#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব-০৮
১৫.
—-“এটা কি করলি তুই!”(মৃদু চেঁচিয়ে)
আমার রিয়াকশনে রানির মুখের হাসিটা কিছুটা মিইয়ে এলো। মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,
—-” সব দাগ কি উঠবার চায় কন দেহি! তয় আমি উঠাইবার একটা চেষ্টাও হাত ছাড়া করিনাই! এক্কেবারে ঘইষা ঘইষা সব দাগ উঠায় দিছি।”
আমি শার্ট টা রানির সামনে তুলে ধরে একবুক কষ্ট নিয়ে বললাম,
—-” তাই বলে এভাবে? পুরো শার্টটা কেচে কেচে আলুভর্তা করে তারপর জায়গা জায়গা থেকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে তো তোকে দাগ উঠাতে বলিনি রে বোন! তুই তো আমায় ম/রা/র আগেই মে/রে ফেললি!”
রানি প্রথমে খানিক উৎসাহ নিয়ে তাকালো। পরক্ষণেই কিছুটা নিভে গিয়ে কালো মুখ করে বলল,
—–” ম/রা/র আগে মা/র/ছি! ক্যামতে? আফনে কিয়া কন আফা?”
ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম আমি। বোধগম্য হলো রানিকে সিংহ মামার শার্টটা দেওয়াই হয়েছে সবচেয়ে বড় পাপ! বুক ফেটে কান্না আসছে আমার। গতকাল উনার এই শার্টে সামান্য কফি পড়ায় উনার সো কল্ড ফ্রেন্ডরা যা করলো আমার সাথে! তাতে করে আজ তারা এই ছিঁড়ে ফাটা শার্টের এমন করুন দশা দেখলে আমায় ঠিক দশতালা বিল্ডিংয়ের উপর থেকে ছুঁ/ড়ে ফে/লবে। পারলে তো এই শার্টের ন্যায় উত্তম মাধ্যম দিয়ে আমায় আলুভর্তা করে দিবে।
—-” আফা, আফ্নের কওনের পরই কিন্তু আমি এতো ভালা কইরা ধুইছি শার্ট টা। এবার আমারে কি জানি গিফোট দিবেন কইছিলেন। হেগুন দিবেন না?”
রানি আবারও উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠলো কথা গুলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,
—-” শার্ট টা ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থায় তো রাখলিনা! কিন্তু সেখানে গিয়ে সিংহ মামার থাবা থেকে বাঁচার জন্য অন্তত গর্জনটা সহ্য করতে হবে। আর সবশেষে যদি বাড়িতে ফিরে আসতে পারি তবে শিওর তোর জন্য কোনো গিফো… আই মিন গিফ্ট নিয়ে আসবো।”
রানি খুশিতে নেচে উঠলো। দুই তিনটা লুঙ্গি ডান্স মে/রে ঘর থেকে বিদায় নিলো। ওর আর কি? ওর ধৌতকরণের কাজ ছিলো ও করে দিয়েছে। কপাল তো আমার পো/ড়া। রাফিদ ভাইয়াকে ফেস করতেই মন সায় দিচ্ছে না। কি করে গিয়ে বলি,
“ভাইয়া আপনার শার্ট টা আমার বাসার কাজের মেয়ে রানি ভালো করে ধোয়ার তাগিদে ঘর মোছার উপযুক্ত করে ফেলেছে। এই নিন আপনার শার্ট! গায়ে তো আর দিতে পারবেননা! ভালো হবে বাসায় গিয়ে বাসার কারোর হাতে তুলে দিয়ে বলবেন, ঘর মোছার জন্য একজন গিফ্ট করেছে। যদিও আহামরি কোনো উপহার নয়। তবুও, উপহার তো, ফেলতে পারিনি। তাই নিয়ে এসেছি।”
নিজের এমন আহাম্মক মার্কা ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলাম। শার্ট টার দিকে তাকালেই মনে হয় কেউ যেন পিঠের উপর ধপাধপ্ করে কিল-ঘুষি বসাচ্ছে। মনটা ছটফট করছে। এই শার্ট নিয়ে কিছুতেই রাফিদ ভাইয়ার মুখোমুখি আমি হতে পারবো না। অসম্ভব! শার্টটা হাতে নিয়েই উঠে গেলাম আলমারির কাছে। আলমারি টা খুলে ভেতরে মায়ের গয়নার বাক্সটার পাশেই সযত্নে তুলে রাখলাম তার শার্টটা। থাক এখানে। একটা শার্ট-ই তো। দরকারে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিবো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের জন্য।
বুক ভরে নিঃশ্বাস আসলেও শান্তি নিয়ে ফেলতে পারলাম না। মনটা মানতে পারছেনা রানির আহাম্মকি মার্কা কাজটা। তবুও মানাতে হবে। যা হয়ে যায় তা তো আর বদলানো সম্ভব নয়। আলমারি দরজাটা বিষন্ন মন নিয়েই চাপিয়ে দিলাম। বিছানার সামনে এসে সময়টা তে চোখ বুলাতেই মনটা কেঁপে উঠলো। ৭ টা অলরেডি বেজে গেছে। আর মাত্র আধঘন্টা বাকি। এক্ষনি বের না হলে আরও কেলেঙ্কারি। দ্রুত পায়ে পুরো রুম একবার ঘুরপাক খেলাম। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না আর চুল ঠিক করতেই মনটা আরেকদফা কেঁপে উঠলো। ডান হাতের সেই অদৃশ্য তিলটা এখন দৃশ্যমান। মনটা হাই ভোল্টেজে কেঁপে উঠলো। ছটফট করতে করতে মস্তিষ্ক বলে উঠলো,
” সামনে কি অপেক্ষা করছে? ভালো কিছু নাকি খারাপ কিছু?”
