#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা
১০.
চৌধুরী বাড়ি মানুষের গমগম করছে।চারপাশ ভরে উঠেছে মানুষের আফসোসসূচক ও দুঃখপূর্ণ কথাবার্তায়।
বিশাল ড্রয়িংরুমের মধ্যে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ইরফান চৌধুরীকে। পাশেই বসে চিরকালের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া মানুষটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা।যেন শেষ যাত্রার সমগ্র জীবনের জন্য বাবাকে দেখে নিচ্ছে সে।নিস্তব্ধ মৃত্তিকার অক্ষিকোটর শুষ্ক।বাবার করুন অবস্থায় যেভাবে কেঁদেছিল মেয়েটা!কিন্তু এখন জড়বস্তুর ন্যায় বসে একধ্যানে তাকিয়ে আছে ইরফান চৌধুরীর পানে।শুধুমাত্র চোখের পলক ফেলছে কিছু সময় পরপর।
অদূরেই এককোণে দাড়িয়ে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে দর্শন।মৃত্তিকার এমন নিস্তব্ধ,শান্ত প্রকৃতি দেখে ভেতরে ভেতরে সুক্ষ্ম ভয় হানা দিচ্ছে।ঝড় আসার পূর্বে বোধ হয় পরিবেশ এমনই নিস্তব্ধ,শান্ত থাকে?
মৃত্তিকা ধীরে ধীরে নড়ে উঠে।বাবার দিকে নিজের হাত বাড়াতে গিয়ে অনুভব করে অসম্ভব কাঁপন হচ্ছে তার হাতে।সময় নিয়ে নিজের নরম তুলতুলে হাতখানা ইরফান চৌধুরীর শক্ত,প্রৌঢ় হাতের মুঠোয় পুরে দেয় সে।শব্দহীন অশ্রু এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় মৃত্তিকার মসৃণ ফর্সা কপোল।বাবার হাত শেষবারের মতোন শক্ত করে ধরে মৃত্তিকা।তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য বরণ করে নেওয়া মানুষটার পানে তাকায় নরমভাবে।অনুশোচনা,অপরাধবোধ কি লেপ্টে ছিল সেই দৃষ্টিতে?হয়ত!
মৃত্তিকা খুব শান্ত করে শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করে।কিন্তু গলায় হরতাল লাগানো কান্নারা তার কন্ঠ ভিজিয়ে দেয়।মৃত্তিকা শান্ত ও ভেজা কন্ঠে ডেকে উঠে,
“বাবা!”
পুনরায় নীরব অশ্রু গড়ায় মৃত্তিকার বাদামী চোখ থেকে।
মৃত্তিকা ফের কাঁপা গলায় বলে উঠে,
“বাবা,এত অভিমান করলে আমার উপর?মেয়ের প্রথমবার করা ভুল ক্ষমা করতে পারলে না?আমাকে এভাবে একা করে চলে গেলে?আমার তো আর কোন আপন মানুষ থাকলো না!এতবড় দুনিয়া বাবা!আমি..আমি কিভাবে তোমাকে ছাড়া থাকবো?জন্মের পর মমকে হারানোর ব্যথাই তো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারলাম না।তুমিও মায়ের দলে যোগ দিলে?আমাকে একদম একা করে দিয়ে চলে গেলে বাবা!প্রেয়সীর সাথে সাক্ষাৎের এত তাড়া ছিল তোমার?তাহলে আমাকেও নিয়ে যেতে।আমাকে কেন রেখে গেলে বাবা?”
মৃত্তিকার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরছে অগুনতি অশ্রুর ধারা।সময় ব্যতিত হতেই অস্পষ্ট হয়েছে কন্ঠস্বর।দর্শন একদৃষ্টে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে।হঠাৎ দৃষ্টি সরায় সে।সেই ক্ষণে চোখ তুলে তার পাবে তাকায় মৃত্তিকা।শূন্য চোখে একপল তাকিয়ে ফের বাবার পানে তাকায় সে।এবার পরম যত্নে বাবার গালে হাত রাখে সে।যেমনটা ছোটবেলায় কোনকারণে বাবা রাগ করলে গালে ধরে বাবাকে মানানোর চেষ্টা করতো সে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা!প্লিজ!”
