#প্রেয়সী 🖤(৩৮)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৭৪.
রাহিয়ানদের বেশ বড় বিজনেস। খালুর নিজ হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা এই সম্পদ। বড় খালুর ইচ্ছে রাহিয়ানের পড়াশোনা শেষ হলে সেখানেই জয়েন করবে। হিমাদ্র ভাই আর খালুই পুরো বিজনেসটা দেখাশোনা করে। রাহিয়ানের পড়াশোনার শেষ ধাপটাও অতিবাহিত হলো গত রোববার। আজ বুধবার! খালুর আজ অফিস থাকলেও রাহিয়ানের অফিস জয়েন করার ব্যাপারে গোল মিটিং করছেন ড্রয়িং রুমে। বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু ঝা*মে*লা*য় পড়েছে খালু আর হিমাদ্র ভাই। তাদের টক্কর দিতেই হাত ধুয়ে তাদের পেছনে পড়েছে কিছু বিদেশি বিজনেসম্যানরা। খালু বেশ চিন্তিত! কারন যারা তাদের সাথে টক্কর দিতে নেমেছে তাদের আসল মালিক হলো এক পুঁচকে ছেলে। রাহিয়ানের সমবয়সী। যদিও সে এখনও অব্দি সামনে আসেনি যা করার পেছনে থেকেই করছে। খবর নিয়ে যতদূর জানা গেলো সে নিজেকে হাইড রাখতেই বেশি পছন্দ করে। খালু আর হিমাদ্র ভাইয়ের থেকে সবটা ডিটেইলসে জেনে বাঁকা হাসি হাসলেন রাহিয়ান। তার অদ্ভুতরকমের হাসিটা কারোর চোখে না পড়লেও আমার চোখ এড়ালো না। মনের মধ্যে অজানা ভ*য় কাজ করল! উনার এমন হাসির মানে কি?
ভার্সিটির গেটে নামিয়ে দিয়ে নিজেও ছুটলেন অফিসে। খালুর আদেশ ঠিক ১১ টার মধ্যে মিটিং রুমে রাহিয়ানকে প্রেজেন্ট থাকতে হবে। যদিও হাতে সময় আছে কিন্তু ঢাকা শহরে ভোরের আবহাওয়া দেখে সারাদিনের আবহাওয়া বিবেচনা করা ক*ষ্টসাধ্য! মূলত জ্যামে আটকালে ঘন্টা দুই এমনেই গায়েব হয়ে যায়।
উনার কঠোর আদেশে বাড়ির বাইরে শাড়ি পড়ে বের হইনা! যদিও আদেশ টা নিজের রুম পর্যন্তই বরাদ্দ ছিলো। কিন্তু খালামনির আদেশ উনার আদেশকে ডিঙিয়ে গেলো। সুতরাং, নিজের বাড়িতে শাড়ি পড়ে ঘোরা যাবে। সেটা খালমনির কঠোর আদেশ হয়ে উঠলো রাহিয়ানের বি*রু*দ্ধে। বাড়ির বউ শাড়ি না পড়লে ভালো লাগে নাকি? যখন বাইরে বের হবে তখন দেখা যাবে। কিন্তু নিজের বাড়িতে যদি যেমন খুশি তেমন ড্রেস পড়া না যায় তাহলে শান্তি থাকে? খালামনির মতে শান্তি থাকেনা। আমার মতেও শান্তি থাকেনা। কিন্তু সাহস দেখিয়ে উনার বি*রু*দ্ধে কিছু বলতে পারিনা। স্বামীর আদেশ শিরোধার্য।
এক এক করে রাহিয়ানের সব ফ্রেন্ডরাই বেরিয়ে গেলেন ভার্সিটি থেকে। এখন উনাদের পরিবর্তে ভার্সিটির সিনিয়র হলেন তাদের জুনিয়র ব্যাচ। বড়ভাইদের রেকর্ড ধরে রাখতে তারাও এখন ফার্স্ট ইয়ারের এডমিশন নেওয়া স্টুডেন্টদের সাথে র্যাগিং করে!
আরফান ভাই ভালো একটা জব হায়ার করেছেন। আরফান ভাইয়ের পরিবার বলতে উনি একাই। বাবা-মা নেই! রাইকে নিয়ে সে নিজেদের ছোট্ট রাজপ্রাসাদটাতে একাই থাকে। যদিও আরফান ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ নিজের জোগাড় করতে হতো না। তার বড় ভাই আবরাহাম দিতেন। তিনি এদেশে থাকেননা। ফ্যামিলি নিয়ে বিদেশে থাকেন। বিয়ের পর বউয়ের খরচ ভাইয়ের থেকে নিবেনা বলেই নিজের যোগ্যতায় ভালো জব অ্যারেঞ্জ করেছেন।
রাহিয়ানদের মাস্টার্সের ফাইনাল হতে হতে আমাদেরও ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল কমপ্লিট হয়ে গেলো। আজ আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাস। রাই আর আমি একসাথেই ক্লাসে ঢুকলাম। আরফান ভাই কিছুক্ষণ হলো ওকে দিয়ে সেও ছুটলো অফিসে। আমরা দুই সখি মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ক্লাসে এসে বসলাম। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে যদিও বিশেষ পরিবর্তন নেই তবুও বাচ্চাদের মতো ঐ যে আনন্দ। আগে ছিলাম ক্লাস ওয়ানে আর এখন প্রমোশন হলো ক্লাস টু-য়ে। এর আনন্দই আলাদা।
—-” মিসেস রাহিয়ান রাফিদ যে। দু’হাত ভর্তি অভিনন্দন। কেমন আছেন?”