১৬.
বড় বড় অক্ষরে ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে 7ঃ43 AM। আত্মচিৎকার পেড়ে উঠলো মনটা। কত সময় লেট করে ফেলেছি। ক্যানটিনের পাশেই অপেক্ষা করছি রাইয়ের জন্য। মেয়ে টা আদৌও কি অর্ধেক পথও আসতে পেরেছে নাকি পারেনি? মনটা দোমনা করছে। একবার মনে হচ্ছে রাইয়ের অপেক্ষা না করেই রাফিদ ভইয়ার সামনে যাই আবার মনে হচ্ছে অসম্ভব! সিংহ মামার তাকানোতেই আমি জ্ঞান হারাবো। আর যখন উনি শুনবেন আমি উনার শার্ট টার এমন দশা করেছি তো নির্ঘাত গ/র্দা/ন কে/টে নিবেন। রাইয়ের কার্যকলাপে তো এটাই মনে হচ্ছে ও আসতে আসতে কম করে হলেও আরও ঘন্টা খানিক লাগাবে। কিন্তু আমার হাতে তো এতো সময় নেই। সময় অলরেডি ওভার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে যতটুকু সম্ভব হলো টেনে বিশাল আকারের এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। রাফিদ ভাইয়াকে আমাকেই ফেস করতে হবে। রাই যে আজ আর আসবে না তা বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার।
সময়ের দিকে তাকাতে গিয়ে কতক্ষণ রকেটের গতিতে ছুটি আবার রাফিদ ভাইয়া র/ক্ত/চক্ষুর চাহনির কথা মনে আসতেই থমকে যাই। ভ/য় আর জড়তা রীতিমতো পিষে ফেলছে আমায়। এতোটা ভ/য় জীবনে কোনো জিনিসে কখনো পাইনি! আজ পেতে হচ্ছে। রাফিদ ভাইয়াকে কি জবাব দিবো ভাবতেই ভ/য়ে ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে।
—-” এখন লাইব্রেরীতে প্রবেশ করা যাবে না। ৮ টার আগে লাইব্রেরীতে প্রবেশ নিষেধ।”
বিশাল আকারের গোঁফ লোকটার মুখে। গলার স্বরটা অনেক মোটা। কালো করে রোগা পাতলা। মোটা একটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আমাকে দেখতেই লাঠিটা বাড়িয়ে দিলো কয়েক হাত। গম্ভীর স্বরে কথা গুলো বলে আবারও নামিয়ে নিলেন লাঠিটা। আমি থমকে গিয়ে চমকে তাকালাম। একেই ভ/য়ে ছিলাম। তারউপর ভ/য়ে/র চোটে জ্ঞান হারানোর জন্য উনার লাঠিটাই যথেষ্ট ছিলো। এভাবে মোটা স্বরে কথা বলে আরও ভ/য় না দেখালেও পারতো। শুকনো গলায় ঢোক গিলে আমতাআমতা করতে লাগলাম। কিছু একটা বলতে চাচ্ছি কিন্তু বলতে পারছিনা। কথা গুলো পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছেনা। উনি বোধকরি আমার হাবভাবে বেশ মজা পাচ্ছেন। গোঁফ নাড়িয়ে আবারও বলে উঠলেন,
—-” লাইব্রেরীতে কেউ নেই। একা একা এখানে আসবেন না। আর সময়ের আগে তো আরও নয়।”
আমি মৃদুস্বরে বললাম,
—-” র..রাফিদ ভাইয়া ডেকেছেন।”
লোকটা ভ্রু কুঁচকালো। হাতের কালো ঘড়িটায় সময় দেখে বললেন,
—-” ভেতরে কেউ নেই। আপনি আসতে পারেন।”
—-” না না আছেন তো। ভেতরে রাফিদ ভাইয়া আছেন। আপনি উনাকে একটু ডেকে দিন আমি উনার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলেই চলে যাচ্ছি।”
লোকটা চোখ মুখ কুঁচকে তাকালেন। ভারী বিরক্ত গলায় বললেন,
—-” আমি এখানে নাইট ডিউটি করি। রাত ১২ টা থেকে সকাল ৮ টা অব্দি আমার ডিউটি। তাই এখানে কেউ আসলে বা গেলে অবশ্যই আমার চোখের সামনে থেকে আসা যাওয়া করতে হবে। আর গত ৬,৭ ঘন্টায় এখান থেকে কাউকে আসতে যেতে আমি দেখিনি।”
আমি গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। রাফিদ ভাইয়া ভেতরে না থাকলে তো আলহামদুলিল্লাহ। কেননা,উনি পৌঁছানোর আগেই আমি আসতে পেরেছি সেই অনেক। তাই যে করে হোক আমাকে এর ভেতরে যেতেই হবে। এই মোটাস্বর আঙ্কেলের নজর পেরিয়েই যেতে হবে আমায়। আমার ডান সাইডের সরু রাস্তা ধরে বড় একটা সিঁড়ি আছে। ওখান থেকে বেশিরভাগ স্টুডেন্টসরা লাইব্রেরীতে আসে। আমার চোখ জোড়া ছটফট করতে করতে সেদিকে চোখ পড়তেই যেন মাথার মধ্যে লাল বাত্তি জ্বলে উঠলো। মুখে একখানা ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠলাম,
—-” আস্তাগফিরুল্লাহ!!”
