#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৪.
বিধ্বস্ত চেহারায় মৃত্তিকা দৌড়ে তৃষার নিকটে আসে।মেয়েটার চক্ষুদ্বয় খোলা।গুলিটা কপালের ঠিক সোজাসুজি লাগেনি।মৃত্তিকার কায়া শিউরে উঠে অতি আতংকে।কাঁপা কাঁপা হাতে তৃষার নাসিকার নিকট নিজের হাত নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেই বুক ভেঙে ক্রন্দন বের আসতে চায়।পরপরই গাঢ় একটা শ্বাস টেনে তৃষার খোলা চোখদুটো বন্ধ করে উঠে দাড়ায় সে।সর্বোচ্চ ঘৃণা নিয়ে তাকায় সামনে দাড়ানো দর্শনের দিকে।চোখা নাকখানা ক্রোধে ফেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।সোজা সিঁথি করা রেশমি কেশ চোখে মুখে আছড়ে মারাত্মক লাগছে।
দর্শনের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ছেঁয়ে!হাতে থাকা রিভলবারটা আলগোছে প্যান্টের পকেটে পুরে নেয় সে।জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে দর্শন বলে উঠে,
“মৃত্তিকা শান্ত হও।তুমি যা ভাবছো তা নয়।”
মৃত্তিকা এবার নিজের হুঁশ হারায়।আক্রোশে তেড়ে এসে দর্শনের কলার চেপে ধরে।আচমকা আক্রমণে দুপা পিছিয়ে যায় দর্শন।বিস্ময় নিয়ে তাকায় মৃত্তিকার মুখশ্রীতে।মৃত্তিকা তখন সর্বোচ্চ ক্রোধ নিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে,
“এমনটা কি করে করলেন আপনি?মেয়েটাকে
মেরে দিলেন?”
হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠে দর্শনের শ্রবণইন্দ্রিয়।অনেকজনের হেঁটে আসার শব্দ কানে এসে বাঁজে।তড়িৎ দরজার বাহিরে তাকায় মৃত্তিকা।তারপর তাকায় দর্শনের চোখের পানে।যার অর্থ আজ আপনার নিস্তার নেই!সবাই আপনার পাপকার্য জানবে।
মৃত্তিকা কলার ছেড়ে যেই দরজার দিকে পা বাড়াবে ওমনি তার মুখ চেপে ধরে দর্শন।কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের জ্ঞান হারায় মৃত্তিকা।দর্শন দ্রুত মৃত্তিকাকে কাঁধে নিয়ে আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
তাদের চলে যাওয়ার দু সেকেন্ডের মাঝেই ভেতরে প্রবেশ করে ইরফান চৌধুরী,দানিশ মির্জা সহ পার্টিতে উপস্থিত আরো অনেকে।মেয়ের পিএকে মেঝেতে মৃত অবস্থায় পরে থাকতে দেখে চোখ কপালে উঠে যায় ইরফান চৌধুরীর।দ্রুত ফোন করেন পুলিশ স্টেশনে।
.
বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে মৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরে দর্শন ।অনামিশায় তাদের দেখা দুষ্কর।গাড়ির পেছনের সিটে মৃত্তিকাকে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে দর্শন।দু’সেকেণ্ড স্থির হয়ে বসতেই টের পায় তার কপালে ঘামের অস্তিত্ব।গায়ের কোর্ট খুলে পাশে রাখে সে।তারপর টাই ঢিলে করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।এখন তার গন্তব্য শহরের বাইরের তাদের একটা বাংলোতে।আপাতত মেয়েটাকে এসব থেকে দূরে রাখতে হবে নয়ত সর্বনাশ হয়ে যাবে।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটা ঘটনাগুলো স্মৃতিতে আওড়ায় সে।পরপরই তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে।দাঁতে দাঁত চেপে ড্রাইভ করতে থাকে দর্শন।চোখজোড়া হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠে তার।অস্পষ্ট স্বরে একটা গালি বের হয় তার মুখ থেকে।
দর্শন গন্তব্যে এসে পৌঁছায় রাত ১২টা বেজে।গাড়ি থেকে বের হয়ে অচেতন মৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে বাংলোর কলিং বেল চাপে দর্শন।দরজা খুলতে দেরি হবে বুঝতে পারে সে।দৃষ্টি এসে স্থির হয় অচেতন মৃত্তিকার মুখশ্রীতে।মৃত্তিকার ঠোঁটের কোণের দিক বাঁ পাশে অতি ক্ষুদ্র একটা তিল।দর্শন অস্থির চলে চিত্তে দৃষ্টি সরায়।মেয়েটার রুপ সর্বগ্রাসী!দেশি ও বিদেশি সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া এক সর্বগ্রাসী রমনী!