পাশাপাশি আমি আর রাই বেশ মজা করছিলাম নিজেদের মাঝে। আচমকা টিচারের আগমনে দু’জনেই ভড়কে গেলাম। কোনো রকম শব্দ বিহীন তার আগমন! আমরা দু’জনেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্যারের কন্ঠে স্বাভাবিকতার বিপরীতে যেন তাচ্ছিল্যের টান বেশি এলো। আমি ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানলাম। নিতান্তই জোরপূর্বক। স্যার আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। পূনরায় একই কন্ঠে বলে উঠলেন,
—-” বিয়ে হতে না হতে ভালোই সুন্দরী হয়ে গিয়েছো দেখছি।”
স্যার চোখা দৃষ্টিতে তাকালো। আমার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। রাই পাশ থেকে ক্ষু*ব্ধস্বরে বলল,
—-” আপনি এসব কি বলছেন?”
রাইয়ের আওয়াজে স্যার ঘোর কাটাতে পারলেননা! আমার থেকে চোখ তুলতে উনার বেশ বেগ পেতে হলো। রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বি*কৃ*ত হেসে বললেন,
—-” হ্যাঁ? কিছু বলছো?”
রাই ফুঁসে উঠলো মুহুর্তেই! ওর মেজাজ ঘেটে ঘ হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতেই মুখ খুললাম আমি। ভদ্রতা দেখিয়ে বেশ জোরালো কন্ঠে বললাম ,
—-” আসসলামু আলাইকুম স্যার। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? বাড়িতে ম্যাম কেমন আছেন?”
আমার উচ্চস্বরে স্যার চমকে উঠলেন। উনার ঘোরও কাটলো বুঝি। আমার দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললেন,
—-” ওয়ালাইকুম আসসালাম! ভ,,ভালো আছে তোমাদের ম্যাম। তোমরা কথা বলছিলে কেন দু’জনে? খেয়াল করো না টিচার কখন ক্লাসে ঢুকে? আর কথা বলবেনা না, বসো বসো।”
স্যারের পারমিশন পেয়েও একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা দু’জনেই! রাই বাঁকা হেসে জোরেশোরে বলে উঠলো,
—-” স্যার আমাদের দু’জনের কিন্তু একসাথেই বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর কিন্তু নিধি একাই সুন্দরী হয়নি আমিও কিন্তু হয়েছি। কমপ্লিমেন্ট দিলে আমাদের দু’জনকেই দিন, একজনকে কেন দিচ্ছেন?”
রাইয়ের কথায় পুরো ক্লাস ঘুরে তাকালো স্যারের দিকে। স্যার পড়ল বিপাকে। বোকার মতো দাঁত কেলানো হাসি হেসেও কারোর তীক্ষ্ণ চাহনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছেনা! স্টুডেন্টদের মাঝে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। রাই মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রাখল। স্যার কাশতে লাগলেন অপরাধ বোধের হাত থেকে বের হতে। বারবার গলা খাঁকারি দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন বোর্ডের সামনে। বইটা হাতে নিয়ে শঙ্কিত মনে পড়াতে শুরু করলেন! আমরাও আর কিছু বললাম না। চুপচাপ পড়ায় মনোযোগী হলাম।
ব্রেক টাইমে আরফান ভাই এলেন রাইকে নিয়ে যেতে। তাদের আজ কোথাও একটা যাওয়ার প্ল্যানিং ছিলো হয়তো। রাই আমার থেকে কোনো মতে বিদায় নিয়েই চলে গেলো আরফান ভাইয়ের সাথে। ওদের ছোট্ট সংসারটার আমি নাম দিয়েছি টোনাটুনির সংসার। দু’জনকে পাশাপাশি বেশ বানায়। খুব সম্ভবত তারা দু’জন দু’জনকে কাছে টেনে নিয়েছে। রাখেনি আর কোনো পিছুটান। আমি এটুকুনি শুনেই বেশ খুশি হয়েছি। রাই ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকতে পারব। রাই বলছিলো, ওর মা মাঝেমধ্যে ফোন করে। ওর ভালোমন্দের খবর নেয়। কি রান্নাবান্না হয়,কি খায় না খায় সব কিছুই সে জানতে চায়। বুঝলাম আন্টিও মেয়ের শূন্যতা অনুভব করে ক*ষ্ট পাচ্ছে। রাইয়ের ভাই প্রায়ই বোনের খোঁজ নিতে একদম বাড়িতে এসে হাজির হয়। আর আসলেই গাড়ি ভর্তি করে ফল-পাকুড় নিয়ে আসে। সবটা জেনে আমি নিজেও খুব আনন্দিত।
৭৫.
