ফরগেট মি নট পর্ব-১৬

0
15

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৬.
সন্ধ্যাকালে যেমন ধরিত্রী হারায় অনামিশায়,তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময় পর কারো কারো জীবনে ঘনিয়ে আসে নিকষ অন্ধকার। যেখানে চোখের সামনে শুধু অনিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তা।

রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।আশেপাশের বিল্ডিং এর আলো নিভে গেছে বহু পূর্বেই।দর্শন-মৃত্তিকার কক্ষে অন্ধকার কাটিয়ে আবছা করে তুলেছে নীল রঙের ড্রিমলাইট।বিছানায় শক্ত হয়ে বসে আছে মৃত্তিকা।দৃষ্টি বিছানার ডার্ক কফি কালার বেডসেটে।দর্শন রুমে নেই।বারান্দায় বিচরণ নিঠুর মানবের।
মৃত্তিকার পরনের শাড়ি এলোমেলো,আঁচল ঠিক নেই।ঠোঁটদুটি রক্তাভ হয়ে আছে।কপোলে অশ্রুদের অবাধ চলাচল।
বারান্দায় অর্ধন*গ্ন শরীরে দাড়িয়ে আছে দর্শন।ডানহাতের দুআঙুলের মাঝে রাখা সিগারেটের দিকে একবার তাকালো সে।তারপর তাতে টান দিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করলো।দর্শনের বারান্দা আজ বহুদিন পর ভরে উঠলো নিকোটিনে।বহুদিন পর বিষাক্ত হলো তার ফুসফুস।
কিছুসময় পর রুমে পা রাখে দর্শন।বিছানার একপাশে মৃত্তিকাকে এমন পাথর বনে বসে থাকতে দেখে বক্ষস্থলে পীড়ন হয় তার।দৃষ্টি সরিয়ে হাত মুঠো করে নেয় সে।মেয়েটার নির্জীবতায় কি আজ তার করা নিঠুরতার প্রমান দিচ্ছে নাহ?মৃত্তিকার মনে নিজের জন্য জমে থাকা ঘৃনার পরিমাণ সর্বোচ্চ হয়ে গেছে তার নির্দিষ্টতা দাবী করছে না?

দর্শন থেমে যায়।এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না!মেয়েটার মনের সমস্ত ঘৃনার প্রলেপ মুছে দিয়ে তাতে প্রেমাঙ্কুর জগিয়ে তোলার কথা ছিল তো!তবে?কেন এই নিকষ,অবরুদ্ধ রাত্রি?
দর্শনের বুকের নিপীড়ন জোরালো হয়।মানব কি ভালোবাসে?মনের সাথে এমন আলোচনা তো কখনো হয়নি তার।তার ঘরনী,অর্ধাঙ্গিনী,বিদেশিনী কন্যাকে কি ভালোবাসে সে?অথচ মৃত্তিকাকে সে বিয়েতে বাধ্য করেছিল জেদের বশে!কিংবা?কিংবা কী?শুন্যস্থানে কি বসবে?

দর্শনের ধ্যানচুত হয় মৃত্তিকার কন্ঠস্বরে।

“দর্শন?ডু ইউ ট্রাস্ট প্রথম দেখায় কারোর প্রতি দিল খুইয়ে বসা যায়?

কথাটুকু শেষ করে মৃত্তিকা চোখ তুলে তাকায়।অক্ষিপটে অশ্রুর আনাগোনা থেমে গেছে আগেই।তবে এই দৃষ্টিতে কি আকুলতা!যেন হৃদয়ের সমস্ত দূঃখ লোচনে ফুটিয়ে তুলেছে রমনী।
দর্শন জোরে শ্বাস নিয়ে ঢোক গিয়ে।মৃত্তিকার দৃষ্টি তার হৃদয় এফোঁড়-ওফোড় করছে।দর্শনের মুখে উত্তর না পেয়ে হাসে মৃত্তিকা।সহস্র শতাব্দীর বিষাদ লুকানো যেন সেই হাসিতে।

“ব্ল্যাক শার্ট পরিহিত এক অচেনা যুবক।চোখে মুখে তাচ্ছিল্য,দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।আলাদাই এক সৌন্দর্য যুবকটির অবয়বে।বিশ বছরের স্বল্প জীবনীতে প্রথম আমার হৃদয় কম্পিত হয়েছিল তাকে দেখে।অথচ সময় যেতেই সেই পুরুষ বাজেভাবে মন ভাঙলো আমার!খুন করলো আমার অতিপ্রিয় এক নারীকে,আমার পিএ!”

