ফরগেট মি নট পর্ব-০৩

0
20

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৩.
“স্যার মিস মৃত্তিকা আমাদের কোম্পানির সাথে ডিল করতে রাজি হয়েছেন।উনার পিএ এটা এইমাত্র ফোন করে জানানো। ”

রাফিনের মুখনিঃসৃত কথা কর্ণগোচর হতেই দর্শনের শক্তপোক্ত হয়ে থাকা মুখশ্রীতে পরিবর্তন আসে।আড়চোখে তাকায় সিঁড়িতে পা রাখতে যাওয়া দীপনের দিকে।রাফিনের কথা শুনে সেও থেমে গেছে।কালকে স্পষ্ট স্বরে নাকোচ করা প্রভাবশালী রমনীকে কি এমন বললো দর্শন যাতে নিজের দৃঢ় সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটলো সে!এমন চিন্তা মস্তিষ্কে আসতেই ঘুরে অবাক হয়ে দর্শনের দিকে তাকায় সে।দর্শনের ওষ্ঠজুড়ে তখন বিশ্বজয়ের হাসি।যেই কাজ করতে গিয়ে বড়ভাই গন্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছিল সেটা সে কিছু সময়ের ব্যবধানেই করতে পেরেছে ভাবতেই দর্শনের হাসির রেশ আরো প্রসারিত হয়।তখনই রাফিন বলে উঠে,

“কিন্তু মিস মৃত্তিকা কিছুটা শর্ত রেখেছেন।”

শর্তের কথা শুনে দর্শনের ভ্রুযুগল কুঁচকে আসে।দন্ত দ্বারা ওষ্ঠ পিষ্ট করে রাফিনকে ইশারা করে কি শর্ত তা বলার জন্য।রাফিন পূর্ণদৃষ্টি দীপনের দিকে তাকায়।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দর্শনও তাকালে অপ্রস্তুত হয় দীপন।রাফিন বলা শুরু করে,

“মিস মৃত্তিকা শর্ত রেখেছেন আমাদের সাথে কাজ করার সময় তিনি যেন দীপন স্যারকে আশেপাশে না দেখেন।আই মিন উনি দীপন স্যারের সাথে কাজ একদমই করবেন নাহ!”

রাফিনের কথা শেষ হতেই হাত মুঠো করে নেয় দীপন।তখনই দর্শন উচ্চস্বরে বলে উঠে,

“আই হ্যাভ নো প্রবলেম!মিস মৃত্তিকা মেহের..জানকে জানিয়ে দাও তার শর্ত কবুল করা হয়েছে।”

রাফিন আড়চোখে দীপনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তাকায়।কিন্তু দীপন কিছু না বলে চলে যাচ্ছে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার।পরপরই মনে হয় যাক ভালোই হলো!আর কোন গন্ডগোল হলো না।অবশেষে অনেক বড় ডিলটা তারা ফাইনাল করতে পেরেছে।
.
” কনগ্রাচুলেশনস ম্যাম! আপনার শর্ত উনারা মেনে নিয়েছেন আর ডিলটাও ফাইনাল হয়ে গেছে।”

কথাটা বলার সময় মৃত্তিকার পিএ তৃষার মুখশ্রীতে খুশির আভা থাকতেও থমথমে হয়ে আসে মৃত্তিকার মুখশ্রী।তার শর্ত মেনে নিয়েছে!মৃত্তিকা যতদূর জানে দানিশ ইন্ডাস্ট্রির কোন প্রজেক্ট দীপনকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না।দীপন আর দর্শন দুভাই মিলে সকল কার্যক্রম হ্যান্ডেল করে।মৃত্তিকা এই কারণেই এমন শর্ত দিয়েছিলো যেটা তাদের কাছে মেনে নেওয়া কঠিন হয় আর দীপনের নিকট অপমানের।বাড়ির ছেলের অপমান হোক এটা নিশ্চয়ই তারা চাইবে না!তবুও তার শর্ত মেনে নেওয়া হয়েছে!
মৃত্তিকার গাঢ় ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে তৃষার আওয়াজে।

“ম্যাম আরেকটা কথা।”

নিজ আসনে বসতে বসতে মৃত্তিকা তৃষাকো কথাখান বলার জন্য ইশারা করে।তৃষা নিজের জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠে,

“এই খুশিতে দানিশ ইন্ডাস্ট্রি আজ সন্ধ্যায় তাদের বাসভবনে পার্টি রেখেছেন আর সেখানকার চীপ গেস্ট আপনি ও ইরফান স্যার।তাই আপনাকে সেখানে অবশ্যই যেতে হবে।”

