী গলায় আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেই আরফান ভাইয়া বলে উঠলেন,

—-” রাই রাজি।”

—-” কিন্তু আবির…”

—-” আমি ওকে ভালোবাসি এটাই এনাফ রাফিদ! প্লিজ তুই আমাকে বাঁধা দিস না!”

রাহিয়ান আর বাঁধা দিলেন না আরফান ভাইয়াকে। উনি স্টেজে এসে আমার পাশে বসতে বসতে আরফান ভাইয়া আর রাইও উঠে এলো স্টেজে। কাজী সাহেবের পাশে দাঁড়াতেই বড় খালু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

—-‘ এই কে কোথায় আছিস আরও দুটো চেয়ার এনে দে। আজ আমার দু’টো ছেলের একসাথে বিয়ে হবে।”

বড় খালুর উৎসাহে ঘেরা মুখটা দেখে আরফান ভাইয়া ছোট্ট করে হেসে উঠলো। হাসি মুখেই বড় খালুর উদ্যেশ্যে বলে উঠলো,

—-” থ্যাংক্যু আঙ্কেল।”

বড় খালু ভরসা চোখে তাকালেন। ততক্ষণে দুটো চেয়ার নিয়ে হাজির হলেন ফাহিম ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া। চেয়ারে পাশাপাশি রাই আর আরফান ভাই বসতেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন। লেখালেখির পর্ব সেরে রাহিয়ানের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন,

—-” বাবা বলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’?”

কাজী সাহেব বলার প্রায় সাথে সাথে রাহিয়ান বলে উঠলেন,

—-” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

রাহিয়ান তিনবার কবুল বলতেই এনার কাজী সাহেব আমাকে বলে উঠলেন,

—-” বলো মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

আমিও নির্দিধায় বলে উঠলাম,

—-” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হতেই কাজী সাহেব রাই আর আরফান ভাইয়েরও বিয়ে সম্পন্ন করলেন। একসাথে আমাদের চারজনেরই বিয়ে সম্পন্ন হলো। রাইয়ের শুঁকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার অবচেতন মনটা বলে উঠলো,

—-” যা হয় ভালোর জন্যই হয়! রাই আর আরফান ভাইয়ের বিয়েটা হয়ে খারাপ হয়নি। মেয়েটার জীবন থেকে আর ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার ভ*য় রইলো না। এবার হয়তো রাইকেও কেউ নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।”

#চলবে____________________