ক্যান্টিনে বসে রাহিয়ানের অপেক্ষা করছি। কল করে বললেন, আড়াইটা নাগাদ উনি আসবেন ভার্সিটিতে। ভেবে খুশি হয়েছিলাম উনি হয়তো আমাকে নিতে আসছেন। কিন্তু উনি নাকি কোনো এক কাজেই আসছেন এখানে। আর তারপর একসাথে বাসায় ফিরবেন। তাই অপেক্ষা করছি। দু’দিন ধরে বেশ গা গোলাচ্ছে আমার। খাবার দেখলেই উল্টি প্রসেস অন হয়ে যেতে চায়। সমস্যাটা অবশ্য এর আগে কখনও হয়নি! তবুও বাসায় কাউকে কিছু জানাইনি। জানি কোনো বড় সমস্যা নয়! গ্যাস জনিত সমস্যা হচ্ছে হয়তো। কয়েকদিনের মাঝেই ঠিক হয়ে যাবে। জানায়নি বললে হয়তো ভুল হবে, জানাতে গিয়েও বারবার ফিরে এসেছি উনার ভ*য়ে।
উনি এই সমস্যার কথা জানতে পারলেই কপট রা*গ দেখিয়ে বকতে আরম্ভ করবেন। আর দো*ষ হবে আমার খাবারের! উনার বক্তব্য, আমি নাকি ঘরের খাবারের চেয়ে বাইরের খাবারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই। এটা সত্যি নয়, আমার বি*রু*দ্ধে সবচেয়ে বড় অ*পবাদ। বিয়ের আট মাসের মাথায় ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল টার্ম শেষ করে যেখানে আজই প্রথম ক্লাস করতে এলাম সেখানে বাইরের খাবার কিভাবে খাওয়া হলো?
—-” ম্যে আই সিটেড প্লিজ?”
প্রত্যাশা ছিলো রাহিয়ানের! পরিবর্তে মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি এঁটে সামনে এসে দাঁড়ালেন কেশব। কম করে হলেও উনাকে এই আটমাস বাদে দেখা। আমাদের বিয়ের আগে উনাকে নিয়ে অনেক কাহিনী হলেও বিয়ের পর উনাকে আর দেখা যায়নি কোথাও। রিম্মি আপু জানিয়েছিলো উনি নাকি আবারও বিদেশে ফিরে গিয়েছেন! কবে এলো কে জানে?
আমি নড়েচড়ে বসলাম। উনি অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লেন। মুখে পূর্বের ন্যায়ই হাসি জুড়ে বললেন,
—-” কেমন আছেন নিধি?”
—-” ভ্ ভালো। আপনি দেশে ফিরলেন কবে?”
কেশব নিঃশব্দে হেসে উঠলেন। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে ডান হাত টা তুলে ভ্রু চুলকে বললেন,
—-” দেশে থেকেই কি দেশে ফেরা যায়?”
আমি ভাবুক কন্ঠে বললাম,
—-” মানে?”
—-” আমি তো দেশেই ছিলাম। কোথাও যায়নি তো!”
—-” তবে যে রিম্মি আপু বলেছিল…”
—-” কারন ওরা জানে আমি দেশের বাহিরে আবারও ব্যাক করেছি তাই।”
—-” মানে?”
—-” মানে এটাই যে আমি কোথাও যায়নি! আমি দেশেই ছিলাম তবে ফ্যামিলির থেকে আলাদা। এই যে আমি আপনার সামনে আছি এটাও কেউ জানেনা আপনি ব্যাতীত। ইভেন আপনার হাজবেন্ডও নয়। আশাকরি জানবেও না। কি বলুন?”(ভ্রু নাচিয়ে)
আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। উনি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছেন! উনি এতদিন দেশেই ছিলেন কিন্তু কাউকে না জানিয়ে! কিন্তু কেন? আর এতোদিন পর হঠাৎ করে আমার সামনেই বা এলেন কেন? কি উদ্দেশ্য উনার?
—-” আপনি হঠাৎ এতোগুলো দিন বাদে আমার সামনে কেন এলেন? কি দরকার?”
আমার কথায় উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। এতক্ষণ চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে ঠেস দিয়ে বসলেও এবার সোজা হয়ে বসলেন। ঘাড়টা দু’বার এপাশ ওপাশ কাত করে আমার চোখের দিকে তাকালেন। উনার চোখের মাঝে লালচে দাগ। হিং*স্র*তা ভরপুর। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি চেয়ার টেনে আরেকটু এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমি পিছিয়ে যেতে নিলেই উনি বলে উঠলেন,
—-” সিক্রেট কথা। এটা শুধু আমার আর রাহিয়ানের মধ্যেই হয়েছে। আর কেউ জানেনা। ভাবলাম আপনাকেও জানাই কারন আপনি আর রাহিয়ান তো একই হলেন তাই না?”
