#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৭.
গাড়ি চলছে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।দর্শন একহাতে বড্ড দক্ষতার সহিত গাড়ির স্টারিং ঘোরাচ্ছে।মৃত্তিকা চুপচাপ বসে।দৃষ্টি বাইরের বড় বড় বিল্ডিং,আপার্টমেন্ট অবলোকন করতে ব্যস্ত।মাঝরাস্তায় জ্যাম পরায় গাড়ি থামায় দর্শন।সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় মৃত্তিকার পানে।ঠিক ওই মুহুর্তে মৃত্তিকাও তাকায় তারদিকে।চোখাচোখি হয় দু’জনের অথচ চোখ সরায় না কেউই।মৃত্তিকার মতে যার সাথে প্রেমময় দৃষ্টিবিনিময় হয় না তার থেকে দৃষ্টি লুকানোরই বা কি আছে?আর দর্শন?
সহধর্মিণীর কাছ থেকে দৃষ্টি লুকানোর মত ভীতু সে নয়!দু’জনের দৃষ্টি তখন একে অপরের চোখে।দর্শন ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠে,
“সকলের সামনে আমার সাথে যে সুন্দর আচরণটা করো তা মন থেকে করতে ক্ষতি কি?”
প্রশ্ন শুনে দৃষ্টি সরায় মৃত্তিকা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
“যে মন তোমাকে শত্রু বলে ভেবেছে সে মন দিয়ে তোমার সাথে অকৃত্রিম সুন্দর আচরণ করা পসিবল না!”
“তুমি আমাকে শত্রু মনে করো আদোতে আমি তা নই।বুঝবে মিসেস দর্শন বুঝবে!কিন্তু সেদিন কি হবে কে জানে?এমন না হয় তখন আপসোসে পাহাড় গড়ে উঠে তোমার মনে।”
দর্শনের কথা শুনে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে মৃত্তিকা।যার অর্থ এ হওয়ার নয়!
গাড়ির জানালায় কারো টোকা পরায় মৃত্তিকা থেকে দৃষ্টি সরায় দর্শন।জানালার কাচ নামিয়ে বাইরে তাকাতেই জীর্ণকায় দেহের এক বালককে ফুল হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকা দেখা যায়।
“স্যার একটা ফুল লন।ম্যাডাম খুশি হইবো!”
দর্শন আড়চোখে একবার মৃত্তিকার পানে তাকায়।রমনী মায়াময় চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে।শীতের মৌসুমেও বালকের দেহে কেবল একটা সেন্টো গেঞ্জি! অথচ বয়সটা গরম পোশাক পরে স্কুলের মাঠে সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করার।
দরিদ্রতার ছোবল বুঝি এতই ভয়ানক!
দর্শন ছেলেটার হাতে থাকা ফুলের দিকে চায়। একতোড়া লাল টকটকে গোলাপ!
দর্শন ছেলেটিকে সবগুলো ফুল দিতে বলে।সারাদিনের ফুল এক লহমায় বিক্রি হয়ে যাওয়ায় ছেলেটার অধরে খুশির হাসি ছেঁয়ে যায়।খুবই যত্ন নিয়ে দর্শনের হাতে সবগুলো ফুল তুলে দেয় ছেলেটি।সুক্ষ্ম এক হাসি মৃত্তিকার অধরের দেখা যায় দু সেকেন্ডের জন্য।দর্শন ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার দুটো নোট বের করে ছেলেটাকে দেয়।ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে গেছে।দর্শন জানালার কাচ তুলতে তুলতে বলে,
“একটা জ্যাকেট কিনে নিও এটা দিয়ে।”
মৃত্তিকা মনেমনে প্রসন্ন হয় দর্শনের এই উদরতা দেখে।তারপরই বুকে জমে রয় দীর্ঘশ্বাস।অথচ লোকটার সমস্ত নিঠুরতা যেন তার জন্য বরাদ্দ!
দর্শন হাতের ফুলখানা মৃত্তিকার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“নিঠুর মানবের তরফ থেকে কোমল উপহার গ্রহণের অনুরোধ মেহের..জান!”
.