লোকটা বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি উনার বিস্ময়টাকে আরেকটু দীর্ঘ করতে হা করে তাকালাম সেদিকে। অবাকের উপর অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,
—-” ছি ছি।”
লোকটা আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তেমন কিছুই বুঝতে পারলেননা। কেননা, ঐ পাশের কিছু উনাকে দেখতে হলে উনার জায়গা পরিবর্তন করে আমার পাশে এসে দেখতে হবে। আর যা উনি আপাতত চাচ্ছেন না। তাই আমার মুখ থেকেই কথা বের করার তাগিদে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
—-” কি, কি? কি হয়েছে? কি দেখছো ওদিকে?”
আমি মুখে হাত চেপে বললাম,
—-” ঐ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে স্টুডেন্টসরা এসব করে। শুনেছি ঐদিকে তো সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই। ইশশ, দেখেছেন আঙ্কেল ঠিক এই কারনেই দেশটা আজ রসাতলের মোড়ে দাঁড়িয়ে।”
—-” কি বলছো? কে কি করছে ঐ দিকে? কি দেখছো তুমি?”
আমি হাত তুললাম ডানপাশের দিকে। অসহায় কন্ঠে বললাম,
—-” আপনি চাইলেই দেশটাকে রসাতলের মোড় থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আঙ্কেল। দেখুন ওখানে ওরা দাঁড়িয়ে কি করছে। ছি ছি আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা!”
লোকটা আর স্থীর থাকতে পারলেননা। আমাকে অতিক্রম করে লাইব্রেরীর দরজা ছেড়ে এপাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উত্তেজিত স্বরে বললাম,
—-” আরে আরে এক্ষনি নেমে গেলো। আঙ্কেল চলুন চলুন। আমরা এখন গেলেও ওদের ধরতে পারবো। আসুন।”
আমার বলতে দেরী হলেও আঙ্কেলের সেদিকে দৌড় দিতে দেরী হলো না। আমাকে রেখেই উনি দৌড়ালেন সেদিকে। আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। হাত ঘড়িত সময় দেখেই বড় বড় ধাপ ফেলে লাইব্রেরী তে ঢুকে পড়েলাম। বাইরে সূর্যের আলো ঝলমল করলেও ভেতরটা এখনো অন্ধকার। পুরো লাইব্রেরী জুড়ে অসংখ্য কৃত্রিম লাইটের ব্যবস্থা থাকলেও নিয়ম মেনে সবই নিভে আছে। শুধু জলছে কিছু ড্রিম লাইট।
আর তাতেই আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে কিছুটা। পা টিপে টিপে একদম লাইব্রেরীর শেষ প্রান্তে চলে এলাম। এখানে সচারাচর কেউ আসেনা। তাই আপাতত এখানে থাকাটাই মঙ্গলকর মনে হচ্ছে। হাতের বাম পাসে ছোট্ট একটা জানালাও আছে। সেটা দেখেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো। আশেপাশে তাকিয়ে কারোর হদিশ চালালে ফলাফল শূন্য মিলল। মনে প্রশান্তি নিয়ে সতর্কতার সহিত জানালাটা খুলে দিতেই ভূতের মতো ভেসে উঠলো কারোর মুখ। ভেতরটা কাঁপিয়ে উঠতেই গগনবিদারী চিৎকার দেওয়ার সমস্ত পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। হা-ও করলাম। কিন্তু শব্দ হলো না কোনো। মুখে কারোর হাত পড়তেই বুক শেল্ফের সাথে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়লাম।
অনুভব হলো আমার সাথে টান খেয়ে হয়তো বুক শেল্ফটা আমার উপরই পড়েছে! নীচে পড়ে আবারও এক গগনবিদারী চিৎকার দেওয়ার কায়দা হলো। কিন্তু এবারও আমায় নিরাশ হতে হলো। যেখানে ভেবেছি ব্যাথা পেয়ে মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড় সেখানে কেবল মাথার নীচের কারোর কোমল হাতের ছোঁয়া মিলল।
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। আমার ধারনা মতে এতো বড় বুক শেল্ফটা আমার উপর পড়লে আমার বাঁচার কথা না। কিন্তু পরক্ষণেই গলায় কারোর গভীর চুম্বনে কেঁপে উঠলাম। না চাইতেও চোখ জোড়া খুলে ফেললাম। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে কারোর মুখ দেখতে না পারলেও তার সুঠাম দেহ আবিষ্কার করলাম। মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। খুব বিশ্রী ভাবে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জানি মানুষটার করা এই অপ্রত্যাশিত কাজটা ইচ্ছে করে নয় তবুও মনটা বারবার আহত হচ্ছে ভেতরটা। মুখের উপর তার গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়তেই আবারও চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। চিন্তাক্লিষ্ট মন আমার এই অজানা ছোঁয়ার হদিশ চালাতে বসলেই শরীর শূন্য হয়ে আসলো। চটজলদি চোখ জোড়া মেলতেই তার অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটার আভাস পেলাম। ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আশেপাশে নজর দিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কারোর হদিশই মিলল না। পুরো লাইব্রেরী জনমানবশূন্যতায় খা খা করছে। আমার মনের ছটফটানির কাছে হার মেনেই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। পা টিপে টিপে আবারও হাঁটা ধরলাম। দু-তিন টা বুক শেল্ফ ফেলে আসতেই দেখলাম স্টুডেন্টরা এক এক করে ভেতরে ঢুকছে। ডিম লাইট গুলো আস্তে আস্তে নিভে গিয়ে বাকি লাইট গুলো জলে উঠছে। চারপাশে আলো পড়তেই সমস্ত অন্ধকার কেটে গেলো। চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবলাম,
—-” ঐ মানুষ টা কে ছিলেন?”