আমি চমকে উঠলাম উনার ফিসফাস আওয়াজে। ঢোক গিলে বিরস মুখে বললাম,
—-” রাহিয়ান আর আপনার মধ্যে সিক্রেট কথা!”
—-” হু। কেন? আপনি জানেন না? রাহিয়ান আপনাকে কিছু জানায়নি?”
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—-” কি জানাবেন?”
—-” এই যে ওর আর আমার মাঝে আপনাকে নিয়ে ডিল হয়েছে?”
আমি হোঁচট খেলাম উনার কথায়। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হতেই আমি কঠিনস্বরে বললাম,
—-” আপনি কি বলতে চাচ্ছেন স্পষ্ট করে বলুন?”
উনি বাঁকা হাসলেন। গলার স্বর পরিস্কার করে বললেন,
—-” রাহিয়ানের ধারনা আমি আপনার বাবাকে মা**র্ডা**র করেছি! তাই সে ঠিক এক বছর সময় নিয়েছে এটা প্রুফ করতে। আর এই এক বছরের মাথায় আমি দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না! সো, আমার এই ক্ষ*তিপূরণ চুকাতে আমিও ওর সামনে একটা ডিল রেখেছি, ও যদি সত্যি প্রুফ করতে পারে আমি আপনার বাবাকে মা**র্ডা**র করেছি তবে আমি নিজে সারেন্ডার করবো পুলিশের কাছে। আর যদি ও প্রুফ করতে না পারে তাহলে ও আপনাকে ছেড়ে দিবে। আমার জন্য।”
আমি নির্বিকার চোখে তাকালাম। বুকের ভেতরটা আজ বহুদিন পর যেন আবারও বাবার শূন্যতায় খা খা করে উঠলো। লোকটা এসব কি শোনালো? তবে কি আমার বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিলো না? নাকি স্বাভাবিক ছিলো! রাহিয়ান কি করে উনার এই ডিলটা মেনে নিতে পারলো? উনার কি একবারও মনে হলো না আমার কথা?
আমার মাথার মধ্যে চিনচিন করে ব্যাথা আরম্ভ হলো। নিজেকে কেমন ভার শূন্য লাগছে। কেশবের থেকে আর একটা কথাও শোনার জন্য রুচিতে টানলো না। উনারা দু’জনেই সমান! লোকটা আমার বাবার খু**নি! আমি কম্পিত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশে প্রকৃতির যথেষ্ট আলো থাকলেও আমার চোখ দুটোতে ভর করেছে অন্ধকার। যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই কেবল অন্ধকার! সামনের দিকে বোধকরি দুই পা এগিয়েছিলাম। আর হাঁটা সম্ভব হলো না। ওখানেই শরীরের ভার ছেড়ে লুটিয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি জীবনের শেষ দিন। চোখ খুলে আরও একবার দুনিয়া দেখার শখ জেগে উঠেলো না। কিন্তু কথায় আছেনা, মানুষ যা চায় তা পায়না। আর যা চায়না তা-ই পায়!
#চলবে____________________
#প্রেয়সী 🧡(৩৯)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৭৬.
ভার্সিটির ক্যানটিনে যখন অ*জ্ঞা*ন হয়ে নীচে পড়ে গেলাম তখন মনে হচ্ছিলো ওখানকার বেশিরভাগ মানুষই আমাকে তী*ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছে না, অথচ দেখে দেখে মজা নিচ্ছে। তারা কে কি ভাবল জানা নেই।
যখন চোখটা বুঁজে যাচ্ছিল তখন হয়তো হৈচৈ লেগেছিলো। কেশব হয়তো ছুটে পালিয়ে ছিলো। রাহিয়ানও যে কোথা থেকে ছুটে এলো জানা হলো না। যখন চোখ মেলে সবাইকে নির্লিপ্ত চোখে দেখছিলাম, তখন হঠাৎই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল রাই। ওর পেছনেই আরফান ভাই দাঁড়িয়ে। আমি চমকে উঠলাম ওর আচরনে। ওকে দু’হাতে ধরতে ধরতে আশেপাশে নজরে এলো বাড়ির সবাইকে। চাচা-চাচিও আছেন দেখছি। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ধারন করতে পারছিনা। রাই আমোদিত গলায় বলতে লাগল,
—-” কংগ্রাচুলেশনস সোনা।”
রাইয়ের কথায় অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েও বিভ্রান্ত হলাম। আমার ডান পাশে বাড়ির ডক্টর আশফাক আলীও আছেন দেখছি। আমার দৃষ্টি সবাইকে ছাপিয়ে রাহিয়ানের পানে ছুটলো। গম্ভীর মুখে হাত ভাজ করে ডক্টরের সাথে আলাপচারিতা করছেন উনি।
আলাপচারিতার মধ্যমনি হয়তো আমিই! আমার দৃষ্টিকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে গেলেন তিনি। তাই ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালামনি আর চাচির দিকে তাকালাম। দু’জনের মুখ জুড়েই তৃপ্তির হাসি! আমার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দৃষ্টি তাদের তৃপ্তি বাড়ালো বৈ কমালো না। বউ মনি,রিম্মি আপু,ফাহিম ভাইয়া সবাই আনন্দে মিটমিট করে হাসছে। ফাহিম ভাইয়া হয়তো আমাকে একবার বুকে জড়িয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছেয় ছটফট করছে। ছটফট করছেন রাহিয়ানও কিন্তু