আজ বেশকয়েকদিন পর চৌধুরী বাড়িতে পা রাখলো মৃত্তিকা।যে বাড়িতে মৃত্তিকার শৈশব,কৈশোর ও যৌবনের প্রথমাংশ কেটেছে সেই বাড়িতে আজ সে কেবল অতিথি মাত্র।কিন্তু মৃত্তিকা এই কথায় বিশ্বাসী নয়!এই আলিশান বাড়িতে অধিকার কেবল তার।সেই এই বাড়ির মালিক।আর বাড়ির মালিক কখনো বাড়ির অতিথি হয় না।
আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে মৃত্তিকা ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝিতে এসে পরে।এই বাড়িতে এখন বাড়ির মেইডরা থাকে।মৃত্তিকা কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছে সবকিছু পরিষ্কার করে রাখতে।ড্রয়িংরুমে বসে রাফিয়া তখন টিভি দেখছিলো।কোন একটা সিরিয়াল চলছে তাতে।মৃত্তিকা বাড়িতে থাকাকালীন মেয়েটাকে তেমন দেখেনি।মৃত্তিকা দর্শনের কাছে বাংলোয় বন্দি থাকাকালীন কাজে ঢুকেছে রাফিয়া।হঠাৎ করে মৃত্তিকাকে নজরে আসে রাফিয়ার।তড়িঘড়ি করে টিভি অফ করে উঠে দাড়ায় সে।মৃত্তিকা তার দিকে একপলক তাকিয়ে সিঁড়ির কাছে যায়।দোতলায় পৌঁছে সবার প্রথমে বাবার রুমে ঢুকে পরে সে।
মৃত্তিকা চোখের আড়াল হতেই দর্শনকে নজরে আসে রাফিয়ার।সুন্দর ভঙ্গিতে হেঁটে আসা দর্শনকে দেখে থমকায় রাফিয়া।এত সুন্দর পুরুষ সে আজ অবধি দেখেনি।গায়ে শার্টটাও কি সুন্দর মানিয়েছে!
পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে নিজেকে সতর্ক করে রাফিয়া।মৃত্তিকা ম্যাডামের স্বামী নিশ্চয়ই উনিই!মৃত্তিকার স্বামী না হলে বোধয় সে প্রেমেই পরে যেত!
ড্রয়িংরুমে কিশোরী রাফিয়াকে ছাড়া কাউকে নজরে আসে না দর্শনের।হাতে থাকা গাড়ির চাবি পকেটে পুরে রাফিয়া দিকে এগোয় দর্শন।গাঢ়স্বরে প্রশ্ন করে,
“মৃত্তিকা কোথায় গেছে?”
“উ..উপরে।”
প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কন্ঠ কেঁপে উঠে রাফিয়ার।টিভিতে কত সুদর্শন নায়কের দেখায় কিনা দর্শন যেন তাদের থেকেও সুদর্শন!এমন একজন তার সাথে কথা বলেছে ভাবতেই যেন রাফিয়ার বুকের ধরফরানি বেড়ে যায়।
দর্শন উত্তর পেয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।পেছন থেকে রাফিয়া আবার বলে উঠে,
“ম্যাডাম হয়ত সাবের ঘরে গেছে।”
ফিরে তাকায় না দর্শন।আপন মনে সিঁড়ি একেকটা ধাপ পাড় করতে থাকে।
অনেকগুলো দিন পরে ইরফান চৌধুরীর ঘরে প্রবেশ করলো মৃত্তিকা।প্রতিটা কদমে কি এক অসহ্য যন্ত্রণা!
ঘরটার বিশাল খাট,বুকশেলফে সাজানো বই,লাগোয়া বড় বারান্দায় পিয়ানো রাখা।সবই তার নিজের জায়গায় আছে অথচ ঘরটার মালিক নেই!মৃত্তিকার অক্ষিপটে অশ্রু জমতে শুরু করে।ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে চায় নিজেদের অস্তিত্ব বোঝাতে।মৃত্তিকা বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। একটা টুল নিয়ে গিয়ে পিয়ানোটার সামনে বসে।মৃত্তিকাকে ইরফান চৌধুরী নিজহাতে পিয়ানো বাজানো শিখিয়েছেন।মৃত্তিকা একটু সময় নিয়ে একটা সুর তোলার চেষ্টা করে।পরপর কয়েকবার চেষ্টা করতেই সুরটা পার্ফেক্ট হয়ে আসে।তখনই পুরুষালি একটা কন্ঠ কানে এসে বাজে।গাঢ় স্বরে কেউ গেয়ে উঠেছে,
“Khune jigar maf kese karu?
Main bhul jau a bhi mumkin nahi!
Ek dil jo dard ka maara hain
Jo pass tha o sab haara hain
Iss bat ko koi jane na….”
সহসা পিয়ানোয় চলতে থাকা হাতটা থামায় মৃত্তিকা।তার শ্বাস-প্রশ্বাস অতিদ্রুত চলছে।বুকের ভেতর কেউ যেন ড্রাম পেটাচ্ছে।মৃত্তিকাকে থামতে দেখে বাঁকা হাসে দর্শন।সুদর্শন যুবক এসে দাড়ায় মৃত্তিকার মুখোমুখি।দর্শনের ছায়া এসে পরে মৃত্তিকার সুশ্রী মুখে।হঠাৎ এলোমেলো বাতাস এসে মৃত্তিকার এলোচুল বের করে আনে।মৃত্তিকা থমকায় আরেকদফা।তার বুক উঠানামা করছে দ্রুত।তার দৃষ্টি বাদামি পিয়ানোটায় নিবদ্ধ।
আচমকা দর্শন এলোচুল মৃত্তিকার কানের পিঠে গুঁজে দেয়।তারপর ভরাট স্বরে উচ্চারণ করে,
“Ek dusman janse peyara he?”