মৃত্তিকা একটুও সময় না নিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে।এটাই যেন তৃষার মুখশ্রীতে বিস্ময় ছেঁয়ে দেয়।কেননা বেশিরভাগ বিজনেস পার্টিতে যেতে নাকোচ করে মৃত্তিকা।এককথায় মৃত্তিকার এসব পার্টিতে কোন ইন্টারেস্ট দেখেনি সে।তবুও সেহেতু মৃত্তিকাকে রাজি করতে তাকে কোন কাঠখড় পোড়াতে হলো না তা ভেবেই খুশি হয় তৃষা।তারপর মৃত্তিকার সাথে কিছু কথা ডিসকাস করে তৃষা তার কেবিন থেকে বের হয়।
.
সূর্য তখন পশ্চিমে অস্ত গেছে আর ধরিত্রী সেজে উঠেছে কৃত্রিম আলোয়।নিজ কক্ষের দর্পনের সামনে দাড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে দর্শন।পরনে কালো কোট যাতে কালো টাই ও সাদা শার্ট উঁকি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে।দর্শনের মুখমন্ডল গম্ভীর।ড্রেসিং টেবিল থেকে পারফিউম নিয়ে গায়ে স্প্রে করে পুরোপুরি তৈরি হয়ে নেয় সে।তারপর রুম থেকে বেরিয়ে বিশাল ড্রয়িংরুমে আসে।এখনো তেমন কেউ আসেনি পার্টিতে।তবে বারের একপাশে ওয়েস্টার্ন পরিহিতা এক রমনীর দিকে দৃষ্টি আটকায় তার।তার পাশেই নিজের বড়ভাই দীপনকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে।রমনীটি দীপনের হবু স্ত্রী!তবে আদো স্ত্রী হয়ে উঠতে পারবে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আসে দর্শনের।ড্রয়িং রুমের অন্যত্র দৃষ্টি ঘোরাতেই দর্শনের গম্ভীর মুখশ্রীতে বদল আসে।ড্রয়িংরুমের এককোনায় দাড়িয়ে আছেন মহিলা।দর্শন দ্রুত হেঁটে এসে মহিলাটিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।কপালের মধ্যভাগে চুম্বন দিয়ে বলে,

“কেমন লাগছে সুইটহার্ট?”

প্রতি উত্তরে গাল ভরে হেসে দর্শনের গালে আলতো করে টেনে দেয় মহিলাটি।মহিলাটি মিসেস দানিশ, দর্শনের মা।মায়ের সাথে আরো কিছু টুকটাকি কথা বলতে যাবে তখনই কাঁধে শক্তপোক্ত থাবা অনুভব করে দর্শন।সহসা পাশ ফিরে তাকায় সে।পাশ ফিরতেই অক্ষিকোটরে ভেসে উঠে পরিচিত একটা মুখ।আদবের একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলে দর্শন।ভদ্রলোক এবার হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন।হ্যান্ডশেক করে বলে উঠেন,

“কংগ্রাচুলেশনস হ্যান্ডসাম বয়।ডেইজি কোম্পানির সাথে আরেকটা বিগ ডিল হলো তোমাদের।কংগ্রাচুলেশনস!”

ভদ্রলোকটি দানিশ মির্জার বন্ধু,সোয়েব শেখ।উনার মেয়ের সাথেই দীপনের এনগেজমেন্ট হয়েছে।
তাদের কথার মাঝেই একটা সুক্ষ্ম শোরগোল শোনা যায়।ডেইজি ইন্ডাস্ট্রির মালিক ও তার উত্তরাধিকারীর আগমন ঘটেছে!সহসা সদর দরজায় চোখ পরে দর্শনের।হাইহিল পরা একটা শুভ্র পা সদর দরজা টপকে ভেতরে প্রবেশ করে।পরপরই দর্শনের দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়।চেরি ফলের বর্ণের শাড়ি পরিহিতা রমনী ধীরে ধীরে সকলের চোখের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠে।অথচ রমনীর মাঝে এর জন্য কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।স্বাভাবিক ভঙিতে বাবার পাশেই এমনভাবে হেঁটে আসছে যেন সকলের এমন দৃষ্টির মধ্যমনি সে বহুযুগ ধরে হয়ে আসছে!

মৃত্তিকা ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে খানিক অবাক হয়।কেননা বিশাল অট্টালিকার বাইরের দিকটা যতটা সাধারণ লেগেছে, তার ভেতরের আভিজাত্যের ছোঁয়া ততটাই চোখে লাগার মতো।সামনে দৃষ্টি পরতেই দর্শনকে চোখে পরে মৃত্তিকার।কালো রঙের আবৃত শুভ্র পুরুষ সুদর্শন হওয়ার সর্বোচ্চ ধাপ পার করলো যেন।তখনই ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় দর্শন।অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি সরায় মৃত্তিকা।আড়চোখে তাকাতেই দর্শনের দিকের দিকে আসতে দেখা যায়।
কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে ইরফান চৌধুরীকে হ্যান্ডশেক করে দর্শন।

মৃত্তিকার পিএ তৃষা এসে উপস্থিত হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই।তাকে দেখেই মনে মনে শান্তি পায় মৃত্তিকা।যেন তারই অপেক্ষায় এতক্ষণ ছিল সে।পার্টি শুরু হয়।অমনি এককোণে এসে দাড়ায় মৃত্তিকা।ম্যামকে এককোণে দাঁড়াতে দেখে তৃষার তার পাশে এসে দাঁড়ায়।সহসা এক মেয়েলী কন্ঠ এসে কানে বাজে মৃত্তিকার।

“এরকম পার্টিতে কেউ শাড়ি পরে আসে!”