দু মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলোর ভেতর থেকে কোন রেসপন্স না আশায় ভেতরে ভেতরে চটে যায় দর্শন।ছেলেটা রাগে খুব দ্রুত।এমনিতেই মৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে কষ্ট করে কলিংবেল বাজিয়েছে।তার উপর ভেতর থেকে কোন হা-হুতাশ নেই!দর্শন এবার উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে,
“জামিল চাচা!”
এই বাংলোর দায়িত্বে থাকা লোকটার নাম জামিল।বেচারা বিরক্ত মুখে ঘুমঘুম চোখে দরজার খুলতেই আসছিল।কিন্তু দর্শনের হুংকারপূর্ণ আওয়াজে পিলে চমকে উঠে তার।ধীরে ধীরে চালানো পায়ের গতি বাড়ে সহসা।দ্রুত এসে সদর দরজা খুলে সে।
প্রথমেই সালাম দেয় সে।দর্শন তার দিকে না তাকিয়েই সালামের জবাব দিয়ে বিরক্ত মুখে ভেতরে ঢুকে।
এত রাতে দর্শনের কোলে একটা মেয়ে খেয়াল করতেই চোখদুটো নিজের ভুড়ির মতো বড় হয়ে উঠে জামিলের।মুখটা হা হয়ে রসগোল্লায় সাইজ হয়।
কিছু কদম হেঁটেই বিচক্ষণ ভঙ্গিতে থামে দর্শন।তারপর ফিরে তাকায় জামিলের দিকে।দর্শনের এই এক চাহনিই যেন যথেষ্ট ছিল তার জন্য।বড় বড় হয়ে থাকা চক্ষু ও মুখ বন্ধ হয়ে আসে। দর্শনের দৃষ্টি সরু হয়।জামিলের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমি এখানে এসেছি আর আমার সাথে একটা মেয়ে আছে এই খবর যদি আমার বাপজান কিংবা এই বাংলোর বাইরে কোন কাকপক্ষীর কাছেও পৌঁছে তবে জামিল চাচা..”
এতটুকু বলে ঠোঁটের কোনে স্পষ্ট বড়সড় একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে দর্শন।এতটুকুই যেন যথেষ্ট ছিল জামিলের আত্মা শুকিয়ে আসার জন্য।তড়িৎ মাথা দুপাশে নাড়ে সে।যার অর্থ কেউ জানবে না।
দর্শন ঘুরে দাঁড়ায়। ফিচেল হেসে পা রাখে সিঁড়িতে।দোতলা বাংলোটায় খুব একটা আসা হয়না তাদের।এটা বছরভর খালিই থাকে।তবে জামিলের দায়িত্বে থাকায় ধুলোবালির আস্তরণ নেই।দর্শন একটা রুমে ঢুকে বিছানায় মৃত্তিকাকে শুইয়ে দেয়।তারপর গলার টাই খুলে বিছানার একপাশে রাখে।পাশেই একটা জগ দেখে সেটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে সে।বেসিন থেকে সামান্য পানি নিয়ে বিছানার নিকট এসে উপস্থিত হয়।উদ্দেশ্য অচেতন মৃত্তিকার জ্ঞান ফেরানো।পরপরই নিজের মত বদলায় দর্শন।এই মুহুর্তে সাবধানে সব করতে হবে।একটা ভুল পদক্ষেপ তার পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।পানি ভর্তি জগটা যথাস্থানে রেখে দর্শন বলে উঠে,
“থাক দর্শন।অচেতন বাঘিনীকে জাগিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে!”
.
