#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১২.
দর্শনের রুমে অনেকক্ষণ ধরেই কাচুমাচু হয়ে বসে আসে মৃত্তিকা।রুমের অবস্থা বড্ড শীতল!মৃদু কাঁপন ধরছে কায়ায়।ডিনারে যায়নি সে।যেখানে দীপনের ন্যায় পুরুষ থাকবে সেখানে মৃত্তিকার গলা দিয়ে খাবার নামা দুষ্কর!
তাকে দেওয়া কুপ্রস্তাবের ক্ষত এখনো বুকে তরতাজা।আর দর্শন? মৃত্তিকার মনে ঘৃণার সর্বোচ্চ স্থান ধারণ করেছে যে ব্যক্তি!মৃত্তিকা যাকে কবুল বলে স্বীকার করলো স্বামীরুপে।তাকে নিয়ে কি মনোভাব পোষণ করবে সে?দর্শন যেন গলার কাটা!যাকে গিলতে চেয়েও গিলা যায় না।আর উগলে ফেলা অসম্ভব!
ভাবনার মাঝেই দরজায় শব্দ হয়।ভেতরে প্রবেশ করে দর্শন।মৃত্তিকা চোখ তুলে তাকায়।দৃষ্টিতে অনাগ্রহ!
প্রথম দৃষ্টিতে নারী হৃদয়ে প্রেম পুষ্প জাগিয়ে তুলতে সক্ষম পুরুষ যে নিজ হাতে মৃত্তিকার হৃদয়ের সমস্ত আগ্রহ নাশ করেছে!
মৃত্তিকা খেয়াল করে দর্শনের হাতে ট্রে।তাতে সম্ভবত খাবার নিয়ে এসেছে।ঘরে থাকা ট্রি টেবিলের উপর সেটা রেখে এসে মৃত্তিকার নিকট দাড়ায় সে।গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“ডিনারে আসো নি কেন?”
চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে দর্শনের পানে তাকায় মৃত্তিকা।শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
“তোমার কি মনে হয়?তোমার আর তোমার ভাইয়ের সাথে একই টেবিলে বসে ডিনার করার রুচি আমার আছে?”
মৃত্তিকার শান্ত স্বরে করা অপমানটুকু শুনে দর্শন চোখ বুঁজে অন্য পাশে ঘাড় ঘুরায়।ফের সময় নিয়ে মৃত্তিকার দিকে চায়।রমনী শক্ত হয়ে বিছানায় বসে।হয়ত কিছু ভাবছে?
দর্শন মলিন হাসে।তারপর বলে,
“খাবারটা খেয়ে নাও।”
“খিদে নেই!”
“মিথ্যে বলো না মৃত্তিকা।সকাল থেকে কিচ্ছু খাও নি তুমি?”
মৃত্তিকা অন্যত্র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দর্শনের দিকে তাকায়।মেকি হাসি হেসে বলে উঠে,
“তোমার কি মনে হয় আমি খাবার খাওয়ার অবস্থায় আছি?
একটু থামে মৃত্তিকা।কন্ঠ খানিক শক্ত হয়।বলে উঠে,
” সদ্য অনাথ হওয়া মেয়ের খিদে না পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়!”
কথা বলার সময় অনাথ শব্দখানা জোর দিয়ে উচ্চারণ করে মৃত্তিকা।এখন তো সে অনাথই!মা নামক ভালোবাসা তো তার কপালে জুটেনি!আর এখন বাবা নামক দুনিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে চিরকালের মতো!
দর্শনের চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া হয় না মৃত্তিকার কথায়।সে ট্রে থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে মৃত্তিকার সামনে এসে বসে।চোখে মুখে গম্ভীর ভাব তার।তবুও শান্ত স্বরে বলে উঠে,
“বেঁচে থাকতে চাও তো?তোমার পিএ এর কিলার কে জেল পুরতে চাও নিশ্চয়ই।আর আমাকে অর্থাৎ যার জন্য তুমি তোমার বাবাকে হারিয়েছো তাকে তো ছাড়বেই নাহ!”