মৃত্তিকা এবার চোখ তুলে তাকায় দর্শনের দিকে।তারপর উঠে পরে বসা থেকে।রুম থেকে বের হতে হতে জানায়,
“তোমার বাড়ি ফিরবো!”
মৃত্তিকাকে এভাবে চলে যেতে দেখে উচ্চস্বরে হেসে ফেলে দর্শন।হাসতে হাসতে কোমড়ে দুহাত রেখে বলে উঠে,
“ভাঙবেন তবু মচকাবেন না ম্যাডাম!”
রুম ত্যাগ করার সময় ইরফান চৌধুরীর একটা ছবি চোখে পরে তার।ছবিটার নিকট একটু থেমে কন্ঠে দুঃখ নিয়ে দর্শন বলে,
“কি একখান মেয়ে জন্ম দিলেন আপনি!জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেললো আমার কোমল মনটাকে!”
.
সূর্য অস্ত গেছে!তার সাথে সাথে আরো ঝলমলে হয়ে উঠেছে দানিশ মির্জার অট্টালিকা।সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে সেজেছে সেথা।সন্ধ্যা গড়িয়ে একটু রাত হতেই বিয়ের তোড়জোড় গেছে যায় চরমভাবে।কাজি সাহেব এসে পৌছে গিয়েছেন সেই কবেই।এখন শুধু বর-বধুর আগমনের প্রতিক্ষা।
মৃত্তিকাকে সাজানো শেষ হতেই পার্লারের মেয়েরা বেরিয়ে পরে রুম থেকে।ফাঁকা পরিবেশে চোখ তুলে আরশিতে নিজেকে দেখে মৃত্তিকা।পরনে ঘিয়ে রঙের ভারী লেহেঙ্গা,দামি পাথরের জুয়েলারি!বুক অবধি দেওয়া পাতলা ঘোমটার আড়াল থেকে নিজেকে ভালো ভাবে দেখার চেষ্টা করে মৃত্তিকা।চোখে গাঢ় কাজল,নাকে বড় নথ,ঠোঁটে কমলারাঙা সাজ প্রসাধনী।মৃত্তিকা ঘোমটা উঠিয়ে নিজেকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করে তখনই একটা হাত এসে তাকে আটকে দেয়।মৃত্তিকা মাথা একটু উঁচু করে তাকায়।মিসেস দানিশকে দেখে পলক ঝাপকায় সে।ফের মাথা নিচু করে।মিসেস দানিশ মৃদুস্বরে বলে উঠে,
“ঘোমটা প্রথম তোমার বর খুলবে তোমাকে দেখার জন্য।এখন চলো নিচে যেতে হবে।তোমার বাড়ি থেকে তো কারোর আসার নেই আমিই তোমাকে নিতে আসলাম।এসো!”
মৃত্তিকা একবাক্যও ব্যয় না করে দর্শনের মার সাথে চলে।
ড্রয়িংরুমে এসে মৃত্তিকার চোখজোড়া একজোড়া চোখের সন্ধান করে।কাঙ্ক্ষিত সে জন তার দিকে অপলক চেয়ে।সোনালি পাঞ্জাবি,হাতে কালো ঘড়িতে কি সুদর্শন দেখাচ্ছে তাকে!মৃত্তিকা ঘোমটার আড়ল থেকে চেয়ে রয় ততক্ষণ অবধি যতক্ষণ না দূরত্ব কমে আসে।
মৃত্তিকা গিয়ে তার আসনে বসতেই দর্শনকে দেখা দুষ্কর হয়ে পরে।মাঝখানে বেলিফুলের ঝালর!সময় যেতেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে।দীপন বয়সে বড় হওয়ায় তার বিয়ে পড়ানো হয়।মৃত্তিকা তার পাশের ছোট সোফায় বসা শ্রেয়ার পানে তাকায়।তার ও শ্রেয়ার লেহেঙ্গার কালার একই।হয়ত ডিজাইনে কম-বেশ থাকতে পারে।
দীপন শ্রেয়ার বিয়া পড়ানো শেষ হলে কাজি দর্শন ও মৃত্তিকার বিয়ে পড়ানে আরম্ভ করে।তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!কাজি মৃত্তিকাকে কবুল বলার জন্য বলে।মৃত্তিকা থম মেরে তাকিয়ে রয় সামনের দিকে।কিছুক্ষণ ব্যয় হওয়ার পরও কোন শব্দ করে না মেয়েটা।
ওপাশে থাকা দর্শন ভ্রু কুঁচকায়।মৃত্তিকা কি লজ্জায় কবুল বলছে না?উঁহু!সে তে লজ্জা পাওয়ার মেয়ে নয়।তবে?
দর্শন মনে মনে বলে,
“এতগুলো লোকের সামনে আমার প্রেস্টিজ নষ্ট করার মতলব আঁটেনি তো?”
কিন্তু দর্শনকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে মুহুর্তেই মৃত্তিকা সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দখানা উচ্চারণ করে।কবুল!
চলবে….