খুশিতে নয় অজানা এক ভ*য়ে। ডক্টর প্রেসক্রিপশন তুলে রাহিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রাহিয়ান খুব সাবধানতার সহিত হাতে নিলো সেটা। ভাবলাম এবার হয়তো উনার গাম্ভীর্য মুখের পরিসমাপ্তি ঘটে হাসির রেখা ফুটে উঠবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। উনি ভুলক্রমেও আমায় দেখলেন না। ডক্টর ব্যাগ তুলে উঠ দাঁড়াতেই আরফান ভাই হাসি মুখে এগিয়ে এসে “আমাকে দিন” বলে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিলো। ডক্টর আরফান ভাইয়ের দিকে একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের আমার দিকে তাকালেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—-” তোমার প্রেগন্যান্সির আড়াই মাস চলে! অনেকে খুব সহজেই ব্যাপারটা ধরতে পারলেও হাতে গোনা মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষেরই একটু সময় লাগে। তোমার ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। নিজের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে হবে। তোমার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু সবার কমপ্লেন শুনলাম! বেবি কনসিভ করলে মাকে ভীষণ সচেতন হতে হয় বিশেষ করে নিজের যত্নের ব্যাপারে। যদিও বাড়ির সবাই তোমার প্রতি খুবই যত্নশীল তবুও ভ*য় তোমাকে নিয়ে। প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে কিন্তু খাবারের প্রতি অনিহা, খাবার থেকে গন্ধ লাগতেই বমি হওয়া এমন আরও কিছু সমস্যা হবে। তাতে তোমার শারীরিক কন্ডিশন একটু দুর্বল থাকবে। তাই বলে কিন্তু ভাবা যাবে না খাবার না খেলেই তো আর সমস্যা নেই! এটা ভাবলে তুমি ভুল করবে। বেবির যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় তার জন্য তোমাকে খাবার-দাবারের প্রতি আরও সিরিয়াস হতে হবে! সম্ভব তো?”
ডক্টরের কথা গুলো শুনে যেন না চাইতেও আপনাআপনি আমার হাতটা পেটের উপর উঠে এলো। উনার থেকে আমার ড্যাবড্যাব চাহনি তুলে পেটের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। আমার ভেতরে কারোর অংশ দিন দিন বেড়ে চলেছে আর আমি টেরই পায়নি! এটা কি করে সম্ভব?
—-” অবশ্যই সম্ভব। ও নিজে নিজের যত্ন না নিলেও বা কি আমরা তো আছি। ঠিকই ওর যত্ন করব। এই ক’টা দিন আর কোথাও বের হওয়া চলবেনা। যা করবে সব আমাদের চোখের সামনে থেকে করবে। বাইরে গেলে এমনিতেই তুমি খাওয়া দাওয়া সব মাথায় তুলো। আর এই সময় এমন কিছু হলে মাও ঝুঁ*কিতে থাকবে বাচ্চাও ঝুঁ*কিতে থাকবে।”
খালামনির কথায় ভরসা পেলেন ডক্টর। মুচকি হেসে আমার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। উনার পেছন পেছন গেলেন রাহিয়ান আর আরফান ভাই। তারা বের হতেই সবাই যেন লাফিয়ে পড়ল আমার উপর। ফাহিম ভাইয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমায় ঠিক আধাঘন্টাই বুকে আগল রাখল। রিম্মি আপু,বউ মনি,রাই তারাও কিছু কম যায়না। সবার আনন্দে আমার মনটাও যেন ভরে গেলো। ইশশ, বাড়িতে কোনো বাচ্চার আগমনের বার্তায় বুঝি এতো আনন্দ হয়।
—-” আমার সংসারটা আজ পরিপূর্ণ করলি রে মা। আজ তুই আমাদের যে কতটা আনন্দ তা দিলি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
খালামনির ছলছল করা চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে দু’ফোটা জল পড়তেই হাতের পিঠে মুছে ফেলল তৎক্ষনাৎ। আনন্দের জল মাটিতে পড়তে নেই। হাতের মুঠোয়ই থাক। আমি দুর্বল চাহনি দিয়ে ছোট্ট করে হাসলাম। সময়টা খুব আনন্দের হলেও যেন হঠাৎ মেনে নিতে পারছিনা আমি! কেশবের ভাস্যমতে রাহিয়ান প্রমান করতে ব্যর্থ হলে আমি উনার থেকে পর হয়ে যাবো। আমরা দু’জন আলাদা হয়ে গেলে আমাদের সন্তানের কি হবে? যখন সবাই জানতে পারবে আমাদের ভা*ঙ্গ*ন নিশ্চিত তখন আমাদের অনাগত বাচ্চার জন্য তাদের যে এই আনন্দ সেটা কি তখনও থাকবে? নাকি কোনো এক ঝড়ো হাওয়ায় ধুলোর সাথে মিলিয়ে যাবে তাদের এই আনন্দ, উল্লাস। তখন যে ওর কপালে জুটবে সবার অবহেলা! আজ যেখানে সবার চোখে খুশির ঝলমলে আলো সেদিনতো থাকবে কেবল ক্ষো*ভ আর হিং*স্র*তা*য়ে ঘেরা অ*ন্ধকার! সেটা আমি কি করে মেনে নিবো? কি করে মেনে নিবো আমার সন্তানের প্রতি সবার অবহেলা,অনাচার, ক্ষো*ভ আর হিং*স্র*তা?