শেষোক্ত কথায় দর্শনের মুখ ভঙ্গি বদলে উঠে।কিছুটা বিষাদ কিংবা সুখ মিশানো কি তাতে?মৃত্তিকা বুঝতে পারে না।দর্শনের কথার জবাব দেয় তৎক্ষণাৎ।
“একদিন না খেলে কেউ মরে যায় না দর্শন।”
“ওকে!ইফ ইউ ওন্ট ইট,আই শেল ইট ইউ…জান!”
কথা শেষ করে ওষ্ঠে বাঁকা হাসির রেশ টানে দর্শন।তার কথা শুনে নেত্র প্রকট হয়ে উঠে মৃত্তিকার।ওষ্ঠদ্বয় নিজ শক্তিতে আলগা হয়ে আসে।মৃত্তিকার এমন চাহনি দেখে মনে মনে মজা লুটে দর্শন।ফিচেল হেসে বলে উঠে,
“ইউ নৌ আই হ্যাভ রাইটস অন ইউ!”
মৃত্তিকা পলকহীন চোখে দর্শনের পানে তাকিয়ে রয়।দৃষ্টিডে আশংকা এসে ভীড় করে।দর্শন হাতে থাকা ডিনারের প্লেট ট্রি টেবিলে রেখে এসে মৃত্তিকাকে নিজের দিকে টানে।অবাক বনে থাকা মৃত্তিকা এক লহমায় দর্শনের বুকে এসে আছড়ে পরে।দর্শন বলে উঠে,
“তুমি ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছো খাবে না।”
এটুকু বলে মৃত্তিকার কানের নিকট নিজের ওষ্ঠ নিয়ে আসে দর্শন।দর্শন নিঃশ্বাস মৃত্তিকার কর্ণে আছড়ে পরতেই শাড়ির আচল খামচে ধরে মৃত্তিকা।দর্শন সুক্ষ্ম হেসে ফিসফিসয়ে বলে উঠে,
“তবে আমি আমার কথা পূর্ণ করি!
লেটস…!মিসেস মেহের..অবিএসলি মাই জান!”
দর্শনের কথা শেষ হতেই আর্তনাদ করার মতো মৃত্তিকা বলে উঠে,
“খাচ্ছি আমি!”
তারপর একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে দর্শনের থেকে সরে গিয়ে দাড়ায়।ঠোঁট টিপে হাসে দর্শন।তারপর পাশ ফিরে তাকিয়ে দূঃখী চেহারা নিয়ে বলে,
“আমার দুর্ভাগ্য!”
.
নভেম্বরের মাঝামাঝিতেই ঠান্ডার আভাস পাওয়া যায়।মাঝরাত্রি থেকে পরা কুয়াশা শীতের আগমনী বার্তা দিতে থাকে।নটা,দশটা বাজতেই তবে সূর্যের তেজ এসে গায়ে লাগে।ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁইছুই হতেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরোয় দর্শন।গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসা মৃত্তিকাকে নজরে আসে তার।পরনে হালকা গোলাপি বর্ণের সেই শাড়ি।রেশমি কেশ বাঁধনহীন পিঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে।দর্শনের গাড়ির সামনে এসে নিঃশব্দে দাড়ায় মৃত্তিকা।গাড়ির গ্লাস নামিয়ে সানগ্লাস নাকের ডগায় এনে মৃত্তিকার দিকে তাকায় দর্শন।অপেক্ষা মৃত্তিকার মুখ থেকে কিছু শোনার।দর্শনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুখ খুলে মৃত্তিকা।ধীর কন্ঠে বলে,
“আমাকে আমার অফিসে ড্রপ করে দাও।”
দর্শন কিছু না বলে হালকা হেসে সামনে তাকায়।কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে মৃত্তিকা।একবার তাকায় আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত দর্শনের পানে।ফোল্ড করা হাতার দরুন ফর্সা ত্বক অপূর্ব লাগছে।আর তাতে কালো এক্সপেন্সিভ ওয়াচ হাতের সৌন্দর্য দ্বিগুন বারিয়েছে।সহসা দর্শনের কন্ঠ কর্ণগোচর হয় মৃত্তিকার।
“আমার দিকে এত গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাবেন না মেহেরজান।প্রেমে পরে যাবেন!যাকে শত্রু মনে করেন তার প্রেমে পরলে শত্রুতা বজায় রাখবেন কিভাবে?”