মৃত্তিকার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইরফান চৌধুরীর দুঃসম্পর্কের এক ভাই বলেন যে এখন দাফনের জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া উচিত।ইরফান চৌধুরীর খুব একটা আত্মীয় নেই।সেই হেতু উপস্থিত সকলে তার বিজনেস ফ্রেন্ড,পার্টনার ইত্যাদি।সকলে মিলে ইরফান চৌধুরীর দেহটাকে কাঁধে তুলার সময়ও চুপ ছিল মৃত্তিকা।বাধাহীন অশ্রু বইছিল তার নেত্র থেকে।অথচ মুখে টু শব্দ করেনি সে।বাড়ির সদর দরজা পার হওয়া অবধি সাদা বসনে আবৃত ইরফান চৌধুরীকে শেষবারের মতো দর্শন করে সে।কাঁধে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া লোকেরা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই উঠে দাড়ায় মৃত্তিকা।তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন মহিলা ছিল।আরো কয়েকজন আছে ড্রয়িংরুমে।সময় বাহিত হয়।সকলে বিদায় নেয়।ড্রয়িংরুমে কেবল উপস্থিত দর্শন,মৃত্তিকা ও রাফিন।দানিশ মির্জা এসেছিলেন।তিনি জানাযায় গেছেন।
ড্রয়িংরুম এখন প্রায় মানবশূন্য।মৃত্তিকা চোখ তুলে দর্শন ও রাফিনের দিকে চায় শক্ত গলায় বলে উঠে,
“তোমরা এখন যেতে পারো।আমাকে একা থাকতে দাও।”
মৃত্তিকার কথায় ভ্রু কুঁচকায় দর্শন।উঁহু!একদম নয়।এখন মৃত্তিকাকে একা ছাড়া উচিত হবে না।ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বের ন্যায় শান্ত মেয়েটা!একদম ভরসা হচ্ছে না তার।রাফিনকে ইশারায় প্রস্থানের আদেশ দিয়ে মৃত্তিকার পাশে এসে দাড়ায় সে।আচমকা বিমূঢ় হয়ে থাকা মৃত্তিকাকে কোলে তুলে নেয় দর্শন।আকস্মিক ঘটনায় বিস্ময় নিয়ে তাকায় মৃত্তিকা।পরপরই নিজেকে দর্শনের কোলে দেখে রাগ চাপে মস্তিষ্কে।দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিয়ে উঠে,
“তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে কোলে নেওয়ার?”
মৃত্তিকার কথায় পাত্তা দেয় না দর্শন।বাড়ির একজন মেইডের নিকট মৃত্তিকার রুমের সন্ধান নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে।পেছন থেকে ফ্যাল করে রয় রাফিয়া।এতবড় কাউকে কোলে নিতে দেখে বিস্ময়ে তার নেত্র প্রকট হয়েছে।
দর্শন দোতলায় পা রাখতেই মৃত্তিকা হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
“নামাও আমাকে দর্শন!ভুলে যেও না এসবের জন্য তুমি দায়ী।সো সিমপ্যাথি দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই।”
কথাটা বলেই দর্শনের বুকে জোরে একটা কিল বসায় মৃত্তিকা।রাগে,সদ্য পাওয়া দুঃখে তার চোখে ভরে উঠে।দর্শনকে এই মুহুর্তে তার বিষাক্ত লাগছে।
দর্শন মৃত্তিকার দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে একটা দরজার সামনে দাড়ায়।মৃত্তিকাকে প্রশ্ন করে,
“এটাই তোমার রুম?”
মৃত্তিকা মৌন রয়।তার মৌনতাকে সম্মতি ধরে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দর্শন।ঘরে প্রবেশ করতেই নামার জন্য ছটফট করে মৃত্তিকা।দর্শন গায়ের জোর না দেখিয়ে নামিয়ে দেয় মৃত্তিকাকে।ঘরটা বেশ অন্ধকার হয়ে আছে।ঘরের সব পর্দা লাগানো থাকায় বিশাল কক্ষে থাকা সামান্য আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে না।দর্শন সুইচবোর্ডে চাপ দিয়ে লাইট জ্বালায়।সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠে পুরো কক্ষ।দর্শন তাকিয়ে দেখে বেডের ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃত্তিকার অনেক ছবি ঠাঙানো।সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দর্শন স্বয়ং মৃত্তিকার দিকে তাকায়।শুভ্র সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা অগ্নিমূর্তি হয়ে।দর্শন ধীরে ধীরে এগোয় মৃত্তিকার পানে।মৃত্তিকা তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে উঠে,
“খুব ভালো লাগছে তোমার তাইনা?আমাকে এভাবে সম্পূর্ণ একা করে?”