তবে কি ওর পৃথিবীতে পদার্পণ ঘটার আগে ওর শেষ চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াটাই উত্তম হবে?পৃথিবীর এই জ*ঘ*ন্য পরিবেশে আসার আগেই ও চলে যাক বাবার কাছে। সেখানে তো মা-ও আছে। আমার বাবা-মা নিশ্চয়ই আমার সন্তানকে অবহেলা করতে পারবেনা! ও নিধির সন্তান জানলেই তো একদম আকড়ে ধরে রাখবে তারা। হ্যাঁ তবে তাই হবে। আমিও রাখব না তোকে। এই পৃথিবীতে এনে তোকে কিছুতেই অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে তোর জীবনটা আমি ন**ষ্ট করতে পারব না। যদি তুই কখনও আমার দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করিস,
“এতো অনিশ্চয়তা,একাকিত্বতা আর বিষন্নতার মাঝে আমাকে কেন একা ফেলে চলে গেলে?” তখন আমি কি জবাব দেবো ওকে? কোনো জবাব নেই তো আমার কাছে! আর আমার কোনো অধিকারও নেই একটা মানুষকে এভাবে ক**ষ্ট দেওয়ার। বেটার হোক তুই আসবিই না এই দুনিয়াতে। আমি এব্রেশন করে ফেলব! হ্যাঁ তাই করবো।
—-” কিরে কি ভাবছিস এতো?”
রাইয়ের হাতে ধাক্কা লাগতেই হকচকিয়ে তাকালাম আমি। সব মুখগুলো প্রশ্ন সুচক হয়ে আমাকেই দেখছে! আমার ভাবনার তাল ঘেঁটে যেতেই আমি বোবা চোখে সবার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
খালামনি বলল,
—-” এই হয়েছে, অনেক হয়েছে মেয়েটাকে নিয়ে দলাইমলাই করা। এবার ওকে একা ছাড়তো। ও একটু রেস্ট নিক। এই আদ্রিতা?”
খালামনির ডাকে রিম্মি আপুকে পাশ কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো বউমনি। বলল,
—-” হ্যাঁ কাকিয়া বলো?”
—-” বলছি কি রে মা, ওকে একটু ফ্রেশ হতে হেল্প কর! আমি বরং ওর জন্য হাল্কা কিছু খাবার পাঠিয়ে দেই। তুই একটু ক*ষ্ট করে খাইয়ে দিস মা।”
—-” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সব করে দিচ্ছি তুমি একদম চিন্তা করো।”( মাথা নেড়ে)
—-” আ..আবার এখনি খেতে হবে? একটু পরে খাইনা প্লিজ!”
আমার বানী কারোর মোটে পছন্দ হলো না। সবাই চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। খালামনি রা*গি গলায় বলল,
—-” আবার শুরু হয়ে গেলো বাহানা। যা পাঠাবো লক্ষি মেয়ের মতো খেয়ে নিবি! বেয়ান, বেয়াই আপনারা আমার সাথে আসুন। আপনারা সেই কখন এলেন আপনাদের কিছু খেতেও দিলাম না! এই রিম্মি, ফাহিম তোরাও আয়। আমায় হাতে হাতে হেল্প করে দিবি।”
খালামনি সবাইকে নিয়ে চলে গেলো। বাকি রইলাম আমরা তিনজন। বউমনি উঠে আলমারি খুলে ড্রেস বের করে আনল। রাই আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। আমি বসতে বসতে বললাম,
—-” বউমনি তোমাদের ক*ষ্ট করতে হবেনা প্লিজ! দেখো আমি একাই পারবো সবটা করতে।”
বউমনি বুঝি গায়ে লাগালো না আমার কথা। ওয়াশরুমে গিয়ে আমার ড্রেস গুলো রেখে বের হয়ে এলো। আমার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,
—-” কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট? সেই তখন থেকে দেখছি মুখে এক ফোঁটা হাসিও নেই!”