—-” হোয়্যার ইজ মাই শার্ট?”
মনটাকে স্বস্তির করেই হাঁটছিলাম। আচমকা পাশ থেকে কারোর কন্ঠ পেতেই ধড়ফড় করে উঠল মন। চমকে উঠে দুই হাত জড়ো করে মুখ চেপে ধরলাম। কাঁপা-কাঁপি করে পাশ ফিরে তাকাতেই মনটা আরেক দফা ধড়ফড় করে উঠলো। বাবাকে বলে খুব শীঘ্রই কোনো ডক্টরের কাছে এপয়েনমেন্ট নিতে হবে। কেননা, সামান্য ব্যাপার গুলোতেই খুব বেশি বেশি চমকাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে একদিন ঠিক হা/র্ট অ্যা;টা;ক এসে যাবে। তখন আমার আত্মা গান গাইবে, আমি জ্ঞান হারাবো ম/রে/ই যাবো! বাঁচাতে পারবেনা কেউ!”
রাফিদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বোধকরি এসাইনমেন্টের কিছু খাতা। লিখতে এসেছেন নাকি এগুলো দিয়ে কাউকে বাঁশ দিতে এসেছেন?
মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলাম। আমতাআমতা করে বললাম,
—-” ববব ভালো আছেন ব্রো!”
রাফিদ ভাই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ ঘুরিয়ে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন,
—-” হু,ভালো। তুমি কেমন আছো?”
উনাকে গম্ভীর নয় শান্ত চাহনিতেই বেশি ভালো লাগে। হয়তো উনি জানেন না। তাই এভাবে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে কথা বলছেন। আমি শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে আবারও আমতাআমতা করে বললাম,
—-” ভ..ভালো! না! ভালো না!”
রাফিদ ভাই শান্ত চোখে তাকালেন এবার। শান্ত কন্ঠে বললেন,
—-” ভালো নাকি ভালো না?”
এবার আর কাঁপা-কাঁপি ব্যাপারটা আসছেনা আমার ভেতর থেকে। কারনটা হয়তো উনার শান্ত চাহনি আর শান্ত স্বর। উনার সো কল্ড ফ্রেন্ড গুলো আশেপাশে নেই। এই সুযোগ। আমি জানি উনি মোটেই খারাপ মানুষ নন। উনি যতটা দেখান ততটা তো একদমই নন। আশা করি উনাকে শার্টের ব্যাপার টা বুঝিয়ে বললে উনি ঠিকই বুঝবেন।
—-” ভাইয়া, আ..আসলে আ..মি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই! আই মিন স..সরি বলতে চাই। আসলে হয়েছে কি…”
—-” রাফিদ।”(গলা উঁচিয়ে)
আসলে আর কিছুই হওয়ার সুযোগ দিলো না তার বন্ধুরা। শায়তানকা নাম লিয়া তো শায়তান হাজির। এবার আমার কপালে খারাপ কিছু ঘটে যাওয়া থেকে আর কেউ আটকাতে পারবেনা।
#চলবে____________________
#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ০৯
১৭.
এক এক করে রাফিদ ভাইকে ঘিরে হাজির হলো তার দলবল। রূপ ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া আমাকে দেখতেই উসকানি মার্কা কথা বলতে লাগলেন। আরফান ভাই আর অনন্যা আপু কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই আরফান ভাই মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
—-” আরে নিধি? কি খবর? এখানে হঠাৎ… ও রাফিদের শার্ট রিটার্ন করতে এসেছো?”
আমি মিষ্টি বা তেঁতো কোনো হাসিই হাসতে পারলামনা। আমার ভেতর থেকে হাসি আসলো না। ভ/য়ে আছি! কি করে শার্টের কথা এই হা/না/দা/র বাহিনীদের সামনে বলবো? বলার পর উনাদের প্রত্যেকের কি রিয়াকশন হবে? একেক জনে কত কেজি গুঁড়া সাবান দিয়ে কাচবে আমায়? ভ/য়ে গলা জড়িয়ে আসছে আমার। আরফান ভাইয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলাম না। চোখের পলক ফেলে জোরপূর্বক হেসে বোঝালাম “হু!” রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললাম। কন্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে আমার। উনি প্রশ্নবিদ্ধ মুখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখে কথা বলছেন! কিছু একটা জিজ্ঞেস করছেন হয়তো কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। আমি হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলাম। চোখ ঝাপটে টেনে নিঃশাস ফেললাম। রাফিদ ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নীচু করে নিয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
—-” আপ…আপনার শার্ট টা আমি র..রিটার্ন করতে পারবো না ভাইয়া। আমি আমার কাজের জন্য খুব ই লজ্জিত। শার্ট টা আ..আসলে রিটার্ন করার অবস্থায় নেই। আমার বাসার লোক সেটার বারোটার ঘন্টা বাজিয়ে ছেড়েছে একদম। আমাকে প্লিজ…”
আমার কথা সম্পূর্ন শেষ হতে দিলেননা। তার আগেই দিপু ভাইয়া আর রূপ ভাইয়া বাজখাঁই গলায়, “হোয়াট?” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
জিয়ান ভাইয়া বললেন,
—-” আমি জানতাম রাফিদ, এই মেয়ে এমনটাই করবে। বুঝছিস না সিনিয়রদের সাথে লাগতে চায়। একটু এটেনশন চায়। তাই এসব করে। ওদের মতো মেয়েদের আমরা চিনিনা বুঝেছিস?”
