#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৫.
“ব্যাকডেটেড?তোমার মত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বের হয়ে থাকে না তাই ব্যাকডেটেড বলছো আমায়?”
মৃত্তিকার খোঁচা শুনে কটমট করে তাকায় শ্রেয়া।পরনের লেহেঙ্গাটা খাঁমচে ধরে রাগে।মৃত্তিকার ঠোঁটে তখন মিটিমিটি হাসি।আরশি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার শ্রেয়ার পানে তাকায়।শ্রেয়ার পরনে গাঢ় হলুদ রঙের লেহেঙ্গা।তার পুরো বাহু ও উদর উন্মুক্ত।শ্রেয়ার চোখেমুখে রাগের আভাস!অথচ মেয়েটাই প্রথম তাকে খোঁচাতে এসেছে।
“মুখ সামলে কথা বলবে মৃত্তিকা।”
“সেটা আপাতত পারছি না।আমি কোন নিরীহ প্রাণী নই যে তোমার সুক্ষ্ম অপমান শুনে চুউপ করে থাকবো।সরি আই কান্ট!”
কথাটুকু শেষ করে মৃত্তিকা একবার বেলকনিতে আসে।এই রুমের মালিক তার পছন্দ না হলেও তার ঘরের বেলকনি তার বেশ পছন্দ।বারান্দায় দাঁড়াতেই ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যায় মৃত্তিকাকে।আড়চোখে খেয়াল করে শ্রেয়া ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে প্রস্থান করেছে।মৃত্তিকা নিশ্চিত নিচে গিয়ে কোন প্যাঁচ কষবে বা তার নামে দীপনকে কিছু বলবে।
মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রয় ওই আঁধারে আচ্ছন্ন আকাশে।বাবার কথা বড় মনে পড়ছে তার।মৃত্তিকার জীবনের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তিনি।
“বাবা নিজে তো জান্নাতের মজা লুটছো!আর আমাকে এই জাহান্নামে একা রেখে গেলে?”
মৃত্তিকার কন্ঠে গাঢ় অভিমান।বুকে হাহাকার ভরা তার।হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে চোখের কোণে জমা অশ্রুকণা তড়িঘড়ি করে মুছে বেলকনি থেকে রুমে আসে মৃত্তিকা।দু-তিনজন মেয়ে এসেছে তাকে নিচে নিয়ে যেতে।মৃত্তিকা সকলের মুখপানে তাকায়।প্রত্যেকটা মুখশ্রী অপরিচিত তার নিকট!
মৃত্তিকা যখন ড্রয়িংরুমে পা রাখে তখন তার গমগম করছে মানুষে।আফটার অল দানিশ মির্জার দুই পুত্রের প্রি ওয়েডিং বলে কথা।
মৃত্তিকাকে নিয়ে শ্রেয়ার পাশে বসানো হয়।একটা সোফায় সে আর শ্রেয়া।তাদের পাশাপাশি একটু দূরত্বে অন্য সোফায় দর্শন ও দীপনের বসার কথা।কিন্তু দীপন সেখানে বসে থাকলেও দর্শন নেই।মৃত্তিকা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দর্শনকে খোঁজে।দরজার শেষপ্রান্তে মৃত্তিকার লেহেঙ্গার কালারের সাথে ম্যাচিং পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক দাড়িয়ে কথা বলছে কারো সাথে।মৃত্তিকার চোখ আটকায়।মুখশ্রী দেখা না গেলেও সে সিউর এটা দর্শনই।হঠাৎ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হয় দু’জনের।চট করে দৃষ্টি সরায় মৃত্তিকা।খানিক বাদে দর্শন এসে দীপনের পাশে বসে।যথারীতি হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
.
রাত্রি প্রায় বারোটা বাজতে চললো এমন সময় নিজ কক্ষে প্রবেশ করে মৃত্তিকা।সারা মুখে হলুদ লেগে যা তা অবস্থা হয়ে আছে।মৃত্তিকার মুখশ্রী থমথমে,কিঞ্চিত রাগে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে তার।রাগের কারণটা কে?দর্শন?উঁহু!শ্রেয়া শেখ।
ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে লাগাতার পানি দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে বেরোয় মৃত্তিকা।মুখ মুছে হাতের তোয়ালে ছুঁয়ে মারে বিছানায়।চোখ বুঁজে একটু আগে ঘটা ঘটনা স্মরণ করে সে।
সকলের হলুদ লাগানো শেষ হলে দোতলায় যাওয়ার জন্য দাঁড়ায় মৃত্তিকা।সারা মুখে হলুদের আস্তরণে খানিক জ্বালাপোড়া অনুভূত হচ্ছে তার।মৃত্তিকার হলুদে এলার্জি!