বউমনির কথার সুর টেনে রাই বলে উঠলো,
—-” ঠিক বলেছো বউমনি। হ্যাঁ রে নিধু? কিছু নিয়ে ভাবছিস নাকি? কি হয়েছে সোনা? বেবি আসার খবরে কি তুই খুশি নস?”
বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। কেঁপে উঠলাম আকস্মিক! অসহায় কন্ঠে বললাম,
—-” সন্তান আসার খবরে কোন মা কি কখনও অখুশি হতে পারে?”
রাই মলিন হাসল। আমার গালে হাত রেখে বলল,
—-” সরি রে! আমি কিন্তু কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি!”
—-” আচ্ছা তোরা এতো খুশি কেন বলতো?”
আমার প্রশ্নে রাই ফিক করে হেসে দিলো। বউমনির দিকে ফিরে বলল,
—-” বউমনি, শুনো মেয়ের কথা। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কোল আলো করে কেউ আসতে চলেছে। আর সেই খবরে আমরা নাকি খুশি হবো না? এও কি সম্ভব?”
বউমনিও হাসল। ওদের দু’জনের হাসি দেখে আমার গা জ্ব**লে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হাসির পেছনেই লুকিয়ে আছে একরাশ ঘৃ*না। এক সমুদ্র অবহেলা। সবটাই আমার সন্তানের জন্য! সবটাই ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটার জন্য।
৭৭.
রাত ১০টা। বিছানায় গা লাগিয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে আরম্ভ করল। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গেলাম ওয়াসরুমে। ভেতরে পা রাখতে না রাখতেই দুনিয়া আঁধার করে বমি শুরু হয়ে গেলো। উনি কোথায় ছিলেন জানিনা। আকস্মিক পেছনে থেকে এসে ধরলেন আমায়। দু’হাত দিয়ে মাথার এপাশ ওপাশ চেপে ধরলেন বমি থামানোর জন্য। কিন্তু বমি থামলো না। যতটুকু হওয়ার প্রয়োজন ছিলো হয়ে গিয়েছে! শরীরে আর কুলচ্ছে না যেন। বমি করেও শান্তি নেই। হাত-পা শীতল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
পাশে উনাকে আবিষ্কার করতে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু যখনই ভাবি মানুষটার সঙ্গে দু’টো কথা বলব তখনই মনে পড়ে কেশবের কথা গুলো। উনি আমার মনের বার্তা বুঝে নিলেন কি না জানিনা! আমায় দুই হাতে শক্ত করে আগলে ধরলেন। যেন বৈশাখী ঝড়ো হাওয়াতেও এই বাঁধন ছুটবে না। উনি আমার চাহনিকে এড়িয়ে গিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নিলেন আমায়। বিছানা অব্দি আসতে আসতে উনার থেকে এক মিনিটের জন্যও চোখ সরেনি আমার। যখন বিছানায় শুয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন আমিও কি ভেবে উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি কিছু বললেন না। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানলেন। পাশের টেবিলে উনার অফিসের কাগজ পত্রের দিকে ইশারা করে বললেন,
—-” আর একটু কাজ আছে!”
আমি অভিমানী সুরে বললাম,
—-” আমায় রেখে কাজ বেশি ইম্পরট্যান্ট হলো?”
—-” প্রশ্নই আসেনা এমন কিছুর। হিমাদ্র ভাইকে এই ফাইলটা আর দশ মিনিটের মধ্যে সেন্ড করতে হবে। ঐদিকে ক্লায়েন্টরা বসে আছে এই প্রজেক্টের জন্য। তাই একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম। কাজটা শেষ করতে পাঁচ মিনিটও লাগবেনা তাই ভাবলাম সেরে এসে একবারেই তোমার পাশে বসি। কিন্তু এখন আর সেটাও ইচ্ছে করছেনা। আমি ফাহিমকে বলে ভাইয়ার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভাইয়া করে নিবে।”
আমি হাত ছেড়ে দিলাম উনার। অভিমান চেপে সাফ গলায় বললাম,
—-” কাজটা কমপ্লিট করে নিন।”
উনি মানলেন না। ঘুরে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন। পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন আমায়। গালে নাক ঘষে বললেন,
—-” তুমি আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট অথচ বুঝতেই পারলেনা। ব্যাপারটা কিরকম অদ্ভুত লাগছেনা বলো?”
—-” অদ্ভুত লাগবে কেন? আজকাল বড় বড় ভ*য়ং*ক*র ব্যাপারও স্বাভাবিক ভাবে সামনে এসে দাড়াচ্ছে! এ আর এমন কি?”