অনন্যা আপু জিয়ান ভাইয়ার সুর ধরেই বলে উঠলেন,
—-” ঠিকই বলেছিস তুই। লাস্ট ইয়ারের মেয়েটার কথা মনে নেই? ঠিক এর মতোই অবস্থা ছিলো।”
রূপ ভাইয়া বললেন,
—-” রাফিদ! এবার তুই যা করার করবি! এবার তুই ওকে শা/স্তি দিবি।”
রাফিদ ভাইয়া অ/গ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি মাথা উঁচিয়ে তার দিকে তাকাতে নিয়েও তাকাতে পারলাম না। সাহসই হলো না। মাথা নীচু করেই আল্লাহর নাম জব করছি। কি করে বেঝাই তাকে এখানে যা কিছু হয়ছে তাতে আমার কোনো হাত নেই। আমি যদি আগেই রানির দশা বুঝতাম তাহলে কখনোই শার্ট টা ওর হাতে দিতাম না।
রাফিদ ভাইয়া ধাপ ফেলে আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। ব্যস আমার পা জোড়া উনার নাম নিয়েই থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে সামনের মানুষ টার কাছে। মনে হচ্ছে যেন বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে এসেছি! হাতের মধ্যে শক্ত শক্ত কিছু লাগতেই চোখ খুললাম। হাতের দিকে তাকাতে তাকাতে উনার কঠিনস্বর ভেসে আসলো কানে,
—-” এখানে ছয়টা এসাইনমেন্টের খাতা আছে। কাল আমাদের ক্লাস টাইমের আগেই এগুলা শেষ হওয়া চাই।”
আমার কলিজায় হাত রেখে কেউ কলিজা ধরে টেনে বের করে দিলো মনে হলো। গোল গোল চোখ করে একবার খাতার দিকে তো একবার রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি। তখন যা ভেবেছিলাম তাই হলো শেষ অব্দি। মন বলছিলো এই খাতা গুলো দিয়ে নিশ্চিত কাউকে বাঁশ দিতে এসেছেন। আর সেই বলির পাঠা আমিই হলাম। নিজের উপর ‘হো হো’ করে হেসে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ভাগ্য যে কখনো এতোটা বলদ করে তুলবে ভাবতেই পারিনি। খুব হাসি পেলেও রাফিদ ভাইয়ার তাগিদে চেপে গেলাম। কেননা, এমন সিরিয়াস সিচুয়েশনে হাসলে তারা আমায় ঠিক পা/গ/লের খেতাবটাও ছুঁড়ে মা/র/বে।
পেছন থেকে আরফান ভাই নরম সুরে বললেন,
—-” রাফিদ, বাচ্চা একটা মেয়ে। ওকে এতো বড় শা/স্তি না দিলেও পারতিস!”
রাফিদ ভাই বাঁকা হাসলেন। আমার দিকে আরেকটু এগোতে চেষ্টা করলে আমি বুকে হাত দিয়ে পিছিয়ে গেলাম। ঢোক গিলে উনার দিকে তাকাতে উনি ভ্রু চুলকে বললেন,
—-” ওকে দেখলে আমার ভীষণ মায়া হয়। ঠিক নওশিনের মতো। তবে আশা করি নওশিনের থেকে নিধি বেটার হবে। সিনিয়রদের থেকে এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা না করে সিনিয়রদের রেসপেক্ট করতে চেষ্টা করবে। নিধি কেবল নিধিই, নওশিন নয়।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি। সাথে গেলেন বাকিরাও। আরফান ভাইয়া “রাফিদ, রাফিদ” ডেকে আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে সেও গেলেন। লাইব্রেরী আপাতত ফাঁকা। দূর-দূরান্তে স্টুডেন্ট তো আছে। কিন্তু তাদের উপস্থিতি বোঝার থেকে নিস্তব্ধতাই বেশি অনুভব হচ্ছে। আমার খালি মাথা খা খা করতে করতে বলে উঠলো,
—-” নওশিন! নওশিন কে?”
১৮.