দর্শন বিস্মিত চোখে তাকায় মৃত্তিকার দিকে।মৃত্তিকার দৃষ্টি আগে থেকেই তার উপর নিবদ্ধ ছিল।মৃত্তিকা একটা শুকনো ঢোক গিলে ফের বলতে শুরু করলো,

“যাদের আমরা ঘৃণা করি তারা বোধয় মেরে ফেলতে চাইলেও এতটা বিস্ময় আসে না।কিন্তু যাদের জন্য হৃদয়ে একবার প্রেমের সূচনা হয় তারা যখন প্রিয়জন ছিনিয়ে নেয় তখন মৃত্যুসম কষ্ট হয় জানো?ভালোলাগা সরাসরি ঘৃণায় পরিনত হওয়ার তীব্রতা বোঝ দর্শন মির্জা?”

বিরতি নিয়ে মৃত্তিকা আবার বলে,

“হয়ত তোমার আমার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হতে পারতো!হয়ত তুমি হতে পারতে আমার চোখে সেরা স্বামী!”

কথা শেষে তাচ্ছিল্য হাসে মৃত্তিকা।
হঠাৎ দর্শন বলে উঠে,

“আমি তৃষার মার্ডার করিনি মৃত্তিকা।”

শূন্য চোখে তাকালো মৃত্তিকা।তারপর বললো,

“দ্যান প্রুভ ইট।”

মৃত্তিকা উঠে দাড়ায় বিছানা থেকে।কাবার্ড থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে সে।
ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে দর্শন।দুহাত দিয়ে খামচে ধরে মাথার চুল।তারপর মাথা ঠেকায় বিছানায়।কি এক অসহ্য নিপীড়ন চালাচ্ছে তার হৃদয়!
মৃত্তিকা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে।চোখ উথলে জল গড়ায়।পানির কণার সাথে মিলেমিশে অস্তিত্ব হারায় তারা।মৃত্তিকার চাপা কান্না ওয়াশরুমের দেওয়াল ভেদ করে দর্শনের কানে যায় না।
.
সকাল হতে না হতেই তীব্র আওয়াজ ও ড্রয়িং রুমের চেচামেচিতে ঘুম ভাঙে মৃত্তিকার।চোখে তখনো রাজ্যের ঘুম।কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার যোগাড় নেই!ঘুম পরিপূর্ণ না হওয়ায় মাথায় হালকা ব্যথা হচ্ছে মৃত্তিকার।পাশে থাকা টেবিল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে ৯:৩০ বাজতে চললো।বিছানায় আর বসে না মৃত্তিকা।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখে দর্শনের মা রুমে দাড়িয়ে আশেপাশে দেখছে।মৃত্তিকা উনাকে দেখে মৃদুস্বরে সালাম দেয়।হেসে সালামের জবাব দেয় দর্শনের মা আলো শেখ।
মৃত্তিকা ওনাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

“আপনি দাড়িয়ে আছেন কেন?বসুন!”

“থাক আর বসছি না।অনেক কাজ পরে আছে।তোমাকে বিয়ের পোশাক দিতে এসেছিলাম।”
এতটুকু বলে একটু থামেন আলো শেখ।তারপর হাঁক ছেড়ে একজনকে ডাকেন।মিনিটের মাঝেই রুমে এসে উপস্থিত হয় দু-তিনজন মহিলা।তাদের হাতে বিয়ের লেহেঙ্গা,জুয়েলারি,দোপাট্টা।মৃত্তিকা একবার শুধু ঘিয়ে রঙের কারুকাজে ভরা লেহেঙ্গার দিকে তাকায়।তারপরই জোরপূর্বক হেসে আলো শেখের দিকে তাকান।আলো শেখ এসে মৃত্তিকার নিকটে এসে দাড়ায়।মৃত্তিকার থুতনিতে হাত দিয়ে ধরে একটু উঁচু করে বলেন,

“ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর হয়ে উঠবে।”

মৃত্তিকা কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রয়।জিনিসপত্র রেখে চলে যান আলো শেখ।তার কিছুক্ষণ পরেই রুম থেকে বের হয় মৃত্তিকা।পুরো বাড়িটাকে আবার নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে।মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে দর্শনকে খোঁজে।তাকে না পেলেও দূরে দাড়ানো রাফিনকে চোখে পরে তার।পেটের কাছের শাড়ির আঁচল ভালোভাবে ধরে মৃত্তিকা এগোয় রাফিনের দিকে।চোখেমুখে রাগের আভাস।রাফিনের সামনে দাড়িয়ে গম্ভীর আওয়াজে ডেকে উঠে মৃত্তিকা,

“মিস্টার রাফিন?”

নারীকণ্ঠ পেয়ে চমকে তাকায় কাজে ব্যস্ত থাকা রাফিন।মৃত্তিকাকে দেখে সালাম দেয় সে।তড়িঘড়ি করে সালামের জবাব দিয়ে বলে উঠে,

“আপনার স্যার কোথায়?”

রাফিন একবার মাথা ঘুড়িয়ে আশেপাশে দেখে।তারপর কিছু মনে পরার মতো করে বলে,

“ওহ!দর্শন স্যার একটু কাজে বাইরে গিয়েছেন।এসে যাবে..”

“আর ইউ লুকিং ফর মি মেহের..”

“ইয়াহ!আ’ম লুকিং ফর ইউ মাই পতি পরমেশ্বর!”

দর্শনকে জনসম্মুখে জান উচ্চারণ না করতে দিয়ে তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয় মৃত্তিকা।পরপরই নিজের বলা কথায় মনে মনে অস্বস্তি বোধ করে মৃত্তিকা।বদ্ধ রুমে একে অপরের সাথে ঝগড়া করেও জনসম্মুখে একেঅপরের মুখে কৃত্রিম চওড়া হাসি ফুটেছে।মৃত্তিকা দর্শনের নিকট এগিয়ে যায়।দর্শনের পরনে ডার্ক কফি কালারের শার্ট।ফর্সা দেহে রঙটা ফুটে উঠেছে চরমভাবে।পকেটে হাত ঢুকিয়ে মৃত্তিকার দিকে সামান্য ঘাড় বেকিয়ে তাকিয়ে আছে দর্শন।মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলে উঠে,

“আমি একবার বাড়ি যেতে চাই দর্শন।আমাকে নিয়ে যাও ওই বাড়িতে।”

দর্য়ন ভ্রু কুঁচকে শুধায়,

“আজকে?আজকে তো বিয়ে!”

“বিয়ে তো রাতে।আমি যেতেই চলে আসবো।দমবন্ধ লাগছে এখানে।প্লিজ!”

এভাবে মৃত্তিকার অনুমতি চাওয়া দেখে মৃদু হাসে দর্শন।তারপর একহাত দিয়ে মৃত্তিকাকে যাওয়ার পথ দেখিয়ে বলে,

“এজ ইউর উইশ ম্যাম!”

দর্শনের কথায় ফুরফুরে হাসি ফুটে মৃত্তিকার মুখে।পরপরই তা মিলিয়ে যায় বিষাদে।মৃত্তিকা এগিয়ে গেলে দর্শন পেছন পেছন যেতে যেতে বলে,

“আবার পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছো না তো?”

এক বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা জানায়,

“আপনার থেকে পালিয়ে কোথায় যাবো জনাব?”

উত্তরে কিছু বলে না দর্শন।বুকে অজানা পীড়ন হয়।এই স্বাভাবিক বাক্যালাপ সবই যে কৃত্রিম,লোক দেখানো!আচ্ছা মৃত্তিকা কি পারে না সব ভুলে গিয়ে তার সাথে এভাবেই পথ চলতে?সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি শেষ করে দর্শনের বাহুতে মাথা রেখে দুফোঁটা সুখের অশ্রু চোখের কোণে জমাতে পারে না?
হাহ!সবই দর্শনের ভুল ভাবনা।এ হবার নয়!এ হবার নয়!

চলবে…