—-” আর কিছুদিন পেরোতেই আমরা প্যারেন্টস্ হয়ে যাবো। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে না এই তো সেদিনই আমি প্রথম দেখলাম তোমায়। হাতে গোনা দু’দিন হলো! আর তারপর টানা দু’টো বছর পা*গ*লে*র মতো খুঁজলাম তোমায়। অতঃপর পেয়েও গেলাম। দ্যেন, কয়টা দিন লুকিয়ে ভালোবাসলাম তোমায়। আর তারপর বিয়ে। সবটা কেমন একসাথে মিলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না?”
—-” হু।”
—-” আর আজকে বিশেষ খবর হলো সেই পুঁচকে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে সে। আর আমি তার বাচ্চার বাবা হবো।”
—-” কেশবের সাথে এমন একটা ডিল কেন করলেন?”
প্রশ্নটা আমার মতে ভীষণ ভ*য়ং*ক*র! হয়তো উনার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে অনেক রিয়াকশন লেনদেন হয়ে যেতো। কিন্তু উনি শান্ত। তাই আমিও নির্বিকার। উনি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলেন। উনার হাতটা আলতো করে আমার পেটের উপর রেখে বললেন,
—-” তোমার ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে?”
—-” বাবা খু**ন হয়েছে কেশবের হাতে অথচ আপনি আমাকে কখনো জানানোরই প্রয়োজন মনে করলেন না!”
—-” জানানোর কিছু ছিলো না! হয়তো তোমার ক**ষ্ট*টা আরও দু’গুন বেশি হতো। বাবার খু**নি*কে খুঁজে বের করার জন্য তুমি হয়রান হয়ে থাকতে, বলতে গেলে তুমি পাগলই হয়ে যেতে তাই তোমায় কিছু জানাইনি!”
—-” তো আপনার কি মনে হচ্ছে আজ আমি ভীষণ ভালো আছি? আজ আমার মোটেও ক**ষ্ট হচ্ছে না?”
—-” কেশব তোমায় কেন এসব কথা নিজের থেকে জানিয়েছে বলোতো?”
—-” জানিনা! আর জানতেও চাই না! শুধু এটুকু জানি আপনার জন্য আমার সন্তানের ভবিষ্যত অন্ধকারে ঢেকে যাবে। ওর জীবনটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ওর বর্তমান,ভবিষ্যত সবটা লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আর এ-সব কিছু হওয়ার পেছনে একমাত্র দায়ী থাকবেন আপনি।”
—-” ভুল বুঝছো?”
—-” এতোদিন হয়তো ভুলই বুঝেছি আপনাকে! আজ হয়তো ঠিক বুঝতে পারছি! আপনি বাবার খু*নে*র কোনো প্রমান দিতে না পারলে আপনি আমায় কেশবের কাছে পাঠিয়ে দিবেন? আমার ভাবতেই ঘৃ*না হচ্ছে নিজের উপর! আজকাল আমায় নিয়ে আমার স্বামী ডিলও করে আসে। তাও এমন একজন মানুষের সাথে যে কি না আমার বাবার খু**নি!”
আমায় ছেড়ে উঠে বসলেন উনি। আমার একেকটা অপবাদ মুখ বুঝে মেনে নিলেন স্রেফ। জবাবে কিছুই বললেন না! তার মানে কি দাঁড়ায়? আমার দেয়া অপবাদ গুলো একটাও ভুল নয়! সবই ঠিক। যা ঘটেছে সবটাই ঠিক। ঘৃ*না*য় উনার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করলো না। কান্না গুলো গলার কাছে এমন ভাবে দলা পাকাতে লাগল যে ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদি!
কেন মানুষটা আমায় এভাবে পর করে দিতে রাজি হলো! কেন হলো? তবে কি উনার জীবনে আমার আর কোনো মূল্য নেই! সবটা শেষ হয়ে গেলো? পর হয়ে গেলাম আমি? তবে কি আমাদের সন্তানও মূল্যহীন? উনার চুপ করে থাকা যে মেনে নিতে পারছিনা আমি! কান্না চেপে বসেতেই পাশে ফিরে গেলাম। দুহাতে মুখটা চেপে ধরেই গিলতে লাগলাম কান্না গুলো। কেন উনি কিছু বলছেন না? কেন জোর দিয়ে বলছেন না, নীলাদ্রিতা? কেশব যা বলেছে সবটা মিথ্যে! সবটা বানোয়াট। আমার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে আমি কিভাবে ডিল করতে পারি বলো? এই মানুষটার মাঝেই তো আমার প্রাণভোমরা থাকে। কি করে পারি তোমায় অন্যকারোর হাতে তুলে দিতে? এমন কথা তুমি ভাবলেই বা কি করে?
উনি কিছুই বলছেন না! উনার চুপ থাকাই যে বলে দিচ্ছে কেশবের একেকটা সিঙ্গেল ওয়ার্ডও সত্যি। সব সত্যি!
#চলবে____________________