আমার রান্নাঘর আপাতত শূন্য। মাস শেষ বাজারও শেষ। এক দানা চিনিও অবশিষ্ট থাকেনা। যদিও এর পেছনে আমার বাবারই অবদান। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে সোজা চলে আসবে রান্না ঘরে। যখন যেটা ভালো লাগবে তখন সেটাই সে করবে। চা,কফি,নুডলস,পাস্তা সব কিছু তখনই নিজ হাতে করে নিয়ে আমার ঘরে হাজির হবে। শান্ত কন্ঠে আমায় আস্তে আস্তে ডেকেও তুলবে। ঘুমটা কাচা থাকাবস্থায় ভেঙে গেলে প্রচুর মেজাজ খারাপ হয় আমার। বাবার কালে ধর্ম ভিন্ন হয়না। চোখ মুখ কুঁচকে বাবার দিকে তাকালেই বাবা হাসি হাসি মুখ করে বলবে,
—-” একা একা খেলে বলবি বাবা স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে। আমায় না দিয়েই সব সাবাড় করে ফেলেছে। তাই তো তোর জন্যও নিয়ে আসি। চল এবার একটু ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর বাবা মেয়ে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করবো।”
বাবার মুখে ভালো ভালো কথা শুনেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনা! কিন্তু আর প্রকাশ করার জো থাকেনা। বাবা বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বায়না ধরে বলে,
—-” বাবা যখন থাকবেনা তখন ঘুমিয়ে নিস শান্তি মতো। এবার জলদি যা, পাস্তা ঠান্ডা পড়ে গেলে আমি আর খেতে পারবো না।”
কি আর করার উঠে যাই ফ্রেশ হতে। চোখে মুখে পানি পড়লেই ঘুমটা মোটামুটি কেটে যায় আর তারপর বাপ বেটিতে মিলে রাজ্যের সব কাহিনি বলি আর খেতে থাকি। যার দরুন মাস শেষ হতেই জিনিসপত্রে টানাপোড়ন শুরু হয়ে যায়। আর সেদিন সারা দুপুর ক্ষিধে চেপে বসে থাকি বাবা আসার অপেক্ষায়। আর আসতেই হালকা খাবার খেয়ে চলে আসি থলে হাতে বাজার করতে। আজও এসেছি। হাতে বড় বড় দুটো থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। সিএনজি নিতে আসা। আমাকে গাড়ি ঠিক করতে বলে পাঠিয়ে বাবা এখনো ঘুরঘুর করছে বাজারের মধ্যে। তার নাকি এখনো পছন্দের দুটো খাবার কেনা বাকি। বাবার কথাতে মাঝেমধ্যে না হেসে পারাই যায় না।
—-” এই মামা দাঁড়াও।”
পেয়ে গেলাম সিএনজি। খালি আছে। হাঁক পাড়তেই ব্রেক করলেন তিনি। থলে দুটো বেশ ভারী। দুই হাতে দুটো টানতে মোটামুটি ক/ষ্টই হচ্ছে। তবুও টানাটানি করে এগিয়ে গেলাম সিএনজির দিকে। সিএনজি মামা আমার দশা দেখে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা হয়তো বলতে চাচ্ছেন কিন্তু আমি জানি কিছুই তিনি বলবেন না।
—-” যাবে মামা?”
—-” কই যাবেন?”
—-” খিলগাঁও। খিলগাঁও চৌরাস্তার পার হয়ে একটু ভেতরে।”
—-” আহেন।”
—-” ভাড়া কত দিতে….”
“নিধি মা”(আতংকিত কন্ঠে)
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো হঠাৎ। ঘাড় ফিরিয়ে বাবার অস্তিত্বের সন্ধান করতেই বাবাকে কারো কাঁধে হেলে পড়া অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। পাশের মানুষ টা কে দেখার ইচ্ছে না করেই বজ্রাহত চোখে বাবাকে দেখতে লাগলাম। এতক্ষণ আমার সাথে ঘুরে ঘুরে বাজার করা সুস্থ মানুষটার হঠাৎ হলো কি? হাত থেকে থলে দুটো ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ধরলাম বাবাকে। আতংকিত স্বরেই প্রশ্ন করলাম বাবাকে,
—-” বাবা, বাবা কি হয়েছে তোমার? ও বাবা?”
বাবা জবাব দিলোনা। বাবাকে ধরে থাকা লোকটা পাশ থেকে জবাব দিলেন,
—-” উনাকে এক্ষনি একবার হসপিটালে নিতে হবে।”
কথাটা শুনতেই হাত-পা অবস হয়ে এলো আমার। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসফাস করতে লাগলাম। তীব্র তেজে ছটফট করে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে হৃদপিণ্ড। বাবার হাত ধরে অসহায়ের মতো এগিয়ে নিয়ে এলাম সিএনজির দিকে। সিএনজি মামা বাবার অবস্থা বুঝতেই দরজা খুলে দিলেন। আমি ভেতরে ঢুকে বাবাকে আমার পাশে বসালাম। লোকটা সিএনজি মামাকে কোথাও একটা যেতে বললেন। কথাটা ঠিক স্পষ্ট বাজলো না কানে। আমি বাবার দিকেই তাকিয়ে আছি। মনটা কাঁদছে খুব। ইচ্ছে করছে শব্দ করে কেঁদে উঠতে। বাবাকে এই অবস্থায় দেখতে মোটেই ভালো লাগছেনা নিধির! সেটা বাবাকে কি করে বলি?
—-” নিধি! ডোন্ট বি আপসেট। উনার তেমন কিছুই হয়নি জাস্ট বিপিটা লো হয়ে গেছে।”
বাবাকে অতিক্রম করে মানুষটার দিকে তাকালাম। রাফিদ ভাইয়া বসে আছেন বাবার পাশে। উনাকে দেখে কোনো অনুভূতি জাগলো না মনে। বাবার সামান্য অসুস্থতা যে নিতান্তই সামান্য নয় তা আমি খুব ভালো করেই জানি! হসপিটালে গেলে নিশ্চয়ই ডক্টর হাসি হাসি মুখ করে বলবেন,
—-” নিধি তোমার বাবার তেমন কিছু হয়নি শুধু ব্লাডে একটা প্রবলেম হয়েছে। উনার শরীরে অতিরিক্ত পরিমানে এলকোহল প্রবেশ করেছে যার দরুন উনার রক্ত খুব বাজে ভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই-টুকুই আর তেমন কিছু না!”