দর্শনের মুখে হঠাৎ আপনি সম্মোধনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মৃত্তিকা।দর্শন সামনে দৃষ্টি রেখে গাড়ির হুইল ঘোরাচ্ছে সন্তর্পণে।তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার মৃত্তিকাও সামনে তাকায়।মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে,
” শত্রুর প্রেমেও পরা যায়।কিন্তু যাকে ঘৃণা করা হয় তার প্রেমে পরা অসম্ভব।”
দর্শন মৌন রয়।মৃত্তিকার কন্ঠ কানে আসে আবার।এবার বোধয় মেয়েটা শক্তস্বরে কথা বলছে,
“আর কিভাবে বললে,কোন শব্দ ব্যবহার করলে তোমার মস্তিষ্কে এটা ঢুকবে যে আমি তোমাকে ঘৃণা করি?”
“তোমার ঘৃনাও একদিন ভাললবাসায় পরিনত হবে।কিন্তু এমন না হোক সেইদিন,সেইক্ষনে তোমাকে প্রচুর পস্তাতে হয়!”
দর্শনের কথার বিপরীতে তাচ্ছিল্য হাসে মৃত্তিকা।অনুভব করে চোখে অশ্রু প্রবাহ চিকচিক করছে।কি কারণে,কেন জানা নেই মৃত্তিকার।
অফিসের সামনে গাড়ি এসে থামতেই বিনাবাক্যে গাড়ি থেকে নামে মৃত্তিকা।তারপর একবারো পেছন না ফিরে দর্শনের দৃষ্টির বাইরে চলে যায় রমনী।পেছন থেকে দর্শন চেয়ে রয় পেয়েও না পাওয়া রমনীর ছন্দময় চলনের দিকে।সে দৃষ্টির অগোচর হতেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিজ গন্তব্যে রওনা হয় সে।
.
“আমাকে ক্যারেক্টারলেস বলে নিজেই মৃত্তিকাকে।জোর করে বিয়ে করে নিলি!তুই তো সেই খেলোয়াড় বের হলি!”
অফিস শেষে মৃত্তিকাকে আনার জন্য ডেইজি ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়েছিল দর্শন।কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারে মৃত্তিকা অফিস থেকে অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে।দর্শন ভেবেছিল হয়ত বাড়িতে গেছে।কিন্তু সেখানেও তাকে না পেয়ে পাগলপ্রায় দশা হয় তার।তিরিক্ষি মেজাজে বাড়িতে ফিরতেই দীপনের এমন কথা সম্মোখীন হয় দর্শন।যা তার মেজাজের দশা বেহাল করতে সক্ষম।ক্ষীপ্ত চোখে ফিরে তাকায় উপহাসের চোখে চেয়ে থাকা দীপনের দিকে।দর্শন খানিক এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
“মুখ সামলে কথা বলবি।”
দীপন ঠোঁট এলিয়ে হেসে উঠে।বলে উঠে,
“কেন?জ্বললো তোর?আসলে তোর থেকে ক্যারেক্টারলেস তো আমার ওই মেয়েকে মনে হয়।যেই বাপ টপকে গেল ওমনি তোর বউ হয়ে গেল!”
দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত চোখে তাকায় দর্শন।বাঘ শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পরার পূর্বমুহুর্তে যেমন দেখায় তেমন মনে হচ্ছে তাকে।
দর্শনের রাগে ঘি ঢেলে দিতে দীপন বলে উঠে,
“আমার কি মনে হয় জানিস?তুই যে বলেছিলি মৃত্তিকা টুরে গেছে!এটা নেহাতই বানানো কথা।নিশ্চয়ই তুই ওকে কোথাও রেখে ভোগ করে…!
দীপনের কথা শেষ হতে না হতেই দর্শন ঘুষি বসায় তার নাকে।আচমকা আক্রমণে পিছিয়ে যায় দীপন।হঠাৎ দর্শনের দৃষ্টি যায় সদর দরজায়।মৃত্তিকার ঘৃণ্য চাহনি সোজা এসে ভেদ করে দর্শনের দৃষ্টি!
চলবে..
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।