রুমে পৌঁছে মুখ ধুয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়িতে পা রাখতেই লেহেঙ্গায় কারো পা পরে।মৃত্তিকা তাড়াহুড়োয় বিষয়টা খেয়াল করেনি একদম।ফলস্বরূপ একপা সামনে এগোতেই ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নেয় সে।লেহেঙ্গায় পা দেওয়া ব্যাক্তি খুবই চালাকির সহিত সরে গেছে ততক্ষণে।মৃত্তিকার পায়ে হাইহিল থাকায় টাল সামলাতে সক্ষম হয় না সে।মৃত্তিকার সুক্ষ্ম চিৎকারে সকলের দৃষ্টি তার উপর।পরে যাওয়ার মুহুর্তে বলিষ্ঠ এক দেহ আঁকড়ে ধরে মৃত্তিকাকে।একটা পুরুষালি ঘ্রাণ এসে নাকে ঠেকে মৃত্তিকার।এই পুরুষালি ঘ্রাণের সাথে পরিচিত সে। মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পুরুষটিকে আঁকড়ে ধরে মৃত্তিকা।অস্ফুটস্বরে উচ্চারিত হয়,
“দর্শন..!”
মৃত্তিকাকে আগলে নিয়ে ভালোভাবে দাড়ায় দর্শন।মৃত্তিকার গালের হলুদ লেপ্টে গেছে তার পাঞ্জাবিতে।হৃদযন্ত্র চলছে দ্রুত গতিতে।আরেকটু হলেই বাজেভাবে পরে যেত দু’জনেই।সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকায় মৃত্তিকা।কানে এসে বাজে উল্লাসিত শব্দ।
দর্শনকে ছেড়ে আশেপাশে তাকায় মৃত্তিকা।
সিঁড়ির পাশেই শ্রেয়াকে চোখে পরে তার।তার দিকে তাকাতে দেখে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরায় শ্রেয়া।মৃত্তিকা শুধু মনে মনে হাসে।গাঢ় চোখে তাকায় শ্রেয়ার পানে।সেই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে মৃত্তিকার সাথে চালাকি সহজ নয়!সে সবটা বোঝে।তখন করা অপমানের প্রতিশোধ তাকে জনসম্মুখে ফেলে দিয়ে নিতে চাইছে শ্রেয়া?
“আমার সাথে শত্রুতা করার চেষ্টা করোনা শ্রেয়া।নয়ত সেই বিষাক্ত সম্পর্ক আমি এমনভাবে হৃদয়ে ধারণ করব যা তোমার কল্পনাতীত হবে!”
মৃত্তিকার মনে মনে বলা কথাখান শ্রেয়ার কান অবধি পৌঁছায় না।তার মুখশ্রীতে মৃত্তিকাকে জনসম্মুখে অপমান করতে না পারার আপসোস।
সম্পূর্ণ ঘটনা মনে করে রুদ্ধশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা।তখনই দরজায় খট করে শব্দ হয়।জনাব হাজির!
মৃত্তিকা কার্বাড থেকে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি বের করে।দর্শনের নিয়ে আসা সবই শাড়ি।সেলোয়ার-কামিজের দরকার ছিলো মৃত্তিকার।কপাল গুটিয়ে শাড়ি নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে মৃত্তিকা।
তাকে রেগেমেগে ওয়াশরুমে ঢুকতে দেখে কোমড়ে হাত রাখে দর্শন।আরশিতে নিজেকে দেখতে দেখতে বলে,
“কি ভাই আমাকে কি সুন্দর লাগছে না?একটাবার চোখ তুলে দেখলো না আমাকে আমার বউ!”