ঠিক একারনেই ডক্টরদের আমি পছন্দ করিনা। উনারা অন্যের শোকে শোকাহত না হয়ে খুব নিখুঁত ভাবে আনন্দ উৎযাপন করতে পারেন। কেউ ম/রে গেলেও উনারা হাসি হাসি মুখ করে বললেন,” সরি হি ইজ নো মোর!” ডক্টররা মানুষ নন। দানব।
—-” আর ইউ ওকে নিধি?”
রাফিদ ভাইয়ার শান্ত কন্ঠটা আবারও বেজে উঠলো কানে। দরদর করে ঘামছি আমি। বুকটা ধড়ফড় করছে ক্রমাগত। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে টলমল চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে বাবাকে আগলে ধরে চুপটি করে বসলাম। দুঃখের সময়ে মানুষের ফর্মালিটি করে কথা বলা আমার কাছে নিতান্তই কটুবাক্য লাগে। উনার কথার জবাবে কিছুই বললাম না আমি। একহাতে চোখের জল মুছে স্কার্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। হৃদকে খুব দরকার এই সময়টাতে। কিন্তু না, ওকে কল করতে ইচ্ছে করছে না। বড় চাচাকে আর নিতু আপুকে কল করলাম। বাবার অবস্থা জানিয়ে বললাম, হসপিটালে যাচ্ছি! উনারা দু’জনেই তাড়াহুড়ো করে বললেন, আচ্ছা আমরা আসছি।” আশ্চর্য! কেউ হসপিটালের নাম জানতে চাইলো না! অবশ্য কি করে জানতে চাইবে? কেউ-ই যে তাদের সাধারণ সেন্সে নেই।
আধঘন্টা লাগিয়ে হসপিটালে পৌঁছোলাম। রাফিদ ভাইয়া বাবাকে খুব যত্নে আগলে ধরে স্ট্রেচারে উঠিয়ে দিলেন। আমিও বাবার ডান পাশটাতে দাঁড়িয়ে বাবাকে ধরে নিয়ে যেতে লাগলাম। পেছন থেকে সিএনজি মামার ডাক এলো,
—-” ভাইজান আমি এহানে অপেক্ষা করতাছি!”
রাফিদ ভাইয়া বোধকরি মাথা নাড়লেন। ভেতরে প্রবেশ করে কারোর নাম বলে বাবাকে ইমার্জেন্সিতে পাঠালেন তিনি। আমি বাবার পেছনে হাঁটা ধরতেই নিজের হাতটা রাফিদ ভাইয়ার হাতের ভাঁজে আঁটকে যেতে অগত্যাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমাকে টেনে নিয়ে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
—-” কোথায় যাচ্ছো তুমি? এখানে দাঁড়াও চুপটি করে! ডক্টররা আঙ্কেলকে চেকআপ করে আমাদের ঠিকই খবর দিয়ে দিবেন। এখানে বসো।”
আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। বুঝতে পারছেনা কেউ! বাবাকে হারিয়ে ফেলার এক তীব্র আ/তং/ক হচ্ছে ভেতরে। মনে হচ্ছে এই বুঝি বাবা মায়ের সঙ্গী হওয়ার বায়না ধরলো। ধপ করে সিটে বসতেই রাফিদ ভাইয়া বুঝি ধরতে নিলেন আমাকে। আমি ঠিক করে বসতে উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—-” নিধি, সামলাও নিজেকে! লুক, আঙ্কেলের তেমন কিছুই হয়নি! উনি একদম ঠিকাছেন। শুধু প্রেশারটা লো হয়ে এসেছে ব্যস এটুকুই। প্রেশার তো যে কারোরই লো হয়ে আসতে পারে বলো? প্লিজ নিজেকে একটু সামলাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রাফিদ ভাইয়ার কথা গুলো বেশির ভাগই মগজ ডিঙিয়ে যাচ্ছে। ধরতে পারছি না। বুঝতেও পারছি না। আর বেঝাতেও পারছিনা নিজেকে যে সত্যিই কি সবটা ঠিক হয়ে যাবে?”
ফোনটা হাতের মধ্যেই আত্নচিৎকার করে বেজে উঠলো। কেঁপে উঠলাম আরেকদফা। নিতুর আপুর কল।
—-” আপু…”
—-” তোরা কি মেডিকেলে আছিস?”
আমি চারপাশে দৃষ্টি ঘোরালাম। সামনে যা দেখি সবই ঘোলাটে ঠেকছে। রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকাতে উনি চোখ ঝাপটে আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন ফেনটা। একটু পাশে সরে গিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে আবারও ফিরে এলেন। ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কেমন অদ্ভুত গলায় বললেন,
—-” তোমার ফোন।”
আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিতে দেখলাম হৃদ লাইনে আছে। হঠাৎ মনে হলো রাফিদ ভাইয়া ঠিক নেই। তার মুখটা কেন জানিনা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। মুখ উঁচিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে ফোনটা আমার হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। তার যাওয়াটাও স্বাভাবিক না। সবই অস্বাভাবিক। চারপাশে যা ঘটে চলেছে সবটাই একদম অস্বাভাবিক লাগছে।
—-” হৃদ?”