দর্শন মৃত্তিকার অতি নিকটে দাড়ায়।মৃত্তিকার রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
“আমি তোমাকে একা ভাবছি না কেননা তোমার পাশে আমি আছি।নাও ইউ আর মাই ওয়াইফ!তুৃমি মানো বা না মানো।”
“ট্রাস্ট মি,স্বয়ং দূঃখ দিয়ে তাতে লেপ লাগাতে আসা মানুষদের আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি।সো কিপ ডিস্টেন্স ফ্রম মি।তিনবার কবুল বলেছি বলে তোমার সমস্ত অপরাধ মাফ করবো না।আমার পাশে তোমার ছায়া বড্ড পীড়া দিবে আমায়।”
তাদের কথোপকথনের মাঝেই একজন মেইড এসে খবর দেয় পুলিশ এসেছে।সাথে সাথে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে মৃত্তিকার।কোনরকম জানায় সে নিচে আসছে।
বাবার মৃত্যুর পরপরই পুলিশের আগমন বাড়িতে হবে এমনটা আশা করেনি মৃত্তিকা।ড্রয়িংরুমের সোভায় বসে থাকা এসপি মৃত্তিকার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করেন,
“এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি মিস মৃত্তিকা?”
দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে দর্শন বলে উঠে,
“সদ্য পিতৃহারা কাউকে মার্ডার সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাবাদ কি উচিত হচ্ছে?”
দানিশ পুত্রকে এখানে দেখে খানিক অবাক হন এসপি।পরপরই একগাল হেসে এগোয় দর্শনের দিকে।হ্যান্ডশেক করেন দু’জনে।দর্শনের মুখশ্রী গম্ভীর।মৃত্তিকা আড়চোখে তাকায় তাদের দিকে।এসপি সাহেব বলেন,
“কি করবো বলুন মিস্টার দর্শন?মিডিয়া প্রচন্ড গরম উপর থেকেও চাপ আসছে প্রচুর।তাই চৌধুরী কন্যা ফিরেছে শুনে দেরি না করে চলে এলাম।পাছে আবার গায়েব না হয়ে যায়!”
শেষ বাক্য দেওয়া সুক্ষ খোঁটাটা মৃত্তিকার গায়ে লাগে বেশ।তৎক্ষণাৎ মুখ খোলে সে,
“আর আপনারাদের মতো পুলিশদের বড্ড বেগ পেতে হয় এটা বের করতে যে মেয়েটা কেন গায়েব হলো!তাই না?”
কথা বলার ফাঁকে দর্শনের দিকে আড়চোখে তাকায় মৃত্তিকা।মৃত্তিকার করা সুক্ষ অপমান গায়ে লাগে এসপি সাহেবের।যেন এক্ষুনি মৃত্তিকাকে জেলে পুরতে পারলে ভালো লাগতো না।সদ্য পিতৃহারা মেয়ের এত তেজ ভালো লাগলো না তার।এমন খোঁটা তো প্রায় শোনেন তবে কি ইরফান চৌধুরীর ছায়া মাথা থেকে সরতেই মৃত্তিকার কথা বড্ড গায়ে লাগতে শুরু করেছে।
মৃত্তিকা ফের বলে,
“আমার পিএ এর মার্ডার কেস নিয়ে আমার থেকে বেশি মাথা আপনার ঘামানোর কোন প্রয়োজন নেই।কালকে আমি স্বয়ং পুলিশ স্টেশনে যাবো।এখন আপনি আসতে পারেন।”
“আপনাকে গ্রেফতার করার আদেশ আছে মিস মৃত্তিকা।মে আই!”
এতক্ষণ চুপচাপ থাকা দর্শন এবার এসপি সাহেবের নিকটে এসে দাড়ায়।নিচু স্বরে বলে উঠে,
“যার মাল খেয়ে আপনি এখানে মৃত্তিকাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন মৃত্তিকা তারই পুত্রবধু।এবার সাহস আছে তাকে গ্রেফতার করার?”
দর্শন তীক্ষ্ণ শান্ত চাহনিতে বুকে কাঁপন ধরে এসপি সাহেবের।দানিশ মির্জার দুজন ছেলের ক্ষমতা ও বেপরোয়াতা বেশ ভালো করেই জানেন তিনি।এদের শান্ত দৃষ্টিও যেন তার হাঁটু কাপাতে সক্ষম!
চলবে….