কথাটুকু শেষ করে দর্শনের মুখে দুঃখের ভাব ফুটে উঠে যেটা আসলে কৃত্রিম।সে জানে তাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।ফাংশনে উপস্থিত মেয়েদের চোখের তারায় ভাসছিলো তার প্রতিবিম্ব।শুধুমাত্র তার স্ত্রী একমাত্র মহিলা যার সময় নেই নিজের স্বামীকে প্রতক্ষ করার।
হাহ্!এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে টিশার্ট পরে সে।তার কিছুক্ষণ পরেই ওয়াশরুম থেকে বের হয় মৃত্তিকা।দর্শনের চোখ আঁটকায় খয়েরী রঙে আবৃত রমনীর উপর।সামনের চুলগুলো কিছুটা ভেজা মনে হচ্ছে। চোখের ঘন পাপড়িতে পানির কনা আঁটকে।দর্শনকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় মৃত্তিকা।রসকষহীন কন্ঠে উঠে,
“এমনভাবে তাকিয়ে থাকলে চোখ তুলে নিবো তোমার!”
ভয় পাওয়ার মতো করে তাকায় দর্শন।পরপরই উচ্চস্বরে হেসে উঠে।আশ্চর্য হয়ে তাকায় মৃত্তিকা।দর্শনের অভিব্যাক্তি কখনো বুঝে উঠে না মৃত্তিকা। মানুষটার এক্সপ্রেশন মুহুর্তেই বদলে যায়!
মৃত্তিকা বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
“হাসার মতো কোন কথা বলিনি আমি।”
“তো এটা কি কাঁদার মতো কোন কথা ছিল মিসেস?ছিলো?তবে আমার কেন হাসি পাচ্ছে?”
বুকে হাত গুঁজে ওষ্ঠে হাসি নিয়ে দর্শনের পানে তাকায় মৃত্তিকা।দর্শনের দৃষ্টি আটকায়।মৃত্তিকা বলে,
“হাসির কথা বলেছি?তো এখন একটা ব্যাড নিউজ শোনো।”
দর্শন ভ্রু উচিয়ে সুধায়।মৃত্তিকার মুখশ্রী শক্ত হয়।নাকের পাটা ফুলে উঠে,
“আই ওয়ান্ট ডিভোর্স!”
দর্শনের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে সহসা।কঠোর হয় মুখশ্রী।গাঢ় কন্ঠে সুধায়,
“হোয়াট ডীড ইউ সে?”
মনে মনে পৈশাচিক হাসে মৃত্তিকা।গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য বলে,
“তোমার সাথে সো কল্ড বৈবাহিক সম্পর্ক আমি আর বইতে পারছি না।এই সো কল্ড বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলেই ডিভোর্স দিবো আমি তোমায়।
বিছানায় বসা ছিলো দর্শন।তড়িৎ বেগে উঠে দাড়িয়ে মৃত্তিকার হাতের কবজি চেপে ধরে সে।দর্শনের হাতের চাপে সুক্ষ্ম আর্তনাদ করে উঠে মৃত্তিকা।দর্শনের দৃষ্টিতে তখন দুনিয়ার সমস্ত অগ্নি জমা হয়েছে যেন।দাঁতে দাঁত চেপে দর্শন বলে উঠেছে,
“বিয়েটাকে সো কল্ড মনে হচ্ছে তোমার?ডিভোর্স চাও?দুইদিন কি ভালো বিহেভ করেছি তোর সাথে আমাকে ভয় পাচ্ছিস না।এখনো ভদ্র স্বামীর মতো বিহেভ করছি বলে ভেবেছিস যা ইচ্ছে তাই বলবি!”
মৃত্তিকা বিস্ময় নিয়ে দর্শনের মুখপানে তাকায়।দর্শনের কপালের রগ ভেসে উঠেছে রাগে।মৃত্তিকার হাত ব্যথায় অবশ হওয়ার যোগাড়!অক্ষিকোটর পরিপূর্ণ হচ্ছে অশ্রুকণায়।ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,
“দর্শন ব্যাথা পাচ..”
মৃত্তিকাকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে ওষ্ঠে আঙুল চেপে ধরে দর্শন।বলে উঠে,
“তুমি বলেছিলে না আমি খুব খারাপ!লেট মি প্রুভ দিস।ট্রাস্ট মি আজকে তোমার বলা কথা তোমার উপর বেশ ভারী পরবে।”
কোমড়ে দর্শনের ছোঁয়া অনুভব করে মৃত্তিকা।ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে তা।মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
“দর্শন প্লিজ ছাড়ো আমায়!”
ফিচেল হাসি ফুটে দর্শনের ওষ্ঠে। মৃত্তিকার নাকে নিজের নাক ছোঁয়ায় সে।চোখ বুঁজে নেয় মৃত্তিকা।কর্ণগোচর হয় দর্শনের ফিসফিসয়ে বলা কথা,
“ইহজনমে নয়!”
চলবে….
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।