—-” নিধু? আজ বিকেলে ফ্রী হতে পারবে? একটু বেরোতা….”
—-” হৃদ বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি বাবাকে নিয়ে হসপিটালে আছি!”
—-” হোয়াট! কি বলছো? কি হয়েছে আঙ্কেলের? তুমি কোন হসপিটালে আছো?”
—-” জানিনা কি হয়েছে! উনি তো বলছেন বাবার বিপি লো হয়ে গিয়েছে। হৃদ তুমি কি একটু আসতে পারবে প্লিজ?”
—-” হ্যাঁ হ্যাঁ লক্ষী আমি আসছি। তুমি একদম চিন্তা করো না। আঙ্কেল ঠিক হয়ে যাবেন। আমি আসছি। কোন হসপিটালে আছো তোমরা?”
—-” মেডিকেলে।”
—-” ওকে ওকে আসছি আমি।”
হৃদ লাইন কেটে দিলো। ফোনে যতটা ব্যস্ততা দেখালো ততটা তাড়াতাড়ি আসতে পারলো না। নিতু আপু আর বড় চাচাও এলেন ঘন্টা দেড়েক হলো। ডক্টর হাসি হাসি মুখ করে শুধু ঘুরলেন আমাদের সামনে থেকে কিন্তু কিছু জানালেন না। বললেন, ২৪ ঘন্টা ব্যতীত কিছু বলা সম্ভব নয়। দশ মিনিট হলো হিমেল ভাই আর চাচীও এসেছেন। নিতু আপু আর চাচী আমাকে কি কি জানি বোঝাচ্ছেন। আমি বুঝছিনা! বাবার চিন্তায় কিছু বোঝার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছি। মস্তিষ্ক বলছে হৃদ কেন এখনো আসছে না?
আজ ফোনটা একদমই দয়ামায়া করছে না আমার প্রতি। ক্ষণে ক্ষণে শুধু বেজেই যাচ্ছে। নিতু আপু আর চাচীকে রেখে উঠে এলাম ফোন হাতে। জনমানবহীন জায়গায় গিয়ে বসালাম। এই কয়েকদিনে আজ প্রথমবার সেই অপরিচিত নাম্বার টা দেখে ভীষণ শান্তি লাগছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা কানে তুলতেই নেশা ধরানো কন্ঠে বলে উঠলেন তিনি,
—-” নীলাদ্রিতার কি খুব মন খারাপ?”
ডুকরে উঠলো আমার ভেতরটা। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্নার বেগটা চেপে গিয়ে ছোট্ট করে বললাম,
—-” হু!”
ওপাশে কিছুক্ষণ নীরব নিস্তেজ রইলো। পরক্ষনেই আবারও বলে উঠলেন তিনি,
—-” কেন মন খারাপ জানতে পারি কি?”
—-” উঁহু।”
—-” তো কি ম্যাডাম এভাবে মন খারাপ করেই থাকবেন?”
—-” হু!”
—-” কেউ মন খারাপ করে থাকলে আমার পছন্দ নয় ম্যাম। তো আপনি দয়াকরে আপনার মন খারাপের কারনটা বলুন। আমি চেষ্টা করব আপনার মন ভালো করতে।”
—-” নো নিড।”
—-” এভাবে শক্ত শক্ত কথা বলছো কেন হু?
—-” আমি তো কথাই বলছিনা!”
—-” রাইট। তুমি তো কথাই বলছো না! কিন্তু কেন বলছো না? কারোর উপরের অভিমানটা আমার উপর কেন ঝাড়ছো? অভিমান করার রিজন টা কি এই অপরিচিত?”
—-” উঁহু!”
—-” তবে কাছের কেউ?”
—-” হু!”
—-” কে সেই কাছের মানুষ টা?”
—-” আপনাকে বলবো কেন?”
—-” বললে হয়তো আমি তোমার অভিমান গলাতে সাহায্য করতে পারবো।”
—-” বললাম তো নো নিড।”
—-” ওকে বেশ। আমি না হয় তোমার অভিমান গলাবো না কিন্তু যার উপর অভিমানী নীলাদ্রিতা এক আকাশ সমান অভিমান করেছে সে কি তা জানে?”
—-” না।”
—-” জানাতে হবে না তাকে?”
—-” কেন জানাবো? অভিমান করলে কি বলে বোঝাতে হবে? সে তো আমার চোখ দেখলেই বুঝতে পারবে।”
—-” আর যদি না পারে?”
—-” পারবে।”
—-” খুব আত্মবিশ্বাস হু?”
” নিধি?”
রাফিদ ভাইয়ার ডাকে চমকে উঠলাম। তাড়াহুড়ো করে কলটা কেটে দিয়ে তার দিকে তাকাতে মিষ্টি হাসলেন তিনি। কিন্তু তার হাসিটা ঠিক ফুটলো না তার মুখের সাথে। কেমন একটা এলোমেলো হয়ে আছেন তিনি। চোখ মুখ শুঁকনো। চোখ দুটো ভরাট হয়ে লালচে হয়ে আছে। ঘন্টা খানিক আগের পরিপাটি ছেলেটা হঠাৎ অগোছালো হয়ে উঠলো কিভাবে?”
—-” ডক্টর কিছু বলেছেন তোমার বাবার ব্যাপারে?”
আমার ভাবনার জগত লণ্ডভণ্ড হলো। চমকিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আহত গলায় প্রশ্ন করলাম,
—-” ঠিকাছেন আপনি?”
#চলবে____________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]