মৃত্তিকা তাকায়! সাদা রঙের লং ওয়েস্টার্ন পরিহিতা রমনীটি এগিয়ে এসেছে তার দিকে।তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মৃত্তিকা।সাদা ওয়েস্টার্নটির নিচ দিকে মেয়েটির পা দেখা যাচ্ছে বেশখানিক।মেয়েটা এবার মৃত্তিকার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়
তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,

“ইরফান চৌধুরীর মেয়ে রাইট?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে ইশারায় সম্মতি বোঝায়।পরপরই মেয়েটি বলে উঠে,

“একজন বিজনেস ম্যানের মেয়ে পার্টিতে শাড়ি পরে আসতে পারে জানা ছিল না!তাও আবার ফুল স্লিভ!”

মেয়েটির মুখে এরুপ কথা শুনে এবার মুখ খুলে মৃত্তিকা।দুহাত বুকে গুঁজে বলে উঠে,

“তোমার নাম শ্রেয়া তো?শ্রেয়া শেখ!আমি কেমন ড্রেস পরবো না পরবো,কীভাবে কোথায় যাবো, না যাবো সেটা কি এখন তুৃমি সাজেস্ট করবে?

শ্রেয়া প্রথমে অবাক হয় মৃত্তিকার মুখে নিজের নাম শুনে।পরপরই মৃত্তিকার তাচ্ছিল্যময় বাক্যে অপমান বোধ করে সে।কিন্তু কিছু বলবে তার আগেই সে স্থান ত্যাগ করে মৃত্তিকা।
.
ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে পাশের খোলা জায়গায় এসে দাড়ায় মৃত্তিকা।ওমনি শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় তাকে।মৃদু বাতাসে খোলা আঁচল উড়তে থাকে বাধাহীন।পার্টিতে গান,বাজনা,ড্রিংকস কোনদিনই আর্কষণ করেনি তাকে।তাই সেই শোরগোল থেকে বেরিয়ে একটু আরামের জন্য এখানে এসেছে সে।সময় অতিবাহিত হয়।হঠাৎ গুলির আওয়াজে চমকে উঠে মৃত্তিকা।দৌড়ে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয় সে।কিন্তু ড্রয়িংরুমে কেউ নেই দেখে আরো বেশি অবাক হয় সে।

মৃত্তিকা এতক্ষণ ড্রয়িংরুমের বা দিকে ছিলো। কিন্তু ড্রয়িংরুমের ডান পাশে বিশাল জায়গা জুড়ে বাগান আছে।ড্রয়িংরুমে থাকা সকলে এখন সেখানেই আছে।অন্যদিকে থাকায় এই সম্পর্কে অবগত নয় মৃত্তিকা।দ্বিতীয়বার গুলির আওয়াজ হতেই পুনরায় কেঁপে উঠে মৃত্তিকা।কিন্তু শব্দের আওয়াজ অতি নিকটে মনে হয়।মেয়েলি চিৎকার কানে আসতেই একটা রুমের সামনে শঙ্কিত মনে উপস্থিত হয় সে।শুকনো ঢোক গিলে দরজা ঠেলতেই নেত্র যুগল বড় বড় হয়ে উঠে মৃত্তিকার।ওষ্ঠজোড়া নিজেদের শক্তিতে আলগা হয়ে আসে।দুপা পিছিয়ে যায় সে।
রুমের ভেতর পরে আসে মৃত্তিকার পিএ তৃষা।কপালে গুলির স্পষ্ট ছাঁপ!সামনেই বন্দুক হাতে তার দিকে ফিরে একজন দাড়িয়ে।মৃত্তিকা অবশ হৃদয়ে আর এক পা পিছাতেই মেঝেতে পরে থাকা কাঁচের বোতলে পা ঠেকে তার।শব্দ করে গড়িয়ে অন্য দিকে চলে যায় সেটা।তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরে তাকায় যুবকটি।কালো কোর্ট পরিহিত যুবকটির মুখশ্রীতে ক্রোধ ছেঁয়ে।কিন্তু মৃত্তিকাকে দেখতেই
মুখশ্রী হয়ে উঠে করুন।মুখ ফুটে কিছু বলতে উদ্ধত হয় তার আগেই মৃত্তিকার ঘৃণাপূর্ণ আওয়াজ তার বুকে এসে থেকে।

“দর্শন আপনি?”

চলবে…

ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।