তীব্র সূর্যারশ্মি চোখে মুখে আছড়ে পরতেই অচেতন মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরে।মুলত তার জ্ঞান আগেই ফিরেছিল।এতক্ষণ তন্দ্রায় মগ্ন ছিল রমনী।বিছানা জানালার সাথে লাগোয়া হওয়ায় পর্দা সরে গিয়ে ভেতরে আলো প্রবেশ করেছে।বেলা গড়িয়ে যাওয়ায় সেই আলোর তেজ প্রখর!যার দরুন তন্দ্রায় বিঘ্ন ঘটে মৃত্তিকার।ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালে আলো সরাসরি মৃত্তিকার অক্ষিকোটরে এসে ঠেকে।বাদামি বর্ণের চক্ষু মনিরা অদ্ভুত সৌন্দর্য পদর্শন করে তাতে।মস্তিষ্কে কালকে রাত্তিরের স্মৃতিরা হানা দিতেই তড়িৎ উঠে বসে মৃত্তিকা।অবাক হয়ে চারপাশে তাকায় সে।এই বিছানা,এই ঘর এমনকি জানালার বাইরে যতদূর অবধি দৃষ্টি যায় সবটাই অচেনা তার কাছে।আতংকে মাথা চেপে ধরে মৃত্তিকা।মনে পরে শেষবার দর্শন ছিল তার সাথে।দর্শনের কথা মনে পরতেই ঘৃণায় বিছিয়ে উঠে মৃত্তিকার মুখশ্রী।দুঃখে উষ্ণ তরল কপোল ছাড়িয়ে গলায় এসে পৌঁছায়।
মৃত্তিকা বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে দাঁড়ায়।দরজা খুলতে গিয়ে বুঝতে পারে বাইরে থেকে লক করা।জোরে জোরে দরজা ধাক্কায় সে।তীব্র আক্রোশ নিয়ে শুধু একটা কথাই বলতে থাকে,
“দরজা খুলুন!”
ধাক্কাধাক্কি করে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে রমনী।চোখে মুখে অসহায়ত্ব ছেঁয়েছে তীব্রভাবে।তখনই দরজা খোলার আওয়াজে তড়িৎ সেদিকে তাকায় মৃত্তিকা।কালো শার্টে মোড়ানো বলিষ্ঠ দেহ দৃষ্টিগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকে আসে মৃত্তিকার।উঠে দাঁড়ায় ধীরে সুষ্ঠে।হুংকার ছুঁড়ে চেনা যুবকটির উদ্দেশ্যে,
“কোথায় এনেছো তুমি আমায়?নিজের অপরাধ লুকানোর এত চেষ্টা তোমার?”
মৃত্তিকার মুখে তুমি সম্মোধনে ভ্রু উচায় দর্শন।পরপরই বড্ড আয়েশ করে বিছানায় এসে বসে।হাতে থাকা প্যাকেটটা বিছানার একপাশে রাখে যত্ন সহকারে।যেন এই রুমে সে ছাড়া আর কারো অস্তিত্বই নেই।দর্শনের এমন আচরণে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে।শাড়ির আঁচল সামলে দর্শনের পাশে এসে দাঁড়ায়।শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“আমি কিছু বলেছি তোমায়?তোমার কোন ধারণা আছে আমাকে না পেলে কি পরিমাণ চিন্তা করবে বাবা?
এবার মৌন দর্শন মুখ খুলে।বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
” ফারহাদ চৌধুরী জানে তার একমাত্র মেয়ে পার্টিতে বোরিং ফিল করে ট্রিপে চলে গেছে।”
“বাবা তোমার কথা কেন বিশ্বাস করবে?”
এবার দর্শনের কপালে ভাজ পরে।কন্ঠে চিন্তার রেশ নিয়ে সে বলে উঠে,
“সেটাই তো?উনি আমার কথা কেন বিশ্বাস করলো!”
দর্শনের আচরণে এবার গায়ে বহ্নি শিখা জ্বলে উঠে মৃত্তিকার।দর্শনের অতি নিকটে দাঁড়িয়ে বিছানায় বসে থাকা দর্শনের চোখের দিকে তাকায় মৃত্তিকা।সহসা দৃষ্টি মিলে দুজনার।মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
“কাল রাতে একটা খুন করে এতটা স্বাভাবিক আচরণ কিভাবে করছেন আপনি?”
দর্শন মৃত্তিকাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠে,
“বারবার আমার এত নিকটে আসাটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে তোমার? ”
চলবে…